0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী

Posted in










প্রচ্ছদ নিবন্ধ


দুর্গামূর্তির কুলজির সন্ধানে
অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী 



দেবী দুর্গার যে মূর্তিটির বর্তমানে আরাধনা করা হয়ে থাকে, অল্প কথায় তার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই দেবী দশভুজা, সিংহবাহিনী আর অসুরবিনাশিনী। অসুর মানে মহিষাসুর, যাকে দেখানো হয় একটি বলিষ্ঠ পুরুষ মানুষের চেহারায় এক কর্তিত-মুণ্ড মহিষের দেহ থেকে বেরিয়ে আসতে। দেবী দুর্গার সঙ্গে অন্যান্য যে সব দেবদেবীকে দেখানো হয়, তারা হলেন লক্ষ্মী,সরস্বতী, গণেশ ও কার্ত্তিক। কোথাও বা সঙ্গে থাকেন শিবও।


দুর্গাপূজা- পুরাণ ও পুরাতত্ত্ব

দুর্গাপূজার সঙ্গে যে পৌরাণিক কাহিনী জড়িত, তার উৎস বিষ্ণু ধর্মোত্তর পুরাণ, মৎস্যপুরাণ, অগ্নিপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবী ভাগবত, কালিকাপুরাণ ইত্যাদি। শিব আর ব্রহ্মার বরে কোনো পুরুষের অজেয় ও ত্রিলোকবিজয়ী এই মহিষাসুরের অত্যাচারে স্বর্গচ্যুত দেবতাদের কাতর প্রার্থনায় আবির্ভূতা তাঁদেরই সম্মিলিত তেজসম্ভূতা দেবী দুর্গার সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হয় সে। রাময়ণের নায়ক রামচন্দ্র তাঁর স্ত্রী সীতাকে রাবণের বন্দীদশা থেকে মুক্ত করার মানসে শরৎকালে দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন, সেই থেকে শারদীয়া দুর্গাপূজার সূচনা হয়, এমন উল্লেখ কোথাও কোথাও পাওয়া যায়। আবার তারও আগে বসন্তকালে রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধি নিজেদের সৌভাগ্যকামনায় দুর্গাপূজা করেছিলেন, এ রকম পৌরাণিক কাহিনীও প্রচলিত আছে। বাঙালি কবি কালিদাস তাঁর রামায়ণে শরৎকালের দুর্গাপূজাকে অকালবোধন বলে উল্লেখ করেছেন, যদিও প্রাচীনতর মার্কণ্ডেয় পুরাণে শরৎকালই দুর্গাপূজার সময় বলে উল্লিখিত। আবার বাল্মিকী রামায়ণে কিন্তু কোথাও রাম দুর্গার আরাধনা করেছিলেন বলে পরিষ্কার উল্লেখ নেই!

দুর্গাপূজার পৌরাণিক পটভূমি যা-ই হোক, এর ইতিহাস যে বেশ প্রাচীন, সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতে দ্বাদশ শতকে বারেন্দ্রীতে দুর্গাপূজার সবচেয়ে পুরানো উল্লেখ পাওয়া যায়। তখন থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত দুর্গা আরাধনার তত্ত্ব ও দুর্গামূর্তির রূপকল্পনা – সব কিছুতেই অনেক বিবর্তন হয়েছে। দেবী দুর্গার আরধনার মধ্যে কৃষি নির্ভর সমাজের পৃথিবীকে অর্থাৎ ভূমিকে ফলে-শস্যে সম্পদবতী করে তোলার প্রার্থনাই রূপায়িত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। তাঁদের মতে পূজার সময়ে দুর্গা মূর্তির সঙ্গে সুসজ্জিতা নবপত্রিকার [যা আদতে ন’ রকম ফল সমেত শাড়ি পরানো একটি কলাগাছ] স্থাপনাতে সেই চিন্তাই অভিব্যক্তি পেয়েছে।

ইতিহাসবিদ ও পুরাতাত্ত্বিকেরা আবার দুর্গাপূজার মধ্যে অন্য একটি রূপকের সন্ধান পান। বহিরাগত আর্যরা অনার্য অধ্যুষিত ভারতবর্ষে যুদ্ধ ও সামাজিক সংঘাতের মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন, এ কথা যদি মেনে নেওয়া যায়, তা হলে এটা খুবই সম্ভব যে, কৃষিপারঙ্গম আর্যরা এসে আদিম বঙ্গভূমির এমন কোনো সমাজের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল, যার কুলপ্রতীক বা টোটেম ছিল মহিষ। শস্যশালিনী পৃথিবীস্বরূপা দুর্গার হাতে মহিষাসুরের নিধনের মধ্যে কি রূপায়িত হয়েছে কৃষিকুশল আর্যদের কাছে আদিম বাংলার কৌম সমাজের নতিস্বীকারের ঘটনা? নবপত্রিকার পূজার মধ্যেও কি সেই কৃষিপরায়ণ আর্যদেরই আধিপত্য বিস্তারের ইঙ্গিত? অসম্ভব নয়। তা ছাড়া দুর্গার মহিষাসুর নিধন আর রামচন্দ্রের রাবণকে পরাভূত করার কাহিনী, এ দুয়ের মধ্যে একটি সাদৃশ্যও লক্ষণীয়। মহিষাসুর ও রাবণ – দু’জনের উদ্ভবের মূলেই রয়েছে শিবের বরপ্রাপ্তি-যে শিব মূলত অনার্য দেবতা। অর্থাৎ এমনটা হতেই পারে যে, দুর্গাপূজার প্রচলনের মধ্য দিয়ে অনার্যদের পরাভবের কাহিনীই রূপায়িত হয়েছে।

আমরা দেবী দুর্গার পুজার সময়ে নির্মিত আধুনিক মূর্তির যে বিবরণ শুরুতেই উপস্থিত করেছি, তার মূলে রয়েছে বিভিন্ন পুরাণ ও শাস্ত্রের বর্ণনা। এই সব পুরাণ, শিল্পশাস্ত্র ও ধ্যানমন্ত্রের বর্ণনা অনুযায়ী এই দেবী দশভুজা ও দশপ্রহরণধারিনী, সিংহবাহিনী তথা অসুরবিনাশিনী। আবার হেমাদ্রির বর্ণনা অনুযায়ী তিনি বিংশতিভুজা আবার শিল্পরত্নের কল্পনায় তিনি ত্রিনয়নী, জটাজুটসংযুক্তা, নীলকমলসদৃশ তাঁর চোখ, তিনি পীনোন্নতপয়োধরা ইত্যাদি ইত্যাদি। কোনো মন্ত্রের বর্ননায় আবার তিনি তপ্তকাঞ্চণবর্ণা,তাঁর মুখ পূর্ণচন্দ্রের মতো -- তাঁর মাথায় অর্ধচন্দ্র, তাঁর হাতে নানা আয়ুধ ও ঘন্টা, তাঁর অস্ত্রে নিপাতিত অসুর।


দুর্গামূর্তির প্রাথমিক রূপ

প্রাচীন ভারতবর্ষ তথা পূর্ব এশিয়ার হিন্দু উপনিবেশগুলির ভাস্কর্যে যেসব দুর্গামূর্তির রূপ পাওয়া যায়, গুপ্ত ও কুষাণ যুগের নানা মুদ্রায় শক্তিরূপিনী যে দেবীমূর্তি চিত্রিত দেখা যায়,তা থেকে এক দিকে দুর্গা আরাধনার প্রাচীনত্বের একটা আঁচ যেমন পাওয়া যায়,তেমন এ কথাও বোঝা যায় যে, অতীত ইতিহাসের নানা পর্বের মূর্তি রচনায় আমাদের উল্লিখিত শাস্ত্রের ওই বর্ণণাকে সব সময় মান্য করা হয়নি। এর একটি কারণ হতে পারে ঐ সব মূর্তি ও মুদ্রা নির্মাণের পরবর্তীকালে ওই দেবী মাহাত্ম্য রচিত হয়েছিল। মার্কন্ডেয় পুরাণ বা সপ্তশতী চন্ডী গুপ্তযুগে অর্থাৎ চতুর্থ শতকের রচনা হলেও এর দেবীমাহাত্ম্য অংশটি আরও পরবর্তী কালের [ ষষ্ঠ বা সপ্তম শতক] রচনা বলে অনেকের ধারণা। আর তার আগেই সিংহবাহিনী এই দেবী যে সমাজে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় গুপ্তসম্রাট প্রথম চন্দ্রগুপ্তের মুদ্রায়। [ছবি- ১ক] ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মনে করেছেন, শক-পহ্লব ও কুষাণযুগের দুর্গামূর্তিগুলি বর্তমানে পূজিত দুর্গামূর্তির উৎস-গ্রন্থগুলি অর্থাৎ পূর্বোল্লিখিত পুরাণগুলি থেকে বেশি প্রাচীন। এদেশের দুর্গামূর্তিগুলির সবচেয়ে পুরানো নিদর্শনগুলি তাঁর মতে খৃস্টের আগে ও পরের একশো বছরের মধ্যবর্তী সময়ের, এবং ওই সময়কাল নাগাদই এ দেশে মহিষমর্দিনী সংক্রান্ত ধর্মবিশ্বাসের প্রচলন হয়েছিল বলে মনে করা যেতে পারে। 

তবে দুর্গামূর্তির নানা হেরফের সত্ত্বেও এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্যকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি, এই দেবী সাধারণত বহুভুজা, অসুরবিনাশিনী ও সিংহবাহিনী। এই সিংহবাহিনী মাতৃকাদেবীর উৎস সন্ধান করতে গেলে আবার পৃথিবীর অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার যে সব নিদর্শন বহির্ভারতে পাওয়া যায়, তার দেবীমূর্তিগুলোর দিকেও আমাদের নজর চলে যায় আর তার ফলে দেবীমূর্তির বৈচিত্র্যও অনেক বেড়ে যায়। বাংলাদেশে প্রবর্তিত আধুনিক দুর্গাপুজার আরাধ্য মূর্তিতে বা অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন পটচিত্রে বা মন্দিরগাত্রের টেরাকোটায় দর্গামূর্তির যে পারিবারিক রূপটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তার অনুরূপ নিদর্শন কিন্তু মধ্যযুগের শেষভাগের আগে পাওয়া যায়না। আদি মধ্যযুগের [অর্থাৎ নবম-দশম থেকে দ্বাদশ শতক] কিছু মূর্তিতে অবশ্য দেবী গৌরী বা চণ্ডীকে লক্ষ্মী-সরস্বতীর সঙ্গে, কোথাও বা গণেশ-কার্ত্তিকের সঙ্গে দেখানো হয়েছে, যেমন ওড়িশায় প্রাপ্ত একাদশ শতকের একটি মূর্তিতে। [ ছবি-২ ক ]। লক্ষণীয় যে, দেবী এই সব ভাস্কর্যে সিংহবাহিনীরূপে রূপায়িত নন আর তাঁর দু’জনের বেশি ‘পরিজন’ নেই। আবার কোনার্কে প্রাপ্ত একটি মূর্তিতে দেবীর দু’ পাশে জগন্নাথ ও শিবলিঙ্গ দেখা যাচ্ছে। রাজস্থানের পিপলায় প্রাপ্ত এক দেবীমূর্তিতে দেবীর দু’ পাশে দেখা যায় কুবের ও গণপতিকে। কলকাতা জাদুঘরে সংগৃহীত একটি মূর্তিতে সিংহবাহিনী দেবীর কোলে একটি শিশুকে [কার্ত্তিক?] দেখা যায়।

প্রাচীন বা মধ্যযুগে ভারতে নির্মিত দুর্গামূর্তিগুলিতে দেখা যায় যে, দ্বিভুজা, চতুর্ভুজা বা অষ্টভুজা [যেমন ভুবনেশ্বরের বৈতাল দেউলের এক মূর্তিতে] দেবী সিংহারূঢ়া হয়ে অথবা সিংহের পাশে দাঁড়িয়ে বধ করছেন একটি মহিষকে [ছবি- ২ খ], কিংবা মহিষমুণ্ডধারী কোনো এক পুরুষকে [যেমন- মহাবলিপুরমের দেয়াল ভাস্কর্য]- কোথাও বা ছিন্নশির মহিষের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা এক অসুরকে [যেমন গুজরাটের পাটানের একটি ভাস্কর্য, দ্রষ্টব্য ছবি- ৩ ক ] । শক ও পহ্লব যুগের মূর্তিগুলিতেও এই ধারা লক্ষ করা যায়।আরও পরবর্তীকালের মূর্তি অবশ্য দেবীকে দেখানো হয়েছে কুড়িটি, আঠাশটি, কখনও বা বত্রিশটি হাতের অধিকারিনীরূপে।

ভারতের যে সব মহিষমর্দিনী ভাস্কর্য সবচেয়ে পুরানো, সেগুলিও খ্রিষ্ট পূর্ব প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝির আগের হবে না। এগুলির একটি পাওয়া গেছে এলাহাবাদের কাছে ভিটাগ্রামে, অন্য কয়েকটি মথুরায়। মথুরার সংখে খনন করে পাওয়া একটি মূর্তিতে দেখা যায়, দেবী একটি পশুর গলার কাছে হাত রেখেছেন। এই সব প্রাচীন ভাস্কর্যগুলির বেশির ভাগ নিদর্শনেই দেখা যায়, দেবী বিনা অস্ত্রেই এক হাতে একটি মহিষের গলা টিপে বা জিভ টেনে ধরেছেন ও অন্য হাতে তার পৃষ্ঠদেশ মর্দন [অর্থাৎ পিষ্ট বা চূর্ণ] করছেন। কোথাও অবশ্য় দেবীর পাশে বা হাতে [যেমন কুষাণ যুগের একটি মূর্তিতে] ত্রিশূল ও দেখানো হয়েছে। গুপ্তযুগের কিছু মূর্তিতে দেবীকে অসুরের দেহে শূলবিদ্ধ করতে দেখা যায়। ভিটা ও মথুরার মূর্তিতে দেখা যায়, চতুর্ভুজা দেবীর পদতলে শূলবিদ্ধ মহিষ, তার লেজ দেবী এক হাতে আকর্ষণ করছেন, বাকি তিন হাতে অস্ত্র [ছবি ৩ খ]। অনুরূপ অস্ত্রধারিনী মহিষঘাতিনী দেবীর মূর্তি পাওয়া যায় পশ্চিম ভারতের বাদামি গুহায় ও ইলোরা গুহায় [দ্রষ্টব্য ছবি- ৪ ], ওড়িশার উদয়গিরি ও হিমাচল প্রদেশের চাম্বায়। এই শ্রেণীর দুর্গামূর্তিগুলির সঙ্গে তুলনীয় জাভা ও কম্বোডিয়ার পাথরের দুর্গামূর্তিগুলো, যার নির্মাণকাল মোটামুটি সপ্তম থেকে পঞ্চদশ শতক। [ছবি-৫ ]

এতক্ষণ যে সব দুর্গামূর্তির কথা বলা হল, তার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য দেবী এখানে বহুভুজা ও ‘মহিষঘ্নী’ অর্থাৎ একটি মহিষকে মর্দন বা বধ করছেন- কখনও খালি হাতে, কখনও বা অস্ত্রের সাহায্যে। কিন্তু প্রাচীন ও আদি মধ্য যুগের এই সব মূর্তিগুলির কোনটিতেই মনুষ্যদেহধারী কোনো অসুর নেই ও সবগুলিতেই সিংহ অনুপস্থিত। ভারতের মূর্তিগুলিতে বাংলাদেশে প্রাপ্ত পালযুগের [দ্বাদশ শতক] মূর্তিগুলির [দ্রষ্টব্য ছবি- ৬] আগের পর্বে অসুর ও সিংহের খোঁজ কিন্তু তেমন মেলেনা। আবার ভারতের এই সব মূর্তিগুলিতে অসুর ও সিংহ দেখা দিতে শুরু করার পরেও কিন্তু পূর্ব এশিয়ার মূর্তিগুলোতে আগের মতোই সিংহ ও অসুর ছাড়াই মহিষমর্দিনী দেবী রূপায়িত হয়েছেন। এ থেকে মনে হয়, যে সময় ভারত থেকে হিন্দু সংস্কৃতি জাভা বা কম্বোডিয়ায় প্রথম পৌঁছেছিল, তখন পর্যন্ত এদেশের দুর্গামূর্তিতে অসুর বা সিংহের আবির্ভাব হয়নি ও সেই ধারা ঐ উপনিবেশগুলিতে কয়েক শতাব্দ ধরে বহমান ছিল, যদিও ততদিনে ভারতবর্ষের কোনও কোনও অঞ্চলে সিংহ ও মানুষের মতো চেহারার অসুরের আবির্ভাব হতে শুরু হয়ে গেছে।


সিংহ ও অসুরের সংযোজন

আমাদের পরিচিত একটি দুর্গাস্তোত্রে দেবীকে বলা হয়েছে “সিহস্থা সিংহনিলয়া, দিব্যস্থাননিবাসিনি” ইত্যাদি। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, আদিতে এদেশের ভাস্কর্যে মহিষমর্দিনী দেবীর সঙ্গে সিংহের উপস্থিতি ছিল না। দুর্গামুর্তিতে সিংহের অভ্যুদয়ের উৎস সন্ধান করতে গেলে বহির্ভারতীয় কিছু সভ্যতার দেবীমূর্তির সঙ্গে আমাদের দুর্গাকল্পনার আত্মীয়তা বেরিয়ে পড়তে পারে। মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার ও ইয়োরোপের কিছু দেশে প্রচলিত বিভিন্ন মাতৃকাদেবীর মূর্তির পাদপীঠ হিসেবে সিংহকে দেখানো হয়েছে। মেসোপটেমিয়ার ইশতার বা সুমেরের ইনানা বা নিন্‌লিল, পশ্চিম এশিয়ার কুবিলি বা সিবিলি‌ পারস্যের অনাহিত, গ্রীসের রিয়া, কুষাণ ও গ্রীকদের [ব্যাবিলনের] ননা প্রমুখ দেবীর বাহন বা সহচর হিসেবে সিংহকে দেখানো হয়েছে [ছবি- ৭ ]। দুর্গার সঙ্গে এই সব দেবীদের একটি সাধারণ মিল হল, এরা প্রায় সকলেই রণনিপুণা ও সিংহ নিয়ে যুদ্ধরতা, কেউ কেউ দেবাসুর সংগ্রামে অসুরনিধন করেছেন আর উর্বরতা তথা শস্যশালিনী ভূমির প্রতীকরূপে পূজিতা। মিল আরও আছে। গ্রীক রণদেবী অ্যাথিনার দেবাসুর সংগ্রামে অবতীর্ণ হবার যে দৃশ্য তুরস্কের পার্গমেনের বেদীর ভিত্তিতে দ্বিতীয় খ্রিস্ট পূর্বাব্দে খোদিত হয়েছিল, সেখানে সিংহারূঢ়া দেবীর ভঙ্গিমা অবিকল আমাদের দুর্গার মতো। এখানকার আর একটি মূর্তিতে দেখা যায়, দেবী অ্যাথিনা এক দানবের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন আর তাঁর সহচর সিংহ [ ছবি- ৮ ক] আর একটি দানবকে আক্রমণ করছে।পার্গমেনে দেবীর সঙ্গে যুদ্ধরত এক পাখাওয়লা দানবকে দেখানো হয়েছে, যার যুদ্ধভঙ্গী[পাখা দুটি বাদ দিলে] অনেকটা আমাদের মহিষাসুরের মতোই! [ ছবি- ৮ খ] একটি আসুরীয় সীলের ওপর খোদিত দেবী ইশতারকে অনেকটা দেবী দুর্গার মতোই সিংহের পিঠে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে দেখা যায়।

খ্রিস্টীয় প্রথম শতকেই ইরান তথা পশ্চিম এশিয়ায় মাতৃকাপূজা ও সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিল দেবাসুরের লড়াই ও পৃথিবীর উর্বরতাবৃদ্ধির নানা ধারণা। দেবী অনাহিতের ভক্তদের বিশ্বাস ছিল সৃজনক্ষমতার আধার বৃষ নিধন করলে তার রক্তে পৃথিবী উর্বরা হবে। হিন্দুদের দুর্গাপূজাতেও মহিষ বলি ও নবপত্রিকার পূজা ইত্যাদি ধর্মাচারে ওই উর্বরতা ও শস্যসমৃদ্ধির ধারণার প্রভাব থাকা হয়তো অসম্ভব নয়। অনেক ইতিহাসবিদের মতো পুরাতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতেও এই সব বিশ্বাস ও দেবীমূর্তিতে সিংহ ও অসুরের সংযোজনের পেছনে মধ্য এশিয়ার ওই সব দেশগুলির মূর্তিকল্পনা ও বিশ্বাসের প্রভাব থাকা বিচিত্র নয়, যে-প্রভাব উত্তর পশ্চিম ভারতের পথ দিয়ে বাণিজ্যিক যোগাযোগ বা দুই অঞ্চলের কিছু অংশ একই রাজনৈতিক শক্তির অধীনে থাকার সূত্রে এদেশে প্রবেশ করেছিল। ব্রতীন্দ্রনাথ প্রথম খৃস্টাব্দের কিছু স্বর্ণ মুদ্রা বা পদক বিশ্লেষণ করে ও শক -পহ্লব রাজা প্রথম অজ-র কিছু মুদ্রায় শক্তিদেবীর সঙ্গে সিংহের মুখ খোদিত দেখে ও গুপ্ত আর কুষাণ রাজাদের নানা মুদ্রায় সিংহবাহিনী দেবীমূর্তি খোদিত থাকার ভিত্তিতে [দ্রষ্টব্য ছবি- ১] সিদ্ধান্ত করেছেন যে ভারতে সিংহবাহিনী দুর্গার ধারণা সম্ভবত ওই সব মাতৃদেবীর সঙ্গে সিংহের যোগাযোগের থেকেই বিকশিত হয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায় যে, ভারতে সিংহ একেবারে অপরিচিত না হলেও বাংলাদেশে বা পূর্ব ভারতে সিংহ দেবীর বাহন হিসেবে খুব স্বাভাবিক নির্বাচন নয়, সেই তুলনায় বাংলায় বাঘ কিন্তু অনেক বেশি পরিচিত। দুর্গার বাহন হিসেবে নানা অর্বাচীন মুর্তি ও পটচিত্রে কিন্তু বাঘকেও দেখানো হয়েছে এবং উত্তর ও পূর্ব ভারতের নানা অঞ্চলে তাই ব্যাঘ্রবাহিনী দুর্গা ‘শেরাওয়ালী মা’ হিসেবেও অভিহিত হয়ে থাকেন। এসব যুক্তি বিচার করলে কিন্তু দুর্গার সিংহারূঢ়া মূর্তির পেছনে বহির্ভারতীয় প্রভাবের সম্ভাবনাই সঙ্গত মনে হয়।
দুর্গার পারিবারিক রূপ-‘ বাংলাদেশের হৃদয় হতে

দুর্গার লোকপূজিত মূর্তির ক্রমবিবর্তনের প্রক্রিয়ায় সর্বশেষ পর্যায় মনে হয় লক্ষ্মী, সরস্বতী ইত্যাদি ‘পরিজনদের সংযোজন যাকে বাংলাদশের একান্ত নিজস্ব অবদান বলা যায়। একচালা দুর্গাপ্রতিমাতে যেন বাংলাদেশের যৌথ পরিবারেরই ছবি দেখা যায়, যেখানে জননী দুর্গা তাঁর ‘ছেলেমেয়ে’দের নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। হিন্দুদের শাস্ত্র বা পুরাণ অনুসারে অবশ্য লক্ষ্মী বা সরস্বতীকে কোনোভাবেই দুর্গার কন্যা বলা যায়না। কিন্তু বাঙালির লৌকিক কল্পনায় এরা শিব-দুর্গার কন্যাতে পরিণত হয়েছেন আর দেবী দুর্গা হয়েছেন গিরিরানী মেনকার আদরিনী কন্যা উমা- যিনি প্রতি বছর শরৎকালে ‘বাপের বাড়ি’ আসেন। এই সব দেবদেবী সমভিব্যহারে দুর্গার মূর্তিকল্পনাটি কিন্তু রঘুনন্দন, বেণীনাথ প্রমুখের প্রণীত পূজাবিধিতে নেই। কিন্তু শিব দুর্গার সন্তানসন্ততি সহ ঘরকন্নার জীবন্ত ছবি আছে রামেশ্বরের শিবায়ন কাব্যে বা ভারতচন্দ্র- মুকুন্দরাম প্রমুখ কবিদের মঙ্গলকাব্যগুলিতে আর খ্যাত অখ্যাত নানা রচয়িতার আগমনী গানে। একটি গান তো আমাদের খুবই পরিচিতঃ- “দেখ না নয়নে গিরি গৌরী আমার সেজে এল/ দ্বিভুজা ছিল যে উমা দশভুজা কবে হল!/ সঙ্গে লক্ষ্মী সরস্বতী আর কার্তিক গণপতি/ সিংহপৃষ্ঠে ভগবতী চারিদিক করেছে আলো।“ বাংলাদেশে দেবী চন্ডীর রূপান্তরের বিচিত্র কাহিনী অবশ্য এত অল্পে সারা যাবে না। এখানে শুধু উল্লেখ করা যায় মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কবিকঙ্কণচন্ডীর একটি অংশ- যাতে আধুনিক কালে পূজিত দুর্গা মূর্তির পুরো চেহারাটি পাওয়া যায়ঃ-“......সিংহ পৃষ্ঠে আরোপিলা দক্ষিণ চরণ/মহিষের পৃষ্ঠে বাম পদ আরোপণ/......বাম করে মহিষাসুরের ধরি চুল/ ডানি করে বুকে তার আরোপিলা শূল।/ বামে শিখিবাহন দক্ষিণে লম্বোদর/ বৃষে আরোহণ শিব মস্তক উপর।/ দক্ষিণে জলধিসুতা বামে সরস্বতী/সম্মুখেতে দেবগণ করে নানা স্তুতি।।“ ইত্যাদি। এ থেকে বলা যেতে পারে যে, মুকুন্দরামের সময়ে [অর্থাৎ ষোড়শ শতাব্দে] বঙ্গভূমিতে দুর্গার সপরিবার মূর্তির পূজা প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। ডঃ সুকুমার সেন অবশ্য মনে করেন, দুর্গামূর্তিতে এই ‘পুত্রকন্যাদের সংযোজন দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ শতকের ঘটনা। বাংলাদেশের বহু মন্দিরের পোড়ামাটির ভাস্কর্যে তাই এই পারিবারিক রূপটি আমরা ফুটে উঠতে দেখতে পাই। [ছবি- ৯ ক] বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, ওড়িশা ইত্যাদি অঞ্চলের শিল্পীরা দুর্গাপূজা উপলক্ষে এই সপরিজন দেবীর সিংহবাহিনী মহিষাসুরমর্দিনী রূপটিকেই অনুসরণ করে থাকেন। বর্তমানে মহিষমর্দিনী দুর্গামূর্তির বঙ্গীয় রূপান্তরের এই ধারাটির আর একটি শাখার উল্লেখও এখানে করা যেতে পারে, যাতে অসুরনিধনের অধ্যায়টি বাদ দিয়ে হরপার্বতীর পুত্রকন্যাসহ নির্ভেজাল পারিবারিক রূপটিই তুলে ধরা হয় [ছবি- ৯খ] এই হরপার্বতী মূর্তিতেও বাংলা ও ওড়িশার কোনো কোনো স্থানে শারদীয়া দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বলা বাহুল্য যে, দেবী দুর্গার এই মূর্তিটিই বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য ও শিবসঙ্কীর্তনগুলির উপজীব্য।

অসুরদলনী দুর্গা বা উগ্ররূপা চণ্ডী থেকে বাঙালির ঘরের আদরিনী মেয়ে উমা বা ঘরণী- জননী অন্নপূর্ণা রূপে দুর্গামূর্তির এই যে বিবর্তন, রবীন্দ্রনাথ তার সুন্দর বিশ্লেষণ করেছিলেন। দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস’ বইটির আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেনঃ-“ তখনকার নানা বিভীষিকাগ্রস্ত পরিবর্তনব্যাকুল দুর্গতির দিনে শক্তিপূজারূপ এই যে প্রবলতার পূজা প্রচলিত হইয়াছিল,ইহা আমাদের মনুষ্যত্বকে চিরকাল পরিতৃপ্ত রাখিতে পারে না।“ তাই তাঁর মতে বাঙলাদেশে অত্যুগ্র চণ্ডী ক্রমশ মাতা অন্নপূর্ণার রূপে, ভিখারীর গৃহলক্ষ্মীরূপে, বিচ্ছেদবিধুর পিতামাতার কন্যারূপে – ‘রমণীর এই ত্রিবিধ মঙ্গলসুন্দর রূপে’ বাঙালির ঘরে রসসঞ্চার করেছেন।














আকর-সূত্রঃ-

১। মহিষমর্দিনীর উৎস সন্ধানে/ ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় – শারদীয় দেশ, ১৩৯০।

২। মুদ্রায় বিচিত্রিতা মহাদেবী/ ঐ, দেশ, ৪-১০-১৯৮৬।

৩। মহিষমর্দিনীর ঠিকুজি/ অতুল সুর- কলকাতা পুরশ্রী,২৩-১০-১৯৮২

৪। দুর্গামূর্তির কথা/ ডঃ সুকুমার সেন- আনন্দবাজার পত্রিকা, পূজা ক্রোড়পত্রিকা।

৫। মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা- যুগান্তরে রূপান্তর/ তারণকুমার বিশ্বাস, দেশ, ১৩-৯- ১৯৮০। 








0 comments: