0

ছোটগল্পঃ ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ছোটগল্প


অভিজাত
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়



বিকেলবেলা রায়বাড়ির ধোয়া-মোছা ঝকঝকে শান বাঁধানো রোয়াকে বসে গুলতানি করছিল ঝোকনরা। রোয়াকে বসে আড্ডা দিলেও মেয়েদের দেখে সিটি মারা, অভব্য আচরণ, অঙ্গভঙ্গি এসব এই রোয়াকে চলেনা। চলে তো নাইই, চলার ছাড়ও নেই। মেয়েদের নিয়ে আড্ডা মারতে হয়, অন্য জায়গায় যাও, এখানে নয়। তবে, মাঝে মাঝে সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে যে আলোচনা হয় না, তা নয়, কিন্তু ওইটুকুই। পাড়ার কিংবা বে-পাড়ার মেয়েদের দেখে উস্‌খুশ করা, মন্তব্য ছোঁড়া, এসব করলে এই রোয়াকে তার জায়গা নেই, এই আড্ডার এখানেই পরিসমাপ্তি।

রায়বাড়িটা বিলুর জ্যাঠামশাইয়ের। পরপর তিনটে বাড়িই রায়বাড়ি। বিলুর বাবা, জ্যাঠা আর কাকার বাড়ি। কিন্তু এ তল্লাটে রায়বাড়ি বলতে সকলে বিলুর জ্যাঠামশাইয়ের বাড়িটাকেই মনে করে। বিলুর বাবা, কাকা পাশের জায়গায়, যেটা একসময় তাঁদের ফলের বাগান ছিল, সেখানে বাড়ি করে উঠে গেছেন। জ্যাঠামশাই রয়ে গেছেন সেই সাবেকী বাড়িতেই। পুরনো আমল থেকেই সকলে রায়বাড়ি বলতে এই বাড়িটাকেই জানে বলে আজও রায়বাড়ি মানে জ্যাঠামশাইয়ের পুরনো বাড়ি। বিলুদের বাড়িতে বা কাকার বাড়িতে এইরকম রোয়াক নেই, বাবা কিংবা কাকা কোন রোয়াক রাখেননি। কিন্তু জ্যাঠামশাই পুরনো বাড়ীটা একইভাবে রেখে দিয়েছেন বলে পুরনো দিনের রোয়াকটাও রয়ে গেছে। জ্যাঠামশাই নিজে রোয়াকে বসে গল্প করা কোনদিনই পছন্দ করতেন না, আজও করেন না। কিন্তু বিলু শুনেছে, দাদু, দাদুর বাবা, তাঁর বাবা সকলে রোয়াকে বসে গল্প করতেন। আসা-যাওয়ার পথে অনেকের সঙ্গে দেখা হত,গল্প হত। জ্যাঠামশাই নিজে রোয়াকে বসেন না, কিন্তু কাজের মেয়েটিকে নির্দেশ দেওয়া আছে, রোয়াক যেন দুবেলা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার থাকে। হাজার হোক, রায়বাড়ির মান-ইজ্জত তো আছে! বিলুরা তাতে স্বর্গ পেয়েছে হাতে।



(২)

সেদিন তখন বিকেল পাঁচটা। নানু আর ঝোকন সবে এসেছে। ঋজু পাশেই বিলুদের বাড়ি গেছে বিলুকে ডাকতে। ফিরে আসার সময় ওদের বাড়ি থেকে বড় ক্যারম বোর্ডটাও নিয়ে আসবে দুজনে মিলে। বড় ম্যাচ খেলার ক্যারম বোর্ড এখানে একমাত্র বিলুদের বাড়িতেই আছে। গতকাল সীতাংশু, মানে সীতুদাই বলেছে, চুপ করে বসে না থেকে একটু ক্যারম-ট্যারম খেললেও তো পারিস্‌! কালুদা, বিলুর দাদা দারুণ ক্যারম খেলে। কালুদা সীতুদাদের বন্ধু। এখানে স্কুলে সব একসঙ্গে পড়াশোনা করেছে সেই ছোটবেলা থেকে। না,সীতুদা মনে হয় আরো একটু বড়। এখানকার ছেলেছোকরাদের মধ্যে সীতুদাই বড়। ঝোকন নাম দিয়েছে—বৃদ্ধ সেনাপতি। তা সীতুদা বৃদ্ধ না হোক, সেনাপতি বটে। আড্ডার সব কাজে সীতুদা নাহলে চলে না, তাকে চাইই চাই। কালুদা এখন এখানে থাকে না, মহীশূরে চাকরি করে। বছরে একবার পুজোর সময় কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে আসে। কয়েকটা দিন পুজো দেখে, হইচই করে, গল্পগুজবে কাটিয়ে দিয়ে আবার চলে যায়। কালুদা যখন আসে তখন কালুদাদের সব পুরনো বন্ধুরাই এখানে আসে আড্ডা দেবার জন্য। গালগল্প, চা, চপ-মুড়ি, রায়বাড়ি থেকে এটা-সেটা...। বেশ লাগে তখন। হই হই করে কেটে যায় দিনগুলো। কালুদা চলে গেলে আরো কয়েকদিন কাটে সেসব গল্প করে, তারপর আবার সেই...চুপচাপ...। তবু রোজ বিকেলে রায়বাড়ির রোয়াকে এসে একবার করে বসাটা যেন ওদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। না এলে কেমন যেন লাগে!

বিলু আর ঋজু ক্যারম বোর্ডটা ধরাধরি করে বাড়ির বাইরে নিয়ে এসে দেখতে পেল, রায়বাড়ির রোয়াকে তাপস এসেছে আর কাকার বাড়ির বাইরের ফটকে শ্যামল দাঁড়িয়ে। শ্যামল বিলুর কাকার একমাত্র ছেলে, ডাক নাম লালু, কালু আর বিলুর সঙ্গে মিলিয়ে। সে বাইরের হোস্টেলে থাকে, ইঞ্জিনীয়ারীং পড়ে। বিলুকে দেখে এগিয়ে এল।

–আমাকে বললি না কেন ছোড়দা...দে, আমিও ধরি, এত ভারি বোর্ডটা...ঋজুর দিকে তাকিয়ে অল্প একটু হেসে বিলুকে বলল লালু।

বিলু মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব এনে বলল – ভারিতো! তারপর শ্যামলের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল–কখনএলি? ছোটমা বলছিল, তুই নাকি রূপুর বাড়ি হয়ে আসবি, তাই?

রূপু এবাড়ির একমাত্র মেয়ে, লালুর দিদি। তার জ্যাঠা, বাবা, কাকাদের ঐ একটিমাত্র মেয়ে। বিলুরা চারভাই সবমিলিয়ে। জ্যাঠামশাইয়ের নিজের কোনও সন্তান নেই। বড়মায়ের কোন এক আত্মীয়ের ছেলেকেই নিজের করে নিয়েছিলেন, ওরা তাকে বড়দা বলে, বাড়িতে সকলে ডাকে হাবলু। বিলুরা নিজেরা দুভাই আর কাকার এক ছেলে লালু। জ্যাঠামশাই বড়দাকে মানুষ করেছেন, বিয়ে দিয়েছিলেন। এমন জাঁকজমকের বিয়ে এখানে অনেকদিন কেউ দেখেনি। বড়দা নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন। জ্যাঠামশাই পুরনো দিনের মানুষ, মনে দুঃখ পেয়েছিলেন, কিন্তু মেনে নিয়েছিলেন, ছেলের বিয়েতে কোন কার্পণ্য করেননি। একবছর যেতে না যেতেই বড়দার সঙ্গে বৌদির ছাড়াছাড়ি। বড়দা সেই যে বিদেশে চলে গেলেন, আর আসেন নি। জ্যাঠামশাইও আর দুজনের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখেননি। পরে শোনা গেছিল, বৌদি নাকি বিবাহিতা ছিলেন, লুকিয়ে বড়দাকে বিয়ে করেছিলেন। একি করে সম্ভব, বিলু আজও বোঝেনি। কালু তখন স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্র হলেও বিলু, লালু ছোট, রূপু তো আরো ছোট। এসব কথা এখানে সকলেই জানে, যদিও মুখে কিছু বলে না, কিন্তু পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে এটা যে বেশ মুখরোচক ঘটনা, সেটা বিলু জানে। বাড়ির একমাত্র মেয়েটিকে নিয়েও অনেক ঘটনা...কিন্তু সেই নিয়ে কেউ সামনে বলতে পারে না, তার কারণ জ্যাঠামশাই, রায়বাড়ির শক্ত পাঁচিল।

বিলু আবার বললে–কই, বললি না, গেছিলি?

লালু একবার ঋজুর দিকে তাকাল। ঋজু দুভাইয়ের কথা শুনেই ক্যারম বোর্ডটা ওদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে রোয়াকে চলে এলো। ওদের দু ভাইয়ের পারিবারিক কথাবার্তার মধ্যে আবার সে কেন, তাই চলে এল ঋজু। বিলু আবার বলল লালুকে–ওবাড়িতে বড়মা কিন্তু অসুস্থ, দেখা করে এসে বসিস, আমাকেও দরকার হলে ডাকিস। সকালে গেছিলাম যদিও...

লালু বিলুর দিকে তাকিয়ে বলল–দিদিয়া খুব কাঁদছিল রে...মা’ও শুনে... 

বিলু উত্তর দিল না। আবার বলল লালু–ছোড়দা, তুই নাকি গিয়েছিলি?’

–হুঁ...কাউকে বলার দরকার নেই...গম্ভীর মুখে বলল বিলু।

রোয়াকে দু ভাই মিলে ক্যারমটা এনে দেখল সীতুদাও হাজির। সীতু বলল–এত দেরি করলি, আর কতক্ষণ খেলবি? লালু সকলের দিকে একবার দেখে নিয়ে বলল–সীতুদা, আমি একবার ওবাড়িতে চট্‌ করে দেখাটা করে আসি, আসছি এক্ষুণি।

ঝোকন হঠাৎ বিরক্তির সুরে বলে উঠল–বোস্‌ তো! কার্টসি! পারিসও তোরা। এখনও এসব মেইনটেইন করিস...? পরে যাস্‌...

–তো, তোদের মত সকলেই হনু নাকি? বলে উঠল সীতু। –বাড়ির ছেলে বাড়িতে এসে বড়দের সঙ্গে দেখা করবে না, কার্টসি আবার কি! এই জন্যই আজকালকার ছেলেগুলো সব এক একটি রত্ন তৈরি হচ্ছে...কোনও মানামানি নেই...বলেই লালুর দিকে ফিরে বলল–যা, ঘুরে আয়, আমরা আছি এখন।

–বাড়ি দেখাচ্ছে, তাও যদি সব না জানা থাকত, তুমি আর বেশী বোলো না তো, সীতুদা! একটু রাগে, দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল ঝোকন–ধামাচাপা দিক আর যাই করুক, জানাজানি কি হয়নি? এদের বাড়ির ঘটনা কে না জানে! এককালে কি ছিল, তাই নিয়ে সব ধুয়ে খাচ্ছে। অতই যদি মান্যগণ্য, ভাইয়েরা আলাদা হল কেন? বাড়ির মেয়ে তাহলে বাইরে যায় কি করে? বলুক তো, কোন শালা জানে না? মুখে যত ভড়ং...রায়বাড়ির মেয়ে...রায়বাড়ির মেয়ের যদি অতই সম্মান, তাহলে ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রিকে বিয়ে করে...কথা শেষ করার আগেই গর্জে উঠল সীতু–চুপ্‌... একটা কথাও নয়!

বিলু, নানু, তাপস, ঋজু সকলে মিলে কথা বলছিল, এদিকে কান দেয়নি, সীতুর কথায় চমকে তাকাল।

–মিথ্যে তো বলিনি, তুমিই বল না...সীতুদা, একটা কথাও মিথ্যে বলেছি...!

সীতাংশু গম্ভীর মুখে তাকাল, তাকিয়েই রইল। ঝোকন ঘাবড়াল না। কিছু একটা বলতে গেল, সীতাংশু বলে উঠল–হয় আমায় এখান থেকে চলে যেতে হবে, নইলে কাউকে কাউকে চলে যেতে হবে...

–তুমি আমায় মীন করলে সীতুদা...বলে উঠল ঝোকন।

–তুই বুঝেও জিজ্ঞেস করছিস...

–তোমার গায়ে লাগছে কেন...?

–কারণ, তুই যেখানে বসে আছিস, সেখানে বসেও ওদের নিয়েই নোংরামি করছিস....

–এটা লালু-বিলুদের বাড়ি নয়, ওর জ্যাঠার বাড়ি...জেদের বশে বলল ঝোকন

–সেটুকু বোঝার মত বুদ্ধি তোর আছে? তাহলে আর এসব বলবি কেন?

চটে গেল ঝোকন। সীতু যে ওর সমবয়সী বন্ধু নয়, অনেক বড়, সেকথা যেন ভুলেই গেছে। ঝোঁকের মাথায় বলে উঠল–তুমি এত কথা বলছ কেন বলত? তোমার গায়ে ফোস্কা পড়ছে কেন? তুমিও কি ইলেকট্রিক মিস্ত্রির আগে বাঁশি বাজিয়েছিলে নাকি? নইলে যা সবাই জানে...তোমার এত...কথা শেষ হবার আগেই চীৎকার করল সীতু–যা চলে যা...বেরো বলছি!

–কেন, তুমি কি প্রেসিডেন্ট নাকি? আমায় কিন্তু অপমান করছ সীতুদা...

–বেরো...নইলে ঘাড় ধরে তুলে দেবো...যা বলছি...বাঁদর কোথাকার! রাগে কাঁপছিল সীতু।–আর আসবি না এখানে, মুখ দেখাস না আমাকে...যা, চলে যা...

ঝোকন আর কিছু বলল না। সীতুর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে রোয়াক থেকে নেমে পায়ে চটি গলাল।

অবাক হয়ে গেছে সকলে। ঠিক কি নিয়ে শুরু হল, তাও বুঝতে পারছে না। বিলু এগিয়ে এসে কাঁধে হাত দিল সীতুর–কি হল সীতুদা, এত রাগারাগি...

সীতাংশু দুহাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছে রোয়াকে, মুখনীচু। লালু ওবাড়ি থেকে এসে দ্যাখে সবাই কেমন চুপ চাপ। সকলের দিকে তাকিয়ে একবার দেখল, তারপর সেও বসে পড়ল রোয়াকের একদিকে।



(৩)

এই ঘটনার পর থেকেই সীতাংশু গম্ভীর, আনমনা। রায়বাড়ির রোয়াক যেন আর জমছে না। হা-হা হাসি ঠাট্টা এসব না হোক, স্বাভাবিক পরিস্থিতিটাও যেন আর নেই। লালু তার হোস্টেলে ফিরে গেছে। ঝোকন আর আসে না। নানু, ঋজু, তাপসও রেগুলার নয়। বিলু কয়েকদিন ধরে নেই। কিছু বলে যায় নি, মনে হয় অফিসের কাজে বাইরে গেছে। সীতাংশু এখান থেকে কিছুটা দূরে এক কারখানার জুনিয়র অফিসার, স্কুটারে যাওয়া আসা করে। কয়েকদিন কাজের ঝামেলায় রাত করে বাড়ি ফিরেছে, ফলে সেও খবর নিতে পারেনি। মোটের উপর রায়বাড়ির রোয়াক এখন ঠিক আগের মত নেই। তবে বাতাসে একটা কথা ভেসে এসেছে, বিলুর দাদা কালুর নাকি বিয়ে। সীতাংশুদের বাড়ির সঙ্গে জ্যাঠামশাইদের পরিবারের ভাব-ভালবাসা, আসা-যাওয়া আছে, সেখানেই সীতাংশুর মা শুনে এসেছেন। বিলুর বাবা নাকি জ্যাঠামশাইয়ের মত নিতে এসেছিলেন, তাঁর অমতে তো এবাড়িতে কারো কিছু হবে না।

সেদিনের পর থেকে অনেক ভেবে দেখেছে সীতাংশু। একদিক দিয়ে দেখতে গেলে ঝোকন সেদিন খুব অন্যায় কিছু বলেনি। যেভাবে বলেছে সেটা খারাপ, কিন্তু কথাগুলো বেঠিক নয়। একসময় জ্যাঠাইমার ইচ্ছে ছিল সীতাংশুর সঙ্গে রূপুর বিয়ে দেবার, সেভাবে কথাটা ওঠেনি। যেটুকু উঠেছিল, তাতে সীতাংশু বয়সে কিছুটা বড়, তাই আর বেশী ভাবা হয়নি। তাছাড়া একমাত্র রাজকন্যার তখন রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ে দেবার চিন্তায় মশগুল সবাই। সীতাংশু সেখানে চুনোপুঁটি। শেষে ঘটনাটা যখন ঘটল, তখন সবার টনক নড়ল। সীতাংশু এখনও বিয়ে করেনি। কিন্তু যে কথাটা সে কাউকে বলতে পারছে না, সেটা হল, কয়েকদিন আগে, যেদিন এখানে ঝোকনের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হল, সেদিন সীতু একটা চিঠি পেয়েছিল রূপুর কাছে থেকে। সীতু নিজেও খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল, কি করবে, কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না। রূপু যে কোনদিন তাকে চিঠি লিখতে পারে, কল্পনাতেও ছিল না। তার ওপরে সেদিন এমন হল, রূপুকে নিয়েই কথাবার্তা, মাথায় চিন্তা ছিল, রাগারাগিটা হয়েই গেল। রূপু লিখেছে, সে ভুল করেছে। বাড়ির লোকের অমতে এমন একটা মানুষকে সে বিয়ে করেছে যে শুধু রায়বাড়ির টাকা চায়, রূপুর টাকা-পয়সা যা ছিল নিয়েছে, আরো চায়। এই নিয়ে গত তিন/চার দিন ধরে কথাকাটাকাটি, রূপুর গায়েও হাত তুলেছে। টাকা ছাড়া আর সে কিছু বোঝে না। জ্যাঠাইমা তাকে সীতাংশু সম্বন্ধে বলেছিলেন, তাই সে জানে তার কথা। সীতাংশু কি পারবে, নিজের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে? ওখানে থাকলে কোনদিন মার খেয়েই হয়ত মরবে। বাড়িতে ফিরে আসার মুখ তার নেই।

কি বলবে সীতাংশু? এও কি সম্ভব? চিঠিটা পাওয়ার পর থেকেই টানাপোড়েনের মধ্যে আছে সে। তবে কি সেও রূপুকে নিয়ে ভাবছে? একবার পালিয়ে বিয়ে করার পর আবার বিয়ে? রায়বাড়ির আভিজাত্যে লাগবেনা, ক্ষমা করবে রায়বাড়ি? আর রূপু এতদিনে তার কথাই বা ভাবল কেন, শুধু জ্যাঠাইমা বলেছিলেন বলে? তখন ভাবতে রায়বাড়ির মানে লেগেছিল, আর এখন? ভাল লাগছে না, কিচ্ছু ভাল লাগছে না...



(৪)

সেদিন বিকেলে রায়বাড়ির রোয়াকে এসে একাই বসেছিল সীতু, বিলু এসে বসল। বিলুকে দেখে বলে উঠল সীতু, –কি রে, না বলে কোথায় গিয়েছিলি? একা একা ভাল লাগে?

–কেন, ওরা সবাই ছিল তো...অন্যদিকে তাকিয়ে বলল বিলু।

তখনও আর কেউ আসেনি। আজকাল সকলে আসেও না। কেউ আসবে কিনা কে জানে! বিলু কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুব ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করল,–সীতুদা, একটা কথা...রূপু তোমাকে কোনও চিঠি দিয়েছে?

চমকে উঠল সীতু। বিলু জানল কি করে? তাহলে কি বিলু ওখানেই গিয়েছিল! কোনও উত্তর দিল না। দূরের সন্ধ্যার আকাশে চেয়ে রইল। সন্ধ্যা নেমে এসেছে, কিন্তু আকাশে তখনও মৃদু লাল আভা ছড়ানো। বিলু আবার বলল–কই, বললে না, সীতুদা?

–তুই ওখানে গিয়েছিলি, রূপোত্তমা বলেছে তোকে? নীচু গলায় প্রশ্ন করল সীতু।

–কে বলেছে? বুঝতে পারল না বিলু।

–রূপোত্তমা...রূপু, ওখানেই তো গিয়েছিলি...বললি...। রূপোত্তমা যে রূপুর ভাল নাম, সেটাই ভুলে গিয়েছিল বিলু। সব ভাইদের ওই একটাই মেয়ে, তায় আবার সুন্দরী। জ্যাঠামশাই আদর করে মেয়ের নাম রেখেছিলেন, রূপোত্তমা। সীতাংশুর দিকে তাকিয়ে ফিস্‌ফিস্‌ করে জিজ্ঞেস করল বিলু–আর কেউ জানে, সীতুদা?’

চোখে চোখে তাকিয়ে রইল সীতাংশু...কি যেন ভাবছে! তারপর চোখ বন্ধ করে দুদিকে মাথা নাড়ল–না।

–তুমি পারবে,সীতুদা?

অবাক চোখে তাকাল সীতু। তারপর মৃদু হাসির সঙ্গে ব্যাঙ্গ মিশিয়ে নিচু গলায় বললে–রায়বাড়ির আভিজাত্য?

–মানিনা...তখনো মানিনি, এখনও মানব না। তুমি জানো না সীতুদা, একমাত্র আমিই যাই রূপুর কাছে। হ্যাঁ,আমি ওখানেই গিয়েছিলাম। বলেছি, চলে আসতে... বলেই সীতুর দিকে তাকিয়ে কাতর গলায় জিজ্ঞাসা করল বিলু,–তুমি পারবে সীতুদা? দয়া করো সীতুদা, নাহয় ওকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাও, মেয়েটা বাঁচবে...

–আবার পালালে রায়বাড়ির গৌরব বাড়বে,বলছিস?

–আমি কিছুই বলছি না সীতুদা, শুধু তুমি পারবে কিনা সেটাই জানতে চাইছি...তোমার কাছে কোনওদিন কিছু চাইনি সীতুদা, আর কিছু চাইব না, তুমি শুধু ওকে নিয়ে যাও...কথাগুলো হাহাকারের মত শোনাল বিলুর।

–আগে ভাবলি না কেন, তাহলে তো ওকে পালাতেই হোত না। নাকি ভেবেছিলি, শুধু রায়বাড়ির আভিজাত্য আছে, আর কারো থাকার দরকার নেই, থাকতে নেই...? বিলুর দিকে চেয়ে বলল সীতু।

চুপ করে আছে বিলু, মাথা নিচু। রূপুর মুখটা মনে পড়ে যাচ্ছে। কেমন হয়ে গেছে মেয়েটা। মুখের দিকে তাকানো যায় না। কি কষ্টেই আছে রূপু...বোনের জন্য দরকার হয় পায়ে ধরবে সীতুর,পায়ে মাথা রেখে পড়ে থাকতেও রাজী। কিছু একটা বলার জন্য মুখ তুলল বিলু। সীতু কাঁধে হাত রাখল। ভারি গলায় বলল–একটু সময় দে। রায়বাড়ির আভিজাত্যে যাতে না লাগে, তার ব্যবস্থাটা অন্তত করতে দে....


সীতাংশুর মুখের দিকে চেয়ে রইল বিলু। চোখে জল এসে পড়ল। আগে কেন কেউ তাকে সীতাংশুর কথা বলেনি!

0 comments: