প্রবন্ধঃ বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধপ্রবন্ধ
গম্ভীর সিং মুড়া – ছো নৃত্যের চিরকালীন সম্রাট
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
এক বৃত্ত থেকে আরেক বৃত্তের দিকে এগিয়ে চলে সময়। আমরা তার ছায়া দেখি। দীর্ঘস্থায়ী রূপ ও রঙ দেখি। আর দেখি সময় পেরিয়ে আসা মানুষের হিরন্ময় ছবি। তাঁদের কাজ এবং চিন্তার সমাকলন।প্রণত হই। উৎসাহিত হই। পদ্মশ্রী গম্ভীর সিং মুড়া একজন বিশ্ববন্দিত ব্যক্তিত্ব। ছো নাচকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি, জনপ্রিয় করেছেন। পিছিয়ে পড়া পুরুলিয়া জেলার মানুষ আমরা।আমাদের লড়াইগুলি যখন আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় সমীহ আদায় করে নেয়, খুব সঙ্গত কারণেই আমাদের শিরদাঁড়া আরও ঋজু হয়ে ওঠে, টানটান হয়ে ওঠে। গম্ভীর সিং মুড়া নামটি তাই আমার কাছে শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির নাম নয়, অবহেলা এবং উপেক্ষার উত্তরে এক শীর্ষস্পর্শী স্পর্ধা। এক আপোষহীন লড়াই-এর চিরস্থায়ী যুদ্ধক্ষেত্র।
সোনার চামচ মুখে দিয়ে তাঁর জন্ম হয়নি। ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ ভারতবর্ষের মানভূম জেলার অন্তর্গত(অধুনা পুরুলিয়া জেলার বাঘমুণ্ডি থানার) অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে বামনী গ্রামের টোলা পিটিদিরিতে মামাঘরে তার জন্ম। বাবা জিপা সিং মুড়া, মা ফুলমনি। নুন আনতে পান্তা ফুরায়, এমনই হতদরিদ্র পরিবার। এই দুঃখ এবং দারিদ্রের জীবনেও বাজ পড়ে। বাবাকে শৈশবেই হারান গম্ভীর। তখনও তিনি গম্ভীর হয়ে ওঠেন নি। বাবু সিং নামেই ডাকত সবাই। আর এই পিতৃবিয়োগ তাঁকে যেন আড়াই বছর বয়সেই অনেক সাবালক করে তুলল। মায়ের ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে থাকত অবিরাম। কিছু ভাবত। কী সেই ভাবনা? হয়তো এক সংকল্প। চোখের জল মুছে ফেলার অঙ্গীকার। মামাবাড়িতে ৪/৫ বছর থাকার পর ফিরে আসেন পৈতৃক ভিটা চড়িদা গাঁয়ে। ভিখ মেগে কোন রকমে দিন গুজরান করে ফুলমনি। কষ্টে সৃষ্টে দিন চলে। পড়াশোনা এখানে তাই বিলাসিতা। মায়ের অভাব দূর করার জন্য গরু বাগালির কাজ আরম্ভ করে বাবু। এতে সংসারে অন্নের অভাব আংশিক দূর হয়। আর গোরু চরাতে চরাতেই প্রকৃতির পাঠশালায় শুরু হয়ে যায় একজন যুগ বিজয়ী মানুষের অন্তরের শিক্ষা। নিজের ছো শিক্ষা বিষয়ে তার নিজের কথাগুলিই এখানে তুলে ধরছি – ‘‘আমার কনহ গুরু টুরু নাই আইজ্ঞা।বনের পশু পাখিই আমার মাস্টর। উয়াদের দিকে ভাইল্যে থাকতি দিন রাইত। আর দেইখে দেইখে মনের ভিতর তুইলে রাখতি উয়াদের চাইলচলন। আর ছিল একট কাল রঙের ভিড়কা গরু, উ শিং উঁচায়ে দমে লাফ ঝাপ কইরত। লেতাড়ে আইসত। আমিও উয়ার সংগে লাফ ঝাপ দিথি। উলফা দিতি। এমনি করেই আমার ছো লাচের হাতেখড়ি।’’
পাহাড়ের কোল ঘেঁষা এক বন্য প্রকৃতির মধ্যেই কাটে বাবুর শৈশব। ফলে বিভিন্ন জন্তু জানোয়ারের সাথে তার পরিচয় হয় শিশুকালেই। তাদের বিভিন্ন সময়ের নানান ভঙ্গিমাগুলিকে নিজের মনের ভেতর এঁকে রেখেছেন সযত্নে। নিজেকে মানভুইয়া বলে পরিচয় দিতে অত্যন্ত গর্ব বোধ করতেন তিনি। অত্যন্ত বিনম্র মনের মানুষ ছিলেন , বারবার বলতেন - ‘‘আমাকে ক্যা চিনত আইজ্ঞা, ভাগ্যিস মহম্মদ আমাকে ধইরে লিয়ে গেছিল রাজ দরবারে।’’ সেই সময় ক্ষেত্রমোহন সিং ছিলেন বাঘমুণ্ডির রাজা। তিনি ছিলেন সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। নাচ গান বাজনা নিয়ে তুমুল আগ্রহও ছিল। প্রতি বছর ছো নাচের আসর বসাতেন। সেবার নানা জায়গা থেকে ছো নাচের দলএ সেছে । মেতে উঠেছে আসর।মহিষাসুরের সাজপোশাকে মঞ্চে প্রবেশ করলেন এক কম বয়সী শিল্পী। উলফা দিয়ে মাতিয়ে দিলেন আসর। সবার মুখে একটাই প্রশ্ন – ‘‘বোলতার মত ঘুরপাক খাচ্ছে, লকটা কে বটেক হে? ইয়ার আগে কুথাও ত লাইচতে দেখি নাই!’’ রাজার পার্ষদ মহম্মদ খাঁ ততক্ষনে সবার সামনে তুলে ধরেছে তার পরিচয় – ‘‘ইয়ার নাম গইমরা, জিপার ব্যাটা বটেক, লাচ উয়ার রক্তে।’’ তখন তাঁর ১৩- ১৪ বছর বয়স। ‘বাঘের ছিলা বাঘ’ - এই নামে তাকে অভিহিত করে রানী এক ভাঁড় মিষ্টি আর উনিশ টাকা আর্থিক পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন তাঁর হাতে।
সেই শুরু। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। যেখানেই গেছেন মুগ্ধ করেছেন দর্শকদের।একসময় তাঁর নাচের প্রদর্শনী নিয়ে একটাই প্রবাদবাক্য ছড়িয়ে পড়েছিল সারা মানভুমে – ‘‘গম্ভীর সিং লাইচ্ছে মানেই মাচা ভাইংছে। ’’
ছো নাচ সম্পর্কে যাঁদের সামান্যতম কৌতূহল আছে, এর পরের ইতিহাস তাঁরা কমবেশি জানেন।১৯৬৮ সালে পুরুলিয়ার মাঠা রেঞ্জ অফিসের সামনে যে নৃত্য প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল,সেখানে উপস্থিত ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি গবেষক ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য এবং ফ্রান্স থেকে আগতা শ্রদ্ধেয়া মেলিনা সলভেনি। গম্ভীর সিং-এর নজরকাড়া নৃত্য পারদর্শিতা তাঁদের মুগ্ধ করে। আশুতোষ বাবু মুগ্ধ হয়ে বলেন – ‘‘আমি যেন এরকমই প্রতিভাবান শিল্পীর খোঁজ করছিলাম।’’ ১৯৬৯ সালে এশিয়ান মেলায় তিনি গম্ভীর সিং এর দলকে দিল্লী নিয়ে যান।দিল্লীর সেই মেলা প্রসঙ্গে গম্ভীর সিং মুড়া লোক সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ সৃষ্টিধর মাহাতকে কি বলেছিলেন তা উদ্ধৃত করা যাক – ‘‘সেরাইকেল্লা, মণিপুরের দল এমন লাচ কইরে দেখাল্য, সে আর কি বইলব?লাচ দেইখ্যে আশুবাবু চুপ। ভয়ে কাঠকাপাস। মুহে রা সইরছে নাই। আমি বইললম, আমাকে কিছু বইলবেন নাই। আপনাদের কথা শুইনব নাই। আসরে ঢুকেই ২১ বার ভোল্ট দিয়ে যখন দাঁড়ালি চড় চড় কইরে, চাইরদিকে শুধু হাততালি আর হাততালি।’’
এই আত্মবিশ্বাস অর্জনের পর সারা পৃথিবীর সামনে খুলে যেতে থাকে তাঁর নতুন দিগন্ত। ১৯৭১ সালে ইন্দোনেশিয়া মাতিয়ে আসেন তিনি। ১৯৭২ সালে ফ্রান্সের প্যারিস, এরপর হল্যান্ড, স্পেন,আমেরিকা মহাদেশ। ১৯৭৬ সালে আবার প্যারিস। এরপর একের পর এক নিজের ছো নৃত্যের জয়যাত্রার স্বাক্ষর রাখেন লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, লস এঞ্জেলস, ওয়াশিংটন ডি সি প্রভৃতি জায়গায়।বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে আমাদের জেলার সংস্কৃতিকে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। শুধু পৌঁছে দেওয়া নয়।মন মাতিয়ে দিয়েছেন সারা দুনিয়ার। পুরুলিয়ার ছো নাচকে যারা অখ্যাত এবং চুয়াড় নাচ বলে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করত, তাদের তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন পারদর্শিতা থাকলে কোন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায় এই গরিমা।
১৯৮১ সালের ২৬শে জানুয়ারী তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডির হাত থেকে পদ্মশ্রী পুরস্কার পান পুরুলিয়ার এই কৃতি মানুষটি। মানভূম গৌরব গম্ভীর সিং মুড়া নয়, এই স্বীকৃতি যেন সারা জেলার। জেলার প্রথম পদ্মশ্রী পাওয়া মানুষটির মধ্যে তবু প্রাণময় সরলতা।
১৯৮২ সালে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার পেলেন গম্ভীর সিং মুড়া। জেলাকে গর্বিত করলেন আবার। তুলে ধরলেন ছো নাচের দিগন্তবিস্তারী উন্মাদনা। যতদিন পুরুলিয়া থাকবে, ততদিন অমর উজ্জ্বল হয়ে থাকবে এই মহৎ মানুষটির নাম।
আজীবন দারিদ্রের সাথে লড়াই করেছেন তিনি। সহজ সরল অনাড়ম্বর মানুষটি গামছা পরেই কাটিয়েছেন জীবনের বেশিরভাগ সময়। আজ দেখি মানভূমের সংস্কৃতিকে বিকৃত করে চটুলতা এবং অশ্লীলতা আমদানি করে সস্তা গানে আসর মাতিয়ে কিছু গায়ক সহজেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন এবং রাতারাতি অর্থবান হয়ে উঠছেন। এঁরা লোকসংস্কৃতির দরদী শিল্পী সাজার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মাটি এবং প্রান্তিক মানুষের সাথে এঁদের কোন সংযোগ নেই। এঁরা বেনিয়া এবং মুনাফালোভী।
গম্ভীর সিং মুড়ার সাথে আমার প্রত্যক্ষ সংযোগ তৈরি হয়নি, দূর থেকে দু এক বার দেখা ছাড়া। বাবার কাছে তাঁর গল্প শুনতাম। বাবার কাছে তিনি একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন – ‘‘এতসব কইরে আর কনহই হইল্য নাই বাবু, পদ্মশ্রী পাইয়েও প্যাট ভইরল নাই, পলাশের সেই তিন পাত। যেমন ছিলি তেমনই রয়্যে গেলম। ছেড়া কাপড়, ভাঙ্গা খাইট, ঘরের চালে পুয়াল নাই। নাম দেদার হইল্য, ফটঅ খিচল্য কাগজওয়ালারা, কিন্তুক পেটের ভুখ ত আর ঘুচল্য নাই। ই মেডেলগুলা কি ভাতকাপড় দিতে পাইরবেক?’’
অভাব আর অনটনের সাথে লড়াই করতে গিয়ে রাষ্ট্রপতির দেওয়া পুরস্কারও বিক্রি করেছেন তিনি। তবু নীতি থেকে আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি কখনও।
২০০২ সালের ১০ নভেম্বর বুক ভরতি অভিমান নিয়ে চলে গেলেন মানভূম গৌরব ছো সম্রাট গম্ভীর সিং মুড়া। কলকাতা থেকে চোখের ছানি অপারেশন করিয়ে ফিরছিলেন তিনি। হাওড়া চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জারের মধ্যে আনাড়া ষ্টেশনে হৃদস্পন্দন থেমে যায় তাঁর। ১৩ বছর কেটে গেছে, তবু আজও মানুষের দিগন্ত বিজয়ের গল্প বলতে গেলে তাঁর উদাহরণই মনে আসবে সবার। যতদিন ছো বেঁচে থাকবে, যতদিন মানুষের সংগ্রামের কাহিনী লেখা হবে, ততদিন তিনি বেঁচে থাকবেন।
kichu kichui jantum na .... lekhok ke dhonnobad ... ai ovimani shilpir sathe alap korabar jonnye
ReplyDelete