0

স্মৃতির সরণী - ঈশানী রায়চৌধুরী

Posted in


স্মৃতির সরণী


অ-রূপকথা
ঈশানী রায়চৌধুরী



(১) 

ক্লাস ফোরের অ্যানুয়াল পরীক্ষা যখন ঘাড়ের ওপরে ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছ, জানতে পারলাম আমরা দক্ষিণ কলকাতার বাস উঠিয়ে উত্তর কলকাতায় যাব। ভবানীপুরের বাড়িটা যে আমার খুব প্রিয় ছিল তা নয়, তবে আশুতোষ মুখার্জী রোডের ওপর ওই স্কুলটা আমার বড় প্রিয় ছিল। এত সবুজ মাঠ, এত বিরাটবড় উপুড় করা বাটির মতো নীল আকাশ, চ্যাপেলে পিয়ানো, লাগোয়া হোস্টেলে উঁকিঝুঁকি মারার লোভ, ঝুপ্পুস বিশাল একটা কুঁচফলের গাছ... মাটিতে পড়ে থাকা অজস্র লাল টুকটুকে ফল টিফিনবেলায় কুড়োনোর অনন্ত লোভ...এ সব কিছু ছেড়ে যাওয়ার কথা ভেবে আমার কচি মনে একটা দুঃখের নদী তৈরী হয়েছিল। সে দুঃখের নদীতে বান ডাকালো মায়ের ঘোষণা। আমাকে তিনটে স্কুলে অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে হবে। বেথুন, ব্রাহ্ম গার্লস আর হোলি চাইল্ড।

বেথুনে পরীক্ষা দিলাম স্কুলের লাইব্রেরিতে বসে আর সত্যি বলতে কী, মনে মনে ঠিক করে নিলাম এখানেই পড়ব...যে স্কুলের লাইব্রেরিতে এত্ত বই, সে স্কুল ভালো হতে বাধ্য! ব্রাহ্ম গার্লসের প্রশ্নপত্র ছিল সবচেয়ে সহজ। ওই এখনকার ভাষায় যাকে "কেক ওয়াক" বলে। আর হোলি চাইল্ডে পরীক্ষা দিতে এসে মনটা খুব দমে গিয়েছিল। এ কী রে বাবা! সবুজ ঘাসের বালাই নেই, শানবাঁধানো উঠোন, আকাশটা এক টুকরো নীল রুমালের মতো, ঘরগুলো কী কঠিন আর ঠাণ্ডা চোখের...সাদা পোশাক পড়া এক নান গার্ড দিচ্ছেন...তিনি যে কী বাংলা বলেন...স্পষ্ট নয়। সব মিলিয়ে সে এক বিচ্ছিরি অবস্থা। কবিতার সংক্ষিপ্তকরণ করতে দেওয়া হয়েছে... মানে সাইক্লো করা প্রশ্নপত্রের কালি ধেবড়ে গেছে (বেথুন, ব্রাহ্ম গার্লসে ছাপা প্রশ্নপত্র ছিল...এরা কী কিপ্টে রে বাবা!)...আমি ধরে নিয়েছি ওটা সংক্ষিপ্তকরণই করতে হবে... গার্ড বলছেন... সারাংশ -ভাবার্থ (শেষ অক্ষরটা হসন্ত দিয়ে)...আমি জিজ্ঞেস করে মরছি প্রেসি-সামারি-না সাবস্ট্যান্স (আগের স্কুলে প্রভাদি বঙ্গললনা হয়েও নিখুঁত বিলিতি উচ্চারণে তিনটি শব্দের অর্থ শিখিয়েছেন আমাদের ক্লাস ফোরেই...এ গার্ড তো দেখি বাংলাটাই ভালো করে বলছেন না...সব্বোনাশ! এদিকে না বুঝে ভুল লিখলে মা জানতে পারলে কান পেঁচিয়ে দেবে)...শেষ পর্যন্ত ওই তিনটের মাঝামাঝি একটা জিনিস খাড়া করা গেল। তবে আমি এই স্কুলে কিছুতেই পড়ছি না। এ পুরো জেলখানা। আর স্কুল ড্রেসটাও তো দেখেছি কেমন ফ্যাকফ্যাকে সাদা। আমরাও কি নান না কি? সব এত রংহীন! না না, আমার পোষাবে না। বেথুন, ব্রাহ্ম গার্লসে লাল ফিতে, লাল বেল্ট, ফ্রকটা কেমন স্মার্ট, ঠিকঠাক...আমার পুরোনো স্কুলে অবিশ্যি নীল ছিল...তা হোকগে...তবু তো রং ছিল একটু। তার ওপর কেমন সামনে পেছনে মস্ত কলার...হাতির কানের মতো লটপট করছে...দূর!

তবে মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক! বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ে তিনটে স্কুলেই আমার নামটা এক নম্বরে এল। আমি ঘোষণা করলাম, বেথুনে পড়ব। কীভালো লাইব্রেরি! মা চোখ লাল করে বলল, "বাজে বায়না করে লাভ নেই। আগেই নিজের পড়ার বইতে মন দাও। হোলি চাইল্ডে পড়তে হবে। কারণ ঐটেই সবচেয়ে কড়া নিয়মের স্কুল। ওখানে পড়লে সিধে থাকবে তুমি।"

জলভরা চোখে ব্যাজার মুখে আমি হোলি চাইল্ডে নাম লেখালাম। পঞ্চম শ্রেণী, 'ক’বিভাগ। আমার সঙ্গে আরও দু-জন ভর্তি হলো। একজন গেল সেকশন 'বি’তে, মৈত্রেয়ী ঘোষ। আর অন্যজন আমারই সেকশনে। শেফালিরানী চৌধুরী, যদিও আমি তন্নতন্ন করে খুঁটিয়ে দেখেও তার মধ্যে কোনো রানীসুলভ চেহারা বা আচরণ কিছুই পেলাম না।

প্রথম দিন ক্লাসে এসে দেখি আগের বছরের ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড গার্লরা তাদের প্রাইজ নিয়ে এসেছে দেখাতে। ফার্স্ট গার্ল পেয়েছে "তালপাতার ভেঁপু" নামের একটা বই, সেকেন্ড গার্ল "মেবারের রাণা প্রতাপ" আর থার্ড প্রাইজ একটা লুডোর বোর্ড। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এ প্রাইজ পাওয়াও যা, না পাওয়াও তাই। কাজেই ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়ার বেকার পরিশ্রম করে লাভ নেই।

বুঝিনি, ভাবা আর তা বাস্তবায়িত করে তোলা...এক কথা নয়। কারণ আমার ভাবনা আর রূপায়ণের মাঝে চীনের প্রাচীর হয়ে যে দাঁড়িয়ে আছে...সে বড় কঠিন ঠাঁই। আমার মা।


(২)

পুরোনো স্কুলে ইংরিজিতে প্রেয়ার হতো চ্যাপেলে। এখানে চাতালে দাঁড়িয়ে বাংলায় প্রার্থনা করা হয়। আবার সপ্তাহের নিয়মে। সোমবার বন্দে মাতরম, মঙ্গলবার ধনধান্যপুষ্প ভরা, এরপর জনগণমন, হও ধরমেতে ধীর আর যীশুর গান...তোমারই করুণা...। একটু এদিক ওদিক হওয়ার জো নেই। সকলে গায়, আমি উসখুস করি, গলা মেলাই না। তারপর তিনভাগে ভাগ হয়ে তিনটি সিঁড়ি দিয়ে ক্লাসে যাওয়া। কপাল মন্দ, তাই বাঁদিকে সারসার জলের কলের পাশের সিঁড়ি দিয়ে ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে চারতলায় উঠতে হয়, কিন্তু শব্দ হয় না সিঁড়িতে। মাঝের সিঁড়ি দিয়ে যেতে পারলে খাসা হতো। কাঠের সিঁড়ি...খটখট আওয়াজ করা যেত। নিয়ম মেনে নিয়ম ভাঙার অন্য মজা।

মনে আছে, প্রথম দিন ছিল ইংরিজি ক্লাসটেস্ট। আমি ক্লাসে গেছি এক সপ্তাহ পরে, ট্রান্সফারের নিয়মকানুন মিটে যাওয়ার পরে। যে কবিতার ওপরে পরীক্ষা, সেটা আমার পড়া (মা মোটামুটি বছরের শুরুতে সিলেবাস শেষ করিয়ে রেখে দিত), কিন্তু বন্দনাদি? সাদা শাড়ি সাদা ব্লাউজে সেজে শ্যামলা রঙের চেহারায় মোহিত করে দীঘল বেণী দুলিয়ে মরালগ্রীবাটি নেড়ে আমার পরীক্ষা দেওয়ার সদিচ্ছায় বাধ সেধে বললেন, "তুমি তো এটা পড়োইনি। তুমি চুপ করে বসে থাকো|" যত বলি, আমি জানি...তত ঘাড় নাড়া বেড়ে যায়। দুত্তেরি! আমি বসে বসে রাফ খাতার পেছনে ডুডলিং করি। বাকিরা আঙুলে ধ্যাবড়া করে ফাউন্টেন পেনের কালি মাখে।

হোলি চাইল্ডে আমার প্রথম সাপ্তাহিক পরীক্ষা ছিল ইতিহাসে। মোগল সাম্রাজ্যের পতনের ইতিহাস লিখ। লতিকাদি আমাদের ইতিহাস পড়াতেন। আমার সবচেয়ে প্রিয় দিদিদের একজন। যাঁর পড়ানোর গুণে আমাকে অন্তত কোনোদিন ইতিহাস "মুখস্থ" করতে হয়নি। সে পরীক্ষায় আমি পঁচিশে বাইশ পেয়েছিলাম। ওটাই হায়েস্ট ছিল। লতিকাদি বলেছিলেন, "নতুন এসেছ ? বা:!"

সাময়িকভাবে আত্মশ্লাঘা হলেও বাড়ি ফেরার পথে শিউরে উঠেছিলাম। এই "হায়েস্ট " -এর গন্ধ নেশার মতো। আমার মা জননীর আবার এ নেশায় বুঁদ হয়ে থাকার নেশাটি আমার অক্ষর পরিচয়ের দিনটি থেকেই রপ্ত করা আছে। আমি কি তবে আজ নিজের কবর নিজেই খুঁড়লাম ?

একদিকে এই দুশ্চিন্তা, অন্যদিকে শুরু হচ্ছে হতচ্ছাড়া সেলাই আর ড্রয়িং ক্লাস। দুটোতেই আবার আমার জুড়ি নেই! একটা লাইন ঠিক করে টানতে পারি না, জলরঙের কন্সিস্টেন্সির মা বাপ নেই...তুলি দিয়ে বোলালে দেখি রঙের চেয়ে জল বেশি, সেলাই করতে গেলে ছুঁচ ফুটে যায় হাতে, হেম সেলাই তো জগতের সবচেয়ে কঠিন ফোঁড়...যতই ছুঁচ হেলাই, আমার হেম সেলাই খটখটে চোখে সটান শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকে, উল বুনতে গেলে ঘর পড়ে যায় এবং যখন পড়ে তখন টের পাই না...টের পেতে পেতে দু-কাঠির মোজা বোনা প্রায় শেষের দিকে পৌঁছে যায়...আমি নিশ্চিত সেলাই ড্রয়িঙে ফেল করব। এবং তাই হয়। সেলাইটা টায়েটায়ে উৎরে গেলেও ড্রয়িঙে আমি হাফ -ইয়ারলিতে...এক নম্বরের জন্য লাল কালিতে চিহ্নিত হই। তবে সব মিলিয়ে যা রেজাল্ট হয়, তাতে ফিলোমিনাদি হেঁড়ে গলায় সামান্য ধমক দিয়ে সেবারের মতো ছেড়ে দেন। আমিও এমন নির্বিকারে ঘুরতে থাকি, যেন আমাকে লাল কালিতে দেগে দেওয়াটা দিদিরই অবিমৃষ্যকারিতা!

তবে অ্যানুয়েলে কেমন বিচ্ছিরি লাগবে না লালকালিটা? মানে মা তো ফার্স্ট না হলে কান পেঁচিয়ে দেবে...এদিকে তার সঙ্গে ওই এক বালতি দুধে এক ফোঁটা চোনার মতো লাল কালি... আমি খুব মন দিয়ে ঘটিবাটির কার্ভ আর আঁচলাসমেত শাড়ির পাড় প্র্যাকটিসে মন দিই। অধ্যবসায়ে কী না হয়!

লাল বদলে যায় রয়াল ব্লু-তে। পার্মানেন্টলি। যদিও সেলাই ড্রয়িঙে বা পরবর্তীকালে ওয়র্ক এডুকেশনে সে নীল খুব উজ্জ্বল ছিল না... ফিকে... জল মেশানো... তবু... নীল তো! 


(৩)

ক্লাস ফাইভে অঙ্ক নিতেন নীলিমাদি। খুব রোগা, ফর্সা, চশমা পরা, একটু খামখেয়ালি ধাঁচের। নম্বর দিয়ে আবার বড় বড় করে মন্তব্য দিতেন, বাজে-ভালো-খুব ভালো-অতি ভালো+। মাঝেমাঝে ++ ও থাকত। হোলি চাইল্ডে অনেক দিদিরই কোনো অজ্ঞাত কারণে পদবী ছিল সেন এবং তাঁদের সে পদবী বদলের কোনো সদিচ্ছাও ছিল না। নীলিমাদি, বন্দনাদি, নন্দিনীদি সব্বাই। এমনকী আল্পনাদিও। অবশেষে আল্পনাদি যেদিন কোঁকড়া চুলের ফাঁকে সরু সিঁথিটি রঙিন করলেন এবং সেন থেকে ভটচায্যি হলেন, আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলাম। তবে ততদিনে আমরা ক্লাস টেনে। 

ক্লাস সিক্সে শুরু হলো অতি অখাদ্য জ্যামিতির উৎপাত। পড়াতে এলেন সুজাতাদি। ইয়াব্বড় কাঠের জ্যামিতি বাক্স (বোর্ডে আঁকার জন্য) এবং প্রভূত পরিমাণে পক্ষপাতিত্ব সঙ্গে নিয়ে। সে এক অকথ্য অত্যাচার! আমাদের মাঝেমাঝেই বোর্ডে তোলেন। কী করে যে ওই রাক্ষুসে কম্পাস কায়দা করে ধরতে হয় যীশুই জানেন, তাতে আবার চক লাগাতে হয়। আমি না পেরে দিদির বিষনজরে পড়ি এবং সুচরিতা কাঁটা কম্পাস বাগিয়ে ধরে এবং দিদির সব কথায় ঢকঢক করে ঘাড় হেলিয়ে চোখের মণি হয়ে ওঠে। সুচরিতার কথা বললাম, কারণ আমি আর সুচরিতা এক্সট্রিম কেস... বাকিরা ভালো -মন্দর মাঝে ত্রিশঙ্কু হয়ে ঝুলে থাকে।

ড্রয়িং ক্লাস হয়ে ওঠে আতঙ্কের কারণ পোর্ট্রেট আঁকা শুরু হয়। সব ব্যাটা হয় অ্যাপোলোর মতো সুন্দর, নয় তো বুদ্ধদেবের মতো সর্বংসহ। আমি আঁকতে গেলেই সে মুখ পি টি দিদিমণি অঞ্জলিদির মতো হয়ে যায়।

সেলাই ক্লাস শুরু হয় চার কাঁটার মোজা বোনা দিয়ে। আমার নাকাল অবস্থার ফারাক হয় না। দু-কাঁটাতেই ডুবজল, চার কাঁটাতে নাভিশ্বাস ওঠে। আর ছুঁচেরকাজ করতে গিয়ে আবিষ্কার করি, আমার সবচেয়ে প্রিয় ফোঁড় রান সেলাই।

ক্লাস সিক্স। গড় বয়স এগারো। সে বয়স "ফুলের বনে যার পাশে যাই, তারই লাগে ভালো"-র ইশারা মনে উঁকিঝুঁকি দেওয়ার বয়স। তখন সাপ্তাহিক "দেশ"-এ ধারাবাহিক চলছে সুনীলের "একা এবং কয়েকজন", বেতার জগতে শীর্ষেন্দুর "জীবনপাত্র"। আমরা চুটিয়ে পড়ছি এবং বহুবিধ জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হচ্ছি। বাইবেলের কঠোর অনুশাসনের সাধ্য কী যে আমাদের দমিয়ে রাখবে? ফলে নীতিশিক্ষার ক্লাসে কানে তুলো গুঁজে বসে থাকি, ফিসফিসিয়ে নবীন কিশোরদের সম্মোহক চাউনি নিয়ে আলাপচারিতা হয়, কেউ কেউ বাছুরে প্রেমের গুল্প ফাঁদে এবং আমরা শুনে শিহরিত হই। সে শুধু অবাক হওয়ার বয়স। সেবয়সে বক্তার বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করার তাগিদ থাকে না। সে "যত শুনি, তত শিখি"-র বয়স। পড়ার বই আর গল্পের বইতে অহর্নিশ দ্বন্দ্ব জারি থাকে এবং আমার নম্বরের গ্রাফ কোনো নিয়মের বালাই না রেখে ইচ্ছেসুখে ওঠানামা করে।

আমাদের সময়ে হেডমিস্ট্রেস ছিলেন সিস্টার অ্যাগনেস। বাঘে গরুতে যেমন তেমন তেমন মনিব হলে একঘাটে জল খায়, সিস্টারের ভয়ে দিদিমণিদের, ছাত্রীদের এবং তাবৎ গার্জেনকুলের একঘাটে ঘাড় গুঁজে জল খেতে আপত্তি ছিল না। সিস্টার যে খুব বকাবকি করতেন, তা নয়। ওই ঠাণ্ডা গম্ভীর চোখ দেখলেই আমাদের গলা শুকিয়ে যেত, হাঁটু কাঁপত ঠকঠক করে। সে এক অদ্ভুত নীরব শাসন! কিন্তু ক্লাসে বসে এই সব নওলকিশোরদের নিয়ে "নির্দোষ" চর্চা করতে গেলে তেমন দিদিমণি চাই, যিনি হয় জাগ্রত এবং উদাসীন (সোনার পাথরবাটি) অথবা নিদ্রালোভী। তা তেমনও ছিলেন বৈকি একজন। এলিজাবেথ গোমস। দৈর্ঘ্যে তিনফুট, প্রস্থে বা বেড়েও তাই, একতাল নৈবেদ্যের ওপরে ছোট্ট দেদো সন্দেশের মতো মাথাটি আর সন্দেশের ওপরে দোপাটি ফুলের পাপড়ির আকারে ছোট্ট বড়ি খোঁপা। কোনোমতে জেগে জেগে হেঁটে স্কুলে ঢুকতেন এবং ক্লাসে এসেই ঘুমিয়ে পড়তেন। পড়াতেন হিন্দি। আমরা জানতাম, দু-বছর পড়ব এবং নিশ্চিন্তে ভুলে যাব, তাই দিদিও আমাদের ঘাঁটাতেন না, আমরাও দিব্যি রসেবশে থাকতাম ওই পিরিয়ডে। খুব সোরগোল করলে অবিশ্যি চটকা ভেঙে লাল চোখে সরু গলায় ডেস্কে স্কেল পিটিয়ে তর্জন গর্জন করতেন, তবে সে আস্ফালন ধোঁপে টিকত না। কবিতা মুখস্থ করার কথা। গাধা এক থা মোটা তাজা। তা প্রথম লাইনটা জোরে জোরে বললেই উনি নাক ডাকতে শুরু করতেন ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে, আমরা বাকিটা হুঁ হুঁ করে চালিয়ে দিতাম। একের পর এক ওই এক ছত্র কবিতা, বাকিটা হুঁ হুঁ। তবে মাঝেমাঝে জাগতেন। সেই অবসরে সিলেবাস শেষ হতো।

সিস্টার অ্যাগনেসের শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে যেমন নবীন প্রেমিকরা আসত আমাদের ফিসফিসানিতে, তেমন করেই কী ভাবে যেন এন্ট্রি নিয়েছিল এক বেঁটে সিড়িঙ্গে চশমা নাকে চানাচুরওয়ালা। সে ব্যাটা টিফিনের সময়ে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে জাঁকিয়ে ব্যবসা করত। দশ পয়সা করে আধ আঙুল ঠোঙায় (অত সরু আর ছোটঠোঙা বানাতেও এলেম লাগে) বিক্রি করত বাদাম, চানাচুর বা মটর, পাঁচ পয়সায় কুট্টি কুট্টি বুনো কুল, কেলেকুষ্টি হজমিগুলি আর চিড়িক তোলা ইলেকট্রিকনুন। আমার জুটত না সে সব অমৃত, কারণ পকেটমনির সীন ছিল না আমার বাড়িতে আর "পুষ্টিকর" (অর্থাৎ অখাদ্য) টিফিন খাওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। সে ব্যাটার কাছে ধারবাকির কারবার ছিল না (ভাগ্যিস ছিল না, কারণ শোধ করার উপায়ও তো ছিল না আমার)। লোকটাকে দেখলেই আমার গা জ্বলে যেত।

সে জ্বালা কমত শুধু বুধবার। টিফিনের পরের পিরিয়ডে লাইব্রেরি ক্লাস। শেফালিদি। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আমি মিঠে কথা বলে বলে মন ভিজিয়ে নিয়েছিলাম দিদির। আগেই তাই ইন্সপেক্ট করে রোল নম্বর হিসেবে করে নিজের পছন্দের বই (মানে যেগুলো ওই মন্দের ভালো, যেমন রাণুর প্রথম ভাগ বা তালনবমী) গুঁজে রাখতাম পাইলে। উপায় কী! যে লাইব্রেরিতে শুধু মহাপুরুষদের জীবনী, যেখানে সবচেয়ে রোম্যান্টিক বইয়ের নাম "নন্দকান্ত নন্দাঘুন্টি" (আমি আবার একবার ওটা ইস্যু করে বোকা বনেছিলাম। ভূগোলে কাঁচা ছিলাম খুব...ভেবেছি নন্দ আর নন্দা মানে রোমিও -জুলিয়েট টাইপ কিছু গল্প টল্প হবে!)...সেখানে জোচ্চুরি না করে উপায় কী!



(৪)

ক্লাস সেভেনে নতুন একটি মেয়ে এল। ডাফ স্কুল থেকে। কাকলি। আমার খুশির আর শেষ রইল না। আমার মতোই ক্লাসে কথা বলতে ভালোবাসে এ মেয়ে। আমরা পাশাপাশি বসে গল্প করে করে ক্লাসটিচার মিনতিদির জীবন এমন মহানিশা করে তুললাম, যে দিদি আমাদের মাঝে পাঁচিল করে মিতা গুপ্তকে বসিয়ে দিলেন। তাতে আমাদের ভারী বয়েই গেল। আমরা দু-জন মিলে মিতার মাথা ডেস্কে চেপে শুইয়ে রেখে তা ঠেসে ধরে (যাতে মাথা তুলতেই না পারে) গল্প চালিয়ে যাচ্ছি রোজ। মিতার অবস্থা শুনে মিনতিদি আর রিস্ক না নিয়ে পুরোনো ব্যবস্থাই বহাল রাখলেন। শুধু কথায় কথায় বললেন, "একটা মাত্র মেয়ে যারা, তারা ভারী অবাধ্য হয়।" আমাদের ভারী গাত্রদাহ হলো। আমি আর কাকলি...কারো ভাই বোন নেই। মিনতিদির মেয়ে শম্পা তখন ক্লাস থ্রীতে পড়ে। আমরা তাকে পাকড়ে হাঁড়ির খবর নিলাম। তারপর মিনতিদিকে একদিন বললাম, "শম্পার তো ভাই বোন নেই দিদি, না ? ভারী অবাধ্য হবে কিন্তু কালে কালে। দেখবেন!"

ক্লাস সেভেনে থাকতেই একদিন শুনলাম স্কুলে আসবেন ভ্যাটিকান সিটি থেকে কার্ডিনাল মেৎসোকান্তি। সে তো সাজ সাজ রব। লালমুখো সাহেব, গ্যাটম্যাটকরে ইঞ্জিরি বলবেন, ধর্মকথাও নিশ্চই...আমাদের পইপই করে নানা সহবত শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল। নির্দিষ্ট দিনে সাদা ধবধবে সারপ্লিস আর লাল সোনালি সরু শাল জড়িয়ে কার্ডিনাল স্কুল পরিদর্শনে এলেন। আমরা সরু-মোটা গলায় "গুড আফটারনুন" বলে চারটে করে টফি আর একটা করে ছোট টিফিন কেক পেলাম। 

আমাদের তো খেলার মাঠ ছিল না। শানবাঁধানো উঠোন ছিল আর অতি হতচ্ছাড়া পি টি ক্লাস ছিল। তাতে যে কী হাতিঘোড়া ড্রিল হতো, না বলাই ভালো! ওই করে কী চতুর্বর্গ লাভ হতো, তাও জানি না! 

স্কুলে আসি, নিয়মমাফিক ক্লাস হয়, পরীক্ষা হয়, বকুনি হয়, নিগ্রহ হয়...সেই এক থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়। আমি সেয়ানা। পরীক্ষা দিয়ে অক্লেশে বলি, "দারুণ হয়েছে।" ভাবটা এই, এখন থেকে বকুনি খেয়ে মরি আর কী! যেটা পারিনি...বলে দিই যে ক্লাসের কেউ পারেনি। কিন্তু বাড়িতে যে ভবিদেবী বিরাজমানা, তিনি ভুললে তো! এমন গার্জেন আমার, স্কুলে গিয়ে হেডমিস্ট্রেসকে বলে আসা হলো, রিপোর্ট কার্ডে যেন সব সাবজেক্টে একটা নতুন কলাম যোগ করা হয়...তাতে তিন সেকশন মিলিয়ে সে সাবজেক্টে হায়েস্ট মার্ক্স্ লেখা থাকবে। ব্যাপারটা বোঝা গেল? যাতে আমাকে অনন্ত চাপে রাখা যায়! আমাদের সেবছরে ক্লাস সেভেনের অ্যানুয়েল পরীক্ষা থেকে সেই কালান্তক নিয়মের শুরু। আমার মা জননীর উর্বর মস্তিষ্কের ফসল।

ক্লাস এইট হলো আমাদের। এ বছরের ক্লাসরুম যদিও চারতলার ওপরে, কিন্তু চিলতে বারান্দা পেরোলেই রাস্তা দেখা যায়। বীডন স্ট্রীট দিয়ে পরেশনাথের মিছিল যায়। ওই একটি দুটি দিন জগঝম্প বাজতে শুরু করলেই আমরা পিঁজরাপোলের ছাগলছানারা তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে বারান্দায় ভিড় জমিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ি। প্রায় উল্টোদিকের স্কুল ভবতারণ। সেখানকার পাকা এবং আধপাকা কিশোরদের বুকে ঢেউ খেলে যায়।

এই ক্লাস এইটে উঠে আমাদের ক্লাসের দেবী চৌধুরী প্রেমে পড়ল। সে একেবারে লাট খাওয়া প্রেম যাকে বলে। দেবীরা থাকত বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাবের গলিতে। প্রেমিকের নাম বাচ্চু। লম্বা হিলহিলে, গায়ের রং শ্যামলা, সিগারেট খেয়ে ঠোঁট কুটকুটে কালো, এক হাতে স্টিলের বালা, ড্রেনপাইপ প্যান্ট, চকরাবকরা শার্ট... একেবারে পাড়ার উঠতি গুল্লু মস্তান। দেবী আবার তাকে "বাচ্চুদা" বলে। আহা, সে তো বলবেই। গুরুজন বলে কথা! তা একদিন সন্ধেবেলা দেবী তার হাত ধরে গলির মোড়ে গুনগুন করছিল... পড়বি তো পড় মিনতিদির চোখে! আর পায় কে! মিনতিদি পরের দিন দেবীকে ধরে...
-- ছি ছি দেবী! তুমি একটা ছোকরার হাত ধরে দাঁড়িয়েছিলে?
-- কে বলল? 
--কে আবার বলবে? আমি নিজে দেখেছি। ছিঃ, তোমার দিদি ছবি কতদিন আগে পাস করে বেরিয়ে গেছে, কই, তার তো এমন খারাপ স্বভাব ছিল না! 
এবার দেবী ফিল্ডে নামল।
-- দিদি আলাদা, আমি আলাদা। আর দেখুন, স্কুলে যতক্ষণ আছি... নিয়ম মেনে চলছি। স্কুলের বাইরে আমার গার্জেন শুধু আমার বাড়ির লোক। তাঁদের যখন সমস্যা নেই, আপনারা এত চেঁচামেচি করছেন কেন? চাইলে গার্জেন কল করে দেখুন। আমরা লুকিয়ে চুরিয়ে মিশি না।

মিনতিদির বাক্যি হ'রে গেল। আমরা গুল্লিগুল্লি চোখে দেবী চৌধুরাণীর তেজ দেখলাম। পরের বছর অবিশ্যি ও অন্য স্কুলে চলে যায়।

তবে এ ঘটনার পরে নিশ্চয়ই টিচার্স রুমে প্রবল হৈচৈ হয়েছিল। কারণ আমাদের মরাল গার্জেন হিসেবে এন্ট্রি নিলেন সিস্টার রোমানা। আমরা দুটো পিরিয়ডের মাঝের সময়টুকুতে কী কী করছি, কী নিয়ে হাসাহাসি হচ্ছে...এ সবের ট্র্যাক রাখতে সিস্টার রোমানা আড়াল থেকে তৎপর হলেন। চরিত্র সংশোধনী বটিকা তো পাওয়া যায় না, কিন্তু তা বলে তো কচি কচি মেয়েদের ছেড়েও রাখা যায় না! দরজার আড়ালে সিস্টার। আমরাও চালু মাল, একটু সাদা ঝিলিক দেখি দরজার আড়ালে আর জোরে জোরে নিষ্পাপ আলাপ আলোচনা করি। কিছুদিন চৌকিদারি করে সিস্টার রণে ভঙ্গ দিয়েছিলেন।

এত কথার মাঝে বলতে ভুলেছি, সিস্টার অ্যাগনেস চলে যাওয়ার পরে হেডমিস্ট্রেস হলেন সিস্টার ম্যাক্সিমিলা। মাল্টাতে বাড়ি, ফুটফুটে মেমসাহেব, মুখে অনাবিল হাসি আর বুকে একরাশ ভালোবাসা নিয়ে। আমি আমার স্কুলজীবনে এত ভালো আর কাউকে বাসিনি। সিস্টার এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। আমাদের সবক'টি কচিকাঁচা বালিকাহৃদয়কে। আমরা এই প্রথম ভয় না পেয়ে কোনো শিক্ষিকাকে শতকরা একশ'ভাগ ভালোবাসতে শিখলাম। আমরা কোনো ক্ষোভের কারণ ঘটলে তা নিয়ে খোলা মনে আলোচনা করার জায়গায় পৌঁছেছিলাম। হোলি চাইল্ডের নীল আকাশ এই প্রথমই একটুকরো রুমালের সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে আমাদের সবার কাছে অনন্ততার অনুভব নিয়ে এসেছিল। আমরা সত্যিই মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলাম।

(চলবে)

0 comments: