0

ছোটগল্পঃ মুস্তাইন সুজাত

Posted in


ছোটগল্প


বাল্যবন্ধু 
মুস্তাইন সুজাত 



এক

মফস্বলের বাজার। জিতা-মরায় মেশামেশি।

ইদানিং সকাল যখন স্ফটিকের মত ফকফকা রোদ ঢালে আর সন্ধ্যা বুজে আসা চিমনির মত আন্ধারের রোয়া মেলে, দোকানগুলোতে জ্বলে উঠা এনার্জি লাইটের আলো যখন হুটহাট করে সেই আন্ধারের মধ্যে ঢুকে পড়ে রোশনি ছড়ায়, বাজার আস্তে আস্তে জাগতে থাকে তখন; লোকজনদের ব্যস্ত চলাচল বাড়তে থাকে রাস্তায় রাস্তায়, দোকানের চিপাচাপায় সরু গলিমোড়ের আলো-আঁধারিতে বাজারিদের আড্ডা জমে এবং চায়ের স্টলগুলোতে দেশ-কাল-রাজনীতি নিয়ে ঝড় উঠে আর চারদিকের এই তুমুল কোলাহলই যেন বাজারকে জিইয়ে রাখে। অন্যসময় বাজার মরা। তখন দোকানিরা বসে বসে মাছি মারে বিরক্ত মুখে। কেউ কেউ গদি থেকে নেমে ঘামে জবজবা লুঙির গিঁট খুলে ফের শক্ত করে বাঁধে, এরপর একটা লম্বা বেকার সময় কাটানোর জন্য আবার গদিমুখী হয়। শুধু কৃষ্ণা নাপিতের সেলুন মাঝেসাজে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ আওয়াজ তোলে। এই মরা বাজারে কদাচিৎ যে ক’জন লোক দেখা যায়, ওরা দাঁড়ায় না বেশিক্ষণ। আসে এবং কাজ শেষে ঝটপট চলে যায়।

এক সকালে রোদ যখন তুলা হয়ে ঝরছিল বাজারের ভিটেগুলায়, তখন আসাদালি নানা উদ্ভ্রান্তের মত উশকো খুশকো চুলে আমার দিকে আওলা মত দৃষ্টিতে তাকালে দূর থেকে তাঁর সদ্য ছানি কাটা সফেদ ফ্যাকাশে চোখ আর ঘোলাটে আবছা চাহনির আহ্বান আমি ঠিক বুঝতে পারি এবং তাঁর দিকে এগিয়ে যাই। গম্ভীর রাশভারী লোক এই আসাদালি নানা। কাছ ঘেঁষতেই এক হাত বাড়িয়ে,বাড়ানো হাতে ধরা হাত টেনে টেনে তিনি যতটা সম্ভব নিজের দিকে আমাকে সরিয়ে নেন কিংবা নিতে চেষ্টা করেন। হ্যাঁচকাটান, টাল হারালেও হাত ছাড়েন না। বরং কিছুক্ষণ মৌন থেকে একসময় কথা বলতে শুরু করেন। অত্যন্ত মৃদুস্বর তাঁর, স্নিগ্ধ ও মোলায়েম, দুধসাদারঙ কইতরের পাখনার পরম আয়েশ ঝরেপড়া শব্দে।

- কেমন আছেন?

- বালই আছি নানা। আফনে আছইন নি বালা?

- বেশি ভাল না, আছি একরকম।

- আর কত বালা থাক্-তাইন! বয়স ত আর কম অইলো না, না কিতা?

- তা হইসে। তবে ভাল-খারাপ সবই ত মাওলার ইচ্ছা। কি বলেন?



দুই

এখন আসাদালি নানার বন্ধুদের মাঝে আর বেশি কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। কেবল তাঁকে প্রায়ই চক্কর দিতে দেখা যায় বাজারের এমাথা ওমাথা। হয়তো নিজের বয়সী কাউকে পান না, কিংবা যাদের পান তাদের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেন না বলে একা একাই ঘুরে বেড়ান। তাঁর খুব কাছের বন্ধুরা যাঁরা ছিলেন, প্রায় সবাই একে একে আলিঙ্গন করেছেন মৃত্যুকে; যে দু’একজন বেঁচে আছেন এখনও, তাঁরাও যমদূতের সাথে টানাহেঁচড়ায় ব্যস্ত; কেবলমাত্র তাঁকেই এই ইহজীবন-সংসার-সমাজ পরম আত্মীয়ের মত জাপটে ধরে রেখেছে এখনও। ফলে তিনি স্বইচ্ছা, কিংবা বলতে পারি একরকম ঘোরতর অনিচ্ছাতেই সঙ্গী করেছেন একাকীত্বকে।

আমরা বাজারের রাস্তায় হাঁটতে থাকি হাত ধরাধরি করে আর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। আর দেখি চারদিক থেকে এই অসম বয়সী যুগলের দিকে কত বিস্ময়েই না কেউ কেউ কিংবা অনেকেই তাকিয়ে আছে। ‘আমার বাল্যবন্ধু।’ কারো কারো মুচকি হাসির উত্তরে তিনিও পাল্টা হেসে জবাব দেন। আমি তখন মাথা নাড়াই, একটু হাসি, যেন নানার কথার সায় দেওয়াই এই মুহূর্তে আমার একমাত্র কাজ। ‘চলেন, চা খাই গিয়া’-আসাদালি নানার গম্ভীর স্বরে সম্বিত ফিরে পাই আর তখনই তাড়াতাড়ি ঢুকে যেতে চাই দৃষ্টি লাগোয়া কোনও এক চায়ের স্টলে।

- নানা, আজগা কইলাম চায়ের বিলডা আমি দিমু।

- নাহ। তা হয় না। আফনার চাকরীস্থলে আমি বেড়াইতে গেলে আফনি দিয়েন।

তিনি আমাকে কখনওই চায়ের দাম দিতে দেন না। দিতে গেলেই কোনও না কোনও বাহানায় থামিয়ে দেন। আমিও আর কথা বাড়াই না এ নিয়ে। আমাদের স্টলে ঢুকতে দেখে ভেতরের অনেকেই জায়গা ছেড়ে চলে যায় কিংবা পাশে সরে গিয়ে বসার জায়গা করে দেয়। আসাদালি নানার প্রতি তাদের বিনম্র শ্রদ্ধা দেখে নিজেকেও কেমন যেন শ্রদ্ধেয় শ্রদ্ধেয় লাগে আমার। অনেকে আবার তাঁর এই অযাচিত আগমনে হাতে ধরা আধভাগ কিংবা সিকিভাগ পুড়ে যাওয়া সিগারেট পিষে ফেলে পায়ের নিচে নির্মম মনোকষ্ট নিয়ে। তাদের কারও কারও মুখের কুঁচকানিতে যে অসন্তুষ্টির ছায়া এঁকে যায়, তাও আমার চোখ এড়ায় না।

আমরা গিয়ে বসি স্টলের ভেতর কোনও এক কোণায়। চায়ের সাথে বিস্কিট আসে কয়েক পিস। সদ্য মাজা চকচকে কাঁচের গ্লাসটা পানি ভর্তি হয়ে ঝকঝক করে। আমরা চায়ে ডুবিয়ে বিস্কিট খাই আর একাল সেকালের নানান গল্পে মেতে উঠি। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে আমি আরও কিছুক্ষণ বসতে চাই। মূলত তাঁর বলা গল্প দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করার বায়না খুঁজি। কিন্তু নানা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলেন, ‘চলেন, আমরা বাইর হয়ে যাই। ঠেকে গিয়া বসি। নইলে কাস্টমাররা আসবে না এইখানে। দেখসেন না কেমন ফাঁকা হইয়া গেছে স্টলটা!’ 

আমি দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখি চারদিক। আসাদালি নানাকে দেখে ঠিকই অনেকে চলে গেছে কিংবা কেউ কেউ স্টলে ঢুকেই আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। অনেকে আবার ঢুকছেই না। বেচারা দোকানির ক্রেতা সমাগম বাড়াতে আমাদের বেরোতে হয় স্টল থেকে। আবারও আমরা অসম যুগল হাঁটতে হাঁটতে ফিরতি পথে মধ্য বাজারে ঢুকি। আসাদালি নানার প্রতিদিনের বসার জায়গাটাতে গিয়ে বসি মুখোমুখি। তেল চকচকে, কালসে কতের মত হয়ে যাওয়া খয়েরি রঙের কাঠের চৌকিটায় বসতেই এক পশলা বাতাস ঝাপটা দিয়ে যায় গায়ে। আমাদের এইখানে ঠায় বসিয়ে রেখে বাজারের দক্ষিণ দিকটা সিকি মাইল ভেতরে ঢুকে যায় বাজারি মানুষদের বসতি হয়ে... আর সেদিকে তাকিয়ে আসাদালি নানা রায়টের গল্প পাড়েন... আর আমি ভীষণ উদগ্রীব হয়ে শুনতে থাকি।



তিন


পরিচয়ে আসাদালি নানা হচ্ছেন আমার আব্বার খুব কাছের বন্ধু। আব্বা জীবিতকালে তাঁদের দুইজন এবং আরও অন্যান্য যাঁরা ছিলেন, তাঁদের আড্ডায় অনেকবার যাওয়া আসা হয়েছে আমার, কারণে-অকারণে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে। আব্বার অন্যান্য সব বন্ধুদের কাকা বলে ডাকি। সে মতে তাঁকেও কাকা ডাকার কথা। কিন্তু তিনি আমাদের নানা। এই সম্পর্কের হিসেবটা হল, আসাদালি নানার আপন ভাগ্নি যখন আমার আম্মার বান্ধবী হয়ে উঠেন কলেজ জীবনে আর আসাদালি নানা যখন আম্মার মামা হয়ে যান, তখন, উত্তরকালে আব্বার বন্ধুর চেয়ে আম্মার মামা সম্পর্কটা আমাদের মনে জোরালো এবং স্থায়ী হয়ে বসে। আর আমরা পরবর্তীতে এই সম্পর্কের ভিতের উপর ইমারত রচনা করে করে এগিয়ে যাই। ফলে তিনি হয়ে উঠেন আমাদের নানা। কথাবার্তায় তিনি অসম্ভব মার্জিত। কখনো আমাদের তুমি বা তুই বলে সম্বোধন করেন না। শুধু আমাদেরই যে, তা না, তিনি কাউকেই তুমি/তুই বলেন না। হোক না সে বয়সে অনেক ছোট কিংবা সমান। আর সব সময় আঞ্চলিকতাটা সযত্নে এড়িয়ে গিয়ে বেশ পরিপাটি ও ভাষার শুদ্ধতা বজায় রেখে কথা বলেন। রায়টের ঘটনার রেশ ধরে আমাকে শোনাতে থাকেন...

-দেখেন, এখনকার মানুষ আর আগের মানুষের মধ্যে কত না পার্থক্য ছিল?

আগের বলতে স্বাধীনতার প্রাক্কাল কিংবা তৎপরপর সময়টা কিনা জেনে নিই আমি। এবং স্পষ্টত নিশ্চিত হই, রায়টের ঘটনা পাকিস্তান আমলে ঘটা অর্থাৎ প্রাক স্বাধীনতার সময়কালে।

-এই যে দেখতেসেন ভিটাগুলা, এইগুলা সব ছিল সমীর বাবুর, মানে সমীর রায়চৌধুরীর। তাইনের বাড়িটা ছিল পেছন দিকে মুখ করা।

বলেই আমাকে হাত উঁচিয়ে চিনিয়ে দেন। বিশাল আয়তনের জায়গা, পুকুর জমি-জিরাত সমেত এখন অন্যের দখলে।

-দেখসেন তো?

-জি নানা।

-মস্ত শিক্ষিত আর ভালো লোক ছিলেন এই সমীর বাবু। তখনো আফনাদের নানি আমার ঘরে আসেন নাই। বাজারে আমাদের এই ঘরটা...

বলে আমরা যেখানটায় বসেছি তার লাগোয়া ভিটায় চোখ ফেলেন নানা।

-চিনলেন তো?

-জি, চিনলাম।

-তখন প্রায় রাতেই থাকি এইখানে। সকালে ইউনিয়ন পরিষদে যাই, তখন আমি পরিষদের সেক্রেটারি। সন্ধ্যায় দোকানে ফিরি। সমীর বাবুর সাথে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দেই। সাথে আরও অনেকেই যোগ দেয় আড্ডায়। সেই সময়ে একদিন খবর পাই, ভারত থাইকা একদল মুসলমান রিফুজি আইসে আমাদের এইখানে। ইস্কুল ঘরের মাঠে জড়ো হয় তারা। চেয়ারম্যান সাব এবং এলাকার গণ্যমান্যদের নিয়া আমরা ইউনিয়ন পরিষদে বসি এবং তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নিয়া আলোচনা করি। পরিষদের বারান্দা, বাজারের প্রতিটা দোকানের বারান্দা আর ইস্কুল ঘরের লম্বা বারান্দায় তাদেরকে রাতে থাকতে দেই আর এলাকার বাড়ি বাড়ি গিয়া চাল ডাল তুলে আনি। ডেকচিতে রান্না হয় এবং আপাদত তাদের থাকা-খাওনের সমস্যা ঘুচে।

-আইচ্ছা নানা, কত জনের মত রিফুজি আইসিল?

-সব মিলায়ে প্রায় সাড়ে উনিশশোর কাছাকাছি। কিছু কম বেশি হইতে পারে।

-এরফরে?

বলে সামনের কাহিনী বলার জন্য নানাকে তাড়া দেই।

-একদিন সন্ধ্যায় সমীর বাবুরে ডাকতে তাইনের বাসাতে যাই। ঘরে ঢুকতেই দেখি সমীর বাবু চিন্তিত মনে বইসা আছেন খাটে। তাইনের বৌ আর ছেলে মেয়েরা টলমল চোখে দাঁড়ায়ে আছে। আমারে চেয়ার টাইনা দেয় কেউ একজন। বৌদি কাঁপা কাঁপা গলায় যা বলেন, শুইনা একেবারে স্তব্দ হইয়া যাই। আমার মুখ দিয়া কোন কথা বাইর হয় না, মনে করেন আমি বোবার মত হইয়া যাই। ‘আমি বাঁইচা থাকতে আপনাদের কিচ্ছু হইব না’-বইলাই চৌকাঠের বাইরে পা বাড়াই।

নানার কথা থামে আর চোখের কোণ চিকচিক করে। এই ফাঁকে আমি পাশের স্টলের ছেলেটাকে ডেকে দুইটা চায়ের অর্ডার দিই। নানার জন্য লিপটন টি’প্যাকের লিকার চা। নানা কিছুটা সময় মৌন থেকে দম নেন। কি যেন ভাবেন আর ভাবেন, ভাবতেই থাকেন। হয়তো অতীতের স্মৃতি, হয়তো বর্তমানের সাথে অতীতের সম্বন্ধ। ভাবুন, আমি তাড়া দিই না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করেন...

-তাইনের বাসা থাইকা বাইর হইয়া আমি অন্ধকার বাজারের এই মাথা থাইকা ঐ মাথা খালি পায়চারি করতে থাকি আর ভাবতে থাকি কি করা যায়। প্রায় আধা ঘণ্টা পর, মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়া বাজারের প্রত্যেক হিন্দু ঘরে যাই ঘটনা কতটুকু ছড়াইছে তা জানতে এবং একই কথা শুনি সবার ভিতু ফ্যাকাসে মুখে। ঘটনাটা এরকম...আগামীকাল রাতে নাকি রায়ট হবে বাজারে। হিন্দুদের বাড়ি ঘর লুট করা হবে আর মুসলমান রিফুজিদের থাকার জন্য বাড়িঘরগুলা ঠিক করে দেয়া হবে। একদিনের সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে সব হিন্দুদের, যদি তারা আগামীকালকে দিনের মধ্যে বাড়ি-ঘর ছেড়ে না ভাগে, তাইলে সবাইকে কেটে সোনাই নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হবে। ঘরে ঘরে অভয় দেই। কালকে তো একটা পুরা দিন আছে, তাই না? ‘চিন্তার কিসু নাই’ বলে নিজেও সাহস সঞ্চয় করি। আমরা একটা বিহিত করবই। ‘তাই যেন অয়’-এমন একটা ভয়ার্ত কম্পমান দৃষ্টির সাথে কিছুটা আশ্বস্তি নিয়া ওরা তাকায় আমার দিকে। সে রাতে বাজার ছাড়ি না। ঘুম কি আর আসে? ফজরের নামাজের ওয়াক্তে রাস্তায় নামি। আতঙ্ক যেন না ছড়ায় তাই দু’একজন প্রভাবশালী আর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের জানাই ব্যাপারটা এবং চেপে রাখতে বলি।



চার


নামে-মানুষে কখনো কখনো অদ্ভুত মিলামিলি হয়। নামের সাথে কারো কারো চেহারায় কিংবা দেহে-গড়নে আর স্বভাবে-চরিত্রে আর রঙে-সুরতে মিলে যায় কাকতালীয়ভাবে। আলতা মিয়া যেন আলতারই জলছাপ। লম্বা দোহারা গড়ন, আলতা রং শরীর আর ঘন কালো চুলের ভেতর অদৃশ্য দুর্ধর্ষতা যেন ওঁত পেতে বসে আছে। বাহ্যিক দেখায় কেউ ঠাহরই করতে পারবে না কতটা হিংস্রতা তার বুকে লুকায়িত। সবই আমাদের শোনা। তার দুঃসাহসিক ডাকাতির কাহিনী একেবারে রহস্য গল্পের মত। কত কত জনের গলা যে আলগা করেছে কোপে, তার হিসাব নাকি সে নিজেই জানতো না। অবশ্য এত কিছুর হিসাব রাখলে কি আর ডাকাত সর্দার হওয়া যায়? ভিনদেশে ডাকাতি করতে যেত আলতা মিয়া তার দলবল নিয়ে, কিন্তু এলাকার কারও বাড়িতে কখনওই নাকি বাইরের চোর-ডাকাতদের আছর পরতে দেয়নি তার জীবনকালে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, কেউ নাকি তাকে ডাকাত বলতো না। বলবেই বা কিভাবে? সে তো আর এলাকায় ডাকাতি করতো না, এমনকি এলাকার কারও কোনও ক্ষতিও হতে দেয়নি! তবে সবার মধ্যেই একটা ভয় কাজ করতো তাকে দেখলে। সে ভয়, ভয়েই হোক আর সমীহেই হোক- বলবত থাকতো আলতা মিয়ার সামনে, এমনকি আড়ালেও। এই আলতা মিয়াই রায়টের পুরুধা জেনে নাকি চিন্তা বাড়ে আসাদালি নানাদের। তিনি বলতে থাকেন...

-রাতে যেমন বাড়িতে যাই নাই, পরের দিনেও আর গেলাম না। পরিষদে গিয়া চেয়ারম্যান চাচার অপেক্ষায় বসে থাকলাম সকাল থাইকা। বারোটা নাগাদ চাচা আসলে, বিষয়টা জানাই এবং এটি যে ভয়ঙ্কর সংকটাপন্ন অবস্থার সৃষ্টি করবে বুঝতে পারি দুইজনেই। একটা কিছু সমাধান করতে হবে এই সঙ্কল্পে উঠে আসি আমি আর চাচা চলে যান রিফুজিদের ক্যাম্পে, তাদের দেখভাল করতে। আপানার বিরক্ত লাগতাসে নি?

-না না। কিতা কইন, আমি তো ফুরা ঘটনা হুনতাম চাই?

-তাইলে হুনেন। ঐদিন সন্ধ্যার পরে বাজারের পরিবেশ দেখলাম থমথমা, বিপদের পূর্বলক্ষণ যে, তা বুঝতে পারি। আমি হিন্দুদের সবাইর ঘর ঘুইরা আইসা সমীর বাবুর বাড়ির সামনের ভিটায় দাঁড়াইয়া লইক্ষ্য রাখি চারদিক। দেখলাম,সন্ধ্যা পূজার বাতি জ্বলে নাই সেইদিন কোনও পরিবারেই। বাতাসেও ধূপ-আগরের গন্ধ নাই। ‘তোমরার কোনও ক্ষতি হইতে দেবো না’-বলে যে কথা দিলাম, এই কথার উপর ভরসা কইরা পরিবারগুলা যে বইসা আছে-আল্লার কাছে ফরিয়াদ জানাই, মান যেন রক্ষা হয়।

নানা চুপ হন এখানে। আমি তাকিয়ে থাকি নানার মুখের দিকে। দক্ষিণ দিক থেকে বৈশাখী বাতাসের সাথে তেতে উঠা রোদের আঁচ এসে মুখে লাগে আমাদের। নানার চোখ আর্দ্র। তাঁর ছানি কাটা চোখের কোণে জমে উঠা প্যাঁচরা আমার চোখে যেন ঢুকে পড়ে। ঘোলাটে দৃষ্টি আমার।

-ঐ যে কাদের মিয়ার দোকানডা দেখতেসেন?

-জি নানা।

-এর ঠিক সামনে একটা বিশাল কাডাল গাছ আছিল। গাছটা আফনেরার দেখার কথা না, দেখছেন?

-জি না নানা, দেহি নাই।

-দোকানের বারান্দার টিনের চালা থাইকা বাদলার সময় বৃষ্টির পানি এই কাডাল গাছ গড়ায়া মাটিতে পড়ত। ঐদিন আবার হালকা বৃষ্টি হয়। কাদের মিয়ার দোকানের মাডির দেয়ালে ঠেস দিয়া বাইরের দিকে মুখ করে আলতা মিয়াকে বসা দেইখা শিউরে উডি। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখতে পাই অন্ধকারে এক এক করে গোটা তিরিশজন লোক নাক মুখ বাঁইধা আলতা মিয়ার চারপাশ ঘিরে দাঁড়াতে। সবার হাতে ধরা দেশীয় অস্ত্র-রামদা, ড্যাগার, বল্লম, কিরিচ আরও কত্ত কি! বিদ্যুতের আলোয় হঠাৎ হঠাৎ চিকচিক করে উঠে ওইগুলা। আর আমি আলতা মিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করি সেই আলোতেই। যেহেতু সমীর বাবু এখানকার হিন্দুদের মাঝে সবচেয়ে বিত্তবান এবং সন্মানী, তাদের পরিকল্পনার শুরু এখান থেকেই হবে ভেবে আমি ঠায় দাঁড়ায়ে থাকি আগের জায়গাতে। মাঝে মাঝে একটু নাড়াচাড়া করি। আমার উসখুস ভাব আলতা মিয়ার চোখে পড়ে। দূর থাইক্কাই ডাক দেয়।

-ভাইগ্না, কুস্তা কইবানি কিতা? ইগানো আও।

এবার নানাকে আমি প্রশ্ন করি, 

-আলতা মিয়া কিতা আফনের মামা লাগতো নি কিতা?

-জিয়ইন। আমার দূর সম্পর্কের মামা লাগত। কিন্তু আমারে বড় মানতো তাইনে। আমারে ভেতরে ঢুকতে জায়গা করে দিলে গিয়া দাঁড়াই আলতা মামার সামনে। আমি জিগাই, কোনও কামকাজ আছে মামা?

-হ ভাইগ্না। আওজগা রাইতে রায়ট অইব। সব হিন্দুরারে কাইট্টা সোনাইয়ে ভাসাই দিমু। বাড়ি ঘর লুট করুম। ফরে সব মেরামত কইরা মুসলমান রিফুজিরারে থাকবার লাইগগা জায়গা কইরা দিমু।

একটু সাহস নিয়া বইলাই ফেলি, আফনেরারে কেডা এই কাম করতে কইসে?

-মুসলমান ইসাবে রিফুজি মুসলমান ভাইরার লাইগগা আমরার একটা দায়িত্ব আছে না, না কিতা ভাইগ্না?

-রিফুজিরার দায়িত্ব তো চেয়ারম্যান চাচা আর তাঁর পরিষদরা নিসে, এলাকার গণ্যমান্যরা নিসে। তারাই তো দেখবো ব্যাপারটা!

-এরফরও ভাইগ্না, দায়-দায়িত্ব বইল্লা একটা কথা আছে না, কিতা কও?

-যা ভাল বুঝেন তাই করেন! হিন্দুরারে কাটলে যদি লাভ হয় তাইলে কাটেন! এই কথার পর আলতা মামা একটু চুপ করে থাকে। আমি আরও যোগ করি, আফনেরা তারারে মাইরা-লুট কইরা ভাইগগা যাইবেন। কেইস হইব, পুলিশ আফনেরারে ধরতে না পাইরা আমরারে ধরব, জেলে দিব। ফাঁসি হইব আমরার। হয়, আপনেরা ঠিক কামই করবাইন রায়ট কইরা। আর আমরা মরলে আফনেরার কিতা আইব যাইব? 

-হ ভাইগ্না, কথাডাতো ঠিহই কইস? আগে ত চিন্তা কইরা দেকলাম না বেফারডা। সব ঝামেলা তো তুমরার উফরে দিয়া যাইব?

সবাইরে ডাক দিয়া আলতা মামা বলেন, এই হুন, রায়ট ফায়ট অইত না। যার যার বাইত যাইগগা হগলে। একজন হিন্দুর উফ্রেও কেউ যেমুন আত দিসত না হুনি।

আলতা মিয়ার অর্ডার অমান্য করার সাহস কারো নাকি ছিল না।

-ভাইগ্না, নিশ্চিন্তায় বাইত গিয়া ঘুমাও। আমি ফারা দিমু হারা রাইত।

এরপর আমি এক এক কইরা বাজারের সব ঘরে যাই আর ‘রায়ট হবে না’ কথাটা বইলা তাদের আশ্বস্ত করি। খুশিতে সবার চোখের জল মিশামিশি হয়। সব শেষে সমীর বাবুর ঘরে যাই। সমীর বাবু আমারে গলায় জড়াইয়া ধরেন। এর বছরখানেক বাদে অবশ্য তিনি পরিবার নিয়া আগরতলায় চলে যান।

আসাদালি নানা থামেন। আমি আর কোনও প্রশ্ন করি না। দেখি নানার চোখে জল-ফোঁটা হয়ে লেগে আছে চোখের কোণে। মুক্তো দানা যেন ঝকঝক করছে।

আর আমি তখন ভাবছি, তাঁর সদ্য ছানিকাটা চোখের শুভদৃষ্টিতে দূর হউক সমস্ত কলুষতা। চারদিকে এই দৃষ্টির আজ বড়ই অভাব!


0 comments: