0

ধারাবাহিকঃ সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক


এক কিশোরীর রোজনামচা
সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়



ভূমিকা

The Diary of a Young Girl হল ১৩ বছরের অ্যানি ফ্রাঙ্ক এর লেখা রোজনামচা। সাধারন অভিজ্ঞতায় এই বয়সে রোজনামচা লেখার অভ্যাস দেখা যায় না। আর যদিও বা দেখা যায়, তা’হলে সেটা নিতান্ত শখ বা শৌখিনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু অ্যানির রোজনামচা তার শখ বা শৌখিনতা কোনওটাই ছিল না। তার ডাইরি ছিল তার মনের বন্ধু। এই রোজনামচার পাতায় অ্যানির চোখে সমাজ রাজনীতির এক ভিন্ন রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি। চল্লিশের দশকের যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সদম্ভ প্রকাশে সমাজ ও রাজনীতিতে যে আগ্রাসী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, সেই পরিস্থিতিই অ্যানিকে তার বয়সের তুলনায় শুধু পরিপক্কই করে তোলেনি, জীবনবোধে দার্শনিক করে তুলেছিল। অস্তিত্বের চূড়ান্ত সংকটের মধ্যেও জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দ আর ইচ্ছাগুলোকে নিয়ে যে বেঁচে থাকার অনুভূতিকে উপভোগ করা যায়, এ’কথা অ্যানির ডাইরি না পড়লে বোঝা যায় না। তাই অ্যানির ডাইরি শুধু ডাইরি নয়, এ হল এক জীবনবোধ, যেখানে সে তার নিজের চোখ আর উপলব্ধি দিয়ে, আমাদের ঊনবিংশ শতাব্দীর তিন-চার দশকের সবচেয়ে বিভীষিকাময় সাম্রাজ্যবাদের অত্যাচারের ধারাবিবরণী শুনিয়েছে। এ এমন এক ধারাবিবরণী যা একদিকে আমাদের স্মৃতিতে হাজির করে যুদ্ধের বিভীষিকা, অন্যদিকে মানবিকতার সংকট। আর এই দুই-এর মধ্যে অ্যানির ডাইরি যেন জীবনের নিদিধ্যাসন। এই গভীর নির্মোহ বোধ থেকেই অ্যানি দেখেছে আটজন অন্তরালবর্তী ব্যক্তির জীবনের ওঠাপাড়ার দৈনন্দিন ঘটনা। আর সে তা’ লিখে রেখেছে তার ডাইরিতে। জানিয়েছে তার একমাত্র বন্ধু কিটীকে।

১৯৪২ সালে নাৎসি বাহিনী যখন ইতালি দখল করে তার চূড়ান্ত রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভুত্ব কায়েমের প্রক্রিয়া শুরু করল, এবং ক্রমেই তা নিশ্চিত করতে উন্মত্ত হয়ে উঠল, তখন এই আটজন ইহুদী নিজেদের জীবন রক্ষার তাগিদে এক গোপন আস্তানায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। এই সময় তাঁদের জীবনের সঙ্গী ছিল বাঁচার জন্য জীবনের ভয়, আর ছিল জীবনের ভয়ে আত্মগোপনের একাকীত্ব। বাইরের উন্মত্ত যুদ্ধ আর জাতিবিদ্বেষের সম্ভাব্য আক্রমণ, আর ভিতরে অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ... এই দুই-এর আক্রমনে বিধ্বস্ত আটজন অন্তরালবাসী, জীবনের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পেরেছিলেন, যুদ্ধের বীভৎসতা আর মানবিকতার অবমাননা।

ভিতর ও বাইরের এই চরম নৈরাজ্য আর অপমান স্বত্বেও তাঁরা বাঁচার জন্য আস্থা রেখেছিলেন জীবনধারণের ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তার উপর। ঠিক যেন দুই হাতের তালুর আড়াল দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা জীবনের শিখা। দুই বছরের অন্তরালে, ১৯৪২ থেকে ১৯৪৪ সাল, অ্যানিও শিখেছিল জীবনের নতুন ধারাপাত। ১৯২৯ সালের ১২ই জুন এক ইহুদী দম্পতির কোলে অ্যানির জন্ম। অ্যানির এক দিদি ছিলেন মারগট। তাঁর জন্ম ১৯২৬ সালে। অ্যানির পরিবার জার্মানির আদি বাসিন্দা হলেও ইহুদী হওয়ার কারণে ১৯৩৩ সালে তাঁরা সপরিবারে হল্যান্ডে দেশান্তরিত হতে বাধ্য হন। তখন অ্যানির বয়স চার কি সাড়ে চার বছর। সেই শুরু হয় অ্যানির দেশান্তরের উদ্বাস্তু জীবন। এই জীবন শেষ হয় ১৯৪৪ সালে। তখন তার বয়স মাত্র ১৫ বছর।

অ্যানির ডাইরির সময়কাল মাত্র এই দুই বছর। ডাইরির প্রথম পাতা শুরু ১৪ই জুন ১৯৪২, দিনটা ছিল রবিবার। আর ডাইরি শেষ হয় ১লা অগস্ট, ১৯৪৪, বৃহস্পতিবার। শেষ দিনের ডাইরির প্রথম ছত্রে অ্যানি তার বন্ধু কিটীকে লিখেছিল, “ছোট ছোট বিরোধ আর অসঙ্গতি নিয়ে দিনগুলো কাটালাম। এভাবেই আমি আমার শেষ চিঠিটা শেষ করতে চাই, এবং এভাবেই আমি আমার শেষ চিঠিটা শুরু করতে চাই। কিছু ছোট ছোট অসঙ্গতি বা বিরোধ, এগুলো ঠিক কি, এবং কেনই বা এগুলো আছে? তুমি আমায় বলতে পার, এই বিরোধগুলো ঠিক কি কারণে আমাদের মধ্যে আছে? এই বিরোধের অর্থই বা কি? অন্য অনেক শব্দের মত, আমার কাছে এই শব্দটার দুটো অর্থ। একটি বিরোধ হল বাইরে, সমাজে, অসীম শূন্যতার মধ্যে থেকে যা যে কোন কিছুকে অবলম্বন করে প্রকট হয়, আমাদের বিধ্বস্ত করে। আর একটি বিরোধ হলো নিজের ভিতরে। নিজের অস্তিত্বের অসঙ্গতিকে নিয়ে বিরোধ। নিজের সঙ্গে নিজের সংঘাত।’’ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে ধ্বস্ত অ্যানি এভাবেই শুরু করেছিল তার শেষ চিঠির প্রথম ছত্র।

যাই হোক, ১৯৪২ থেকে ১৯৪৪ সাল, এই দুই বছরের পর্বটা ছিল তার জীবনের অন্তরালবর্তী পর্ব। এই সময় তার কাছে সমাজ, পরিচিত, পড়শী, বন্ধু , কেউ ছিল না। ছিল একমাত্র অন্তরালের একাকীত্ব । জীবন জীবনে ছিল না, ছিল শুধু অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইএর মধ্যে। কিন্তু অন্তরালের গোপনীয়তায় যখন বাইরের খোলা আকাশ চাপা পড়ে যায়, তখন খুলে যায় মনের ভিতরের জানালা। জীবনবোধের এক নীরব নির্মোহ অভিব্যক্তি। এই অভিব্যক্তিই জন্ম দেয় বাঁচা ও বেঁচে থাকার অসঙ্গতিকে, ইতি ও নেতির সংঘাতকে। অ্যানির সঙ্গের আটজন, খোলা আকাশের নীচে, পরিপূর্ণ জীবন নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁদের জাতি পরিচয় তাঁদের বাধ্য করেছিল গোপন অন্তরালে জীবনকে আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখার সুযোগ খুঁজে বেড়াতে। সেই খোঁজার সরল অভিব্যক্তি হল অ্যানির এই ডাইরি। এখানে দিন আছে শুধু সময়ের অর্ধ হিসাবে, জীবন আছে শুধু অস্তিত্বের উপলব্ধির জন্য। আর অবকাশ আছে শুধু মনের অগম্য দিগন্তে ভাসার জন্য।

১৯৪২ থেকে ১৯৪৪ সাল। অ্যানি তার তেরোতম জন্মদিন থেকে পনেরোতম জন্মদিনে যাওয়ার মধ্যেই খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গিয়েছিল। জীবন আর মৃত্যুর মধ্যেকার অগাধ রহস্য, অনন্ত অপেক্ষা, চেতনার বিস্মিত বিকাশ, সব অভিজ্ঞতা সে এই দুই বছরের মধ্যে সঞ্চয় করে নিয়েছিল। তাই তার ডাইরি শুধু নিত্যকার ঘটনার বর্ণনা নয়। তার ডাইরি জীবনবোধের এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার নির্মোহ বর্ণনা। অন্তরীণ জীবনের উষ্ণ উত্তেজনাকে কিভাবে রসজ্ঞ চাতুর্যে বহন করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়, সে প্রজ্ঞা অ্যানি স্বল্প কালের জীবনেই আত্মস্থ করে নিয়েছিল। সেটাই ছিল তার বেঁচে থাকার একমাত্র সঙ্গী। অ্যানি তার জীবনবোধের প্রজ্ঞা দিয়ে প্রতিটি কালো দিনকে এমনভাবে আলোক সজ্জায় সাজিয়েছে যে, তার ডাইরি পড়তে পড়তে প্রতিটি পাঠকের মনে হবে, এটাই ছিল স্বাভাবিক, আর এটার মধ্যেই আছে জীবনের নতুন এক ছন্দ। তার লেখার ছন্দের মধ্যে থেকেই ফুটে ওঠে, তার বাবা, মা, দিদি আর অন্য সহবাসীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক। আর ফুটে উঠেছে কিভাবে সময় তার নিজের ছন্দের বাইরে গিয়ে, তাকে “বড়” করে তুলেছে।

এই ডাইরি এক অস্থির সময়ের সমাজ ও রাজনীতির দলিল। মানব সভ্যতার কলংকিত সময়ের সাম্প্রদায়িকতার এক চলমান ক্যানভ্যাস। মানুষ তখন মনুষ্যত্বের পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার পরিবর্তে ধর্ম, বর্ণ আর সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে পরিচিত হত। এই সবের মধ্যে দিয়েই অ্যানি পার হয়েছিল তার তেরো থেকে পনেরো বছরের জীবন। আর তাই এসবকে নিয়েই অ্যানি তার সরল সহজ চাতুর্যে চিন্তা, চেতনা, আশা, নিরাশা, প্রেম ও ভালবাসা নিয়ে শুধু বেঁচেই ছিল না, জীবনকে উপভোগও করছিল। এখানেই অ্যানির বিশেষত্ব। অ্যানির ডাইরি পড়ে পাঠকের কোথাও কখনও মনে হবে না, এই অসূয়া, অসহিষ্ণুতা বা অন্ধকার অ্যানিকে বা তার স্বাভাবিক মানবিক চিন্তার পথকে কোনও ভাবে আচ্ছন্ন করতে পেরেছিল। অ্যানি তার সরল উপলব্ধি দিয়ে এই সব নেতিকে অস্বীকার করতে পেরেছিল। পনেরো বছরের অ্যানি হয়ে উঠেছিল সকল ক্লেদ আর সংস্কার মুক্ত মানবিকতার চিরন্তন প্রতীক।

তেরো বছর বয়সে অ্যানির জীবনে প্রেম এসেছিল। অ্যানি তার ডাইরির এক জায়গায় লিখেছে, “আমাদের স্কুলে কেউই সম্ভবত এই ছেলে বন্ধুর বিষয়টা এড়িয়ে যেতে পারে না। যখনই কোনও ছেলে স্কুলের শেষে তার বাইসাইকেল নিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে বাড়ী পৌঁছে দেবে কিনা, তৎক্ষণাৎ এক পক্ষ অপর পক্ষের সাথে কথা বলতে শুরু করে। এরকম দশটা ঘটনার মধ্যে ন’টার ক্ষেত্রে দেখা যায় ছেলেটা ডিগবাজি খেয়ে মেয়েটার প্রেমে পড়ে যায়।’’ ঠিক এভাবে না হলেও, সাইকেলকে সামনে রেখেই অ্যানি অকস্মাৎ হ্যারি গোল্ডবার্গের প্রেমে পড়ে যায়। তখন ছিল ১৯৪২ সালের জুন মাস। এই প্রেম তার চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগোবার আগেই ১৯৪২ সালেরই জুলাই মাসের এক বৃষ্টিস্নাত সকালে (৯ই জুলাই) অ্যানি তার পরিবারের সঙ্গে বাবার হাত ধরে অজানা গুপ্ত আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। পিছনে পড়ে থাকে তার আবাল্য বেড়ে ওঠা বাসস্থান, তার স্কুল, আর তার কৈশোরের প্রেম আর একটা বিড়াল, যাকে সে কিছু খাবার দিয়ে পিছনে রেখে আসে।

এরপর অ্যানির ডাইরির পাতায় প্রেম এসেছে বার বার। কিন্তু তার অভিজ্ঞান হ্যারির কাছে কোনওদিন পৌঁছেছিল কিনা, তা জানা নেই।

অ্যানির কাছে ডাইরি লেখাটা ছিল, তার ভিতরের আত্মোপলব্ধির খোলসটা ভাঙ্গার এক চেষ্টা। নিজের মধ্যেকার আত্মবিশ্বাসকে কালো অক্ষরে জাগিয়ে তোলা। ১৯৪২ সালের ২০শে জুন অ্যানি তার ডাইরিতে লিখেছে, “আমার মধ্যেকার বন্ধুত্বের মানসিকতাকে প্রসারিত করার মাধ্যম হল আমার ডাইরি। আমার সেই প্রসারিত দৃষ্টি দিয়ে খুঁজে নিতে চেয়েছি আমার বন্ধুকে।’’ অ্যানি তার সেই প্রসারিত দৃষ্টি দিয়েই খুঁজে পেয়েছিল তার কল্পিত বন্ধু কিটীকে। যার কাছে সে তার মনের নীরস, আপাত মাধুর্যহীন সব কথা শেয়ার করত। হতে পারে কিটী কল্পিত। কিন্তু সেই ছিল অ্যানির সমস্ত চিন্তার আধার। অন্য অনেক কিছুর মত অ্যানি কিটীকেই শুনিয়েছিল, তার আর হ্যারির প্রেমের কথা। কিংবা শুনিয়েছিল ১৯৪২ সালে জার্মানির নাৎসি বাহিনীর হল্যান্ডে প্রবেশ, ও জাতি বিদ্বেষ সৃষ্টির ঐতিহাসিক কাহিনী। যার সূত্রপাত এক বৃষ্টিস্নাত সকালে বাবার হাত ধরে ইহুদী কন্যার শহরত্যাগের মধ্যে প্রতিফলিত।

এই ডাইরি শুধু ডাইরি নয়। এ হল জাতি বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে নস্যাৎ করে মানবিকতার পথে জীবনের নিষ্ক্রমণ। এই নিষ্ক্রমণের উচ্চতা বয়স দিয়ে মাপা যায় না। এর উচ্চতা নির্ধারণ করে নির্মোহ মানবিকতার ইতিবাচক দর্শন। এই জন্য “A Diary of a Young Girl” একটি ইতিবাচক বই। আকারে নয়, এর বিশালতা গভীরত্বে। এর ব্যাপ্তিতেই এর পরিচয়। 

ঋতবাকের আগামী কিছু সংখ্যায় ধারাবাহিক ভাবে এই ব্যাপ্তিকে আমি হাজির করতে চাই পাঠকের দরবারে। আমার বিশ্বাস সুধী পাঠককূলের মানবিক সহানুভূতি এবং সহৃদয় মনোযোগ অ্যানির জীবন বোধের গভীরতাকে উপযুক্ত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করবে।

0 comments: