0

প্রবন্ধ - সবর্না চ্যাটার্জ্জী

Posted in



প্রবন্ধ


বিষয় যখন কেক 
সবর্না চ্যাটার্জ্জী 


কদিন হলো শীতটা একটু জাঁকিয়েই পড়েছে। জম্পুই শীতে কম্পুই দিতে দিতে আমরাও বেশ হাত পা সেঁকে নিচ্ছি নরম রোদের আলতো আরামে। মনটাও এখন তরতাজা ফুরফুরে। চারদিকে শুধু চড়ুইভাতি, হুটহাট বেড়িয়ে পরার চিন্তা আর পিঠেপুলি খাইখাই, কেকের গন্ধে শীতের মরসুম একদম রমরমিয়ে চলছে। সামনে আবার আসছে বড়দিনের ছুটি। বড়দিন মানে ক্রিসমাসের এই সময়টা কেক ছাড়া খাদ্যরসিক আমরা আর কিছু ভাবতেই পারিনা। 

তবে যিশুর জন্মদিনের কোন নির্দিষ্ট ডেট বাইবেলে নেই| তাই কবে সেলিব্রেশন হবে তাই নিয়ে প্রথম দিকে বেশ মতভেদই ছিল| কেউ বলেন ২৫শে মার্চ প্রথম মা মেরি জেনেছিলেন যে তাঁর কোলে আসছে একজন বিশেষ সন্তান| তার ঠিক ৯ মাস বাদে ২৫শে ডিসেম্বর তাই যিশুর জন্মদিন পালিত হয়| আবার অনেকের মতে য্যুইশ ফেস্টিভ্যাল হানুক্কার সময়ের সাথে মিলিয়ে যিশুর জন্মদিন পালন হয় ২৫শে ডিসেম্বর| 

প্রথম ক্রিসমাস পালিত হয় রোমান সম্রাট কনস্টানটাইনের আমলে ৩৩৬ খ্রীস্টাব্দে| ক্রিসমাসে কেক খাওয়ার প্রচলন অবশ্য আরো পরে| ক্রিসমাসের আগের দিন উপবাস করার নিয়ম ছিল| উপবাস ভাঙ্গা হতো প্লাম পরিজ খেয়ে| 

এরপর পরিজ বানানো শুরু হয় ড্রাই ফ্রুটস দিয়ে| ক্রমশ মশলা‚ মধু সহযোগে পরিজ হয়ে ওঠে ক্রিসমাস পুডিং| ১৬ শতকে ওটমিলের বদলে ময়দা‚ চিনি আর ডিম দিয়ে তৈরী করা হয় সেদ্ধ প্লাম কেক| অপেক্ষাকৃত ধনী ব্যক্তিদের কাছে আভেন থাকতো| তাঁরা ইস্টারের কেকের স্টাইলে ড্রাই ফ্রুটস আর প্রাচ্যের মশলা ব্যবহার করে বানাতে শুরু করেন আজকের দিনের প্রচলিত ক্লাসিক ক্রিসমাস কেক| 

কালের নিয়মে ক্লাসিক ক্রিসমাস কেকের অনেক ভ্যারিয়েশন এসেছে| লাইট‚ ডার্ক‚ ময়েস্ট‚ ড্রাই‚ হেভি‚ স্পঞ্জি| কয়েকটা পপুলার ভ্যারিয়েশন হলো--হ্যুইস্কি ডান্ডি, অ্যাপল ক্রিম কেক, মিন্সমিট কেক ইত্যাদি। 

তবে ক্রিসমাসে কেকের আসল মজা অন্যত্র| সব ক্রিসমাস কেক ই বানানো হয় অনেক আগে| অনেকে এক মাসের ও বেশি আগে কেক বানিয়ে এয়ার টাইট ক্যন্টেনারে উল্টো করে রেখে দেন| এর পর প্রতি সপ্তাহে কেকের মধ্যে ঢালা হয় অল্প পরিমাণে ব্র্যান্ডি‚ শেরি বা হ্যুইস্কি| এই ভাবে 'ফিড্' করা কেক স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় হয়ে ওঠে ক্রিসমাস আসতে আসতে| 

এ তো গেল শুধু ক্রিসমাস কেকের গল্প। আজকে বরং একটু উঁকি দেওয়া যাক, কেকের আবিষ্কারের ইতিহাসের পাতায়। 

কেকের ইতিহাস খুঁজতে হলে উল্টেপাল্টে দেখতে হবে প্রাচীন পুঁথিপত্র। বর্তমানে আমরা যে খাদ্যবস্তুটিকে কেক বলে চিনি, শুরুতে তার রূপ ছিল সম্পূর্ণ আলাদারকম। সেগুলি দেখতে অনেকটা রুটির মত হলেও কেকগুলি মিষ্টি স্বাদের করার জন্য মধু মেশানো হতো। বাদাম ও ড্রাইফ্রুট মাঝেমধ্যে মেশানো হতো। খাদ্য ঐতিহাসিকদের মতানুসারে, প্রাক্তন ইজিপ্টিয়ানরা সেসময় অ্যাডভান্সড বেকিং পদ্ধতি রপ্ত করেছিলেন। ইংরাজি অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী, ১৩দশ শতাব্দীতে কেক শব্দটি প্রকাশ্যে আসে। পুরানো নর্স শব্দ কাকা থেকে কেক শব্দের উৎপত্তি। 

Medieval European bakers যে ফ্রুটকেক ও জিনজারব্রেড বানাতেন তা বহুমাস রাখা যেত। 

খাদ্য গবেষকদের মতানুসারে, আজকের এই অত্যাধুনিক গোলাকার আইসিং কেকের প্রথম জন্ম হয় ইউরোপে। সময়টা ছিল ১৭ শতকের মাঝামাঝি। সাধারণত কেক তৈরীর উপযুক্ত ওভেন, মোল্ড ও উপকরণ হিসাবে বিশুদ্ধ চিনির উপলব্ধতা এই আবিষ্কারকে অগ্রসর হতে সাহায্য করে অনেকটাই। 

সেইসময় সাধারণত গোলাকার কেক মোল্ডটিকে একটি ফ্ল্যাট বেকিংট্রেতে বসিয়ে ওভেনে বেক করা হতো। এগুলি তৈরী হতো প্রধানত কাঠ, কোন বিশেষ প্রকার ধাতু বা কাগজ দিয়ে। 

কেকের ওপর প্রথম আইসিং হিসাবে ব্যবহৃত হয় চিনি ও ডিমের সাদা অংশটির সাথে বিশেষ সুগন্ধি মিশিয়ে ফোটানো একটি মিশ্রণ। এটি এরপর কেকের ওপর ডেলে দিয়ে অল্পকিছু সময়ের জন্য পুণরায় ওভেনে রাখা হতো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠান্ডা হওয়ার পর, কেকের আইসিং কভারটি বরফের মত চকচকে ও কঠিন হয়ে যেত। সেসময়ও অনেক কেক তৈরী হতো যেগুলিতে বেশকিছু ড্রাইফ্রুট দেওয়া হতো। 

মনে করা হয়, ১৯শতকের মাঝামাঝি সময়েই কেক নিজের বর্তমান রূপ পায়। অর্থাৎ উপকরণ হিসাবে এক্সট্রা রিফাইন ময়দা, বেকিং পাওডারের ব্যাবহার শুরু হয়। বিংশ শতক থেকেই পুরানো আইসিং পদ্ধতির বদলে বাটার, ক্রিম, পাওডার্ড চিনি বা আইসিং সুগার এবং বিভিন্ন ফ্লেভার ব্যবহার করে বাটারক্রিম তৈরী করে তার দ্বারা কেক কভার করা শুরু হয়। 

ফ্রান্সের Antonin Careme [1784-1833] কে 

কেক বা পেস্ট্রি ওয়ার্ল্ডের প্রধান ঐতিহাসিক সেফ বলে মনে করা হয়। French culinary ইতিহাস বইতেও তার সম্বন্ধে জানা যায় অনেক কথা। 

কেক, ব্রেড কিংবা বিস্কুট তৈরীতে খুব বেশি পার্থক্য না থাকায় সাধারণত ব্রেড বা রুটিকেই এদের জন্মদাতা বলা যেতে পারে। যদিও বেকিং ও ফার্মেন্টেশনের পদ্ধতি, খাওয়ার পরিবর্তিত প্যাটার্নের ওপর ভিত্তি করে কিছু ব্রেডের নামকরণ করা হয়। 

কিছু রোমান ব্রেড আছে কেকের মতই, যাতে ডিম, বাটার ব্যবহৃত হয়। 

ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার কিছু স্থানে যেখানে ইউরোপীয় প্রভাব খুব বেশি ছিল সেটিই কেকের প্রধান কেন্দ্রস্থল বলা চলে। 

যদিও কন্টিনেন্টাল ইউরোপিয়ান gateau(ফরাসি শব্দ) এবং torte(জার্মান শব্দ) এও বেশি পরিমাণে বাটার, ডিম, চকোলেট দেওয়া থাকত তবুও ওগুলোকে কেকের চেয়ে পেস্ট্রি বলাই বেশি যুক্তিযুক্ত। 

মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের দুটি ভিন্ন আইটেম যেমন বাবা এবং ইস্টার কুলিচও কেকের চেয়ে সামান্য আলাদা। 

বহমান সভ্যতায় সবকিছুর মতই কেকও ক্রমশ জায়গা দখল করল পাশ্চাত্য থেকে এশিয়ার মাটিতে। জাপানে ছোট স্পঞ্জকেকগুলো kasutera নামে পরিচিত ছিল। আবার ফিলিপাইন এর মুনকেক ও রাইসকেকও বেশ খ্যাতি অর্জন করে সেসময়। 

সুইস হ্রদের গ্রামগুলিতে কেক তৈরীর উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হতো অসমানভাবে ভাঙা দানাশস্য। সেগুলিকে জমিয়ে গরম পাথরের ওপর রেখে বেক করা হতো। 

১৯ শতকে কেক তৈরীর পদ্ধতিতে নতুন দিগন্ত খুলে গেল। ১৮৪০সালে বেকিং পাওডারের আবিষ্কার কেক তৈরী আরও সহজ করে দিল। সোডা বাইকার্বোনেট একটি মৃদু অ্যাসিডের কম্পোজিশনে বেকিংপাওডার নামক এই যৌগটির আবিষ্কারে কেকের মিশ্রণকে সহজেই ফারমেন্ট করা সম্ভব হলো। ফলে ইস্টের ব্যবহার বেশ খানিকটা কমে গেল। তাপমাত্রা পরিবর্তশীল ওভেনের আবিষ্কারও কেক তৈরীর পথ আরও মসৃণ করে দিল। 

উত্তরপশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় একসময় বাড়িতেই নিত্যনতুন কেক প্রস্তুতির প্রণালী আবিষ্কার হতে থাকে। প্রধানত বাড়িতেই গৃহকর্ত্রীদের দ্বারাই এসব বিস্ময়জাগানো কেকের আবিষ্কার হয়। এই কেক তৈরীতে তারা বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। বিশেষ করে কোন অনুষ্ঠানে বা অতিথি আপ্যায়নে এই কেকের বিকল্প তেমন আর কিছু ছিল না বিংশ শতকের দিকে। এখনও বিবাহ বা জন্মদিনের মত শুভ অনুষ্ঠানে কেক বানানোর প্রচলন আছে। 

কেক আবিষ্কার নিয়ে এইসব পড়াশোনা করতে করতে নানান কেকের ছবি ও রেসিপি নজরে এসেছে। আমিও নিছক নিরলস নই বলেই মনে মনে বেশ ছকে নিয়েছি এই শীতে কোনদিন কোন কেকটা বাড়িতে বানানো যায়। আর যাই হোক আবিষ্কারটি নেহাত বিফলে যায় কেন?এই বড়দিনে ক্রিসমাস কেক না হোক মার্বেল কেক, চকোলাভা কেক, ফ্রুট কেক, অরেঞ্জ কেক, পাইন্যাপেল কেক, ব্লাক ফরেস্ট নানান কেক বাড়িতে সহজেই বানানো যেতেই পারে। আর তা না হলে কেক সপ তো রইল নিজেদের ঠিকানায়, কি বলেন? 

তথ্যসূত্র: 
http://www.foodtimeline.org/foodcakes.html 
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Cake 
https://www.puckles.com.au/pages/a-history-of-christmas-cakes 

0 comments: