2

সম্পাদকীয়

Posted in




সম্পাদকীয়



দেখতে দেখতে বইমেলা একেবারে দোরগোড়ায়। গত কয়েকটা দিন কেটে গেলো অসম্ভব ব্যস্ততায়। ঋতবাক মুদ্রণ সংখ্যার প্রস্তুতির ব্যস্ততায়। এই ব্যস্ততার সূচনা অবশ্য বেশ কিছুমাস আগেই। সেই সময়, একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে তখন সেরা একশোটি লেখা বাছাইয়ের কাজ চলছিলো। ‘প্রবন্ধ কটি আছে?’, ‘গল্পগুলো সব একজায়গায় করে দাও তো’, ‘কবিদের একটা লিষ্ট পাওয়া যাবে কি?’... নির্বাচকদের হাজারও সাহায্য - ফোন, মেইল, দৌড়োদৌড়ি! 

একেবারে প্রথমে ঠিক হয়, সংকলনটি হবে একশো পৃষ্ঠার। কিন্তু ঋতবাকের সঙ্গে নিয়মিতভাবে সম্পৃক্ত প্রায় দু’শো কবি-সাহিত্যিককুলের এমনকি নির্বাচিত লেখাগুলিকে পুনর্বিবেচনা করেও যে আয়তন দাঁড়ায়, তাতে করে একটি পাঁচশো পৃষ্ঠার সংকলনও কম পড়বে, একথা বোঝা গেলো অচিরেই। পুনঃসিদ্ধান্তে পৃষ্ঠাসংখ্যা দেড়শো করেও বিশেষ সুরাহা হলোনা, বলাই বাহুল্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাধ্যের চোখরাঙ্গানিতে সাধের রাশ টানতেই হলো একটি দু’শো পৃষ্ঠার সংকলন প্রকাশের সিদ্ধান্তে। 

লেখা নির্বাচনের পরেই অবশ্য শুরু হলো আসল কাজ। প্রুফ চেকিং...প্রুফ চেকিং...প্রুফ চেকিং!! এক দফা, দুই দফা, তিন দফা... তাও কিছু ভুল থেকে গেলো কিনা, কে জানে! তার পরেও প্রচ্ছদ তৈরী, বিজ্ঞাপন অলঙ্করণ, পৃষ্ঠা আর বাঁধাই কেমন হবে, বইমেলার কোন স্টলে থাকবে ঋতবাক, কোথা থেকে সংগ্রহ করা যাবে, আরো কত ধরনের ব্যবস্থাপনা! প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, বইমেলায় ঋতবাক পাওয়া যাবে থিম প্যাভেলিয়নের পাশেই ‘এই সহস্রধারা’ স্টলে, স্টল নম্বর ৩৯৮ এবং লিটিল ম্যাগ প্যাভেলিয়নে ‘গ্রাফিত্তি’-র টেবিলে। এই সম্বন্ধীয় যাবতীয় তথ্য পাওয়া যাবে আগামী ২রা ফেব্রুয়ারী প্রকাশিতব্য দেশ পত্রিকার বইমেলা সংখ্যায়, যা ৩১শে জানুয়ারী থেকেই পাওয়া যাবে সমস্ত বুক স্টলগুলিতেই। 

যাবতীয় ঝড়ঝাপটা সামলে শেষ পর্যন্ত ঋতবাক প্রস্তুত। আগামী ২৫শে জানুয়ারি, ২০১৬, বিকেল ৩টেয় সংকলনটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন শোভাবাজার রাজবাড়ির ঠাকুরদালানে। উদ্বোধন করবেন নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী। উপস্থিত থাকবেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, বিশ্বনাথ রায়, সুজিত আচার্যের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা। এ এক পরম পাওয়া। 

বইমেলায় প্রকাশের জন্য প্রস্তুত আরো একটি বই। ঋতবাকের ব্যবস্থাপনায় নন্দিনী সেনগুপ্তের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অরণ্যমেঘবন্ধুর দল’। এক অসাধারণ কবিতা সংকলন। ২৫শে জানুয়ারি, ২০১৬, বিকেল ৩টেয়, ঋতবাক মুদ্রিত সংস্করণ উদ্বোধন অনুষ্ঠানেই শোভাবাজার রাজবাড়ির ঠাকুর দালানে এই কাব্যগ্রন্থটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন বিশিষ্ট কবি অনীক রুদ্র। ভূতাত্ত্বিকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রত্যাশিত ভাবেই আদ্যন্ত প্রকৃতির সুবাসে সুরভিত। তিনপর্বে বিভক্ত গ্রন্থের প্রথম পর্বে অরণ্য, দ্বিতীয় পর্বে মেঘ-জল-নদী মনকে আবিল করে তুললেও তৃতীয় তথা শেষ পর্বে কবি ছুঁয়ে গেছেন সেই প্রকৃতিরই সন্তান, ভৌগোলিক সীমারেখা অতিক্রমী সর্বকালীন ছিন্নমূল মানুষের মর্মস্পর্শী অন্তরবেদনা... সামগ্রিকভাবে যা একজন মননশীল কাব্যপাঠকের সচেতন কাব্যতৃষ্ণাকে চূড়ান্তভাবে তৃপ্ত করবে, নিঃসন্দেহে। এককথায়, নন্দিনী সেনগুপ্তর 'অরণ্যমেঘবন্ধুর দল' একাধারে প্রকৃতিপ্রেমী ও সমাজসচেতন কাব্যরস-পিপাসু পাঠকের সংগ্রহে স্থান পাওয়ার দাবী রাখে প্রশ্নাতীত ভাবেই। 

২০১৬ বইমেলায় প্রথম মুদ্রিত সংকলন প্রকাশের টানটান উত্তেজনার চরম মুহূর্তে প্রকাশিত হলো ঋতবাকের নিয়মিত আঠারোতম ওয়েব সংখ্যা। এই সমগ্র পথচলায় সঙ্গে পেয়েছি অসংখ্য সাহিত্যপ্রেমী সুহৃদ-বন্ধুজনকে। ঋতবাকের পক্ষ থেকে তাঁদের সকলকে জানাই অশেষ কৃতজ্ঞতা। 

শুভেচ্ছা নিরন্তর...

সুস্মিতা বসু সিং

2 comments:

1

প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ পল্লববরন পাল

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


বইবই - মেলাবই
পল্লববরন পাল
 




বই নিয়ে হই চই – উৎসব – প্রদর্শনী – মেলা - ধ্যাৎ, তাও হয় নাকি?

বই কি বারোয়ারি পুজো, নাকি ঢাক-ঢোল-কাঁসি-নৃত্য?

রথমেলার তেলেভাজা নাকি তালপাতার সেপাই?

ধম্মের নাড়ু নাকি নাগরদোলা?

সুরে সুরে রাতভর অনুষ্ঠান নাকি সুর‍রিয়ালিস্ট তৈলচিত্রের সমাবেশ?
কী সব উল্টোপাল্টা বিদঘুটে চিন্তা!

এইরকমই মন্তব্য ছিলো অভিজ্ঞদের - ১৯৭৪ সালে যখন কিছু বাঙালি তরুন গ্রন্থপ্রকাশক কলকাতা কফিহাউসে বসে প্রকাশনাশিল্পের প্রসারের তাগিদে আড্ডা মারতে মারতে বই নিয়ে মেলার কথা ভেবেছিলেন এবং পরবর্তীকালে প্রস্তাব পেশ করেছিলেন কর্তাব্যক্তিদের কাছে। ফলস্বরূপ, ১৯৭৫-এ সুশীল মুখার্জির পৌরোহিত্যে জন্ম নিলো ‘পাবলিশার্স এণ্ড বুকসেলার্স গিল্ড’ – ’৭৬-এর ৫ই মার্চ মাত্র ৫৬টা স্টল নিয়ে ৩৪টা কলকাতার প্রকাশনা সংস্থা একাডেমি অফ ফাইন আর্টস আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাঝখানের চিলতে ঘাসের ওপর সদর্পে পা রাখলো প্রথম ‘কলকাতা পুস্তকমেলা’।

হাঁটি হাঁটি পা পায়ের পরেরটুকু ইতিহাস। আমাদের সকলের জানা। এ বছরে চল্লিশে পা দিলো বইমেলা।

যে মেলা বা উৎসবে হিন্দু-মুসলিম গরু-শুয়োর পায়েস-কেক নারী-পুরুষ প্রাপ্ত-অপ্রাপ্ত ভেদাভেদ নেই, খুন-ধর্ষণ নেই, ঢিসুমঢুসুম রাজনীতি নেই –

যে মেলার কেন্দ্রচরিত্র একমেবাদ্বিতীয়ম - বই।

বই কী?

একজন বা বহুজনের লিখিত ও মুদ্রিত দলিল। এটুকু এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলা যায়। কিন্তু, হঠাৎ লিখবার দরকার হলো কেন? যা বলতে চাই শোনাতে চাই জানাতে চাই একাধিক মানুষকে – তার জন্যই। এ পর্যন্ত আমাদের কাউকেই অযথা হোঁচট খেতে হয়নি। আর, মুদ্রণের দরকার পড়লো সেই কথা আরো অনেক মানুষের কাছে প্রচারের জন্য – যদিও মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার তো সাম্প্রতিক, মাত্র শ’ছয়েক বছর আগে। লেখার শুরু তো হাজার হাজার বছর আগে, সেই প্রস্তরযুগেই, যখন অনুভূতি আদানপ্রদানের মাধ্যম ছিলো একমাত্র পাথরের ওপর পাথরের অস্ত্র দিয়ে আঁকিবুকি কাটা। আঁকা আর লেখা তখন অভিন্নহৃদয়।

লিপি বা বর্ণমালার উদ্ভবের পরে লেখা আর আঁকা দুটি ভিন্ন সত্ত্বার স্বীকৃতি জুটলো, দুজনের মাঝখানে সীমান্তের কাঁটাতারের দেয়াল পড়লো। সে অন্য ইতিহাস। অন্যত্র আলোচিত হবে’খন। পৃথিবীতে যদি মানুষের সংখ্যা সবশুদ্ধ পঞ্চাশ এক’শ বা শ’পাঁচেক হতো, লেখা বা মুদ্রণের কথা হয়তো মাথায়ই আসতোনা কারুর। দরকারও পড়তো না। প্রস্তরযুগের মতো দেয়ালচিত্রেই হয়তো কাজ চলে যেতো। বর্ণমালা বা লিপিরও আবিষ্কার হতো কিনা সন্দেহ। 

বই লিখতে উপকরণ হিসেবে লাগে কাগজ, কলম আর কালি – যদিও ইদানিং এই তিনটের একটাও আর লাগছে না। কম্পিউটারের জানলাই এখন কাগজ,কলম হাতের আঙুল, সে আঙুল দিয়ে কীবোর্ডে টাইপ করেই কালির অক্ষর লেখা হয়ে যাচ্ছে কম্পিউটারের জানলায়। প্রস্তরযুগের পাথরের দেয়ালের বদলে আধুনিকযুগে আমরা জানলায় লিখছি। লেখা পড়া এখন সবকিছুই জানলায়।সভ্যতার বিবর্তন। ভবিষ্যতে আদৌ বই বলে কিছু থাকবে কিনা, সেটাই অধুনা চিন্তার খোরাক। বিস্তর বিতর্ক চলছে। কিন্তু বইয়ের ইতিহাসের পাতা ঘাঁটতে গেলে আপাতত কাগজ কলম আর কালিকে অস্বীকার করার উপায় নেই।



ওসিরিস ঈশ্বরের ছবি - মিশরীয় প্যাপিরাস

লিপির আবিষ্কার সম্ভবত মিশরীয় সভ্যতার আদিযুগে। নীলনদের তীর বরাবর জন্মানো প্যাপিরাস গাছ - সেই গাছের ছাল কেটে, রোদ্দুরে রেখে শুকিয়ে তারপর পাথরের হাতুড়ি পিটিয়ে পিটিয়ে তৈরি হলো পাতলা ব্লক – যার ওপর বাঁশের কঞ্চির একপ্রান্ত ছুঁচলো করে শুরু হলো লেখা ও আঁকা। এইরকম লিখিত ব্লকের প্রান্ত বুনে বুনে নয়তো আঠা দিয়ে সেঁটে একসাথে তৈরি হলো বই। এখন অবধি আবিষ্কৃত পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো বই হলো রাণী নেফারতিতির আমলের হিসেবের বই, আনুমানিক ২৪০০ খৃষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ের।

প্রথম লেখার কালি জন্ম নিলো চীনদেশে খৃষ্টজন্মের প্রায় ২৩০০ বছর আগে।গাছের রস, জন্তুজানোয়ারের চামড়া থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় চৈনিকেরা তৈরি করলো এই কালি। সমসাময়িক কালে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন জনগোষ্ঠী নিজেদের এলাকার গাছগাছালি থেকে নিজেদের সুবিধেমতো কালি বানিয়ে নিতো। তাই দিয়েই লেখালেখির জয়যাত্রা শুরু।

ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের মতে, প্যাপিরাস পদ্ধতির বই ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে দশম খৃষ্টপূর্বাব্দে গ্রীসে নিয়ে আসেন ফিনিশিয়রা – অধুনা লেবানন ইস্রায়েল সিরিয়ার আদি যুগের মানুষেরা – যারা আধুনিক সভ্যতায় শিক্ষিত হয়ে এখন যুদ্ধ মৃত্যু ও ধ্বংসকে জীবনে অগ্রাধিকার দিয়েছে – আড়াই হাজার বছর আগে এত সভ্য ছিলোনা তারা, কাজকম্মোও ছিলো কম, তাই বোধহয় সত্যিকারের সভ্যতার সামগ্রিক বিকাশের কথা ভেবে তারা এক যুগান্তকারী কাজ করে বসলো। বর্ণমালাকে প্রথম সার্বজনীন স্বীকৃতি দিয়ে দিলো। যার ফলে ধীরে ধীরে জন্ম হলো বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর। সমাজে এলো নতুন নতুন জীবিকা - লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন কিছু মানুষ। আর সেইসব লিখিত বইপত্র যাঁরা পড়লেন বা অধ্যয়ন করলেন, তাঁরা সমাজে পণ্ডিত হিসেবে পরিচিত হলেন।



বার্চ গাছের ছালের ওপর খোদিত লিপি (পঞ্চম শতক)

বিভিন্ন দেশের নিজস্ব ভৌগোলিক কারণে প্যাপিরাসের বিভিন্ন বিকল্প মাধ্যমের সৃষ্টি হলো – প্যাপিরাসের বিকল্প হিসেবে এলো পার্চমেন্ট এবং ভেল্লাম – যা মুলত ভেড়া ছাগল গরুর চামড়া থেকে তৈরি। এলো বিভিন্ন গাছের ছাল – বার্চ খেজুর এরকম আরও অনেক। সার্বজনীনতার ফলে বইয়ের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলো।একটা বই থেকে কপি করে একাধিক বই তৈরির দরকার পড়লো। নতুন জীবিকার জন্ম হলো - নকলনবিশ।

জন্ম হলো পাণ্ডুলিপির – মূল লেখকের নিজের হাতের লেখা বই। নকলনবিশেরা সে বইয়ের কপি করে করে পৌঁছে দিলেন আরও অনেক মানুষের কাছে। এই ধারণার প্রকৃত বিকাশ হলো মুদ্রণশিল্পের জন্মের পরে।


ব্রাহ্মীলিপিতে লিখিত প্রাচীন পুঁথি 

ভারতবর্ষে হিমালয় পাদদেশে অফুরন্ত বার্চ গাছের ছালের ওপরে লেখা বইয়ের তথ্য আমরা সুশ্রুত (তৃতীয় শতাব্দী) কালিদাস (চতুর্থ শতাব্দী) বরাহমিহির(পঞ্চম শতাব্দী) প্রমুখ মনিষীদের লেখা থেকে জানতে পারি। প্রথম শতাব্দী নাগাদ ব্রাহ্মীলিপিতে লিখিত বৌদ্ধযুগীয় এরকম অসংখ্য পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয়েছে তক্ষশীলায়। প্রায় তিন হাজার এরকম পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে বর্তমান আফগানিস্তানের বামিয়ান গুম্ফায়। তৎকালীন ছোটো ছোটো মঠগুলির ক্ষমতা অনুযায়ী এরকম কম বেশি কয়েকশো করে পুঁথি ছিল নিজেদের।মধ্যযুগের মঠগুলির কারো কারো হাতে ৫০০ থেকে ২০০০টি পুঁথি ছিলো – এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এ সবই মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের আগের ঘটনা। 

আধুনিক সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার মুদ্রণযন্ত্র। তার অনেক আগেই,সম্ভবত খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে চীনদেশ করে ফেলেছে কাগজ ও কালির আবিষ্কার,যদিও প্রথম কাগজ তৈরির কারখানা নির্মাণ করতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ত্রয়োদশ শতক অবধি। আর ১৪৪০ সালে জোহানেস গুটেনবার্গ ইউরোপে নিয়ে এলেন প্রথম মুদ্রণযন্ত্র, অবশ্য তার আগে ১৩৭৭ সালেই চীনে এসে গেছে পোড়ামাটির ব্লক দিয়ে মুদ্রণের পদ্ধতি। রেনেসাঁযুগে ইউরোপে এই মুদ্রণযন্ত্রের প্রসার হলো বিপুল। শিল্পবিপ্লব এই পদ্ধতিকে করে দিলো সাধারণ মানুষের কাছে আরও সহজলভ্য। কাগজ কালির ব্যাপক উৎপাদনের ফলে খরচ কমে গেলো, মুদ্রণমূল্যও কমে গেলো যন্ত্রের বিপুল ক্ষমতায়।

ব্যস! পরবর্তী কয়েক শতকে বইয়ের বিবর্তনের ইতিহাস আমরা সবাই কমবেশি জানি। উৎপাদন বাড়ার ফলে বই নিজেই একটা বিপুল সম্ভাবনাসমৃদ্ধ আস্ত শিল্প হয়ে উঠলো। গজিয়ে উঠলো প্রকাশনা সংস্থা। সাহিত্য শিল্পের নিজস্ব তাগিদে বাজারে এসে গেলো সাময়িক ম্যাগাজিন বা পত্রিকা। অষ্টাদশ শতকে এই ধরনের সাহিত্যপত্রিকা বিপুল জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। বই চলে এলো ঘরে ঘরে।

বই নিয়ে হইচইয়ের সেই শুরু।

অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ইউরোপে শুরু হলো শিল্পমেলা, যেখানে প্রদর্শিত হতে শুরু হলো নতুন নতুন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নিদর্শন। বই নিয়ে মেলার শুরু স্থানীয় স্তরে শুরু হয়েছে প্রায় পাঁচশো বছর আগেই, যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৪৯ সালে ফ্র্যাঙ্কফুর্টের সেন্ট পল চার্চে আয়োজিত মেলাই প্রথম আধুনিক আন্তর্জাতিক বইমেলা হিসেবে স্বীকৃত।

বইয়ের আবিষ্কারক কে? – আমি জানিনা।

মেলার ভাবনা কার মস্তিষ্কপ্রসূত? – আমি জানিনা।

যেটুকু জানি, সেটা হলো – শ্রী সুশীল মুখার্জী ও তার দলবলের গোঁয়ার্তুমি থেকে জন্ম নিয়েছিলো আমাদের বাংলার বইমেলা, যা আজ শুধু কলকাতায় নয়, ছড়িয়ে পড়েছে জেলায় জেলায়, স্থানীয় স্তরে।

দুর্জনেরা বলে – ইদানিং ঘরে ঘরে নাকি অস্ত্রশিল্প প্রসার লাভ করেছে আমাদের বাংলায়। প্রসার ঘটুক অস্ত্রশিল্পের – বই হয়ে উঠুক আমাদের সার্বজনীন অস্ত্র হাতিয়ার।

আসন্ন বইমেলায় এটাই হোক আমাদের শপথ।


1 comments:

1

প্রবন্ধঃ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় – সার্ধশতবর্শের শ্রদ্ধাঞ্জলি
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



জন্ম মহাবিদ্রোহের সাত বছর পরে, মৃত্যু স্বাধীনতার চার বছর আগে। অর্থাৎ আমাদের জাতীয়তাবাদের উন্মেষলগ্ন থেকে তার চরম প্রকাশের বিস্তীর্ণ সময়টাই তাঁর জীবনকাল। তিনি উনিশ শতকের বাংলার বৌদ্ধিক জাগরণকালের বিশিষ্ট কৃতবিদ্য ব্যক্তিত্ব – রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। সেই সময়টার কথা ভাবা যাক।বাংলার সারস্বতভূমিতে নক্ষত্রের কি আলোকদ্যূতি – জগদীশচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, কামিনী রায়, অবলা বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন। বাংলার সারস্বতভুমির সে এক মহা সৃজনকাল। অন্যদিকে জাতীয়য়াবাদী চেতনার বিকাশ। এই আবহে জন্ম রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের।

শুধু সাংবাদিক বা ‘প্রবাসী’ ও ‘মডার্ণ রিভিউ’ পত্রিকার সম্পাদক বললে কিংবদন্তীতুল্য রামানন্দ সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না। রবীন্দ্রনাথ ‘সবুজ পত্র’ পত্রিকায় লিখেছিলেন “সুদীর্ঘকাল আমার ব্রত যাপনে আমি কেবল যে অর্থহীন ছিলেম তা নয়, সঙ্গহীন ছিলেম; ভিতরে বাহিরে বিরুদ্ধতা ও অভাবের সঙ্গে সম্পূর্ণ একা সংগ্রাম করে এসেছি। এমন অবস্থায় যাঁরা আমার এই দুর্গম পথে ক্ষণে ক্ষণে আমার পাশে এসে দাড়িয়েছেন, তাঁরা আমার রক্তসম্পর্কগত আত্মীয়ের চেয়ে কম আত্মীয় নন, বরঞ্চ বেশি। বস্তুত আমার জীবনের লক্ষ্যকে সাহায্য করার সঙ্গে সঙ্গেই আমার দৈহিক জীবনকেও সেই পরিমানে আশ্রয় দান করেছেন। সেই আমার অল্প সংখ্যক কর্মসুহৃদদের মধ্যে ‘প্রবাসী’ সম্পাদক অন্যতম। আজ আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি।” এহেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। ‘নটীর পূজা’ প্রবাসীকে না দিয়ে মাসিক বসুমতীকে দেওয়ার কারণে রামানন্দ ব্যথিত হয়েছিলেন। প্রবল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন রামানন্দ রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন “আপনি অতঃপর আমাকে বাংলা ও ইংরাজি কোন লেখা দিবেন না।’’ ‘বিচিত্রা’ ও ‘সবুজ পত্র’ প্রকাশের পর রবীন্দ্রনাথে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে ঐ দুটি পত্রিকার সঙ্গে, কিছুটা পারিবারিক দায়বদ্ধতার কারণে।অভিমানাহত রামানন্দ রবীন্দ্রনাথকে লেখেন “আমি আপনার লেখা হইতে বঞ্চিত থাকিবার প্রতিজ্ঞা করিলাম ...... ‘মডার্ণ রিভিউ’এর জন্যও অনুগ্রহ করিয়া অতঃপর আমাকে কোন লেখা দিবেন না”।

জন্ম ২৯শে মে ১৮৬৫ বাঁকুড়া জেলার পাঠকপাড়ায় এক সংস্কৃত পণ্ডিত বংশে।পিতা শ্রীনাথ চট্টোপাধ্যায় ও মাতা হরসুন্দরী দেবীর তৃতীয় পুত্র রামানন্দ, বিদ্যালয় ও কলেজ জীবনে ছিলেন অত্যন্ত মেধাসম্পন্ন। ১৮৮৩তে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। দু’বছর পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ পরিবর্তন করে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে চতুর্থ স্থান অধিকার করে এফ এ পরীক্ষায় কৃতকার্য হন। ১৮৮৬তে বাঁকুড়া জেলার ওন্দা নিবাসী হারাধন মিশ্রের ১২ বছরের কিশোরী কন্যা মনোরমার সঙ্গে বিবাহের দু বছর পরে ১৮৮৮তে সিটি কলেজ থেকে ইংরাজি সাহিত্যে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতক হন এবং রিপন স্কলারশিপ লাভ করেন।

রামানন্দের কর্মজীবন ছিল বহুধা বিস্তৃত – শিক্ষকতা, পত্রিকা সম্পাদনা ও জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রচার ও স্বাদেশিকতা। রামানন্দের সাহিত্য-গবেষণা কীর্তি তাঁর সাংবাদিক ও সম্পাদক পরিচয়ের আড়ালে থেকে গেছে। তাঁর রচিত-অনূদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে আরব্যোপন্যাস, রাজা রবি বর্মার জীবনী, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে কৃত্তিবাসী রামায়ণ, সচিত্র অষ্টাদশ পর্ব মহাভারত, টুওয়ার্ডস হোম রুল, রামমোহন রায় অ্যান্ড মডার্ন ইন্ডিয়া, দ্য গোল্ডেন বুক অফ টেগোর, ইত্যাদি।

পত্রিকা সম্পাদনা সেযুগে সমাজকর্মীদের মধ্যে একটা প্রথা হয়ে উঠেছিল। অক্ষয় কুমার দত্ত সম্পাদিত ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা (১৮৪৩-১৮৮৪) এর আদি নিদর্শন।কেশবচন্দ সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী সহ ব্রাহ্মসমাজের অনেকেই পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। জ্ঞান-বিদ্যা চর্চা, সমাজ সংস্কার ও জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রসারে এই সব পত্রিকা প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল। রামানন্দের সামনে এই আদর্শ ছিল। সিটি কলেজে ছাত্রাবস্থায় অধ্যক্ষ উমেশচন্দ্র দত্তের ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকাও রামানন্দকে আকর্ষণ করেছিল। শিবনাথ শাস্ত্রী প্রতিষ্ঠিত ‘ইন্ডিয়ান মেসেঞ্জার’ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক হেরম্বচন্দ্র মৈত্র ছিলেন রামানন্দের শিক্ষক। তিনি রামনন্দকে ইন্ডিয়ান মেসেঞ্জারের সহ-সম্পাদক পদে আহ্বান করেন। এখানে রামানন্দ লেখালেখি করতেন। ১৮৯১-এর মাঝামাঝি কিছু ব্রাহ্ম হিতসাধক তরুণ নিরন্ন, পীড়িত মানুষের সেবাব্রতের আদর্শে গড়ে তুলেছিলেন ‘দাসাশ্রম’ নামে এক সেবাপ্রতিষ্ঠান। রামানন্দও ছিলেন সেই তরুণ দলে। ১৮৯২-এ রামানন্দ বের করলেন তাঁদের সেবাপ্রতিষ্ঠানের মুখপত্র ‘দাসী’। তাঁর সম্পাদনা গুণে ‘দাসী’ শুধুমাত্র সেবাপ্রতিষ্ঠানের মুখপত্র হয়েই থাকে নি। সেকালের সাহিত্য সাধকদের আকর্ষণ করে আর সমকালীন সামাজিক ঘটনাবলীর প্রকাশ করে পত্রিকাটিকে বিশিষ্ট মর্যাদা দান করেছিলেন রামানন্দ। একথাও বলা হয় যে ‘দাসী’ই হল ‘প্রবাসী’র সূতিকাগৃহ, যে প্রবাসী রামানন্দকে কিংবদন্তী করেছিল। একই সময়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে ‘সাধনা’ পত্রিকা প্রকাশ হতে থাকে, যার মূল চালিকাশক্তি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পত্রিকাটির চতুর্থ বর্ষে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ‘সাধনা’র সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তা সত্বেও ‘সাধনা’ চারবছর চলার পর বন্ধ হয়ে যায় ১৮৯৫তে। পরের বছরে রামানন্দ ‘দাসী’ পত্রিকার দায়িত্ব ত্যাগ করে প্রকাশ করেন ‘প্রদীপ’ পত্রিকায়, পৌষ ১৮৯৬-এ। গল্প, কবিতার সঙ্গে ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, রাজনীতি, বিজ্ঞান, ইত্যাদি জ্ঞানবিদ্যার সবকটি বিষয়ই আশ্রয় পেলো সে পত্রিকায়। পত্রিকার সূচনায় সম্পাদক রামানন্দ লিখেছিলেন “শিক্ষা ও চিত্তবিনোদন উভয়ের যথাযথ সংমিশ্রণের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া আমরা ‘প্রদীপ’ সম্পাদনা ও পরিচালনার চেষ্টা করিব।” এবং রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্ররচনার প্রকাশের ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছিলেন রামানন্দ ‘প্রদীপ’ পত্রিকা থেকেই। ১৯০১-এ তিনি ‘প্রদীপ’-এর সম্পাদনার দায়িত্ব ত্যাগ করে এপ্রিল মাস থেকে প্রকাশ করেন ‘প্রবাসী’ এবং তার সাত বছর পরে ইংরাজি পত্রিকা ‘মডার্ণ রিভিউ’।‘প্রবাসীর’ প্রকাশকালে তিনি এলাহাবাদে কলেজে অধ্যাপনায় যুক্ত ছিলেন। প্রবাস থেকে পত্রিকার আত্মপ্রকাশ বলে নাম দিয়েছিলেন ‘প্রবাসী’।

‘প্রবাসী’ হয়ে উঠেছিল বাঙালি সমাজের প্রতিনিধি স্বরূপ পত্রিকা। প্রবাসীতে লিখতেন সে যুগের প্রায় সমস্ত সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিকরা। প্রবাসী প্রকাশের উদ্দেশ্য সম্পর্কে রামানন্দ বলেছিলেন (১) প্রথম শ্রেণির লেখকদের রচনাসম্ভারের নিয়মিত প্রকাশ, (২) প্রত্যেক লেখককে সামান্য হলেও কিছু সম্মান দক্ষিণা দেওয়ার রীতি প্রবর্তন করা এবং (৩) সর্বোপরি পত্রিকাকে স্বদেশীভাব ও ভাবনা প্রচারের বাহন করে তোলা। এই উদ্দেশ্য থেকে তিনি কোনওদিন সরে যাননি।কে না লিখেছেন প্রবাসীতে? জগদীশচন্দ্র বসু, স্বর্ণকুমারী দেবী, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিবনাথ শাস্ত্রী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, জলধর সেন, রাজশেখর বসু, সজনীকান্ত দাস, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, মেঘনাদ সাহা, জগদানন্দ রায় প্রমুখ এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথের রচনা প্রকাশে রামানন্দ ছিলেন স্থিতধী। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’, ‘জীবনস্মৃতি‘, ‘শেষের কবিতা’, ‘মুক্তধারা’, ‘রক্তকরবী’, ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’, ‘সত্যের আহবান’, ‘শিক্ষার মিলন’, এবং ‘রাশিয়ার চিঠি’ থেকে শেষ জন্মদিনের অভিভাষণ ‘সভ্যতার সংকট’ পর্যন্ত সব প্রবন্ধাবলীর প্রকাশের স্থান ছিল ‘প্রবাসী’।বস্তুত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রামানন্দর যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা শুধুই পত্রিকা সম্পাদক – লেখকের সম্পর্ক ছিল না, ছিল উভয়ের আত্মিক স্পম্পর্ক। ১৯১১ থেকে ১৯৩১ সময়কালে বিভিন্ন সময়ে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে কাটান রামানন্দ। ১৯২৫-এ রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে বিশ্বভারতীর অবৈতনিক অধ্যক্ষ্যও হয়েছেলেন অল্প সময়ের জন্য। রবীন্দ্রনাথ রামানন্দকে বলেছিলেন. ‘‘আপনি যদি সময়মত আমাকে ঘুষ না দিতেন তাহলে কোন মতেই ‘গোরা’ লেখা হত না। নিতান্ত অতিষ্ঠ না হলে আমি অধিকাংশ বড় বা ছোট গল্প লিখতুম না।’’ বলা বাহুল্য, তাঁর অতিষ্ঠতা মানে লেখার জন্য রামানন্দের তাগাদা।এইভাবে তিনি লেখকদের কাছ থেকে লেখা আদায় করে নিতেন। কলকাতা টাউন হলে রবীন্দ্রনাথের সত্তরতম জন্মদিন পালনের উদ্যোক্তা ছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্র সম্মাননায় প্রকাশিত হয় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ‘দ্য গোল্ডেন বুক অফ টেগোর’, যেখানে লিখেছিলেন গান্ধীজি, জগদীশচন্দ্র বসু, রমারঁলা ও আইনস্টাইনের মত ব্যক্তিত্ব।

আমরা জানি জমিদারি দেখাশোনার কাজে শিলাইদহে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ লালন ফকির এবং অন্য বাউলদের গান সংগ্রহ করেন। রবীন্দ্রনাথের পরামর্শে রামানন্দ ‘প্রবাসী’তে হারামণি নামে একটি বিভাগ চালু করেন, যেখানে রবীন্দ্রনাথ সংগৃহীত বাউল গানগুলি স্বরলিপি সহ প্রকাশ হয়েছিল। গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’ সহ কুড়িটি বাউল গান প্রবাসীতে প্রকাশিত হয়েছিল।

প্রবাসীর প্রথম সংখ্যা থেকেই পত্রিকার পৃষ্ঠায় বহুবর্ণের চিত্র ও ভাস্কর্যের প্রকাশ প্রবাসীর বৈশিষ্ট্য ছিল। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বখ্যাত ছবি ‘বুদ্ধ ও সুজাতা’, ‘বজ্রমুকুট ও পদ্মাবতী’, ‘বিরহী যক্ষ’, ‘ভারতমাতা’, ‘লঙ্কায় বন্দিনী সীতা’ ইত্যাদি প্রবাসীতে প্রকাশিত হয়েছিল। মাসিক পত্রিকায় রঙ্গীন চিত্রের প্রকাশে রামানন্দই ছিলেন পথিকৃত। প্রবাসী পত্রিকার আর একটি বৈশিষ্ট্য রামানন্দ নির্মাণ করেছিলেন, তা হল বিজ্ঞান সম্পর্কিত লেখা। বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার ও গবেষণার বৃত্তান্ত প্রকাশ ও তাঁদের চিন্তা-ভাবনার প্রকাশের মাধ্যম হয়ে উঠেছিল প্রবাসী।রামানন্দের স্বদেশ প্রীতি ও জাতীয়তাবোধ তাঁকে এই কাজ করতে প্রেরণা দিয়েছিল। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহার বহু মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রবাসীর পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছিল। ১৩১৩ বঙ্গাব্দের ভাদ্র সংখ্যায় রামানন্দ লিখেছিলন “কেহ যদি জিজ্ঞাসা করেন এ বৎসর আমাদের দেশে সর্বপ্রধান স্বদেশী ঘটনা কি ঘটিয়াছে, আহা হইলে আমরা কি উত্তর দেবো?... সর্বপ্রধান স্বদেশী ঘটনা বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর ‘উদ্ভিদের সাড়া’ (plant response) নামক গ্রন্থ প্রকাশ।’’ লিখেছিলেন “আমাদের সর্বপ্রকার মানসিক শক্তি ইংরেজের চেয়ে কম, এই ধারণা যত বদ্ধমূল হইবে আমরা ততই রসাতলে যাইব। জ্ঞানে, মানসিক শক্তিতে আমরা যত স্বাধীন হইব, সেই প্রকারে আমাদের সর্বপ্রকার অন্যবিধ পরাধীনতা কমিয়া আসিবে। ... আচার্য বসুর গ্রন্থকে কোন কোন ইংরেজ সমালোচক বিজ্ঞান জগতে বিপ্লব বা যুগান্তর সংঘটক বলিয়াছেন।”এই ছিল রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের স্বাজাত্যবোধ। এই তীব্র দেশাভিমান থেকেই ‘প্রবাসী’ ও ‘মডার্ন রিভিউ’এর পাতায় সকালীন ঘটনাবলীর ওপর সুস্পষ্ট ও নির্ভীক অভিমত ও তীক্ষ্ণ সমালোচনা প্রকাশ করতেন। স্পষ্টবাদী রামানন্দ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মত ব্যক্তিত্বেরও কঠোর সমালোচনা করতে পিছপা হননি। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার লাভের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.লিট দিয়েছিল। প্রবাসীর পাতায় রামানন্দ তীব্র শ্লেষাত্মক সমালোচনায় লিখেছিলেন “যখন ইংলন্ডে তাঁহার ইংরাজি রচনা বাহির হইয়া গেল, তিনি নোবেল প্রাইজ পাইলেন, তখন ‘রূপান্তরিত’ রবীন্দ্রনাথ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সাহিত্যাচার্য বলিয়া স্বীকৃত হইলেন।তখন আশুবাবুই ভাইস-চ্যান্সেলর।”

রামানন্দ ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে বা তাদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তাঁর সম্পাদিত পত্রিকাগুলি কখনোই ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র হয়ে ওঠেনি। প্রবল স্বাদেশিকতাবোধসম্পন্ন রামানন্দ কখনোই সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির গণ্ডীতে আবদ্ধ থাকেননি। তাঁর ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় যেমন জওহরলাল নেহেরুর রচনা প্রকাশিত হয়েছিল, তেমনই জায়গা পেয়েছিল স্বামী নিগমানন্দর আধ্ম্যাত্মিক লেখা ‘ঠাকুরের চিঠি’। তিনি কংগ্রেসের অধিবেশনে উপস্থিত থাকতেন, জাতীয় কংগ্রেসের নরমপন্থী-চরমপন্থী মিলনের পক্ষে সওয়াল করতেন। ১৯৩৯এ সুরাটে নিখিল ভারত হিন্দু মহাসভার অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন আবার ১৯৪১এ হিটলারের নাৎসি বাহিনীর সোভিয়েৎ রাশিয়া আক্রমণেরর বিরুদ্ধে বামপন্থী লেখক শিল্পীরা যে জনমত সংগঠনে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের সঙ্গেও ছিলেন তিনি। বামপন্থী তরুণ লেখক সোমেন চন্দ্রর হত্যার প্রতিবাদে ১৯৪২-এ কলকাতায় যে ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক সম্মেলন হয়, সেই সম্মেলনে পৌরোহিত্য করেছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। পত্রিকা সম্পাদনা, সাহিত্য ও মানবিক বোধের এক বিরল সংমিশ্রণ ছিল রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে। আজকের ভোগবাদী প্রজন্মের কেই বা তাঁর মত ঋষিকল্প জীবন কল্পনা করবে!

১৯৪১এর অগস্টে পরম সুহৃদ রবীন্দ্রনাথ চলে গেলেন, আর দুবছর পরে অল্প কিছুদিন রোগ ভোগের পর, ছোট মেয়ে সীতা দেবীর বাড়িতে ৭৯ বছর বয়সে মৃত্যু হয় নির্ভীক দেশপ্রেমিক কর্মযোগী রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের।


1 comments:

1

প্রবন্ধঃ বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


গম্ভীর সিং মুড়া – ছো নৃত্যের চিরকালীন সম্রাট
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়




এক বৃত্ত থেকে আরেক বৃত্তের দিকে এগিয়ে চলে সময়। আমরা তার ছায়া দেখি। দীর্ঘস্থায়ী রূপ ও রঙ দেখি। আর দেখি সময় পেরিয়ে আসা মানুষের হিরন্ময় ছবি। তাঁদের কাজ এবং চিন্তার সমাকলন।প্রণত হই। উৎসাহিত হই। পদ্মশ্রী গম্ভীর সিং মুড়া একজন বিশ্ববন্দিত ব্যক্তিত্ব। ছো নাচকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি, জনপ্রিয় করেছেন। পিছিয়ে পড়া পুরুলিয়া জেলার মানুষ আমরা।আমাদের লড়াইগুলি যখন আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় সমীহ আদায় করে নেয়, খুব সঙ্গত কারণেই আমাদের শিরদাঁড়া আরও ঋজু হয়ে ওঠে, টানটান হয়ে ওঠে। গম্ভীর সিং মুড়া নামটি তাই আমার কাছে শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির নাম নয়, অবহেলা এবং উপেক্ষার উত্তরে এক শীর্ষস্পর্শী স্পর্ধা। এক আপোষহীন লড়াই-এর চিরস্থায়ী যুদ্ধক্ষেত্র।

সোনার চামচ মুখে দিয়ে তাঁর জন্ম হয়নি। ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ ভারতবর্ষের মানভূম জেলার অন্তর্গত(অধুনা পুরুলিয়া জেলার বাঘমুণ্ডি থানার) অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে বামনী গ্রামের টোলা পিটিদিরিতে মামাঘরে তার জন্ম। বাবা জিপা সিং মুড়া, মা ফুলমনি। নুন আনতে পান্তা ফুরায়, এমনই হতদরিদ্র পরিবার। এই দুঃখ এবং দারিদ্রের জীবনেও বাজ পড়ে। বাবাকে শৈশবেই হারান গম্ভীর। তখনও তিনি গম্ভীর হয়ে ওঠেন নি। বাবু সিং নামেই ডাকত সবাই। আর এই পিতৃবিয়োগ তাঁকে যেন আড়াই বছর বয়সেই অনেক সাবালক করে তুলল। মায়ের ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে থাকত অবিরাম। কিছু ভাবত। কী সেই ভাবনা? হয়তো এক সংকল্প। চোখের জল মুছে ফেলার অঙ্গীকার। মামাবাড়িতে ৪/৫ বছর থাকার পর ফিরে আসেন পৈতৃক ভিটা চড়িদা গাঁয়ে। ভিখ মেগে কোন রকমে দিন গুজরান করে ফুলমনি। কষ্টে সৃষ্টে দিন চলে। পড়াশোনা এখানে তাই বিলাসিতা। মায়ের অভাব দূর করার জন্য গরু বাগালির কাজ আরম্ভ করে বাবু। এতে সংসারে অন্নের অভাব আংশিক দূর হয়। আর গোরু চরাতে চরাতেই প্রকৃতির পাঠশালায় শুরু হয়ে যায় একজন যুগ বিজয়ী মানুষের অন্তরের শিক্ষা। নিজের ছো শিক্ষা বিষয়ে তার নিজের কথাগুলিই এখানে তুলে ধরছি – ‘‘আমার কনহ গুরু টুরু নাই আইজ্ঞা।বনের পশু পাখিই আমার মাস্টর। উয়াদের দিকে ভাইল্যে থাকতি দিন রাইত। আর দেইখে দেইখে মনের ভিতর তুইলে রাখতি উয়াদের চাইলচলন। আর ছিল একট কাল রঙের ভিড়কা গরু, উ শিং উঁচায়ে দমে লাফ ঝাপ কইরত। লেতাড়ে আইসত। আমিও উয়ার সংগে লাফ ঝাপ দিথি। উলফা দিতি। এমনি করেই আমার ছো লাচের হাতেখড়ি।’’

পাহাড়ের কোল ঘেঁষা এক বন্য প্রকৃতির মধ্যেই কাটে বাবুর শৈশব। ফলে বিভিন্ন জন্তু জানোয়ারের সাথে তার পরিচয় হয় শিশুকালেই। তাদের বিভিন্ন সময়ের নানান ভঙ্গিমাগুলিকে নিজের মনের ভেতর এঁকে রেখেছেন সযত্নে। নিজেকে মানভুইয়া বলে পরিচয় দিতে অত্যন্ত গর্ব বোধ করতেন তিনি। অত্যন্ত বিনম্র মনের মানুষ ছিলেন , বারবার বলতেন - ‘‘আমাকে ক্যা চিনত আইজ্ঞা, ভাগ্যিস মহম্মদ আমাকে ধইরে লিয়ে গেছিল রাজ দরবারে।’’ সেই সময় ক্ষেত্রমোহন সিং ছিলেন বাঘমুণ্ডির রাজা। তিনি ছিলেন সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। নাচ গান বাজনা নিয়ে তুমুল আগ্রহও ছিল। প্রতি বছর ছো নাচের আসর বসাতেন। সেবার নানা জায়গা থেকে ছো নাচের দলএ সেছে । মেতে উঠেছে আসর।মহিষাসুরের সাজপোশাকে মঞ্চে প্রবেশ করলেন এক কম বয়সী শিল্পী। উলফা দিয়ে মাতিয়ে দিলেন আসর। সবার মুখে একটাই প্রশ্ন – ‘‘বোলতার মত ঘুরপাক খাচ্ছে, লকটা কে বটেক হে? ইয়ার আগে কুথাও ত লাইচতে দেখি নাই!’’ রাজার পার্ষদ মহম্মদ খাঁ ততক্ষনে সবার সামনে তুলে ধরেছে তার পরিচয় – ‘‘ইয়ার নাম গইমরা, জিপার ব্যাটা বটেক, লাচ উয়ার রক্তে।’’ তখন তাঁর ১৩- ১৪ বছর বয়স। ‘বাঘের ছিলা বাঘ’ - এই নামে তাকে অভিহিত করে রানী এক ভাঁড় মিষ্টি আর উনিশ টাকা আর্থিক পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন তাঁর হাতে।

সেই শুরু। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। যেখানেই গেছেন মুগ্ধ করেছেন দর্শকদের।একসময় তাঁর নাচের প্রদর্শনী নিয়ে একটাই প্রবাদবাক্য ছড়িয়ে পড়েছিল সারা মানভুমে – ‘‘গম্ভীর সিং লাইচ্ছে মানেই মাচা ভাইংছে। ’’

ছো নাচ সম্পর্কে যাঁদের সামান্যতম কৌতূহল আছে, এর পরের ইতিহাস তাঁরা কমবেশি জানেন।১৯৬৮ সালে পুরুলিয়ার মাঠা রেঞ্জ অফিসের সামনে যে নৃত্য প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল,সেখানে উপস্থিত ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি গবেষক ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য এবং ফ্রান্স থেকে আগতা শ্রদ্ধেয়া মেলিনা সলভেনি। গম্ভীর সিং-এর নজরকাড়া নৃত্য পারদর্শিতা তাঁদের মুগ্ধ করে। আশুতোষ বাবু মুগ্ধ হয়ে বলেন – ‘‘আমি যেন এরকমই প্রতিভাবান শিল্পীর খোঁজ করছিলাম।’’ ১৯৬৯ সালে এশিয়ান মেলায় তিনি গম্ভীর সিং এর দলকে দিল্লী নিয়ে যান।দিল্লীর সেই মেলা প্রসঙ্গে গম্ভীর সিং মুড়া লোক সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ সৃষ্টিধর মাহাতকে কি বলেছিলেন তা উদ্ধৃত করা যাক – ‘‘সেরাইকেল্লা, মণিপুরের দল এমন লাচ কইরে দেখাল্য, সে আর কি বইলব?লাচ দেইখ্যে আশুবাবু চুপ। ভয়ে কাঠকাপাস। মুহে রা সইরছে নাই। আমি বইললম, আমাকে কিছু বইলবেন নাই। আপনাদের কথা শুইনব নাই। আসরে ঢুকেই ২১ বার ভোল্ট দিয়ে যখন দাঁড়ালি চড় চড় কইরে, চাইরদিকে শুধু হাততালি আর হাততালি।’’

এই আত্মবিশ্বাস অর্জনের পর সারা পৃথিবীর সামনে খুলে যেতে থাকে তাঁর নতুন দিগন্ত। ১৯৭১ সালে ইন্দোনেশিয়া মাতিয়ে আসেন তিনি। ১৯৭২ সালে ফ্রান্সের প্যারিস, এরপর হল্যান্ড, স্পেন,আমেরিকা মহাদেশ। ১৯৭৬ সালে আবার প্যারিস। এরপর একের পর এক নিজের ছো নৃত্যের জয়যাত্রার স্বাক্ষর রাখেন লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, লস এঞ্জেলস, ওয়াশিংটন ডি সি প্রভৃতি জায়গায়।বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে আমাদের জেলার সংস্কৃতিকে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। শুধু পৌঁছে দেওয়া নয়।মন মাতিয়ে দিয়েছেন সারা দুনিয়ার। পুরুলিয়ার ছো নাচকে যারা অখ্যাত এবং চুয়াড় নাচ বলে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করত, তাদের তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন পারদর্শিতা থাকলে কোন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায় এই গরিমা।

১৯৮১ সালের ২৬শে জানুয়ারী তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডির হাত থেকে পদ্মশ্রী পুরস্কার পান পুরুলিয়ার এই কৃতি মানুষটি। মানভূম গৌরব গম্ভীর সিং মুড়া নয়, এই স্বীকৃতি যেন সারা জেলার। জেলার প্রথম পদ্মশ্রী পাওয়া মানুষটির মধ্যে তবু প্রাণময় সরলতা।

১৯৮২ সালে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার পেলেন গম্ভীর সিং মুড়া। জেলাকে গর্বিত করলেন আবার। তুলে ধরলেন ছো নাচের দিগন্তবিস্তারী উন্মাদনা। যতদিন পুরুলিয়া থাকবে, ততদিন অমর উজ্জ্বল হয়ে থাকবে এই মহৎ মানুষটির নাম।

আজীবন দারিদ্রের সাথে লড়াই করেছেন তিনি। সহজ সরল অনাড়ম্বর মানুষটি গামছা পরেই কাটিয়েছেন জীবনের বেশিরভাগ সময়। আজ দেখি মানভূমের সংস্কৃতিকে বিকৃত করে চটুলতা এবং অশ্লীলতা আমদানি করে সস্তা গানে আসর মাতিয়ে কিছু গায়ক সহজেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন এবং রাতারাতি অর্থবান হয়ে উঠছেন। এঁরা লোকসংস্কৃতির দরদী শিল্পী সাজার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মাটি এবং প্রান্তিক মানুষের সাথে এঁদের কোন সংযোগ নেই। এঁরা বেনিয়া এবং মুনাফালোভী।

গম্ভীর সিং মুড়ার সাথে আমার প্রত্যক্ষ সংযোগ তৈরি হয়নি, দূর থেকে দু এক বার দেখা ছাড়া। বাবার কাছে তাঁর গল্প শুনতাম। বাবার কাছে তিনি একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন – ‘‘এতসব কইরে আর কনহই হইল্য নাই বাবু, পদ্মশ্রী পাইয়েও প্যাট ভইরল নাই, পলাশের সেই তিন পাত। যেমন ছিলি তেমনই রয়্যে গেলম। ছেড়া কাপড়, ভাঙ্গা খাইট, ঘরের চালে পুয়াল নাই। নাম দেদার হইল্য, ফটঅ খিচল্য কাগজওয়ালারা, কিন্তুক পেটের ভুখ ত আর ঘুচল্য নাই। ই মেডেলগুলা কি ভাতকাপড় দিতে পাইরবেক?’’

অভাব আর অনটনের সাথে লড়াই করতে গিয়ে রাষ্ট্রপতির দেওয়া পুরস্কারও বিক্রি করেছেন তিনি। তবু নীতি থেকে আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি কখনও।

২০০২ সালের ১০ নভেম্বর বুক ভরতি অভিমান নিয়ে চলে গেলেন মানভূম গৌরব ছো সম্রাট গম্ভীর সিং মুড়া। কলকাতা থেকে চোখের ছানি অপারেশন করিয়ে ফিরছিলেন তিনি। হাওড়া চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জারের মধ্যে আনাড়া ষ্টেশনে হৃদস্পন্দন থেমে যায় তাঁর। ১৩ বছর কেটে গেছে, তবু আজও মানুষের দিগন্ত বিজয়ের গল্প বলতে গেলে তাঁর উদাহরণই মনে আসবে সবার। যতদিন ছো বেঁচে থাকবে, যতদিন মানুষের সংগ্রামের কাহিনী লেখা হবে, ততদিন তিনি বেঁচে থাকবেন।


1 comments:

0

প্রাচীন কথাঃ কৃষ্ণদেব রায়

Posted in


প্রাচীন কথা


বিন্দুতে সিন্ধু-দর্শন -৩
কৃষ্ণদেব রায়


গত কিস্তিতে আপনাদের মহেঞ্জোদাড়ো আর হরপ্পায় পাওয়া এক নগ্নিকা ব্রোঞ্জ মূর্তি আর একটি সীলমোহর দেখিয়ে এনেছি। সঙ্গে অবিশ্যি কিছু জ্ঞানও দিয়েছি! সে যাই হোক, এই লেখাটিকে আমি মোটেও রাবার ব্যান্ডের মত টেনে বা টিভির মেগা সিরিয়ালের মত বিরক্তিকর পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইনা। আমার লেখার শিরোনামেই আমি এটা বলে দিয়েছি। “বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন” মানে খুব অল্প কথায় আমাদের প্রাচীনতম সভ্যতার কিছু হাল-হদিশ দিতে এবং ১৯৯০ সাল থেকে একশ্রেণীর হিন্দু মৌলবাদী, কখনও কখনও সরকারি মদত পুষ্ট হয়ে, সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যে, আর্যরাই নাকি এই প্রাচীন সিন্ধু-সভ্যতার স্রষ্টা এবং আর্যরা মোটেই বহিরাগত নয়, বরং ভারতবর্ষই নাকি ছিল আর্যদের আদি বাসভূমি। এর পিছনে একমাত্র কারণ হল বৈদিক ধর্মকে হিন্দুধর্মের পূর্বসূরী ধরে নিয়ে তার মাহাত্ম্য প্রচার ও সেই প্রচারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা। ইতিহাসকে বিকৃত করার এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধেই আমাদের প্রমাণ করতে হবে যে সিন্ধু-সভ্যতা একান্ত ভাবেই আর্যদের ভারতে আগমনের অনেক পূর্বের সভ্যতা এবং সেই সভ্যতার স্রষ্টারা আর্য তো নয়ই, বরং সিন্ধুসভ্যতা একান্তভাবেই দ্রাবিড়জাতি দ্বারা সৃষ্ট সভ্যতা। যদিও এই দ্রাবিড়রাও ভারতবর্ষের বাইরে থেকেই কোনও এককালে ভারতে এসেছিল এবং সেটা আর্যদের ভারতে আসার অনেক পূর্বে। শুধু মুখে বললেই তো হবেনা! মুখে তো ওঁরাও বলছেন যে আর্যরাই ভারতের আদিম অধিবাসী এবং তারাই সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা! আমাদের তাই এক এক করে প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, স্থাপত্যবিদ্যা বা কারিগরিবিদ্যা, রেডিও কার্বন বিশ্লেষণের মত বৈজ্ঞানিক সূত্রগুলি থেকে পাওয়া তথ্য বিচার করে দেখতে হবে। আর যুক্তিপূর্ণ ভাবে প্রমাণ করতে হবে যে এই সব অপপ্রচারের কোনও বৈজ্ঞানিক, প্রত্নতাত্ত্বিক বা ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। বরং এর বিপরীত যে ধারণা, তার সপক্ষে অনেক প্রমাণ আছে। তাই, এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় আর্য কারা? সিন্ধুসভ্যতার প্রকৃত স্রষ্টা কারা? আর্যরা কি সত্যিই ভারতের আদিম অধিবাসী ছিল? এটা যে সত্যি দ্রাবিড়ীয় সভ্যতা তার প্রমাণ কি? বৈদিক ভাষার উদ্ভব ও বিকাশ, সিন্ধু সভ্যতার সমসাময়িক ব্রোঞ্জ নির্ভর অন্যান্য সভ্যতাগুলি থেকে পাওয়া তথ্য, আর্যদের দ্বারাই কি মহেঞ্জোদড়ো ও হরপ্পা নগরী ধ্বংস হয়েছিল? আর্যরা কোনপথে ভারতে প্রবেশ করে? বৈদিক ভাষার সঙ্গে ইরানের ধর্মগ্রন্থ ‘আবেস্তা’র ভাষা ও শব্দের সাদৃশ্য, ঋগবেদে বেশ কিছু দ্রাবিড় শব্দের উপস্থিতি এবং আর্যরা কি করে তাদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত একটি সভ্যতা বা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পরাভূত করতে সক্ষম হল, সিন্ধুসভ্যতা কি মহেঞ্জোদাড়ো, হরপ্পার মত আকস্মিক ভাবে হঠাৎ কোনও কারণে সত্যিই ধ্বংস হয়েছিল? নাকি এটা এক অন্য সভ্যতার সঙ্গে মিশে গিয়ে আরো একটি উন্নত সভ্যতার সৃষ্টি করেছিল? এই প্রশ্নগুলির সঠিক বিচার এবং বিশ্লেষণ করলেই হিন্দু মৌলবাদী আর তাদের তাঁবেদার কিছু ঐতিহাসিকের মিথ্যা প্রচারকে ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করা সম্ভব হবে।

আর্য কারা? আর্যরা কোনও জাতি নয়। এটা একটা ভাষাগোষ্ঠীর নাম। সমস্ত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষীদের আর্য বলা হয়ে থাকে। এরা থাকতো পূর্ব ইউরোপ, মধ্য এশিয়া, গ্রীস, অ্যানাথোলিয়া, ইরাক, ইরান অঞ্চলে।এদেরই একটা অংশ ইউরোপের দিকে যায়। আর একটা অংশ পাকিস্তান, আফগানিস্তান হয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢোকে। এই জন্যই পূর্ব ইউরোপ, মধ্য এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশেঅনেক প্রাচীন শিল্প, পৌরাণিক দেব-দেবী, ভাষা ও শব্দের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

তাহলে আর্য কারা এটা তো আমরা জানলাম। কিন্তু আর্যরা যদি সিন্ধুসভ্যতার জনক না হয়, তাহলে এই সিন্ধু সভ্যতা কাদের দ্বারা সৃষ্ট? এই প্রসঙ্গে আমি অন্তত চোখ বন্ধ করে একটুও ঢোঁক না গিলে বলতে পারি যে, আর যাঁরাই হন, আর্যরা কিছুতেই এই সিন্ধুসভ্যতার জনক নয়। কেন? সেই কেনর জবাব দিতেই আমরা এখন ঢুকে যাবো সিন্ধুসভ্যতার অন্দরমহলে। সিন্ধুসভ্যতার মূল দুটি স্তম্ভ হল, ‘মহেঞ্জোদাড়ো’ আর ‘হরপ্পা’ নামে দুটি নগরী। সিন্ধুসভ্যতার কবর খুঁড়ে আমরা আর কিছু পাই বা না পাই, আর কিছু জানি বা না জানি, অন্তত এই দুটি শহরের উপস্থিতি এবং তার স্থাপত্য সম্পর্কে নিশ্চিৎ হতে পেরেছি। আর সেইজন্যেই শুধুমাত্র এই দুটি শহরের উপস্থিতিই প্রমাণ করে যে সিন্ধুসভ্যতার জনক আর্যরা ছিলেন না। কারণ আর্যরা ছিলেন পশু-পালক, যাযাবর শ্রেণীর মানুষ। তাঁরা ছিলেন একান্তভাবেই নগর সভ্যতার বিরোধী। ঋগবেদে এমন অনেক স্তোত্র আছে যেখানে তাঁরা ইন্দ্রের কাছে প্রার্থনা করছেন নগর এবং শহরগুলিকে ধ্বংস করে দেওয়ার আকুল আবেদন জানিয়ে। আর্যদের দেবতা ইন্দ্রের আর এক নাম তাই পুরন্দর। অর্থাৎ পুর বা শহরের বিনাশকারী। ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ৫৩ সূক্তের সপ্তম ঋকে আছে, “হে ইন্দ্র তুমি শত্রুধর্ষণকারীরূপেযুদ্ধ হতে যুদ্ধান্তরে গমন কর, বল দ্বারা নগরের পর নগর ধ্বংস কর।”

হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদড়োতে যে নরকঙ্কাল গুলি পাওয়া গেছে, তাদের খুলির হাড় দেখে অনুমান করা যায় যে তখন সেখানে, মানে হরপ্পা বা সিন্ধুসভ্যতার সাম্রাজ্যের মধ্যে, অনেক জাতি বসবাস করত। সিন্ধুসভ্যতার অন্তিম অবস্থায়, মানে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োর খননের একদম ওপরের স্তর থেকে আমরা মোট ৩৭টি নরকঙ্কাল পেয়েছি। এই নরকঙ্কালগুলির মধ্যে বেশীরভাগই আদি অস্ট্রেলীয় বা প্রোটো-অস্ট্রালয়েড।এদের ললাট অনুন্নত এবং নাসিকা অনতিপ্রশস্ত। বেশ কিছু করোটি পাওয়া গেছে যাদের দ্রাবিড়ীয় বা বর্তমান ভারতের আদিম অধিবাসীদের অনুরূপ মানুষের পরিচয় দেয়। কিছু মোঙ্গলয়েড এবং মাত্র গোটা দুই ককেশিয়ান গোত্রের মানুষের কঙ্কাল পাওয়া গেছে। এই কঙ্কালগুলি দেখে কিন্তু ভয় পাবেন না! এরা আমাদের অনেক কথা বলবে, অনেক কথা জানাবে। এদের সঙ্গে গল্প করলেই বেরিয়ে আসবে সিন্ধুসভ্যতার অনেক অজানা তথ্য। আপাতত এই দ্রাবিড়ীয় এবং অস্ট্রালয়েড কঙ্কালের আধিক্য এবং মাত্র দুটি ককেশিয়ান বা আর্য গোষ্ঠীর কঙ্কালের অস্তিত্ব আমাদের খুব সুদৃঢ় ভাবেই একথা জানাচ্ছে যে, সিন্ধুসভ্যতার জনক যদি আর্যরা হত, তাহলে ৩৭টি নরকঙ্কালের মধ্যে ৩১টি দ্রাবিড়ীয় ও অস্ট্রালয়েড কঙ্কালের বদলে অন্তত সমসংখ্যক ককেশিয়ান কঙ্কাল পাওয়া যেত। যে দুটি ককেশিয়ান বা আর্য কঙ্কাল পাওয়া গেছে, তা থেকে পণ্ডিতদের সিদ্ধান্ত এই যে, ঋগ্বেদ বা তার সমসাময়িক যুগে হিন্দুকুশ পর্বত পেরিয়ে যে আর্য অনুপ্রবেশ ঘটেছিল এবং আর্য সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল, তার বহু আগে থেকেই দফায় দফায় বেশ কিছু আর্যদের আগমন ঘটে এই সিন্ধুসভ্যতায় এবং তাঁরা কালক্রমে সিন্ধুসভ্যতারই অংশ হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকেন। এঁরা অশ্বের ব্যবহার জানতেন না। এই ককেশিয়ান নরকঙ্কাল দুটি তাঁদেরই। আবার কেউ কেউ এঁদের আর্মিনীয় বা আর্মেনয়েড বলে চিহ্নিত করেছেন।



সিন্ধু সভ্যতার জনক বা স্রষ্টা যদি আর্যরাই হন তাহলে অতি অবশ্যই সিন্ধুসভ্যতার সমগ্র পরিব্যাপ্তি ও শহরগুলিতে আর্য সংস্কৃতির প্রভাব দেখা যাবে। বৈদিক, ইরানীয় এবং গ্রীক সাহিত্যধর্মী গ্রন্থ এবং ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা সমূহের আদি রূপের মধ্যে সমগোত্রীয় যে শব্দগুলি আমরা পাই, তার ভিত্তিতেই আর্য সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্টগুলি নির্ধারন করা যায়। আসুন এক ঝলক দেখে নিই সেই বৈশিষ্টগুলি কি এবং সিন্ধুসভ্যতায় তাদের আদৌ কোনও অস্তিত্ব ছিল কিনা। যে সমস্ত গ্রন্থ থেকে আমরা নিশ্চিৎ ভাবেই আর্য সংস্কৃতির বস্তুগত ও অন্যান্য বিষয়ে সম্যক একটা ধারণা পাই, সেগুলির মধ্যে রয়েছে ঋকবেদ, জেন্দ-আবেস্তা এবং হোমারের ইলিয়াস আর অডিসি। এইসব গ্রন্থাবলীর কালনির্ণয়ের মাপকাঠি নিয়ে পণ্ডিতেরা নানা মত পোষণ করলেও আমরা সাধারণ ভাবে গ্রাহ্য প্রচলিত সময়কেই ধরে নেব। প্রথম গ্রন্থটি, অর্থাৎ ঋক বেদ মোটামুটিভাবে ১৫০০ খ্রীষ্টপূর্ব অব্দে রচিত বলে ধরে নেওয়া হলেও গ্রন্থটির শেষ দিককার অংশের রচনাকাল ১০০০ খ্রীষ্টপূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত বলে ধরে নেওয়া হয়। জেন্দ-আবেস্তা নামক ধর্মগ্রন্থটির কাল ধরা হত ১৪০০ খ্রীষ্টপূর্ব অব্দে এবং হোমার রচিত গ্রীক মহাকাব্য দুটির রচনাকাল ৯০০—৮০০ খ্রীষ্টপূর্ব অব্দের। ( চলবে )।

0 comments:

0

প্রাচীন কথাঃ সৌরেন চট্টোপাধ্যায়

Posted in


প্রাচীন কথা



উত্তরাপথের পথে
সৌরেন চট্টোপাধ্যায়
= নবম পর্ব =





কান্যকুব্জ নগরীর পূর্ব সিংহদ্বার থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে অটবী-অধ্যুষিত নাতিউচ্চ পার্বত্য মালভূমি অঞ্চলে ছোট ছোট কয়েকটি টিলার মাঝে মাঝে হরিৎ শাদ্বলাচ্ছাদিত সমভূমি। একটি নাতিউচ্চ সমতল-শিখর টিলার উপরিভাগে স্থান্বীশ্বরের স্কন্ধাবার। সেখানে বর্তমান অধিরাজ মহামহিম কুমার রাজ্যবর্ধনের যুদ্ধকালীন পট্টাবাস নির্মিত হয়েছে। তার শীর্ষদেশে একটি সুউচ্চ দণ্ডের শীর্ষে পুষ্পভূতি বংশের ভগবান বিবস্বান-লাঞ্ছিত নিশান সগৌরবে উড্ডীয়মান; তার আশেপাশে মন্ত্রী-অমাত্যদের পট্টাবাস। টিলার সানুদেশে তরাই-এর ছোট-বড় বৃক্ষ-সংকুল অরণ্যানীর বৃক্ষান্তরালে তুরঙ্গ-নায়েক বৃহদশ্ব কুন্তলের দায়িত্বে স্থান্বীশ্বরের বিশাল অশ্বারোহী বাহিনীর গুপ্ত সেনানিবাস। বড় বড় গাছের ফাঁকে লতাগুল্ম বিশেষ নেই, বৃক্ষচ্যুত শুষ্ক পত্র ছাড়া মোটামুটি পরিচ্ছন্ন বনতল জুড়ে স্থান্বীশ্বরের রাজকীয় সৈন্যবাহিনীর শিবির।
টিলার উপরে স্কন্ধাবারের বাইরে সমস্ত অঞ্চলটির চতুর্দিক ঘিরে স্থান্বীশ্বরের অপরাজেয় তুরঙ্গবাহিনীর সহস্রাধিক সশস্ত্র অশ্বারোহী সেনানী প্রহরারত। তাদের পিঠে ধারালো তীরপূর্ণ দ্রোণ, স্কন্ধে মেষ-অন্ত্রে প্রস্তুত জ্যা সমন্বিত দুই অরত্নি পরিমাপের ছোট শার্ঙ্গ ধনু, এবং উন্মুক্ত কৃপাণ। তারা ধীর গতিতে চক্রাকারে আবর্তিত হয়ে অহোরাত্র প্রহরা দিচ্ছে; একটি মক্ষিকারও সেখানে প্রবেশাধিকার নেই।

মালবরাজ দেবগুপ্তর হাত থেকে কনৌজ অধিকার করলেও রাজ্যবর্ধনের মনে বিন্দুমাত্র আনন্দ নেই। তিনি প্রিয়জনবিহীন মৃত্যুপুরীসদৃশ কান্যকুব্জ নগরীর রাজভবনে রাত্রিযাপন করতে কিছুতেই রাজি হলেন না। যে প্রাসাদ তাঁর পরমপ্রিয় ভগ্নী ও ভগ্নীপতির বিচরণস্থান ছিল, সেখানে কোন পাষাণ-হৃদয়ে তিনি বাস করতে পারেন! তিনি আর মুহূর্তকাল কনৌজের রাজপুরীতে থাকতে চাইলেন না। দেবগুপ্তের হাতে ভগ্নীপতি মৌখরিরাজ গ্রহবর্মার নিষ্ঠুর হত্যা ও প্রাণপ্রতিমা ভগ্নী রাজ্যশ্রীর কোনও সংবাদ না পেয়ে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর মন ক্রোধে, বেদনায় অশান্ত। সেনানায়ক কুন্তলের অধীনস্থ সৈনিকরা নগরী ও তার আশপাশের সমস্ত স্থান তন্নতন্ন করে সন্ধান করেও রাজ্যশ্রীকে খুঁজে পায়নি।

সুহৃৎ মহামাত্য ভণ্ডী রাজ্যবর্ধনের মনবেদনা সম্যক উপলব্ধি করে অল্প সময়ের মধ্যেই যথাযথ ব্যবস্থা করলেন। মহামন্ত্রীর পরামর্শে ছয়জন বিচক্ষণ অমাত্য ও দুই সহস্র সেনানীর চারজন সেনানায়কের হাতে রাজ্য পরিচালনা ও রক্ষার ভার ন্যস্ত করে রাজ্যবর্ধন শিবিরে ফিরে এলেন। কনৌজের রাজভবন পরিত্যাগ করলেও রাজ্যবর্ধন তখনই স্থান্বীশ্বরে প্রত্যাগমন না করে নগরীপ্রান্তে মালভূমির উপর সেই স্কন্ধাবারেই কিছুকাল অবস্থান করবেন এবং সেখান থেকেই তাঁর ভবিষ্যৎ কর্তব্য-কর্ম নিরূপণ করবেন স্থির করেছেন।

বাইরে দ্রুত শীতের সন্ধ্যা নামছে। যুদ্ধশেষে পরিশ্রান্ত রাজ্যবর্ধন সপারিষদ স্কন্ধাবারে ফিরে এসে ঈষদুষ্ণ জলে হস্তপদাদি প্রক্ষালন করে দুগ্ধফেননিভ বেত্র-পট্টিকায় শ্রীঅঙ্গখানি এলিয়ে দিলেন। অঙ্গমর্দক ক্ষতস্থানে ভেষজের প্রলেপ দিয়ে শরীর মর্দন করার পর বস্ত্রকর্মান্তিক এসে সযত্নে পরির্বহ পরিবর্তন করে শীতোপযোগী নরম সুতিবস্ত্রে রণক্লান্ত অধিরাজের দেহ আবৃত করে দিল।

পরদিন প্রভাতে রাজ্যবর্ধন স্নান-পূজা সমাপনান্তে প্রাতঃকালীন আহারে বসেছেন। উষ্ণ মেষদুগ্ধ ও কদলী সহযোগে সামান্য কিছু চিপিটক দিয়ে অধিরাজের জলযোগ সমাপ্ত হলে অমাত্য-সখা ভণ্ডী অন্দরে প্রবেশ করলেন। চির বিশ্বস্ত মাতুল-পুত্রকে দেখে রাজ্যবর্ধন খুশি হলেন। ভণ্ডীদেব আসন গ্রহণ করে বললেন,‘‘রাজন, আমি জানি আমরা এখন এক চরম দুঃখ ও বিপদের মধ্যে কালযাপন করছি; এখন আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে সতর্কতা ও দূরদর্শিতা অবলম্বন করতে হবে। এমতাবস্থায় আপনার চিত্ত স্বাভাবিক ভাবেই বিক্ষিপ্ত জানি, তথাপি পরবর্তী যে কোন পরস্থিতির জন্য আমাদের অবশ্যই প্রস্তুত থাকতে হবে।’’

‘‘তুমি যথার্থ বলেছ ভণ্ডী,’’ রাজ্যবর্ধন বললেন, ‘‘কান্যকুব্জ আমাদের অধিকৃত হলেও আমাদের প্রাণপ্রিয় একমাত্র ভগ্নী রাজ্যশ্রীর খোঁজ এখনো পাইনি। তার জন্য আমার মন অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। তোমার নির্দেশে যারা ভগ্নী রাজ্যশ্রীর সন্ধানে গিয়েছিল, তারা সকলেই কি প্রত্যাবর্তন করেছে? কেউ তার অন্তর্ধানের সামান্যতম সূত্রও কি পায়নি?’’

‘‘না রাজন,’’ ভণ্ডী বিষণ্ণকন্ঠে বললেন, ‘‘কনৌজ-রাজপুরী আক্রান্ত হওয়ার পর রাজঅন্তঃপুরের বেশিরভাগ দাসীরা মালব-সৈনিকদের দ্বারা ধর্ষিতা হয়, বয়স্কারাও তাদের নৃশংস উৎপীড়ন থেকে রেহাই পায়নি; স্বাভাবিকভাবেই সেই অভিশপ্ত রাত্রে ওরা সকলেই নিজেদের মান-প্রাণ বাঁচাতেই ব্যস্ত ছিল। সৈনিকদের অকথ্য অত্যাচারে হতাহতের সংখ্যাও কম নয়। আমাদের বিশ্বস্ত বিশেষ চরেরা রক্ষক ও দাস-দাসী থেকে শুরু করে রাজধানীর সাধারণ প্রজাদের কাছে অনেক অনুসন্ধান করেছে, কিন্তু কেউই তাঁকে দেখেনি।’’

‘‘রাজ্যশ্রীর এই অন্তর্ধানের বিষয়ে তোমার কি মনে হয় ভণ্ডী?’’

‘‘সংবাদকের কাছে যা শুনেছি, তাতে মনে হয় রাজপুরীর যামচেটিদের অনেককেই উৎকোচে বশীভূত করা হয়েছিল। আর ভগ্নী রাজ্যশ্রীকে যদি অপহরণ করা হয়ে থাকে, তাহলে যে বা যারা করেছে, তা সকলের অলক্ষ্যেই করেছে। অথবা এমনও হতে পারে, তিনি নিজেই হয়তো আত্মরক্ষার্থে একা বা কারও সাহায্যে ছদ্মবেশ ধারণ করে অন্তঃপুরের বাইরে কোথাও আত্মগোপন করে আছেন; সেক্ষেত্রে তিনি নিজে না চাইলে তাঁর সন্ধান পাওয়া দুষ্কর। আর যদি কোন দাস-দাসী বা নাগরিক তাঁকে দেখেও থাকে, রাজ-রোষের ভীতিতে তারা প্রকাশ্যে আসতে চাইছে না, বিশেষতঃ রাজ্য এই কয়দিন বহিঃশত্রুর হস্তগত ছিল বলে। অর্থ-সম্পদের লোভে কেউ হয়তো সংবাদ দিলেও দিতে পারে।’’

‘‘ঠিক আছে, আমরা এখানে যে কয়দিন অবস্থান করব, তার মধ্যে যে কেউ ভগ্নীর সংবাদ দিলে তাকে দুই লক্ষ সুবর্ণমুদ্রা ও তিনটি বড় গ্রাম পারিতোষিক হিসাবে প্রদান করা হবে, এ কথা কান্যকুব্জ রাজধানীতে ঘোষণা করে দাও।’’ মহামাত্যের কথা অনুমোদন করলেন অধিরাজ রাজ্যবর্ধন। তাঁদের কথোপকথনের মধ্যেই প্রতিহারী এসে জানালো, সেনানায়েক বৃহদশ্ববার কুন্তল অধিরাজের সাক্ষাৎপ্রার্থী। এই শৈত্যের সময় পট্টাবাসের শীতল অন্ধকারের চেয়ে বাইরের সূর্যোকরোজ্জ্বল উন্মুক্ত প্রান্তর অনেক বেশী শ্রেয় বিবেচনা করে কুমার ও ভণ্ডী রাজপট্টাবাসের বিতানক সরিয়ে বাইরে এসে দেখলেন কুন্তল হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে, পাশে একজন সহিসের হাতে তার প্রিয় কৃষ্ণ-অশ্বটির লাগাম।

‘‘অধিরাজের জয় হোক!’’ কুন্তল আভূমি নত হয়ে প্রণাম জানিয়ে বলল।

‘‘কি ব্যাপার কুন্তল! কোন বিশেষ সংবাদ আছে কি?’’ ভণ্ডী এগিয়ে গিয়ে ব্যাকুল-কন্ঠে শুধালেন, ‘‘ভগ্নী রাজ্যশ্রীর কি কোনও সন্ধান পেয়েছো?’’

‘‘এখনও পাইনি মহামন্ত্রী, তবে অনুসন্ধানে আমাদের পঞ্চাশ জন বিশেষ প্রশিক্ষিত চর কনৌজ নগরী ও তার আশেপাশে সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে।’’ 

কুন্তল সবিনয়ে বলল, ‘‘আশা করছি খুব শীঘ্রই আমরা তাঁর সংবাদ পেয়ে যাব। আমি অন্য একটি কারণে মহামান্য অধিরাজ ও আপনার পরামর্শ নিতে এসেছি।’’

‘‘বল, কি তোমার নিবেদন।’’ ভণ্ডীদেব বললেন।

‘‘আজ অতি প্রত্যুষে আমি নিত্য অভ্যাসমত একাকী অশ্বারোহণে বেরিয়েছিলাম। কান্যকুব্জ নগরীর পশ্চিমে যমুনা নদীর বালুকাময় তটভূমিতে গিয়ে চতুর্দিকে ভস্মীভূত প্রচুর কুটীর ও বস্ত্রাবাস, আর নদীর ধারে একটি ক্ষুদ্র অথচ রাজকীয় আড়ম্বড়পূর্ণ শিবির এবং ভিন্ন প্রদেশবাসী সৈনিকদের দেখতে পাই। কৌতূহলবশতঃ কাছে গিয়ে জানতে পারি, পূর্ব ভারতের পরাক্রমশালী রাজ্য গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক সানুচর সেখানে অবস্থান করছেন। নিজের পরিচয় দিয়ে গৌড়েশ্বরের সাক্ষাৎপ্রার্থী হলে তিনি অত্যন্ত সমাদরে আমাকে তাঁর বস্ত্রাবাসে আহ্বান করে আপ্যায়ন করেন এবং আমাদের কনৌজ অধিগ্রহণের ঘটনা আগ্রহের সঙ্গে জানতে চান।’’

‘‘আর তুমিও অমনি গৌড়রাজের শিবিরে অতি উত্তম খাদ্যপানীয় উদরসাৎ করতে করতে সমস্ত কিছু তাঁর কাছে প্রকাশ করে বেশ আত্মপ্রসাদ লাভ করলে!’’ ভন্ডীদেব ব্যঙ্গের স্বরে বললেন।

‘‘না, না, মানে ঠিক তা নয়, মানে...’’ কুন্তল থতমত খেয়ে বলতে গেল, ‘‘গৌড়েশ্বর অত্যন্ত অমায়িক ব্যক্তি, অত বড় রাজা হয়েও আমার মত একজন সামাম্য সৈনিকের সঙ্গে...’’

‘‘বুঝেছি, তারপর কি হল বল।’’

মহামন্ত্রীর মুখে চিন্তার গাম্ভীর্য দেখে থেমে গেল কুন্তলের কথা। সে বিনীতকন্ঠে বলল, ‘‘আমি কি কোন ভুল করেছি?’’

‘‘কতটা ভুল করেছ জানি না, তবে একটু বেশী আপ্লুত হয়ে কাজটা ঠিক করনি তুমি।’’ ভণ্ডীর গম্ভীর কন্ঠস্বরে প্রচ্ছন্ন ধমক।

‘‘তিনি আর কি বলেছেন তোমাকে?’’ ভণ্ডী ঘুরে দাঁড়িয়ে শুধালেন।

‘‘মহারাজ শশাঙ্ক স্থান্বীশ্বর-অধিরাজ রাজ্যবর্ধনের সাক্ষাৎপ্রার্থী, নেহাৎই সৌজন্য সাক্ষাত; এও বলেছেন যে, আমাদের অধিরাজ অনুমতি দিলে তিনি নিজে আসবেন এই স্কন্ধাবারে।’’

দিনের প্রথম প্রহরের শেষ ভাগ, শীতকালীন প্রভাতে মিঠে রৌদ্রে তৃণাচ্ছাদিত মালভূমির উপরে প্রিয় অমাত্য ও মাতুলপুত্র ভণ্ডী এবং বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা কুন্তলের সঙ্গে পাদচারণা করতে করতে রাজ্যবর্ধন এতক্ষণ তাঁর দুই পরম সুহৃদের কথা মন দিয়ে শুনে বললেন, ‘‘কুন্তলকে তুমি অকারণে তিরস্কার করছ ভণ্ডী, মহারাজ শশাঙ্কের মতন একজন শ্রদ্ধেয় রাজার বন্ধুত্বসুলভ ব্যবহারে যে কোন ব্যক্তিই অভিভূত হত, তাই নয় কি?’’

‘‘আমাকে মার্জনা করবেন রাজন,’’ ভণ্ডী সবিনয়ে কিন্তু দৃঢ় ও সংযত ভাবে বললেন, ‘‘আমরা এখানে শিকার বা কোনও প্রমোদ ভ্রমনে আসিনি। যে পরিস্থিতিতে ও সময়ে আমাদের এই অকস্মাৎ যুদ্ধাভিযান করতে হয়েছে তা একবার ভেবে দেখুন দেব, আর এই সময় দেশান্তরে আত্ম-পরিজনহীন অবস্থায় কে মিত্র, কে শত্রু সে বিষয়েও সম্পুর্ণ অন্ধকারে আছি।’’

‘‘তোমার যুক্তি বুঝলাম, কিন্তু গৌড়েশ্বর তো আমাদের শত্রু নন! যত দূর শুনেছি তিনি একজন প্রকৃত বীর এবং ধার্মিক প্রজাবৎসল রাজা।’’

‘‘মহারাজ শশাঙ্ক ঠিক এই সময়ে কনৌজ নগরীর উপান্তে অবস্থান করছেন শুনে আমার মনে কিছু সন্দেহের উদ্ভব হয়েছে রাজন, তাই আমি একটু উদ্বিগ্ন।’’ ভণ্ডীর গলায় দুঃশ্চিন্তার প্রলেপ।

‘‘তোমার এমন সন্দেহের কারণ কি মিত্র?’’

‘‘প্রথমতঃ, ঠিক যে সময়ে মালবরাজ দেবগুপ্ত কনৌজ আক্রমণ করেছে, ঠিক সেই সময়েই সুদূর গৌড় থেকে শশাঙ্কও এখানে এসে উপস্থিত হলেন কেন? আর তিনি কেনই বা কনৌজ নগরীর কাছেই যমুনার তীরে শিবির সংস্থাপন করলেন? এই জায়গাটি তো কোনও তীর্থস্থান নয়! আর যদি নিছকই ভ্রমণেচ্ছায় তিনি আর্যাবর্তে এসে থাকেন, তাহলে কনৌজ, মধুপুরী (মথুরা), স্থান্বীশ্বর বা অন্য কোনও কাছাকাছি রাজ্যের সম্মানীয় অতিথি হওয়াই তো তাঁর মতন রাজার পক্ষে স্বাভাবিক ছিল, তাই নয় কি!’’

‘‘তাই তো! এতটা তলিয়ে তো আমরা কেউই ভাবিনি!’’ রাজ্যবর্ধন তাঁর এই ধীমান মিত্রের কথায় চমৎকৃত হলেন। বললেন, ‘‘আর কি কি সন্দেহের কারণ আছে তোমার মিত্র?’’

‘‘আবার দেখুন, প্রয়াগ ও মথুরার মাঝে গঙ্গা-যমুনার দোআব অঞ্চলে কনৌজ; তার ঠিক দক্ষিণে যমুনার অন্য তীরে মালব ও তার রাজধানী অবন্তী নগরী (উজ্জয়িনী); আর সেই মালবই কয়েকদিন আগে রাতের অন্ধকারে কূটঘাত-যুদ্ধে কনৌজ অধিকার করেছিল। স্বাভাবিক ভাবেই মনে প্রশ্ন জাগছে, মালবের সঙ্গে গৌড় জড়িত হয়ে পূর্বপরিকল্পিত ভাবে এই কূটঘাত সঙ্ঘটিত করেনি তো! শুনেছি কূটনৈতিক ও যুদ্ধবিশারদ হিসাবে মহারাজ শশাঙ্ক যথেষ্ট প্রতিভাবান, তাই এমন একটা সময়ে এই স্থানে তাঁর উপস্থিতি আমার একেবারেই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। তার উপর ভেবে দেখুন, তাঁর শিবিরের অনতিদূরেই কনৌজে এত বড় একটা বিপর্যয় ঘটে গেল, অথচ তিনি একেবারেই নিষ্ক্রিয় রইলেন, এটাও কি আশ্চর্যের নয়!’’

‘‘কিন্তু আমরা কনৌজ নগরীতে কারও কাছেই গৌড়েশ্বর বা গৌড়ীয় সেনার কথা শুনিনি, এমনকি সংবাদক বা আমাদের অন্য কোনও গুপ্তচরও এদের বিষয়ে কিছুই বলে নি।’’ রাজ্যবর্ধন বললেন। ‘‘যাই হোক, তিনি যখন নিজেই আমার দর্শনাভিলাষী হয়েছেন, তখন শুধুমাত্র সন্দেহের বশে আমি কোনও মতেই তাঁকে বিমুখ করতে পারি না। পিতা বলতেন --- ‘অরাবপ্যুচিতং কার্যমাতিথ্যং গৃহমাগতে। ছেত্তুঃ পার্শ্বগতাং ছায়াং নোপসংহরতি দ্রুমঃ।। (শত্রুও গৃহে এলে যথাসম্ভব আতিথেয়তা করা উচিত। গাছ তার ছেদনকারীকেও ছায়া প্রদান করে।) কুন্তল তুমি এখনি নিজে গিয়ে মহামান্য গৌড়েশ্বরকে এই স্কন্ধাবারে সসম্মানে আমন্ত্রণ জানিয়ে এসো।’’

‘‘যথা আজ্ঞা দেব।’’ বৃহদশ্ব কুন্তল রাজাজ্ঞা পালনে তৎপর হল।

মহামন্ত্রী ভণ্ডীদেব আর কিছুই বলতে পারলেন না। তাঁর মন কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। কি যেন একটা অমঙ্গল আশঙ্কায় তাঁর হৃদয় শঙ্কিত। তিনি বিমর্ষ মনে রাজ্যবর্ধন সমভিব্যাহারে শিবিরে ফিরে এলেন।


*********



দ্বিপ্রহরের পর গৌড়েশ্বর শশাঙ্কদেব কিংখাবের শিবিকায় আরোহণ করে সপারিষদ স্থান্বীশ্বর-অধিরাজ কুমার রাজ্যবর্ধনের সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে সকাশে উপনীত হলেন;তাঁর সঙ্গে শুধু গৌড়ের প্রধান অমাত্য মহিম ভট্ট আর মাত্র চারজন পদাতিক দেহরক্ষী সৈনিক। শশাঙ্ক টিলা-সংলগ্ন মালভূমির সানুদেশে এসে শিবিকা থেকে অবতরণ করে চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করে স্থান্বীশ্বরের সুরক্ষিত স্কন্ধাবার দেখে মনে মনে প্রশংসা করলেন। ভাবলেন, এই রণনিপুণ সশস্ত্র ও বিশ্বস্ত সৈন্যবাহিনীর মধ্যে প্রায় নিরস্ত্র ও জনবলহীন একা তিনি কিভাবে তাঁর কার্যসিদ্ধি করবেন। শশাঙ্কদেবের ভাবনার মাঝেই বনান্তরাল থেকে দশজন সৈন্যসহ সেনানায়ক কুন্তল গৌড়েশ্বরের প্রত্যুদ্গমন করে টিলার গায়ে ছোট পাকদণ্ডি পথটি ঘুরে মালভূমির উপরে অধিরাজ রাজ্যবর্ধনের পট্টাবাসে নিয়ে গেলেন।

সুসজ্জিত রাজপট্টাবাস-সংলগ্ন অস্তিকাগারে কুমার রাজ্যবর্ধন রাজাসনে আসীন। ছায়াসঙ্গী মহামন্ত্রী ভণ্ডীদেব এগিয়ে এসে গৌড়রাজকে অভিবাদন জানিয়ে আসন গ্রহণ করতে অনুরোধ জানালেন। শশাঙ্ক প্রত্যভিবাদন জানিয়ে আসন গ্রহণ করলে মন্ত্রী মহিম ভট্ট একটি ক্ষুদ্র চন্দন কাষ্ঠের পেটিকা সামনের মঞ্চকে রাখলেন। পেটিকা থেকে একটি বহুমূল্য গল্বর্ক বার করে রাজ্যবর্ধনের হাতে দিয়ে সবিনয়ে বললেন, ‘‘হে স্থান্বীশ্বর রাজ, গৌড়াধীপ মহারাজ শশাঙ্কের বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ যৎসামান্য কৌশলিকা, আপনি অনুগ্রহ করে গ্রহণ করে কৃতার্থ করুন।’’

গৌড়াধীপ শশাঙ্কের গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম, বিশাল মুখমণ্ডলে পুরুষ্টু গুম্ফ, স্কন্ধ পর্যন্ত লম্বমান কুঞ্চিত ঘন কেশ, ঈষৎ ক্ষুদ্র চক্ষুদ্বয়ে প্রখর বুদ্ধির ছাপ। তাঁর পরণের রাজকীয় পরির্বহের উর্ধাংশ একটি কাশ্মিরী দোশালায় আবৃত, ললাটের উপরিভাগে কেবল একটি হীরকখচিত সুবর্ণ-নির্মিত বলয়ের প্রত্যভিজ্ঞান এবং মণিবন্ধে একটি রত্নমণ্ডিত সুবর্ণ বলয় ছাড়া আর কোনও অলঙ্কারের বাহুল্য নেই।

সাধারণ কুশলাদি ও পরিচয় বিনিময়ের পর শশাঙ্ক বললেন, ‘‘হে স্থান্বীশ্বররাজ, আপনার পিতৃদেব পরম ভট্টারক মহারাজ প্রভাকরবর্ধনের নানা যশ-কীর্তির কথা আমি পূর্বেই শুনেছি, এবং আমি তাঁর প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল। আমি এই বৎসর প্রয়াগ তীর্থে পূর্ণকুম্ভ যোগে স্নান করে পুণ্যার্জনের আশায় কয়েকদিন আগেই গৌড়ের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ থেকে প্রয়াগে এসেছি। সাধ ছিল ফেরার পথে সেই কীর্তিমান প্রাজ্ঞ নরপতির সান্নিধ্যে থেকে ধর্মনীতি ও রাজনীতির কিছু অমূল্য উপদেশ নিয়ে যাব। জন্মসূত্রে ক্ষত্রিয় হলেও আমি আশৈশব ধর্মপিপাসু, ধর্মপথে মোক্ষলাভই আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, রাজকার্য আমার কাছে নিতান্তই একটি কর্তব্য ছাড়া কিছু নয়। তবুও কোনও মহাপ্রাণ ব্যক্তি বা ধর্মরাজ্য দুর্দশা প্রাপ্ত হয়েছে শুনলে আমি আমার যৎসামান্য শক্তি নিয়ে তার পাশে দাঁড়াবার প্রয়াস করি। আমি সর্বান্তঃকরণে স্থান্বীশ্বর-রাজের মিত্রতার মনোবাসনা নিয়ে নিজেই আপনার দর্শনাভিলাষী হয়েছি।’’

‘‘হে মহামান্য গৌড়েশ্বর, আপনার কথা আমি অনেক শুনেছি। আপনি নিজে স্থান্বীশ্বরের আতিথ্য গ্রহণ করে আমার সাক্ষাৎলাভ করতে এসেছেন, এবং আমাকে বন্ধুত্বপাশে আবদ্ধ করতে চান --- এ আমার পরম আনন্দ ও গর্বের বিষয়;’’ শশাঙ্কের মধুর বাচনভঙ্গীতে অভিভূত হয়ে বললেন রাজ্যবর্ধন, ‘‘কিন্তু এই অস্থায়ী স্কন্ধাবারে আপনার উপযুক্ত অতিথি সৎকার কিভাবে করব, তা ভেবে পাচ্ছি না; বিশেষত বর্তমানে আমরা এক ঘোর দুঃসময়ে পতিত হয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।’’

‘‘এখন আতিথেয়তার প্রকৃষ্ট সময় নয় মিত্র, আমি আপনার সমব্যাথী।’’ শশাঙ্ক বললেন, ‘‘আমি এমন সময়ে এই স্থানে উপস্থিত থেকেও কনৌজরাজ গ্রহবর্মাকে কোনওরূপ সাহায্য করতে না পারায় নিজেই অনুতপ্ত।’’

‘‘ক্ষমা করবেন মহারাজ,’’ পাশ থেকে মহামাত্য ভণ্ডী হঠাৎ বলে উঠলেন। গৌড়রাজের কূর্চভাগ কুঞ্চিত হল, তিনি ভণ্ডীর আপাদমস্তক ভাল করে দেখে মৃদু হাসলেন। ভণ্ডী সবিনয়ে অধিরাজ রাজ্যবর্ধনের অনুমতি নিয়ে বললেন, ‘‘মালবরাজ দেবগুপ্ত রাত্রির অন্ধকারে কূটযুদ্ধে কনৌজ আধিকার করল, আর আপনার মতন একজন পরাক্রমশালী বিচক্ষণ রাজা নগরীর সামান্য দূরত্বে অবস্থান করেও কিছু জানতে পারলেন না, বা জেনেও কোন সাহায্যের জন্য এগিয়ে গেলেন না...’’

‘‘স্থান্বীশ্বরের মহামন্ত্রী হিসাবে আপনার মনে সন্দেহের উদ্রেক হওয়া অমূলক নয়,’’ শশাঙ্ক ভণ্ডীকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে স্মিতহাস্যে বললেন, ‘‘যে কোনও মানুষের মনেই এই প্রশ্ন ওঠা অত্যন্ত স্বাভাবিক। আবার আমি এই বিশেষ সময়ে এখানে কেন? এটাও খুবই সন্দেহজনক বইকি! আমি যথাসাধ্য আপনাদের সন্দেহ নিরসনের প্রযত্ন করছি। আমি পক্ষকাল আগে কিঞ্চিৎ পুণ্যার্জনের আশায় প্রয়াগে পূর্ণকুম্ভে স্নান এবং সেই সঙ্গে আর্যাবর্তের বিখ্যাত তীর্থস্থানগুলি দর্শনের অভিলাষে সুদূর গৌড় থেকে এখানে এসেছি। এই অভিযানে আমি কোনও রাজা নই,আমার পরিচয় একজন সাধারণ তীর্থযাত্রী; তাই অতি প্রয়োজনীয় কয়েকজন সাহায্যকারী ছাড়া আমার সঙ্গে কোনও সৈন্যসম্ভারও নেই, নেই কোনও রাজকীয় আড়ম্বর। নিরাপত্তা ও মানুষের অযথা কৌতূহল থেকে দূরে থাকতে তাই নিজের পরিচয়ও আমি যথাসাধ্য গোপন রেখেছি। যে কোনও জায়গায় রাত্রিবাসের জন্য বস্ত্রাবাস নির্মান করলে সাধারণ মানুষের কৌতূহল উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক, তাই যে সব স্থানে সাধু-মহাত্মারা একত্রিত হয়ে বাস করেন, সেই স্থানগুলিই বেছে নিয়েছি, আর সমগ্র উত্তরাপথ জুড়ে এমন জায়গার তো কোনও অভাব নেই!’’

কথার মাঝেই পাদাৎ এসে তাম্বুল-করঙ্ক দিয়ে গিয়েছে। মহারাজ শশাঙ্ক আয়েস করে একটি তাম্বুল মুখে নিয়ে চর্বন করতে করতে বলে চললেন, ‘‘কুম্ভস্নান শেষে আমি প্রথমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমি মথুরা ও বৃন্দাবন দর্শনের বাসনায় গঙ্গা-যমুনার দোয়াব অঞ্চলের এই স্থানে আসি। এখান থেকে মথুরা খুব বেশী দূরে নয়,আর আর একটু উত্তরে গেলে হৃষিকেশ ও হরিদ্বার –- পুণ্যসলিলা দেবী গঙ্গার অববাহিকার সূত্রপাত এবং দেবভূমি হিমালয়ের প্রবেশদ্বার। ইচ্ছা আছে উত্তর ভারতের বিখ্যাত তীর্থগুলিতে পূজা নিবেদন করে ভগবান শঙ্কর ও শ্রীকৃষ্ণের চরণাশীর্বাদ নিয়ে দেশে ফিরব।’’

‘‘কিন্তু সেই দুঃখজনক রাত্রে আপনি তো এখানেই ছিলেন!’’ ভণ্ডী জিজ্ঞাসা করলেন।

‘‘না, আমি সেই দিনই প্রভাতে সানুচর মধুপুরীর উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গিয়েছিলাম, তিনদিন পরে যখন ফিরলাম তখন যা ঘটার ঘটে গিয়েছে। ফিরে এসে দেখলাম পাষণ্ড মালবরাজ কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারে কাপুরুষের মত কনৌজ অধিকার করে নিয়েছে। যমুনা তীরের যত সাধু-সন্তের কুটীর ছিল সেগুলিতে এবং আমাদের পরিত্যক্ত একটি বস্ত্রাবাসেও অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে। পরে পলায়নরত প্রজাদের কাছে কনৌজরাজের মর্মান্তিক পরিণতি শুনে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে গিয়েছে।’’

বলতে বলতে গৌড়রাজের কন্ঠস্বর ভারী হয়ে এলো, তিনি নত মস্তকে যেন শোকাবেগ সংবরণ করলেন। তাঁর কথা শুনতে শুনতে রাজ্যবর্ধনেরও শোকোচ্ছাস প্রবল হল। ভণ্ডী কেবল স্থির দৃষ্টিতে মহারাজ শশাঙ্ককে অবলোকন করতে লাগলেন। গৌররাজও অপাঙ্গে ভণ্ডীকে দেখে ভাবতে লাগলেন, এই যুবকটি অত্যন্ত বুদ্ধিসম্পন্ন,এ থাকতে কুমার রাজ্যবর্ধনকে সহজে করতলগত করা যাবে না।

‘‘মিত্র রাজ্যবর্ধন,আমি আপনার মনোবেদনা মর্মে মর্মে অনুভব করতে পারছি। আশা করি ওই দুর্ঘটনার পরিপেক্ষিতে আমার অবস্থান আপনি বুঝতে পেরেছেন।’’শশাঙ্ক মুখ তুলে বললেন, ‘‘এখন আমার কিছু প্রস্তাব আছে, আপনি অনুমতি দিলে তা নিবেদন করতে পারি।’’

‘‘আপনি সত্যই মহানুভব বন্ধু,’’ রাজ্যবর্ধন বাষ্পাকুল কন্ঠে প্রত্যুক্তি করলেন, ‘‘এমন দুঃসময়ে আপনার মতন বিবেচক ও শক্তিশালী রাজাকে সাথী পেয়ে আমার মনোবল বৃদ্ধি পেল, আপনার প্রস্তাব নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করুন।’’

‘‘আমার প্রথম প্রস্তাব হল, আজ থেকে স্থান্বীশ্বর ও গৌড় এক হয়ে মালবরাজ দেবগুপ্তের মত পররাজ্যলোভী নিষ্ঠুর রাজাদের যথাযোগ্য শাস্তি দান করে উত্তরাপথের বুকে এক ধর্মাশ্রয়ী ন্যায় ও সুশাসিত সাম্রাজ্য স্থাপন করবে, আর মহামান্য মণ্ডলেশ্বর রাজ্যবর্ধনই হবেন সেই ধর্মযুদ্ধের নায়ক ও ভাবীকালে উত্তরাপথের একচ্ছত্র অধিশ্বর। তার জন্য আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে আপনাকে সাহায্য করব।’’

অকস্মাৎ গৌড়াধীপের এমন ঘোষণা শুনে উপস্থিত সকলেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। বিস্মিত রাজ্যবর্ধন কিছু বলার আগে ভণ্ডীদেব বললেন, ‘‘আপনার প্রস্তাব অতীব উত্তম মহারাজ, কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, স্থান্বীশ্বরের বর্তমান অধিরাজের সদ্য পিতৃবিয়োগ হওয়ায় রাজ্যপ্রাপ্তি ঘটলেও তিনি এখনও রাজ্যপরিচালনার সুযোগ পান নি, তার আগেই তাঁকে মালবরাজের প্রতিবিধান করতে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়েছে। তাছাড়া তিনি বয়সেও নবীন, রাজনীতির কূট-কৌশল এখনও তাঁর আয়ত্তাধীন হয়নি তা আপনি ভালই জানেন, অথচ আপনার মতন বর্ষীয়ান বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ থাকা সত্বেও কুমার কি করে সর্বাধিনায়ক হতে পারেন! আর এই পরিকল্পনা সফল হলে আপনার কি লাভ, এবং আপনার ভূমিকা কি হবে?’’

‘‘আপনার এই প্রশ্ন অতি সঙ্গত মহামন্ত্রী,’’ শশাঙ্ক মনের বিরক্তি চেপে স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন, ‘‘প্রথমতঃ, আর্যাবর্তের পূর্বপ্রান্তে একেবারে শেষে খুবই ক্ষুদ্র রাজ্য আমার গৌড়দেশ, আবহাওয়া আর জল-মাটির গুণে আমার প্রজা তথা সৈনিকরা অলস ও আয়েসি, আর তারা যুদ্ধবিদ্যায়ও তেমন পটু নয়। অপরদিকে স্থান্বীশ্বররাজ শুধু রাজাই নন, তিনি একজন রাজাধিরাজ -- মণ্ডলেশ্বর। গৌড়ের মত ছোট ছোট রাজ্যগুলি শুধুমাত্র দেশীয় রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেই নিজেদের কীর্তি স্থাপন করেছে, কিন্তু স্থান্বীশ্বর-অধিপতি মহামান্য প্রভাকরবর্ধন দেশীয়রাজ্য ব্যতিরেকে বিদেশী রণদুর্মদ হূণদের পরাজিত করে আর্যাবর্তে যে অক্ষয় কীর্তি স্থাপন করেছেন তা অতুলনীয়। অধিরাজ রাজ্যবর্ধন তাঁর সুযোগ্য উত্তরাধিকারী, তিনি মাত্র অষ্টাদশ বৎসর বয়সেই স্থিতধী রণনায়ক হিসাবে তাঁর কীর্তিমান পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে যশস্বী হয়েছেন। এ ছাড়া স্থান্বীশ্বরের ভৌগলিক অবস্থান, যেখান থেকে সমস্ত উত্তরাপথের সাম্রাজ্য পরিচালনা ও শাসন করা সুবিধাজনক। আর সর্বশেষ কারণটি হল, আমি নিজে কোনওদিনই রাজ্যলোলুপ নই, রাজনীতি অপেক্ষা ভগবান মহেশ্বরের প্রসাদলাভই আমার জীবনের পরম মোক্ষ। সমস্ত দেশের মঙ্গলার্থে এই ধর্মযুদ্ধে আমি স্থান্বীশ্বররাজের অধীনে সামান্য একজন সৈনিকের ভূমিকা পালন করতেই ইচ্ছুক। আমি সব সময় এই আপ্তবাক্যটি স্মরণ করি... ‘ধনানি জীবিতঞ্চৈব পরার্থে প্রাজ্ঞ উৎসৃজেৎ। সন্নিমিত্তে বরং ত্যাগো বিনাশে নিয়তে সতি।।’ (জ্ঞানী ব্যক্তিরা নিজের ধন এবং জীবন পরের জন্য উৎসর্গ করেন। এগুলির বিনাশ যখন হবেই, তা সৎ কাজে ত্যাগ করাই ভালো।) তাই অনেক চিন্তা করেই আমি এই প্রস্তাব নিবেদন করেছি, এখন মিত্র রাজ্যবর্ধনের যা ইচ্ছা।’’

গৌড়াধীপ শশাঙ্ক মানবচরিত্র অনুধাবনে অসম্ভব পারদর্শী এবং তিনি অসাধারণ বাগ্মী। কোন কথা, কাকে, কখন, কিভাবে বললে কার্যসিদ্ধি হবে তা তিনি বিলক্ষণ জানেন। তাঁর ভাষণ অচিরেই ফলপ্রদ হল। রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ, সদ্যযুবক রাজ্যবর্ধন অভিভূত হয়ে পড়লেন। মহামন্ত্রী ভণ্ডীদেব কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, রাজ্য তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘আমি আপনার প্রস্তাবে সম্মত। কিন্তু আমারও একটি প্রস্তাব আছে, মিত্র।’’

‘‘বলুন মিত্র, আপনার যে কোনও প্রস্তাব পরম সমাদরে বিবেচিত হবে।’’ শশাঙ্ক হাসিমুখে বললেন।

‘‘পিতার আদেশে আমি ভারতবর্ষের বহিঃশত্রু হূণদের দমন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা সর্বগুণাকর কুমার হর্ষবর্ধন সর্বক্ষেত্রেই আমার পরিপূরক;আমি নিজে রাজসিংহাসন অভিলাষী নই, তাই আমার স্থলে হর্ষদেবই হবেন আপনার এই পরিকল্পনার সার্থক রূপকার। পরবর্তীকালে আমি তাকেই উত্তরাপথের সার্বভৌম সম্রাটরূপে দেখতে চাই।’’

‘‘অতি উত্তম প্রস্তাব,’’ শশাঙ্কদেব সানন্দে বললেন, ‘‘আমি যেন দেখতে পাচ্ছি আপনারা দুই ভ্রাতা একাধারে শিব-বিষ্ণুরূপে আর্যাবর্তের রাজচক্রবর্তী সম্রাট হয়ে সুশাসনে একে শ্রেষ্ঠতম ঐশ্বর্যশালী ও সমৃদ্ধিশালী সুবর্ণ-দেশে পরিণত করবেন। আমার আর একটিমাত্র অনুরোধ আছে মিত্র, আশা করি নিরাশ করবেন না।’’

‘‘নিশ্চয়ই মিত্র, বলুন কি আপনার ইচ্ছা।’’

‘‘আপনার মতন সিংহহৃদয় উদারমনা মিত্রকে পেয়ে আমার মন আনন্দে পরিপূর্ণ। বহুদিন যাবৎ স্বজনবান্ধবহীন অবস্থায় প্রবাসে কাল কাটাচ্ছি; আগামী কাল আমার জন্মতিথি। আমার একান্ত ইচ্ছা আপনি কাল আমার পট্টাবাসে আতিথ্য স্বীকার করে আপনাকে সামান্য সেবা করার সুযোগ দিয়ে আমার মনোবাসনা পূর্ণ করুন; কিন্তু বলতে লজ্জিত হচ্ছি যে এই প্রবাসে আমার জনবল ও অর্থবল অতি সামান্য, আপনার মতন রাজাধিরাজের সপারিষদ অতিথিসেবা করার সামর্থ এই সময় আমার নেই, তাই...’’

‘‘এ তো অতি উত্তম কথা!’’ রাজ্য সোৎসাহে বললেন, ‘‘আপনার কুন্ঠিত হওয়ার কোন কারণ নেই, মিত্র। আমি অবশ্যই যাব, আমার সঙ্গে শুধু মহামাত্য আমার মাতুল-পুত্র ভণ্ডী আর চিরসহচর কুন্তল যাবে।’’

‘‘আপনি সত্যিই মহদাশয়। আজ আমি অত্যন্ত পরিতৃপ্ত মনে বিদায় নিচ্ছি।’’

সভা ভঙ্গ হল। গৌড়েশ্বর রাজ্যবর্ধনকে আলিঙ্গন করে বিদায় নিলেন।


*** (সংবাদকের দেওয়া সংবাদে একটি মাত্র ভুল ছিল। সে মালবরাজ দেবগুপ্তর দ্বারা কান্যকুব্জ অধিকারের সময় সন্ন্যাসীবেশী গৌড়েশ্বর শশাঙ্ককে চিনতে বা তাঁর ভূমিকার কথা জানতে পারেনি। তাই স্থান্বীশ্বরের রাজপুরুষদের তাঁর কথা না বলায় কেউ তাঁর কথা জানতে পারেন নি। সুতরাং অভিযানে রণকৌশল ইত্যাদির পরিকল্পনার সময় শশাঙ্কের বিষয়ে কোনও চিন্তাই কেউ করেননি। সকলের অজান্তে ঈশাণ কোণের একটি অজানা মেঘ থেকে যে কি ভীষণ দুর্যোগ ঘনিয়ে আসতে পারে তা কল্পনাতীত।) --- (ক্রমশ প্রকাশ্য)


0 comments:

0

ধারাবাহিকঃ সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক


এক কিশোরীর রোজনামচা
সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়



ভূমিকা

The Diary of a Young Girl হল ১৩ বছরের অ্যানি ফ্রাঙ্ক এর লেখা রোজনামচা। সাধারন অভিজ্ঞতায় এই বয়সে রোজনামচা লেখার অভ্যাস দেখা যায় না। আর যদিও বা দেখা যায়, তা’হলে সেটা নিতান্ত শখ বা শৌখিনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু অ্যানির রোজনামচা তার শখ বা শৌখিনতা কোনওটাই ছিল না। তার ডাইরি ছিল তার মনের বন্ধু। এই রোজনামচার পাতায় অ্যানির চোখে সমাজ রাজনীতির এক ভিন্ন রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি। চল্লিশের দশকের যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সদম্ভ প্রকাশে সমাজ ও রাজনীতিতে যে আগ্রাসী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, সেই পরিস্থিতিই অ্যানিকে তার বয়সের তুলনায় শুধু পরিপক্কই করে তোলেনি, জীবনবোধে দার্শনিক করে তুলেছিল। অস্তিত্বের চূড়ান্ত সংকটের মধ্যেও জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দ আর ইচ্ছাগুলোকে নিয়ে যে বেঁচে থাকার অনুভূতিকে উপভোগ করা যায়, এ’কথা অ্যানির ডাইরি না পড়লে বোঝা যায় না। তাই অ্যানির ডাইরি শুধু ডাইরি নয়, এ হল এক জীবনবোধ, যেখানে সে তার নিজের চোখ আর উপলব্ধি দিয়ে, আমাদের ঊনবিংশ শতাব্দীর তিন-চার দশকের সবচেয়ে বিভীষিকাময় সাম্রাজ্যবাদের অত্যাচারের ধারাবিবরণী শুনিয়েছে। এ এমন এক ধারাবিবরণী যা একদিকে আমাদের স্মৃতিতে হাজির করে যুদ্ধের বিভীষিকা, অন্যদিকে মানবিকতার সংকট। আর এই দুই-এর মধ্যে অ্যানির ডাইরি যেন জীবনের নিদিধ্যাসন। এই গভীর নির্মোহ বোধ থেকেই অ্যানি দেখেছে আটজন অন্তরালবর্তী ব্যক্তির জীবনের ওঠাপাড়ার দৈনন্দিন ঘটনা। আর সে তা’ লিখে রেখেছে তার ডাইরিতে। জানিয়েছে তার একমাত্র বন্ধু কিটীকে।

১৯৪২ সালে নাৎসি বাহিনী যখন ইতালি দখল করে তার চূড়ান্ত রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভুত্ব কায়েমের প্রক্রিয়া শুরু করল, এবং ক্রমেই তা নিশ্চিত করতে উন্মত্ত হয়ে উঠল, তখন এই আটজন ইহুদী নিজেদের জীবন রক্ষার তাগিদে এক গোপন আস্তানায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। এই সময় তাঁদের জীবনের সঙ্গী ছিল বাঁচার জন্য জীবনের ভয়, আর ছিল জীবনের ভয়ে আত্মগোপনের একাকীত্ব। বাইরের উন্মত্ত যুদ্ধ আর জাতিবিদ্বেষের সম্ভাব্য আক্রমণ, আর ভিতরে অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ... এই দুই-এর আক্রমনে বিধ্বস্ত আটজন অন্তরালবাসী, জীবনের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পেরেছিলেন, যুদ্ধের বীভৎসতা আর মানবিকতার অবমাননা।

ভিতর ও বাইরের এই চরম নৈরাজ্য আর অপমান স্বত্বেও তাঁরা বাঁচার জন্য আস্থা রেখেছিলেন জীবনধারণের ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তার উপর। ঠিক যেন দুই হাতের তালুর আড়াল দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা জীবনের শিখা। দুই বছরের অন্তরালে, ১৯৪২ থেকে ১৯৪৪ সাল, অ্যানিও শিখেছিল জীবনের নতুন ধারাপাত। ১৯২৯ সালের ১২ই জুন এক ইহুদী দম্পতির কোলে অ্যানির জন্ম। অ্যানির এক দিদি ছিলেন মারগট। তাঁর জন্ম ১৯২৬ সালে। অ্যানির পরিবার জার্মানির আদি বাসিন্দা হলেও ইহুদী হওয়ার কারণে ১৯৩৩ সালে তাঁরা সপরিবারে হল্যান্ডে দেশান্তরিত হতে বাধ্য হন। তখন অ্যানির বয়স চার কি সাড়ে চার বছর। সেই শুরু হয় অ্যানির দেশান্তরের উদ্বাস্তু জীবন। এই জীবন শেষ হয় ১৯৪৪ সালে। তখন তার বয়স মাত্র ১৫ বছর।

অ্যানির ডাইরির সময়কাল মাত্র এই দুই বছর। ডাইরির প্রথম পাতা শুরু ১৪ই জুন ১৯৪২, দিনটা ছিল রবিবার। আর ডাইরি শেষ হয় ১লা অগস্ট, ১৯৪৪, বৃহস্পতিবার। শেষ দিনের ডাইরির প্রথম ছত্রে অ্যানি তার বন্ধু কিটীকে লিখেছিল, “ছোট ছোট বিরোধ আর অসঙ্গতি নিয়ে দিনগুলো কাটালাম। এভাবেই আমি আমার শেষ চিঠিটা শেষ করতে চাই, এবং এভাবেই আমি আমার শেষ চিঠিটা শুরু করতে চাই। কিছু ছোট ছোট অসঙ্গতি বা বিরোধ, এগুলো ঠিক কি, এবং কেনই বা এগুলো আছে? তুমি আমায় বলতে পার, এই বিরোধগুলো ঠিক কি কারণে আমাদের মধ্যে আছে? এই বিরোধের অর্থই বা কি? অন্য অনেক শব্দের মত, আমার কাছে এই শব্দটার দুটো অর্থ। একটি বিরোধ হল বাইরে, সমাজে, অসীম শূন্যতার মধ্যে থেকে যা যে কোন কিছুকে অবলম্বন করে প্রকট হয়, আমাদের বিধ্বস্ত করে। আর একটি বিরোধ হলো নিজের ভিতরে। নিজের অস্তিত্বের অসঙ্গতিকে নিয়ে বিরোধ। নিজের সঙ্গে নিজের সংঘাত।’’ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে ধ্বস্ত অ্যানি এভাবেই শুরু করেছিল তার শেষ চিঠির প্রথম ছত্র।

যাই হোক, ১৯৪২ থেকে ১৯৪৪ সাল, এই দুই বছরের পর্বটা ছিল তার জীবনের অন্তরালবর্তী পর্ব। এই সময় তার কাছে সমাজ, পরিচিত, পড়শী, বন্ধু , কেউ ছিল না। ছিল একমাত্র অন্তরালের একাকীত্ব । জীবন জীবনে ছিল না, ছিল শুধু অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইএর মধ্যে। কিন্তু অন্তরালের গোপনীয়তায় যখন বাইরের খোলা আকাশ চাপা পড়ে যায়, তখন খুলে যায় মনের ভিতরের জানালা। জীবনবোধের এক নীরব নির্মোহ অভিব্যক্তি। এই অভিব্যক্তিই জন্ম দেয় বাঁচা ও বেঁচে থাকার অসঙ্গতিকে, ইতি ও নেতির সংঘাতকে। অ্যানির সঙ্গের আটজন, খোলা আকাশের নীচে, পরিপূর্ণ জীবন নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁদের জাতি পরিচয় তাঁদের বাধ্য করেছিল গোপন অন্তরালে জীবনকে আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখার সুযোগ খুঁজে বেড়াতে। সেই খোঁজার সরল অভিব্যক্তি হল অ্যানির এই ডাইরি। এখানে দিন আছে শুধু সময়ের অর্ধ হিসাবে, জীবন আছে শুধু অস্তিত্বের উপলব্ধির জন্য। আর অবকাশ আছে শুধু মনের অগম্য দিগন্তে ভাসার জন্য।

১৯৪২ থেকে ১৯৪৪ সাল। অ্যানি তার তেরোতম জন্মদিন থেকে পনেরোতম জন্মদিনে যাওয়ার মধ্যেই খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গিয়েছিল। জীবন আর মৃত্যুর মধ্যেকার অগাধ রহস্য, অনন্ত অপেক্ষা, চেতনার বিস্মিত বিকাশ, সব অভিজ্ঞতা সে এই দুই বছরের মধ্যে সঞ্চয় করে নিয়েছিল। তাই তার ডাইরি শুধু নিত্যকার ঘটনার বর্ণনা নয়। তার ডাইরি জীবনবোধের এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার নির্মোহ বর্ণনা। অন্তরীণ জীবনের উষ্ণ উত্তেজনাকে কিভাবে রসজ্ঞ চাতুর্যে বহন করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়, সে প্রজ্ঞা অ্যানি স্বল্প কালের জীবনেই আত্মস্থ করে নিয়েছিল। সেটাই ছিল তার বেঁচে থাকার একমাত্র সঙ্গী। অ্যানি তার জীবনবোধের প্রজ্ঞা দিয়ে প্রতিটি কালো দিনকে এমনভাবে আলোক সজ্জায় সাজিয়েছে যে, তার ডাইরি পড়তে পড়তে প্রতিটি পাঠকের মনে হবে, এটাই ছিল স্বাভাবিক, আর এটার মধ্যেই আছে জীবনের নতুন এক ছন্দ। তার লেখার ছন্দের মধ্যে থেকেই ফুটে ওঠে, তার বাবা, মা, দিদি আর অন্য সহবাসীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক। আর ফুটে উঠেছে কিভাবে সময় তার নিজের ছন্দের বাইরে গিয়ে, তাকে “বড়” করে তুলেছে।

এই ডাইরি এক অস্থির সময়ের সমাজ ও রাজনীতির দলিল। মানব সভ্যতার কলংকিত সময়ের সাম্প্রদায়িকতার এক চলমান ক্যানভ্যাস। মানুষ তখন মনুষ্যত্বের পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার পরিবর্তে ধর্ম, বর্ণ আর সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে পরিচিত হত। এই সবের মধ্যে দিয়েই অ্যানি পার হয়েছিল তার তেরো থেকে পনেরো বছরের জীবন। আর তাই এসবকে নিয়েই অ্যানি তার সরল সহজ চাতুর্যে চিন্তা, চেতনা, আশা, নিরাশা, প্রেম ও ভালবাসা নিয়ে শুধু বেঁচেই ছিল না, জীবনকে উপভোগও করছিল। এখানেই অ্যানির বিশেষত্ব। অ্যানির ডাইরি পড়ে পাঠকের কোথাও কখনও মনে হবে না, এই অসূয়া, অসহিষ্ণুতা বা অন্ধকার অ্যানিকে বা তার স্বাভাবিক মানবিক চিন্তার পথকে কোনও ভাবে আচ্ছন্ন করতে পেরেছিল। অ্যানি তার সরল উপলব্ধি দিয়ে এই সব নেতিকে অস্বীকার করতে পেরেছিল। পনেরো বছরের অ্যানি হয়ে উঠেছিল সকল ক্লেদ আর সংস্কার মুক্ত মানবিকতার চিরন্তন প্রতীক।

তেরো বছর বয়সে অ্যানির জীবনে প্রেম এসেছিল। অ্যানি তার ডাইরির এক জায়গায় লিখেছে, “আমাদের স্কুলে কেউই সম্ভবত এই ছেলে বন্ধুর বিষয়টা এড়িয়ে যেতে পারে না। যখনই কোনও ছেলে স্কুলের শেষে তার বাইসাইকেল নিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে বাড়ী পৌঁছে দেবে কিনা, তৎক্ষণাৎ এক পক্ষ অপর পক্ষের সাথে কথা বলতে শুরু করে। এরকম দশটা ঘটনার মধ্যে ন’টার ক্ষেত্রে দেখা যায় ছেলেটা ডিগবাজি খেয়ে মেয়েটার প্রেমে পড়ে যায়।’’ ঠিক এভাবে না হলেও, সাইকেলকে সামনে রেখেই অ্যানি অকস্মাৎ হ্যারি গোল্ডবার্গের প্রেমে পড়ে যায়। তখন ছিল ১৯৪২ সালের জুন মাস। এই প্রেম তার চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগোবার আগেই ১৯৪২ সালেরই জুলাই মাসের এক বৃষ্টিস্নাত সকালে (৯ই জুলাই) অ্যানি তার পরিবারের সঙ্গে বাবার হাত ধরে অজানা গুপ্ত আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। পিছনে পড়ে থাকে তার আবাল্য বেড়ে ওঠা বাসস্থান, তার স্কুল, আর তার কৈশোরের প্রেম আর একটা বিড়াল, যাকে সে কিছু খাবার দিয়ে পিছনে রেখে আসে।

এরপর অ্যানির ডাইরির পাতায় প্রেম এসেছে বার বার। কিন্তু তার অভিজ্ঞান হ্যারির কাছে কোনওদিন পৌঁছেছিল কিনা, তা জানা নেই।

অ্যানির কাছে ডাইরি লেখাটা ছিল, তার ভিতরের আত্মোপলব্ধির খোলসটা ভাঙ্গার এক চেষ্টা। নিজের মধ্যেকার আত্মবিশ্বাসকে কালো অক্ষরে জাগিয়ে তোলা। ১৯৪২ সালের ২০শে জুন অ্যানি তার ডাইরিতে লিখেছে, “আমার মধ্যেকার বন্ধুত্বের মানসিকতাকে প্রসারিত করার মাধ্যম হল আমার ডাইরি। আমার সেই প্রসারিত দৃষ্টি দিয়ে খুঁজে নিতে চেয়েছি আমার বন্ধুকে।’’ অ্যানি তার সেই প্রসারিত দৃষ্টি দিয়েই খুঁজে পেয়েছিল তার কল্পিত বন্ধু কিটীকে। যার কাছে সে তার মনের নীরস, আপাত মাধুর্যহীন সব কথা শেয়ার করত। হতে পারে কিটী কল্পিত। কিন্তু সেই ছিল অ্যানির সমস্ত চিন্তার আধার। অন্য অনেক কিছুর মত অ্যানি কিটীকেই শুনিয়েছিল, তার আর হ্যারির প্রেমের কথা। কিংবা শুনিয়েছিল ১৯৪২ সালে জার্মানির নাৎসি বাহিনীর হল্যান্ডে প্রবেশ, ও জাতি বিদ্বেষ সৃষ্টির ঐতিহাসিক কাহিনী। যার সূত্রপাত এক বৃষ্টিস্নাত সকালে বাবার হাত ধরে ইহুদী কন্যার শহরত্যাগের মধ্যে প্রতিফলিত।

এই ডাইরি শুধু ডাইরি নয়। এ হল জাতি বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে নস্যাৎ করে মানবিকতার পথে জীবনের নিষ্ক্রমণ। এই নিষ্ক্রমণের উচ্চতা বয়স দিয়ে মাপা যায় না। এর উচ্চতা নির্ধারণ করে নির্মোহ মানবিকতার ইতিবাচক দর্শন। এই জন্য “A Diary of a Young Girl” একটি ইতিবাচক বই। আকারে নয়, এর বিশালতা গভীরত্বে। এর ব্যাপ্তিতেই এর পরিচয়। 

ঋতবাকের আগামী কিছু সংখ্যায় ধারাবাহিক ভাবে এই ব্যাপ্তিকে আমি হাজির করতে চাই পাঠকের দরবারে। আমার বিশ্বাস সুধী পাঠককূলের মানবিক সহানুভূতি এবং সহৃদয় মনোযোগ অ্যানির জীবন বোধের গভীরতাকে উপযুক্ত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করবে।

0 comments: