ছোটগল্প - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
তামাশা
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
নেশার ঘোরে বিরজু জুয়াখেলায় যে কি ডাক হাঁকছিল, সে নিজেই জানে না। ডাক দিচ্ছে আর হেরে ভূত হচ্ছে। লখিরামের তাতে খুব আনন্দ। খুচরো পয়সাগুলো দুহাতে কুড়িয়ে নিচ্ছে, যেন হরির লুটের পয়সা। যত পারো তুলে নাও। না, বেশী টাকা নিয়ে ওরা জুয়া খেলে না। একটাকা, দু’টাকার খুচরো করে, তাই নিয়ে সন্ধ্যায় জুয়ার আসর পাড়ে। সঙ্গে তাড়ি। লখিরাম দু এক চুমুক দেয়, বাকিটা বিরজু একাই সাবাড় করে। খেলে তো ভারি দুটো-তিনটে টাকা নিয়ে, লেকিন চাল দেখো ইসকো, একদম রাজাবাবু মাফিক ! গলায় দু ঢোঁক পড়ল তো একেবারে বাদশা, শাহেনশা। কে বলবে তখন যে বিরজু হল এ তল্লাটের নর্দমা পরিষ্কার করার জমাদার। বাপরে! উসকো কিছু বোলবে, তো মারতে আসবে!
লখিরামও এই সুযোগটা নেয়। আজকেও তার ব্যতিক্রম হল না। যে কটা টাকা খুচরো করেছিল বিরজু, তার সবটা লখিরাম জিতে নিল। পয়সাগুলো গুটিয়ে তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল লখিরাম। বিরজু তখন মহানিদ্রায় মগ্ন। লখিরাম উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই বনোয়ারী সামনে এসে হাজির। চোখের ইশারা করল বিরজুকে দেখিয়ে। লখিরাম পা দিয়ে বিরজুকে একটা ঠেলা দিল তারপর ওর দিকে তাকিয়ে মাটিতে থুক্ করে থুতু ফেলল---মর গয়া, শা লা!’
(২)
ঘুমটা যখন ভাঙ্গল বিরজুর, তখন মাঝরাত। এক চিলতে খাপরার ঘরের উঠোনে প্রকান্ড এক বটগাছের তলায় সে চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে। এই বটগাছের তলাতেই ওদের বসার ঘর, খাবার ঘর, জুয়ার আসরের জায়গা, গরমের দিনে ফুরফুরে হাওয়ায় এখানে বসেই ধনিয়ার সঙ্গে দুটো সোহাগের কথা...সব। চোখ কচলে উঠে বসার চেষ্টা করতেই গায়ের উপর থেকে চাদর পড়ে গেল। অল্প একটুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল বিরজু। তারপর যেন সব মনে পড়ে গেল। কে তাকে গায়ে চাদর দিল? কথাটা মনে হতেই তড়াক্ করে উঠে বসল বিরজু। ধনিয়া...সেই তাকে গায়ে চাদরটা ঢেকে দিয়ে গেছে। লেকিন, ধনিয়া কোথায়? ‘আরে..., এ ধনিয়া!’ জোরে ডাকার চেষ্টা করল বিরজু কিন্তু কিছুটা নেশার পর ঘুম ভাঙ্গার কারণে আর কিছুটা ধনিয়ার ভয়ে গলা দিয়ে সেরকম আওয়াজ বার হল না। গতকাল, মাত্র গতকালই ধনিয়ার সঙ্গে ঝগড়া, একেবারে হাতাহাতি বলা যায়। মারমুখী হয়ে উঠেছিল ধনিয়া।–পি ব, তো দূর ভাগ্! ইতনা পিবে তো নাই থাকব। দারুবাজ কঁহিকা...! না দানাপানি, না কুছ...খালি দারু, খালি দারু। ভাগ যাব, নহি রহনা হ্যায় মেরেকো...ছিঃ’ ঘেন্নায় মাটিতে থুতু ফেলেছিল ধনিয়া। চলে যাবে সে। কেন থাকবে? কি দেয় তাকে?
--আরে...যা যা! কঁহা যাইব, হ্যায় কোই আপনা?’ হ্যা হ্যা করে হাসতে হাসতে ঝগড়া করে বিরজুও।
পালটা জবাব ধনিয়ারও---হাঁ আছে। এই দুনিয়ায় কি কেউ নেই নাকি? ইঁট ভাটাতে কাম করবে, ঘর বানাবে। ভাগ যাবে সে। দারুবাজের সঙ্গে আর নয়। বার করে দেবে ঘাড় ধরে। বেইমান !! মনে পড়তেই উঠে দাঁড়াল বিরজু। একবার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল, দেখতে পেল না ধনিয়াকে। ঘর খালি। বাইরে এসে আকাশের দিকে একবার তাকাল। রাত তখনও অনেক বাকি। এত রাতে গেল কোথায়? তবে কি বনোয়ারী, লখিরামের সঙ্গে ওদের বাড়ি গেছে? লখিরামের বৌয়ের সঙ্গে ভারি ভাব ধনিয়ার। ওই বৌটাই যত নষ্টের গোঁড়া। সব ধনিয়াকে মন্তর দিচ্ছে। মনে মনে একটা খারাপ গালি দিল বিরজু। রাগে-দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করল। আর কোনদিন সে নেশা করবে না। মা কি কসম্... ধনিয়া কি কসম্! দরজায় গোড়ায় বসে রইল বিরজু সারারাত।
(৩)
পরের দিন সকালেই বস্তিতে গোলমাল। ধনিয়া বস্তির ধারে বড় নর্দমার পাড়ে বসে মাথায় হাত দিয়ে কপাল চাপড়াচ্ছে আর কাঁদছে---আরে, কোই উঠাও উসকো...উ তো মরিয়ে যাবে। আরে, কোই উঠাও... বিরজু...এ বিরজু...তু মরনা নহি রে...বিরজু...’ নর্দমা পরিষ্কার করার জমাদার বিরজু নিজেই বড় নর্দমার ভিতর আধ শোয়া হয়ে পড়ে আছে। আকন্ঠ তাড়ি গিলে নেশায় একেবারে টইটম্বুর। নর্দমার জল বয়ে যাচ্ছে শরীরের উপর দিয়ে। মাঝে মাঝে বিড় বিড় করছে---ধনিয়া..., তু মত্ যা রে, উ শালা লখিরাম কি অউরত কে পাস.....সব পয়সা লে লিয়া রে... তু মত্ যা রে...’ বলেই ভেউ ভেউ করে কান্না...। ধনিয়ার চীৎকারের সঙ্গে বিরজুর কান্না মিলেমিশে এক। যেমন নেশা না করলে ওদের মিলমিশ হয়ে থাকে, ঠিক তেমনি...!
নর্দমার দুপারে বস্তির লোকের ভিড়, তামাশা দেখছে। ইয়ে দুনিয়া ভি অজীব... !
এক নিঃশ্বাসে পড়লাম। একরাশ ভলোলাগা।
ReplyDelete