0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক


জলরেখা 
নন্দিনী সেনগুপ্ত



২৩ 

‘না নিরূপদা, এত তাড়াতাড়ি কোনও রিপোর্ট দিতে পারব না। তুমি ফিরে যাও। তার মধ্যে রেডি না হলে এক কপি রিপোর্ট একদম রেজিস্টার্ড পোস্ট করে দেবো।’ ল্যাবরেটরিতে টেস্ট টিউবে স্যাম্পল গুছিয়ে নিতে নিতে বলতে থাকে শুভ। শুভ নিরূপের কলেজের এক্স-স্টুডেন্ট এবং দুই ব্যাচ জুনিয়র। সেই সূত্রে ওকে দাদা বলে ডাকে। তবে শুভর বিষয় ছিল রসায়ন, আর নিরূপের ভূতত্ত্ব। শুভ ছাত্রজীবনে রাজনীতি করত এবং কিচ্ছু পড়াশুনা করত না; বলিয়ে কইয়ে হিসেবে বেশ নামডাক ছিল। কলেজজীবনে একটা খুব খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল শুভ। বাবা মারা যায় হঠাৎ এবং কলেজে অনার্সও কাটা যায়। সেসময় নিরূপ এবং আরও কিছু সিনিয়র দাদা দিনের পর দিন শুভকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে ফেরত নিয়ে আসে পড়াশুনার মধ্যে। 

শুভ বলছিল ‘আজো ভুলিনি নিরূপদা, তুমি বলেছিলে ‘আগে নিজের পা শক্ত করে দাঁড়া। সেটা করতে গেলে আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের পড়াশুনা ছাড়া গতি নেই’। ’ 

ওদের বহুদিন পরে দেখা হলো হেড অফিসে এসে। ওরা দুজনেই বারে বারে অতীতের কথা বলছিল। কলেজে ছাত্রাবস্থার ফেলে আসা সেই সোনালি দিনগুলো নিয়ে ওরা অনেকক্ষণ কথা বলার পরে কাজের কথায় ঢুকেছিল। অতীতচারিতা নিরূপকে বেশি আচ্ছন্ন করে রাখে, সেই কারণে ও যে কাজের কথা নিয়েই শুভর ল্যাবে এসেছে, সেটা বলতে অনেকটা সময় লাগিয়ে দেয়। শুভ হেসে খুন, ‘উফফ, পারো বটে! ডেটা দরকার, সেটা বলতে এত কিন্তু কিন্তু করছ কেন? আরে বাবা, তোমার মতো সায়েন্টিস্টের সাথে পেপার ছাপা হলে কলার উঁচু করে ঘুরব, ব্যস!’ 

নিরূপ দ্বিধাগ্রস্ত ভঙ্গীতে হাসে। সে নিজেই জানে না সে কেমন সায়েন্টিস্ট। সে কাজ ছাড়া আর কিছু পারে না, তাই! প্রতি দিন শুনতে হয়, এটা নেই, সেটা নেই। কাজ করার পথে প্রতিদিন অজস্র বাধা আসে। পরিস্থিতি মনে করিয়ে দেয় যে সে একজন তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক। বিজ্ঞানচর্চা বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়।

নিরূপ বলে, ‘দ্যাখ না, যদি এই স্যাম্পলগুলো, এই যে যেগুলো হাইলাইট করে রেখেছি, সেগুলো যদি, ... মানে একটা ওভারভিউ অন্তত দে... ডিটেইল নাহয় পরে দিস!’ 

শুভ বলে, ‘ওকে, হ্যাঁ, সেটা পারব মনে হচ্ছে! আচ্ছা, নিরূপদা, এদ্দিন পরে এলে, থেকেই যাও না আর কটা দিন! তাহলে একেবারে সব ডেটা দিয়ে দেবো!’ 

নিরূপ হাসে, ‘না রে, ওই অফিসে সেরকম কেউ নেই। কাজ ঝুলে যাবে। তাছাড়া এই প্রজেক্টটা সেভাবে শিডিউলের মধ্যেই ছিল না। ঘুরে ঘুরে গ্রামের ব্যাপারস্যাপার দেখে একটু জড়িয়ে গেছি। এখন একটা গতি না করলেই নয়। বেশিদিন থাকতে পারছিনা। আজ বিকেলে হুগলী যাবো। ওখানে তিনদিন থেকে শুক্রবার সকালে সোজা এখানে এসে তোর থেকে ডেটাগুলো নিয়ে নেবো। ওইদিন রাতেই ট্রেন। পরদিন বিকেলের আগে পৌঁছাতে পারছিনা। আর যদি লেট হয় ট্রেন... নিরূপ হাত উলটায়। 

শুভ আশ্বাস দেয়, ‘দেখি, এর মধ্যেই চেষ্টা করছি। কিছু ডেটা এর মধ্যে অবশ্যই দিতে পারব।’

‘থ্যাঙ্কিউ রে!’ নিরূপ শুভর সাথে করমর্দন করে ল্যাবের দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসার আগে আবার ফিরে তাকিয়ে হাত নেড়ে বলে, ‘দেখা হবে!’ 

নিরূপ সবার সাথেই সাধারণত সৌজন্যমূলক ব্যবহার করে। আইয়মের কাছ থেকে চলে আসবার সময়ও একবার ফিরে দেখবার ইচ্ছে হয়েছিল তার। আইয়ম পিছন ফিরে বসেছিল। ব্যস্ত ছিল রান্নাঘরে কী যেন কাজে। নিরূপ ইচ্ছে করেই ওর মুখোমুখি দাঁড়ায়নি। নিরূপ বাচ্চাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে বলে বেরিয়ে এসেছিল। না, একবারও পেছনে ফিরে তাকায়নি। সব ব্যবস্থা করাই ছিল। হেঁটে, ভীষণ শান্তভাবে হেঁটে এসে পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে নিচে নেমে এসে ও গাড়িতে উঠেছিল। ওর ভয় হচ্ছিল ওকে কেউ দেখল কি না! কিংবা কেউ বেবি লিরকে দেখে ফেলল কিনা! না, কেউ দেখেনি। একঘণ্টা ড্রাইভ করে সোজা এয়ারপোর্ট! মুক্তি... হ্যাঁ, মুক্তি মনে হয়েছিল ওর। এমনকি বেবি লির, মানে নীরদা, তখন অল্প অল্প বুলি ফুটেছে তার মুখে, সেও কী খুশি ছিল! একটুও কাঁদেনি। মুখ দিয়ে বু বু আওয়াজ করছিল আর আঙ্গুল তুলে চারদিক দেখাচ্ছিল। বাচ্চাটা কি বুঝতে পারেনি যে ওকে ওর মায়ের কাছ থেকে আলাদা করে দেওয়া হলো? প্লেনে উঠেই ফ্লাস্কে রাখা দুধ বের করে নিরূপ খাইয়ে দিয়েছিল ওকে; ওয়শরুমেও নিয়ে গিয়েছিল একবার। ব্যস, নিরু ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভেঙ্গেছিল একেবারে কলকাতার বাড়িতে বিহ্বল ঠাম্মার কোলে শুয়ে। এষা বিব্রত, বিহ্বল বোধ করছিলেন। তার পরে সব সামলেও নিয়েছিলেন খুব অল্প সময়ের মধ্যে। অদ্ভুত ক্ষমতা আছে মায়ের! ভাবছিল নিরূপ। যাবে সে, আজ বিকেলেই যাবে। মায়ের সামনে গিয়ে, নিরুর সামনে গিয়ে তাকে তো দাঁড়াতেই হবে। সে হয়ত সেভাবে কোনও কাজেও আসবেনা তাদের। তবুও, সামনে গিয়ে তো একবার বলতে হবে যে সে ভুল করেছে বিভিন্নসময়। ভুলগুলো সেভাবে শোধরানো যাবেনা আর হয়ত কোনওদিন। চেষ্টা করতে গেলে আরও জটিল হয়ে যেতে পারে পরিস্থিতি। 

হ্যাঁ, বাঘেলখোট আর ধুন্ধুয়া গ্রামেও এখন পরিস্থিতি জটিল। যে লিস্টটা নিরূপ একটু আগে শুভর কাছে দিয়ে এসেছে, সেখানে ওই গ্রামের ব্লকগুলি থেকে আনা স্যাম্পলগুলো হাইলাইট করা আছে। ওই অঞ্চলের মানুষের হাড়ের অসুখের রিপোর্ট সবচেয়ে বেশি। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে যেতে পারে, যদি চাপাকলগুলো সিল করে দেওয়া হয়। মানুষ কোথা থেকে জল পাবে? হয়ত বা সবগুলো ব্লকের চাপাকলের জলে বিষ মিশেছে। মিশছে পাথুরে মাটির থেকেই। আসলে ওখানকার প্রকৃতি চায় না যে মানুষ ভূগর্ভের জল বের করে নিক। অল্প রয়েছে জলভাণ্ডার। যেটুকু আছে, সেটুকু অরণ্যের জন্য প্রয়োজন। মানুষের ওখানে যাবার কথাই ছিল না। মানুষ কেন গেল? ঝর্ণা আর নদীর ধার থেকে সরে গেল কেন? কেন নষ্ট করল অরণ্য? আরও ভূমির প্রয়োজনে? আরও বেশি বেশি চায় মানুষ? নিজের চাহিদার জন্য ভুল করে হয়ত। সেই ভুল সবসময় শোধরানো মুস্কিল হয়ে যায়। ভুল বাড়তে থাকে, হয়ে ওঠে পাহাড়প্রমাণ এবং তা একদিন গিলতে আসে মানুষকেই। 

0 comments: