0

প্রাচীন কথা - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


প্রাচীন কথা


সরস্বতী কুমার
অনিন্দিতা মণ্ডল


সদ্য রাজা রামপাল পুত্র কুমারকে সিংহাসনের ভার দিয়েছেন। তাঁর সমস্ত জীবন রাজ্যের নানা প্রান্তে বিদ্রোহ দমন ও শত্রুদের শায়েস্তা করতে কেটেছে। এখন এই ১১৩০ সালে তাঁর মনে জেগেছে অবসরের চিন্তা। শেষ পর্যন্ত গৌড় রাজ্য পুনরুদ্ধারের পর রাজা রামাবতীতে রাজধানী স্থাপন করেছেন। বরেন্দ্রভূমির জলবায়ু মনোরম নাতিশীতোষ্ণ। বৃদ্ধ মহারাজ রাজকার্য থেকে সরে এসে ধর্মেকর্মে মন দিয়েছেন। নগরীর কেন্দ্রে মহারাজ নির্মাণ করিয়েছেন এক মহাবিহার, জগদ্দল পদ্ম মহাবিহার। এখানে অবলোকিতেশ্বর ও মহাতারা প্রতিষ্ঠিত। মহাযান ধর্মের দুই আরাধ্য। 
আপাতত বিহারের দ্বারপণ্ডিত আচার্য মোক্ষকর গুপ্ত তর্কভাষা নামে বৌদ্ধ ন্যায়ের গ্রন্থ রচনা করছেন। আচার্য দানশীল তিব্বতী ভাষায় বৌদ্ধ শাস্ত্রে অনুবাদ করছেন। সমস্ত বিহার জুড়ে ভাবগম্ভীর পরিবেশ। শ্রমণ ছাত্র সব দূর থেকে সমীহ ভরে মহাপণ্ডিত আচার্যদের লক্ষ করছেন। নিজেদের অধ্যয়নের সঙ্গে সঙ্গে এঁদের আলোচনা শুনছেন। কখনও কখনও শিবিকা করে বৃদ্ধ রাজা রামপাল আসেন বিহারে। বিশেষ বিশেষ তিথিতে পূজা আরাধনায় যোগ দেন। 
নতুন রাজা কুমারপাল বয়সে নবীন নন। যৌবন অতিক্রান্ত বয়সেই তিনি সিংহাসনে বসেছেন। রাজা হবার পর থেকেই পাল সাম্রাজ্যের চারিদিকে শত্রুর আক্রমণ তাঁকে বড়ই বিব্রত করে। ইতিমধ্যে তিনি বিব্রত আছেন দক্ষিণের সামন্তরাজার বিদ্রোহ ঘোষণায়। সকলেই ভাবছেন কুমার এই বিদ্রোহ দমনে অসমর্থ। কিন্তু কুমারের যে বহুমুখী প্রতিভা! 
প্রধান অমাত্যকে নিয়ে কুমার এসেছেন সপ্তগ্রামে। রাজ্যের প্রধান বন্দরনগর। এখান থেকেই বানিজ্য নৌবহর পাড়ি দেয় বিদেশে। হাজার বছর আগেকার সরস্বতী, যার মোহনায় ছিল সেদিনের তাম্রলিপ্তি বন্দর, তা সরতে সরতে দক্ষিণ পূবে ভাগীরথীর কাছে চলে এসেছে। তাম্রলিপ্তি তার নাব্যতা হারিয়েছে। মোহনা থেকে সাগর সরে গিয়ে নদীবাহিত পলির সঞ্চয়ে চর তৈরি হয়েছে, ক্রমে তা বাসযোগ্য ভুমি হয়েছে। তাম্রলিপ্তির স্থানে এখন সপ্তগ্রাম প্রধান বাণিজ্যবন্দর । সেই সরস্বতীর তীরেই । কুমার ভাবেন, এমন একদিন আসবে যেদিন সরস্বতীর খেয়ালখুশিতে সপ্তগ্রামও নাব্যতা হারাবে। কিন্তু এখন সপ্তগ্রাম সম্পন্ন নগর। চারিদিকে বৌদ্ধ ও হিন্দু বিহার মন্দিরের ছড়াছড়ি। প্রহরে প্রহরে শঙ্খ ভেরীর শব্দ ওঠে। অর্ণবপোতের আসাযাওয়া, বন্দরের কর্মচঞ্চল গতি তাঁকে আনন্দ দেয়। নদীতীরবর্তী রাজপ্রাসাদে বসে এখন কুমার দক্ষিণের বিদ্রোহ দমনের কর্মসূচী প্রস্তুত করছেন। 
এখনি কতগুলি নৌযান চাই। যুবরাজ থাকার সময়ে তিনি ছিলেন নৌবাহিনীর দায়িত্বে। ফলে জাহাজ নির্মাণ সম্পর্কে তাঁর বিশেষ জ্ঞান আছে। অমাত্য বৈদ্যদেব তাঁর সহকারী। সপ্তগ্রামের বণিক সম্প্রদায়ের কাছে কুমার জনপ্রিয় । আসন্ন যুদ্ধযাত্রায় তাঁর যে পরিমান জাহাজ ও নৌযান চাই তা যদি শ্রেষ্ঠীদের থেকে নিতে হয় তবে তাঁরা তা খুশিমনেই দেবেন। কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষতি বিপুলাকার ধারণ করবে। তা কুমার চাননা। অতএব কয়েকটি জাহাজ নির্মাণ করাতে হবে। কারণ দক্ষিণ দেশ অজস্র নদী মোহনায় পূর্ণ। জলের স্রোত সেখানে ধরিত্রীকে অসংখ্য শিরা উপশিরায় ঢেকে রেখেছে। জলযান ছাড়া সেখানে অভিযান অসম্ভব। অমাত্য এই ব্যপারে সপ্তগ্রামের বন্দর অঞ্চল ছাড়িয়ে অপেক্ষাকৃত নির্জন স্থানের সন্ধান করছেন। কুমার কোনও ভাবেই সপ্তগ্রামের দৈনন্দিন অর্থনীতিকে আঘাত করতে চান না। অবশেষে অমাত্য সংবাদ এনেছেন। ত্রিবেণীর সঙ্গমে সরস্বতী ও ভাগীরথীর মিলনে যে বিস্তার ঘটেছে, সেখানে এই কর্মযজ্ঞের আয়োজন করা যেতে পারে। 
সন্ধ্যার স্তিমিত দীপালোকে কুমার উপবিষ্ট সরস্বতী তীরের রাজপ্রাসাদে। সামনের বাতায়ন থেকে দেখতে পাচ্ছেন আপাত শান্ত সপ্তগ্রামের বন্দর। মনে তাঁর নানা অনুভূতির জোয়ার। বিগতযৌবন রাজা তিনি। দক্ষিণের বিদ্রোহ দমনে কতটা সফল হবেন কে জানে! সম্রাট রামপালের ন্যায় দুর্ধর্ষ বীর তো তিনি নন! তাঁর বিদ্যা অস্ত্রে নয়, স্থাপত্যে নৌনির্মাণে, নৌবানিজ্যে, ইত্যাকার বিষয়ে। তাই জগদ্দল পদ্মবিহারে শেষ বুদ্ধপূর্ণিমায় উৎসবে যোগদান করেছিলেন যখন, একান্তে নিজের মনের কথা জানিয়েছিলেন আচার্য মোক্ষকর গুপ্তকে। আচার্য জ্ঞানী। কুমার পদ্মবিহারের মূল ছাতটির অসাধারণ রূপকার! আচার্য তাঁর এই প্রতিভার ব্যপারে বিশেষ স্নেহশীল। তিনি কুমারের এই মনঃকষ্টের কথা অনুভব করেছিলেন। কুমার প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানের সাধক। জ্ঞানের নানা বিচিত্র বিষয়ে তাঁর মেধা ধাবমান। এমন কুটিল কাজ তাঁকে দিয়ে কি হয়? কিন্তু রাজ্যরক্ষা আশু প্রয়োজন। আচার্য সান্ত্বনা দিয়ে বললেন – মহারাজ কুমার, আমি দেখতে পাচ্ছি আগামী অভিযানে আপনি দক্ষিণের বিদ্রোহ আয়ত্ত্ব করতে সক্ষম হবেন। এ যেমন সত্য, তেমনই আপনার বহুদিনের লালন করা একটি বাসনা পূর্ণ হবে। কুমারের চোখে জিজ্ঞাসা দেখে তিনি স্মিত হেসে বলেছিলেন – না, মহারাজ। অবলোকিতেশ্বর আমাকে ভবিষ্যৎ দর্শনের অলৌকিক ক্ষমতা এখনও দেননি। আমি শুধু অভ্রান্ত অনুমান করতে পারি। আপনার বহুগামী মেধার কথা জানি। কিন্তু কোন বিশেষ বিষয়ে সেই মেধার প্রয়োগ ঘটবে, আপনি আপ্তকাম হবেন, তা জানিনা। তবে নিঃসংশয়ে অভিযানের উদ্যোগ করুন। জয় নিশ্চিত। 
এত বড় আশীর্বাদকে পাথেয় করে এসেছেন কুমার। ওপরে ওপরে শান্ত দেখালেও ভিতরে এক অদম্য উৎসাহ অনুভব করছেন। সরস্বতীর দুই পারে মাঝে মাঝে উজ্জ্বল দীপ ও শঙ্খধ্বনি শোনা যায়। জাহাজ এসেছে বন্দরে। কোথাও নোঙর ফেলা জাহাজে পণ্য তোলা হচ্ছে। ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় পণ্য চলেছে। দেখতে দেখতে কুমারের মনে যেন সাগরের মায়া ছড়ায়। আহা, যদি রাজপুত্র না হয়ে বণিকপুত্র হতেন! যদি তুলা কাপাসবস্ত্র নিয়ে পাড়ি দিতেন দূর দেশে! তাঁর চিন্তায় ছেদ পড়ে। দ্বাররক্ষী এসে জানায়, অমাত্য বৈদ্যদেব এসেছেন। অমাত্য আসন গ্রহণ করতেই রাজা জানতে চাইলেন- অমাত্য, কতগুলি জাহাজ সংগ্রহ করা গেল? অমাত্য কুণ্ঠার সঙ্গে জানালেন, মহারাজ, এখন বাণিজ্যের কাল। সবে শরত সমাগত। বণিক শ্রেষ্ঠীদের জাহাজগুলি নিয়ে এসময়ে যুদ্ধের জন্য ব্যবহার করলে সমূহ আর্থিক ক্ষতি। আমাদের নিজস্ব জাহাজ যা আছে তা অভিযানের জন্য অপ্রতুল। দক্ষিণ হল জলের দেশ। শিরা উপশিরার মত অসংখ্য নদী এই দেশকে প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ দিয়েছে। এখানে অভিযান করতে হলে যথেষ্ট পরিমানে উন্নত প্রযুক্তির জাহাজ না হলে অভিযান করা বৃথা। মহারাজ চিন্তিত হলেন। তবে উপায়? 
সেদিন রাত্রে নিদ্রিত রাজা একটি স্বপ্ন দেখলেন। দেখলেন দুটি অলোকসামান্যা সুন্দরী কন্যা হাত জড়াজড়ি করে, রঙ্গ পরিহাস করতে করতে চলেছে। একসময়ে তারা বিচ্ছিন্ন হলো। একটি কন্যা প্রাসাদসংলগ্ন সরস্বতীর তীরে এসে অদৃশ্য হয়ে গেল। ওপর কন্যাটি মকরবাহিনী হয়ে পূবে যাত্রা শুরু করল। নিশান্তে মহারাজের মন প্রসন্ন হয়ে উঠল। স্বপ্নের যেন এক গূঢ় অর্থ পাচ্ছেন! অমাত্যকে ডাক দিলেন। জানতে চাইলেন – এখন সরস্বতীর ভগ্নীসমা, ভাগীরথীর বুকে কত জল অমাত্য? অমাত্য এমন অদ্ভুত প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেননা। হেসে বললেন, কেন মহারাজ? ভাগীরথী পূর্বে ক্ষীণকায়া ছিল বটে, তবে এখন বর্ষাশেষে সেটি স্ফীতা বলে অনুমান করি। মহারাজের দুটি চোখ উজ্জ্বল, আচ্ছা ভদ্র, মকরবাহিনী কন্যা কে? অমাত্য জানেন হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী ইনি ভাগীরথী। কিন্তু প্রশ্নের কারণ অনুমান করতে পারছেন না। মহারাজ নিজেই উত্তর দিলেন। হ্যাঁ, ভদ্র বৈদ্যদেব, ভাগীরথী মকরবাহিনী। সরস্বতীর নির্দেশ অনুযায়ী বলশালিনী ভাগীরথীর পূর্ব তীরে একটি স্থান নির্বাচন করতে হবে। সেখানেই আমি একটি নৌবিতান স্থাপনা করব। দুই পক্ষকালের মধ্যে আপনাকে যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত কয়টি নৌযান উপহার দেবো, কথা দিলাম। বৈদ্যদেব বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিলেন, মহারাজ, ভাগীরথীর পূর্বতীর কোটাটবীর চেয়েও বেশি বনাকীর্ণ। হিংস্র পশুর বাস। আটবিক উপজাতির বাস। সেখানে নৌনির্মাণ কেন্দ্র স্থাপনা কি বিবেচনার কাজ হবে মহারাজ? তার চেয়ে সপ্তগ্রামের পরিবেশই তো অনুকূল মহারাজ! মহারাজ হাসলেন। না ভদ্র। সপ্তগ্রামে নৌনির্মাণকেন্দ্র স্থাপন করে তাকে আর অধিক বিব্রত করবনা। আপনিই ত বলছিলেন, এ হল বাণিজ্যের কাল। বন্দর এখন বড়ই ব্যস্ত। আপনি তাম্রলিপ্তির ভাগ্যের কথা স্মরণ করুন। প্রার্থনা করব সপ্তগ্রামের যেন এমন দুর্দশা না হয়। 
সত্যই সরস্বতী আর ভাগীরথীর মিলনস্থলে, কিছু দক্ষিণে, ভাগীরথীর পূর্বতীরে, যেখানে নদীখাত গভীর ও প্রশস্ত, নাব্যতা যথেষ্ট, সেখানে মহারাজ কুমার স্থাপন করলেন একটি নৌবিতান। না, অমাত্যের কথা সত্য নয়। এখানে প্রচুর মানুষের বাস। এরা ধর্মে হিন্দু। ভাগীরথীর পূণ্যস্রোত নাকি এদের পাপ ক্ষয় করে। অনেকেই এ নিয়ে উপহাস করছেন। কিন্তু পালরাজাদের রক্তে পরধর্ম সহিষ্ণুতা। 
রাতারাতি সহস্র কারিগর নিয়োগ হলো। মহারাজের তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠল অপূর্ব নৌবিতান। স্থানটির নতুন নামকরণ হলো। কুমারহট্ট। পরবর্তী কালে বঙ্গ ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য অঞ্চল, যার আধুনিক নাম হালিশহর। 
আর সত্যিই সেবারে রাজা কুমারপাল দক্ষিণের বিদ্রোহ দমনে সমর্থ হন। আচার্য মোক্ষকর গুপ্তর আশীর্বাদ বর্ণে বর্ণে মিলেছিল।

0 comments: