0

প্রাচীনকথা - সুনন্দিতা দত্ত

Posted in


প্রাচীনকথা


বুদ্ধং শরণং 
সুনন্দিতা দত্ত 


আমাদের ভারত বিশাল দেশ, আয়তন, লোকসংখ্যার দিক থেকে তো বটেই, শিল্প -শিক্ষা- সংস্কৃতি সব দিক থেকেও| তাই মিশ্রণগুলিও বৈচিত্র্যময়| এ দেশের কোণায় কোণায় কত দার্শনিক তত্ত্ব জমা হয়েছে প্রাচীনকাল থেকে, তার সঠিক হিসেব করা সম্ভব নয়, কারণ সব তত্ত্ব দার্শনিকের মনের কোণ ছেড়ে বাইরের আলো দেখেইনি| যেগুলো দেখেছে, তাদের সবকটিরও প্রচার সমান ব্যপকতা নিয়ে হয়নি| তবু তারই মধ্যে যে কজন মানুষ সাহসী হয়ে নিজের দর্শনকে প্রকাশ করতে পেরেছেন, প্রচার করতে পেরেছেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম সারিতে আছেন কপিলাবস্তুর শাক্যকুলতিলক... সিদ্ধার্থ| তাঁর জীবন কাহিনী মোটামুটি সকলেই জানেন, সে নিয়ে খুব বিস্তারে যাব না, শুধু তাঁর দর্শন নিয়ে কোনো কঠিন তাত্ত্বিক আলোচনা নয়--- একটু গল্পগুজব করবো আমরা|

তবে গল্প শুরুর আগে একটু পটভূমিকা বলে নিতেই হয়|

জন্ম থেকেই মাতৃহীন হলেও মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হননি সিদ্ধার্থ, বরং মাসি তথা বিমাতা মহাপ্রজাপতি গোতমীর গৌতম হয়েই বড় হয়ে উঠেছিলেন তিনি| পিতা শুদ্ধোদনও যে কোনো কারণেই হোক, সমাজ জীবনের সব যন্ত্রণাময় দিকগুলো থেকে আড়ালে রাখতেন তাঁকে| সুতরাং বই পত্র, অস্ত্রশস্ত্র, শিকার খেলা, নারীসঙ্গ এসবের মাঝেই সুখী দিনযাপন ছিল তাঁর| ১৬ বছর বয়সে রীতিমতো স্বয়ং 'বধূ' সভা করে, সেখানে গিয়ে প্রেমে পড়েন যশোধারার| সিদ্ধার্থর মাতুল কুলের রাজকুমারী তিনি, শাক্যদের মধ্যে এ ধরনের বিবাহ বহুল প্রচলিত ছিল| 

১৬ থেকে ২৯. এই বয়সের ভেতর রাজপ্রাসাদের বাইরের সমাজ - জীবন দেখেছিলেন তিনি, খানিকটা পিতার সাথে জোরাজুরি করেই বেরিয়ে| চিন্তাশীল মানুষ, অল্প দেখাতেই চিন্তার রসদ পেলেন অনেক, ঘর ছাড়লেন এক আষাঢ়ী পূর্ণিমায় | 

৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে বেড়ালেন, উচ্চতর শিক্ষার সাধনায়| যেদিন নিজের তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার মতো জমি পেলেন, অর্থাৎ বুদ্ধত্ব লাভ করলেন, সেদিন থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত নিজের মত প্রকাশ এবং প্রচার করে গেছেন অবলীলায়| 

তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর মতগুলি একত্রিত করে সংকলন করা হয়... যার ফল, ত্রিপিটক| 

এরপর যত জল গড়িয়েছে, গঙ্গার খাত বেয়ে, তত, বৌদ্ধ দর্শন শাখা বিস্তার করেছে, তাতে ভালোর সাথে সাথে একটা মন্দও হয়েছে, বুদ্ধের জীবনদর্শন ধীরে ধীরে বৌদ্ধধর্ম হয়ে উঠেছে| তাঁর পথের মানুষরা নিজেদের 'ধর্ম' প্রচার করতে পথে নেমেছে| চরম নাস্তিক, রিচুয়্যালস্ এ অবিশ্বাসী সিদ্ধার্থ 'ভগবান' হয়ে গেছেন, তথাকথিত পাপ পুণ্যের সংজ্ঞায় অবিশ্বাসী মানুষটির মতবাদে লেগেছে. পাপ -পুণ্য , স্বর্গ- নরকের প্রলেপ| পুজো আচ্চা ধূপ ধুনোর গন্ধে, নিয়মের অত্যধিক বাড়াবাড়ির আড়ালে হাঁফিয়ে উঠেছে আসল মতবাদ, তবু তার মুক্তি মেলেনি, জটিলতর হয়েছে সে পথ | 

আমার চেনা এক চরম কমিউনিস্ট মানুষকে, কয়েক বছর আগের রাজনৈতিক পালাবদলের সময় প্রশ্ন করেছিলাম, সবাই পরস্পরের এত নিন্দে করছে কেন? সকলের কার্যকলাপ একই ধরনের ভয় উদ্রেক করে কেন? তিনি বলেছিলেন, যে রাজনৈতিক মতবাদেরই হোক না কেন, বেশীরভাগ মানুষগুলো একই আর্থ -সামাজিক স্তর থেকে এসেছে, তাদের ভাবনা চিন্তাগুলোও একই রকম, কোনো রাজনৈতিক মতেই অন্যকে ছোটো করার কথা বলা নেই, কিন্তু যে মানুষগুলো মতবাদকে বয়ে নিয়ে চলেছে, তাদের ভেতরেই এই নেগেটিভ মানসিকতা ছড়িয়ে আছে, তারা দল বদল করেছে বারবার, মন বদল তো করেনি, সুতরাং যে দলেই যাক, কাজগুলো একই ধরনের হবে| এই ভদ্রলোকটি বৌদ্ধ দর্শনে সুপণ্ডিত| তাঁর দেওয়া বইগুলি পড়তে শুরু করে দেখতে পেলাম, তাঁর কথাটা কত বড়ো অমোঘ সত্যি| যুগে যুগে যে সব মানুষ বুদ্ধের মতানুগামী হয়েছেন, তাঁরা তো জন্মসূত্রে সম্প্রদায়হীন হয়ে জন্মাননি, ব্রাহ্মণ্য(শৈব-শাক্ত- বৈষ্ণবীয়) বা জৈন বা বৌদ্ধ বা অন্য কোনও সম্প্রদায় থেকে এসেছেন বুদ্ধের দর্শনের ছায়ায়, কিন্তু তাঁদের দেহের রক্তকণা, কোষ, আমূল বদলে যায়নি, মন বদলে যায়নি, নিজেরা সম্পূর্ণ মত-শূন্য হয়ে যাননি, বরং নিজের এতদিনের মত, বিশ্বাসের ওপর পড়েছে নতুন ছায়া| তৈরী হয়েছে নতুন মিশ্রণ | 

ফলে ব্রাহ্মণ্য দেবতার দলে ঢুকেছে মানুষ তথাগতর নাম| বুদ্ধ পূজারিণী একসময়ের নরমাংসভোজী হারিটী হয়েছেন শিশুরক্ষাকারিণী দেবী মাতৃকা হারিটী| 

বৌদ্ধ মতের একাংশ হয়েছে পৌত্তলিক, অন্য অংশ অবশ্য মানুষ সিদ্ধার্থের মতের অনুগামী থেকে গেছে, যদিও তারাই সংখ্যায় কম| বৌদ্ধ মত প্রচারের জন্য অনেক সময়ই বৌদ্ধ শ্রমণরা অন্য সম্প্রদায়গুলিকে মন্দ বলেছেন, নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বেশ বড়ো গলায় বলে বেড়িয়েছেন, বাড়িয়েই বলেছেন| বৌদ্ধ কাহিনীগুলি পড়লেই এ কথার প্রমাণ মেলে| 

উদাহরণ দিয়ে বলি... রামায়ণ কথাতে শাক্যদের সমাজ জীবনের ছাপ পড়েছে, রাম -সীতা ভাই বোন হয়ে গেছেন; বাল্মীকির দোষেগুণে ভরা মানুষ রাম হয়ে গেছেন শোক তাপের ঊর্ধে থাকা বোধিস্বত্ত্ব রামপণ্ডিত| বেশ কড়া মেজাজের সীতা হয়ে গেছেন, সারাজীবন প্রায় চুপ করে থাকা যশোধারার পূর্বজন্ম| যতই মহাযানী বৌদ্ধরা দাবী করুক, তাদের সাহিত্য থেকে পড়ে বাল্মীকি নিজের মতো নতুন গল্প সাজিয়েছেন, সবাই জানি যে ঘটনাটা আসলে উল্টো... কারণ প্রথমত রামায়ণের প্রাচীনত্ব নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই; দ্বিতীয়ত, নিজের কয়েক হাজার সংখ্যক পূর্বজন্মের কাহিনী, গৌতম বলে গিয়েছিলেন, আর তাঁর মত্যুর কয়েকশো বছর পর সেগুলো বৌদ্ধরা অবিকল মনে রেখে লিখে ফেলেছে - এতটা ডাহা মিথ্যে কথা মানতে পারা বড়ো মুশকিল; তৃতীয়ত, গৌতম যাগযজ্ঞ, পাপপূণ্য, জন্মান্তর কর্মফল এসবে তো বিশ্বাসই করতেন না, তাহলে কী করে তিনি এত পূর্বজন্মের কাহিনী বললেন? কী করে এত পাপের আর নরকে যাবার গল্প শোনালেন তাঁর অনুগামীদের? 

যাই হোক, এভাবেই মিশ্রিত হতে হতে এগিয়ে চললো বৌদ্ধ 'ধর্ম'| তবে গৌতম ঈশ্বরত্ব পেলেও, অন্যান্য ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীরা বৌদ্ধায়িত হন অনেক পরে, ততদিনে হিউ-এন-সাং নিজের দেশে ফিরে গেছেন| উত্তর-পশ্চিম ভারতের যে তক্ষশীলা, পুরুষপুর বৌদ্ধ শাস্ত্র আর শিল্পের কেন্দ্র ছিলো, সেখানে বারবার বিদেশী আক্রমণ হয়ে চলেছে| আগের বিদেশী আক্রমণকারীরা, নিজেদের বৌদ্ধ সংস্কৃতিতে মিশিয়ে ফেলেছিল, নতুন সৃষ্টিতে মেতে উঠেছিলো (যেমন রাজা মিনাণ্ডার, কণিষ্ক) পরবর্তীরা মেতে উঠল ধ্বংসের খেলায়| গঙ্গা যমুনা অববাহিকা জুড়ে ছোট ছোট রাজ্যগুলিকে কোনও কোনও শাসক হঠাৎ শক্তিশালী হয়ে উঠে একত্র করার চেষ্টা করতেন, কিছুদিন পর আবার তা ভেঙে যেত| কখনও শাসক হতেন সর্বমত সহিষ্ণু, সর্বমতের পৃষ্ঠপোষক; কখনো বা চরম অসহিষ্ণু| মোটামুটি ভাবে সম্রাট হর্ষের মৃত্যুর পর থেকে অসহিষ্ণুতা চরমে উঠল| তার আগে বাংলার তথা গৌড়ের শাসক শশাঙ্কর ও মৃত্যু হয়েছে... তিনি অবশ্য কখনো চুপ থাকতেন, কখনো খড়্গ হস্ত হয়ে উঠতেন বৌদ্ধদের ওপর| নেহাত মহামতি শীলভদ্রের ব্যক্তিত্বের সামনে পড়ে, এবং নিজের ছেলেও সেদলেই চলে যেত বলে, কিছু করে উঠতে পারতেন না (শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গৌড়মল্লার কাল্পনিক হলেও, রাজনৈতিক পটভূমি সর্বৈব সত্যি)| তাঁর মৃত্যুর পর আসামের ভাস্কর বর্মা গৌড় দখল করলে রাজনৈতিক ডামাডোল চরমে ওঠে| সব মিলিয়ে পূর্ব-পশ্চিম-ব্যপী প্রায় সমগ্র গাঙ্গেয় অববাহিকা জুড়ে বৌদ্ধ অস্তিত্ব বিপন্ন হতে শুরু করে এবং ক্রমশ ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার দিকে পিছিয়ে যেতে থাকে| সে অঞ্চলে আবার তখন নানা রকম তন্ত্র মন্ত্র অর্থাৎ ভুডু আর্ট এর রমরমা| উদ্ভূত হয় নতুন মিশ্র মত, বৌদ্ধ তন্ত্র| ভুডু আর ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীরা এবার বৌদ্ধিক রূপ পেলেন, তাঁরা বোধিস্বত্ত্বে আর বুদ্ধের নানা রূপে এবং শক্তিতে পরিণত হলেন, (যেমন তারাপীঠের তারা মা আসলে সংস্কার স্কন্ধ থেকে উৎপন্ন অমোঘ সিদ্ধির শক্তি, তিনি উত্তরমুখী; মলুটির মৌলীক্ষ্যা মা সংজ্ঞা স্কন্ধ থেকে উৎপন্ন, ধ্যানীবুদ্ধ অমিতাভর শক্তি, রক্তবর্ণা পাণ্ডরা, পশ্চিমমুখী)|

পরবর্তী কালে বঙ্গ-বিহারের পাল রাজারা বৌদ্ধ 'ধর্মের' ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন| তাঁরা যখন দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন, গোপনে রাজ্য রক্ষার আশায় বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেন, যদিও উপকার তাতে কিছুই হয়নি| এরপরের সেন রাজারা আবার কট্টর ব্রাহ্মণ্যবাদী ছিলেন| তারপর তো সমগ্র উত্তর ভারতে বারবার রাজনৈতিক পালা বদল, তুর্কী আক্রমণ কিছুই বাদ গেল না| বাংলাও রেহাই পেলো না, কোণ ঠাসা বৌদ্ধরা পালালো বর্তমান মায়ানমারে, তিব্বতে... যদি তিব্বত আর চীনে আগেই বৌদ্ধরা গিয়েছিল, খোটান কাশগড় হয়ে; এবার শুধু পথ পাল্টালো, মানে অরুণাচল হয়ে ঢুকলো| মায়ানমারের পার্বত্য জাতিগুলির আশ্রয়ে গিয়ে অনেক বৌদ্ধ শ্রমণই আর সংযম রাখতে পারলেন না... সৃষ্টি হলো মিশ্র জাতি -- মগ নামে যাদের চিনি আমরা| স্বাভাবিক কারণেই তাদের রাগ ছিল বাংলা ও অন্যান্য অঞ্চলগুলির ওপর, যেখান থেকে তাদের পূর্বপিতাদের পালাতে হয়েছে| তাই বারবার তারা আক্রমণ করতো, অবশ্য মধ্য ভারত পর্যন্ত বিশেষ যেতে পারতো না, রাজত্ব করতে তারা আসেওনি; তবু লুঠতরাজ করে বিশেষত ব্যতিব্যস্ত করে তুলতো সুজলা সুফলা বঙ্গদেশকেই| কঠোর মুঘল শাসনের পর অবশ্য ধীরে ধীরে তাদের উৎপাত কমে আসে| ইংরেজদের পাল্লায় পড়ে তো, এ বদভ্যাস ছাড়তে বাধ্য হয়|

বর্তমানে দেশের সীমারেখা, ভিসা পাসপোর্ট এর ঝামেলা হওয়ায়, আর লুঠপাট করলে অন্যের চেয়ে নিজের অসুবিধে বেশী এটা বুঝতে শেখায়, যে যার দেশে গণ্ডীবদ্ধ| ভারতীয় বৌদ্ধরা ছোট ছোট ভৌগোলিক 'পকেট' এ নিজেদের মতো আছে, ব্যপকতাও নেই, অস্তিত্বহীনও নয়| আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চলই এখন বুদ্ধ প্রভাবিত| আমাদের রাজকুমার আজ তাদের হৃদয়ের সম্রাট, সংস্কৃতির উৎস, মানবতার ঈশ্বর| 

(চলবে)

0 comments: