0

অণুগল্প - হিমাংশু চৌধুরী

Posted in


অণুগল্প


সঙ্গী
হিমাংশু চৌধুরী 
 

বাবার ঘরের কাছে আসতেই বাবার শ্লেষ্মাজড়িত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। "কার সাথে কথা বলছো?" ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম।

"তোর মায় আইসিলো," বাবার চোখমুখ অদ্ভুত চকচক করছে, "আমার পাশে শুইয়া কত্তডি না চক্ষের জল ফ্যালাইলো। কাইন্দা কাইন্দা কইলো, আমার আর একা একা ভালো লাগতেছে না, তুমি জলদি আসো আমার কাছে।"

মা মারা গেছে প্রায় মাসতিনেক হলো। ক্যানসার। লাস্ট স্টেজে ধরা পড়েছিলো। মা চলে যাবার পরে পরেই বাবারও স্ট্রোক হয়ে ডানদিকটা প্যারালিসিস হয়ে যায়।

"কি উল্টোপাল্টা বকছো তুমি?" আমি একটু কড়া ভাবেই বলি। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর থেকেই বাবা একটু কেমন যেন হয়ে গেছে।

"বিশ্বাস হয়না? দ্যাখ, আমার ডাইনদিকটা তার চখের জলে ভিইজ্যা গ্যাছে গিয়া।

সত্যিই বাবার গেঞ্জির ডানদিকটা বেশ ভেজা, দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে। আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে, তাহলে সত্যিই কি... কাছে গিয়ে তাকিয়ে দেখি, বাঁদিকের বেডসাইড টেবিলে জলের গ্লাসটা উলটে পড়ে আছে।

"ধূর, তুমি নিশ্চয়ই জল খেতে গিয়ে গেঞ্জি ভিজিয়েছো।"

"নারে, সইত্য কইতাছি, এগুলান তর মায়েরই চক্ষের জল। তর সাড়া পাইয়া তাড়াতাড়ি ঐ ফটোর মইধ্যা গিয়া সেঁধাইলো।" অসহায় কন্ঠে বাবা আবার বলে, "আর দ্যাখনা, জল পড়ছে বাম দিকে, কিন্তু আমার ডাইনদিকডাই তার চক্ষের জলে ভিজছে।"

কথাটা অবশ্য যুক্তিপূর্ণ, কিন্তু তাও কি হয়? সত্যি, হতে পারে এমনটা? মা'র কথা মনে পড়ে আমারও চোখে জল চলে আসে। তিনমাস হয়ে গেলো মায়ের স্নেহশীল হাতের পরশ পাইনা, আমারও বুকটা হুহু করে ওঠে। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখি ফটো থেকে হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে মা। মৃত্যুর তিনমাস আগে তোলা। মাথায় একঢাল কালো চুল। এত জীবন্ত, মনে হচ্ছে, এক্ষুণি বলে উঠবে, "আর দুগা ভাত দিমু তকে? ভালো কইরা খাওয়া দাওয়া করস না ক্যান?"

চোখের ভুল কিনা কে জানে, মনে হলো সত্যিই ফটোটা একটু দুলছে।

হঠাৎ ফটোর পিছন থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো একটা টিকটিকি, এমনভাবে জেট গতিতে সে দেয়ালের কোণের দিকে দৌড় দিলো যে মনে হলো যেন কেউ তাকে তাড়া করেছে। হাঁফ ছেড়ে আমি বাবার দিকে এগিয়ে যাই। বুড়ো বয়সে একা থাকে সারাদিন, শয্যাশায়ী। চল্লিশ বছরের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী মারা গেছে, তার কথা মনে তো পড়বেই। ডিপ্রেশন তো হবেই, ভুল দেখাটাও অস্বাভাবিক নয়।

বাবাকে বসিয়ে বিছানাটা পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখি, ওমা, বাবার বালিশের ডানদিকে কয়েকটা লম্বা কালো চুল, প্যারাশুট লাইট হেয়ার অয়েলের হালকা ফুলেল গন্ধ ভাসছে বাতাসে।

মায়ের খুব যত্নের ছিলো এই চুল। মারা যাবার দিন অবধি একটাও চুল পাকেনি, তবে শেষ তিনমাসে কেমোথেরাপি চলার সময় শীতের পাতা ঝরার মতো চুল পড়ে যাচ্ছিলো। ক্যানসারের থেকে বেশি কষ্ট মা পেয়েছিলো এই চুল পড়ে যাওয়ায়।

বাবা দেখি আমার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। আমায় বললো, "তয়?"

0 comments: