1

প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ পল্লববরন পাল

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


বইবই - মেলাবই
পল্লববরন পাল
 




বই নিয়ে হই চই – উৎসব – প্রদর্শনী – মেলা - ধ্যাৎ, তাও হয় নাকি?

বই কি বারোয়ারি পুজো, নাকি ঢাক-ঢোল-কাঁসি-নৃত্য?

রথমেলার তেলেভাজা নাকি তালপাতার সেপাই?

ধম্মের নাড়ু নাকি নাগরদোলা?

সুরে সুরে রাতভর অনুষ্ঠান নাকি সুর‍রিয়ালিস্ট তৈলচিত্রের সমাবেশ?
কী সব উল্টোপাল্টা বিদঘুটে চিন্তা!

এইরকমই মন্তব্য ছিলো অভিজ্ঞদের - ১৯৭৪ সালে যখন কিছু বাঙালি তরুন গ্রন্থপ্রকাশক কলকাতা কফিহাউসে বসে প্রকাশনাশিল্পের প্রসারের তাগিদে আড্ডা মারতে মারতে বই নিয়ে মেলার কথা ভেবেছিলেন এবং পরবর্তীকালে প্রস্তাব পেশ করেছিলেন কর্তাব্যক্তিদের কাছে। ফলস্বরূপ, ১৯৭৫-এ সুশীল মুখার্জির পৌরোহিত্যে জন্ম নিলো ‘পাবলিশার্স এণ্ড বুকসেলার্স গিল্ড’ – ’৭৬-এর ৫ই মার্চ মাত্র ৫৬টা স্টল নিয়ে ৩৪টা কলকাতার প্রকাশনা সংস্থা একাডেমি অফ ফাইন আর্টস আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাঝখানের চিলতে ঘাসের ওপর সদর্পে পা রাখলো প্রথম ‘কলকাতা পুস্তকমেলা’।

হাঁটি হাঁটি পা পায়ের পরেরটুকু ইতিহাস। আমাদের সকলের জানা। এ বছরে চল্লিশে পা দিলো বইমেলা।

যে মেলা বা উৎসবে হিন্দু-মুসলিম গরু-শুয়োর পায়েস-কেক নারী-পুরুষ প্রাপ্ত-অপ্রাপ্ত ভেদাভেদ নেই, খুন-ধর্ষণ নেই, ঢিসুমঢুসুম রাজনীতি নেই –

যে মেলার কেন্দ্রচরিত্র একমেবাদ্বিতীয়ম - বই।

বই কী?

একজন বা বহুজনের লিখিত ও মুদ্রিত দলিল। এটুকু এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলা যায়। কিন্তু, হঠাৎ লিখবার দরকার হলো কেন? যা বলতে চাই শোনাতে চাই জানাতে চাই একাধিক মানুষকে – তার জন্যই। এ পর্যন্ত আমাদের কাউকেই অযথা হোঁচট খেতে হয়নি। আর, মুদ্রণের দরকার পড়লো সেই কথা আরো অনেক মানুষের কাছে প্রচারের জন্য – যদিও মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার তো সাম্প্রতিক, মাত্র শ’ছয়েক বছর আগে। লেখার শুরু তো হাজার হাজার বছর আগে, সেই প্রস্তরযুগেই, যখন অনুভূতি আদানপ্রদানের মাধ্যম ছিলো একমাত্র পাথরের ওপর পাথরের অস্ত্র দিয়ে আঁকিবুকি কাটা। আঁকা আর লেখা তখন অভিন্নহৃদয়।

লিপি বা বর্ণমালার উদ্ভবের পরে লেখা আর আঁকা দুটি ভিন্ন সত্ত্বার স্বীকৃতি জুটলো, দুজনের মাঝখানে সীমান্তের কাঁটাতারের দেয়াল পড়লো। সে অন্য ইতিহাস। অন্যত্র আলোচিত হবে’খন। পৃথিবীতে যদি মানুষের সংখ্যা সবশুদ্ধ পঞ্চাশ এক’শ বা শ’পাঁচেক হতো, লেখা বা মুদ্রণের কথা হয়তো মাথায়ই আসতোনা কারুর। দরকারও পড়তো না। প্রস্তরযুগের মতো দেয়ালচিত্রেই হয়তো কাজ চলে যেতো। বর্ণমালা বা লিপিরও আবিষ্কার হতো কিনা সন্দেহ। 

বই লিখতে উপকরণ হিসেবে লাগে কাগজ, কলম আর কালি – যদিও ইদানিং এই তিনটের একটাও আর লাগছে না। কম্পিউটারের জানলাই এখন কাগজ,কলম হাতের আঙুল, সে আঙুল দিয়ে কীবোর্ডে টাইপ করেই কালির অক্ষর লেখা হয়ে যাচ্ছে কম্পিউটারের জানলায়। প্রস্তরযুগের পাথরের দেয়ালের বদলে আধুনিকযুগে আমরা জানলায় লিখছি। লেখা পড়া এখন সবকিছুই জানলায়।সভ্যতার বিবর্তন। ভবিষ্যতে আদৌ বই বলে কিছু থাকবে কিনা, সেটাই অধুনা চিন্তার খোরাক। বিস্তর বিতর্ক চলছে। কিন্তু বইয়ের ইতিহাসের পাতা ঘাঁটতে গেলে আপাতত কাগজ কলম আর কালিকে অস্বীকার করার উপায় নেই।



ওসিরিস ঈশ্বরের ছবি - মিশরীয় প্যাপিরাস

লিপির আবিষ্কার সম্ভবত মিশরীয় সভ্যতার আদিযুগে। নীলনদের তীর বরাবর জন্মানো প্যাপিরাস গাছ - সেই গাছের ছাল কেটে, রোদ্দুরে রেখে শুকিয়ে তারপর পাথরের হাতুড়ি পিটিয়ে পিটিয়ে তৈরি হলো পাতলা ব্লক – যার ওপর বাঁশের কঞ্চির একপ্রান্ত ছুঁচলো করে শুরু হলো লেখা ও আঁকা। এইরকম লিখিত ব্লকের প্রান্ত বুনে বুনে নয়তো আঠা দিয়ে সেঁটে একসাথে তৈরি হলো বই। এখন অবধি আবিষ্কৃত পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো বই হলো রাণী নেফারতিতির আমলের হিসেবের বই, আনুমানিক ২৪০০ খৃষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ের।

প্রথম লেখার কালি জন্ম নিলো চীনদেশে খৃষ্টজন্মের প্রায় ২৩০০ বছর আগে।গাছের রস, জন্তুজানোয়ারের চামড়া থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় চৈনিকেরা তৈরি করলো এই কালি। সমসাময়িক কালে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন জনগোষ্ঠী নিজেদের এলাকার গাছগাছালি থেকে নিজেদের সুবিধেমতো কালি বানিয়ে নিতো। তাই দিয়েই লেখালেখির জয়যাত্রা শুরু।

ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের মতে, প্যাপিরাস পদ্ধতির বই ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে দশম খৃষ্টপূর্বাব্দে গ্রীসে নিয়ে আসেন ফিনিশিয়রা – অধুনা লেবানন ইস্রায়েল সিরিয়ার আদি যুগের মানুষেরা – যারা আধুনিক সভ্যতায় শিক্ষিত হয়ে এখন যুদ্ধ মৃত্যু ও ধ্বংসকে জীবনে অগ্রাধিকার দিয়েছে – আড়াই হাজার বছর আগে এত সভ্য ছিলোনা তারা, কাজকম্মোও ছিলো কম, তাই বোধহয় সত্যিকারের সভ্যতার সামগ্রিক বিকাশের কথা ভেবে তারা এক যুগান্তকারী কাজ করে বসলো। বর্ণমালাকে প্রথম সার্বজনীন স্বীকৃতি দিয়ে দিলো। যার ফলে ধীরে ধীরে জন্ম হলো বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর। সমাজে এলো নতুন নতুন জীবিকা - লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন কিছু মানুষ। আর সেইসব লিখিত বইপত্র যাঁরা পড়লেন বা অধ্যয়ন করলেন, তাঁরা সমাজে পণ্ডিত হিসেবে পরিচিত হলেন।



বার্চ গাছের ছালের ওপর খোদিত লিপি (পঞ্চম শতক)

বিভিন্ন দেশের নিজস্ব ভৌগোলিক কারণে প্যাপিরাসের বিভিন্ন বিকল্প মাধ্যমের সৃষ্টি হলো – প্যাপিরাসের বিকল্প হিসেবে এলো পার্চমেন্ট এবং ভেল্লাম – যা মুলত ভেড়া ছাগল গরুর চামড়া থেকে তৈরি। এলো বিভিন্ন গাছের ছাল – বার্চ খেজুর এরকম আরও অনেক। সার্বজনীনতার ফলে বইয়ের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলো।একটা বই থেকে কপি করে একাধিক বই তৈরির দরকার পড়লো। নতুন জীবিকার জন্ম হলো - নকলনবিশ।

জন্ম হলো পাণ্ডুলিপির – মূল লেখকের নিজের হাতের লেখা বই। নকলনবিশেরা সে বইয়ের কপি করে করে পৌঁছে দিলেন আরও অনেক মানুষের কাছে। এই ধারণার প্রকৃত বিকাশ হলো মুদ্রণশিল্পের জন্মের পরে।


ব্রাহ্মীলিপিতে লিখিত প্রাচীন পুঁথি 

ভারতবর্ষে হিমালয় পাদদেশে অফুরন্ত বার্চ গাছের ছালের ওপরে লেখা বইয়ের তথ্য আমরা সুশ্রুত (তৃতীয় শতাব্দী) কালিদাস (চতুর্থ শতাব্দী) বরাহমিহির(পঞ্চম শতাব্দী) প্রমুখ মনিষীদের লেখা থেকে জানতে পারি। প্রথম শতাব্দী নাগাদ ব্রাহ্মীলিপিতে লিখিত বৌদ্ধযুগীয় এরকম অসংখ্য পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয়েছে তক্ষশীলায়। প্রায় তিন হাজার এরকম পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে বর্তমান আফগানিস্তানের বামিয়ান গুম্ফায়। তৎকালীন ছোটো ছোটো মঠগুলির ক্ষমতা অনুযায়ী এরকম কম বেশি কয়েকশো করে পুঁথি ছিল নিজেদের।মধ্যযুগের মঠগুলির কারো কারো হাতে ৫০০ থেকে ২০০০টি পুঁথি ছিলো – এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এ সবই মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের আগের ঘটনা। 

আধুনিক সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার মুদ্রণযন্ত্র। তার অনেক আগেই,সম্ভবত খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে চীনদেশ করে ফেলেছে কাগজ ও কালির আবিষ্কার,যদিও প্রথম কাগজ তৈরির কারখানা নির্মাণ করতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ত্রয়োদশ শতক অবধি। আর ১৪৪০ সালে জোহানেস গুটেনবার্গ ইউরোপে নিয়ে এলেন প্রথম মুদ্রণযন্ত্র, অবশ্য তার আগে ১৩৭৭ সালেই চীনে এসে গেছে পোড়ামাটির ব্লক দিয়ে মুদ্রণের পদ্ধতি। রেনেসাঁযুগে ইউরোপে এই মুদ্রণযন্ত্রের প্রসার হলো বিপুল। শিল্পবিপ্লব এই পদ্ধতিকে করে দিলো সাধারণ মানুষের কাছে আরও সহজলভ্য। কাগজ কালির ব্যাপক উৎপাদনের ফলে খরচ কমে গেলো, মুদ্রণমূল্যও কমে গেলো যন্ত্রের বিপুল ক্ষমতায়।

ব্যস! পরবর্তী কয়েক শতকে বইয়ের বিবর্তনের ইতিহাস আমরা সবাই কমবেশি জানি। উৎপাদন বাড়ার ফলে বই নিজেই একটা বিপুল সম্ভাবনাসমৃদ্ধ আস্ত শিল্প হয়ে উঠলো। গজিয়ে উঠলো প্রকাশনা সংস্থা। সাহিত্য শিল্পের নিজস্ব তাগিদে বাজারে এসে গেলো সাময়িক ম্যাগাজিন বা পত্রিকা। অষ্টাদশ শতকে এই ধরনের সাহিত্যপত্রিকা বিপুল জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। বই চলে এলো ঘরে ঘরে।

বই নিয়ে হইচইয়ের সেই শুরু।

অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ইউরোপে শুরু হলো শিল্পমেলা, যেখানে প্রদর্শিত হতে শুরু হলো নতুন নতুন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নিদর্শন। বই নিয়ে মেলার শুরু স্থানীয় স্তরে শুরু হয়েছে প্রায় পাঁচশো বছর আগেই, যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৪৯ সালে ফ্র্যাঙ্কফুর্টের সেন্ট পল চার্চে আয়োজিত মেলাই প্রথম আধুনিক আন্তর্জাতিক বইমেলা হিসেবে স্বীকৃত।

বইয়ের আবিষ্কারক কে? – আমি জানিনা।

মেলার ভাবনা কার মস্তিষ্কপ্রসূত? – আমি জানিনা।

যেটুকু জানি, সেটা হলো – শ্রী সুশীল মুখার্জী ও তার দলবলের গোঁয়ার্তুমি থেকে জন্ম নিয়েছিলো আমাদের বাংলার বইমেলা, যা আজ শুধু কলকাতায় নয়, ছড়িয়ে পড়েছে জেলায় জেলায়, স্থানীয় স্তরে।

দুর্জনেরা বলে – ইদানিং ঘরে ঘরে নাকি অস্ত্রশিল্প প্রসার লাভ করেছে আমাদের বাংলায়। প্রসার ঘটুক অস্ত্রশিল্পের – বই হয়ে উঠুক আমাদের সার্বজনীন অস্ত্র হাতিয়ার।

আসন্ন বইমেলায় এটাই হোক আমাদের শপথ।


1 comment:

  1. "এখন অবধি আবিষ্কৃত পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো বই হলো রাজা নেফারতিতির আমলের হিসেবের বই, আনুমানিক ২৪০০ খৃষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ের।"

    "রাজা" নেফারতিতি ?

    ReplyDelete