3

অণুগল্পঃ শৌনক দত্ত

Posted in


অণুগল্প


কথা ছিলো
শৌনক দত্ত 


পানভেলের যে ফ্ল্যাটটির সামনে দিয়ে রাস্তাটি পুনের দিকে চলে গেছে, গল্পটি সেখানেই শুরু হতে পারতো। কিংবা রাতের অন্ধকার সেঁকে যে রোদ ঘুম ঘুম চোখে ব্যস্ত হয়ে ওঠে আর সব নির্জনতা কোলাহলে ডুবে যায়, সেইসব প্রতিশ্রুতি রাতের বিশ্বাসী চোখ হতে পারতো এই লেখা! লেখা কি সব সময় বিশ্বাসী? প্রশ্নের উত্তর নিশ্চুপ থাকে। যদিও ভেতরে ভেতরে কথার পরে কথা ভাঙছে, জুড়ছে। যেখানে সত্যি বলে সত্যিই কিছু নেই, সেখানে বিশ্বাস গৃহপালিত বিড়ালটির মত অলস দুপুরের হাঁড়ি চেটেপুটে খায়। আমচি মুম্বাই কমপ্ল্যান খেয়ে রোজ একটু একটু বড় হয়, চৌপাটি বিচ বালুর কনায় নোনা অভিযোগ লিখে রাখে আর নুনের দাম হুহু করে বেড়ে যায়। অথচ বিস্বাদ জিভ খুঁজে ফেরে নোনতা আস্বাদন দৈনিক অভ্যাসে! বাসু আর সুস্মির জীবন একঘেয়েমি মুছতে মুছতে যেখানে এসে থামে, সেখানে লেখারা নিখোঁজ। বাসুর বড় একা লাগে। তখন সুস্মির ডাইরী খুঁজে বাসুর কলম নিরুদ্দেশ যাত্রায় লেখে একলা বাঁচার উপখ্যান! সে উপখ্যান পড়া হয়না। কিন্তু প্রতিটি মানুষ তার নিজের সাথে লিখে রাখে সেই উপখ্যানের সারকথা - একা! একাকিত্ব তখন পৌষের শেষে, বাতাসের শীতলতায় যে রঙ্গীন বাহারী যাপন, তা নীলকন্যাভাস আকাশে ঘুড়ি জীবন লিখে রাখে আর বাসুর সুস্মি যাপন সুতো কেটে উড়ে যায়, দোল খায়, হাওয়া কেটে কেটে! এইটুকু লিখে সে থামে আর ক্যালেন্ডারের পাতা উড়ে উড়ে যায়। তার চোখে যে বিনিদ্র রাতের অলসতা তাতে চিরহরিৎ গাছের ছায়া এঁকে এঁকে যায় এঁটো সময়। মোবাইল বেজে উঠলে তার ঘোর কাঁচের চুড়ির মতো ভাঙ্গে, মনের মোড়ে তখন লালন গলির সন্ধান করে আর একতারা বাউল জোছনা রাতের মতো গায়, ‘কেন পিরীতি বাড়াইলা রে বন্ধু ছাইড়া যাইবা যদি’...


তার চোখ জুড়ে শৈশব। সেই শৈশব - যেখানে মুম্বাই নেই। আছে রাধাগোবিন্দ মন্দির, চিলাখানা স্কুল, তার পাশে গ্রামীনব্যাংক এবং বেড়ে ওঠা। রাধাগোবিন্দ মন্দির কার জন্য কি সে জানতো না। সে জানতো সেবায়েত নিতাই মানে দুপুরের গরম ভাত, জাতপাতহীন, মানুষ বলতেই স্রষ্টা, ধর্ম মানে নিজেকে জানা। সে জানতো মাটির গন্ধভরা চিলখানায় যে মাটির টালি তৈরী হয় সেই টালিপোড়ানোর মতই জ্ঞানের আলোয় পুড়তে, তবেই ধর্ম বলতে মানুষ চিনবে মানুষ শুধু। তার লিখতে ইচ্ছে করেনা। অথচ লিখতে তাকে হবেই, এইসব ভুলভাল শৈশব লিখতে মন চায় কিন্তু....জানালার মুখ ঢাকা পর্দায়, সরাতে মন চায় না।তবুও পর্দা নাড়িয়ে যে বকুল মুখ উঁকি দেয় তাতে বাতাসের দীর্ঘশ্বাস।মুম্বাইয়ের নোনা বাতাসে আজ উত্তরবঙ্গ উত্তরবঙ্গ গন্ধ। এর আগে বহুবার এমন যে হয়েছে সে জানে। সে জানে সাগর চোখে রেখে বহুবার তার মনে হয়েছে তিস্তা-তোর্ষার কথা। মনে হয়েছে এইসব প্রজাপতি দিন তার নয়, অন্য কারো! আজো তিস্তা-তোর্ষার কথা মনে পড়তেই তার মনে হলো, ঐ দূর থেকে আসা ঢেউগুলোয় একে একে ঘোড়া ছুটিয়ে আসচ্ছে লালন, কবীর আরো অনেকে। রাজপথ জুড়ে তখন ত্রিশূল, মাইকে মাইকে মৌলবাদ। সে মুখে হাতের উপর হাত রেখে হাসি চাপে। টিভিতে দিলবালে শৈশব আঁকে। রুদ্রাক্ষমালা জপা আঙুলের মতন অরিজিত্‍ গাইতেই থাকে রিমোটে বোতামে 'রঙ দে তো মোহে গেরুয়া'। শাহরুখ-কাজল বয়স মুছে ফেলে, আবার ফেরার প্রত্যয়ে। তার আরো জোরে হাসি পায়। ঘরের দেয়ালে ঝুলতে থাকা ফিদা হুসেন রঙের সাথে রঙ মেশাতে থাকে। আর গিরগিটির রঙে অবলীলায় বদলে যায় ধর্ম। তক্ষুনি ঠিক তক্ষুনি আকাশ সংস্কৃতির বোকাবাক্স মাটির গন্ধ বুকে বেজে ওঠে- 'কেউ কোনদিন আমারে তো কথা দিলো না'। তার আর লেখা হয়না, খাতা ভরা আকাশ আর কলমভরা গুজরাট। তার বড় কান্না পায় আষাঢ় শ্রাবণ কান্না...

3 comments:

  1. সেবায়েত নিতাই মানে দুপুরের গরম ভাত,লেখাটির আত্মা এখানে।কাব্যিক মেজাজ প্রথম থেকে শেষ অবধি রয়েছে ।বিষেশত যে দেখেছে বর্ষার শেয়াদ্রি পাহারের রুপ, পেন পানভিল থেকে আরো এগিয়ে আলিবাগ কি মুরুত জঞ্জিরা অথবা মাথেরনের আঝোর ধারায় নাইতে গেলে যে ছন্দ পায় যুগল ভুরু। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন “বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব ধান।সেখানে নিতাই যেন আসতে গিয়েও গল্পে যায়গা পায় না কাব্যের অফুরান বেগে। গল্পের পরিণতির পক্ষে তা বাঁধা পেয়েছে।দেশ ও বিগত কাল থেকে চ্যুত মানুষের কিছু স্বাভাবিক বিপন্নতা থাকে।কিন্তু গল্পের তো আরো কিছু বলারও ছিল।সেটা কোথায় যেন বলা গেল না।বস্তুত ধর্মীয় মৌলবাদের অবস্থান ও প্রকরণটা আরো বিস্তার পেতে গিয়েও পেলনা। অনুগল্প তাই এরকম হতে হবে সেটা কি খুব যুক্তির? আসলে অনেক বিষয় যা বিস্তার পাওয়ার পরিসর পাবে না তাদের উল্লেখ করাটাই খুব সমস্যার। মুম্বাই পুণে বা নাসিকের রাজনৈতিক ও হিন্দু মৌলবাদের চরিত্র বির্দভের রাজনৈতিক চরিত্রের সঙ্গে মেলে না। সেখানে এন সি পি আর বিজেপি ক্ষমতার মেরুকরণে হাঙ্গামা বাঁধালেও ইরিগেশন স্ক্যামের ক্ষেত্রে হাত ধরাধরি করেছে। নিরীহ সাংবাদিক হত্যা হয়েছে। ছগন ভুজায়লের লোকেরা মানমারে পেট্রলে ভেজাল রুখতে যাওয়া সরকারি অফিসারকে জ্বালিয়ে দিয়েছে। আবার ২০০৭-২০০৮ নাগাদ শিব সেনার গুন্ডামির একটা অলিখিত ইতিহাস আছে। সেখানে বাঙালী বিহারী ও তামিল এরকম অনেক প্রদেশের লোকেদের বহু বাঁধার সম্মুখিন হতে হয়েছিল ।শিব সেনা নিজেরাও টুকরো হয়েছে অন্তর্দন্দ্বে। গল্পে কোথাও যেন সেই বিপন্নতার আঁচ ছিল কিন্তু বিষন্নতার মধ্যে তা যেন বলা গেল না।স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের বিছিন্নতারও বিশেষ কোন দিক নির্দেশ নেই।নাকি নিছক নাগরীক ক্লান্তি?
    তবু লেখনির হাতটা সরেস।না হলে কি অযাচিত ভাবে এতগুলো কথা বলে গেলাম।

    ReplyDelete