1

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়



"If all the women who have been sexually harassed or assaulted wrote 'Me too.' as a status, we might give people a sense of the magnitude of the problem.” - Alyssa Milano

এই একটা টুইটে কত কাণ্ড! গেল গেল রব। একে হুজুগ বলে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত বলে চালাবার চেষ্টা। আর, নারীবাদ বলে গাল পাড়া! আচ্ছা, নারীবাদ বস্তুটা ঠিক কী বলুন তো? নারীর পুরুষের ওপর খবরদারি চালানোর অধিকার? নাকি মেয়েদের যখন তখন, যার তার সঙ্গে জোট বাঁধার অধিকার? এরকমই কিছু মনে না করলে শব্দটা একটা গালির মতো ব্যবহার করার কারণ কী? নারীবাদ তো একটা অবস্থানের নাম। একটা বিশেষ চোখে বিশ্ব দেখার নাম। উদাহরণ? নারীবাদ চায়, কোনও মেয়ে যদি মাধ্যমিকে ফিফথ্ হয়, তবে তাকে তাই বলা হোক। মেয়েদের মধ্যে প্রথম নয়। নারীবাদ চায়, ষাটের দশকের কবিদের মধ্যে শক্তি, সুনীল, প্রণবেন্দু, নবনীতা, কবিতা - এই নামগুলো একসঙ্গে উচ্চারণ করা হোক। কোনও সাহিত্যের ইতিহাসেই যেন মহিলাকবি বলে একটা আলাদা অধ্যায় না থাকে। খুব কঠিন কি কাজটা? খুব কঠিন সহনাগরিক ভাবা মহিলাদের? বোধহয় কঠিনই। কেননা, তা না হলে আজ এত জনকে তাদের শরীরে অবাঞ্ছিত নোংরা হাতের ছোঁয়ার কথা বলে সরব হতে হতো না। সবচেয়ে তাজ্জব ব্যাপার হলো, যে বাঙালি সমাজের পরতে পরতে মাতৃকাসাধনের এত চিহ্ন, সেখানেই এত নারীনিগ্রহের ঘটনা ঘটা। এই তো, এখনও, মণ্ডপে শোভা পাচ্ছেন এক নগ্নিকা দেবী। তাঁর নগ্নতাকে লালসার চোখ দিয়েই দেখেন কি পুরুষ ভক্তরা? বলা কঠিন জানেন! 'যৌনতা ও বাঙালি' বইতে ঋতবাকের প্রধান উপদেষ্টা নৃসিংপ্রসাদ ভাদুড়ীর 'শৃঙ্গার' বলে একটা প্রবন্ধ আছে। তাতে তিনি এক পৌরাণিক শ্লোক ঊদ্ধৃত করেছেন : 

মত্রা সস্রা দুহিত্রা বা ন বিবিক্তাসনো ভবেৎ।
বলবান্ ইন্দ্রিয়গ্রামঃ বিদ্বাংসপি কর্যতি।।

এর অর্থ, মা, বোন অথবা মেয়ের সঙ্গেও নির্জনে কখনও বেশিক্ষণ থেকো না, কেননা প্রবল ইন্দ্রিয়বৃত্তি বুদ্ধিমান লোককেও মথিত করে। 

এই যদি পুরাণকারের ভারতীয় পুরুষ চরিত্রের মূল্যায়ন হয়, তবে আর কথা না বাড়ানোই ভালো ! 

কিন্তু, কোনওভাবেই যে এই মূল্যায়ন শেষ সত্য নয় তার প্রমাণ আমাদের ঘরে ঘরে। আমাদের বাবা, দাদা, ভাই, ছেলে, বন্ধু, সহকর্মীদের মধ্যে। সমস্যাটা অন্যত্র। বুঝতে হবে, একটা মেয়ের অধিকার, একটা ছেলের অধিকারের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। সে অধিকারটা তার শরীরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কী নারী, কী পুরুষ, হেনস্থা মানে হেনস্থাই। নারীবাদের নয়। প্রশ্নটা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের। মেয়েরা মানুষ। মেয়েমানুষ নয়। 

ঋতবাকের যাত্রা আলোর পথে। সব ঋতব্রতীও আলোকপথযাত্রী। তাই, এইসব সামাজিক আঁধারের ওপর মননের আলো ফেলে, সে আঁধার  একদিন দূর করবেনই তাঁরা, এটা নিশ্চিত। কাল ছিলো আলোর উৎসব। আজ ভাইফোঁটা। সকলে আলোকস্নাত হোন। যমদুয়োরে কাঁটা পড়ুক সব্বার... 

শুভকামনা নিরন্তর।

1 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী

Posted in










প্রচ্ছদ নিবন্ধ


দুর্গামূর্তির কুলজির সন্ধানে
অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী 



দেবী দুর্গার যে মূর্তিটির বর্তমানে আরাধনা করা হয়ে থাকে, অল্প কথায় তার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই দেবী দশভুজা, সিংহবাহিনী আর অসুরবিনাশিনী। অসুর মানে মহিষাসুর, যাকে দেখানো হয় একটি বলিষ্ঠ পুরুষ মানুষের চেহারায় এক কর্তিত-মুণ্ড মহিষের দেহ থেকে বেরিয়ে আসতে। দেবী দুর্গার সঙ্গে অন্যান্য যে সব দেবদেবীকে দেখানো হয়, তারা হলেন লক্ষ্মী,সরস্বতী, গণেশ ও কার্ত্তিক। কোথাও বা সঙ্গে থাকেন শিবও।


দুর্গাপূজা- পুরাণ ও পুরাতত্ত্ব

দুর্গাপূজার সঙ্গে যে পৌরাণিক কাহিনী জড়িত, তার উৎস বিষ্ণু ধর্মোত্তর পুরাণ, মৎস্যপুরাণ, অগ্নিপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবী ভাগবত, কালিকাপুরাণ ইত্যাদি। শিব আর ব্রহ্মার বরে কোনো পুরুষের অজেয় ও ত্রিলোকবিজয়ী এই মহিষাসুরের অত্যাচারে স্বর্গচ্যুত দেবতাদের কাতর প্রার্থনায় আবির্ভূতা তাঁদেরই সম্মিলিত তেজসম্ভূতা দেবী দুর্গার সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হয় সে। রাময়ণের নায়ক রামচন্দ্র তাঁর স্ত্রী সীতাকে রাবণের বন্দীদশা থেকে মুক্ত করার মানসে শরৎকালে দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন, সেই থেকে শারদীয়া দুর্গাপূজার সূচনা হয়, এমন উল্লেখ কোথাও কোথাও পাওয়া যায়। আবার তারও আগে বসন্তকালে রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধি নিজেদের সৌভাগ্যকামনায় দুর্গাপূজা করেছিলেন, এ রকম পৌরাণিক কাহিনীও প্রচলিত আছে। বাঙালি কবি কালিদাস তাঁর রামায়ণে শরৎকালের দুর্গাপূজাকে অকালবোধন বলে উল্লেখ করেছেন, যদিও প্রাচীনতর মার্কণ্ডেয় পুরাণে শরৎকালই দুর্গাপূজার সময় বলে উল্লিখিত। আবার বাল্মিকী রামায়ণে কিন্তু কোথাও রাম দুর্গার আরাধনা করেছিলেন বলে পরিষ্কার উল্লেখ নেই!

দুর্গাপূজার পৌরাণিক পটভূমি যা-ই হোক, এর ইতিহাস যে বেশ প্রাচীন, সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতে দ্বাদশ শতকে বারেন্দ্রীতে দুর্গাপূজার সবচেয়ে পুরানো উল্লেখ পাওয়া যায়। তখন থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত দুর্গা আরাধনার তত্ত্ব ও দুর্গামূর্তির রূপকল্পনা – সব কিছুতেই অনেক বিবর্তন হয়েছে। দেবী দুর্গার আরধনার মধ্যে কৃষি নির্ভর সমাজের পৃথিবীকে অর্থাৎ ভূমিকে ফলে-শস্যে সম্পদবতী করে তোলার প্রার্থনাই রূপায়িত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। তাঁদের মতে পূজার সময়ে দুর্গা মূর্তির সঙ্গে সুসজ্জিতা নবপত্রিকার [যা আদতে ন’ রকম ফল সমেত শাড়ি পরানো একটি কলাগাছ] স্থাপনাতে সেই চিন্তাই অভিব্যক্তি পেয়েছে।

ইতিহাসবিদ ও পুরাতাত্ত্বিকেরা আবার দুর্গাপূজার মধ্যে অন্য একটি রূপকের সন্ধান পান। বহিরাগত আর্যরা অনার্য অধ্যুষিত ভারতবর্ষে যুদ্ধ ও সামাজিক সংঘাতের মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন, এ কথা যদি মেনে নেওয়া যায়, তা হলে এটা খুবই সম্ভব যে, কৃষিপারঙ্গম আর্যরা এসে আদিম বঙ্গভূমির এমন কোনো সমাজের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল, যার কুলপ্রতীক বা টোটেম ছিল মহিষ। শস্যশালিনী পৃথিবীস্বরূপা দুর্গার হাতে মহিষাসুরের নিধনের মধ্যে কি রূপায়িত হয়েছে কৃষিকুশল আর্যদের কাছে আদিম বাংলার কৌম সমাজের নতিস্বীকারের ঘটনা? নবপত্রিকার পূজার মধ্যেও কি সেই কৃষিপরায়ণ আর্যদেরই আধিপত্য বিস্তারের ইঙ্গিত? অসম্ভব নয়। তা ছাড়া দুর্গার মহিষাসুর নিধন আর রামচন্দ্রের রাবণকে পরাভূত করার কাহিনী, এ দুয়ের মধ্যে একটি সাদৃশ্যও লক্ষণীয়। মহিষাসুর ও রাবণ – দু’জনের উদ্ভবের মূলেই রয়েছে শিবের বরপ্রাপ্তি-যে শিব মূলত অনার্য দেবতা। অর্থাৎ এমনটা হতেই পারে যে, দুর্গাপূজার প্রচলনের মধ্য দিয়ে অনার্যদের পরাভবের কাহিনীই রূপায়িত হয়েছে।

আমরা দেবী দুর্গার পুজার সময়ে নির্মিত আধুনিক মূর্তির যে বিবরণ শুরুতেই উপস্থিত করেছি, তার মূলে রয়েছে বিভিন্ন পুরাণ ও শাস্ত্রের বর্ণনা। এই সব পুরাণ, শিল্পশাস্ত্র ও ধ্যানমন্ত্রের বর্ণনা অনুযায়ী এই দেবী দশভুজা ও দশপ্রহরণধারিনী, সিংহবাহিনী তথা অসুরবিনাশিনী। আবার হেমাদ্রির বর্ণনা অনুযায়ী তিনি বিংশতিভুজা আবার শিল্পরত্নের কল্পনায় তিনি ত্রিনয়নী, জটাজুটসংযুক্তা, নীলকমলসদৃশ তাঁর চোখ, তিনি পীনোন্নতপয়োধরা ইত্যাদি ইত্যাদি। কোনো মন্ত্রের বর্ননায় আবার তিনি তপ্তকাঞ্চণবর্ণা,তাঁর মুখ পূর্ণচন্দ্রের মতো -- তাঁর মাথায় অর্ধচন্দ্র, তাঁর হাতে নানা আয়ুধ ও ঘন্টা, তাঁর অস্ত্রে নিপাতিত অসুর।


দুর্গামূর্তির প্রাথমিক রূপ

প্রাচীন ভারতবর্ষ তথা পূর্ব এশিয়ার হিন্দু উপনিবেশগুলির ভাস্কর্যে যেসব দুর্গামূর্তির রূপ পাওয়া যায়, গুপ্ত ও কুষাণ যুগের নানা মুদ্রায় শক্তিরূপিনী যে দেবীমূর্তি চিত্রিত দেখা যায়,তা থেকে এক দিকে দুর্গা আরাধনার প্রাচীনত্বের একটা আঁচ যেমন পাওয়া যায়,তেমন এ কথাও বোঝা যায় যে, অতীত ইতিহাসের নানা পর্বের মূর্তি রচনায় আমাদের উল্লিখিত শাস্ত্রের ওই বর্ণণাকে সব সময় মান্য করা হয়নি। এর একটি কারণ হতে পারে ঐ সব মূর্তি ও মুদ্রা নির্মাণের পরবর্তীকালে ওই দেবী মাহাত্ম্য রচিত হয়েছিল। মার্কন্ডেয় পুরাণ বা সপ্তশতী চন্ডী গুপ্তযুগে অর্থাৎ চতুর্থ শতকের রচনা হলেও এর দেবীমাহাত্ম্য অংশটি আরও পরবর্তী কালের [ ষষ্ঠ বা সপ্তম শতক] রচনা বলে অনেকের ধারণা। আর তার আগেই সিংহবাহিনী এই দেবী যে সমাজে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় গুপ্তসম্রাট প্রথম চন্দ্রগুপ্তের মুদ্রায়। [ছবি- ১ক] ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মনে করেছেন, শক-পহ্লব ও কুষাণযুগের দুর্গামূর্তিগুলি বর্তমানে পূজিত দুর্গামূর্তির উৎস-গ্রন্থগুলি অর্থাৎ পূর্বোল্লিখিত পুরাণগুলি থেকে বেশি প্রাচীন। এদেশের দুর্গামূর্তিগুলির সবচেয়ে পুরানো নিদর্শনগুলি তাঁর মতে খৃস্টের আগে ও পরের একশো বছরের মধ্যবর্তী সময়ের, এবং ওই সময়কাল নাগাদই এ দেশে মহিষমর্দিনী সংক্রান্ত ধর্মবিশ্বাসের প্রচলন হয়েছিল বলে মনে করা যেতে পারে। 

তবে দুর্গামূর্তির নানা হেরফের সত্ত্বেও এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্যকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি, এই দেবী সাধারণত বহুভুজা, অসুরবিনাশিনী ও সিংহবাহিনী। এই সিংহবাহিনী মাতৃকাদেবীর উৎস সন্ধান করতে গেলে আবার পৃথিবীর অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার যে সব নিদর্শন বহির্ভারতে পাওয়া যায়, তার দেবীমূর্তিগুলোর দিকেও আমাদের নজর চলে যায় আর তার ফলে দেবীমূর্তির বৈচিত্র্যও অনেক বেড়ে যায়। বাংলাদেশে প্রবর্তিত আধুনিক দুর্গাপুজার আরাধ্য মূর্তিতে বা অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন পটচিত্রে বা মন্দিরগাত্রের টেরাকোটায় দর্গামূর্তির যে পারিবারিক রূপটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তার অনুরূপ নিদর্শন কিন্তু মধ্যযুগের শেষভাগের আগে পাওয়া যায়না। আদি মধ্যযুগের [অর্থাৎ নবম-দশম থেকে দ্বাদশ শতক] কিছু মূর্তিতে অবশ্য দেবী গৌরী বা চণ্ডীকে লক্ষ্মী-সরস্বতীর সঙ্গে, কোথাও বা গণেশ-কার্ত্তিকের সঙ্গে দেখানো হয়েছে, যেমন ওড়িশায় প্রাপ্ত একাদশ শতকের একটি মূর্তিতে। [ ছবি-২ ক ]। লক্ষণীয় যে, দেবী এই সব ভাস্কর্যে সিংহবাহিনীরূপে রূপায়িত নন আর তাঁর দু’জনের বেশি ‘পরিজন’ নেই। আবার কোনার্কে প্রাপ্ত একটি মূর্তিতে দেবীর দু’ পাশে জগন্নাথ ও শিবলিঙ্গ দেখা যাচ্ছে। রাজস্থানের পিপলায় প্রাপ্ত এক দেবীমূর্তিতে দেবীর দু’ পাশে দেখা যায় কুবের ও গণপতিকে। কলকাতা জাদুঘরে সংগৃহীত একটি মূর্তিতে সিংহবাহিনী দেবীর কোলে একটি শিশুকে [কার্ত্তিক?] দেখা যায়।

প্রাচীন বা মধ্যযুগে ভারতে নির্মিত দুর্গামূর্তিগুলিতে দেখা যায় যে, দ্বিভুজা, চতুর্ভুজা বা অষ্টভুজা [যেমন ভুবনেশ্বরের বৈতাল দেউলের এক মূর্তিতে] দেবী সিংহারূঢ়া হয়ে অথবা সিংহের পাশে দাঁড়িয়ে বধ করছেন একটি মহিষকে [ছবি- ২ খ], কিংবা মহিষমুণ্ডধারী কোনো এক পুরুষকে [যেমন- মহাবলিপুরমের দেয়াল ভাস্কর্য]- কোথাও বা ছিন্নশির মহিষের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা এক অসুরকে [যেমন গুজরাটের পাটানের একটি ভাস্কর্য, দ্রষ্টব্য ছবি- ৩ ক ] । শক ও পহ্লব যুগের মূর্তিগুলিতেও এই ধারা লক্ষ করা যায়।আরও পরবর্তীকালের মূর্তি অবশ্য দেবীকে দেখানো হয়েছে কুড়িটি, আঠাশটি, কখনও বা বত্রিশটি হাতের অধিকারিনীরূপে।

ভারতের যে সব মহিষমর্দিনী ভাস্কর্য সবচেয়ে পুরানো, সেগুলিও খ্রিষ্ট পূর্ব প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝির আগের হবে না। এগুলির একটি পাওয়া গেছে এলাহাবাদের কাছে ভিটাগ্রামে, অন্য কয়েকটি মথুরায়। মথুরার সংখে খনন করে পাওয়া একটি মূর্তিতে দেখা যায়, দেবী একটি পশুর গলার কাছে হাত রেখেছেন। এই সব প্রাচীন ভাস্কর্যগুলির বেশির ভাগ নিদর্শনেই দেখা যায়, দেবী বিনা অস্ত্রেই এক হাতে একটি মহিষের গলা টিপে বা জিভ টেনে ধরেছেন ও অন্য হাতে তার পৃষ্ঠদেশ মর্দন [অর্থাৎ পিষ্ট বা চূর্ণ] করছেন। কোথাও অবশ্য় দেবীর পাশে বা হাতে [যেমন কুষাণ যুগের একটি মূর্তিতে] ত্রিশূল ও দেখানো হয়েছে। গুপ্তযুগের কিছু মূর্তিতে দেবীকে অসুরের দেহে শূলবিদ্ধ করতে দেখা যায়। ভিটা ও মথুরার মূর্তিতে দেখা যায়, চতুর্ভুজা দেবীর পদতলে শূলবিদ্ধ মহিষ, তার লেজ দেবী এক হাতে আকর্ষণ করছেন, বাকি তিন হাতে অস্ত্র [ছবি ৩ খ]। অনুরূপ অস্ত্রধারিনী মহিষঘাতিনী দেবীর মূর্তি পাওয়া যায় পশ্চিম ভারতের বাদামি গুহায় ও ইলোরা গুহায় [দ্রষ্টব্য ছবি- ৪ ], ওড়িশার উদয়গিরি ও হিমাচল প্রদেশের চাম্বায়। এই শ্রেণীর দুর্গামূর্তিগুলির সঙ্গে তুলনীয় জাভা ও কম্বোডিয়ার পাথরের দুর্গামূর্তিগুলো, যার নির্মাণকাল মোটামুটি সপ্তম থেকে পঞ্চদশ শতক। [ছবি-৫ ]

এতক্ষণ যে সব দুর্গামূর্তির কথা বলা হল, তার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য দেবী এখানে বহুভুজা ও ‘মহিষঘ্নী’ অর্থাৎ একটি মহিষকে মর্দন বা বধ করছেন- কখনও খালি হাতে, কখনও বা অস্ত্রের সাহায্যে। কিন্তু প্রাচীন ও আদি মধ্য যুগের এই সব মূর্তিগুলির কোনটিতেই মনুষ্যদেহধারী কোনো অসুর নেই ও সবগুলিতেই সিংহ অনুপস্থিত। ভারতের মূর্তিগুলিতে বাংলাদেশে প্রাপ্ত পালযুগের [দ্বাদশ শতক] মূর্তিগুলির [দ্রষ্টব্য ছবি- ৬] আগের পর্বে অসুর ও সিংহের খোঁজ কিন্তু তেমন মেলেনা। আবার ভারতের এই সব মূর্তিগুলিতে অসুর ও সিংহ দেখা দিতে শুরু করার পরেও কিন্তু পূর্ব এশিয়ার মূর্তিগুলোতে আগের মতোই সিংহ ও অসুর ছাড়াই মহিষমর্দিনী দেবী রূপায়িত হয়েছেন। এ থেকে মনে হয়, যে সময় ভারত থেকে হিন্দু সংস্কৃতি জাভা বা কম্বোডিয়ায় প্রথম পৌঁছেছিল, তখন পর্যন্ত এদেশের দুর্গামূর্তিতে অসুর বা সিংহের আবির্ভাব হয়নি ও সেই ধারা ঐ উপনিবেশগুলিতে কয়েক শতাব্দ ধরে বহমান ছিল, যদিও ততদিনে ভারতবর্ষের কোনও কোনও অঞ্চলে সিংহ ও মানুষের মতো চেহারার অসুরের আবির্ভাব হতে শুরু হয়ে গেছে।


সিংহ ও অসুরের সংযোজন

আমাদের পরিচিত একটি দুর্গাস্তোত্রে দেবীকে বলা হয়েছে “সিহস্থা সিংহনিলয়া, দিব্যস্থাননিবাসিনি” ইত্যাদি। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, আদিতে এদেশের ভাস্কর্যে মহিষমর্দিনী দেবীর সঙ্গে সিংহের উপস্থিতি ছিল না। দুর্গামুর্তিতে সিংহের অভ্যুদয়ের উৎস সন্ধান করতে গেলে বহির্ভারতীয় কিছু সভ্যতার দেবীমূর্তির সঙ্গে আমাদের দুর্গাকল্পনার আত্মীয়তা বেরিয়ে পড়তে পারে। মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার ও ইয়োরোপের কিছু দেশে প্রচলিত বিভিন্ন মাতৃকাদেবীর মূর্তির পাদপীঠ হিসেবে সিংহকে দেখানো হয়েছে। মেসোপটেমিয়ার ইশতার বা সুমেরের ইনানা বা নিন্‌লিল, পশ্চিম এশিয়ার কুবিলি বা সিবিলি‌ পারস্যের অনাহিত, গ্রীসের রিয়া, কুষাণ ও গ্রীকদের [ব্যাবিলনের] ননা প্রমুখ দেবীর বাহন বা সহচর হিসেবে সিংহকে দেখানো হয়েছে [ছবি- ৭ ]। দুর্গার সঙ্গে এই সব দেবীদের একটি সাধারণ মিল হল, এরা প্রায় সকলেই রণনিপুণা ও সিংহ নিয়ে যুদ্ধরতা, কেউ কেউ দেবাসুর সংগ্রামে অসুরনিধন করেছেন আর উর্বরতা তথা শস্যশালিনী ভূমির প্রতীকরূপে পূজিতা। মিল আরও আছে। গ্রীক রণদেবী অ্যাথিনার দেবাসুর সংগ্রামে অবতীর্ণ হবার যে দৃশ্য তুরস্কের পার্গমেনের বেদীর ভিত্তিতে দ্বিতীয় খ্রিস্ট পূর্বাব্দে খোদিত হয়েছিল, সেখানে সিংহারূঢ়া দেবীর ভঙ্গিমা অবিকল আমাদের দুর্গার মতো। এখানকার আর একটি মূর্তিতে দেখা যায়, দেবী অ্যাথিনা এক দানবের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন আর তাঁর সহচর সিংহ [ ছবি- ৮ ক] আর একটি দানবকে আক্রমণ করছে।পার্গমেনে দেবীর সঙ্গে যুদ্ধরত এক পাখাওয়লা দানবকে দেখানো হয়েছে, যার যুদ্ধভঙ্গী[পাখা দুটি বাদ দিলে] অনেকটা আমাদের মহিষাসুরের মতোই! [ ছবি- ৮ খ] একটি আসুরীয় সীলের ওপর খোদিত দেবী ইশতারকে অনেকটা দেবী দুর্গার মতোই সিংহের পিঠে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে দেখা যায়।

খ্রিস্টীয় প্রথম শতকেই ইরান তথা পশ্চিম এশিয়ায় মাতৃকাপূজা ও সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিল দেবাসুরের লড়াই ও পৃথিবীর উর্বরতাবৃদ্ধির নানা ধারণা। দেবী অনাহিতের ভক্তদের বিশ্বাস ছিল সৃজনক্ষমতার আধার বৃষ নিধন করলে তার রক্তে পৃথিবী উর্বরা হবে। হিন্দুদের দুর্গাপূজাতেও মহিষ বলি ও নবপত্রিকার পূজা ইত্যাদি ধর্মাচারে ওই উর্বরতা ও শস্যসমৃদ্ধির ধারণার প্রভাব থাকা হয়তো অসম্ভব নয়। অনেক ইতিহাসবিদের মতো পুরাতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতেও এই সব বিশ্বাস ও দেবীমূর্তিতে সিংহ ও অসুরের সংযোজনের পেছনে মধ্য এশিয়ার ওই সব দেশগুলির মূর্তিকল্পনা ও বিশ্বাসের প্রভাব থাকা বিচিত্র নয়, যে-প্রভাব উত্তর পশ্চিম ভারতের পথ দিয়ে বাণিজ্যিক যোগাযোগ বা দুই অঞ্চলের কিছু অংশ একই রাজনৈতিক শক্তির অধীনে থাকার সূত্রে এদেশে প্রবেশ করেছিল। ব্রতীন্দ্রনাথ প্রথম খৃস্টাব্দের কিছু স্বর্ণ মুদ্রা বা পদক বিশ্লেষণ করে ও শক -পহ্লব রাজা প্রথম অজ-র কিছু মুদ্রায় শক্তিদেবীর সঙ্গে সিংহের মুখ খোদিত দেখে ও গুপ্ত আর কুষাণ রাজাদের নানা মুদ্রায় সিংহবাহিনী দেবীমূর্তি খোদিত থাকার ভিত্তিতে [দ্রষ্টব্য ছবি- ১] সিদ্ধান্ত করেছেন যে ভারতে সিংহবাহিনী দুর্গার ধারণা সম্ভবত ওই সব মাতৃদেবীর সঙ্গে সিংহের যোগাযোগের থেকেই বিকশিত হয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায় যে, ভারতে সিংহ একেবারে অপরিচিত না হলেও বাংলাদেশে বা পূর্ব ভারতে সিংহ দেবীর বাহন হিসেবে খুব স্বাভাবিক নির্বাচন নয়, সেই তুলনায় বাংলায় বাঘ কিন্তু অনেক বেশি পরিচিত। দুর্গার বাহন হিসেবে নানা অর্বাচীন মুর্তি ও পটচিত্রে কিন্তু বাঘকেও দেখানো হয়েছে এবং উত্তর ও পূর্ব ভারতের নানা অঞ্চলে তাই ব্যাঘ্রবাহিনী দুর্গা ‘শেরাওয়ালী মা’ হিসেবেও অভিহিত হয়ে থাকেন। এসব যুক্তি বিচার করলে কিন্তু দুর্গার সিংহারূঢ়া মূর্তির পেছনে বহির্ভারতীয় প্রভাবের সম্ভাবনাই সঙ্গত মনে হয়।
দুর্গার পারিবারিক রূপ-‘ বাংলাদেশের হৃদয় হতে

দুর্গার লোকপূজিত মূর্তির ক্রমবিবর্তনের প্রক্রিয়ায় সর্বশেষ পর্যায় মনে হয় লক্ষ্মী, সরস্বতী ইত্যাদি ‘পরিজনদের সংযোজন যাকে বাংলাদশের একান্ত নিজস্ব অবদান বলা যায়। একচালা দুর্গাপ্রতিমাতে যেন বাংলাদেশের যৌথ পরিবারেরই ছবি দেখা যায়, যেখানে জননী দুর্গা তাঁর ‘ছেলেমেয়ে’দের নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। হিন্দুদের শাস্ত্র বা পুরাণ অনুসারে অবশ্য লক্ষ্মী বা সরস্বতীকে কোনোভাবেই দুর্গার কন্যা বলা যায়না। কিন্তু বাঙালির লৌকিক কল্পনায় এরা শিব-দুর্গার কন্যাতে পরিণত হয়েছেন আর দেবী দুর্গা হয়েছেন গিরিরানী মেনকার আদরিনী কন্যা উমা- যিনি প্রতি বছর শরৎকালে ‘বাপের বাড়ি’ আসেন। এই সব দেবদেবী সমভিব্যহারে দুর্গার মূর্তিকল্পনাটি কিন্তু রঘুনন্দন, বেণীনাথ প্রমুখের প্রণীত পূজাবিধিতে নেই। কিন্তু শিব দুর্গার সন্তানসন্ততি সহ ঘরকন্নার জীবন্ত ছবি আছে রামেশ্বরের শিবায়ন কাব্যে বা ভারতচন্দ্র- মুকুন্দরাম প্রমুখ কবিদের মঙ্গলকাব্যগুলিতে আর খ্যাত অখ্যাত নানা রচয়িতার আগমনী গানে। একটি গান তো আমাদের খুবই পরিচিতঃ- “দেখ না নয়নে গিরি গৌরী আমার সেজে এল/ দ্বিভুজা ছিল যে উমা দশভুজা কবে হল!/ সঙ্গে লক্ষ্মী সরস্বতী আর কার্তিক গণপতি/ সিংহপৃষ্ঠে ভগবতী চারিদিক করেছে আলো।“ বাংলাদেশে দেবী চন্ডীর রূপান্তরের বিচিত্র কাহিনী অবশ্য এত অল্পে সারা যাবে না। এখানে শুধু উল্লেখ করা যায় মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কবিকঙ্কণচন্ডীর একটি অংশ- যাতে আধুনিক কালে পূজিত দুর্গা মূর্তির পুরো চেহারাটি পাওয়া যায়ঃ-“......সিংহ পৃষ্ঠে আরোপিলা দক্ষিণ চরণ/মহিষের পৃষ্ঠে বাম পদ আরোপণ/......বাম করে মহিষাসুরের ধরি চুল/ ডানি করে বুকে তার আরোপিলা শূল।/ বামে শিখিবাহন দক্ষিণে লম্বোদর/ বৃষে আরোহণ শিব মস্তক উপর।/ দক্ষিণে জলধিসুতা বামে সরস্বতী/সম্মুখেতে দেবগণ করে নানা স্তুতি।।“ ইত্যাদি। এ থেকে বলা যেতে পারে যে, মুকুন্দরামের সময়ে [অর্থাৎ ষোড়শ শতাব্দে] বঙ্গভূমিতে দুর্গার সপরিবার মূর্তির পূজা প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। ডঃ সুকুমার সেন অবশ্য মনে করেন, দুর্গামূর্তিতে এই ‘পুত্রকন্যাদের সংযোজন দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ শতকের ঘটনা। বাংলাদেশের বহু মন্দিরের পোড়ামাটির ভাস্কর্যে তাই এই পারিবারিক রূপটি আমরা ফুটে উঠতে দেখতে পাই। [ছবি- ৯ ক] বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, ওড়িশা ইত্যাদি অঞ্চলের শিল্পীরা দুর্গাপূজা উপলক্ষে এই সপরিজন দেবীর সিংহবাহিনী মহিষাসুরমর্দিনী রূপটিকেই অনুসরণ করে থাকেন। বর্তমানে মহিষমর্দিনী দুর্গামূর্তির বঙ্গীয় রূপান্তরের এই ধারাটির আর একটি শাখার উল্লেখও এখানে করা যেতে পারে, যাতে অসুরনিধনের অধ্যায়টি বাদ দিয়ে হরপার্বতীর পুত্রকন্যাসহ নির্ভেজাল পারিবারিক রূপটিই তুলে ধরা হয় [ছবি- ৯খ] এই হরপার্বতী মূর্তিতেও বাংলা ও ওড়িশার কোনো কোনো স্থানে শারদীয়া দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বলা বাহুল্য যে, দেবী দুর্গার এই মূর্তিটিই বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য ও শিবসঙ্কীর্তনগুলির উপজীব্য।

অসুরদলনী দুর্গা বা উগ্ররূপা চণ্ডী থেকে বাঙালির ঘরের আদরিনী মেয়ে উমা বা ঘরণী- জননী অন্নপূর্ণা রূপে দুর্গামূর্তির এই যে বিবর্তন, রবীন্দ্রনাথ তার সুন্দর বিশ্লেষণ করেছিলেন। দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস’ বইটির আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেনঃ-“ তখনকার নানা বিভীষিকাগ্রস্ত পরিবর্তনব্যাকুল দুর্গতির দিনে শক্তিপূজারূপ এই যে প্রবলতার পূজা প্রচলিত হইয়াছিল,ইহা আমাদের মনুষ্যত্বকে চিরকাল পরিতৃপ্ত রাখিতে পারে না।“ তাই তাঁর মতে বাঙলাদেশে অত্যুগ্র চণ্ডী ক্রমশ মাতা অন্নপূর্ণার রূপে, ভিখারীর গৃহলক্ষ্মীরূপে, বিচ্ছেদবিধুর পিতামাতার কন্যারূপে – ‘রমণীর এই ত্রিবিধ মঙ্গলসুন্দর রূপে’ বাঙালির ঘরে রসসঞ্চার করেছেন।














আকর-সূত্রঃ-

১। মহিষমর্দিনীর উৎস সন্ধানে/ ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় – শারদীয় দেশ, ১৩৯০।

২। মুদ্রায় বিচিত্রিতা মহাদেবী/ ঐ, দেশ, ৪-১০-১৯৮৬।

৩। মহিষমর্দিনীর ঠিকুজি/ অতুল সুর- কলকাতা পুরশ্রী,২৩-১০-১৯৮২

৪। দুর্গামূর্তির কথা/ ডঃ সুকুমার সেন- আনন্দবাজার পত্রিকা, পূজা ক্রোড়পত্রিকা।

৫। মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা- যুগান্তরে রূপান্তর/ তারণকুমার বিশ্বাস, দেশ, ১৩-৯- ১৯৮০। 








0 comments:

1

প্রবন্ধ - রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল

Posted in


প্রবন্ধ


মালদহের জগজীবনপুর
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল



ইতিহাসকে বলা হয়- টাওয়ার অফ এক্সেলেন্স! গৌড় – মালদহ সেই এক্সেলেন্সের এক চরমতম উদাহরণ।

আমি ইতিহাসের ছাত্র নই। জীবন এবং জীবিকার প্রয়োজনে কোনো চাকরি না পেয়ে (এককালে, খুব “শান্ত” থাকায় কোতোয়াল সাহেবরা আমার সম্বন্ধে খুব একটা ভালো ধারণা রাখেননি)।

ফলে, সে কালের স্বপ্ন –কোনো সরকারি বা আধা সরকারি চাকরি জোটেনি, আমার।

যে চাকরি পেয়েছিলাম, তার একটা গাল ভরা নাম থাকলেও আসলে সেটা ছিল, মাথায় ঝাঁকা নিয়ে ওষুধ বেচার চাকরি। পদে,পদে চাকরি হারানোর ভয়।

প্রথমে খুব অস্বস্তি বোধ করতাম। ধীরে ধীরে প্রচুর জায়গা ঘোরার ফলে এবং বহু মানুষের সংস্পর্শে আসায় এই চাকরিকে আর ছাড়তে পারিনি।

ইতিহাসের ওপর, মানুষের ওপর জন্মাল প্রেম। প্রেমের চিহ্ন,হলো ফুল।

কেউ কেউ জানেন, বেশীর ভাগই জানেন না হয়তো – বাংলার প্রাচীনতম ফুল ফুটেছিলো এই মালদাতেই। 

“পাললিক শিলাস্তরের ৯২ মিটার তলায় মালদার “মিল্কি” অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছিলো গণ্ডোয়ানা স্তর।”

সেখান থেকে আগ্নেয়গিরির লাভা স্তরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একটি ফুলের ফসিল পেয়ে, পরীক্ষা করে এটাই প্রমাণিত হলো- প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি বছর আগে এই ফুলটি ফুটেছিল এই মালদার মাটিতেই।

বৈজ্ঞানিকরা নাম রাখলেন – ওয়েল ট্রিকিয়া মালদা এনসিস এস পি নোভা। 

বাংলার ইতিহাসে অনেক গৌরবময় অধ্যায় এবং বস্তুদের সঙ্গে নব সংযোজন ঘটলো- এই প্রাচীনতম পুষ্প জীবাশ্মটি। (ঝাড়খণ্ডী বাংলায় – পুপ্স)
(সূত্র :- মালদার ইতিহাস, কমল বসাক।)

আসল নাম হলো মালদহ। অপভ্রংশে- মালদা। যতটুকু জেনেছি, “মালদহ” নামটা কিন্তু সংস্কৃত নয়।

কেউ কেউ বলেন – মলদ, নামে এক জাতি গোষ্ঠীর নামে এই নামটা এসেছে। আবার কেউ বলেন :- “মালদহ” নামটা সৃষ্টি হয়েছে, এই ভাবে- মাল- শব্দটি হলো ফার্সি। অস্যার্থ-ধন/সম্পদ/পণ্যসামগ্রী।

মূল সংস্কৃত থেকে আসা – দহ শব্দটির অর্থ হলো, জলাশয়।

তাই বোঝা যায়- মালদহ একটা ধনশালী দেশকেই বোঝাচ্ছে। এই দেশে- কিছু মারোয়াড়ী ব্যবসায়ীও আসেন সেই সময়ে।

বেশীর ভাগই “আগরওয়ালা”। কালে এঁরা বাঙালি হয়ে যান। এখনও এই জনগোষ্ঠী আছেন, মূলত ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। পরে এরা “ রায়”- “দাস” এই উপাধিগুলো নিয়ে নেন। এই সম্প্রদায়ের বেশ কিছু পুরোনো লোক এখনও নিরামিষ খান বাড়ীতে, পুরোনো ধারা বজায় রাখতে।

মালদহের ইতিহাস মানেই গৌড় – পাণ্ডুয়ার ইতিহাস। এই ইতিহাস পাল রাজত্বের (আনুমানিক খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতক থেকে শুরু) আগে পর্যন্ত সে ভাবে পাওয়া যায় না।


যেটুকু জানা যায়, আগেই বলেছি-বেশির ভাগই গালগল্প, যার কোনো তথ্য প্রমাণ নেই। তবু বলি- বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে, অনেক জনশ্রুতির মধ্যে।


সেই গালগল্পই এবারে বলি। এগুলো মিথ হিসেবেই নেবেন, তবু একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে।


মহাভারতকেও অনেক নব্য যুক্তিবাদী (দাড়িওয়ালা মুখ) উড়িয়ে দেন গালগল্প বলে। আমার বক্তব্য, ধার্মিক দিকটা বাদ দিয়ে বর্ণিত ইতিহাসের ব্যাপারটা দেখাই যাক না।


*Mythology is to be considered to be the parent of all history!!!! Sir William Jones: - History of the primitive world!*

History কথাটার উদ্ভব, বহু হাজার বছর আগের গ্রীক শব্দ HISTOR থেকে। যার অর্থ:- Knowledge and judgment। পরে ল্যাটিন শব্দ Historia আরও একটা অর্থ যোগ করে। সেটা হলো- বর্ণণ বা narration।


কলির ৬৫৩ বছর হয়ে যাবার পর যুধিষ্ঠিরের বর্ণনা আছে মহাভারতে। মহাভারতের মধ্যে, পুণ্ড্র রাজ্যের সীমা নির্দেশ করতে গিয়ে, পূর্ব এবং পশ্চিমে –“করতোয়া” ও “মহানন্দা” এই দুটো নদীর নাম দেখতে পাই।

এই মহানন্দা নদী এখনও বর্তমানের মালদা জেলার মধ্যে প্রবাহিত। এটা বলা যেতেই পারে, মহাভারতের যুগে এখনকার মালদা জেলার সম্পূর্ণ না হলেও অন্তত পূর্বের দিকটা পুণ্ড্রবর্ধন রাজ্যের অন্তর্গত ছিল।


দেবীপুরাণ আর পদ্মপুরাণে পুণ্ড্রবর্ধন নামটা আবার পাই। প্রবাদ আছে, এই জেলার যে জায়গায় পাণ্ডবরা ছিলেন, সেই স্থানের নাম পাণ্ডুয়া হয়েছিল।

অর্জুন যে জলাশয় খনন করেছিলেন, সেটা আজও সাতাইশ ঘড়া নামে আছে। ঘড়ার সাইজটা জানা যায় না, তবে সাতাশ ঘড়া জল দিয়ে অর্জুন এই জলাশয়কে ভরেছিলেন। এছাড়াও আছে- পাণ্ডবরাজ দালান।

বলা হয়, বাংলা নাকি পাণ্ডব বর্জিত দেশ। তা, সেই সময়ে এই মালদহ মগধ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল।


সুতরাং পাণ্ডবরা (যদি থেকেই থাকেন) এই পাণ্ডুয়া বা পুণ্ড্র বর্দ্ধনে এসেছিলেন বলেই অনুমান করা যায়।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় প্রাগজ্যোতিষপুরের (মোটামুটি ভাবে আসাম) রাজা ভগ দত্ত নাকি এই জায়গা দিয়ে যুদ্ধের হাতী সাপ্লাই দিয়েছিলেন।

মালদা এই বারেন্দ্র ভূমের একটি অংশ।

“গৌড়” এই নামটা, প্রাচীন যুগ থেকেই এক বিশাল সাম্রাজ্যের নাম হিসেবে পাওয়া যায়।

পূর্বভারতের এক সমৃদ্ধিশালী রাজ্য হিসেবে গৌড় চিরকালই বন্দিত। এই নামটা ছিল সম্ভ্রমসূচক। কারণ, এই রাজ্যের লোকপ্রিয়তা।

খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে বিখ্যাত বৈয়াকরণিক পাণিনিও “গৌড়” নামটি উল্লেখ করেছেন।

“গৌড়” বিশেষ্য নামটি এতই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে, স্থানবাচক শব্দটি “ বিশেষণ” হিসেবেও ব্যবহৃত হতে থাকে। ব্যঞ্জনাও বেড়ে যায় শব্দটির।

“ওজঃ” (এখানে, সাহিত্যের গাম্ভীর্য সৃষ্টিকারী দীপ্তি) প্রকাশক শব্দের ব্যবহার, আড়ম্বরপূর্ণ সমাসবহুল কাব্য রচনার এক বিশেষ রীতিকে “গৌড়রীতি” বলা হতো।

সারা ভারতবর্ষ, এই গৌড়রীতিকে সাদরে গ্রহণ করেছিল। সংস্কৃত আলঙ্ককারিকরা সংস্কৃত রচনার চার রকম রীতির মধ্যে এই রীতিকে সমাদরে নিয়েছিলেন।

আলঙ্ককারিক ভামরু এবং দণ্ডী সেকালের কাব্য রীতির সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে প্রাচীন বৈদর্ভরীতির সঙ্গে গৌড়রীতির কথাও সম্ভ্রমের সাথে বারবার বলেছেন।

সেযুগে সর্বভারত গ্রাহ্য বৈদর্ভরীতির মানের পাশে গৌড়রীতির তার একটা আলাদা আসন নিয়েছিল। প্রাচীন বাংলার এটা একটা দারুণ গর্বের ব্যাপার।

আমার মনে হয়, সেই কারণেই বাংলায় কোনোকালেই কবিদের কমতি হয়নি বা এখনও নেই।

“গৌড়িক” নামে এক খনিজ রূপার ব্যবহার ছিল, এটাও আমরা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে জানতে পারি। অলঙ্কার তৈরির জন্য এই বিশেষ মানের রূপা “গৌড়েই” প্রস্তুত করা হতো বলে কৌটিল্য (চাণক্য) বলে গেছেন।

প্রসঙ্গত বৃহৎসংহিতা একটি প্রসিদ্ধ জ্যোতিষ গ্রন্থ, গৌড়রীতির পদ্য আকারে লেখা। এতে তিনি জ্যোতিষী দৃষ্টিকোণ থেকে বহু পাথরের বিবরণ এবং প্রাচীন ভারতের ভৌগোলিক তথ্য সন্নিবেশিত করেছিলেন। এছাড়াও এতে সূর্য ও চন্দ্রের গতি ও প্রভাব, আবহবিদ্যা, স্থাপত্য এবং পূর্তবিদ্যার নানা বিষয় প্রসঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার কথা আলোচিত হয়েছে। এই বইয়েই তিনি ব্রজলেপ নামে একটি বস্তুর প্রস্তুতপ্রণালী ব্যাখ্যা করেছেন যা আধুনিককালের সিমেন্টের সমগোত্রীয় ছিল। সে সময় ভারতে বরাহমিহির উদ্ভাবিত এই ব্রজলেপ দিয়েই বড় বড় দালান কোঠার ইটের গাঁথুনি তৈরীতে ব্যবহৃত হতো বলে অনেকেই মনে করেন, তবে তথ্যসূত্রের অভাব আছে।

“গৌড়ীয়” ইটের তৈরি বহু, মন্দির- মজসিদ বা বসত বাড়ী এখনও গৌড় মালদায় দেখা যায়।আচার্য যাস্কাচার্যের নিরুক্তে (বেদের দুরূহ শব্দগুলোর ব্যুত্পত্তি ও ব্যাখ্যাসংবলিত বই) “গৌড়ী” নামের এক বিশেষ মদিরার কথা উল্লেখ আছে। বিশেষ এক ধরণের গুড় পচিয়ে এই “গৌড়ী” তৈরি হতো।

রামায়ণে, বনবাস কালে রামচন্দ্র – অন্য দুইরকম মদিরার (পৌষ্টি- পিঠে পচিয়ে তৈরি, মাদ্ধী – মধু থেকে তৈরি) সাথে এই “গৌড়ী” পান করতেন বলে রামায়ণের কাব্যকাররা বলেছেন। রামচন্দ্র কল্পিত চরিত্র যদি হয়েও থাকেন তবুও এটা বলা চলে, এই “গৌড়ী” তখনকার ভারতবর্ষের লোকেরা পান করতেন।

আনুমানিক অষ্টম- নবম শতাব্দীতে রচিত মহাযান বৌদ্ধ গ্রন্থ আর্যমঞ্জুশ্রী মূলকল্পে “গৌড়- তন্ত্র” নামের উল্লেখ পাই।

সেই সময়ে এই “গৌড়- তন্ত্র” এক অনন্য স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিল।

সঙ্গীত রত্নাকর বইতে সঙ্গীতের যে সব রীতি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে যে সব রাগ-রাগিনীর কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে “গৌড়মল্লার”, “গৌড়সারঙ্গ”, “গৌড়কৌশিক”, “কর্ণাট- গৌড়” এই সব নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। 

তাছাড়া চর্যাগীতির মধ্যে বলা “ গবড়া” বা “ গউড়া” নামটি সম্ভবত “গৌড়” নামের সঙ্গে যুক্ত।

ভারতের নাট্য শাস্ত্রে প্রাচীনকালে উল্লেখ আছে যে, নাট্যাভিনয়ে “গৌড়পাত্রগণ” অর্দ্ধ মাগধী ভাষা ব্যবহার করতেন।

সেই সময়ে-পূর্বভারতে প্রচলিত লিপিকে, অর্থাৎ বর্তমানের দুই বাংলা, ওডিশা,আসাম প্রভৃতি অঞ্চলে প্রচলিত লিপির আদি রূপকে “ গৌড় লিপি” বলা হতো।

আল- বিরুনী, একাদশ শতাব্দীতে এই “ গৌড় লিপি” র কথা বলেছেন।

এখন লজ্জার কথা হলেও, বলা দরকার- মধ্যযুগে দাসদাসী কেনা বেচার প্রথা যে প্রচলিত ছিল, সেটা অভিজ্ঞ পাঠক মাত্রেই জানেন।

গৃহকর্তার অধীনে ঘরের কাজকর্ম করা ছাড়াও দাসীদের কাজ ছিল, কর্তার যৌন লালসার শিকার হওয়া।

গৃহকর্ত্রী জেনেও কিছু বলতেন না। বরং, এই সবে উৎসাহই ছিল। নিজেও এই সবে সাগ্রহে অংশ নিয়ে, “ পুণ্য” করছে বলে ভাবতো।

সে যাই হোক, দাসদাসীর কেনা বেচার লিখিত দলিলের অভিধা ছিল “গৌড়ীয় শত পত্রিকা” ।

সমাজ সংস্কারক হিসেবে চৈতন্য দেব এই ঘৃণ্য প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।

চৈতন্য দেবের প্রবর্তিত ধর্ম- “গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম” ও “গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাধনা” সম্বন্ধে সবাই জানেন।

অবিভক্ত বাংলাকে “গৌড়দেশ” বলা হতো, আর এদের অধিবাসীদের “গৌড়জন”।

সেই সময়ে ভারত সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে একটা আঞ্চলিক চেতনা “ গৌড়” নামে একটা বিশিষ্ট সংজ্ঞায় খ্যাতিলাভ করতে এবং একটা স্বতন্ত্র ধারার প্রচলন করাতে সফল হয়েছিল।


আজকের গৌড় শহর, ইংলিশবাজার থেকে ১৫ কিমি দূরে। সুবিধে মতো যান- বাহন নিয়ে ঘুরে আসা যায়। গৌড়ের কিছু অংশ বাংলাদেশের মধ্যেও পড়েছে। এখানকার সীমান্ত মহদীপুর । প্রচুর পণ্য চলাচল এখন এই সীমান্ত দিয়ে হয়।

ভ্রমণকারীদের একটা প্রশ্ন জাগে মনে, মাত্র ৫০০ বছর আগে যে শহরের এত জাঁকজমক ছিল, তার এখন এরকম দশা কেন!!! 

দেখে নেওয়া যাক, সেই সময়ের গৌড় কেমন ছিল!

১৫৪০ খৃষ্টাব্দের কিছু আগে লেখা এক পর্তুগীজ ব্যবসায়ীর (De Barros) প্রতিবেদন থেকে ইংরেজী অনুবাদ দিচ্ছি :-

“The population of the city is so great and the streets are so thronged with concourse and traffic of the people, especially of such as come to present themselves at the king’s court, that they cannot force their way past one another.

A great part of this city consists of stately and well-wrought buildings.”

এই প্রসঙ্গে De Barros এর ১০০ বছর পর ১৬৪০ খৃষ্টাব্দের কিছু আগে Fariay Souza নামে আর এক প্রত্যক্ষদর্শী পতুর্গীজ ব্যবসায়ীর প্রতিবেদনের হুবহু অনুবাদ হলো :-

“…It (GOUR) contained 1,200,000 inhabitants and was so crowded that at the time of religious, festivals and processions, numbers of people were trodden to death.”

বর্তমানে, কয়েকটি মসজিদ এবং তোরণ ছাড়া, সেযুগের সাধারণ নাগরিকদের তৈরি অট্টালিকা বা বাসস্থানের একটিও গৌড়ে নেই,কিছু ধ্বংসাবশেষ ছাড়া। জগতে কোনো কিছুই কালজয়ী নয়। এর একটা কারণ অবশ্য আছে।

বৃষ্টিস্নাত পলিমাটির দেশ বাংলায় গরম আবহওয়া ইঁটের তৈরি স্থাপত্য শিল্প টিকিয়ে রাখার অনুকূলে নয় । 

১৫৭৪ খৃষ্টাব্দে, খান্ খানান্ মুনিম খাঁ, যখন দিল্লির সুলতানের নিযুক্ত বাংলার শাসন কর্তা হয়ে আসেন, তখন শ্রীহীন গৌড়ের অবস্থান, প্রাচীন প্রাসাদ,জনসাধারণের বাসযোগ্য কিন্তু পরিত্যক্ত অট্টালিকা দেখে এতই মোহিত হয়ে পড়েন, যে পরিত্যক্ত গৌড়ের সংস্কার করে এই গৌড়েই তাঁর রাজধানী করলেন।

বিধি বাম হলে যা হয়, ভয়ঙ্কর প্লেগের প্রাদুর্ভাব । এই মড়কের জন্য গৌড় মনুষ্য বর্জিত শূন্য নগরীতে পরিণত হলো।

ফার্সী বই – “তবকৎ-ই-আকবরী” র ইংরেজী অনুবাদকের ভাষায় বর্ণণাটা এই রকম :-

“ By degrees the pestilence reached to such a pitch that men were unable to burry the deads and cast the corpses into the river...”

বিপদ অন্যরকম ভাবেও এলো। এই নদীর জল পানীয় হিসেবে খেয়ে প্রচুর লোক বিষক্রিয়ায় মারা গেলেন।

ধীরে ধীরে গৌড়ের সমস্ত প্রাচীন প্রাসাদ, জনসাধারণের বাসযোগ্য অট্টালিকা পাষাণ পুরীর থমথমে স্তব্ধতাকে সঙ্গী করে, ক্রমশ ঘন জঙ্গলে ছেয়ে গেল। জন্তু, জানোয়ারদের প্রিয় আবাস স্থল হলো গৌড়।

অনেক অনেক পরে, গৌড়ের প্রাসাদ ও অট্টালিকার শক্ত ও প্রায় ক্ষয়হীন “গৌড়ীয় ইঁট”গুলো খুলে নিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার হিড়িক পড়ে গেল।

মুর্শিদাবাদ যখন বাংলা-বিহার-ওডিশার রাজধানী ছিল তখন এখানের সমস্ত বাড়ী ঘর এই “গৌড়ীয় ইঁট” দিয়েই তৈরি হতো।

বর্ষাকালে খাল –ডোবা-নীচু জমিতে জল জমার ফলে নৌকা নিয়ে গৌড়ে ঢোকা খুবই সহজ ছিল। তাই “গৌড়ীয় ইঁট” পাচার করাটা ছিল জল ভাত।

মানুষ নিজের হাতে ধ্বংস করতে লাগল-মহামূল্যবান এই সব প্রাচীন ঐতিহাসিক শিল্পকে।

Mr. Reuben Barrow ১৭৮৭ খৃষ্টাব্দে গৌড় বেড়াতে এসে লিখেছিলেন-

Gaur seems rather to have been destroyed by the removal of the materials for other purpose, than by time.”

এই ঘটনা, ভারতের সব জায়গাতেই ঘটেছে।

গৌড়- এই নামটা এলেই রাজা শশাঙ্কের কথা আসবেই আসবে। শশাঙ্কের প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে অতি অল্প তথ্য জানা যায়। ধারণা করা হয় যে,তিনি রোহতাসগড়ের মহা সামন্ত হিসেবে কর্ণসুবর্ণের গৌড় রাজার অধীনে কিছুদিন রাজ্য শাসন করেন।

রোহতাসগড়ে প্রাপ্ত সীলের ছাঁচে লিখিত ‘শ্রী মহা সামন্ত শশাঙ্ক’, বাণ ভট্টের সমসাময়িক সাহিত্য উপকরণ,চৈনিক তীর্থযাত্রী হিউয়েন-সাঙের বিবরণ এবং বৌদ্ধ গ্রন্থ আর্য মঞ্জুশ্রী মূলকল্প শশাঙ্কের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এই বৌদ্ধ গ্রন্থে পুণ্ড্রবর্ধনের যুদ্ধে হর্ষের হাতে শশাঙ্কের পরাজয়ের কাহিনী এবং শশাঙ্কের ১৭ বছরের রাজত্বকাল সম্পর্কে বলা হয়েছে।

উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গের গুপ্ত বংশীয় শাসকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, ৬০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে গুপ্ত শাসকদের নিয়ন্ত্রণ থেকে গৌড়কে মুক্ত করে একটি স্বাধীন রাজ্যের পত্তন ঘটিয়েছিলেন শশাঙ্ক।

তাঁর ৮ম ও ১০ম রাজ্যাঙ্কে প্রকাশিত দুটি লিপি পাওয়া গেছে মেদিনীপুর থেকে এবং দিনাঙ্ক বিহীন অপর একটি লিপি খড়গপুরের নিকট এগ্‌রা হতে আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়া শশাঙ্কের অধীনস্থ গঞ্জামের (ওডিশা) রাজা মাধববর্মার তাম্রশাসন (৬১৯ খৃষ্টাব্দের), হর্ষবর্ধনের বাঁশখেরা ও মধুবন তাম্রশাসন এবং কামরূপের রাজা ভাস্কর বর্মণের নিধান পুর তাম্রশাসন থেকে তাঁর সম্পর্কে জানা যায়। শশাঙ্কের উৎকীর্ণ স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রাও পাওয়া গেছে।


আগে দেখে নেওয়া যাক, কর্ণ সুবর্ণ ঠিক কোন জায়গায় ছিল। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় রাজবাড়িডাঙ্গার (রক্ত মৃত্তিকা মহাবিহারের প্রত্নস্থল অথবা আধুনিক রাঙ্গামাটি) কাছেই চিরুটি রেল ষ্টেশন। এই চিরুটি হলো কর্ণ সুবর্ণ।

বাংলা, মৌর্য বংশের (খৃঃ পূঃ ৩২৪-১৮৫ খৃঃ পূঃ) শাসনাধীন ছিল। পর্যটক হিউয়েন-সাঙের এর বর্ণনা মতে বর্তমান পশ্চিম বাংলার মেদিনীপুর, চব্বিশ পরগনা ও পূর্ণিয়া জেলায় আবিষ্কৃত মুদ্রা এবং মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত সম্রাট অশোকের শিলালিপি হতে নিশ্চিত প্রমাণিত হয় যে মৌর্যরা বাংলাদেশ শাসন করেন।

গুপ্ত শাসনামলের শেষের দিকে বাংলাদেশের দক্ষিণ এলাকায় ধর্মাদিত্য, গোপচন্দ্র ও সমাচারদের এবং গৌড় এলাকায় স্থানুদত্ত রাজা ছিলেন! হযরত মুহম্মদ (সঃ) যখন মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন ঠিক তখন গৌড় তথা বাংলাদেশের স্বাধীন নরপতি ছিলেন রাজা শশাঙ্ক। অনেকের মতে রাজা শশাঙ্ক গুপ্ত বংশোদ্ভূত ছিলেন।

শশাঙ্ক ছিলেন শিবের ভক্ত। বান ভট্ট এবং হিউয়েন সাঙ শশাঙ্ককে বৌদ্ধ-বিদ্বেষী হিসাবে উল্লেখ করেছন। কিন্তু নালন্দায় অবস্থিত বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, যেখানে হিউয়েন-সাং নিজেও বেশ কিছুদিন লেখাপড়া করেছিলেন, এবং শশাঙ্কের রাজধানী শহর কর্ণসুবর্ণের উপকণ্ঠে রক্ত মৃত্তিকা মহাবিহারসহ বেশ কিছু সংখ্যক বৌদ্ধ মঠের অস্তিত্বের ইত্যাদি থেকে এদের তথ্যকে যথার্থ বলে মনে করা যায় না।

লিপিমালা এবং সাহিত্যিক সূত্রে শশাঙ্ক সংকীর্ণ গৌড়ের শাসক হিসেবে বর্ণিত হয়েছেন। সংকীর্ণ অর্থে পদ্মা ও ভাগীরথী নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলই গৌড়। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এক বিস্তৃত এলাকা এর অন্তর্ভুক্ত হয়। শক্তি সঙ্গম তন্ত্র গ্রন্থের ৭ম পটল ‘ষটপঞ্চদ্দেশবিভাগে’ বলা হয়েছে যে, গৌড়ের সীমানা বঙ্গদেশ হতে ভুবনেশ (ওডিশার ভুবনেশ্বর) পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। এটি অসম্ভব নয় যে, লেখক শশাঙ্কের রাজ্যসীমা, যা ওডিশার একটি অংশকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিল, চিন্তা করেই গৌড় দেশের বিস্তৃতির বর্ণনা দিয়েছেন।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির সঙ্গে গুপ্ত সাম্রাজ্যের ধ্বংস ও পতন আকস্মিক যুগপৎ সংঘটন। অনেক অপরিচিত এলাকা, যেগুলি সম্ভবত গোত্র প্রধানগণ শাসন করতেন এবং যেখানে জনবসতি ছিল হালকা, ঐতিহাসিক খ্যাতি অর্জন করে। এ এলাকাগুলির মধ্যে ছিল পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর ওডিশা এবং মধ্যপ্রদেশ সংলগ্ন এলাকার (ছোট নাগপুর মালভূমির অংশ) লালমাটি অঞ্চল, যেখানে চাষাবাদ ও বসবাস করা বেশ কষ্টসাধ্য।

এ পরিপ্রেক্ষিতে শশাঙ্ক ভারতের বিভিন্ন অংশে তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম কাজ ছিল মৌখরিদের দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ থেকে মগধ মুক্ত করা। শশাঙ্ক তাঁর মিত্র মালবের রাজা দেব গুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে পুষ্যভূতি রাজ প্রভাকর বর্ধনের জামাতা মৌখরি রাজ গ্রহবর্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। গ্রহবর্মা দেব গুপ্তের হাতে নিহত হন। এরপর প্রভাকর বর্ধনের জ্যেষ্ঠ পুত্র বৌদ্ধ ধর্ম মতাবলম্বী থানেশ্বর রাজ রাজ্যবর্ধন দেব গুপ্তের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং দেব গুপ্তকে পরাজিত ও নিহত করেন। কিন্তু দেব গুপ্তের মিত্র শশাঙ্কের সঙ্গে এক সংঘর্ষে রাজ্যবর্ধন নিহত হন।

অধিকাংশ পণ্ডিত গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের সঙ্গে রাজ্যবর্ধনের সাক্ষাতের বিষয়টি সত্য বলে ধরে নিলেও শশাঙ্কের হাতে রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর অভিযোগ এড়িয়ে যান। বাণভট্টের মতে, রাজ্যবর্ধন খুব সহজেই মালবের সৈন্যবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করেন এবং তিনি ‘গৌড়ের রাজার মিথ্যা উপচারে আশ্বস্ত হয়ে নিরস্ত্র ও একাকী অবস্থায় শত্রু শিবিরে নিহত হন’। চৈনিক তীর্থযাত্রী হিউয়েন-সাঙ একই ধরনের বর্ণনা দেন। শশাঙ্কের শত্রুর মৃত্যুর প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যের অভাব রয়েছে। তাই রাজ্যবর্ধনের প্রতি শশাঙ্কের আচরণ বিশ্লেষণ করা অসম্ভব। নিজের পৃষ্ঠপোষকের ভাইয়ের মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত বাণভট্ট এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগী ও হর্ষবর্ধনের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞ হিউয়েন-সাঙ উভয়েই তাদের মনোভাবের জন্য সুপরিচিত। সম্ভবত এ কারণেই রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু সম্পর্কিত বিবরণ দানে আবেগ প্রশমিত করতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন বলেই ঐতিহাসিকরা মনে করেন।

গুপ্তবংশের রাজাদের ক্রম (সকলের সময়েই বাংলা গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল, এমন নয়)

শ্রীগুপ্ত> ঘটোৎকচ> প্রথম চন্দ্রগুপ্ত> নিশামুসগুপ্ত> সমুদ্রগুপ্ত> রামগুপ্ত> দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত> প্রথম কুমারগুপ্ত> স্কন্ধগুপ্ত> পুরুগুপ্ত> দ্বিতীয় কুমারগুপ্ত>বুদ্ধগুপ্ত> নরসিংহগুপ্ত বালাদিত্য> তৃতীয় কুমারগুপ্ত> বিষ্ণুগুপ্ত> বৈন্যগুপ্ত> ভানুগুপ্ত।



প্রখ্যাত বৌদ্ধ ইতিহাস রচয়িতা তারানাথ এই সময় সম্পর্কে বলেন, 'সমগ্র বাংলাদেশ জুড়িয়া অভূতপূর্ব নৈরাজ্যের সূত্রপাত হয়। গৌড়ে-বঙ্গে সমতটে তখন আর কোনও রাজার আধিপত্য নাই, সর্বময় রাষ্ট্রীয় প্রভুত্ব তো নাইই। রাষ্ট্র ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন; ক্ষত্রিয়, বণিক, ব্রাহ্মণ। নাগরিক স্ব স্ব গৃহে সকলেই রাজা। আজ একজন রাজা হইতেছে, কাল তাহার মস্তক ধূলায় লুটাইতেছে।'

এর চেয়ে নৈরাজ্যের বাস্তব চিত্র আর কি হতে পারে! সমসাময়িক লিপি ও কাব্যে (রামচরিত) এ ধরনের নৈরাজ্যকে বলা হয়েছে মাৎস্যন্যায়। বাহুবলই একমাত্র বল, সমস্ত দেশময় উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খল শক্তির উন্মত্ততা; দেশের এই অবস্থাকে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে তাকেই বলে মাৎস্যন্যায়। অর্থাৎ বড়মাছের ছোট মাছকে গ্রাস করার যে ন্যায় বা যুক্তি সেই ন্যায়ের অপ্রতিহত রাজত্ব।

শত বৎসরের এই মাৎস্যন্যায়ের নৈরাজ্যে বাংলায় আর্থ সামাজিক অবস্থা চরম নাজুক অবস্থায় পতিত হয়। এই নৈরাজ্যে সাধারণ মানুষের জীবনেকি পরিমাণ ভোগান্তি ও দুর্দশা ছিল টা সহজেই অনুমেয়। সংস্কৃত গ্রন্থ মঞ্জুশ্রীমূলকল্প থেকে এই সময় ঘটা এক নিদারুণ দুর্ভিক্ষের খবর পাওয়া যায়।

শেষ পর্যন্ত এই উৎপীড়ন যখন আর সহ্য হলো না তখন সারা বাংলার রাষ্ট্র নায়কেরা একত্র হয়ে নিজেদের মধ্য থেকে একজন কে অধিরাজ বলেনির্বাচন করলেন এবং তাঁর সর্বময় আধিপত্য মেনে নিলেন। এই রাষ্ট্রনায়ক অধিরাজের নাম গোপাল দেব।

কে এই গোপাল দেব? গোপালের পুত্র ধর্মপালের খালিমপুর তাম্রলিপি তে বলা হয়েছে "গোপাল দেব ছিলেন দয়িতবিষ্ণুর পুত্র এবং বপ্যটের পৌত্র। মাৎস্যন্যায় দূর করিবার অভিপ্রায়ে প্রকৃতিপুঞ্জ গোপালকে রাজা নির্বাচন করিয়াছিল"।

একটা ব্যাপার লক্ষণীয় পাল রাজাদের রাজ সভায় রচিত কোনও গ্রন্থে নিজেদের বংশ কৌলীন্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়নি। সাধারণ প্রজা দয়িতবিষ্ণুরপুত্র গোপাল দেবের জন্ম ভূমি বরেন্দ্র(রাজশাহী) অঞ্চলে। এবং সেখানে তিনি একজন সামন্ত নায়ক ছিলেন। এবং তিনি যে বাঙালি ছিলেন এতে সন্দেহের অবকাশ নাই।

লিপিতে বলা সংস্কৃত প্রকৃতিপুঞ্জ শব্দের অর্থ যদিও জনসাধারণ, কিন্তু বাংলার সকল জনগণ সম্মিলিত হয়ে গোপালকে রাজা নির্বাচিত করেছিল এটা মনে হয় না। আসলে তখন দেশ জুড়ে অসংখ্য সামন্ত নায়কেরা ছিল দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তাহারা যখন দেশকে বারবার বৈদেশিক শত্রুর আক্রমণ থেকে আর রক্ষা করতে পারলেন না, শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারলেন না, তখন একজন রাজা ও কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র গড়ে তোলা ছাড়া বাঁচার আর পথ ছিলনা।তাদের এই শুভ বুদ্ধির ফলে বাংলাদেশ নৈরাজ্যের অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা এবং বৈদেশিক শত্রুর কাছে বার বার অপমানের হাত থেকে রক্ষা পেল।

আনুমানিক ৭৫০ খৃস্টাব্দে গোপাল দেব(৭৫০ খ্রীঃ-৭৭৫ খ্রীঃ) পাল বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। রাজা হয়ে সমস্ত সামন্ত প্রভুদের দমন করে নিজের আধিপত্যপ্রতিষ্ঠা করেন, দেশ থেকে অরাজকতা দূর করেন, বহি শত্রু আক্রমণ থেকে দেশ কে রক্ষা করেন। দ্বাদশ শতাব্দীতে গোবিন্দপালের(১১৬১খ্রীঃ-৬৫খ্রীঃ) সঙ্গে সঙ্গে গোপাল প্রতিষ্ঠিত এই পাল বংশের অবসান ঘটে। সুদীর্ঘ চারশো বৎসর ধরে নিরবচ্ছিন্ন একটা রাজবংশের রাজত্ব খুব কম দেশের ইতিহাসেই দেখা যায়।

বৃহত্তর বাংলাকে সংহত ও শক্তিশালী করে গোপাল মারা যাবার পর হাল ধরেন পুত্র ধর্মপাল। তার নেতৃত্বে বাঙালির সামরিক শক্তি তৎকালীন ভারতেরঅন্যতম প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়। তিনি প্রায় সমগ্র পূর্ব ভারতের একের পর এক রাজয় জয় করে এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হন। "কনৌজজয় করার পর এক দরবারের আয়োজন করেন। ঐ দরবারে ভোজ, মৎস্য, মুদ্র, কুরু, যদু, যবন, অবন্তী, মালব, বেরাব, গান্ধার, পেশোয়ার, কীর প্রভৃতি প্রাচীন রাজ্যগুলির রাজাগণ উপস্থিত হইয়া বাঙালি ধর্মপালকে অধিরাজ বলিয়া স্বীকার করেন" - (খালিমপুর তাম্র লিপি)

পাঞ্জাব থেকে নেপাল পর্যন্ত বিস্তৃত বিভিন্ন রাজ্যসমূহ ধর্মপাল জয় করেছিলেন। ধর্মপাল মারা যাওয়ার পর রাজা হন পুত্র দেবপাল। দেবপাল পিতার সাম্রাজ্য আরও বিস্তৃত করেন। হিমালয়ের সানু দেশ হতে আরম্ভ করে বিন্ধ্য পর্যন্ত এবং উত্তর পশ্চিমে কম্বোজ থেকে আরম্ভ করে প্রাগজোতিষ পর্যন্ত তার আধিপত্য স্বীকৃত হতো।

এত বড় সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য বিশাল শক্তিশালী সেনাবাহিনীর প্রয়োজন ছিল। আরবের বণিক পর্যটক সুলেমান তার বিবরণীতে বলেন। "বঙ্গরাজ দেবপালের সৈন্যদলে ৫০০০০ হাতি ছিল এবং সৈন্যদলের সাজসজ্জা ও পোশাক পরিচ্ছদ ধোওয়া, গুছানো ইত্যাদি কাজের জন্যই ১০ থেকে ১৫ হাজার লোক নিয়োজিত ছিল"।

একশ বছরের কম সময়ের মধ্যে ছিন্ন ভিন্ন হতোদ্যম বাঙালি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে শৌর্য বীর্য ও দক্ষতার সাথে বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করেছিল। যার যাদু মন্ত্র ছিল বৃহত্তর বাংলার ঐক্যবদ্ধ শক্তি। এই শক্তির ভিত্তি রচনা করে গিয়েছিলে প্রতিষ্ঠাতা গোপাল।

বাংলার ইতিহাসে পালবংশের আধিপত্যের এই চারশো বৎসর নানাদিক থেকে গভীর ও ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে। বর্তমানের বাঙালি জাতির গোড়াপত্তন হয়েছে এই যুগে। শশাঙ্ক যদিও শুরু করেছিলেন কিন্তু পাল আমলেই বাঙালির রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকাশ লাভ করে এই পাল যুগে। বাংলা ভাষাও লিপির গোড়া খুঁজতে হলে এই চারশো বৎসরের মধ্যে খুঁজতে হবে। এই লিপি, ভাষা, ভৌগলিক সত্ত্বা ও রাষ্ট্রীয় আদর্শকে আশ্রয় করে একটি স্থানীয়সত্ত্বাও গড়ে উঠে এই যুগে।

সেই হাজার বছর আগে পাল রাজাগণ ছিলে অসাম্প্রদায়িক। তারা নিজেরা বৌদ্ধ; অথচ বৈদিক হিন্দু ধর্মও তাদের আনুকূল্য ও পোষকতা লাভ করেছিল। এমনকি একাধিক পালরাজা হিন্দু ধর্মের পূজা এবং যজ্ঞে নিজেরা অংশ গ্রহণ করেছেন, পুরোহিত সিঞ্চিত শান্তি বারি নিজেদের মস্তকে ধারণ করেছেন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মে ব্রাহ্মণের নিয়োজিত হতেন, মন্ত্রী সেনাপতি হতেন, আবার কৈবর্তরাও এই সব পদে স্থান পেত। এইভাবে পালবংশকে কেন্দ্র করে বাংলায় প্রথম সামাজিক সমন্বয় সম্ভব হয়েছিল।

পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও আনুকূল্যে নালন্দা, বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরী, সারনাথের বৌদ্ধ সংঘ ও মহাবিহারগুলিকে আশ্রয় করে আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ জগতেও বাংলা ও বাঙালির রাষ্ট্র এক গৌরবময় স্থান ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল।

এই সকলের সম্মিলিত ফলে বাঙলায় এই সময়েই অর্থাৎ এই চারশো বৎসর ধরে একটি সামগ্রিক ঐক্যবোধ গড়ে উঠে। এটাই বাঙালির স্বদেশ ও স্বজাত্যবোধের মূলে এবং এটাই বাঙালির একজাতীয়ত্বের ভিত্তি। পাল-যুগের এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ দান।” -

এই পরম্পরা মেনে রাজা মহেন্দ্রপাল, কুড্ডলখটকা বৈশ্য (জেলা), এবং পুণ্ড্রবর্দ্ধন ভুক্তি (ডিভিশন) প্রজ্ঞাপারমিতা এবং অন্যান্যদের পূজার জন্যবজ্রদেবকে দায়িত্ব দেন এই বৌদ্ধবিহার গড়ে তোলার জন্য।

তা হলে, এখন প্রশ্ন – এই বৌদ্ধবিহারের খোঁজ কি ভাবে পাওয়া গেল?


দিনটা ছিল, ১৩ ই মার্চ ১৯৮৭। স্থানীয় ভাষায় “ নেউ” খোঁড়া মানে, ভিত তৈরি করার জন্য মাটি কাটা। জগন্নাথ গায়েন তাঁর বাড়ি তৈরি করার জন্য ভিত খোঁড়াচ্ছিলেন।

মাটি কিছুটা কাটার পরেই উঠে এল বিশাল এক তামার পাত। জায়গার নাম, “তুলাভিটা” মালদা জেলার হবিবপুর থানায় পড়ে, (অঞ্চল: বৈদ্যপুর জগজীবনপুর)। শহর ইংলিশ বাজার থেকে দূরত্ব প্রায় ৪১ কি মি। বাংলাদেশের রাজশাহী কাছেই।

এই তামার পাতের ওজন- ১১ কে জি ৯০০ গ্রাম, ১৮ ইঞ্চি লম্বা ও ২২ ইঞ্চি চওড়া।

হিজিবিজি লেখা এই তামার পাতের মূল্য, স্বাভাবিক ভাবেই ওই ভদ্রলোকের জানার কথা নয়।

জগন্নাথ গায়েন একটি স্থানীয় স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ছিলেন।

প্রথমে, এক তামার ব্যবসায়ী এই তামার পাতটি কিনে নিতে চান। কিন্তু, ওই ভদ্রলোকের একটা কিছু মনে হওয়াতে, চলে আসেন ইংলিশ বাজার (মালদা বলে যাকে আমরা জানি) শহরে। সৌভাগ্য বশত মালদার অন্যতম ইতিহাসবিদ শ্রী কমল বসাকের হাতে ওই তামার ফলকটি আসে।

২২ শে সেপ্টেম্বর, ১৯৮৭ সালে, মালদার সংবাদপত্র “ এই মালদা” তে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখে জানান :-

এই তাম্রফলকটিতে সিদ্ধার্থ মাত্রিকা লিপিতে লিখিত। ভাষা সংস্কৃত। গদ্য ও পদ্য দুই ধরণের ধাঁচেই এই লিপি উৎকীর্ণ আছে।

রাজা মহেন্দ্র পালকে আমরা এযাবৎ জেনে এসেছিলাম গুর্জর প্রতিহার বংশের। কিন্তু এই ফলকে লেখাতে সেই ভুল ভাঙে।

এই মহেন্দ্র পাল হলেন বাংলার বিখ্যাত পাল বংশের ৪র্থ রাজা দেবপালের ছেলে। এই বংশ সম্বন্ধে আগে বলে নেই, তা হলে আরও সুবিধে হবে, ব্যাপারটা বুঝতে। -

বাঙালি রাজা শশাঙ্কের গৌড়কে কেন্দ্র করে বৃহত্তর গৌড় তন্ত্র গড়ে তুলার প্রচেষ্টা তার মৃত্যুর পর ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। শশাঙ্কের ধনুকে গুণ টানার মতো বীর অব্যবহিত পরে আর দেখা গেল না। ফলে এর পর সুদীর্ঘ একশত বৎসর(৬৫০ -৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ) সমগ্র বাংলার উপর নেমে আসে গভীর ও সর্বব্যাপী বিশৃঙ্খলা, মাৎস্যন্যায়ের অরাজকতা।


বারোশো বছর আগের এই বৌদ্ধ বিহার নালন্দা থেকেও বড় – এই কথা, আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়া বলেছেন – মাটি খোঁড়ার সময়।

এটা, মালদার গুণিজনেরা ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে স্মারক লিপি দিয়ে অনুরোধ করেন – এটাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হোক, যাতে বিভিন্ন দেশের বৌদ্ধালম্বীরা এসে দেখতে পারেন।
একটা ইংরেজী সংবাদ পত্রের খবর দিই

Statesman (India)

| December 30, 2001 |

STATESMAN NEWS SERVICE MALDA, Dec. 29. - The government's delay in developing a Buddhist pilgrimage site at Jagajibanpur in Habibpur block was due to the lack of infrastructure, the chief minister said.

Speaking to The Statesman during his visit here on Thursday, the chief minister, Mr Buddhadev Bhattacharya, said: "Jagajibanpur is an important excavation site. But due to lack of infrastructure, we are unable to attract the Buddhist pilgrims, particularly the Japanese, to it. They (international Buddhist tourists) only flock to Bihar and return." He assured that the government was "trying to create the necessary infrastructure at the place".

According to Mr Bhattacharya, the completion of excavation work at the site will take some more time. The Archaeological Survey of India is doing the excavation at the site which includes Tulavita, well known during Pala rule. A part of the site falls in Bangladesh. A Bangladeshi archaeologist, Mr Najmul Haque, is also engaged in the task, he pointed out.

After the Jagajibanpur project is completed, Mr Bhattacharya, said the state would feature in the itinerary of the Buddhist pilgrims. The chief minister also assured that the Malda unit of the West Bengal Democratic Writers-Artists' Association will set up a museum in Jagajibanpur.

The association, however, alleged that the then chief minister, Mr Jyoti Basu, too had promised the museum in March 1994, but no initiative has been taken.

It has also demanded that Malda must be covered in the next issue of the West Bengal Magazine published by Information and Cultural Affairs ministry.

If the demand is acceded to, it will be for the first time in 24 years of Left Front rule that Malda will feature in the magazine.

কিন্তু, কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

দুঃখের কথা – মালদার ট্যাক্সি ড্রাইভাররাও তুলাভিটা নামটাও আর জানে না।

যেতে গেলে বলতে হবে- আইহো, বুলবুলচণ্ডীর রাস্তায় মানিকুড়া গ্রাম দিয়ে তুলাভিটা চলুন।

গোটা ঘটনায় ক্ষুব্ধ মালদার স্থানীয় গবেষকরা, বিশেষ করে শ্রী কমল বসাক।

এখন শুধু অপেক্ষা। কেউ জানি না- এই ঐতিহাসিক স্থান আর রক্ষা পাবে কিনা!

এই হলো আমার প্রাণের মালদা বা গৌড়। আমি ইতিহাস বেত্তা নই। তাই সঠিক বিবরণ দিলাম কি না কে জানে! তবে, চেষ্টা করেছি আপ্রাণ!

গৌড়ের দ্রষ্টব্য স্থান নিয়ে প্রচুর বই আছে। মালদা যাবার প্রচুর ট্রেন আছে। গৌড় এক্সপ্রেস/হাটেবাজারে এক্সপ্রেস/ইন্টারসিটি/ জনশতাব্দী / কামরূপ এক্সপ্রেস এবং আরও অনেক ট্রেন। হোটেলও পাবেন প্রচুর।

একটা গাড়ী ভাড়া করে ঘুরে আসুন, এই ঐতিহাসিক স্থান থেকে।



ঋণ:-

কমল বসাক (ঐতিহাসিক)
আর্য চৌধুরী (লোকগায়ক)
শ্রী মলয় ভট্টাচার্য
প্রয়াত মটরাদা- যোগেন্দ্রনাথ মালাকার (লোকগায়ক)
প্রয়াত পন্টাদা- পুণ্যব্রত সরকার (মালদা জেলা স্কুলের ভূতপূর্ব প্রধান শিক্ষক)
প্রয়াত বুজুদা – দুর্গাপদ সেন (মালদা জেলার সিপিআইয়ের ভূতপূর্ব সম্পাদক)
প্রয়াত ধীরেনদা (মালদার এইআইআরের সংবাদ দাতা)
প্রয়াত দুর্গাকিঙ্কর ভট্টাচার্য কাকা (মালদা কলেজের অধ্যক্ষ)
এবং গৌড়ের ইতিহাস, রজনী কান্ত চক্রবর্তী

1 comments:

1

প্রবন্ধ - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ


কেনা বই চেনা বই
দীপারুণ ভট্টাচার্য




।। যাত্রা শুরু ।।

বহু বাঙালি সন্তানের মতোই আমারও শিক্ষা শুরু হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণপরিচয় ও প্রথম ভাগ-দ্বিতীয় ভাগ গ্রন্থ পাঠের মধ্য দিয়ে। এরপর এসেছে স্কুলের বিভিন্ন পাঠ্য বই। পাঠ্যবই ছাড়া অন্য বই পড়া শুরু হয়েছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগে। ছেলেবেলা থেকে উপহার হিসেবে যা বই পেয়েছি তা ছিল খুবই সাধারণ। আর নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বই কেনা ছিল বিলাসিতার সামিল। কিন্তু যে জাতি রবীন্দ্র, বঙ্কিম বা শরৎচন্দ্রকে 'আমাদের' বলতে গর্ব বোধ করে তারা বই কেনার বিরোধিতা করতে পারেনা কোনভাবেই। আমার বই কেনা শুরু হয় এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেই। প্রথমদিকে বই কিনতাম টিফিনের পয়সা জমিয়ে।
তবে সমস্যা ছিল কি কিনব, কেন কিনব বিষয়ে অজ্ঞতা। তখন বলার মতো অভিভাবকও ছিলেন না। কাজেই বইয়ের দোকানে গিয়ে বই কেনা আমার পক্ষে ছিল সত্যিই কষ্টকর। তাই আমার বই কেনা শুরু হয় বইমেলা দিয়ে। সেখানে কলেজস্ট্রিটের মতো কেউ জানতে চান না, "কি দাদা কি বই?" প্রশ্ন শুনেই খানিকটা কুঁকড়ে যেতাম, মনে মনে বলতাম, যদি জানতাম কি বই...!
আমার বইমেলা যাওয়া শুরু ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে, বন্ধুদের সঙ্গে। যেহেতু বই বা নিজের পছন্দ সম্পর্কে কোন ধারণা আমার ছিল না, তাই তখন বই কেনাটা সম্পূর্ণ ভাবে নিয়ন্ত্রিত হতো বইয়ের দামের উপর। এভাবেই ধীরে ধীরে বইমেলা ও কলেজস্ট্রিট থেকে আমি বেশ কিছু বই সংগ্রহ করেছিলাম। এ বাদেও আমার কাছে বইমেলার একটা বড় আকর্ষণ ছিল বইয়ের সঙ্গে সময় কাটানো। 
এমন উদ্দেশ্যহীন ভাবে বই কেনা ও পড়ার মধ্য দিয়েই আমার বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়। কিছুদিন বাদে ভাল-মন্দ বোধ হলে বুঝতে পারি আমি ততদিনে বেশ কিছু আজেবাজে বই পড়ে ফেলেছি। এ নিয়ে আমার মধ্যে একটা দুঃখবোধ কাজ করত। পরে সুনীল বাবুর অর্ধেক জীবন পড়তে গিয়ে দেখি তার অভিজ্ঞতাও আমার চেয়ে খুব বেশি আলাদা নয়, এটা জানার পর এ নিয়ে আর কোনদিন দুঃখ করিনি। 


।। বই রাখা ।।


ধীরে ধীরে বুঝলাম বই কেনার মতো বই রাখাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দর ভাবে গুছিয়ে রাখা, যা দেখলেও মন ভরে। প্রয়োজনের সময় চট করে পাওয়া যায়। সংরক্ষণ ভাল হলে দীর্ঘ দিন বই ভালো থাকে। এই জন্যই চাই বইয়ের আলমারি। স্কুলের লাইব্রেরিতেই আমি প্রথম বইয়ের সুন্দর আলমারি দেখি। তারপর আমার এক মাষ্টার মশাইয়ের বাড়িতে। তাঁর কাছে মাঝে মাঝেই আমি বই চাইতাম। তিনি দিতেনও ভালোবেসে। সমস্যাটা হলো তখন, যখন আমার বন্ধুরাও বই চাইতে শুরু করল। একরকম বাধ্য হয়েই একদিন মাষ্টার মশাই শোনালেন একটা পুরাতন গল্প। এরপর আর কেউ তাঁর কাছে বই চায়নি। তিনি বলেছিলেন, "একজনের বাড়িতে প্রচুর বই। এত বই যে ঘরের মধ্যে চলা ফেরা তো দূরে থাক বসা দাঁড়ানোর ও কোন উপায় নেই। তার এক বন্ধু এসব দেখে বললেন, তুমি একটা বইয়ের আলমারি কেন আনছো না। একথা শুনে ভদ্রলোক মুচকি হেসে বলেন, লোকের বাড়ি থেকে বই আনা যায়, কিন্তু বইয়ের আলমারি তো আর আনা যায় না!"

বিষয়টা যে একেবারেই অসত্য নয় তা সকল বই প্রেমীরাই জানেন। আমার নিজের সংগ্রহেও এমন কিছু বই রয়েছে। আবার আমারও বেশ কিছু বই এমন ভাবেই সংরক্ষিত হয়ে আছে অনেক পুস্তক প্রাণ মানুষের সংগ্রহে। এই জন্যই বই দেওয়ার আগে এক বন্ধু-দাদা খাতায় লিখে সই করিয়ে রাখতেন। তবে যারা এই ভাবে বই সংগ্রহে বিশ্বাস রাখেন তাদের অবশ্য কোন ভাবেই ঠেকানো যায় না। এমনই এক প্রবাসী মানুষ তার পাশের বাড়ির বন্ধুর কাছে বই চাইতে গেলে তিনি বলেন, "তুমি আমার ঘরে বসে যত খুশি পড় কিন্তু বই নিয়ে যেতে দেবো না।" এই ভদ্রলোকও সুযোগ পেলেন একদিন। যেদিন সেই বইয়ের মালিকের ঘাস কাটার যন্ত্রটি খারাপ হলো। এবার চাইতে এলে ভদ্রলোক বললেন, "যন্ত্রটা দিয়ে তুমি আমার বাগানে যত খুশি ঘাস কাটতে পারো কিন্তু নিয়ে যেতে দেবো না।"
নীরদচন্দ্র বাবু তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছেন, "…এই জন্য যে বইগুলো আমার খুব প্রিয়, উহাদের প্রত্যেকটির তিনটি সংস্করণ কিনিয়াছি - একটি ছাপা-বাঁধাই-চিত্রের সৌন্দর্যের জন্য, দ্বিতীয়টি বিদ্বান সম্পাদকের ব্যাখ্যা ও ভাষ্যের জন্য, তৃতীয়টি দৈনন্দিন পড়া ও অন্যকে পড়িতে দিবার জন্য।"

আমার অবশ্য জানা নেই নীরদ বাবুর বইগুলো ফেরত আসতো কি না! তবে তাঁর মতো বই সংগ্রহকারী মানুষ সত্যিই বিরল। তিনি নিজে লিখেছেন, "…এম. এ পড়িবার সময় পাঠ্য বিষয়গুলির যত বই আমার ছিল, আমার অনেক অধ্যাপকের ও তত বই ছিল না। … আমি কখনও নিত্য পাঠ্য বই নিজের না হইলে পড়িতে পারিতাম না। তাই কিনিতাম - এম. এ-র পাঠ্য পুস্তক কিনিবার জন্য পিতা তখন (১৯১৮-২০) আমাকে এক হাজার টাকা দিয়াছিলেন।" সত্যি বলতে এমন গ্রন্থকীট পুত্রের এমন বিত্তবান বাবা থাকাটা কিন্তু খুবই প্রয়োজন।


এক বইমেলা উদ্বোধনে এসে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডাঃ আব্দুল কালাম বলেছিলেন অন্য এক কথা। তিনি বলেছিলেন, প্রতিমাসে কিছু কিছু বই কিনুন। বইগুলো একটা নির্দিষ্ট ঘরে রাখুন এবং রোজ বইগুলোর সঙ্গে কিছুটা সময় কাটান। আপনাকে দেখে আপনার ছেলে মেয়েরাও শিখবে। আর আপনার নাতি নাতনিরা পেয়ে যাবে এক চমৎকার সুন্দর লাইব্রেরি। 
ঢাকায় এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে আমি দেখেছি এমনই একটা সুন্দর লাইব্রেরি। যা তারা তিন পুরুষ ধরে গড়েছেন ধীরে ধীরে। 


তবে, অনেকে আবার সুন্দর করে বই গুছিয়ে রেখেই বেশি আনন্দ পান। এই প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর মশাইয়ের এক গল্প মনে পড়ছে। তিনি যে বিলিতি বই কিনতেন তা বেশ অর্থব্যয় করে বিলাত থেকে চামড়া দিয়ে বাঁধিয়ে আসতো। তাঁর সংগ্রহ বর্তমানে কোলকাতায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে রাখা আছে। অনেকেই বইয়ের জন্য তাঁর এই অপব্যয় বিষয়ে তাঁকে কথা শোনাতেন। একবার এক ধনী বাঙালি বাবু তাঁকে এবিষয়ে বললে তিনি চুপচাপ তার কথা শোনেন। কথা শেষ হলে বিদ্যাসাগর মশাই লোকটির কোর্টের বুকপকেটে রাখা ঘড়িটির সোনার চেনের দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে প্রশ্ন করেন, "এটা কি?" লোকটি বেশ গর্ব ভরে বলেন, 'ঘড়ি বেঁধে রাখার সোনার চেন।' তখন বিদ্যাসাগর মশাই বলেন, "ঘড়ি কি দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না।"


ভালোবাসার আর পাঁচটা জিনিসের মতো বইকে কতটা যত্ন করা উচিত তা কিন্তু পুস্তক প্রেমীরাই জানেন।


।। বই পড়া ।।


একটা সাইন বোর্ডের গল্প পড়েছিলাম। তাতে লেখা ছিল, "সন্ধের পর বাঁদিকের রাস্তা ব্যবহার করবেন না। পথে বন্য প্রাণী আক্রমণ করতে পারে। যারা পড়তে পারেন না তারা উল্টো দিকের মুচির দোকান থেকে জেনে নিন।" এই সাইন বোর্ডের মতোই শিক্ষাহীন মানুষের কাছে এই সব বইয়ের আলোচনা অর্থহীন।


ভারতের স্বাধীনতার বয়স ৭০ বছর পেরিয়ে গেছে। তবুও দেশ থেকে নিরক্ষরতার অন্ধকার আমরা দূর করতে পারিনি। ১৯৪৭ সালে দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ১২% আজ (২০১৭) ৭৪% । এই পরিসংখ্যান আমাদের আনন্দ দিতে পারে কিন্তু ভাবতে হবে, আমরা বিশ্ব স্বাক্ষরতার (৮৪%) থেকে এখনও অনেকটা পিছিয়ে। তার থেকেও বড় কথা হলো ২০১৭ সালে ২৬% নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা ১৯৪৭ সালের ৮৮% নিরক্ষর মানুষের সংখ্যার থেকে বেশি। অর্থাৎ কিনা ব্রিটিশ ভারত থেকে এখন বেশি সংখ্যক নিরক্ষর মানুষের বাস আমাদের ভারতে। তাই আমাদের দেশে পুস্তক প্রেম বিষয়টা এক অংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বিজন কুমার ঘোষ, তাঁর 'বাজার সরকারের ডাইরি' বইতে লিখেছেন, "পৃথিবীর সবচেয়ে বই-পড়ুয়া দেশটি হল ফ্রান্স। শতকরা একশো ভাগই শিক্ষিত। শ্রেষ্ঠ সাহিত্য গঁকুর পুরস্কার প্রাপ্ত বই নিয়ে সেখানে বাবুর সঙ্গে পরিচারিকার আলোচনা হয়।"


এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের দেশে ঠিক কতগুলো বই বিক্রি হয়? বাংলা ভাষার বইয়েরই বা বিক্রি সংখ্যা কত? সত্যি বলতে আমাদের বইয়ের বাজার এখনও স্বাবলম্বী নয়। পাশাপাশি রয়েছে বইয়ের কালো বাজারি। তাই সংখ্যাটা সঠিক ভাবে কেউ বলতে চান না। বইয়ের ISBN রেজিস্ট্রেশন থেকে জানা যায়, এদেশে গড়ে প্রতি বছর ৯০,০০০ নতুন বই প্রকাশিত হচ্ছে। তবে ISBN এখনও বাধ্যতামূলক নয় বলে প্রকাশ সংখ্যাটা ৯০ হাজার থেকে অনেক বেশি হবে বলেই আমার ধারণা। উন্নত দেশের দিকে তাকালে একটা সংখ্যা পাওয়া যায়। আমেরিকায় ২০১৫ সালে ৬৫ কোটির কিছু বেশি বই বিক্রি হয়েছিল। সে দেশের জনসংখ্যা ৩০ কোটি। অর্থাৎ মাথাবিচ্ছু বছরে দুটি বই। আমরাও একদিন বই কেনা ও পড়াতে আমেরিকা বা ফ্রান্সকে ধরতে পারবো; এই আশাতেই গ্রন্থ প্রেমীদের বেঁচে থাকা।


।। বই উপহার ।।


নীরদ চন্দ্র চৌধুরী লিখেছেন, "বই হল বউয়ের মতোন। একবার ভালো বাসিলে তাহাকে ছাড়িয়া যাওয়া কঠিন।" একথার সত্যতা বই প্রেমীরাই অনুভব করেন। হয়তো এই অনুভূতি সঞ্চারিত করার জন্যই তারা বই উপহার দিয়ে থাকেন প্রিয় মানুষদের। তবে বই উপহার পাওয়া ও দেওয়ার কিছু সমস্যা রয়েছে। আমার বড় পিসি সম্পূর্ণ রবীন্দ্ররচনাবলী আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। সে আমার জীবনের প্রথম পাওয়া বড় সম্পদ। এ বাদে বিভিন্ন সময়ে বন্ধু বান্ধব বা প্রিয় মানুষদের থেকে বই উপহার পেয়েছি। কবিতা আবৃত্তি করেও বই উপহার পেয়েছি কয়েকবার। এমন বই বেশ কয়েকবার পেয়েছি যা আমার সংগ্রহে আগে থেকেই ছিল। তবু উপহারের মর্যাদা দিয়ে তাকে তুলে রেখেছি যথাস্থানে। কিন্তু সবাই বোধহয় এভাবে ভাবেন না। 


বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতে। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় এই ফুটপাত থেকেই কিনি ম্যাক্সিম গোর্কির মা ও ইস্পাত এবং আরও অনেক অনুবাদ সাহিত্য। এই ফুটপাতেই কাফকার মেটামরফসিস বইটা হাতে নিয়ে বেশ অবাক হয়েছিলাম। যখন দেখলাম, কোন এক রাজুকে দেওয়া রাঙাদাদুর উপহার বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ফুটপাতে এসেছে আবার বিক্রি হতে। 


ফুটপাত থেকেই 'সেই সময়' বা 'লোটা কম্বল' এর মতো বই আমি সংগ্রহ করেছিলাম। কিন্তু আশ্চর্য হলাম যখন কিনলাম সুকুমার রায় সমগ্র। বইটি আমারই বড় পিসি উপহার দিয়েছিলেন তাঁরই ছাত্র সুগত দাশকে। বাড়ি এসে পিসিকে বইটা দেখাতেই বেশ কষ্ট পেলেন। যেন বলতে চাইছিলেন, 'সুগত তুমিও…'।


নতুন বইয়ের পাশাপাশি কলেজ স্ট্রিটের পুরোনো বইয়ের বাজার কিন্তু নেহাৎ ছোট নয়। বহু ছাত্র-ছাত্রীরা এই বাজার থেকে পাঠ্য বই সংগ্রহ করেন। ২০১০ সালের The Telegraph কাগজের এক প্রতিবেদনে জানাচ্ছে কলেজ স্ট্রিট ও সংলগ্ন অঞ্চলে পুরোনো বইয়ের বাজার বছরে ব্যবসা হয় কমপক্ষে ৭-৮ কোটি টাকার মতন।


একটা গল্প দিয়ে উপহার পর্ব শেষ করা যাক। জনৈক কাকা এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গেলেন তার ভাইপোর জন্মদিনের উপহার কিনতে। দোকানদার বিভিন্ন জিনিস দেখালেন। কিন্তু কাকা কিছুই পছন্দ করতে পারলেন না। সবেতেই বললেন, "এটা ওর আছে।" শেষে বিরক্ত হয়ে দোকানদার বললেন, "ভাইপো'কে বরং বই উপহার দিন, স্যার।" একটু ভেবে কাকা বললেন, "বই, বাড়ীতে সে ও আছে বেশ কয়েক খানা!"


।। বই সাজানো ।।


বই মূলত লোকেরা কেনেন শিক্ষা, আরাম, আনন্দ ও ঘর সাজাবার জন্য। ছোটবেলা এক আত্মীয়ের বাড়িতে দেখতাম দেওয়াল জোড়া কাঁচের আলমারি ভর্তি রবীন্দ্র, বঙ্কিম, শরৎ, বিভূতি, তারাশংকর রচনাবলী। কিন্তু সে বাড়িতে কাউকে কখনো বই পড়তে দেখিনি। একবার একটি বই চাইলে ভদ্রলোক বেশ বিব্রত বোধ করেন। পরে সংকোচের সঙ্গে বলেন, "আলমারির চাবি হারিয়েছে অনেকদিন। নানা কাজে নতুন চাবি তৈরি করা হয়নি।"


গতবছর দিল্লির বইমেলার এক দোকানে জনৈকা ভদ্রমহিলা সুচিত্রা ভট্টাচার্য ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বেশ কয়েকটি বই এক সঙ্গে নেবেন বলে খুব দরাদরি করতে শুরু করেন। শেষে তার চাহিদা ও বিক্রেতার শেষ দরের মধ্যে ৫০টাকার পার্থক্য রয়েই গেল। তাই তিনি বই না নিয়েই চলে গেলেন। দোকানে বসা মানুষটি আমার পরিচিত। বললাম, "দিয়ে দিলেই পারতেন, মাত্র ৫০টাকার জন্য!" ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে তিনি বললেন, "ভারি তো ঘর সাজাবে।" প্রশ্ন করলাম, "কি করে বুঝলেন?" তিনি বলেন, "ও আমি চোখের ভাষা বুঝি, কত বছর হলো বলতো!" 


বেশ মোটা বই না হলে, ঠিক ঘর সাজানো যায় না। তাই সাজাবার বাজারে রচনাবলী বা সমগ্রের চাহিদাই সব থেকে বেশি। তবে এটা ভাবলে ভুল হবে যে এই স্টাইল আজকালকার। ভবানী চরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত, কলিকাতা কমলালয় (১৮২৩) গ্রন্থে এই বিষয়ে এক চমৎকার সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়:
" বাবুসকল নানা জাতীয় ভাষায় উত্তম উত্তম গ্রন্থ অর্থাৎ পার্সি ইংরাজি আরবি কেতাব ক্রয় করিয়া কেহ এক কেহ বা দুই গেলাসওয়ালা আলমারির মধ্যে সুন্দর শ্রেণী পূর্বক এমত সাজাইয়া রাখেন যে দোকানদারের বাপেও এমন সোনার জল করিয়া কেতাব সাজাইয়া রাখিতে পারেনা, আর তাহাতে এমন যত্ন করেন এক শত বৎসরেও কেহ বোধ করিতে পারেননা যে এই কেতাবে কাহারো হস্ত স্পর্শ হইয়াছে। অন্য পরের হস্ত দেওয়া দূর থাকুক জেলদগর (বাইন্ডার) ভিন্ন বাবুও কখনো হস্ত দেন নাই, এবং কোনোকালেও দিবেন এমত শুনা যায় না।" 
এইসব ধারাবাহিকতা পেরিয়ে এসেছে আজকের ইন্টারনেটের লেখালিখি, ই-বুক, ব্লগ ইত্যাদি। এ এক অন্য জগৎ। অনেক সুবিধা অসুবিধার মধ্যে এর বিশেষ অসুবিধা হলো এসব দিয়ে কোনভাবেই ঘর সাজানো সম্ভব নয়!


কেউ কেউ বলেন বর্তমান ইন্টারনেটভিত্তিক লেখালিখির ফলে বইয়ের বিক্রি কমেছে। কিন্তু ইন্টারনেটভিত্তিক সংস্থা যখন বইপ্রকাশে মন দেন কিম্বা ফেসবুকে বারবার পড়া গল্পগুলো গ্রন্থ আকারে প্রকাশ পাওয়ার পর যখন তা এক বইমেলাতেই এক সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায় তখন বিশ্বাস হয় ছাপানো বইই এখনো পর্যন্ত মূল মাধ্যম আর ইন্টারনেট তার সহায়ক মাত্র। লেখাটি শেষ করি শ্রী নীরদচন্দ্র চৌধুরীর একটি পরিচিত উক্তি দিয়ে - "বই কিনিয়া পড়া বিবাহ করিবার মত, ধার করিয়া পড়া বারবনিতার গৃহে যাইবার তুল্য।"
এই মন্তব্য আজও কতটা সঠিক সে অবশ্য পাঠকেরাই বিচার করবেন।

1 comments: