0

রম্যরচনা - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in

রম্যরচনা


সীমানার ওপারে
দীপারুণ ভট্টাচার্য


দেশের সীমানা পেরিয়ে যাওয়াটা সব সময়ই বেশ রোমাঞ্চকর। সে হোকনা সবথেকে কাছের দেশে যাওয়ার মুহূর্ত। দেশ বিভাগের আগে আমার পূর্বপুরুষেরাও ছিলেন ওই অঞ্চলেরই বাসিন্দা। এখনও অনেক আত্মীয়তা রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আসলে বাংলাদেশকে সঠিক অর্থে বিদেশ ভেবে নেওয়া কঠিন। তবুও আন্তর্জাতিক সীমানা পেরিয়ে যাওয়ার মধ্যে রয়েছে কিছু নিয়ম নীতি। পাসপোর্ট ও ভিসা তার মধ্যে অন্যতম। খুব ছোটবেলায় কয়েকবার গিয়েছি সেখানে। তখন কতই বা বয়স! বোঝার মতো বয়স যখন হলো তখন আর যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। ওপারের আত্মীয়রা অবশ্য সঙ্গে মাঝে মধ্যে আসতেন এপারে। কখনও বা চিকিৎসার প্রয়োজনে, কখনও বিয়ের বেনারসীর কিনতে বা আরও অন্যান্য দরকারে। কয়েকবার তাদের আমি বর্ডারে আনতেও গিয়েছি। তাদের যাতায়াতের অভিজ্ঞতার গল্প শুনে বাংলাদেশ বর্ডার সম্পর্কে আমার সামান্য ধারণা হয়েছিলো।

বছর খানেক আগে অফিসে একটা পদ-পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আমি আসি আন্তর্জাতিক ব্যবসাতে। আর তখন থেকেই বাংলাদেশ হয়ে ওঠে আমার আরেকটি কর্মক্ষেত্র। এখন সেদেশে যাওয়াটা নিতান্তই পেটের দায়। কিন্তু কর্মসূত্রে যাওয়া তো, তাই প্রতিবারই বাংলাদেশ গিয়েছি বিমানে, ঢাকা হয়ে। সে অভিজ্ঞতা বেশ ভালো। তবে সেবারে কাজছিলো খুলনার আশেপাশে। তাই ঢাকা হয়ে যাওয়াটা বোকামি বলেই মনে হলো। কেননা দিল্লি থেকে ঢাকা হয়ে খুলনা যেতে যতটা সময় ও অর্থ ব্যয় হবে তার চেয়ে অনেক কম অর্থ ও সময়ে কোলকাতা হয়ে খুলনা পৌঁছনো সম্ভব বেনাপোল বর্ডার পেরিয়ে। এই পরিকল্পনা মতো বিধাননগর স্টেশন থেকে বনগাঁ লোকাল ধরে যখন বনগাঁ স্টেশনে পৌঁছালাম তখন বেলা দশটা বাজে। স্টেশন থেকে বর্ডার নয় কিলোমিটার। লাইন দিয়ে ক্রমাগত চলছে আটো রিক্সা। আটো যেখানে নামায় তার একশো মিটারের মধ্যেই ইমিগ্রেশন অফিস। আটো থেকে নামার সাথে সাথেই দালাল চক্রে ছেকে ধরলো। এ ছবিটা অবশ্য আমার অচেনা নয়। আসলে এরা সবাই এজেন্ট। এদের পরিষেবা এবং রেটও মোটামুটি বাঁধা। এপারে পাসপোর্ট পিছু একশো আবার ওপারে একশো। এপারের সব মানিকদেরই একটি করে জোড় রয়েছে সীমানার ওপারেও। এই দুইশো টাকার সেবাতে রয়েছে খানিকটা কুলিগিরি আর বাকিটা পূজা সামগ্রী। 

একটু খুলে বলা যাক। আসলে আমার মত অফিসের প্রয়োজনে এই পথে যাতায়াত করেন, এমন মানুষ নিতান্তই নগন্য। এই বর্ডার দিয়ে মূলত ওই পারের মানুষ ভারতে আসেন চিকিৎসার প্রয়োজনে, বিয়ে বা ইত্যাদির বাজার করতে এবং দেশ ভ্রমণে। এবাদে ছোট ব্যাবসায়ীরা বিভিন্ন মালপত্র এপার ওপর করেন। তাছাড়া চলে সরকারি পথে আমদানি রপ্তানি। এই পথে সাধারণত মানুষ প্রচুর মালপত্র ভারত থেকে বাংলাদেশ নিয়ে যায়। আর ওদেশ থেকে আসে জামদানি শাড়ি, টাঙ্গাইল শাড়ি ইত্যাদি। আর এই কারণেই এখানে কাস্টমস অফিসারদের রমরমা। আগে শুনেছি তারা সরাসরি টাকা নিতেন। কয়েক বছর হলো মাঝখানে এসেছে এই দালাল চক্র। কিভাবে? শুনুন তবে।

ধরা যাক আটো থেকে নেমে আপনি যে দালালকে বেছে নিলেন তার নাম পাঁচু। প্রথমে এই পাঁচু আপনাকে স্বযত্নে বসতে দেবে তার ছোট্ট অফিস ঘরে। হাসি মুখে খোশগপ্প করবে খানিক্ষণ। যাতে সীমানা পেরিয়ে যাওয়া সম্পর্কে আপনার মনে কোনো টেনশন না থাকে। এবার সে যত্ন করে চা খাওয়াবে যাতে ওপারে যাওয়ার আগে শরীরটা বেশ ঝর ঝরে লাগে। চাইলে দুয়েকটা মেরি বিস্কুটও পেতে পারেন। কিছু টাকা দিলে ফাইফর্মাস খাটা ছেলেটি এনে দেবে কচুরি তরকারি ও জিলিপি। বনগাঁ অঞ্চলের রসগোল্লা ও মাখা সন্দেশ কিন্তু অপূর্ব। কচুরি তরকারির পর পেটে জায়গা থাকলে কোন ভাবেই এই স্বাদ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা ঠিক নয়। আপনি যতক্ষণ প্রাতরাশে ব্যস্ত, পাঁচু ততক্ষণে মনযোগ সহকারে ভর্তি করবে ইমিগ্রেশন ফর্ম। এবারে একটা কুলি গোছের লোকের সঙ্গে আপনাকে পাঠিয়ে দেবে ইমিগ্রেশন অফিসে। বিদায়ের আগে অবশ্য সে বুঝে নেবে তার পাওনাটুকু। 

কুলিটি শ্রদ্ধা ভরে বইবে আপনার ব্যাগ খান। আর ইমিগ্রেশন বাবুর কাছে আপনার পাসপোর্টটি এগিয়ে দিয়ে বলবে, "পাঁচু দা"। তিনি তৎক্ষণাৎ ছাপ্পা মারবেন ফেরাবেন আপনার পাসপোর্ট খানা। আর সাদা কাগজে লিখে রাখবেন, "পাঁচু -১"। দিনের শেষে পাঁচু হিসাব পত্র সহ ইমিগ্রেশন বাবুর পূজা সামগ্রী পৌঁছে দেবেন নির্দিষ্ট মন্দিরে। মনে হয় এই বিষয়ে এদের বেশ সততা রয়েছে। তাই কুলি "পাঁচুদা" বললে ইমিগ্রেশন বাবু সন্দেহ প্রকাশ করেন না এ সত্যিকারের "পাঁচু" কিনা!

কিন্তু আমার কাছে রয়েছে Business Visa তাও আবার multiple entry। তাই "পাঁচুদা" চক্করে 'নৈব নৈব চ'। এই ভেবে দালাল চক্রকে বুড়ো আঙুলটি দেখিয়ে গট গটিয়ে চললাম ইমিগ্রেশনের অফিসের দিকে। প্রথমে ডলার পাল্টে বাংলা টাকা নিলাম। তারপর ফর্ম ভরে দাঁড়ালাম ইমিগ্রেশন লাইনে। আমার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে বাবু একটু করুণ মুখে বললেন, 'আপনি কি একা?'
- 'অফিসের কাজতো তাই একাই যেতে হয় স্যার।' কিঞ্চিৎ তির্যক ভাবে ছাড়লাম লেগ স্পিনটা। দেখলাম লেগে গেল। ঝপ ঝপ ছাপ মেরে পাসপোর্ট ফেরিয়ে একটু ঠোঁট উল্টে বললেন, আসুন তবে। 

ইমিগ্রেশন পেরিয়েই দেখি বিরাট লাইন। প্রথমে ভাবলাম ব্যাগ চেক হচ্ছে বোধ হয়। আমার পাশ দিয়ে কুলি সহযোগে পর পর বেরিয়ে যাচ্ছেন পাঁচুদা'র লোকেরা। একটু বাদেই বুঝলাম লাইনে আমার মতোই কিছু বোকা লোক দাঁড়িয়ে রয়েছেন। প্রায় আধা ঘন্টা লাইনে থাকার পর দরজার ভিতরে গিয়ে দেখি, X-Ray যন্ত্রগুলো বন্ধ আর লোকজনও কেউ নেই। বুঝলাম সঠিক অর্থেই দাঁড়িয়ে ছিলাম বোকার দলে। এবারে জোরে জোরে কয়েক কদম ফেলতেই দেখতে পেলাম প্রকৃত আন্তর্জাতিক সীমানা। পর পর দুটি বিরাট বিরাট লোহার গেট। এদিকে BSF আর ওদিকে BDR। তাদের পাসপোর্ট দেখিয়ে প্রবেশ করলাম বাংলাদেশের ভিতরে। এবারে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস। 

দেখলাম অফিস ঘরের সামনে কয়েকজন লোক নানান রকমের স্টিকার হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। বুঝলাম এরা এপারের মণি-মানিক্য। হতে পারে ওপারের পাঁচু'র দোসর এখানে নাসিম বা ইসমাইল। নামটা পাঁচুই বলে দেবে, আপনার কাজ শুধুমাত্র মনে রাখা। দেখলাম লোকেরা নাম বলছেন আর ছেলেটি তাদের বুকে বা কাঁধে লাগিয়ে দিচ্ছে স্টিকার। তাতে লেখা "ইসমাইল", "সত্তার" বা "রেজাউল"।
ছেলেটি আমাকেও করলো একই প্রশ্ন, 'নাম বলেন'? 
পিতৃদত্ত নামটি ছাড়া আমার আর বলার কি ছিলো! শুনে সে একটু থমকে গেল কিন্তু পথ ছাড়লোনা। 
- 'পাসপোর্ট টা দেন, কার সাথে যাবেন?'
এবার এগিয়ে গেলাম খানিকটা জোর করেই। কয়েক পা চলতেই বুঝলাম এপারে দালালের সংখ্যা ও প্রভাব ওপারের থেকে অনেক অনেক বেশি। কিন্তু আমিতো পণ করেছি একাই যাবো! তাই ফর্ম খুঁজতে লাগলাম। অদ্ভুত ব্যাপার হলো কোথাও ফর্ম খুঁজে পেলাম না। এমন সময় একজন এগিয়ে এসে একটা ফর্ম দেখিয়ে বলল, 'আপনারে কি ফরম খান ভৈরে দেবো?'
একটু গম্ভীর হয়ে বললাম, 'আমি নিরক্ষর নই ভাই। ফর্ম নিজেই ভরতে পারি।'
- 'ওঃ, ভরেন তাইলে। বলে একটা মুচকি হাসি দিলো সে।'
- 'দিন, একটা ফর্ম দিন।'
- 'যান যান ওই পুলিশের কাছে চান গে।' বলেই লোকটা অন্য মক্কেল ধরতে এগিয়ে গেল।
বুঝলাম এদের কাছে ফর্ম পাওয়া যাবে না। 

এবার পুলিশের কাছে গিয়ে ফর্ম চাইতেই তিনি পরিষ্কার ভাষায় বললেন, 'কিছু টাকা দেন, ফরম আমরা ভরে দিবানে।'
চোখে মুখে চূড়ান্ত বোকামির মুখোশ টেনে প্রশ্ন করলাম, 'আমি ফর্ম ভরলে কি আপনার অসুবিধা হবে?'
এই প্রশ্নের উত্তর মনে হল তক্ষুনি লোকটা দিতে চাইলেন না। মুচকি হাসি দিয়ে পাশের সহকর্মীটিকে বললেন, 'ও ভাই একটা ফরম দাও। এলোক নিজেই ভরবে বলতিছে।'

দেখলাম পাশাপাশি দুটো লাইন। কিন্তু কোনটা যে আমার জন্য সঠিক, ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে অন্য একজন পুলিশের কাছে গেলাম। তারও সেই এক প্রস্তাব। খানিকটা তর্কাতর্কি হয়ে গেল। এবার একজন সাধারণ যাত্রী এগিয়ে এলেন। ফিসফিস করে বললেন, 'আপনার Business Visa তাই, বেশি কিছু করবে না। তবে এদের সাথে মুখ না লাগানোই ভালো।'

অগত্যা ডান দিকের লাইনটাতেই দাঁড়ালাম। প্রায় আধাঘন্টা পর কাউন্টারে পৌঁছে বুঝলাম এই লাইনটা আমার জন্য সঠিক নয়। এবার বাঁদিকের লাইন দাঁড়াবার পালা। ওই পুলিশটি আমাকে দেখে যেন একটু মুচকি হাসলেন। বুকে ছাপ্পা মারা লোকগুলো একের পর এক বেরিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ বেরিয়ে যাচ্ছে সরাসরি বাংলা নোটের জোরে। দেখলাম আমার মতোই হতভাগ্য আরও জনা দুয়েক আছেন এই লাইনে। আমার আগে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি বৃদ্ধ মানুষ। সব চুল সাদা। বেশ দুঃখ করেই বললেন, 'আমার দাদা থাকেন যশোরে। ৫০ সালে সবাই ভারতে চলে আসি, সে আসেনি। আমি প্রতি বছর একবার তাকে দেখতে যাই। টাকা দিয়ে যাই না তো তাই এই রকম দেরি হয় প্রতিবার। কি করবো বলো, সামান্য একশো টাকা মন তবু সায় দেয় না। তবে অবস্থা আগের চেয়ে অনেকটা ভালো হয়েছে।'

পাসপোর্টে ছাপ মেরে সেই পুলিশটি বললেন, 'অকারণ দাঁড়ালেন ভাই।' কথা না বাড়িয়ে আমি চুপচাপ এগিয়ে গেলাম। এবার কাস্টমস। এখানে X-ray যন্ত্রটি চলছে কিন্তু সেদিকে দেখার কেউ নেই। ব্যাগ খুলে স্বচক্ষে দেখতেই এদের আগ্রহ বেশি। আমাকেও ব্যাগ খুলতে বলল একজন। মুখে একরাশ বিরক্তি টেনে বললাম, 'X-ray তে কি দেখলেন?' আমার কথায় অফিসার সম্পূর্ণ হতবাক, 'মানে?'
- 'মানে হলো, X-ray তে দেখার পর সন্দেহ হলে তবেই তো ব্যাগ খোলা, না হলে আর মেশিনটা রয়েছে কেন?'
তিনি পাশের জনের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'এ লোক তো ব্যাগ খোলবে না বলতিছে!'
এবার গলার জোর বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই বুঝলাম। পরিষ্কার প্রশ্ন করলাম, 'আপনি কি বাংলা ভাষা বোঝেন না?'

খানিকটা মজা লুটতে এবার উঠে এলেন এতক্ষণ উদাস নয়নে চেয়ারে বসে থাকা একজন কাস্টমস অফিসার, 'কি ভাই, বিষয় টা কি?'
হিন্দি ছবিতে CBI অফিসার সেভাবে তাদের কার্ড দেখান কতকটা সেই ভঙ্গিতেই পাসপোর্টটা তুলে ধরে বললাম, 'Business Visa তে আছি, ব্যাগ খুলবো না; খুললেও কিছু পাবেন না!'
হঠাৎ যেন সবকটা মুখ পানসে হয়ে গেল। একজন বলল, 'ঠিক আছে, ঠিক আছে ভাই, আপনি যান।'

এবারে একদম বাইরে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে এলাম বাংলাদেশের মুক্ত বাতাসে। কোথায়ও একটাও টাকা না দিয়ে আসতে পেরেছি ভেবে যখন ভেতরে ভেতরে বেশ গর্ব অনুভব করছি, ঠিক তখনই একটি বছর পঁচিশের ছেলে এসে দাঁড়াল পাশটিতে। ছেলেটি বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস এলাকা তে অনেক্ষণ ধরেই ঘোরাফেরা করছিলো লোক নিয়ে, অনেকবার চোখাচোখি হয়েছে। সে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, 'এসেই কটা টাকার দিলি, এতখুনে যশোর যেতি পারতেন। দশ মিনিটের পথ দুই ঘন্টায় পর হওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয় ভাই।' কথাটা বলে একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ছেলেটা চলে গেল। 

তার অযাচিত উপদেশ শুনে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এবার পিঠে কে যেন হাত রাখলেন। পিছন ফিরে দেখি লাইনের সেই বৃদ্ধ মানুষটি। 
- 'ভালোই ফাইট দিয়েছো ভায়া। তোমার মধ্যে আমার যৌবন দেখলাম যেন। যাকগে, যশোরে হয়েই তো খুলনা যাবে, এসো আমার সঙ্গে।'

সীমানার কোন্দল ভুলে এবার ফেরার পথে যাওয়ার পালা।



0 comments: