কৈশোরনামা - রাজীব চক্রবর্ত্তী
Posted in কৈশোরনামা
কৈশোরনামা
গবা পাগলার গল্প
রাজীব চক্রবর্ত্তী
ছেলেরা তখনো আসেনি। গবা মন্দিরের চাতালে বসে মাঠের দিকে চেয়ে একমনে কিছু একটা শুনছে। কিছুক্ষণ পরেই ছেলের দল হৈ হৈ করতে করতে এসে পড়ল। সবাইকে মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে হাতের ইশারায় বসতে বলল গবা। মাঠের একদম শেষ প্রান্তের বুড়ো বট গাছটার দিকে দেখিয়ে বলল, শুনতে পাচ্ছিস? ছেলেরা বলে উঠল, কোকিলের ডাক? গবা বলল ডাক নয়,গান। দু:খের গান। মনের ব্যথা গানের সুরে প্রকাশ করছে।
ছেলেরা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, কোকিলের আবার কিসের দু:খ? গবা হেসে উঠল। হাসি থামিয়ে ধীরে ধীরে বলল, কোকিল হলো স্বভাব শিল্পী। আর জাত শিল্পীর দু:খ থাকবেই। তোরা যে কোকিলের ডাক শুনছিস ওটা আসলে দুটো কোকিল। বর - বৌ দুজনে মনের দু:খে জঙ্গল ছেড়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে ঐ গাছে।
গল্পের গন্ধ পেয়ে ছেলেরা নড়েচড়ে বসল। গবাও শুরু করল, কোকিল দুটো থাকত দূরের এক জঙ্গলে। সকাল দুপুর সন্ধ্যে যখন ইচ্ছে হতো মনের আনন্দে গান গেয়ে বেড়াত। সারাদিন শিকার খুঁজে ক্লান্ত পশুরা যখন গাছের তলায় কিংবা জলার ধারে ঝোপে বিশ্রাম নিত, ভেসে আসা কোকিলের গান তাদের প্রাণ জুড়িয়ে দিত।
বনের রাজা সিংহমশাই বয়সের সাথে সাথে আয়েসি হয়ে পড়েছেন। সারাদিন গুহার মধেই বসে বসে ঝিমান। শিকার করতে বাইরে যান না। অবশ্য তার প্রয়োজনও পড়ে না। তার সবসময়ের সঙ্গী এক শিয়াল। সিংহের খাবার জোগাড়ের দায়িত্ব তার। ধূর্ত শিয়াল ছোট, বড়, মাঝারি যখন যেমন পশুকে সামনে পায় তার সাথে আলাপ জমিয়ে ভুলিয়ে নিয়ে আসে সিংহের গুহায়। সিংহ ওঁত পেতেই থাকে। এক ঝটকায় পশুটাকে কব্জা করতে তার বেশি সময় লাগে না। সিংহ মশাই পেট পুরে খেয়ে বাকিটা দিয়ে দেন শিয়ালকে। শিয়াল মরা পশুর দেহটা নিয়ে আসে তার মহল্লায়। তারপর শিয়ালের দল মহানন্দে খায় রাজার প্রসাদ। তাদের উল্লাসে নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে জঙ্গলের আকাশ বাতাস ভরে যায় হুক্কা - হুয়া শব্দে।
নিয়মিত ভাল মন্দ খাইয়ে শিয়াল তার দলের মাথা হয়ে উঠল। পশুরাজের সাথে দহরম মহরম থাকায় সবাই তাকে সমীহও করত। ক্রমে ক্রমে শিয়াল নিজেকে বনের রাজা ভাবতে শুরু করল। সবাইকে বলে বেড়াত রাজামশাই আমার কথা শুনেই কাজ করেন। বনের ভালমন্দ আমিই ঠিক করব। পশুরাজ সিংহের সাথে তার সম্পর্কের কথা ভেবে কেউ আর মুখ খুলত না। আর শিয়ালের দল তাকে নেতা মেনে মাথায় করে রাখত।
একদিন, সূর্য তখন মধ্য গগনে। শিয়াল দৌড়তে দৌড়তে এসে বসল একটা বড় গাছের ছায়ায়। ক্লান্ত হলেও মনে বেশ খুশি খুশি ভাব। একটা বুনো মোষের বাচ্চা পৌঁছে দিয়ে এসেছে সিংহের গুহায়। আজ সন্ধ্যের ভোজটা বেশ জমাটি হবে। এখন একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক - এই ভেবে চার হাত পা ছড়িয়ে গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে শরীর এলিয়ে দিল। চোখ বন্ধ করার আগে গাছের উপর দিকে তাকিয়ে দেখল কোকিল দম্পতি বসে আছে। মনে মনে ভাবল, ভালই হলো গান শুনতে শুনতে ঘুমানো যাবে। কোকিলদের দিকে মুখ করে বলল, দুজনেই আছিস দেখছি। একটা গান শোনা।
কোকিল জোড়া সকাল থেকেই মনমরা হয়ে গাছে বসে। ভোরবেলা দুজনে গিয়েছিল কাকের বাসায় ডিম পাড়তে। মুহূর্তের অসাবধানতায় ডিম মাটিতে পড়ে ভেঙে যায়। মনের দু:খে কোকিলরা ফিরে আসে। সারাদিন দুজনে খাওয়া দাওয়া করেনি, গান গায়নি। শুধু চুপ করে বসে আছে গাছের ডালে। শিয়ালের কথায় তারা বেশ বিরক্ত হলো। তবু মুখে কিছু বলল না। শিয়াল যথেষ্ট ক্ষমতাশালী। হয়ত পশুরাজকে বলে তাদের বন থেকেই বের করে দেবে। শান্ত স্বরে তারা বলল, মাফ করো শিয়ালদাদা। আজ মনমেজাজ ভাল নেই। গান গাইতে বোল না। একটা ব্যঙ্গের হাসি হেসে শিয়াল বলল, তোদের আবার দু:খ কি রে? খাচ্ছিস দাচ্ছিস আর গান গেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। গান শুনিয়ে আনন্দ দেওয়াই তোদের কাজ। শ্রোতারা আনন্দ পেলেই তোর গানের সার্থকতা। দেরি করিস না। ধর একটা মিষ্টি দেখে গান। কোকিলরা অনেক অনুনয় বিনয় করল - আজ থাক দাদা। অন্য একদিন তোমায় শুনিয়ে দেব। আজ ছেড়ে দাও। শিয়ালও ছাড়ার পাত্র নয়। আমি গান শুনতে চেয়েছি এটা তোদের সৌভাগ্য। শিয়ালের কথায় কোকিলদের শিল্পী অভিমান জেগে উঠল। তারা আরো জোড়ালো স্বরে বলল, না। ক্রমে বাদানুবাদ তীব্র হলো। শিয়াল হুমকি দিল, তোদের ভাল হবে না। শেষবার বলছি - গান গাইবি কিনা বল? কোকিলরাও গলা উচিয়ে জবাব দিল, আমরা কারো মর্জির গোলাম নয়। একথা বলে তারা উড়ে গেল অন্য গাছে। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে কি যেন চিন্তা করল শিয়াল। তারপর উঠে দৌড়ল জলার পিছনে শিয়াল মহল্লার দিকে।
পরের দিন ভোরবেলা কোকিল দুটো আবার ফিরে এল বড় গাছে। বসন্তের দখিণা বাতাস বইছে। চারিদিক শান্ত। তখনো বনের জন্তুরা জাগেনি। মনের দু:খ অনেকটা সামলে নিয়েছে কোকিল দম্পতি। গলা ছেড়ে তারা গান ধরল - বহে দখিণা পবন / হলো ব্যাকুল মন ...
হঠাত্ দেখে দলে দলে শিয়াল এগিয়ে আসছে গাছের দিকে। গাছের নিচে শিয়ালের দল গোল হয়ে বসল। গানের তালে তালে মাথা দোলাতে লাগল ডাইনে বায়ে। কোকিলরা খুব খুশি। শিয়ালটা খারাপ নয় মোটেও। সবাইকে তাদের গান শুনতে পাঠিয়ে দিয়েছে। মনের দু:খ ভুলে আরও উত্সাহ নিয়ে গাইতে লাগল তারা। কোকিল দম্পতির দ্বৈত সঙ্গীতে আকাশ বাতাস ভরে উঠল। ভুল ভাঙল একটু পরেই। গান যখন জমে উঠেছে শিয়ালের দল একসাথে চিত্কার করে উঠল। হুক্কা হুয়া ডাকে আকাশ বাতাস ভরে গেল। কোকিলের গান গেল থেমে। গান থামতেই শিয়ালদের চিত্কারও বন্ধ হয়ে গেল। একটু পরে তারা গান ধরতেই আকাশ বাতাস জুড়ে আবার হুক্কা হুয়া ডাক। কোকিলরা শিয়ালের ফন্দি বুঝতে পারল। তাদের বিরুদ্ধে সব শিয়ালদের লেলিয়ে দিয়েছে সিংহরাজার চামচা। কোকিলরা উড়ে গিয়ে বনের শেষপ্রান্তে পাহাড়ের দিকে চলে গেল। দৌড়ে এল শিয়ালদের সর্দার । খুশিতে ডগমগ হয়ে মুখে করে আনা বনমুরগীটা সবার সামনে রেখে বলল, তোরা আমার মান রেখেছিস। গাছের ডালে একটা বাঁদর বসে পিঠ চুলকাচ্ছিল। শিয়ালের ইশারায় নেমে এল গাছ থেকে। বাঁদরের কানে কানে কিছু একটা বলে শিয়াল হেলে দুলে চলে গেল ঝোপের দিকে।
পরের দিন সকালবেলা। পাহাড়ের থেকে আসা ঠান্ডা হাওয়া শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে। পাহাড় চূড়ার আড়াল থেকে সুয্যিমামা তার নরম আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে গাছের মাথায়। বুড়ো বট গাছের ডালে বসে কোকিল যেই না গান ধরেছে - প্রভাত রবি জাগাল প্রাণে .... কোথা থেকে বাঁদরটা এসে হাজির। কোকিল গলা সপ্তমে তুলে তখন গাইছে, ভোরের আলো ঘুচিয়ে দিল .... বাঁদর গাছের ডাল ধরে দোল খেতে লাগল। কোকিল যে ডালে বসে গান গাইছিল, তার উপর লাফাতে লাগল। গান গেল থেমে। বাঁদর খ্যাঁক করে হেসে গা চুলকাতে লাগল। কোকিল বুঝে গেল এও শিয়ালের চাল।
ধীরে ধীরে কোকিলের গান গাওয়াই মুশকিল হয়ে উঠল। গান ধরলেই হয় শিয়ালরা এসে হল্লা করে নয়তো বাঁদরের দল এসে হুটোপাটি করে। নিঝুম রাতে যদি কখনো পুকুর পাড়ের গাছে বসে গান গায়, নিমেষের মধ্যে ব্যাঙের দল ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ শুরু করে দেয়। হতাশ কোকিল গান গাইতে না পেয়ে ছুটল সিংহরাজার কাছে।
সব শুনে সিংহ ডেকে পাঠাল শিয়ালকে। গুহা কাঁপিয়ে হুংকার ছেড়ে শিয়ালকে বলল, তোমায় গান শোনায়নি বলে কোকিলের পেছনে লেগেছ? ভেবেছ কি? তোমায় ভালবাসি বলে যা খুশি করে বেড়াবে? এক থাবড়ে ধড় থেকে মুন্ডু আলাদা করে দেব।
শিয়াল মাথা চুলকে বলল, অপরাধ নেবেন না মহারাজ। আসলে কোকিল গান ধরলেই তার মধুর গান শুনে অন্য জীবজন্তুদেরও গান গাইতে ইচ্ছে হয়। তখন তারা কোকিলের সাথে গলা মেলাতে চেষ্টা করে। সিংহ জানতেও পারল না শিয়ালের ফন্দির কথা। কেশর ঝাঁকিয়ে বলল, আমার রাজ্যে সবাই সমান। সকলেই যাতে গান গাওয়ার সমান সুযোগ পায় তার ব্যবস্থা করো।
বড় একটা সেলাম ঠুকে সিংহের গুহা থেকে বেরিয়ে শিয়াল মনের আনন্দে গান ধরল। মহারাজ তাকে অনেক বড় সুযোগ করে দিয়েছেন। কেউ বুঝতেও পারবে না, অথচ কোকিলদের গান গাওয়া চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।
সবাইকে গান গাওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য শিয়াল একটা সভা ডাকল। সব পশুপাখিদের সিংহের আদেশ জানিয়ে দিয়ে বলল তার পরিকল্পনার কথা। প্রত্যেক পশুপাখির জন্য আলাদা আলাদা সময় নির্দিষ্ট থাকবে। সেই সময়ের বাইরে কেউ গান গাইতে পারবে না। ভোরবেলা গান গাইবে মুরগির দল। তারপর একে একে কুকুর, গরু -মোষ আর ছাগলেরা। একটু বেলায় হাঁসেরা গান গাইবে। আর রাত্রে গান শোনাবে ব্যাঙের দল। শিয়াল জানত সন্ধ্যেবেলা পশুপাখিরা বিশ্রাম করতে করতে কোকিলের গান শোনে। তাই সন্ধ্যেবেলা গান গাওয়ার সুযোগ দিল শিয়ালের দলকে। আর কোকিলের গান যাতে কেউ শুনতে না পারে তাই তাদের জন্য বরাদ্দ করল দুপুরবেলার সময়।
দুপুরবেলা কারোর সময় নেই। সবাই ব্যস্ত খাবারের সন্ধানে। ফলে কোকিলের গান শোনার জন্য বনে শ্রোতা প্রায় নেই বললেই হয়। দু' একটা বৃদ্ধ আর অসুস্থ পশু যাদের শিকার করার ক্ষমতা নেই, কিংবা পশু পাখীদের ছোট ছোট ছানারাই ছিল কোকিলের শ্রোতা। শ্রোতার অভাবে কোকিল গান গাওয়ার উত্সাহ হারাল। শিয়ালের কথা অনুযায়ী কে কখন গান গাইবে তা নাকি রাজার আদেশেই ঠিক হয়েছে। রাজার আদেশ অমান্য করার উপায় নেই। কোকিল আর কি করে! অভ্যেস বজায় রাখার জন্য অল্পক্ষণ গান গেয়েই থেমে যায়।
সপ্তাহ দুয়েক পরেই পরিস্থিতি বদলে গেল। কোকিল দেখল ধীরে ধীরে শ্রোতা বাড়ছে। একটা দুটো করে সব ধরণের পশুই হাজির তার গান শুনতে। কেবল শিয়াল আর বাঁদর ছাড়া। আসলে সন্ধ্যেবেলা সারাদিনের খাটুনির শেষে বিশ্রামের সময় শিয়ালের গান শুনে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। শান্তির আশায় তারা শুনতে চাইত কোকিলের গান। তাই নিজেরাই ব্যবস্থা করে নিল নিজেদের মতো করে। সব কাজ ফেলে দুপুরে কয়েক ঘন্টার জন্য ফিরে আসত নিজেদের ডেরায়। কোকিলের গান শুনতে শুনতে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বেড়িয়ে পড়ত শিকারের সন্ধানে।
কয়েক দিন পরের ঘটনা। তখন বেলা প্রায় বারোটা। সিংহের জন্য পশুর জোগাড় করে উঠতে পারেনি শিয়াল। দূর থেকে একটা গাধাকে দেখতে পেয়ে ছুটল তার দিকে। কিন্তু হায়! অনেক চেষ্টা করেও গাধাকে ভুলিয়ে সিংহের গুহার দিকে নিয়ে যেতে পারল না। খাবারের লোভ দেখিয়েও লাভ হলো না। গাধা শুধু বলে সকাল থেকে অনেক পরিশ্রম হয়েছে। এখন গাছতলায় বসে কোকিলের গান শুনে প্রাণটা আগে জিরাবো তারপর অন্য কথা। শিয়াল পড়ল ফ্যাসাদে। কোকিলের গান গাওয়া বন্ধ তো হলোই না, তার উপর সিংহের জন্য দুপুরে পশু পাওয়াই মুশকিল হলো। ধীরে ধীরে অনেক পশুপাখিই দুপুরবেলা জড়ো হতে লাগল কোকিলের গান শুনতে।
শিয়াল রেগে গেলেও কিছু করতে পারল না। তার বানানো নিয়মের জালেই আজ সে বন্দী। একটা ব্যাপার বুঝে গেল কোকিলকে গান গাইতে দিলে অন্যদের গান আর কেউ শুনবে না। অথচ কোকিলকে জব্দ করার জন্য শিয়াল চায় অন্য পশুপাখিদের দিয়ে নিজের ইচ্ছামতো গান গাওয়াতে। ধূর্ত শিয়াল ফন্দি আঁটতে লাগল।
দুষ্টের ছলের অভাব হয় না। আর ছলনা সব সময়ই আসে সুন্দর সাজে। শিয়াল কয়েকদিন পরে সব পশুপাখিদের ডেকে ধন্যবাদ জানাল। বলল, বনে এমন সুশৃঙ্খলভাবে সবাই শিল্প চর্চা করছে দেখে পশুরাজ খুব খুশি হয়েছেন। আগামী দিনে আরো অনেক পশু-পাখী, কীট-পতঙ্গ সঙ্গীত চর্চায় এগিয়ে আসবে বলে তার বিশ্বাস। বনের শিল্প-সংস্কৃতির মান বাড়ানোর জন্য সিংহ মশাই শিয়ালকে সভাপতি করে এক কমিটি তৈরী করে দিয়েছেন। নিজেকে সভাপতি ঘোষণা করে শিয়াল গর্বের সাথে লেজ নাড়িয়ে উঠল। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠল, এবার একটু কাজের কথা হোক। সবাই নড়েচড়ে বসল। নিশ্চয়ই কোন মতলব আছে। বিনয়ের সাথে শিয়াল বলল, এই একমাসে আপনারা সবাই নানা ধরণের গান শুনিয়ে আমাদের আনন্দ দিয়েছেন। সবাই আরো ভাল গান করুন। একটা বিষয়ে আশা করি আপনারা একমত হবেন - কোকিলের থেকে ভাল গায়ক এই বনে আর নেই। ব্যাঙ যদিও আগের থেকে অনেক উন্নতি করেছে তবুও কোকিলের মতো এখনো গান গাইতে শেখেনি। গানের কিছুই না বুঝলেও গম্ভীর গলায় শিয়াল বলতে লাগল - রাত্রে যখন ঘুম আসে না তখন ব্যাঙের গান পারে না ঘুম এনে দিতে। কিন্তু কোকিলের বেহাগ, মাল্লার, ভৈরবী শরীর মন শান্ত করে ঘুম এনে দেয়। তাই অনেক ভেবে আমি ঠিক করেছি এখন থেকে দুপুরবেলা ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ করবে ব্যাঙ আর রাত্রে গান গেয়ে আমাদের ঘুম পাড়াবে এই বনের শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী কোকিল। শিয়ালের কথা শুনে কোকিলের চোখমুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
রাত্রিবেলা সবাইকে গান শোনাতে পারবে ভেবে কোকিল খুব খুশি। এইবারও ধরতে পারল না শিয়ালের চাল। কয়েক দিন পর বুঝতে পারল কেন শিয়াল এত প্রসংশা করে তাকে রাত্রে গান গাইতে পাঠিয়েছে! একটা দুটো গান গাইতে না গাইতেই কোকিলরা দেখে বনের বাসিন্দারা ঝিমোচ্ছে। চারটে বড়জোর পাঁচটা গানের পর সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। বাঘমামা গুরর্ - গুর - ফরাত্ করে বিকট শব্দে নাক ডাকতে শুরু করে। হতাশ কোকিল গান থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে। ধীরে ধীরে কোকিলরা বুঝল দুপুরবেলা কিছু শ্রোতা থাকলেও, রাত্রে তাদের গানের শ্রোতা প্রায় নেই। হতাশ কোকিল দম্পতি মনের দু:খে গান গাওয়া প্রায় ছেড়েই দিল। দিনে দিনে হয়ে গেল মনমরা। কয়েকদিন পরে কোকিলরা বুঝল গান ছাড়া তারা বেঁচে থাকতে পারবে না। আর বনে তাদের গান গাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। নিরুপায় হয়ে কোকিল জোড়া অনেক দু:খে বন ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে মাঠের ধারের ঐ গাছে। এই পর্যন্ত বলে গবা থামল।
গাছের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে গবা বলল, তোরা কোকিলের গান শোন আমি চলি। চাতাল থেকে নেমে গবা গুনগুন করতে করতে হাঁটা লাগাল - যতদিন প্রাণ, ততদিন গান ...।
0 comments: