0

ছোটগল্পঃ মনোজিৎকুমার দাস

Posted in







ছোটগল্প


কুসুম কুসুম গন্ধ
মনোজিৎকুমার দাস 



কুসুমের বয়স তখন আর কত, চোদ্দ পেরিয়ে পনেরোয় পড়েছে। সামনের পরীক্ষার পর ক্লাস টেনে উঠবে। ও বড় বোন শিউলি’র চেয়ে চার পাঁচ বছরের ছোট। শিউলি’র বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রাম কদমতলীর রজব মুন্সির একমাত্র ছেলে সেলিম মুন্সি’র সঙ্গে। 

কুসুমরা চার বোন এক ভাই। কুসুমের একমাত্র ভাইটি এখনও মায়ের বুকের দুধ খায়। খেটেখুটে বাড়ি ফিরে কুসুমের বাবা যা আয় করে নিয়ে আসে, তা দিয়ে পাঁচটা পেটকে প্রায় আধা পেট খেয়ে থাকতে হয়। জমিজিরেত এককালে ভালই ছিল, নদী ভাঙ্গনে প্রায় জমিই পদ্মা গর্ভে বিলীন হয়ে কুসুমদের আজ দুরবস্থা! 

এতগুলো ছেলেপিলের জন্য কুসুমের বাবা উঠতে বসতে তার আম্মুকে দোষারোপ করতে কসুর করে না। কুসুমের মাও দু’চারটা কথার জবাব দেয়। 

রাতে পাশের ঘর থেকে মা বাবার ঝগড়াঝাটি মুখ বুঁজে সহ্য করতে হয় কুসুমকে। তার আর দুটো বোন তার থেকে ছোট, সন্ধ্যের পরেই একটু পড়াশোনা করেই ঘুমিয়ে পড়ে। প্রাইমারী স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে সিক্স-এ ওঠার পর কুসুমের পড়াশোনার ইতি ঘটাতে তার বাবা উঠে পড়ে লাগে।

একদিন কুসুমের আব্বা আম্মাকে বলে,‘কুসুম ডাগর হয়ে উঠিছে, তোর চোহে পড়ে না! ওরে আর পড়তি হবি নে।’ মা তার বাবার কথার প্রতিবাদ করে বলে, ‘ডাঙ্গর হইছে বলে বড় মিয়্যাডার পড়ালেহা বন্ধ করে দিছিলে, এবারে কুসুমরে পড়া বন্ধ করার কতা কইছো!’

‘দিনকাল যা, ঘরে সমত্ত মিয়্যা নিয়ে বসত করে দেহ!’

‘কুসুমকে ডাঙ্গর হইছে কোন চেহে দেখতি পেলে! মুইরে যে বয়সি সাদি করছিলে সে সুমারকার দিন এহন নেই। বাবুপাড়ার দাসেগের মিয়্যা ঢাহায় পড়ে ডাক্তর, উহিল হতিছে তা তুমার জানতি বাকি নেই। মিয়্যাগেরে কুড়িতি বুড়ি হবির দিন শ্যাষ!’ 

‘তুমার প্যচাল মুই’র ভাল লাগতিছে না।’ 

‘এহন ভাল লাগবি ক্যানে! মুই’র শ্যাষ পোলাটা হতি নার্গিস নার্স্ আর ডাক্তর রেবা দাসের কতা এহন তো মনে নেই! তুমাগেরে মতোন তারা পুরষে মানিষ্যি।’

কুসুমের বাপ কথা ঘুরিয়ে বলল,‘মিয়্যাডিরাতো রজব মুন্সি তার পোলার বউ করতি এক পায়ে খাড়া ছিল! তাই ওর সাদিডা ওহানেই দিতি বেগ পাতি হয়নি।’ 

কুসুমের বড়বোন শিউলির বিয়ে রজব মুন্সির ছেলে সেলিম মুন্সির সঙ্গে ভাল ভালয় হয়ে যাওয়ায় কুসুমের বাবা সে সময় স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলেছিল। কুসুমের মা’র ইচ্ছে ছিলনা কম বয়সে শিউলির বিয়ের দেবার। তখন পাড়ার মেয়েরা স্কুলে যেত না।

কুসুম সংকল্প করে যেভাবেই হোক ক্লাস সিক্সে ভর্তি হবে। ওদের পাড়ায় দাসবাবুদের জমিতে নবারুণ জুনিয়র স্কুল হয়েছে। বছরের প্রথম থেকেই নবারুণ স্কুলের শিক্ষকরা কুসুমকে তাদের স্কুলে ক্লাস সিক্স এ ভর্তি করানোর জন্য কুসুমের বাবাকে অনুরোধ করে আসছিলেন। কুসুমের বাবার এক কথা, ‘বড় মিয়্যাডারে লেহাপড়াডা না শিখোয়েই ভাল সাদি দিছি সেডাতো জানতি পারিছেন। মুই’র কুসুমডা তো বড় মিয়্যাডা থিকে বড় সুন্দরী! ওকে সাদি করতে আর কয়ডাদিন পরে কত পোলা মুই’র পায়ে পড়বিনে।’ 

‘কুসুম প্রাইমারী স্কুল থেকে বৃত্তি পেতে পারে।’ ওদের স্কুলে হেড টিচার শ্যামলবাবু বলছিলেন, ‘তাই আপনাকে এতটা অনুরোধ করছি।’ কুসুমের বাবার মন গলাতে পারেননি। 

নবারুণ জুনিয়র হাই স্কুলে ভর্তি হওয়া হয়ে ওঠে না। কুসুম জানে তার বড় বোন শিউলি’র বিয়ে কদমতলীর মুন্সি বাড়িতে হওয়ার কথা নয়, শুধুমাত্র সুন্দর মুখশ্রী আর নিটোল দেহ সৌষ্ঠবের জন্য হয়েছে। কদমতলী বাজারে কুসুমের দুলাভাই সেলিম মুন্সির বেশ বড়সড় মুদির দোকান। কুসুমের মতো ভাল ছাত্রী হাইস্কুলে সিক্সে ভর্তি হয়নি বলে সেলিম ও শিউলির ভাল লাগে না। কুসুমদের প্রাইমারী স্কুলের হেড টিচার শ্যামলবাবু সেলিমকে বলেন, ‘কুসুম ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে, আর ও ক্লাস সিক্সে ভর্তি হলো না, আমার কাছে এটা বড়ই দু:খের ব্যাপার। বাবা সেলিম, এখনো ভর্তির সময় আছে, ওকে ওদের গ্রামের নবারুণ জুনিয়র হাইস্কুলে ভর্তি করার ব্যবস্থা তো তুমিও করতে পার।’ 

শ্যামলবাবুর কথা শুনে সেলিম পরদিন ভোরেই কুসুমদের বাড়িতে রওনা দেয়। শ্বশুরবাড়িতে ঢুকতেই লাল ফুলে ফুলে ভরা গোলাপ গাছের কাছে কুসুমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পায়। কুসুমের সদা হাস্যোজ্জ্বল গোলগাল ফরসা মুখটাতে হাসির লেশমাত্র নেই। ‘ছোট গিন্নি, তোমার কুসুম কুসুম চেহারায় ------------’ সেলিমের কথা শেষ করার আগেই কুসুম বলে উঠে, ‘কুসুম তো শুকায়ে কাঠ হয়ে গেছে মোর পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার দিন থিকে।’ 

‘কুসুম কী অসময়ে শুকোয়! ফুলে ফুলে ভরা তুমার গোলাপ গাছডি দ্যাখো কেমনডা আলো করে আছে। এ বয়সে তুমার তো শুকোয়ে যাওয়ার কতা না।’ সেলিম সুখবরটা দেওয়ার পরেও কুসুমের মনটা আরও বিষণ্ণতায় ভরে যায়। সে তার দুলোভাইকে বলে,‘ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায়ে এখন আর আমার কী লাভ, বলোতো দুলোভাই!’ 

‘তুমার গোলাপী মুখিতি হাসি ফিরোতি ভোর হতি না হতিই ঘর থিকে বের হয়ছি, কসুম।’ 

‘আমাগেরে গাঁওয়ের মোল্লা বাড়ির ফকর মোল্লার বকাটে পোলাডা মুইকে দিখতি পালিই বলে, সে নাকি মুইকে সাদি করে ঘরে তুলবি। ওর কতার মিল পাইছি ফকর মোল্লাকে বারে বারে আমাগেরে বাড়িতি আসে আব্বার সাথে ঘুজুরঘুজুর ফুসুরফুসুর করতি দেখতি পায়ে।’ কথাগুলো শেষ করে কুসুম কেঁদে ফেলল। 

‘ফকর মোল্লার পোলার লগে তুমার সাদি! হা হা হা।’ সেলিম কুসুমের কথা শুনে হো হো করে হেসে বলল। 

‘মুই ভয়ে সেদিয়ে আছি, তুমি মজা করে হাসতিছে! ফকর মোল্লা কী সংঘাতিক লোক তা তো তুমার জানা নেই।’

হাসি থামিয়ে সেলিম বলল,‘ফকর মোল্লা, তুমার আব্বা মানে মুইয়ের শ্বশুর আব্বাজান ‘জানে দেশে সাদি’র নতুন আইন হইচ্ছে, মিয়্যার বয়স ১৮, আর পোলার বয়স ২১ বছরের কম হলে সাদি দেওয়া অপরাধ। এই আইন না মানলি পারে মিয়্যা আর পোলার বাবার জেল জরিমানা হবি।’ 

দুলাভাইয়ের কাছ থেকে এই আইনের কথা শুনে কুসুম একটু আশ্বস্ত হল। সেলিম এবার হেসে বলল,‘জন্ম নিবন্ধন করার নিয়ম ছিল না আর সাদি’র আইননি কড়াকড়ি ছিল বলেই মুই তুমার বুনকে সাদি করতি পারিছিলাম, তা কুসুম, তুমি কি আমারে গোলাপের কুসুম কুসুম গন্ধ শুকোয়েই বিদেয় করবে?’ 

কুসুম দুলোভাইকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলে সেলিম সঙ্গে আনা টুকিটাকি জিনিসপত্রে ভরা থলিটা শাশুড়ি আম্মাজানের হাতে দিয়ে কদমবুচি করে বলে,‘আপনার মিয়্যা এগুলি পাঠইছে।’ জামাই বাবাজী এত সকালে তাদের বাড়িতে আসায় কুসুমের মায়ের মনটা কেন যেন ছ্যাত করে ওঠে এই ভেবে যে, বড় মেয়ে শিউলি নয় মাসের পোয়াতি,তার কিছু ঘটলো নাতো! তাই সে সবার আগে জিজ্ঞাসা করল,‘মুই’র শিউলি মার শরীল ভালতো বাপজান?’

এতক্ষণ ঘরের ভেতর থেকে কুসুমের আব্বা ঘাপটি মেরে কুসুম আর সেলিমের কথা শুনছিল। তাদের কথা থেকে সে বুঝতে পারল কুসুমকে ছয় ক্লাসে ভর্তি করার জন্য জামাই বাবাজীর এত সকাল সকাল আসা। সাদি‌-বিয়ের বয়স সম্বন্ধে নতুন আইনের কথা শুনে কুসুমের বাবার মনে পড়ল হুজুর আলী মেম্বরের কথা। চায়ের দোকানে মেম্বারের সঙ্গে দেখা হলে মেম্বর সাহেব বললেন,‘ফকর মোল্লার পোলার সঙ্গে নাকি তোমার মেয়ে কুসুমের বিয়ে দিচ্ছ। যে আইন হয়েছে তাতে দশ এগার বছর মেয়ের বিয়ে দিলে জেলের ঘানি টানতে হবে।’ হুজুর আলী মেম্বরের কথা শুনে কুসুমের বাবা মনে করেছিল ফকর মোল্লা তার এন্টি দলের লোক, তাই হয়তো মেম্বর সাহেব তাকে ভয় দেখায়েছে। এখন জামাইবাবাজীর মুখ থেকে একই কথা শুনে তার হুঁশ হল। 

সেলিমবাবাজী কুসুমকে নবারুণ জুনিয়র স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি করার প্রস্তাব করায় কুসুমের বাবা এক কথায় রাজি হয়ে গেল। ক্লাস শুরুর তিন মাস পরে কুসুম ক্লাস সিক্সে নবারুণ জুনিয়র হাই স্কুলেও ফার্স্ট হয়ে পরের ক্লাসে উঠল। 

এদিকে জামাই সেলিম শ্বশুরকে কদমতলী বাজারের বড় একটা মুদির দোকানে বেচাবিক্রির কাজ দেওয়ায় কুসুমদের সংসারে আর আগের মতো অভাব নেই। কুসুম ভাবে, বাবার অভাবী সংসারে তাকে তার পড়াশোনার খরচ চালাতে কষ্ট হবে। তার পড়াশোনার খরচের টাকা নিজেকেই আয় করার চেষ্টা করতে হবে। 

ক্লাস এইটের পরীক্ষায়ও ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ায় কুসুম সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল দুলাভাই সেলিমকে। সে বছরই কুসুমদের স্কুলটাতে ক্লাস নাইন খুলল। কুসুম ভাবল, আগামী বছর নবারুণ হাইস্কুলের প্রথম ব্যাচের স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী হবে। 

কুসুমরা ক্লাস টেনে ওঠার পর জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে হেড স্যার ক্লাসে বললেন, ‘মেয়েদের জন্যে একটা সুখবর আছে। পড়াশোনায় ভাল নম্বর পাওয়া মেয়েদেরকে মাসে মাসে উপবৃত্তি দেবে, তার সঙ্গে বই কেনার ও পরীক্ষার ফিসেরও টাকা থাকবে।’ তিনি ইংরেজি ক্লাস শেষ করে ক্লাসরুম থেকে বের হওয়ার আগে কুসুম, বিমল, নাজনীন ও সুজাতা ও ফিরোজ এই পাঁচ জনের নাম ধরে বললেন, ‘তোমরা জান, তোমরাই নবারুণ হাই স্কুলের একমাত্র ভরসা, নতুন স্কুলের মানসম্মান তোমরাই রক্ষা করবে বলে আমি আশা করি। আমি তোদের কথা দিচ্ছি, তোমাদের জন্যে সব সাবজেক্টের স্পেশাল কোচিং এর ব্যবস্থা করা হবে। সবার জন্য শুভেচ্ছা।’ 

নবারুণ হাই স্কুলের শিক্ষকদের আশা সত্যি হল। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় ওই পাঁচ জন ছাত্রছাত্রীই একাধিক স্টার নম্বর পেয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করল। একমাত্র কুসুমই বিজ্ঞান বিভাগে ছয়টা বিষয়ে লেটার পেয়ে ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়ায় সবাই খুশি হয়। 

কুসুম ভাবে, সেলিম দুলাভাইয়ের ঋণ কোন দিনই শোধ করতে পারবে না। আর ঋণশোধ করতে পারবে না সোহাদি’র। কুসুমদের গ্রামের দক্ষিণপাড়ায় হিন্দুদের বাস। ৪৭ এর দেশভাগের পর অবস্থাপন্ন হিন্দুরা ভারতে চলে গেছে। ওপাড়ায় যে সব হিন্দুরা, তারা প্রায়ই কৃষিজীবী। তাদের ছেলেমেয়েরাও এখন লেখাপড়া শিখছে। ওপাড়ায় যে সব মেয়েরা কষ্ট করে লেখা পড়া শিখছে তাদের কথা কুসুম ভাবে, সোহাদিরা দু’বোন, সোহা’র বড়দি নেহা আধা প্রতিবন্ধী, বাবা রিক্সা ভ্যান চালায় আর ভাগ চাষী হিসাবে অপরের জমিতে ফসল জন্মায়। সোহা আর তার মা বাবাকে চাষের কাজে সাহায্য করে। সকালে বিকালে ছোটমেয়েদের প্রাইভেট পড়িয়ে যা পায়, তাদিয়ে পড়াশোনর খরচ চালায়। এবার সোহা ইন্টারের সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে। ক্লাসে সিক্স এ ভর্তির বিষয়ে সোহাদির কথাও কুসুম ভুলতে পারে না। সে সময় সোহা তাকে কী বলেছিল তা কুসুমের সব সময়ই মনে পড়ে। ‘কুসুম, তুই এখনও সিক্সে ভর্তি হোসনি ক্যানে?’

‘আব্বা তো আমাকে ভর্তি করাবি নানে, আমারে সাদি ---------’ 

‘তুই রাখ তোর বাবার কথা! বাবা পড়বে না তুই পড়বি। মনে হচ্ছে, তোর সোয়মির ঘর করার ইচ্ছে হইচ্ছে।’

‘না, না সোহাদি, আমি আরও পড়তে চাই।’ 

‘আমি কেমন করে পড়শোনা চালায়ে যাচ্ছি তুই তো জানিস্ না? দুই বেলা প্রাইভেট পড়াই, তারপর মাঠেও খাটি। তুই নতুন স্কুলটাতে ভর্তি হয়। আমি ছেলেমেয়ে জুটায়ে দেব প্রাইভেট পড়ানোর জন্য।’ 

সিক্সে ভর্তি হওয়ার পর সত্যি সত্যি সোহা কুসুমকে প্রাইভেট পড়ানোর জন্য ছেলেমেয়ে জোগাড় করে দেয়। তাই কুসুম সোহাদির কথা ভুলতে পারে না। 

রেজাল্টের খবর জেনে কুসুম আর তার মা মিষ্টি নিয়ে সেলিম দুলাভাইয়ের বাড়ি যায়। শিউলি’র শাশুড়িকে কদমবুচি করলে সেলিমের আম্মা এক হাজার টাকার একটা নোট কুসুমের হাতে দিয়ে বলেন, ‘মা, তুমি আরো লেহাপড়া শিখে মস্ত ডাক্তার হইও। সময় মতো ডাক্তার পালি সেলিমের আব্বা অকালে মরতো না।’ জবাবে কুসুম বলে,‘মাওইসাহেবা, দোয়া করবেন আমি যেন ডাক্তার হতে পারি।’

চরম দারিদ্রের মধ্যে এত ভাল রেজাল্ট করায় কুসুমের আম্মা আব্বা’র মান সম্মান বেড়ে যায়। একদিন সন্ধ্যের আগে ফকর মোল্লা কুসুমদের বাড়িতে এসে হাজির। এ গল্প সে গল্প বলার পর ফকর মোল্লা আব্বাকে বলে,‘তুমার তো লায়েক মেয়ে, কী কী ফাস্টো বিয়ে পাশ করলো। মুই’র বড় পোলার সঙ্গে ওরে সাদি না দ্যেয়ায় মুই না খোশ না। মুই’র দুই নোম্বর পোলা কলেছে পরতিছে, ওর জন্যি একডা মিয়্যা খুজতিছি।’ 

কুসুম পাশের খোপে থেকে ফকর মোল্লার কথা কান পেতে শুনছিল। কুসুমের আব্বার মুখ থেকে কোনও জবাব না পেয়ে ফকর মোল্লা আবার মুখ খুলল,‘গভমেন্ট প্রাইমারী ইস্কুলে মিয়্যাগেরে মাস্টরী দিতিছে। কুসুম মারে মাস্টোরীতে ঢুকায়ে দাওগে। মুই’র থায়েস হইছে দুই নোম্বর পেলাডার সাদি একডা মাস্টোরী মিয়্যার লগে দিবার।’ এবার কুসুমের বোধগম্য হয় ফকর মোল্লা কেন তাদের বাড়িতে এসে আগ বাড়িয়ে এসব কথা তার আব্বাকে বলছে। 

কুসুম মনে মনে ভাবে, তাদের গ্রামের টাউট ফকর মোল্লা ঘুঘু দেখেছে, কিন্তু ফাঁদ দেখেনি! পড়ালেখা করে ফকর মোল্লাকে-----------------

সন্ধ্যে হবো হবো, দুলোভাই, শিউলি আপা তাদের একমাত্র ছেলে মিথুনকে কোলে তার ফুল বাগানের কাছে দেখতে পেয়ে কুসুমের চিন্তায় ছেদ পড়ে। সে ঘর থেকে বের হয়ে তাদের উদ্দেশে দৌড় লাগায়। কুসুম প্রথমেই শিউলির কোল থেকে মিথুনকে নিজের কোলে নিয়ে তাকে আদর করতে থাকে। 

‘শিউলি, আসার আগে তোমারে বলে ছিলাম না, কুসুমদের বাড়িতে গিয়েই কুসুম কসুম গন্ধ পাবে। সত্যি হল তো?’

শিউলি বেশ অনেকদিন হল বাপের বাড়িতে আসে না। কুসুম তাদের বাড়ির সামনে এত সুন্দর একটা ফুলের বাগান করতে পারে, তা শিউলির জানাই ছিল না। তাদের বাড়ির সামনে মাত্র দুটো গোলাপ, একটা শিউলি আর হাস্নাহানার ফুলের ঝাড় ছিল মাত্র। স্বামীর কথার জবাবে শিউলি বলল, ‘সত্যি তো কুসুম কুসুম গন্ধে মো মো করতিছে।’ সে বোনের উদ্দেশে বলে, ‘মুই শিউলি হয়েও আমাগেরে বাড়িতি একডাও শিউলি ফুল গাছ নেই। তোর ফুল বাগান থিকে কুসুম কুসুম গন্ধ ছড়াতিছে, আর তোর গা দিয়েও কুসুম কুসুম গন্ধ ছড়ায়।’ 

‘আমাকে প্রশংসা করার আগে দুলোভইকে প্রশংসা করো, বড় আপা। সব সৌরভ ছড়ানোর মূলেই আছে দুলোভাই। দুলোভাই না থাকলে আমাকে ফকর মোল্লার বেটার বউ হয়ে এতদিনে পোলার মা হতে হতো।’ 

রাতে খানাপিনার পর তাদের ঘরে এসে কুসুমকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে শিউলি বলল, ‘কাঁদছিস্ ক্যানে, আব্বা না মা বকেছে?’

সেলিম কুসুমকে পাশে বসিয়ে কান্নার কারণ জানতে চাইলে কুসুম বলল,‘ফকর মোল্লা এখনও আমার পেছনে লেগে আছে। মেয়েদের কোটায় সরকারী প্রাইমারী স্কুলে আমাকে শিক্ষকতা করার জন্য আব্বাকে ফুঁসলাচ্ছে। সে নাকি তার মেঝ ছেলের জন্য এমন একটা স্কুলের শিক্ষকতা করা মেয়ে খুঁজছে।’ 

কুসুমের কথা শুনে শিউলি বলল, ‘মনে পড়িছে, আমরা কুসুমের সাথে কথা বলতিছিলাম, তখন তো ফকর মোল্লাকে ডানে দিকের পুকুর পাড় দিয়ে যাতি দেখতি পাইছিলাম। তা কুসুম তোর ভয় ক্যানে? সে তো তোর সাথে তার ম্যাছে পোলাকে বিয়ে দিতি চাচ্ছে না।’ 

‘আভাসে ঈঙ্গিতে আমার সঙ্গে তার পরের পোলাটারে বিয়ে দিতে খায়েস করছে।’ 

কুসমের কথাটা শুনে সেলিম রেগে গিয়ে বলল,‘মুই’র শ্বশুর আব্বার মুরোদ কতডা তা তো কুসুম ভাল ভাবেই জান! শ্বশুর আব্বা কি তুমার ভবিষ্যৎ উন্নতি ঘটাতি পারবেনে?’

স্বামীর কথা শুনে শিউলি স্বামীকে বলল, ‘কুসুমের পড়ালেহার এর পরের দায় তুমার নয়। আব্বাজানের। আব্বাজান কুসুমকে সরকারী চাকরী দিতি পারলি ওকে বিনে পয়সায় বিয়ে দিতে পারবে।’ 

‘তা হলি পারে ফকর মোল্লার ম্যাজো পোলার সাথে কুসুমের বিয়ে দিয়ে দিতি পারবেন আবাবাজান, তাই না মিথুনের মা?’ সেলিম বউকে কথাটা বলে কী যেন চিন্তা করে রাগের সঙ্গে বলে, ‘আব্বাজান তুমার সাদি মুই’র সাথে না দিয়ে ফকর মোল্লার বড় পোলা মস্তান ফন্টার সাথে দিলি পারে ভাল হতো, তাই না? এত দিনে বড় মস্তান তুমার সোয়ামী হতো।’ স্বামী সেলিমের কথা শুনে শিউলি কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ মেরে থাকল। দুলোভাইয়ের কথা শুনে কুসুম তো থ। 

‘কুসুম, মুই না থাকলি পারে তুমার পড়ালেহা প্রাইমারী স্কুল থিকেই শেষ হতো, তাই না?’

কুসুম সঙ্গে জবাব দিল। ‘তা কে না জানে?’

‘ঠিক আছে, তুমার মতো মেধাবী শালীকে আমি নিজেই সাদি করবো, স্কুলে চাকরী পাওয়ার আগেই, তুমাগেরে গ্রামের ফকর মোল্লার ফোকলা দাঁতগুলো ভেঙে দিয়ে। তুমার বড় আপার রাজি না হলে ওকে তালাক দেব।’ স্বামীর কথা শুনে কুসুমের বড় আপা শিউলি ভয়ে জড়সড় হয়ে পড়ল। সে ভাবল, তার স্বামী মাটির মানুষ, কিন্তু একবার রেগে গেলে মানুষ থাকে না। কুসুম কী যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই শিউলি আচমকা তার স্বামীর পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বলল, ‘এবারে মতো জন্যি আমাকে মাপ করে দাও মিথুনের আব্বা। মুই জেবন থাকতি এমডা কোনওদিন বলবো না। বোনডা আর মুইরে তুমি বাঁচাবে কিনা তা না বললি মুই তুমার ছাড়তিছি নে।’ 

‘পা ছাড়, এবারে মাপ করে দিলাম। আর এমনডা কথা বললি তোর কপালে কেমন দুঃখ লেহা আছে বুঝতি পারবি।’ 

সে রাতটাতে তাদের মধ্যে আর কোনও কথা হল না। পরদিন সেলিমরা বাড়ি ফেরার আগে শ্বশুর শাশুড়ির কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলে তার শ্বশুর যা বলল, তা থেকে সেলিম বুঝতে পারল তার বউ শিউলি গতরাতের সব কথা তার বাপ মাকে বলেছে। ‘বাবাজান সেলিম, কুসুমের লেহাপড়া ভার তোমারের নিতি হবি। শিউলি বলছিল – বিয়ানের নাকি ইচ্ছে কুসুম ডাক্তার হোক।’ 

সেলিম ভাবল, শ্বশুরকে একটু ছবক দিয়ে যাওয়া লাগবি। সে বলল,‘কুসুমের আর পড়ালেহা করিয়ে কি লাভ! বড়মিয়্যা শিউলির সঙ্গে ফকর মোল্লার পোলার সাদি দিলি গ্রামে একটা ধজগজ পাতেন। ফকর মোল্লার বড় মাতুব্বর মানুষ। কুসুমের প্রাইমারী ইস্কুলি চাকরি তার তো হাতে ময়লা। ফকর মোল্লার ম্যাজো পোলার সাথে সাদি দিয়ে গ্রামে একঘর ধজগজ বানান।’ জামাইয়ের কথা শুনে কুসুমের আব্বা একটা কথাও বলল না। সেলিমের কথা শুনে কুসুম, কুসুমের মা আর শিউলি কাঁদতে লাগল। সেলিমদের এগিয়ে দেওয়ার জন্যে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে গেল কুসুম। কুসুম সেলিম ও শিউলিকে কদমবুচি করে সেলিমকে বলল, ‘ওইটাই যদি তোমার শেষ কথা হয়, তবে তোমাদের এর পরের বার আমার মরা মুখ দেখতে আসতে হবে।’ 

প্রতিবার বাপের বাড়ি থেকে ফিরে পোলার বউ তার শাশুড়ির কাছে বাপের বাড়ির কত গল্প করে। কিন্তু এবার বাপের বাড়ি থকে শিউলির মুখে কোনও রা নেই। সেলিমও কোনও কথা বলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় সেলিমের আম্মা চিন্তায় পড়ে। সেলিম দুপুরে খেতে না আসায় সে শিউলিকে জিজ্ঞেস করে, ‘বউমা, সেলিম তো এহন খাতি আলো না! তুমিও মুইকে কোন কতাই কইছো না, বিষয়ডা কী, মা? বাপের বাড়িতি তুমাদের------’ 

শাশুড়ির কথা শেষ হওয়ার আগেই শিউলি তার বাপের বাড়িতে ঘটা সব কথা শাশুড়িকে বলল। শাশুড়ি সব কিছু বুঝতে পেরে শিউলিকে বলল, ‘কুসুমের পড়ালেহা নিয়ে এত চিন্তে ক্যানে তুমার আব্বার, মা? আমি তো কইছি, কুসুমকে ডাক্তার হতি হবি। ডাক্তারের অভাবে বিনে চিকিৎসেয় অকালে তুমার শ্বশুরের এন্তেকাল হওয়ার পর আমি প্রিতিজ্ঞে করিছি, আমি নিজির লোককে ডাক্তার বানাবই। একদিন মুই’র নাতি মিথুন ডাক্তার হবি, তা তো মুই দেহে যাতিও পারি। কুসুমকে ডাক্তার হতি হবি, সে কতা তো ওকে বলেই দিছি। আমাদের তো টাহা পয়সা কম নেই। কুসুমকে ডাক্তার বানাতি যে খরচ লাগে, তা আমরাই দেব। বউমা, তুমি এহন মুই’র সেলিম বাবাজীকে চিনতি পারনি। কুসুমকে সে সাদি করবি, তা তুমি ভাবতি পারলে ক্যামনে?’ 

সেলিমের সহায়তায় কুসুমের যে জীবন সংগ্রাম শুরু হয়, তা ধাপে ধাপে সাফল্যের শিখরে একদিন কুসুমকে পৌছে দেয়। পদ্মা তীরের অখ্যাত গ্রাম সোহাগপুরের হতদরিদ্র ছোট্ট কুসুম আজ মনিকগঞ্জ সদর হসপিটালের ডাক্তার কুসুম পারভনী এম.বি.বি.এস। 


এম.বি.বি.এসের রেজাল্ট জেনে কুসুম প্রথমেই গিয়েছিল মাওইমা, মানে সেলিম দুলোভাইয়ের আম্মাকে সুখবরটা জানাতে। সেলিম দুলোভাই, শিউলি আপা, মিথুন, সবাই ওখানে ছিল। কুসুম মাওইমাকে কদমবুচি করে সুখবর জানালে তিনি মাথায় চুমু দিয়ে বলল, ‘কুসুম মা, আমি আগেই জানতাম তুই পারবি। সেলিম বাবা তুমাকে যতার্থই বলতো ‘কুসুম কুসুম গন্ধ’। যতার্থই তুমি কুসুম কুসুম গন্ধ মাখা মিয়্যা মুই’র।’

0 comments: