0

সম্পাদকীয়

Posted in





কালের নিয়মে আরেকটি বছর সমাগতপ্রায়। অতঃপর নববর্ষ উদযাপন, চড়ুইভাতি, পিঠেপুলি উৎসব এবং বইমেলা। অতিমারির কালো ছায়া এসবই গ্রাস করে নিয়েছিল। গতবছরও পিছিয়ে যায় বইমেলার নির্ঘণ্ট। এবং শেষ পর্যন্ত যখন তা বাস্তবায়িত হয়, একপ্রকার অভূতপূর্ব উৎসাহ আর উদ্দীপনার ঝোঁক লক্ষ্য করা গিয়েছিল প্রতিদিনের মানুষ সমাগমে। জানা গিয়েছিল ১৯৭৬ সালে শুরু হওয়া বার্ষিক এই আয়োজন ভেঙে দিয়েছে আগের বছরগুলির বাণিজ্যের যাবতীয় রেকর্ড। শ্লাঘার কথা নিঃসন্দেহে। আশার আলো এই শিল্পের জন্য, যার ওপর নির্ভরশীল শত-সহস্র পরিবার। এর পরও একটি দুর্বিনীত প্রশ্ন মনের আনাচে কানাচে ঘোরাফেরা করতে থাকে। একই হারে পাঠক তৈরি হচ্ছে তো? এই ছবিটি বিভ্রান্তিকর নয়তো? একজন লেখক কি জানেন, কীভাবে তাঁর পাঠক জন্মলাভ করে? তিনি নিজেই কি সেই প্রথম পাঠক নন? মুদ্রণ এবং প্রকাশনা শিল্পের ওপর অনেকাংশেই বৃহত্তর পাঠক কূল নির্মাণের দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই কাজটি জরুরিতর হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়।

একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি কথাশিল্পীর ধারণা ছিল আজীবন তিনি পাঠক রয়ে গিয়েছিলেন। এ মাসের ২৮ তারিখ রমাপদ চৌধুরি শতবর্ষ পূর্ণ করবেন। তাঁকে আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম।




সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।

শুভেচ্ছা অফুরান।

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in





উন্নয়ন বা আর্থিক বিকাশ এবং মানবমূল্যের বিকাশ কি পরিপূরক নয়?

[পশ্চিম ভারতের উপকূল আরব সাগর ঘেঁষে আমাদের গুজরাত রাজ্যের জনতা এ মাসের প্রথম সপ্তাহে বিধানসভা নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের নতুন সরকার তৈরি করে নিচ্ছে। এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হবার আগে হয়ত নতুন সরকার শপথ নেবে।

নিঃসন্দেহে গুজরাত ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্প ইত্যাদির পাটিগণিতে ভারতের সামনের সারির একটি রাজ্য। মিডিয়ায় হরদম শুনি গুজরাত মডেলের গুণগান। কিন্তু আমাকে বিচলিত করেছে দু’মাস আগের খবরের কাগজে একটি ঘটনার রিপোর্ট এবং তার সম্পর্কিত ভিডিও। এ নিয়ে সেই সময় মামলা আদালতে গিয়েছে এবং অনেকের চোখে পড়েছে। এবার আসল কথায় আসি। ]

আমরা জানি যে রাষ্ট্রের কাজ নাগরিককে সুরক্ষা দেওয়া। তার জন্যে প্রশাসন এবং পুলিশ বিভাগকে দক্ষ এবং সজাগ থাকতে হয়। সেটা আদর্শ পরিস্থিতি।

কিন্তু বাস্তবে? রাষ্ট্র যদি রামের কথায় শ্যামকে বা শ্যামের কথায় রহিমকে মারতে থাকে তাহলে সেটা কি রুল অফ ল বা আইনের শাসন বলা যাবে? অথবা যখন একজনের কথিত অপরাধে তাকে আদালতে না পাঠিয়ে তার পারিবারিক ঘর বা বৌয়ের বাড়ি বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে দেয়?

সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়ানো অগুনতি ভিডিও’র মধ্যে একটি ইদানীং অনেকের নজর কেড়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, কোন এক জনপদের রাস্তায় চার-পাঁচজন লোককে, একের পর এক, খোলাখুলি বিজলী ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে বেধড়ক লাঠিপেটা করা হচ্ছে। যাদের পেটানো হচ্ছে তারা ক্রমাগত হাত জুড়ে অনুনয় বিনয় করছে, আর মেরো না! আর উপস্থিত জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ছে, হাততালি দিচ্ছে; যেন কোন উৎসব বা স্টেডিয়ামে ক্রীড়াপ্রতিযোগিতা চলছে।

জায়গাটা কোথায়? যারা মারছেন তাঁরা কে? যাঁদের পেটানো হচ্ছে তাঁরাই বা কারা?

কিন্তু একটা ব্যাপার সবার নজরে এলো যে যাঁরা পেটাচ্ছেন তাঁদের একজনের কোমরের বেল্ট সংলগ্ন হোলস্টারে রিভলবার। তবে কি এঁরা সাদা পোষাকের পুলিশ? সন্দেহ পোক্ত হল যখন দেখা গেল খানিকক্ষণ পেটানোর পর তাঁরা বন্দীদের টেনে নিয়ে একটি পুলিশ ভ্যানে তুলে দিলেন।

সংবাদমাধ্যমের সূত্রে যদ্দুর জানা গেছেঃ

জায়গাটা গুজরাত রাজ্যের খেড়া জেলার মাতার তালুকের উন্ধেলা গাঁয়ের একটি চৌমাথার চত্বর। তারিখ ৪ অক্টোবর। ওই চৌমাথায় রয়েছে একটি মন্দির, যার গায়ে লাগা একটি মাদ্রাসা এবং উল্টোদিকে মুখোমুখি একটি মসজিদ।

লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছিলেন যিনি তাঁর পরিচয় পুলিশ ইন্সস্পেক্টর এ ভি পরমার; আর যিনি মারখাওয়া লোকদের পকেট থেকে ওয়ালেট এবং মোবাইল বের করে নিচ্ছিলেন তিনি হলেন সাব-ইন্সপেক্টর ডি বি কুমাওত। দুজনেই খেড়া জেলার স্থানীয় ক্রাইম ব্র্যাঞ্চের সঙ্গে যুক্ত। রাজ্যের ডিজিপি জানিয়েছেন যে তদন্ত শুরু হয়েছে, দোষ প্রমাণিত হোলে নিশ্চয়ই শাস্তি পাবে।

আর যারা মার খেয়েছে তাঁদের পরিচয় এখনও প্রকাশ করা হয় নি। তবে পুলিশ সূত্রে বলা হয়েছে ওরা সবাই মুসলমান সম্প্রদায়ের।[1]

৬০০০ জনসংখ্যার এই গাঁয়ে হিন্দু-মুসলিম অনুপাত প্রায় সমান সমান। এঁরা স্পষ্ট করে চিহ্নিত করা আলাদা পাড়ায় বসবাস করেন।

ঘটনা সম্পর্কে গাঁয়ের নবনির্বাচিত সরপঞ্চ ইন্দ্রবদন সিং বলেন যে উনি এখানে এই চৌমাথায় সোমবার একটি গরবা অনুষ্ঠানের আয়োজন করিয়ে ছিলেন। শান্তিভঙ্গের আশংকায় আগে থেকেই পুলিশ মোতায়েন ছিল। বলা হয় যে কিছু দুষ্কৃতি গরবা চলার সময় সেখানে ঢিল ছোঁড়ে।

স্থানীয় নিবাসী রবীন্দ্র প্যাটেলের কথায় -- যখন জানা গেল যে কিছু উপদ্রবকারী ধরা পড়েছে, তখন ভিড় একত্রিত হয়। আমরা পুলিশকে বলি ওদের উচিত শিক্ষা দিতে। ওদের মধ্যে অন্ততঃ আটটা এমন লোক আছে যারা সবসময় অন্যদের ওসকায়, ভয় দেখায়।

তাই পুলিশ ওদের পেটালে সবাই খুশিতে হাততালি দেয়। এত বছরের অপমান সহ্য করে ভেতরে ভেতর ফুঁসছিলাম, কয়েক দশকের মধ্যে এই প্রথম ন্যায় পেলাম।

এবার দেখুন গুজরাতের গৃহমন্ত্রী ওই ঘটনাটির প্রেক্ষিতে কী বলছেন?

গুজরাত বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আলোচনা সভায় শ্রোতাদের প্রশ্নোত্তরের সময় উনি বলেন – মানবাধিকার কি শুধু যারা পাথর ছোঁড়ে তাদের জন্যে? যারা ওই পাথরের ঘায়ে আহত হল সেই শিশু ও মেয়েদের কি মানবাধিকার নেই? সময় এসেছে এ নিয়ে ভাববার। গুজরাত পুলিশ কঠিন পরিশ্রম করেছে যাতে আমাদের বোনেরা আমাদের তরুণেরা অনেক রাত পর্য্যন্ত গরবা নাচতে পারে, দোকানদারেরাও তাদের জীবিকা অনুযায়ী মাঝরাত্তির পর্য্যন্ত তাদের ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারে।

যদি ওরা যা করেছে সেটা দেখে আপনাদের ভালো লেগে থাকে তাহলে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাকে নয়, গুজরাত পুলিশকে ধন্যবাদ দিন। [2]

স্বয়ং গৃহমন্ত্রী যদি বেঁধে পেটানোর ঘটনায় পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করে আম জনতাকে ওদের সমর্থনে দাঁড়াতে বলেন তাহলে ওই পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে ওঁর অধীনস্থ পুলিশ বিভাগ নিরপেক্ষ তদন্ত করবে এবং দোষীদের শাস্তি দেবে—এটা কি আমরা বিশ্বাস করতে পারি?

হ্যাঁ, সংবাদসূত্রে জানা গেছে ওই ঘটনায় উন্ডহেলা গ্রামের ৪৩ জন মুসলিম বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে এফ আই আর রুজু করা হয়েছে। গ্রেফতারের আশংকায় অনেক ঘরেই তালা ঝুলছে।

আর পরে তদন্তে দেখা গেছে যে পুলিশ আগে যাদের গ্রেফতার করে থানায় পুরেছে, স্থানীয় জনতার দাবিতে তাদেরই কয়েকজনকে বার করে এনে মাঝরাত্তিরে চৌমাথায় বেঁধে পিটিয়েছে।

এছাড়া সবিনয়ে বলতে চাই যে মানবাধিকার নিয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের ব্যখ্যানটি সর্বৈব ভুল।

কেউ পাথর ছুঁড়ে আহত করলে সেটা অপরাধ, মানবাধিকার উল্লংঘন নয়। সেই অপরাধের জন্যে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডে শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। ব্যক্তি আইন ভেঙে অন্য নাগরিক বা ব্যবস্থার ক্ষতি করলে সেটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বা সমূহের বিরুদ্ধে অপরাধ; মানবাধিকার উল্লংঘন নয়।

কিন্তু রাষ্ট্র যদি আইন অনুমোদিত পদ্ধতি বা ‘ডিউ প্রসেস অফ ল’ পালন না করে কোন ব্যক্তির শরীর বা সম্পত্তির ক্ষতি করে –সেটা মানবাধিকার উল্লংঘন। অর্থাৎ মানবাধিকারের প্রশ্নটি কেবল রাষ্ট্র ও ব্যক্তি নাগরিকের সুরক্ষার প্রেক্ষিতেই অর্থবহ হয়, অন্যথা নয়।



এই ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনটে প্রশ্ন উঠে আসে—

এক, মানবাধিকার ব্যাপারটা কী?

দুই, সরকারের কোন বিভাগ, বিশেষ করে পুলিশ কি ডিউ ডিলিজেন্স বা আইনসম্মত পদ্ধতি অবলম্বন না করে যা খুশি তাই করতে পারে? সেটা জনতাকে ত্বরিত ন্যায় বা হাতে-গরম জাস্টিস দেওয়ার অজুহাত হলেও?

তিন, আমাদের সংবিধান কি পুলিশকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার দিয়েছে?

আমি তিনটে প্রশ্ন নিয়েই কথা বলতে চাই, কিন্তু শুরু করব রিভার্স অর্ডারে, মানে আগে তিন নম্বর।

সংবিধান কি পুলিশকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার দিয়েছে?

বিগত ২৭ নভেম্বর, ২০১৯ তারিখে হায়দ্রাবাদের কাছে পশু চিকিৎসক দিশাকে চারজন গণধর্ষণ করে হত্যা করে। মিডিয়ায় দেশজুড়ে কভারেজের পর জনমানস ক্রোধ এবং আবেগে উদ্বেল। সাইবেরাবাদ পুলিশ অপরাধীদের পরের দিনই গ্রেফতার করে এবং আটদিন পর ৬ ডিসেম্বর ভোরে হায়দ্রাবাদের উপকণ্ঠে কথিত এনকাউন্টারে চারজনকেই মেরে ফেলে, তাদের মধ্যে দু’জন নাবালিক।

নাগরিকেরা খুব খুশি, পুলিশেরা প্রকাশ্যে সম্মানিত হলেন; কিছু সাংসদ এবং অধিকাংশ রাজনৈতিক দলও ‘ত্বরিত ন্যায়’ প্রদানের জন্য পুলিশের প্রশংসা করলেন। হায়দ্রাবাদ সরকারের প্রবীণ মন্ত্রী টি এস শ্রীনিবাস যাদব বললেন যে সরকারের সমর্থন ছাড়া পুলিশ এমন দ্রুত অ্যাকশন করতে পারত না।

কিন্তু সুপ্রীম কোর্ট নিযুক্ত জাস্টিস শিরপুরকর কমিশন তদন্তের পর এই সিদ্ধান্তে এলেন যে ওই এনকাউন্টারের ঘটনাটি সাজানো। উনি তাঁর রিপোর্টে ওই সাজানো এনকাউন্টারের জন্য দোষী ১০ জন পুলিশের বিরুদ্ধে খুনের মামলা চালানোর সুপারিশ করেছেন।

মামলাটি এখন, কমিশনের রিপোর্ট সহ, হাইকোর্টে বিচারাধীন।

কথা হচ্ছে, শিরপুরকর কমিশন এমন রায় কেন দিল?

অভিযুক্তরা কি একটি অসহায় মেয়েকে বর্বর অত্যাচার ও হত্যার অপরাধে দোষী নয়? এইসব জঞ্জালকে পৃথিবীর বুক থেকে চটপট সরিয়ে দিয়ে পুলিশ কি ঠিক করে নি, যাতে আমরা নাগরিকেরা নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারি এবং আমাদের মেয়েরা নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের নিজের ইচ্ছেমত জীবনযাপন করতে পারে?

আমার পালটা প্রশ্নঃ

তাহলে আর বিচারব্যবস্থা , মানে এতগুলো আদালত, সেশন ও জেলা কোর্ট , আবার দুই স্তরের আপিল করার কোর্ট—হাইকোর্ট এবং সুপ্রীম কোর্ট—থাকার দরকার কি? শুধু পুলিশ থাকলেই হল। ওদের যাকে মনে হবে অপরাধী, সেই অপরাধী। ওরাই বিচার করবে এবং শাস্তি দেবে। কোন উকিলের কথা কাটাকাটি, তারিখ পে তারিখ, এসবের দরকার নেই।

সোজা কথায়, যাকে পুলিশ দেগে দিয়েছে অপরাধী বলে সেই অপরাধী; তার কথা শোনার দরকার নেই।

ভেবে দেখুন, তাহলে আমাদের দেশ কি ক্রমশঃ একটি আদিম সমাজের কৌম আইনের বা মাওবাদী এবং সন্ত্রাসবাদীদের ক্যাঙারু কোর্টের অধীন হয়ে যাবে না? কোন সভ্যদেশে এমন হতে পারে?

আসলে কমিশনের রায়ের ভিত্তিতে রয়েছে আমাদের সংবিধান এবং ক্রিমিনাল জুরিসপ্রুডেন্সের কিছু মৌলিক নীতি। পুলিশের কাজ শাস্তি দেয়া নয়। আর প্রত্যেক অভিযুক্তেরই বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তার পক্ষ না শুনে তাকে দোষী ঠাউরানো যায় না। অনেক ঘটনায় আমরা দেখেছি যে পুলিশ যাকে অপরাধীকে ধরে ফেলেছি বলে পেশ করেছে পরে দেখা গেছে যে সে নির্দোষ।

তাহলে পুলিশের কাজ কি? পুলিশের দায়িত্ব বলতে দুটো।

প্রথমতঃ পাহারা এবং নজরদারির মাধ্যমে অপরাধ ঘটিত হবার সম্ভাবনাকে আটকানো।

দ্বিতীয়তঃ অপরাধ ঘটিত হলে তদন্ত করে অভিযুক্তদের প্রমাণ সহ আদালতের সামনে পেশ করা। শাস্তি দেওয়া পুলিশের কাজ নয়।

বিচার বিভাগের কাজ সেই প্রমাণ গুলো খতিয়ে দেখা এবং অভিযুক্তদের বক্তব্য শোনা; তারপর তুল্যমূল্য বিচার করে সিদ্ধান্তে আসা যে অপরাধী দোষী কিনা এবং অপরাধের গুরুত্ব বুঝে তার শাস্তির পরিমাণ ঠিক করা।

আমাদের দেশের ক্রিমিনাল জুরিসপ্রুডেন্স অনুযায়ী আদালতে প্রমাণ না হওয়া পর্য্যন্ত কেউ দোষী বা অপরাধী নয়, অভিযুক্ত মাত্র। আর কাউকেই, এমনকি জঘন্যতম অপরাধের অভিযুক্তকেও, তার বক্তব্য না শুনে শাস্তি দেওয়া যায় না।

‘ত্বরিত ন্যায়’ আধুনিক রাষ্ট্রের এবং সংবিধানের গোড়ায় কুড়ুলের কোপ দিচ্ছে।

রাষ্ট্র, তিনটে অঙ্গ, ডিউ ডিলিজেন্স বা আইনসম্মত উপায়

যে কোন সভ্য দেশে এবং আধুনিক রাষ্ট্রে শারীরিক শাস্তি দেওয়ার অধিকার কেবল মাত্র রাষ্ট্রের। কোন নাগরিক অন্য নাগরিকের গায়ে হাত তুললে সেটা আইনতঃ অপরাধ। তাই আজকের অবধারণায় শিক্ষক ছাত্রকে বেধড়ক পেটালে জেলে যাবেন। এমনকি বাবা ছেলেকে ঠ্যাঙালে বা স্বামী স্ত্রীর গায়ে হাত তুললে সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেই গণ্য হবে।

এর ব্যতিক্রম শুধু আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে। তাই পুলিশও নকল এনকাউন্টারের সময় বলে যে অপরাধী পালাতে চেষ্টা করছিল এবং পুলিশের উপর পালটা হামলা করছিল। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছে।

আধুনিক রাষ্ট্রের পরিচয় সে দেশে আইনের শাসন রয়েছে কি নেই।

রুল অফ ল মানে রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি অঙ্গ – আইনসভা, প্রশাসন (পুলিশ সমেত) এবং বিচারব্যবস্থা সংবিধান নির্ধারিত পদ্ধতিতে নিজের নিজের দায়িত্বপালন করবে। কেউ অন্যের এক্তিয়ারে দখল দেবে না।

পুলিশ আইন প্রণয়ন করতে পারে না, সেটা আইনসভার মানে সংসদ ও বিধানসভার কাজ। পুলিশ শাস্তি দিতে পারে না, সেটা বিচারবিভাগের কাজ।

পুলিশের মাধ্যমে ত্বরিত ন্যায় বাস্তবে সেই বেড়া ভেঙে বিচার বিভাগের এলাকায় প্রবেশ করা মাত্র।

পুলিশ তার খেয়ালখুশি মত কাজ করতে পারে নাঃ

রুল অফ ল’এর আরেকটি অর্থ-- নাগরিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের প্রতিটি পদক্ষেপ আইন নির্ধারিত পদ্ধতিতে হতে হবে। পুলিশও তার ব্যতিক্রম নয়।

তদন্তের খাতিরে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হলে, কারও শরীর বা ঘর বা অফিস তল্লাসি করতে হলে তাদের ক্রিমিনাল প্রসিডিওর অ্যাক্ট নির্ধারিত পদ্ধতি মেনে চলতে হয়। তাই সার্চ ওয়ারেন্ট লাগে, গ্রেফতারের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ লাগে, তল্লাসি করে জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করতে হোলে সিজার লিস্ট বানাতে হয় এবং পঞ্চনামা করে নিরপেক্ষ সাক্ষীর দস্তখত নিতে হয়।

গুজরাতের ঘটনাটির ভিডিও এবং বাসিন্দাদের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে এখানে পুলিশ আইনসম্মত উপায়ে তার দায়িত্ব পালন করেনি। পাথর ছোঁড়ার জন্য অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে ভ্যানে তুলে নিয়ে যাওয়া এবং থানায় জেরা করা যথেষ্ট ছিল।

এখানে রাষ্ট্রের একতরফা আচরণের বিরুদ্ধে অভিযুক্ত মুসলিম যুবকদের সম্মান এবং মর্যাদা নিয়ে বাঁচার সংবিধান প্রদত্ত অধিকার অবশ্যই লঙ্ঘিত হয়েছে। পুলিশ মন্ত্রীর বয়ান আদৌ রাষ্ট্র এবং প্রশাসনের ছবি উজ্বল করে নি।

কিন্তু তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল জনতার পুলিশকে আইন হাতে নিতে উসকে দেওয়া এবং সেটাকে মহিমামণ্ডিত করা।

একটি উলটো ঘটনাঃ

কর্ণাটকের বিদার জেলায় একটি মহম্মদ গওয়ান নামের সুপ্রাচীন মাদ্রাসা রয়েছে। ১৪৬০ সালে নির্মিত দক্ষিণের বাহমণী সুলতানেতের সময়কালীন এই মাদ্রাসাটি ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে প্রসিদ্ধ। এটি হেরিটেজ বিল্ডিং এবং ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগ এর রক্ষণাবেক্ষণ করে।

গত ৬ই অক্টোবর, বৃহস্পতিবার বিজয়াদশমীর মিছিল গিয়ে ওই ঢুকে সেখানে নারকোল ফাটিয়ে পুজা অর্চনা করে। ভিডিও ভাইর‍্যাল হওয়ায় একটি অভিযোগের ভিত্তিতে ন’জনের বিরুদ্ধে এফ আই আর হয়েছে কিন্তু এখন অবধি কেউ গ্রেফতার হয়নি।[3]

পুলিশের অধিকার নিয়ে জনমানসে নিহিত কিছু ভুল ধারণাঃ

পুলিশ কি কথা বের করার জন্যে তদন্তের স্বার্থে কোন অভিযুক্তকে টর্চার করতে পারে?

না, সেটা অপরাধ। তাই পুলিশ কাস্টডিতে নেওয়ার সময় এবং কোর্টে পেশ করার সময় অভিযুক্তের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। আর থানায় জোর করে কোন স্বীকারোক্তি নিলে সেটা আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হবে না( এভিডেন্স অ্যাক্টের সেকশন ২৫ এবং ২৬)।

শুধুমাত্র যে বয়ান অভিযুক্ত একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে স্বেচ্ছায় ক্রিমিনাল প্রসিডিওর অ্যাক্টের ধারা ১৬৪ নির্ধারিত পদ্ধতিতে দিয়ে সাইন করেছে সেটাই আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রাহ্য হবে।

কারণ, এ না হলে পুলিশ ভয় দেখিয়ে বা যন্ত্রণা দিয়ে কাউকে এমন অপরাধ স্বীকার করিয়ে নেবে যা সে করেনি। এছাড়া কেউ চাইলে নিজের অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে স্বীকারোক্তি দিতে অথবা কোন দলিল দিতে এই বলে অস্বীকার করতে পারে যে ‘কাউকে নিজের বিরুদ্ধে প্রমাণ বা স্টেটমেন্ট দিতে বাধ্য ‘করা যায় না। এটি সংবিধান প্রদত্ত অধিকার --আর্টিকল ২০(৩)।

পুলিশ এবং প্রশাসনের দায়িত্ব আইনসম্মত উপায়ে অপরাধ প্রমাণ করা, জোর করে স্বীকারোক্তি লিখিয়ে নয়। তার বৈজ্ঞানিক উপায় আছে।

তাই কাউকে সন্দেহের বশে গ্রেফতার এমনকি জেরা করতে হলেও আইন সম্মত পদ্ধতি মেনে করতে হবে। যেমন মহিলাদের রাত্রিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় ডেকে পাঠানো যায় না। সন্দেহাস্পদ মহিলাকে তার বাড়িতে গিয়ে পরিবারের লোকজনের সামনেই জেরা করতে হবে।

পুলিশের মাধ্যমে ‘ত্বরিত ন্যায়’ বা instant justice এর ধারণাটির উৎস কী?

ভারত সরকারের প্রাক্তন স্পেশাল ডায়রেক্টর (ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো)এবং ভূতপূর্ব সেন্ট্রাল ইনফর্মেশন কমিশনার যশোবর্ধন আজাদ জানাচ্ছেন যে এই অবধারণাটি কলোনিয়াল।[4] এটির প্রয়োগ বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিবাদীদের দমন করতে শুরু করেছিল। প্রায় এক শতাব্দী আগে (১৯২৪ সালে) রাম্পা বিদ্রোহী নেতা আল্লুরি সীতারাম রাজু্র হত্যা তার মধ্যে একটি।

রাজু তখন মাদ্রাজ ফরেস্ট অ্যাক্ট ১৮৮২র বিরুদ্ধে ইস্টার্ন ঘাট পার্বত্য এলাকার আদিবাসীদের সংগঠিত করছিলেন। পুলিশ তাঁকে বন্দী করে আদালতে পেশ না করে গুলি করে হত্যা করে।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী গত ১৫ই অগাস্টে সমস্ত কলোনিয়াল ঐতিহ্য মুছে ফেলার ডাক দিয়েছেন। তবে তাঁর মূল রাজ্য গুজরাতের গৃহমন্ত্রী এ’ব্যাপারে ঠিক অবহিত ন’ন মনে হচ্ছে।

শুধু তাই নয়, স্বাধীন ভারতে পুলিশ এনকাউন্টারে কথিত অপরাধীর মৃত্যুর ঘটনা বড় কম নয়। যশোবর্ধন আজাদ জানাচ্ছেন যে ১৯৫০ থেকেই পুলিশের বিরুদ্ধে-- ডাকাত দমনে, পাঞ্জাব, জম্মু-কাশ্মীর, উত্তর পূর্বে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহী এবং বিভিন্ন রাজ্যে মাওবাদী দমনে-- সাজানো এনকাউণ্টারের অভিযোগ উঠেছিল।

কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রকের বয়ান অনুযায়ী ১ জানুয়ারী ২০১৭ থেকে ৩১ জানুয়ারি ২০২২ পর্য্যন্ত পুলিশ এনকাউন্টারে মৃত্যুর খতিয়ান নীচে দেওয়া হলঃ[5]

রাজ্য মৃত্যুর ঘটনা

ছত্তিশগড় ১৯১

উত্তর প্রদেশ ১১৭

অন্য ১৩টি রাজ্য ৩৪৭

মোট ৬৫৫



জনতার নিজের হাতে বিচার এবং শাস্তির কিছু ঘটনাঃ

· অভিজিৎ নাথ এবং নীলোৎপল দাস আসামে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পরা গুজবের ভিত্তিতে উন্মত্ত জনতা তাদের গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে এবং সেই দৃশ্য ভিডিও করে গর্বের সঙ্গে মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়।[6]

· ত্রিপুরা পুলিশ বলছে, গত ২৭ এবং ২৮ জুন, ২০১৮, একই ভাবে গুজব ছড়িয়ে ছেলেধরা সন্দেহে চারজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। এর মধ্যে একজন মহিলাও আছেন। আর আছেন সুকান্ত চক্রবর্তী যাঁকে সরকার গ্রামে পাঠিয়েছিল ছেলেধরার মিথ্যে গুজব ঠেকাতে।

· বিবিসি বাংলার রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৮ সালের মে এবং জুন মাসের ভেতর ছেলেধরা সন্দেহে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অন্ততঃ ১৪ জন মানুষকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। [7]

· ১৯৮২ সালে কলকাতার বিজন সেতুতে উন্মত্ত জনতা ছেলেধরা সন্দেহে ১৭ জন আনন্দমার্গীকে পুড়িয়ে মারে।

· এবার কর্ণাটকের গল্প। ঝারখণ্ড থেকে বেঙ্গালুরুতে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে আসা ৩৩ বছরের আদিবাসী যুবক সঞ্জয় টুডুকে, গত ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ , দরগা মহল্লার কাছে ছেলেধরা সন্দেহে বেধড়ক ঠ্যাঙানো হয়। ডেপুটি পুলিশ কমিশনারের বয়ান অনুযায়ী হয়সালা থানার পুলিশ ওকে জীবিতাবস্থায় থানায় নিয়ে গিয়ে বলে কমপ্লেইন কর, আর তোমাকে আমরা হাসপাতালে ভর্তি করে দিচ্ছি।

কিন্তু ও দুটো প্রস্তাবেই রাজি না হয়ে থানা থেকে বেরিয়ে যায়, বলে আমি আমার গৃহনগরে ফিরে যেতে চাই। ও তখন একটু মত্ত, কিন্তু সজ্ঞানে ছিল। পরের দিন ২৪ তারিখে ওকে আইটি আই কলোনির ফুটপাথে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এখন কয়েকজন পুলিশের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে।[8]

জনতা কেন আইন নিজের হাতে তুলে নেয়?

এটা অবশ্যই দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার প্রকাশ।

নিঃসন্দেহে ভারতে বিচারব্যবস্থা এবং পদ্ধতি ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। আমরা বলি বটে—জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনায়েড’। কিন্তু বিচারব্যবস্থার সংস্কার আমাদের প্রাথমিকতা নয়।

দেখুন, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১২ সালের গণধর্ষণের নির্ভয়া কাণ্ডে অপরাধীরা দ্রুত গ্রেফতার হয়েছে। অথচ, বিচার শেষ করে তাদের শাস্তি দিতে সময় লেগে গেল ৬ বছর।

পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অফ ইণ্ডিয়ার একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ধর্ষণের মামলায় ৭০% বৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র ১০% কেসে বিচার প্রক্রিয়া ২০১৮ নাগাদ শেষ হয়েছে। তার মধ্যে আবার ৭৩% ছাড়া পেয়ে গেছে।

দিশা কেসটিতে সুপ্রীম কোর্টের গঠিত কমিটি প্রশাসন এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের ঢিলেমির জন্যে তিরস্কার করেছে।[9]

সেজন্যেই আজও, মানে ৬ অগাস্ট ২০২২ নাগাদ, সুপ্রীম কোর্টে ৩৪টি পদের তিনটি রিক্ত, হাইকোর্টের অনুমোদিত ১১০৮ পদের মধ্যে রিক্ত পদ ৩৮০। আর জেলা এবং নিম্ন আদালতে ২৪, ৬৩১ পদের মধ্যে ৫৩৪২টি খালি পড়ে রয়েছে। ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশে সর্বস্তরে অনুমোদিত পদের সংখ্যাই যে অনেক কম সেকথা নাই তুললাম।

আমাদের কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রী কিরেন রিজ্জু বিগত ১৬ জুলাই তারিখে জয়পুরে এক সেমিনারে চিন্তা প্রকট করে বললেন যে দেশের বিচারালয়ে ৫ কোটি কেস ঝুলে রয়েছে। এর মধ্যে ৪ কোটি কেস নিম্ন আদালতের। এর মধ্যে ক্রিমিনাল কেসের সংখ্যা ৩ কোটি। সুপ্রীম কোর্টে লম্বিত রয়েছে প্রায় ৭১০০০ কেস।[10]

সেখানে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রমন্না বলেন যে এর কারণ সর্বস্তরে পদ খালি পড়ে থাকা এবং বিচারব্যবস্থার অপ্রতুল পরিকাঠামো।

ফলে সাধারণ মানুষ ন্যায় পেতে অনেক সময়ই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা বা প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের কাছে সাহায্য চাইতে যান। এর ফলে গড়ে ওঠে মাফিয়া এবং সন্দিগ্ধ নায়ককে কেন্দ্র করে কিছু মিথ এবং প্রভামণ্ডল। সোশ্যাল মিডিয়া ও সিনেমায় এরকম চরিত্রকে মহিমামণ্ডিত করা হয়।

এর থেকে এক ধাপ এগোলেই জনমানসে পুলিশের এনকাউন্টারকে ন্যায়োচিত বলে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। গড়ে ওঠে ‘এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট’ বলে নতুন নায়কের কিংবদন্তী। আমরা খেয়াল করিনা যে আসলে আমরা সিভিক সোসাইটির ধারণার বিরুদ্ধে এক সমান্তরাল মাফিয়া সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছি, তাকে গ্রহণযোগ্য করে তুলছি।

এর বিষময় ফল দেখা যায় দেশের আইন প্রণয়নের দায়িত্বে থাকা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রোফাইলে।

অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস (এ ডি আর) সাংসদ এবং বিধায়কদের এফিডেভিট অধ্যয়নের ভিত্তিতে বলছে যে ওঁদের নিজেদের ঘোষণা অনুযায়ী ৩৬৩ জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস চলছে। এর মধ্যে বিধায়ক ২৯৬ জন এবং সাংসদ ৬৭। এঁদের মধ্যে ৪ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং ৩৫ জন বিভিন্ন রাজ্যের মন্ত্রী।

এঁদের মামলা ৭ থেকে ১০-১১ বছর ধরে বিচারাধীন, তাই তাঁরা নির্বাচনে দাঁড়ানোর যোগ্যতা হারান নি।[11]

দু’দশকের লোকসভা নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে বিজয়ী প্রত্যাশীদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস থাকার হার বেড়েই চলেছে। ২০০৯ সালে ৫৪৩ জন বিজয়ী সাংসদের মধ্যে ১৬২ জনের (৩০%) ক্রিমিনাল কেস ছিল, যার মধ্যে ৭৬ জনের (১৪%) বিরুদ্ধে ছিল খুন, রেপ গোছের সিরিয়াস চার্জ। ২০১৯ সালের ফল বেরোলে দেখা গেল উপরোক্ত দুটো অনুপাত বেড়ে হয়েছে ৪৩% এবং ২৯%।

আরও চিন্তার বিষয়, যাঁর বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস চলছে তাঁর জেতার সম্ভাবনা ১৫.৫% , অথচ যাঁর প্রোফাইল নিষ্কলংক ভালোমানুষের তাঁর চান্স মাত্র ৪.৭%! [12]

ত্বরিত ন্যায়, বুলডোজার এবং মানবাধিকার

ত্বরিত ন্যায়ের মানসিকতা একদিক থেকে দেখলে ভীড়ের হিংস্র মানসিকতা। যার বশবর্তী হয়ে আমরা রাস্তায় পকেটমার! পকেটমার! চিৎকার শুনে ভিড়ের মধ্যে অজানা অচেনা লোকের গায়ে হাত তুলি, তাকে নিরাপদে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ভাবি না।

এই আদিম হিংস্রতার বশেই আমরা মর‍্যাল পুলিশ হয়ে অনৈতিক জীবনযাপনের কথিত দোষে বা কারও ঘরভাঙার সত্যি অথবা কাল্পনিক অপবাদে প্রকাশ্য রাস্তায় কোন মহিলার গায়ে হাত ওঠাই। ঘরে গয়না বা দামি জিনিস হারালে প্রথমেই কাজের দাদা বা মাসিকে নিজেরাই শারীরিক নিগ্রহ করতে শুরু করি।

এই মানসিকতা একদিকে আমাদের অবচেতনে গেড়ে বসা পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রকাশ। আমরা মনে করি রাষ্ট্র আমাদের পিতাসম। তার কাছ থেকে আমরা চাই সুরক্ষা এবং ন্যায়। কাজেই রাষ্ট্রকে আমরা প্রশ্ন করি না। ধরে নিই যা করছে আমাদের ভালর জন্যেই করছে।

পুলিশ আমাদের চোখে সেই পিতৃতন্ত্রের ক্ষমতার প্রতীক। আমরা চাই কড়া রাষ্ট্র, কড়া পুলিশ। যদি ছাত্রদের কষে বেত না লাগাবে তবে কিসের মাস্টার! যদি অপরাধীদের না পেটাবে তো কিসের পুলিশ! রাষ্ট্র এর সুযোগ নেয়। পুলিশ যাকে ধরে আমরা মেনে নিই যে সে অপরাধী। তাকে সামাজিক বয়কট করি।

কিন্তু খেয়াল করি না যে পুলিশ যাদের রাষ্ট্রবিরোধী এবং ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত বলে জেলে ভরছে তাদের মধ্যে কতজন পরে নির্দোষ প্রমাণিত হয়। কতজনের জীবনের এবং যৌবনের দামি বছরগুলো জেলে পচে শেষ হয়। ছাড়া পেয়ে বেরিয়ে আশে ভাঙাচোরা মানুষ, যাকে কেউ কাজ দিতে চায় না। মিথ্যে অভিযোগে জেল খেটে বিনা ক্ষতিপূরণে মাথা নীচু করে ঘরে ফেরে কতজন?[13]

মানবাধিকার কী, খায় না মাথায় দেয়?

মানবাধিকার কোন আকাশ থেকে খসে পড়া আলাদা আইন নয়। এ হল রাষ্ট্রের একতরফা বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে একা ব্যক্তিমানুষের সুরক্ষার গ্যারান্টি।

অর্থাৎ রাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দেওয়া যে কোন নাগরিকের বিরুদ্ধে সমষ্টির স্বার্থ রক্ষার অজুহাতে তুমি আমার মৌলিক অধিকার কেড়ে নিতে পার না। তুমি ভগবান নও। তোমাকে নিজের আচরনের জন্যে জবাবদিহি করতে হবে ন্যায়ালয়ের কাছে।

আমার সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার, রোজগার করার, যাতায়াত করার, নিজের ইচ্ছে মত ধর্মপালনের, পরিবার প্রতিপালনের যে গ্যারান্টি সংবিধান দিয়েছে আমি কোন অপরাধে অভিযুক্ত হলেও তা স্বতঃ খারিজ হয়ে যায় না।

আমি যেমন নাগরিক হিসেবে আইন মেনে চলতে বাধ্য, রাষ্ট্রও আইন নির্ধারিত পথে চলতে বাধ্য। তা না হলেই মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে। মানবাধিকার সবার রয়েছে; পুলিশেরও আছে। পু

লিশ হিসেবে নয়, ব্যক্তি হিসেবে, এবং রাষ্ট্রের এলোমেলো কাজের বিরুদ্ধে। যেমন সেই পুলিশ মানুষকে যদি লঘু অপরাধে সরকার গুরুদণ্ড দেয়, নিয়মবহির্ভূত ভাবে দূরে ট্রান্সফার করে, ইঙ্ক্রিমেন্ট বা প্রমোশন যোগ্যতা সত্ত্বেও আটকে দেয় ইত্যাদি।

কিন্তু কেউ পাথর ছুঁড়ে আহত করলে সেটা অপরাধ, মানবাধিকার উল্লংঘন নয়। সেই অপরাধের জন্যে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডে শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে।

বুলডোজার দিয়ে কারও পৈতৃক ঘর বা স্ত্রীর সম্পত্তি যে ঘর সেটা বিনা বিচারে ভেঙে দেওয়া একই ভাবে ত্বরিত ন্যায়ের একটি প্রকাশ। এখানে প্রশাসন বিচারবিভাগের এক্তিয়ারে ঢুকে পড়ছে। শাস্তি নির্ধারণের অধিকার তো পুলিশ কেন, প্রশাসনেরও নেই। আদালত সেটা ঠিক করলে প্রশাসন তার প্রয়োগ করবে মাত্র।

এ ব্যাপারে গুয়াহাটি হাইকোর্ট আসাম রাজ্যকে একটি ঘটনায় নোটিশ জারি করেছে।

এছাড়া একজনের দোষে তার পরিবার মায় বাচ্চাদের গৃহহারা করা অবশ্যই সেই মহিলা ও শিশুদের মানবাধিকার লঙ্ঘন। ওরা কোন দোষ না করেও রাষ্ট্রের হাতে শাস্তি পাচ্ছে।

রাষ্ট্রকেও বিধিসম্মত ভাবে কাজ করতে হবে।

মানবাধিকারের অবধারণা রাষ্ট্রকে স্বেচ্ছাচারী হতে বাধা দেয়।

===========================================================================






[1] ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৭ অক্টোবর, ২০২২।


[2] ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৮ অক্টোবর, ২০২২।


[3] ঐ, ৭ অক্টোবর, ২০২২।


[4] ঐ , ২ জুন, ২০২২।


[5] ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২ জুন, ২০২২


[6] এন ডি টি ভি বাংলা, ১০ জুন, ২০১৮।


[7] বিবিসি বাংলা, ১ জুলাই, ২০১৮।


[8] ঐ, ৮ অক্টোবর, ২০২২।


[9] যশোবর্ধন আজাদ, তাঁর ‘দ্য স্কার অফ ইন্সট্যান্ট জাস্টিস’ প্রবন্ধে।


[10] স্ক্রোল ডট ইন, ৬ অগাস্ট, ২০২২।


[11] ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ২৩ অগাস্ট, ২০২১।


[12] হিন্দুস্থান টাইমস্‌ ১১ অগাস্ট, ২০২১।


[13] দ্য ক্যুইন্ট, ‘বাইজ্জত বরী’, ২৫ জানুয়ারি, ২০২২।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - সৌভিক দে

Posted in





ব্যক্তির ভূমিকা ইতিহাসের প্রেক্ষিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঘটনা প্রবাহের কোনো এক বিচিত্র রসায়নে একজন ব্যক্তি একটি বিশেষ ঐতিহাসিক পর্বে প্রধান বা বিশেষ চরিত্র হয়ে ওঠেন। অনেক ক্ষেত্রেই একটি কালপর্ব চিহ্নিত হয় ব্যক্তির পরিচয়ে। এমন চরিত্রদের জন্য ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন ইতিবাচক বিশেষণ। জনমানসে এই প্রতিক্রিয়া কোন নির্দিষ্ট সময়সীমায় বা ভূখণ্ডে থেমে থাকে নি। নানা সময় সাধারণ মানুষ খুঁজে নিয়েছে, নানা বিষয় ভিত্তিক ইতিহাস-পুরুষদের। চৈতন্যদেবের আবির্ভাব বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। উল্লেখযোগ্যও বটে। এই মহামানবের আবির্ভাবে বিগত পাঁচশ বছরের পুঞ্জীভূত গ্লানি, ইতিহাস ও সংস্কৃতির অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘটনা প্রবাহ, ধর্মীয় গোঁড়ামি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য থেকে ম্রিয়মান ও ক্ষয়িষ্ণু বাঙালির সংস্কৃতিকে পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টার কাল বললে বোধ হয় অত্যুক্তি করা হবে না। চৈতন্যের জীবৎকালে, অন্তরঙ্গ ভক্তবৃন্দ তাঁর ঈশ্বরত্ব বিশ্বাস করত। চৈতন্যচরিতকারগণ তাঁকে স্বয়ং ভগবান বলে উল্লেখ করে প্রচার করতে চেয়েছেন –


“শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য প্রভু স্বয়ং ভগবান।
তাঁহার পদারবৃন্দে অনন্ত প্রণাম।।”
(চৈত্যচরিতামৃত : আদি-১-২৪)


কোন ব্যক্তির মধ্যে কিছু পরিমান অসাধারণত্বের সন্ধান মিললেই, তাঁর উপর দেবত্ব আরোপ করার প্রবণতা হিন্দুদের মধ্যে চিরকালীন বৈশিষ্ট্যসমূহের অন্যতম। মধ্যযুগে তা বিপুল মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে বর্তমান সময়, ভগবান চৈতন্যের তুলনায় মানবপ্রেমিক চৈতন্যকেই বেশি পছন্দ করে। কারণ, মানুষের প্রতি গভীর প্রেম চৈতন্য-মতবাদের মূল বৈশিষ্ট্য। চৈতন্যদেবের সমগ্র জীবনলীলা আলোচনা করলে দেখা যায় তিনি একান্তই বাস্তববাদী ও যুগোপযোগী ছিলেন। খোল-করতাল সহযোগে সংকীর্তনের মাধ্যমে বাংলার আপামর জনসাধসরণকে তিনি শুধু সেই যুগের রাজধর্মের ভীতি থেকে রক্ষা করেননি, জাতিভেদ প্রথাকে দূর করে এবং তার সঙ্গে শূদ্র ও স্ত্রীলোকদের হিন্দুধর্ম ভিত্তিক নবপ্রবর্তিত আবেগপ্রবণ ধারায় দীক্ষিত করার ব্যবস্থা করে এক নতুন সমাজ-সংহতির আদর্শ সৃষ্টি করেছিলেন।


চৈতন্যের আকস্মিক তিরোধনের পর তাঁর নামে বিপুল তত্ত্বকথা প্রচারিত ও অধিক ভগবত্তা আরোপিত হওয়ায় মানুষ চৈতন্য চিরকালের জন্য হারিয়ে গেলেন! অথচ চৈতন্য নিজে এসবের বিরোধী ছিলেন। বাসুদেব সার্বভৌম কর্তৃক স্তব ও প্রণাম, অদ্বৈত আচার্যের চৈতন্যলীলা কীর্তন, মথুরাবাসী ব্রাহ্মণের স্তব ও প্রণামগ্রহণ করার তিনি পক্ষপাতী ছিলেন না। তবে চৈতন্য-চর্চা করার সময় মনে রাখতে হবে, মুরারীগুপ্তের কড়চা ব্যতীত অন্যান্য চরিতগ্রন্থগুলি চৈতন্যের মৃত্যুর পর রচিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চরিতগ্রন্থের বর্ণনাসমূহের মধ্যে কিছু কিছু পর্ব আপাতদৃষ্টিতে প্রামাণ্য বলে মনে হলেও, তুলনামূলক বিচারে তা অসমঞ্জস্যপূর্ণ। চরিতকারগণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে উঠতে অক্ষম। আবার কিছু ক্ষেত্রে গোষ্ঠীপ্রধান্য বজায় রাখার ফলে উক্ত রচনাগুলিতে ঔদার্যের অভাব পরিলক্ষিত।


।।১।।


চৈতন্যর পূর্বপুরুষ সিলেট থেকে এসেছিলেন, ওনার সমসাময়িক সমস্ত জীবনীকার তাই বলছেন। ওড়িষ্যার যাজপুর থেকে তাঁরা সিলেটে গিয়েছিলেন – এরকম কোনও কথা চৈতন্যের সমসাময়িক কোনও বাঙালি জীবনীকার বলেন নি। মধ্যযুগের ওড়িষ্যার কবি মাধব পট্টনায়ক প্রথম বললেন, যে চৈতন্যদেবের পূর্বপুরুষ ওড়িষ্যার যাজপুর থেকে সিলেট গেছিলেন। এই মাধব পট্টনায়কই কবি জয়দেবকে ওড়িয়া বলে দাবী করেছিলেন প্রথম। এর থেকে সহজেই অনুমেয় – কেবল মাত্র রসগােল্লাই নয়, বাংলার অনেক কিছুই ওড়িয়ারা আপন করে নিতে চেয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ওরা আংশিক রূপে সফল। এই মাধব পট্টনায়কের বিষয়ে খুব বেশি কিছু জানা না গেলেও, লোকটি চৈতন্যের সময়ে ওড়িষ্যার পঞ্চসখা বৈষ্ণব দলেরই একজন অনুগামী ছিলেন বলে জানা যায়।


এরপর বাঙালি কবিদের মধ্যে প্রথম জয়ানন্দই “চৈতন্যের পূর্বপুরুষ ওড়িয়া ছিলেন” মাধবের এই বক্তব্যটি রিপিট করেন, তারপর থেকে ওই যাজপুরের কথাটা চলছে। চৈতন্য যে শ্রেণীর ব্রাহ্মণ ছিলেন, অর্থাৎ পাশ্চাত্য বৈদিক, সে শ্রেণীর ব্রাহ্মণ ওড়িষ্যায় নেই, কোনদিন ছিলও না। যদিও মিশ্র পদবী ওড়িষ্যায় দেখা যায়, সেখান থেকেই এমন মিথ্যের সূত্রপাত। চৈতন্যের থেকে বয়েসে একটু বড়, চৈতন্যের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী মুরারি গুপ্ত, ‘চৈতন্য কড়চা’ লিখেছেন সংস্কৃত ভাষায়, সেটাই চৈতন্যের প্রথম জীবনীগ্রন্থ। এতে চৈতন্যের পূর্বপুরুষদের যাজপুর থেকে আসার কোন দূরদূরান্তের ইঙ্গিতও নেই। এরপর চৈতন্যের আরও অনেকগুলো জীবনীগ্রন্থ রচিত হয়, সেখানেও এমন কিছুর উল্লেখ নেই। বরং চৈতন্যর পিতা যে সিলেটে ইসলামিক উপদ্রব থেকে বাঁচতে নবদ্বীপে চলে আসেন, সেটা জীবনীগ্রন্থগুলি পড়লে সহজেই বোঝা যায়। মুসলমানদের শাসনে লাঞ্ছিত বৈষ্ণব-সমাজ বঙ্গদেশের নানা প্রান্ত থেকে নবদ্বীপে জড়ো হয়েছিল। তারা সমবেত ভাবে নামসংকীর্তনের মাধ্যমে আরাধ্যের উদ্দেশ্যে দিন বদলের আশায় প্রার্থনা করতো বলেও জানা যায়।


ওই সময়ে আরও অনেক বৈষ্ণব মনোভাবাপন্ন ব্রাহ্মণ সিলেট থেকে নবদ্বীপে চলে এসেছিলেন, নবদ্বীপের চৈতন্য আন্দোলনে এই পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসা মানুষজন একটা বড় ভূমিকা পালন করেছেন। এইসব কারণে আমার ধারণা চৈতন্যের পূর্বপুরুষ সিলেটেরই আদি বাসিন্দা ছিলেন, যাজপুর থেকে তিনি যান নি। তাছাড়া পাশ্চাত্য বৈদিক(“আসী শ্রীহট্ট মধ্যস্থ্যে মিশ্রোমধুকরাভিধঃ । পাশ্চাত্যে বৈদিকবিশ্বেব তপস্বী বিজিতন্দ্ৰিয়ঃ।” – শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যোদয়াবলী) শ্রেণীর ব্রাহ্মণ যে ওড়িষ্যায় মেলে না, সেটা জোর দিয়ে বলছেন চৈতন্য গবেষক বিমান বিহারী মজুমদার এবং মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল। উভয়েই যাজপুর তত্ত্বের প্রবল বিরোধিতা করেছেন এবং উক্ত তত্ত্বকে অসত্য বলেছেন।


১৪০৭ শকাব্দের ২৩ ফাল্গুন দোল পূর্ণিমার সন্ধ্যায় জন্ম নিলেন গোরাচাঁদ। সেই স্মৃতিকে স্মরণে রাখতে বাংলার বৈষ্ণবসমাজ দোল পূর্ণিমাকে বদলে দিলেন গৌরপূর্ণিমায়। চৈতন্যজন্মের প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর পরেও চৈতন্যধাম নবদ্বীপে দোলের দিন তাই শুধুই মহাপ্রভুর আবির্ভাব উৎসব পালিত হয়। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান নিয়ে ১৪৮৬ থেকে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কোনো বিরোধ ছিল না। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ঊনবিংশ শতকের শেষ দশকে এই জন্মস্থান সম্পর্কিত যে মতানৈক্য শুরু হল, তার ফল সুদূর প্রসারী। কৃষ্ণনগরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কেদারনাথ দত্ত জন্মস্থান বিরোধের মুখ্য প্রবক্তা। বৈষ্ণব সাহিত্যের সুপণ্ডিত কেদারনাথ বাঘনাপাড়ার বিপিনবিহারী গোস্বামীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ‘ভক্তিবিনোদ’ উপাধি লাভ করেন। তারপর নবদ্বীপের সন্নিকটে ভাগীরথী নদীর পরপারে জমি কিনে স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে উক্ত স্থানকে মায়াপুর বলে ঘোষণা করেন। তিনি আরও প্রচার করেন যে মায়াপুরই চৈতন্যের জন্মস্থান। মিঞাপাড়া বা মিঞাপুরকে মায়াপুর বলে ঘোষণা করে এমন অপপ্রচারের জন্য তাঁর দীক্ষাগুরুর সঙ্গে মনান্তর ও মতান্তর ঘটে। ফলে গুরু শিষ্যকে বর্জন করেন। তবু নির্বিকার কেদারনাথ ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে সরকারী চাকরি থেকে সেচ্ছাবসর গ্রহণ করে হয়ে উঠলেন আচার্য ভক্তিবিনোদ ঠাকুর। ১৬ জানুয়ারী কৃষ্ণনগরের এ.ভি. স্কুলে এক সভায় মায়াপুর সম্পর্কিত তাঁর বিকৃত তত্ত্ব তিনি ঘোষণা করায়, সভায় উপস্থিত ব্যক্তিবৃন্দ ইংরেজ সরকারের প্রাক্তন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের আচরণে হতচকিত হয়ে নীরব রইলেন। কারণ, কেদারনাথ তাঁদেরই সভায় ডেকেছিলেন যাঁরা তাঁর অনুগত। তিনি তা ভুল বুঝে লিখে গেলেন, ‘সভার সকলে একমত হয়ে মায়াপুরে চৈতন্য মহাপ্রভুর সেবা প্রকাশের অনুমতি দিলেন’।


ঐতিহাসিকদের মতে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর ভদ্রাসন সহ নবদ্বীপের বৈদিকপল্লী গঙ্গা গর্ভে লীন হয়েছে। চৈতন্যদেবের সময় গঙ্গার শাখা নদী ভাগীরথী নবদ্বীপের পশ্চিমে প্রবাহিত ছিল। এখন নবদ্বীপের পূর্বদিকে তা প্রবাহিত। সমস্ত আকর চৈতন্যচরিত গ্রন্থের কোথাও মায়াপুরের উল্লেখ নেই। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে বা তার কাছাকাছি সময়ে নরহরি চক্রবর্তী রচিত ‘ভক্তিরত্নাকর’ গ্রন্থে চৈতন্যের জন্মস্থানের সঙ্গে মায়াপুর নামটি প্রথম যুক্ত হয়। কারণ, ভারতীয় ঐতিহ্যানুসারে অবতারের আবির্ভাব ক্ষেত্রকে ‘মায়াপুর’ বলার রীতি বর্তমান। যেমন – রামের জন্মভূমি ‘অযোধ্যা’ মায়াপুর, কৃষ্ণের ‘মথুরা’ মায়াপুর ইত্যাদি। তাছাড়া আমাদের মনে রাখতে হবে, ‘গঙ্গাগর্ভ থেকে উত্থিত নতুন দ্বীপ’ থেকে নবদ্বীপ কথাটি এসেছে। নবদ্বীপ ন’টা দ্বীপের সমষ্টি নয়। ঠিক যেমন ‘নববৃন্দাবন’ ন’টা বৃন্দাবনের সমষ্টি নয়, তা নতুন বৃন্দাবন। নরহরির বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করে মিঞাপুরকে মায়াপুর করার স্বার্থে এমন প্রচার হয়ে থাকে। নরহরি বৃন্দাবনের অনুকরণে নবদ্বীপ মণ্ডল সাজিয়েছিলেন। তা আজও বহু ভক্ত পরিক্রমা করেন। বৃন্দাবনের দ্বাদশ বনের শেষে যেমন সবই ‘বন’ দিয়ে নামকরণ হয়েছে, তেমনি চৈতন্যের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলিকে নবদ্বীপের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে তিনি ‘দ্বীপ’ আখ্যা দিয়েছেন। যেমন – সীমান্তদ্বীপ, গোদ্রুমদ্বীপ, জহ্নুদ্বীপ ইত্যাদি। নরহরি লিখেছেন, ‘দ্বীপনাম শ্রবণে সকল দুঃখ ক্ষয়।’ নরহরি চক্রবর্তীর ‘ভক্তিরত্নাকর’ গ্রন্থে সপ্তদশ শতব্দীর বৈষ্ণবমণ্ডলী ও কেন্দ্রগুলির একটা সাধারণ পরিচয় পাওয়া গেলেও, প্রকৃত ইতিহাসের দিক দিয়ে তা নির্ভরযোগ্য নয়।


কেদারনাথ দত্তের মৃত্যুর পর তাঁর পঞ্চম সন্তান সাধক ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী মিঞাপুরে ‘শ্রীচৈতন্য মঠ’ প্রতিষ্ঠা করে এই অপপ্রচার চালিয়ে যান। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে ‘মায়াপুর’ নামের সরকারী স্বীকৃতির জন্য, উক্ত নামের ডাকঘর প্রতিষ্ঠা করান। তাঁর শিষ্য ISKCON-এর প্রতিষ্ঠাতা এ. সি. ভক্তিবেদান্ত স্বামী বা ‘শ্রীল প্রভুপাদ’ ১৯৭২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারী গৌর পূর্ণিমা তিথিতে ‘চন্দ্রোদয়’ মন্দিরের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করার পর থেকে ISKCON বা ‘কৃষ্ণভাবনামৃত সঙ্ঘ’ এই মায়াপুর সংক্রান্ত অপপ্রচারের মাত্রা শতগুণে বৃদ্ধি করে। তা আজও চলছে।


১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে নবদ্বীপে চৈতন্যের জন্ম। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে পুরীতে তাঁকে হত্যা করা হয়। তাঁকে হত্যা করার কথা উল্লেখ না থাকলেও বিভিন্ন চরিতগ্রন্থে মহাপ্রভুর জীবনলীলার বিস্তারিত বর্ণনা মেলে। তার মধ্যে কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈত্যচরিতামৃত’-এ বর্ণিত কালক্রম অত্যন্ত স্পষ্ট ও বিস্তারিত –


“শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নবদ্বীপে অবতারি।
আটচল্লিশ বৎসর প্রকট বিহারি।।
চৌদ্দশত সাত শকে জন্মের প্রমাণ।
চৌদ্দশত পঞ্চান্নে হৈল অন্তর্ধান।।
চব্বিশ বৎসর প্রভু কৈল গৃহবাস।
নিরন্তর কৈল কৃষ্ণকীর্তন বিলাস।।
চব্বিশ বৎসর শেষে করিয়া সন্ন্যাস।
আর চব্বিশ বৎসর কৈল নীলাচলে বাস।।
তার মধ্যে ছয় বৎসর গমনাগমন।
কভু দক্ষিণ কভু গৌড় কভু বৃন্দাবন।।
অষ্টাদশ বৎসর রহিলা নীলাচলে।
কৃষ্ণপ্রেম নামামৃতে ভাসাল সকলে।।”
(চৈ. চ. আদি : ১৩/৮-১৩)


ভক্তদের কাছে ‘আদিলীলা’ হল নবদ্বীপের জীবন যাপন এবং ‘শেষলীলা’ হল নীলাচল বা পুরীতে যাওয়ার পর থেকে অন্তর্ধান পর্যন্ত। যদিও অন্তর্ধান নাকি হত্যা – তথ্যসহ তার মীমাংসা করে, এই রচনায় আলোচিত হয়েছে। ‘শেষলীলা’র উপবিভাগ ৬ বছরের ‘গমনাগমন’ বা মধ্যলীলা ও ‘নীলাচলে বাস’ বা অন্তলীলা/অন্তর্দশা। চৈতন্যদেবের জন্ম-সময় নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও – মুরারীগুপ্ত, বাসুদেব ঘোষ, কবিকর্ণপুর ও কৃষ্ণদাস কবিরাজের বিবরণানুযায়ী ১৪০৭ শকাব্দের ২৩শে ফাল্গুন দোলপূর্ণিমা তিথিতে চন্দ্রগ্রহণের পূর্বে তাঁর জন্ম হয়। বিশ্বকোষে মুদ্রিত আছে ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই ফুব্রুয়ারী(জুলিয়ান ক্যালেন্ডার) চন্দ্রগ্রহণ হয়েছিল।


জগন্নাথ মিশ্র ও শচীদেবীর কনিষ্ঠ পুত্রের নাম রাখা হয় বিশ্বম্ভর। ডাকনাম নিমাই। সেই নিমাই যখন আট বছরের বালক, তখন বিবাহে অনিচ্ছুক তাঁর অগ্রজ বিশ্বরূপ সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তার কিছু পরে নিমাইয়ের উপনয়ন সম্পন্ন হয়। তারপর শুরু হয় বিদ্যাশিক্ষারম্ভ। অপ্রামানিক নানা গ্রন্থে প্রচারিত হয়ে আসছে – শ্রীচৈতন্য, রঘুনাথ শিরোমণি, রঘুনন্দন ভট্টাচার্য ও কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ সহপাঠী ছিলেন। তাঁরা একত্রে বাসুদেব সার্বভৌমের টোলে বিদ্যাশিক্ষা গ্রহণ করতেন। এসব তথ্য অমূলক। এগুলির কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। সম্ভবত ১৪২১ শোকের জ্যৈষ্ঠ মাসে জগন্নাথ মিশ্র পরলোক গমন করেন। পিতার অন্তিমদশার সময় তিনি সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে পাড়া-প্রতিবাসীদের সঙ্গে হরিনাম সংকীর্তনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর শচীদেবীর কিছুটা আর্থিক অসচ্ছলতা হয়েছিল বলে জানা যায়। নিমাই আরও কিছুকাল অধ্যয়ন করার পর ষোলো বছর বয়সে মুকুন্দ সঞ্জয়ের চণ্ডীমণ্ডপে টোল স্থাপন করে অধ্যাপনা শুরু করেন। তাঁর প্রতিভা, পণ্ডিত্য ও অধ্যাপনার খ্যাতিতে অল্পকালের মধ্যে উক্ত টোলে বহু ছাত্রের আগমন ঘটে। এর ফলে আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৪২৪ শকাব্দে মাতৃ-ইচ্ছায় বল্লভচার্যের কন্যা লক্ষীপ্রিয় দেবীর সঙ্গে বিশ্বম্ভরের বিবাহ হয়। লক্ষীপ্রিয় দেবীকে আমাদের বিশ্বম্ভর নিজে পত্নীরূপে পছন্দ করেছিলেন। তাঁদের মনের আদান-প্রদানও হয়েছিল। যদিও চৈতন্য-চরিতকারগণ চতুর্দশ শতাব্দীর রক্ষণশীল সমাজের কথা ভেবে প্রেমিক-প্রেমিকার দু’বারের বেশি বিবাহের পূর্ববর্তী সাক্ষাতের বর্ণনা দিয়ে যাননি। শচীদেবীর অবশ্য এই বিবাহে সমর্থন ছিল। বিবাহের বছর দুই পরে পৈতৃক বিষয় সম্পত্তির বন্দোবস্তের স্বার্থে বিশ্বম্ভরকে শ্রীহট্টে যেতে হয়। এদিকে সর্প দংশনে সেইসময়ই লক্ষ্মীপ্রিয়ার মৃত্যু হয়। ফিরে এসে ভারাক্রান্ত বিশ্বম্ভর অধ্যাপনায় মনোনিবেশ করেন। সংসারের প্রতি পুত্রের বীতরাগ দেখে শচীদেবী প্রায় জোড় করেই বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে বিশ্বম্ভর বা নিমাইয়ের বিবাহ দেন।


বেদবেদান্ত আর ন্যায়-বৈশেষিকের চর্চা চৈতন্য মহাপ্রভুর সমকালীন নবদ্বীপকে ভারতবর্ষের অক্সফোর্ড করে তুলেছিল। চৈতন্য মহাপ্রভুও এই ন্যায়-বেদান্তের পরিবেশেই জন্মেছেন। সার্বভৌম ভট্টাচার্যের মতো ন্যায়-বেদান্তী যদি তাঁর জ্যেষ্ঠ সমকালীন হন, তবে তাঁর কনিষ্ঠ সমকালীন সেখানে রঘুনাথ শিরোমণি। কিন্তু চৈতন্য মহাপ্রভু বেদবেদান্তের দিকেও গেলেন না, ন্যায়-বৈশেষিকের পদার্থ-পরমাণু-বিচারের মধ্যেও থাকলেন না। বাল্যকাল থেকেই সমস্ত প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে তাঁর মন বিদ্রোহী হয়ে উঠত। তাঁর জীবনের চর্চার ক্ষেত্রে এরপর যেটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, সেটা হল ধর্ম – তা এমন এক ধর্ম, যা ব্রাহ্মণ্যবাদের বিপরীত মেরুর নিকটবর্তী এক আবেগময় মধুরতর ফল ও লোকধর্মের উচ্চতর পরিশীলিত রূপ। এর পশ্চাতে ছিল এক দীর্ঘ বৈষ্ণব-লাঞ্ছনার ইতিহাস। তৎকালীন মুসলমান শাসককুল ও অবৈষ্ণব হিন্দু পাষণ্ডীদের নেতিবাচক মানসিকতা বৈষ্ণব-সমাজকে প্রায় একঘরে করে রেখেছিল। এমতাবস্থায় ঘুরে দাঁড়াতে গেলে প্রয়োজন একজন নেতা বা অবতারের – নবদ্বীপের বৈষ্ণবরা সেই ধ্রুব সত্যটি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল। যদিও শ্রেণীসংগ্রাম তখন ছিল অচিন্তনীয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বহু চেষ্টায় গড়ে তোলা নেতা বা অবতারেরও জীবনের ক্রমবিকাশ আছে। কেমন অবতার? কৃষ্ণের অবতার। তাহলে, তাঁর মধ্যেও তো কৃষ্ণভক্তি চাই। তাঁকে এমন একটা উচ্চমার্গে উঠতে হবে, যখন তাঁর অবতারত্ব নিয়ে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকবে না। অর্থাৎ, নেতা হতে গেলে তাঁকে সকলের মধ্যে, নেতৃত্বের উপযুক্ত বলে গ্রাহ্য হতে হবে।


১৪৩০ শকাব্দের কার্তিক মাসে গোয়ায় পিতৃশ্রাদ্ধ ও পিণ্ডদান(সম্ভবত অপঘাতে মৃতা স্ত্রীর পিণ্ডদানও এর সঙ্গে করা হয়েছিল) করে, মাধবেন্দ্রপুরীর শিষ্য দশনামী শৈব-সম্প্রদায় ভুক্ত সন্ন্যাসী ঈশ্বরপুরীর নিকট মন্ত্রদীক্ষা গ্রহণ করে বিশ্বম্ভর কেমন বদলে যেতে শুরু করেন। এই সময় থেকে তাঁর রঙ্গপ্রিয়তা ও পাণ্ডিত্যের অহংকার একেবারে অন্তর্হিত হল। শ্রীবাস পণ্ডিত এই ধরনের মানসিক পরিবর্তনকে মহাভক্তিযোগ আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি প্রতিদিন প্রাতঃস্নান, গৃহদেবতা দামোদর শালগ্রাম শিলার পুজো ও উক্ত পুজোয় নিবেদিত খাদ্যবস্তু আহার করতেন। ভাবলে অবাক লাগে, পিতার মৃত্যুর তেরো বছর পর, দ্বিতীয় পত্নী জীবনে আসার তিন বছর পর বিশ্বম্ভর গোয়ায় গেলেন। ‘দৈবযোগ’এ ঈশ্বরপুরীও সেইসময়ই গোয়ায় উপস্থিত হলেন। কেন এমন হল – তার কোনো পুঁথিগত ব্যাখ্যা নেই। লাঞ্ছিত বৈষ্ণব-সমাজের তৎকালীন নেতা বা ‘kingmaker’ অদ্বৈত আচার্যের কৃষ্ণের অবতার অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা এই সময়ই হয়তো বাস্তবায়িত হল। এর শুরু চৈতন্যের জন্মের অনেক পূর্বে হয়েছিল। বিশ্বম্ভরের কৃষ্ণভাবনা, কৃষ্ণভজনা ও হরিনাম সংকীর্তনের ফলে নবদ্বীপ ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জনসাধারণের একটা বিরাট অংশের মনে উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বম্ভরের ভক্তগোষ্ঠিতে সংখ্যাধিক্য ঘটায় নবদ্বীপে এক বিরাট বৈষ্ণবমণ্ডলী গড়ে উঠেছিল। তখন শ্রীবাস পণ্ডিত তাঁকে কৃষ্ণের অনুগ্রহ প্রাপ্ত ভক্ত রূপে ঘোষণা করেন। প্রথম প্রথম স্বগৃহে ও পরে শুক্লাম্বর ব্রহ্মচারীর গৃহে আসর বসত। কিন্তু ভক্তগোষ্ঠীর সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পাওয়ায় শ্রীবাসের গৃহে স্থায়ীভাবে শুরু হল হরিনাম সংকীর্তন। এরপর তার অধ্যাপনা বন্ধ হয়ে গেল। শচীদেবী কনিষ্ঠপুত্রের ভাবান্তরের জন্য অদ্বৈত আচার্যকে দায়ী করতেন। কীর্তনে নিমাইয়ের আবেশ দেখে বৈষ্ণবরা প্রথমে সন্দেহ করলেও, পরে তাঁকে কৃষ্ণের অংশ বা অবতার বলে মনে করতেন।


১৪৩১ শকের আষাঢ় মাসের শেষভাগে গুরুপূর্ণিমার আগের দিন নিত্যানন্দ নামক এক অবধূত সন্ন্যাসীর সঙ্গে বিশ্বম্ভরের সাক্ষাৎ ঘটে, যা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রেক্ষাপটে এক ঐতিহাসিক বিষয়। নিত্যানন্দ বীরভূম জেলার একচক্রা নিবাসী হাড়াই পণ্ডিত ও পদমাবতীর সন্তান। বাল্যে এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে গৃহত্যাগ করে প্রায় বাইশ বছর ভারতের বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করে নবদ্বীপে উপস্থিত হন। বিশ্বম্ভরের সহযোগিতায় অতি অল্পকালের মধ্যেই নবদ্বীপের বৈষ্ণবমণ্ডলী তাঁকে সমাদরে গ্রহণ করে। নিত্যানন্দ নবদ্বীপে স্থায়ীভাবে মাত্র ৭ মাস, বিশ্বম্ভরের সন্ন্যাস গ্রহণের পর ২ মাস এবং নীলাচলে ৪ বার মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের সঙ্গ লাভ করেছিলেন। অবধূত সন্ন্যাসী হয়েও তাঁর ভাবাবেগ, সাংগঠনিক প্রতিভা, ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও লোকচরিত্র জ্ঞান থাকায় অচিরেই তিনি মহাপ্রভুর ভক্তগোষ্ঠীর প্রধান ব্যক্তিতে পরিগণিত হন এবং চৈতন্যের মৃত্যুর পর গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম প্রচারে মুখ্য ভূমিকা নেন। নিত্যানন্দের নবদ্বীপ-আগমনের পূর্বে অদ্বৈত আচার্য, মুরারীগুপ্ত, গদাধর পণ্ডিত, শ্রীবাস পণ্ডিত, নরহরি সরকার, চন্দ্রশেখর ও পুরুষোত্তম আচার্যের প্রভাব যেই পরিমান ভক্তবৃন্দের মধ্যে তৈরি হয়েছিল; তা অবশ্য প্রায় অটুটই ছিল।


মুসলনাম সমাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য তখন প্রয়োজন ছিল এক আন্দোলনের। তার স্বরূপটি কেমন? স্ত্রী, চণ্ডাল, শূদ্রাদির মুক্তি। এ মুক্তি নিতান্ত পুজো-পাঠের মাধ্যমে অসম্ভব। বৃহত্তর কিছু দরকার। সর্বপ্রথম সকলকে ঐক্যবদ্ধ করা দরকার। ক্রমশ বিশ্বম্ভরের আত্মপ্রকাশ বা নেতৃত্বের ভিতর দিয়েই সেই আন্দোলনের স্বরূপটি ফুটে উঠবে। চৈতন্যের উদয়, বাংলার বুকে এক মহত্তম আবির্ভাব। এ এক অবিস্মরণীয় মানবতার প্রকাশ, যার মাধ্যমে তখনকার সমস্ত শ্রেণীর নরনারী বহুদূর অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা অনুভব করল। সকলে মিলে হরিনাম সংকীর্তনই ঈশ্বর আরাধনার একমাত্র সহজ-সরল পথ, মুক্তি লাভের পথ – এই বিশ্বাস ও তার প্রয়োগ যত জনপ্রিয় হতে লাগলো, তত দ্রুত তৈরি হতে থাকলো বিরুদ্ধপথ। নবদ্বীপের স্মার্ত ব্রাহ্মণগণ অব্রাহ্মণদের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের মেলামেশা, ইষ্টগোষ্ঠী স্থাপন ও একত্রে প্রকাশ্যে হরিনাম সংকীর্তন করার বিপক্ষে ছিল। এরই ফলস্বরূপ ১৪৩১ শকে বিশ্বম্ভরকে স্বপার্ষদ কঠিন পরীক্ষার সম্মুখে পড়তে হয়। তাঁদের নামে কুৎসা চরমে উঠলে গৌড়ের সুলতানের প্রতিনিধি কাজী প্রকাশ্যে হরিনাম সংকীর্তন নিষিদ্ধ করে। বিশ্বম্ভর বিপুল সংখ্যক ভক্ত ও অনুরাগীদের নিয়ে স্বগৃহে থেকে হরিনাম সংকীর্তন শুরু করে, সমগ্র নবদ্বীপ পরিক্রমা করে, সিমুলিয়া পল্লী পর্যন্ত যান। সেখানেই মুসলমান অধিবাসীদের সঙ্গে কাজী বসবাস করত। কাজী সব দেখে-শুনে প্রকাশ্যে হরিনাম সংকীর্তনের অধিকার ফিরিয়ে দিল। বিশ্বম্ভরের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ও দৃঢ় মনভাবের পরিচয় পেয়ে বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এক স্থায়ী ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটল। এই আন্দোলনকে বঙ্গসংস্কৃতির নতুন পথের দিশারী বললেও অত্যুক্তি হবে না।


এই সংক্ষিপ্ত সময়ে তিনি যে সহজাত সহজিয়া প্রেমসাধনার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, যে সমাজসংস্কার, ধর্মসংস্কার করে গেছেন, বারবার যুক্তিসহকারে সেসব অনুধাবন করতে হবে। জাতিভেদ আর হানাহানির যুগে, যখন মানুষের আদিম হিংস্র প্রবৃত্তির চতুর্দিকে জয়জয়কার, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে তার মোকাবিলায় চৈতন্য জাগাতে চেয়েছিলেন মানুষের আর এক আদিম বৃত্তিকে – যার নাম প্রেম। তখনকার সমাজের মূলধারার সংস্কারগুলির অধিকাংশকেই চৈতন্য অমান্য করেছিলেন। তাঁর ভক্তিতত্ত্বের মধ্যেই ছিল সাম্যবাদের হৃদয়াবেগ। সেদিকে আমাদের সকলের নজর দেওয়ার খুব প্রয়োজন।


চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্য পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা অসাধারণ দু’টি পারিভাষিক শব্দ তৈরি করেছেন। তাঁকে বলেছেন ‘Cultural Specialist’, ‘Cultural Mediator’। প্রথম শুনলে অবোধ লাগে বটে, কিন্তু তটস্থ হয়ে বিচার করলে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন চৈতন্য মহাপ্রভু। আমাদের দেশে ধর্মের দুটো ধারা আছে। একটা সেই বেদ-উপনিষদের ব্রাহ্মণ্য ধারা, যেটা বিরাট এক আচার-আড়ম্বরতা ধারণ করে আছে। আর দ্বিতীয়টা হল পৌরাণিক ধারা, যা বেদ-উপনিষদকে হৃদয়ে ধারণ করেও মানুষের কাছাকাছি আসা এক লৌকিক ধারার প্রবর্তন করেছে, তারই অবশেষ ফল কিন্তু আমাদের মঙ্গলকাব্যগুলি। চৈতন্যের ধর্মান্দোলন আজ অনেকের কাছেই তেমন কোনো বার্তা বয়ে আনে না। পঞ্চাশ বছর আগের নকশাল আন্দোলনও তেমনি। কিন্তু স্থান-কালের প্রেক্ষিতে শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্বে সেদিন নকশাল আন্দোলন তার ভিত্তি পেয়েছিল। শত শত মেধাবী ছাত্র সেদিন ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করে অনিশ্চয়তা, দুঃখ ও মৃত্যু বরণ করেছিল। তেমনি, স্থান-কালের প্রেক্ষিতে চৈতন্যের ভিত্তি কৃষ্ণপ্রেম। এই দুই আন্দোলনেরই মূল একটা চিরকালীন আবেদন। সেটা হল পুরনোর অস্বাস্থ্যকে ছেড়ে নতুনের স্বাস্থ্যকে লাভ করা। নকশাল আন্দোলন, চৈতন্য আন্দোলনে আছে পরিবর্তন সাধনার সেই চিরকালীন আবেদন। যা চিরকালীন তা সেকেলে হতে পারে না। চৈতন্যের আবেদনও তাই অনাধুনিক নয়।

চৈতন্য সম্বন্ধে আধুনিক মানুষের কৌতূহলের আর একটা দিক থাকতে পারে। তৎকালীন জাতিভেদ আর হানাহানির যুগে, যখন মানুষের আদিম হিংস্র প্রবৃত্তির জয়জয়কার, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে তার মোকাবিলায় চৈতন্য জাগাতে চেয়েছিলেন মানুষের আর এক আদিম বৃত্তিকে – তার নাম প্রেম। কেবলমাত্র কৃষ্ণপ্রেম নয়, ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সেই প্রেম তিনি অকাতরে বিলিয়েছেন। চৈতন্যের সমগ্র জীবনকাল ও কর্মের মধ্যে ১৪৩০ শকের কার্তিক মাস থেকে ১৪৩১ শকের মাঘ মাস পর্যন্ত – মোট ১৬ মাস সময়কাল অত্যন্ত ঘটনা বহুল ছিল। ১৪৩১ শোকের মাঘ মাসের গোড়ার দিকে তিনি গার্হস্থ্য আশ্রমের সর্বশেষ সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেন – যার ফলশ্রুতি স্বরূপ বাংলার সমাজ-সংস্কৃতি, ধর্মীয় আন্দোলন, সাহিত্য-শিল্প ও এক কথায় বাঙালির জাতীয় জীবনে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন সাধিত হয়। উক্ত মাসের শুক্লপক্ষে তিনি সন্ন্যাস-দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন, তার উল্লেখ চৈত্যচরিতামৃত গ্রন্থে রয়েছে –


“চব্বিশ বৎসর শেষ সেই মাঘ মাস।
তার শুক্লপক্ষে প্রভু করিলা সন্ন্যাস।।”


বিশ্বম্ভর কাটোয়ায় কেশবভারতীর নিকট বৈষ্ণবমন্ত্রে সন্ন্যাস-দীক্ষা গ্রহণ করলেন। তাঁর নাম হল শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ভারতী। ইতিহাস জানে এরপর কতদূর সফল তিনি হতে পেরেছিলেন – জীবৎকালে এবং তার পরে। সেই সময়কার বৈরী সমাজ চৈতন্যের কাজকর্ম কীভাবে সামলাতে চেয়েছিল, তাঁর জীবন ও অন্তর্ধানের ইতিহাসে সে ইঙ্গিত রয়েছে। সেই সমাজের সঙ্গে আজকের সমাজের মিল যদি কেউ দেখতে পান, এবং তাকে বদলানোর আবেগ অনুভব করেন, তবে সেই ইতিহাস সম্বন্ধে তাঁর কৌতূহল থাকা স্বাভাবিক।


প্রসঙ্গত চৈতন্যজীবনের দিকে আর একবার ফিরে তাকানো যাক। চৈতন্যের জন্মের সময় বাংলা তথা ভারতবর্ষ হিংসা, বিদ্বেষ ও হানাহানিতে জর্জরিত ছিল। শোষণ ও লুণ্ঠন ছিল অবাধ। জাতিভেদ, সংস্কারাচ্ছন্নতা ছিল সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে হানাহানি লেগেই থাকত। এই বিষয়গুলি আজও রয়েছে, তবে সেদিন এর চেহারা ছিল আরও বীভৎস। তার উপরে, তখন সাধারণ মানুষ ছিল অনেকটাই অসংগঠিত। এই সব ক’টি বিকার মূলত সংস্কারাচ্ছন্নতা থেকেই জন্মায়। সেদিন চৈতন্যের প্রধান কাজ ছিল এই সংস্কারাচ্ছন্নতাকে নির্মূল করা। শোনা যায়, চৈতন্য তাঁর নিজের সমস্ত লেখা একদিন গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, সেজন্য তাঁর স্বরচিত লেখা বিশেষ একটা পাওয়া যায় না। সামান্য যে ক’টি শ্লোক এদিক-ওদিক পাওয়া গেছে তার একটিতে তিনি বলছেন –


“নাহং বিপ্রো ন চ নরপতির্নাপি বৈশ্যো ন শূদ্রো।”
(আমি ব্রাহ্মণ নই, নই নরপতি কিংবা বৈশ্য, নই শূদ্র।)


আর এক জায়গায় বলছেন,
“চণ্ডালহোপি দ্বিজশ্রেষ্ঠঃ হরিভক্তি পরায়ণঃ”
(হরিভক্তি পরায়ণ চণ্ডালও দ্বিজশ্রেষ্ঠ বলে গণ্য।)


আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে ব্রাহ্মণকুলজাত এক ধর্মীয় নেতার পক্ষে সংস্কার ভাঙার এমন উল্লসিত শ্লোক রচনার ঘটনা ঐতিহাসিক। কেননা, স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়েও দেখা গেছে সর্বভারতীয় কোনো কংগ্রেস নেতা কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দিতে সদলবলে আসছেন, সঙ্গে আনছেন ভৃত্যমণ্ডলী ছাড়াও পাঁচটা ব্রাহ্মণ যাতে শুদ্ধাহারের বিঘ্ন না ঘটে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, চৈতন্যের পুরীবাসের কালে ব্রাহ্মণসন্তান জগন্নাথদাস তাঁর কাছে দীক্ষা নিতে চাইলে, তিনি বলরামদাসকে নির্দেশ দেন সেই দীক্ষা দেওয়ার জন্য। তাঁর নির্দেশ শিরোধার্য হয়েছিল। কিন্তু গুরু বলরামদাস ছিলেন শূদ্র। তবে, স্বাভাবিকভাবেই তাঁর এই আচরণকে রাজা প্রতাপরুদ্রের কুলগুরু কাশী মিশ্র ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ বলে মনে করেছিলেন। চৈতন্যের আচরণে ব্রাহ্মণ সমাজের বিরক্তি কৃষ্ণদাস কবিরাজের লেখনীতে ধরা আছে –


“এই ত সন্ন্যাসীর তেজ দেখি ব্রহ্ম-সম।
শূদ্রে আলিঙ্গিয়া কেন করেন ক্রন্দন।।”


ব্রিটিশ আমলে কেন, আজও যেখানে অনেক উচ্চশিক্ষিত প্রবাসী ভারতীয় প্রচুর খরচা করে দেশ থেকে খাঁটি ব্রাহ্মণ নিয়ে গিয়ে পুজো করান। আমাদের দেশে যেখানে তথাকথিত রেনেশাঁসের যুগেও অনেক বৈপ্লবিক ধর্মনেতা ও সমাজনেতা তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে প্রথাসিদ্ধ সংস্কার মেনে চলতে বাধ্য হয়েছেন কম-বেশি; সেখানে রঘুনাথদাসকে শালগ্রাম শিলাস্বরূপ গিরি গোবর্ধনের শিলাদান করে, রঘুনাথকেই তার পুজোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন চৈতন্য। এই রঘুনাথদাসও ছিলেন শূদ্র। চৈতন্যের এই আচরণে রাজকুলগুরু কাশী মিশ্র চৈতন্যের উপর ক্রোধ প্রকাশ করেছিলেন।

তখনকার সমাজের মূলধারার সংস্কারগুলির অধিকাংশকেই চৈতন্য অমান্য করেছেন। এই না মানাটা ছিল না তত্ত্বগত। তাঁর ভক্তিতত্ত্বের মধ্যেই ছিল অভেদের হৃদয়াবেগ। চৈতন্যের এই আবেগপূর্ণ সাম্যবাদ – সেদিন বাংলার স্মার্তসমাজকে রুষ্ট করেছিল, রুষ্ট করেছিল ওড়িশার স্মার্তসমাজকেও। এছাড়াও তেমন মানুষও আছেন যাঁরা স্মার্ত নন কিন্তু অন্যতর ভেদের উপর ভিত্তি করে সামাজিক প্রতিপত্তির অধিকারী। তাঁদেরও চৈতন্যের বাণীতে বিগলিত হওয়ার কথা নয়। চৈতন্য যখন বলেন,


“তৃণাদপি সুনীচেন তরোরপি সহিষ্ণুনা।
অমানিনা মানদেন কীর্তনীয়ঃ সদাহরিঃ।।”


তখন যাঁরা ইতিমধ্যেই সামাজিক ক্ষমতা অর্জন করে বসে আছেন তাঁদের এই বাণীতে বিগলিত হওয়ার কিছু থাকে না। সেটা এইজন্যও আরও – যে এসব কথা চৈতন্য তাত্ত্বিকভাবে বলেন নি, বলেছিলেন এক আন্দোলনের সক্রিয় নেতার অবস্থান থেকে। ফলে, তিনি যতই গুণের অধিকারী হোন – জীবন দিয়ে যা বলে চলেছেন, তা নিরঙ্কুশ জনপ্রিয় না হতেই পারে। কার্যক্ষেত্রে তা হয়ও নি।


চৈতন্য ছিলেন সংবেদনশীল এক পুরুষ। বাল্য ও কৈশোরে তাঁর জীবনযাপনের চারি ধারে তিনি প্রথাসর্বস্ব ও স্থূল সমাজ দেখেছিলেন। তাঁর মন সেই সবকে ছাড়িয়ে এক প্রীতিপূর্ণ জীবনের সন্ধান করেছিল। রবীন্দ্রনাথ যেমন পুজো-আচ্চা থেকে নিজেকে দূরে রেখে নাচ-গান, অভিনয়, বৃক্ষরোপণ উৎসব, ঋতুবন্দনা, হল-কর্ষণ উৎসবের মধ্য দিয়ে জীবনযাপনের ছন্দ খুঁজেছিলেন – তেমনি চৈতন্যও সেই যুগের কুসংস্কারাচ্ছন্নতাকে কাটিয়ে নতুন এক সংস্কার রচনা করতে চেয়েছিলেন, যা হবে সঙ্কীর্ণতা ও হিংসা থেকে দূরতম রুচির এক জীবনযাপনশিল্প। তার মধ্যে ছিল নগরসঙ্কীর্তন, ছিল সঙ্গীত ও কাব্যচর্চা। এইগুলিই আধ্যাত্মিকতার বাতাবরণে সাধন করতে ব্যয়িত হয়েছিল চৈতন্যের জীবন।


এই চৈতন্যজীবনের পরিণামে পরবর্তীকালের পরিশীলিত বাঙালি জীবনের সাহিত্যে, সঙ্গীতে ও জীবনবোধে তাঁর একক ব্যক্তিত্বের একছত্র প্রভাব সর্বত্র লক্ষ্য করা যায়। এমনকি রবীন্দ্রসাহিত্য থেকে “ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে” যদি বৈষ্ণব উপাদানকে আলাদা করা সম্ভব হত – তাহলে আর যাই হোক, যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা জানি – তাঁকে পাওয়া সম্ভব হত না। মনে রাখতে হবে যে, যে-দুশো কুড়ি জন মুসলমান কবি বৈষ্ণব পদরচনায় হাত দিয়েছিলেন – তা সম্ভব হয়েছিল, চৈতন্যভাবনার প্লাবনে সঞ্চিত সাম্যবাদী-পলি থেকে। লালন ফকির ভালবাসায় তোলপাড়-করা ওই আবেশ কোথায় পেয়েছিলেন – সে বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গেলেও, এই প্লাবনের পরিণামের কথাই সামনে এসে যায়।


।।২।।


চৈতন্য যে কাজ হাতে নিয়েছিলেন – তাতে রাজশক্তির, অর্থাৎ রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্রব এড়িয়ে চলা অসম্ভব ছিল। নীলাচল পূর্ববর্তী তাঁর জীবনের প্রথম চব্বিশ বছরে এই সংস্রব ঘটেছিল বাংলার নবাব হুসেন শাহ’র সঙ্গে। সেই সংস্রবে প্রথমে ছিল দ্বন্দ্ব, পরে সন্ধি। ফলে, তাঁর বাংলায় থাকাকালীন তৎকালীন রাজশক্তি ছিল তাঁর অনুকূল। কিন্তু অনুকূল ছিল না ব্রাহ্মণ্যসমাজ। তাঁর প্রাণহানির আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল জন্মভূমিতেই। তারপর শ্রীকৃষ্ণ-স্মৃতি বিজড়িত মথুরা-বৃন্দাবন বা দ্বারকার বদলে তিনি কর্মক্ষেত্র রূপে পুরীকে বেছে নিতে বাধ্য হন এবং ১৫১০ খৃস্টাব্দে, মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে, সন্ন্যাস গ্রহণের পর, তিনি তাঁর দলবল নিয়ে পুরীতে উপস্থিত হন। এই সময় বাংলার নবাব হুসেন শাহ’র সঙ্গে ওড়িশার রাজা প্রতাপরুদ্রদেবের যুদ্ধ চলছিল। বাংলা থেকে পুরী যাওয়ার পথে, স্থানে স্থানে অবরোধ তৈরি করা হয়েছিল এবং বাংলা থেকে আগত অনেক ব্যক্তিকে গুপ্তচর সন্দেহে হত্যা করা হচ্ছিল। সেই হত্যালীলার পথ বেয়ে সেদিন চৈতন্যের সঙ্কীর্তনের দল পুরীতে প্রবেশ করেছিল।


শ্রীচৈতন্য ১৪৩১ শকাব্দের ফাল্গুন মাসের শেষের দিকে জগন্নাথক্ষেত্রে উপস্থিত হন। কালবিলম্ব না করে বিগ্রহ দর্শনের নিমিত্ত মন্দিরে প্রবেশ করেন এবং বিগ্রহ দর্শন মাত্র, তা আলিঙ্গনের ইচ্ছায় অগ্রসর হলে – পাণ্ডা দ্বারা বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে মুর্ছিত হন। উড়িষ্যার তৎকালীন রাজপণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌম সেই সময় মন্দিরে উপস্থিত ছিলেন। এই অজ্ঞাত পরিচয় নবীন সন্ন্যাসী সম্পর্কে কৌতুহলী হয়ে, তাঁকে রক্ষা করেন। পরে বাল্যবন্ধু নীলাম্বর চক্রবর্তী এই দৌহিত্রকে স্বগৃহে নিয়ে এসে বাসুদেব সার্বভৌম টানা সাত দিন ধরে চৈতন্যকে শুনিয়েছিলেন ব্রহ্মসূত্রের ব্যাখ্যা। কিন্তু চৈতন্য মহাপ্রভুর কোনও কথা না বলে চুপ করে শুনে যাচ্ছিলেন। অষ্টম দিনে সার্বভৌম জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি কিছুই বুঝতে পারছো না? এরপর শ্রীচৈতন্যের মুখে ব্রহ্মসূত্রের সেই আশ্চর্য ব্যাখ্যা, যার জন্য শুধু সার্বভৌমই নয় সারা ভারতবর্ষ অপেক্ষা করছিল। জ্ঞান ও আচারসর্বস্ব আধ্যাত্মিকতায় শ্রীচৈতন্য প্রবাহিত করালেন নতুন চেতনার স্রোত। ভগবানকে নামিয়ে নিয়ে এলেন মানুষের প্রাণের কাছাকাছি। জ্ঞানের অনেক ওপরে তিনি স্থাপন করলেন সংস্কারমুক্ত প্রেমকে। এই চূড়ান্ত সাম্যবাদী আদর্শকে অস্বীকার করতে পারলেন না সার্বভৌম। চুরমার হয়ে গেল তার পাণ্ডিত্যের অহংকার। আত্মসমর্পণ করলেন তিনি। কথিত আছে, এরপর চৈতন্য মহাপ্রভুর ষড়ভূজ রূপ দর্শন করেন পণ্ডিত সার্বভৌম। এই রূপে ছিল একই দেহে কৃষ্ণ, রাম ও চৈতন্যের সমন্বয়। চৈতন্য মহাপ্রভুর ষড়ভূজ রূপটি বেশ বৈচিত্রপূর্ণ। যদিও চৈতন্যদেবকে যে যেমন পেরেছেন, তাদের রুচি অনুযায়ী রূপায়িত করেছেন! কেউ তাঁকে দুর্গা বা নৃসিংহ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তো কেউ আবার তাঁর রাধাভাব হতো বলে – তাঁকে প্রায় সমকামীদের দলভুক্ত করে দিয়েছেন! তাঁর অধিকাংশ জীবনীকার – তাঁর উপর শ্রীকৃষ্ণের বৈশিষ্ট্যসমুহ আরোপ করেছেন। আর আমরা আমাদের পছন্দানুযায়ী তা নিয়ে কল্পনা করেছি, যুক্তি সাজিয়েছি, কথা বলেছি, তর্ক করেছি! এই সবের মধ্যে ব্যক্তি চৈতন্য ও তাঁর অবদানগুলি গেছে হারিয়ে!


পুরীতে বাসুদেব সার্বভৌমের গৃহে অষ্টাদশ দিবস অবস্থিতির পর চৈতন্যদেব দক্ষিণ ভারত ভ্রমণের ইচ্ছা হয়। ভক্তিবাদের লীলাভূমি দক্ষিণ ভারতে ভক্তিমার্গীয় মত ও পথ সম্যকরূপে উপলব্ধি করতে আগ্রহী চৈতন্যের উক্ত অঞ্চল থেকে ভক্তিশাস্ত্র সংগ্রহেরও ইচ্ছা ছিল। তখন বঙ্গদেশে শ্রীমদ্ভাগবত ব্যতীত অন্য কোনো ভক্তিশাস্ত্রের প্রচলন ছিল না। ১৪৩২ শকের বৈশাখ মাসে তিনি সেতুবন্ধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তারপর আলালনাথ দর্শন করে বিদ্যানগরে রায় রামানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উভয়ের মধ্যে ভক্তিবাদ ও সাধ্যসাধন তত্ত্বের যে সমস্ত গূঢ় আলোচনা হয়, তা পরবর্তীকালে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের বিশিষ্ট মতবাদে পরিগণিত হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, তাঁর গৌড়ীয় পরিকরগণের মধ্যে তত্ত্বকথা বা দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনা করার মত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি বিশেষ কেউ ছিল না। শ্রীচৈতন্যের দক্ষিণ ভারত ভ্রমণের সময় বাকি উল্লেখযোগ্য ঘটনা – পাণ্ডুপুরে মাধবেন্দ্রপুরীর শিষ্য রঙ্গপুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার ও শঙ্করারণ্যের অপ্রকট সংবাদ সংগ্রহ, পয়োস্বিনী নদীতীরের আদি কেশব মন্দিরে ব্রাহ্মসংহীতার পুঁথি সংগ্রহ, বিল্বমঙ্গলঠাকুর বিরচিত কর্ণামৃত পুঁথি উদ্ধার এবং এই সমস্ত অঞ্চলের বৈষ্ণব সমাজের সাধন-ভজন রীতি প্রত্যক্ষ করে অভিজ্ঞতা লাভ। এ সবই উত্তরকালের কার্য নির্ধারণের সহায়ক। ১৪৩৪ শকের রথযাত্রার পূর্বে মহাপ্রভু নীলাচল বা পুরীতে ফিরে আসেন।


চৈতন্যদেবের উদ্যোগে বাংলা, ওড়িষ্যা ও দক্ষিণ ভারতে বহু শাক্ত, শৈব, এমনকি বৌদ্ধ ও জৈন ভাবধারার মানুষ বৈষ্ণব ধর্মে যুক্ত হলেন। নবদ্বীপের পুরুষোত্তম আচার্য বারণসীতে সন্ন্যাস-দীক্ষা নিয়ে সেইসময় পুরীতে চলে আসেন। পরবর্তীকালে ইনি চৈতন্যের মরমী সঙ্গেই স্বরূপ দামোদর নামে প্রসিদ্ধ হন। এদিকে দাক্ষিণাত্যে প্রেমধর্ম প্রচার করবার সময় রাজমহেন্দ্রীর প্রশাসক রায় রামানন্দ, চৈতন্যের সান্নিধ্যে আসার পর রাজ-কাজে ইস্তফা দিয়ে পুরীতে চলেন আসেন চৈতন্যের সঙ্গী ও সেবক হবেন বলে। ততদিনে বাসুদেব সার্বভৌমের ঐকান্তিক ইচ্ছায় ও রাজানুরোধে পুরীতে কাশীমিশ্রের বাগান-বাড়িতে চৈতন্য থাকতে শুরু করেছেন। ১৪৩৪ শকের রথযাত্রার সময় থেকে বঙ্গদেশের ভক্তগণ শ্রীচৈতন্য ও জগন্নাথ দর্শনার্থে পুরী আসা শুরু করল। মহাপ্রভুর প্রায় ২৪ বছরের সন্ন্যাস-জীবনে ১৯/২০ বার বঙ্গীয় ভক্তগণ রথযাত্রার সময় পুরীতে এসেছিল। প্রথমবারের দলে আগত উল্লেখযোগ্য ভক্তের নাম হরিদাস ঠাকুর। তিনি আর বঙ্গদেশে ফিরে যান নি। এই সময় থেকেই লোকশিক্ষার নিমিত্তে গৌড়ীয় ভক্তদের নিয়ে চৈতন্যদেব স্বহস্তে গুণ্ডিচা মার্জনা করতেন। রাজা প্রতাপরুদ্রের বারংবার আকুতিতে সন্তুষ্ট হয়ে ১৪৩৫ শকাব্দের রথযাত্রার সময়ে কাশীমিশ্রের বাগান-বাড়িতে মহাপ্রভু রাজার সঙ্গে দেখা করেন।


ক্রমে চৈতন্যকে ঘিরে চৈতন্যের অগোচরে রাজ্যশাসন ব্যাপারে একটি বিষয় ক্রমে ক্রমে দানা বেঁধে উঠতে শুরু করল। ১৫০৯ খৃস্টাব্দে(১৪৩০ শকাব্দে) হুসেন শাহ যখন ওড়িশা আক্রমণ করেন, তখন প্রতাপরুদ্র তাঁর সেনাপতি গোবিন্দ বিদ্যাধর ভৈ-এর হাতে উত্তর ওড়িশার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে দক্ষিণ ভারতে পেন্নুর নদীর তীরে রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের আক্রমণ ঠেকাতে ব্যস্ত ছিলেন। গোবিন্দ বিদ্যাধর সুলতানি আক্রমণে পরাজিত হন এবং সারঙ্গগড় দুর্গে আশ্রয় নেন। সুলতানি বাহিনী বিনা বাধায় পুরী অবধি পৌঁছে যায়। যে সময় চৈতন্য পুরী পৌঁছান, সেই একই সময়ে বা তার কিছু পূর্বে প্রতাপরুদ্র ঝড়ের বেগে কটকে এসে পৌঁছান এবং তাঁর প্রবল আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে পিছু হটতে হটতে সুলতানি বাহিনী গড়মান্দারণে আশ্রয় নেয়। প্রতাপরুদ্র সেই দুর্গ অবরোধ করে, সেই অবরোধ রক্ষার দায়িত্ব গোবিন্দ বিদ্যাধরের হাতে তুলে দিয়ে দাক্ষিণাত্যে আক্রমণ প্রতিহত করতে আবার ফিরে যান। এদিকে প্রতাপরুদ্রের অবর্তমানে হুসেন শাহ’র সেনাপতি ইসমাইল গাজির সঙ্গে গোবিন্দ বিদ্যাধরের সম্ভবত কোনো গোপন বোঝা-পড়া হওয়ায় অবরোধ তুলে নেওয়া হল এবং হুসেন শাহ’র অধিকার মান্দারণ অবধি বিস্তৃত হয়ে পড়ল। দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধ ও রাজত্বের অন্যত্র বহু সামন্তরাজার বিক্ষুব্ধ অবস্থানে বিধ্বস্ত প্রতাপরুদ্র, বিদ্যাধরের এই আচরণে প্রবল অসন্তুষ্ট হলেও – তাঁকে শাস্তি না দিয়ে, কলিঙ্গ প্রদেশের রাজ্যশাসনভার অর্পণ করে – তাঁর মন জয় করে বশ্যতা আনার প্রয়াস করলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সমগ্র উত্তর ভারত মুসলিম শাসকদের দখলে চলে এলেও; সেদিন পর্যন্ত উত্তর-পূর্বে কামরূপ এবং দক্ষিণে উড়িষ্যা ও বিজয়নগর সাম্রাজ্য ছিল হিন্দু রাজাদের অধীনে।


কামরূপকে আলাদা করে আলোচনায় রাখলে, আমরা দেখব – দক্ষিণের দুই হিন্দু রাজা পরস্পরের সঙ্গে দীর্ঘদিন লড়াইতে নিযুক্ত। ওদিকে বিজাপুর ও এদিকে গৌড়ের মুসলিম শাসকদের আক্রমণকে প্রতিহত করতে বিজয়নগর ও উড়িষ্যার রাজাদের মধ্যে মিত্রতার পরিবেশ তৈরি হওয়া জরুরী ছিল। গোপনে এই দৌতকার্য করলেন চৈতন্যদেব। মাধবেন্দ্র পুরী, ঈশ্বরপুরী এবং কৃষ্ণদেব রায়দের মাধ্ব গুরুর সহায়তায় এই কার্য সফল হল একপ্রকার। ১৫১০-১৫৩০ দুই রাজার মধ্যে কোনো যুদ্ধ সংঘটিত হল না। প্রতাপরুদ্রের কন্যার সঙ্গে বিবাহ হল কৃষ্ণদেব রায়ের। ধার্মিক হিন্দুদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, অন্ধ্র, ওড়িষ্যা সহ বাংলার মেদিনীপুর, হাওড়া ও হুগলীর কিছু অঞ্চল জুড়ে এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল রইল।


১৪৩৬ শোকে তিনি বঙ্গদেশে গিয়েছিলেন। এর তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল – প্রথম, জন্মভুমি-দর্শন। দ্বিতীয়, জ্যেষ্ঠভ্রাতা শঙ্করারণ্যের সংবাদ প্রদান। এর জন্য তিনি শচীদেবীর কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। তৃতীয়, গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের শাস্ত্রীয় ও দার্শনিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা এবং ভক্তিশাস্ত্র রচনা ও প্রচারের জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন সমমতাবলম্বী কয়েকজন উদারচেতা পণ্ডিত ব্যক্তি নির্বাচন। বাংলার সুলতানের উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী সনাতন ও তাঁর ভ্রাতা রূপের সঙ্গে মহাপ্রভুর সাক্ষাৎ ঘটে। ১৪৩৭ শকে এঁদের সাহায্যে চৈতন্যদেব, মথুরা-বৃন্দাবন অঞ্চলে বৈষ্ণব ধর্মের জাগরণ ঘটালেন। বৃন্দাবন থেকে প্রত্যাবর্তনের পর মহাপ্রভুর মানসে কৃষ্ণভাবনায় পরিবর্তন ঘটে। বৃন্দাবনের গোপীদের মধ্যে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ স্থানের অধিকারিণী, সেই রাধাঠাকুরাণী যেরূপে সর্বস্ব সমর্পণপূর্বক কৃষনসেবা করতেন – অনুরূপভাবে রাধভাবে পরমপুরুষ কৃষ্ণের প্রতি প্রেমভক্তি সমর্পণ করে কৃষসেবায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, রাধাঠাকুরাণীকে এক উচ্ছস্থানে অভিষিক্ত করলেন। সমগ্র ভারতের বৈষ্ণব-সংস্কৃতিতে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের এটাই শ্রেষ্ঠ অবদান।


এর পর ১৫১৪ খৃস্টাব্দে(১৪৩৫ শকাব্দে) জানা গেল হোসেন শাহ আবার ওড়িশা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। খবর শুনে প্রতাপরুদ্র এখন গৌড় আক্রমণ করতে চাইলেন। কিন্তু প্রেমধর্ম প্রচার করছেন যে চৈতন্য, তাঁরই পরামর্শে প্রতাপরুদ্র সে ইচ্ছা ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। প্রতাপরুদ্রকে এই পরামর্শ দেওয়ার পরে ওই বছরেই বিজয়া দশমীর দিন বৃন্দাবন যাওয়ার পথে হুসেন শাহ’র রাজধানী গৌড়ের কাছেই সদলবলে একদিন ঘাঁটি গাড়লেন চৈতন্য। হয়তো যুদ্ধেচ্ছু হুসেন শাহকে ঠেকা দেওয়ার ইচ্ছা ছিল তাঁর। এইখানে হুসেনশাহ’র ব্যক্তিগত সচিব দবীর খাস ও রাজস্ব বিভাগের অধিকর্তা সাকর মল্লিক রাতের অন্ধকারে ছদ্মবেশে চৈতন্যের সঙ্গে দেখা করলেন।


এই সাক্ষাতের পরদিনই চৈতন্য বৃন্দাবনে না গিয়ে নীলাচলে ফিরে গেলেন এবং তার কয়েকদিনের মধ্যেই হুসেন শাহ’র এই দুই মহামন্ত্রী গোপনে গৌড় ছেড়ে পালালেন। পরবর্তী কালে এরাই ছয় গোস্বামীর প্রধান দুই গোস্বামী সনাতন ও রূপ নামে বিখ্যাত হন। দবীর খাস ও সাকর মল্লিকের নিষ্ক্রমণে হুসেন শাহ’র অভীপ্সিত যুদ্ধ পিছিয়ে যায় এবং যুদ্ধপ্রস্তুতির জন্য প্রতাপরুদ্রও কিছুটা সময় হাতে পেয়ে যান। অবশেষে এই দুই মহামন্ত্রীর সাহায্য ছাড়াই ১৫১৫ খৃস্টাব্দের(১৪৩৬ শকাব্দে) শেষের দিকে হুসেন শাহ ওড়িশা আক্রমণ করেন। সেই যুদ্ধে হুসেন শাহ পরাজিত হলেন। সেই যুদ্ধই হয়ে দাঁড়ায় হুসেন শাহ’র শেষ ওড়িশা যুদ্ধ। হুসেন শাহ’র পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে গোবিন্দ বিদ্যাধরের কৌশলে ওড়িশা অধিপতি হয়ে ওঠার স্বপ্নও বিফল হল। এই ঘটনায় চৈতন্য হয়ে উঠলেন “প্রতাপরুদ্র সংত্রাতা” – অর্থাৎ, প্রতাপরুদ্রের রক্ষক।


অনুমান করা যায়, প্রতাপরুদ্র ও হুসেনশাহ’র মধ্যে এই যুদ্ধটা ঘটিয়ে তোলার পরিকল্পনাটা গোবিন্দ বিদ্যাধরের মস্তিষ্কপ্রসূত। এতে তিনি কৌশলে ওড়িশার সিংহাসন দখল করতে পারতেন। চৈতন্যের সক্রিয় হস্তক্ষেপে এই ছক ব্যর্থ হয়ে যাওয়ায়, গোবিন্দ বিদ্যাধরের সব ক্ষোভ গিয়ে পড়ল চৈতন্যের উপরে। বিদ্যাধর লক্ষ্য করলেন যে, রাজ্য পরিচালন ব্যাপারে রাজা প্রতাপরুদ্র চৈতন্যের প্রতি নির্ভরশীল। জনগণের চোখে প্রতাপরুদ্র যেন নামেই রাজা, আসল রাজা হয়ে দাঁড়িয়েছেন গেরুয়াবসনধারী এই চৈতন্যই। বিদ্যাধরের এও মনে হল যে, চৈতন্য থাকতে তিনি আর প্রতাপরুদ্রকে স্পর্শ করতে পারবেন না। চৈতন্যের মৃত্যু হলে সেটা হয়তো সম্ভব। মনে রাখতে হবে, শ্রীচৈতন্যদেব ১৪৩৮ শকের জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে ১৪৫৫ শকের আষাঢ় মাস পর্যন্ত পুরীধামেই অবস্থান করেন। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, শ্রীচৈতন্যের তিরোভাবের আষাঢ় মাসে হওয়ায়, বিশেষজ্ঞগণের মতানুযায়ী নিয়ম ম শকাব্দের সঙ্গে ৭৮ যোগ করে ইংরেজি বর্ষ ধার্য করা উচিত। তাই তিরোভাব সাল ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দ ধরা হয়। এই বিশেষজ্ঞগণই শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব ও সন্ন্যাস-দীক্ষা যথাক্রমে ফাল্গুন ও মাঘ মাসে হওয়ায় শকাব্দের সঙ্গে ৭৯ যোগ করেন। কারণ, শকাব্দের সঙ্গে ৭৮ যোগ করে খ্রিস্টাব্দ নিরূপন হলেও, পৌষ মাসের মাঝামাঝি থেকে চৈত্র সংক্রান্তি পর্যন্ত সময়কালে শকাব্দের সঙ্গে ৭৯ যোগ করাই নিয়ম।


সে যুগেও পুরোহিততন্ত্র প্রবল ছিল। রাজ্যশাসন ব্যাপারে জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডা বাহিনীর বিপুল ভূমিকা থাকত। স্বয়ং জগন্নাথ নাকি রাজা নির্বাচন, রাজ্যশাসন প্রভৃতি ব্যাপারে পাণ্ডা মারফৎ স্বপ্নযোগে নির্দেশ পাঠাতেন। অর্থাৎ, পরোক্ষে থেকে পাণ্ডাবাহিনীই রাজনীতির নিয়ন্তা ছিল। চৈতন্যের ব্যক্তিত্বে আকৃষ্ট হয়ে প্রথম দিকে তাঁদের মুগ্ধতা ঘটলেও – চৈতন্যের উপস্থিতিতে তাঁদের গুরুত্ব ক্রমশ হ্রাস পেতে শুরু করলে, চৈতন্যের প্রতি তাঁদের সেই মুগ্ধতাতেও ক্রমশ ভাটা পড়া শুরু হয়ে যায়। চৈতন্যের জাতিভেদ না মানা এবং জগন্নাথ মন্দিরে আচণ্ডাল প্রবেশাধিকার লাভ করুক, তাঁর এই ইচ্ছা জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডাসমাজ এবং ব্রাহ্মণ ও অভিজাতদের ক্রমশ তাঁর প্রতি বিমুখ করে তোলে।


সেদিন চৈতন্যের ভক্তি আন্দোলন এমন সর্বপ্লাবী হয়ে উঠেছিল – যে পঞ্চসখা সম্প্রদায়ের অচ্চুতানন্দ, পুরী থেকে প্রায় কুড়ি মাইল উত্তরে প্রাচী নদীর তীরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে এক গোপন সভার আয়োজন করেন। সেই সভায় সেই সব সম্প্রদায়ের নেতাদেরই ডাকা হয়েছিল, যাদের অন্তরে রাজানুগ্রহের অভাব ও চৈতন্যের প্রতি প্রতাপরুদ্রের সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে বিরক্তি বা হিংসা জন্মেছিল। সভার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, কোনো একটি বিশেষ ধারার(অর্থাৎ, চৈতন্যআন্দোলন) যাত্রাপথে, অন্যান্য ধর্মীয় স্রোতগুলি যাতে ধ্বংস না হয় – তার উপায় খোঁজা। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে, এই সম্প্রদায়গুলি তাদের হারানো প্রতিপত্তি ফিরে পেতে চৈতন্যবিরোধী কার্যকলাপে পরোক্ষে জড়িয়ে পড়তে পারে এবং তাতে গোবিন্দ বিদ্যাধরের ষড়ন্ত্রের পথ সুগম হয়ে উঠতে পারে।


প্রতাপরুদ্র যুদ্ধপ্রিয় রাজা ছিলেন। কিন্তু চৈতন্যের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের পর থেকে তাঁর রাজ্যের ভৌগোলিক সীমানা যে সঙ্কুচিত হয়ে চলেছিল, সেটা একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা এবং সেই কারণে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতা বাড়ছিল – তাও সত্যি। এতে গোবিন্দ বিদ্যাধরের চৈতন্য ও প্রতাপরুদ্র-বিরোধী প্রচার, পায়ের তলায় শক্ত মাটি পাচ্ছিল। গোবিন্দ বিদ্যাধর যে মান্দারণের অবরোধ তুলে নিয়ে প্রতাপরুদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন, সেই খবর সাধারণ ওড়িশাবাসীর জানবার কথা নয়। ওড়িশাবাসী তাঁর সম্বন্ধে এইটাই জানতেন যে, সুলতান বাহিনী যখন পুরীর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তখন তিনিই মন্দিরের গোপন সুড়ঙ্গপথ দিয়ে বিগ্রহগুলিকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে – মুসলমানদের হাতে অপবিত্র হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেন এবং বিগ্রহগুলিকে দোলায় চড়িয়ে সংকট কালে চিল্কায় নিয়ে গিয়ে চড়াইগুহা পর্বতে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর এই আচরণ স্মার্ত ও অভিজাতদের তাঁর প্রতি অনুকূল করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই।


বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ পড়ে অনুভব করেছি, রাজা প্রতাপরুদ্রের সঙ্গে চৈতন্যের ঘনিষ্ঠতার পর থেকে চৈতন্যই উৎকল, আর উৎকলই চৈতন্য হয়ে গিয়েছিল। চৈতন্যের জনপ্রিয়তার কারণে, তিনি বহু ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের চক্ষুশূল হয়েছিলেন। গোবিন্দ বিদ্যাধরের সঙ্গে তাদের মধ্যে যেমন ছিল শ্রীমন্দিরের কিছু পুরোহিত ও পাণ্ডা – তেমনই আবার ছিল অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্য্যের মঠ, শৈব সম্প্রদায় ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একাংশ। এর ফলস্বরূপ, চৈতন্য হত্যার সম্ভাবনা তখনকার অনেকেই মনে হয় অনুমান করে নিয়েছিলেন। অন্যায় শাসন ব্যবস্থা সেখানে জারি ছিল, অপকর্মটা কোনো একক ব্যক্তির দ্বারা সাধিত হয় নি। সাধনের দায় বর্তায় সমগ্র ‘ব্যবস্থা’-টির উপর। এই ‘ব্যবস্থা’ জিনিসটি এমন যে, প্রকৃত প্রস্তাবে তাকে সরাসরি প্রশ্ন করতে পারে মুষ্টিমেয় মানুষ। বাকিরা ভয়ে নিরব থাকতে বাধ্য হয়।


।।৩।।


‘‘বাঙ্গালীর হিয়া অমিয় মথিয়া নিমাই ধরেছে কায়া’’ – আজ যখন বাংলার ধর্ম ও সাংস্কৃতিক জগতের মধ্যে প্রবেশ করি, তখন পদে পদে দেখতে পাই সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের এই রচনাটির অমোঘ সত্যতা! কেউ কেউ বলেন চৈতন্য আন্দোলন(যদিও এটি কোনোভাবেই আন্দোলন ছিল না), বাংলার প্রথম renaissance. আমার ধারনা ভিন্ন। আমি মনে করি বিশ্ব দরবারে বাঙালি জাতির প্রথম গরিমাময় আত্মপ্রকাশ! কারণ, এর পূর্বে যে প্রাচীন বাংলাকে আমরা পাই, সেই বাংলার অতি অল্পই আজ আমাদের মধ্যে টিকে আছে! পাল ও সেন যুগের ধর্ম, দেবতা, সংস্কৃতি, আচার, বিশ্বাস, প্রথা, পরিধেয়, শিল্প, অতীশ দীপঙ্করের মত কৃতীদের কীর্তি – সবই আজ লুপ্ত। সেই বাংলায় আর আজকের এই বাংলায় বিস্তর প্রভেদ। মিল যৎসামান্য!


এই দুই বাংলার মাঝে মিলন সেতু রুপে যিনি বিরাজিত, তিনি সেই নদিয়া বিহারি শ্রী গৌরহরি। আজকাল অখণ্ড বাংলার ধর্মীয় ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে বার বার মনে হয় ‘রঘুনন্দন’, ‘কৃষ্ণানন্দ’ ও ‘বিশ্বম্ভর’ – তিন বিপ্র সমসাময়িক নন বটে, কিন্তু সময়ের স্রোতকে এঁরা নিয়ন্ত্রিত করতে চেয়েছিলেন। পুণ্যফল, পরকাল ও ঈশ্বর-সামীপ্যের লোভ দেখিয়ে বিধি-নিষেধের বেড় – রঘুনন্দন আঁট করে বেঁধেছিলেন। তাঁর রচনার প্রভাব, তাঁর অনুসরণকারীদের ক্লীব-অনুষ্ঠানক্লিষ্ট-প্রথাকীটে পরিণত করেছিল। কৃষ্ণানন্দ ও বিশ্বম্ভর দু’জনেই সেই বেড়া ভাঙতে চেয়েছিলেন, অন্ততঃ বলা যায় আলগা করেছিলেন। কিন্তু উভয়ের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিল ছিল গুরুতর। ‘কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ’ বৌদ্ধ তন্ত্র প্রভাবকেই ঢেলে সাজিয়েছিলেন। তাতে ব্রাহ্মণ্যপ্রভাবে বিশেষ হেরফের হয়নি, কেবল পশ্বাচার(শুদ্ধাচারী তান্ত্রিক আচারবিশেষ)-এর প্রবণতা বেড়েছিল। সেখানে বিশ্বম্ভর ভক্তি ও যুক্তিকে মিলিয়েছিলেন৷ এর ফলে, পুজোর অধিকার নিয়ে ভেদাভেদ ও জাত-পাতের ব্যবধান পাকা হয়েছিল। চৈতন্য কিন্তু সেটারও বিষদাঁত ভেঙেছিলেন৷ চৈতন্য-আবির্ভাব বঙ্গীয় ইতিহাসের উজ্জ্বল প্রভা। কায়স্থ নরোত্তম দাস, ব্রাহ্মণ শ্রীনিবাস আচার্য, বৈদ্য নরহরি(সরকার তাঁর উপাধি), সুবর্ণবণিক উদ্ধারণ দত্ত, সদগোপ শ্যামানন্দ সকলেই হয়েছিলেন ‘মোহান্ত’, সমান মর্যাদার অধিকারী। সন্ন্যাসী হবার আগেও বিশ্বম্ভর বন্ধুবর শ্রীবাসের বাড়িতে সমপ্রাণ সঙ্গীদের নিয়ে জাতি নির্বিশেষে কীর্তনে মগ্ন হতেন। সন্ন্যাসী হবার পরে তাঁর ধর্মই হয়েছিল অপ্রেমজয়ের।


এবারে প্রশ্ন হল, চৈতন্যের আন্দোলন কি আধুনিক অর্থে ‘Elitist’ ছিল না? তাঁর বিদগ্ধ পরিকর-গোষ্ঠীর অনেকেই ছিলেন সেকালের উচ্চশিক্ষিত এবং তাঁরা উঁচু রাজপদে নিযুক্ত ছিলেন। সুবুদ্ধি রায়, সৈয়দ হুসেন খাঁর মনিব ছিলেন। তাই হুসেন শাহ গৌড়ের সুলতান হয়েও তাঁকে বিশেষ মান্য করতেন৷ ‘সাকর মালিক’ সনাতন এবং রূপ গোস্বামী ‘দবীর খাস’ সুলতানের খুব প্রিয় ছিলেন। অনুপম বা বল্লভও সরকারী কর্মচারী ছিলেন। শ্রীখণ্ডের নরহরি ছিলেন ‘রাজবৈদ্য’। উদ্ধারণ দত্ত ছিলেন বর্ধমান জেলার ধনী বণিক পরিবারের সন্তান। নরোত্তমের প্রভাবে উত্তরবঙ্গে চৈতন্য ভাবন্দোলনের প্রসার ঘটেছিল৷ উড়িষ্যার মহাবলী স্বাধীন রাজা গজপতি প্রতাপরুদ্র দেব, চৈতন্যদেবের শিষ্য হওয়ায় ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম’ হয়ে উঠেছিল তৎকালীন উড়িষ্যার রাজধর্ম। ‘শ্ৰেষ্ঠী’, ‘সামন্ত’ ও তাঁদের অনুগৃহীত বুদ্ধিজীবীরা ‘চৈতন্যপন্থী’ হয়েছিলেন। সেই ধারা মান্দারণ অঞ্চলের রাজা বীর হাম্বীর পর্যন্ত অনুসৃত হয়েছিল। কেউ কেউ বলতে পারেন, কলকাতার ‘শেঠ-বসাক’ এবং ‘সুবর্ণ বণিক’ গোষ্ঠীও মূলতঃ চৈতন্যপন্থী বৈষ্ণব। তাঁরা কেউই সাধারণ শ্রেণীর লোক নন। বরং অর্থনৈতিক শ্রেণী হিসেবে তাঁরা সামন্ত শোষণের সঙ্গেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। এইভাবে দেখলে চৈতন্য-আন্দোলনকে অবশ্যই ‘Elitist’ বলা যেতে পারে।


এই আন্দোলনের মূল অবদান ভক্তি সাধনার ধারা। যেটা সেই সময়ের প্রেক্ষিতে পূর্ব ভারতে একদম নতুন, কিছু ক্ষেত্রে বাকি ভারতবর্ষের জন্যেও নতুন। যেমন, চৈতন্য প্রবর্তিত ‘নাম মহিমা’। সেই বহিরশত্রুর আক্রমণে জর্জরিত যুগে, তিনি এনে দিলেন ধর্মাচরনের এক সহজ উপায়, যাতে মন্দির, বিগ্রহ, মন্ত্র, ব্রাহ্মণ সবই গুরুত্বহীন। নাম আর নামী অভেদ জেনে, শুধুমাত্র নামোচ্চারণের দ্বারা, সাধক নিজেই যুক্ত হতে পারে তার ইষ্টের সাথে! বাংলা আগাগোড়া তন্ত্রের দেশ। যেখানে সাধন পদ্ধতি মূলত যৌগিক এবং ক্রিয়া ভিত্তিক। সেখানে প্রথা নির্দিষ্ট নিয়ম পালনই আধ্যাত্মিক উন্নতির সোপান। কিন্তু চৈতন্যের এই নতুন ধারায় প্রাণের আবেগই শেষ কথা এবং যাবতীয় নিয়ম সেই আবেগের পথে অন্তরায়! অনুরাগের কাছে হার মানল বৈধী আচার-বিচার! এই যে নতুন অভূতপূর্ব সাধান ধারা, এর আলোকে একে একে উদ্ভাসিত হবেন বাংলার উত্তরকালের সমস্ত সাধক কূল। রামপ্রসাদ আবেগে ভেসে গিয়ে, নিজের আরাধ্য ‘মা’-কে গাল পারবেন। দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণ, ‘ভবতারিণী’কে প্রথা-বিরুদ্ধ-ভাবে পুজাে করবেন। আবার আনন্দময়ী মায়ের মতন অদ্বৈত-সিদ্ধ-সাধিকা পর্যন্ত হরিনামে মাতবেন। ‘‘দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা’’ – এটা মহাপ্রভু কৃষ্ণ চৈতন্যেরই অবদান! এই প্রেম ভক্তির দ্বার খুলে এক মহাপ্লাবনে বঙ্গদেশকে ভাসিয়ে গিয়েছিলেন চৈতন্য, যার তরঙ্গ আজও বাংলার ধর্ম জগতের মর্মস্থানে দোলা লাগিয়ে যাচ্ছে!


স্বীকার করতেই হবে, ‘Little tradition’(রবার্ট রেডফিল্ডের ভাষায়) অর্থাৎ গৌণ বা লোকধর্মীয় পরম্পরা সমূহ ইতিহাসের আদি ও মধ্য যুগে বাংলায় প্রভাবশালী ছিল। ‘Great tradition’(মহান বা প্রতিষ্ঠিত ধর্ম) বা মন্দির-ভিত্তিক সভ্যতার তুলনায় ওই সমস্ত আচার-বিশ্বাস পদ্ধতি অনেক বেশি প্রকট বা বিস্তারিত ছিল। আদি ও মধ্য যুগে সমগ্র বাংলায় প্রায় পাওয়াই যায় না – পৌরাণিক দেব-দেবীদের বিশাল আকারের পুজোর নিদর্শন। মঙ্গলকাব্যের পালা শুনতে ও দেখতে মানুষ ভিড় করতো। যেখানে, পৌরাণিক দেব-দেবীদের জব্দ করতেন মনসা-শীতলা-চণ্ডীর মতো লৌকিক দেবীরা। তা দেখার জন্য রাতের পর রাত জাগত প্রান্তিক মানুষজন। উচ্চবর্ণের গ্রাম্য কবিরা এই তথাকথিত নিম্নবর্গের জনসমুদ্রকে নিজের দিকে টানার জন্যেই লেখেন অগণিত মঙ্গলকাব্য। ‘নিত্যানন্দ-শ্রীচৈতন্য’সহ সমগ্র গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের অক্লান্ত পরিশ্রমেরও তো সেই একই লক্ষ্য ছিল – নিম্ন ও প্রান্তিক জনগণকে নিজেদের দিকে টানা। সেই সামাজিক ও ধর্মীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বঙ্গীয় সংস্কৃতির বৃহৎ ছত্রছায়ায় বিভিন্ন মানুষ ব্রাহ্মণ্যবাদের শোষণ ও শাসনের স্বীকার হয়েও মুসলমান ধর্ম গ্রহন না করে তৎকালীন সময়ে নিজেদের স্থান করে নিতে পেরেছিল।


তবে ‘নিত্যানন্দ-শ্রীচৈতন্য’ প্রাথমিক ভাবে শাস্ত্রের বাঁধন ছিঁড়ে আচণ্ডালে একই মনুষ্যত্ব দেখেছিলেন বলেই মানুষ জেগেছিল। কিন্তু বৃন্দাবনের গোস্বামীরা বৈষ্ণব হবার আগে পণ্ডিত ছিলেন, পরেও তাঁদের পাণ্ডিত্য কর্ম যায় নি; সেটা শুধু রূপ বদলেছিল। তাঁরা আবার নানা বিধিনিষেধ আনুষ্ঠানিকতা, কৃত্যাকৃত্যের জালে সমাজকে বাঁধতে চেয়েছিলেন৷ বৈষ্ণবাপরাধের তালিকা এবং অপরাধ মুক্তির উপায় বর্ণিত হয়েছিল। ‘সনাতন শিক্ষা’, ‘রামানন্দ-চৈতন্য আলাপ’(সাধ্যসাধনতত্ত্ব) ইত্যাদি বৈষ্ণব ধর্ম ও জীবনাচরণকে একটা মার্জিত বিদগ্ধ ‘Elitist’ মর্যাদা দিয়েছিল। কিন্তু সেই পরিমাণে জনগণের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ‘বিদগ্ধ মাধব’, ‘ললিত মাধব’, ‘সঙ্গীত পারিজাত’, ‘রূপাবলী’, ‘পদ্যাবলী’, ‘দানকেলি কৌমুদী’, ‘উজ্জ্বল নীলমণি’, ‘উদ্ধবসন্দেশ’, ‘ষট্‌-সন্দর্ভ’ যাঁরা চর্চা করতেন, তাঁরা সকলেই ছিলেন নমস্য বুদ্ধিজীবী৷ কিন্তু শ্রীচৈতন্যের আহ্বানে যে বিপুল জনজাগরণ হয়েছিল, সেই স্রোতের সঙ্গে এই বৈদগ্ধ্যের ধারার কোন মিল ছিল না। তাঁরা নামকীর্তন, মালাজপ আর গৌরবন্দনা নিয়েই তৃপ্ত থাকতেন। আসলে তাঁরা ছিলেন গরীব, ‘নিষ্কিঞ্চনতার দর্শন’ তাঁদের মুক্তি দিয়েছিল হীনমন্যতা থেকে। কিন্তু কোন ‘Filtration’-পদ্ধতি ছিল না যার দ্বারা বৈষ্ণবদের ওপর তলার জ্ঞান নীচের তলায় চুঁইয়ে পড়তে পারে। কেবল ভাগবত-পাঠ ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে কথকতা-সূত্রে বৈষ্ণব তত্ত্বাদির কিছু সরলীকরণ সাধারণের কাছে পৌঁছাতে পেরেছিল। কিন্তু দুটি ধারা পাশাপাশি বয়ে গিয়েছিল। একটি ছিল পণ্ডিত বিদগ্ধজনের আচরিত; অন্যটি ছিল ব্রাহ্মণ-শাসিত স্মৃতিনির্ভর হিন্দুসমাজের পীড়িত মানুষজনের জাগ্রত চেতনার ধারা।


নিত্যানন্দ যৌথভাবে বহু মানুষকে একসঙ্গে বৈষ্ণব সমাজে এনেছিলেন। অন্যদিকে, অদ্বৈতের মনে আশঙ্কা ছিল – অতটা দরজা খুলে দিলে কোন নীতির আগল থাকবে না। গদাধর কোনমতে চৈতন্য অনুসারী একটি শিষ্যসমাজ নিয়ে তৃপ্ত ছিলেন। নরহরি সরকার দাপটের সঙ্গেই বোধহয় জমিদারি, তেজারতি এবং শিষ্য-সম্প্রদায় চালিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে আর যে পার্থক্যই থাক, মিল ছিল এক জায়গায়; তাঁরা কেউই চৈতন্য-আন্দোলনের মাটি ছাড়েননি। তাই তাঁদের সকলেই বাংলায় উপদেশ দিয়েছিলেন, বাংলায় ‘কৃষ্ণভাবনা’ ও ‘চৈতন্যতত্ত্বের সার’ বুঝিয়েছিলেন৷ প্রথম নারীশিক্ষা এঁদের দ্বারাই বৈষ্ণবসমাজে চালু হয়েছিল। স্বরূপ দামোদরের মত যে-পক্ষ নীলাচলে শ্রীচৈতন্যের সঙ্গে কাটিয়েছিলেন, তাঁরাও বঙ্গীয় বৈষ্ণব গোষ্ঠীসমূহের প্রধানদের ন্যায় যতটা আত্মমগ্ন এবং বিধি-নির্দিষ্ট পথের পথিক ছিলেন, ততটা আচণ্ডালে উৎসাহী ছিলেন না। এঁরা সকলেই ছিলেন একধরনের বুদ্ধিজীবী; তাঁদের ‘দীনতার অভিমান’ ছিল আভিজাত্যেরই নামান্তর। আষ্টেপৃষ্ঠে সামাজিক বাঁধনের যে গ্রন্থিগুলি আলগা করেছিল চৈতন্যের ধর্মান্দোলন – তাঁরা নতুন করে সে বাঁধন তৈরি করেছিলেন। ফলে, শিক্ষিত-অশিক্ষিত বৈষ্ণব সমাজের মধ্যে আদান-প্রদানের কোন মাধ্যম গড়ে ওঠেনি। শিক্ষিত-অশিক্ষিত বৈষ্ণব সমাজের সেই সমান্তরালতা প্রথম পর্যায়ের মহান্তরা হয়ত বুঝতে পারেননি। তারই ফলস্বরূপ নবপ্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম বিশুদ্ধ সাত্ত্বিক প্রেম ও ভক্তিবাদের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও তা অধিকদিন স্থায়ী হয়নি। জাতিভেদ ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফলে এই মহৎ সম্ভাবনা অধিক ফলপ্রসূ হয়নি। শ্রীচৈতন্যের জীবদ্দশাতেই ব্যক্তিত্বের সংঘাত শুরু হয়েছিল। চৈতন্যের হত্যার পর গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মধ্যে গুরুবাদ আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী গুরু বা মহান্তরা বংশানুক্রমে দীক্ষাদান, দান ও শিষ্যসেবাগ্রহণের ব্যবসা চালিয়েছিলেন। বঙ্গদেশে এমন বৈষ্ণব মহান্ত পরিবার মেলা কঠিন যাঁরা শিষ্য-যজমান ঘর চালিয়েই যথেষ্ট ভূসম্পত্তি করেননি।


সব যাঁরা একদিন ছাড়তে শিখিয়েছিলেন, তাঁদের বংশধরদের কাছে এটি জীবিকা উপার্জনের একটি সহজ উপায় হয়ে দাড়িয়েছে। আবার ব্রাহ্মণ-প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মনে হয়, ‘শ্রীখণ্ডের বৈদ্যরা’(নরহরি সরকার শাখা) এখনও পূজার্চনার কাজ নিজেরাই করেন; অন্যসব পাট-বাড়িতেই রয়েছেন ব্রাহ্মণ পুজারী। ‘তামানন্দ(সদগোপ) পাটের’ জৌলুষ সবচেয়ে কম। সতেরোর শতক থেকেই গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের জঙ্গমতা ক্রমে হ্রাস পাচ্ছিল। চৈতন্য আন্দোলনের উজ্জীবনী প্রভাব তখন গতানুগতিকতা ও আনুষ্ঠানিকতায় স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। যে কোন ধর্ম আন্দোলনের প্রাণশক্তি একসময় তার উজ্জ্বলতা হারায়। যেহেতু সমাজের অর্থ নৈতিক কাঠামো আমূল না বদলালে ধর্ম বা সংস্কৃতির মৌল পরিবর্তন ঘটানো অসম্ভব, তাই এই পরিণতিও অবশ্যম্ভাবী। ফলে যতটুকু সম্ভাবনা ছিল, সেটাও নষ্ট হয়েছিল – (ক) ঐতিহাসিক কারণে, (খ) বৈষ্ণবদের পাটোয়ারী বুদ্ধি ও আদর্শহীন আনুষ্ঠানিকতায়, (গ) নতুনভাবে ব্রাহ্মণ প্রাধান্য ও স্মৃতি-অনুশাসনের প্রতিষ্ঠায়, এবং (ঘ) তান্ত্রিক ও সহজিয়া সংস্রবে।


গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মে তান্ত্রিক ও সহজিয়া সংস্রবের প্রসঙ্গে মনে পড়ে, বিশিষ্ট গবেষক ও পন্ডিত রমাকান্ত চক্রবর্তী তাঁর ‘বঙ্গে বৈষ্ণব ধর্ম’ গ্রন্থে বলছেন, ‘‘রায় রামানন্দ যে কোন ঐতিহাসিকের বিচারে এক বিরাট সমস্যা।.... রামানন্দ রায়ের দেবদাসী সহবাসের বিশদ বিবরণ কেন যে কবিরাজ গোস্বামী দিলেন তাও স্পষ্ট নয়।’’ কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃতের অন্তলীলার, পঞ্চম পরিচ্ছেদের, শ্লোক ৩৬ - ৪২ এ দেখতে পাওয়া যায়, প্রদ্যুম্ন মিশ্র চৈতন্য মহাপ্রভুকে রায় রামানন্দের দেবদাসীদের স্নান করানো ও নিজের হাতে সাজানো সংক্রান্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে বলছেন, ‘‘তবহিঁ বিকার পায় মোর তনু-মন।/প্রকৃতি-দর্শনে স্থির হয় কোন জন।।’’ এর উত্তরে চৈতন্য মহাপ্রভু তাঁকে রায় রামানন্দের নারীসঙ্গের কথা জানিয়ে বলছেন –


‘‘একে দেবদাসী, আর সুন্দরী তরুণী।
তার সব অঙ্গ-সেবা করেন আপনি।।
স্নানাদি করায়, পরায় বাস-বিভূষণ।
গুহ্য অঙ্গের হয় তাহা দর্শন-স্পর্শন।।
তবুও নির্বিকার রায়-রামানন্দের মন।
নানাভাবোদ্গার তারে করায় শিক্ষণ।।
নির্বিকার দেহ-মন -- কাষ্ট-পাষাণ-সম।
আশ্চর্য -- তরুণী-স্পর্শে নির্বিকার মন।।
এক রামানন্দের হয় এই অধিকার।
তাতে জানি অপ্রাকৃত-দেহ তাঁহার।’’


অর্থাৎ এখানে এই বিষয়ে রায় রামানন্দের অসাধারণ অধিকারের কথাই চৈতন্য মহাপ্রভু উল্লেখ করছেন। এতো সরাসরি দেহ-সাধনার কথা বলে দিলেন কৃষ্ণদাস কবিরাজ। অথচ চৈতন্য মহাপ্রভু রায় রামানন্দের এই কাজের নিন্দা করা তো দূরের কথা, বরং নিজেই উচ্চকণ্ঠে তাঁর প্রসংশা করে যাচ্ছেন।


আবার দেখা যাচ্ছে, কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্যচরিতামৃতের অন্তলীলার দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বর্ণনা করেছেন, পুরীতে বিশিষ্ট বৈষ্ণবী সাধিকা মাধবী দাসীর বাড়িতে গেছেন চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রিয় কীর্তনীয়া ছোট হরিদাস। ভগবান আচার্যের বাড়িতে চৈতন্য মহাপ্রভুর সেবার জন্য মাধবীর কাছ থেকে উৎকৃষ্ট চাল নিয়ে এলে, সন্ন্যাসী নারীর মুখ দর্শন করেছে বলে চৈতন্য মহাপ্রভু ছোট হরিদাসকে বহিষ্কার করেন। ‘‘প্রভু কহে, বৈরাগী করে প্রকৃতি সম্ভাষণ।/দেখিতে না পারোঁ আমি তাহার বদন।।’’ এরপর ছোট হরিদাস আত্মহত্যা করেন, ‘‘ত্রিবেণী প্রবেশ করি প্রাণ ছাড়িল।’’ কৃষ্ণদাস কবিরাজ জানিয়েছেন, এতে চৈতন্য মহাপ্রভু বললেন হরিদাস যেমন আচরণ করেছে তেমনি ফল পেয়েছে। কৃষ্ণদাস কবিরাজের ভাষায়, চৈতন্য মহাপ্রভু বলছেন, ‘‘প্রকৃতি দর্শন কৈলে এই প্রায়শ্চিত্ত।’’


চৈতন্য মহাপ্রভুর সমসাময়িক ওড়িয়া কবি মাধব পট্টনায়কের লেখা ‘বৈষ্ণব-লীলামৃত’ থেকে জানা যায় – চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রিয় কীর্তন গায়ক ছোট হরিদাস মাধবীর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন এবং তার বাড়িতে যাতায়াত শুরু করে দেন। ছোট হরিদাস এবং মাধবীকে জড়িয়ে পুরীর বৈষ্ণব ভক্তমন্ডলীতে তখন বিস্তর জলঘোলা হয়। তাই অনেক পরে লেখা কবিরাজ গোস্বামীর চৈতন্যচরিতামৃততে এমন একটি কলঙ্কজনক ঘটনা না থাকাটাই তো স্বাভাবিক। রমাপদ চক্রবর্তী লিখছেন, ‘‘যে চৈতন্য প্রায় বিনা দোষে ছোট হরিদাসকে সকর্মের ফল ভোগ করতে বাধ্য করলেন, সে চৈতন্যই দেবদাসীর গুহ্যাঙ্গদর্শী ও স্পর্শী রামানন্দের সঙ্গে তত্ত্বালোচনা করেন।.... চৈতন্যের ব্যবহারে কেন এই স্ববিরোধ?’’ চৈতন্য মহাপ্রভুর খুবই প্রিয় ছিল গীতগোবিন্দ, বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস শ্রীমদ্ভাগবত থেকে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা বিষয়ক শ্লোক বা পদ। অথচ আমাদের মত সাধারণ মানুষের বিচারে তা কিন্তু অশালীন বা আদিরসাত্মক। তাহলে চৈতন্য মহাপ্রভু এগুলি বার বার শুনতে চাইতেন কেন? কেনই বা চৈতন্যচরিতামৃতের মতো সর্বজনশ্রদ্ধেয় তাত্ত্বিক বৈষ্ণবগ্রন্থে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে এরকমই বহুসংখ্যক তথাকথিত ‘আদিরসাত্মক’ শ্লোক? রমাকান্ত চক্রবর্তী লিখছেন, ‘‘বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, কামিনীকাঞ্চনে-বিরক্ত, ভক্তিমূলক সদাচারের প্রচারক চৈতন্য কৌমার্যহরণ বিষয়ক এমন আদিরসাত্মক শ্লোক আবৃত্তি করেছিলেন।’’


চৈতন্য-জীবনীকারদের লেখা এই ধরণের ঘটনা সমূহের সদ্ব্যবহার করে, তান্ত্রিক ও সহজিয়া সংস্রবের ফলে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের যে সমস্ত শাখা আজও বিদ্যমান, তারা ‘আপন মনে মাধুরী মিশায়ে’ চৈতন্যকে নিয়ে এমন সমস্ত তত্ত্ব উপস্থাপন করে – যার সূত্রগুলি বেশ দুর্বল। তবে এত কিছুর পরেও চৈতন্যের ধর্মান্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম, তা খাটো করা অসম্ভব। তিনি যে ধর্মীয় আন্দোলন করেছিলেন, তা জ্ঞানমার্গের বিরোধী নয়। তবে সহজিয়া লোকায়ত চেতনা, বরাবরই জ্ঞানমার্গের নামে অবভাসের যথেচ্ছাচারের বিরোধী। চৈতন্য-আন্দোলন সম্পর্কে এরকম কথাও বলা হয়েছে যে, আসলে উনি ছিলেন একজন বিপ্লবী; বৈষ্ণব ধর্ম ছিল ছদ্মবেশ। পুরোটাই রাজনৈতিক আন্দোলন, বাংলায় হিন্দু-বাঙালির ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়াস। মানে বৈষ্ণবরাই মধ্যযুগের বলশেভিক আর কি। এরকম একটা কথা অনেক চৈতন্য জীবনীতে লেখা হয়, ঠিক এভাবে লেখা না হলেও এই স্পিরিটে বক্তব্য রাখা হয়।


চৈতন্যর মধ্যে বিপ্লবী খুঁজে পায় জনআন্দোলনের জয়ধ্বনি আর রক্ষণশীল খুঁজে পায় আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ শিখর। নাস্তিক এই আন্দোলনে মানব অস্তিত্বের অবলম্বন খুঁজে পায় আর আস্তিক এই আন্দোলনে পায় ঈশ্বরের বিভূতি। একাধিক কমিউনিস্ট নেতা চৈতন্যর মধ্যে গৌড়বঙ্গের প্রথম কমিউনিস্টকে খুঁজে পেয়েছেন। আবার গান্ধী স্বয়ং চৈতন্য আন্দোলনে খুঁজে পেয়েছিলেন মধ্যযুগের প্রথম অহিংস আন্দোলনের নজির। চৈতন্য-স্মরণে রত হন যুক্তিবাদী থেকে ভাববাদী, লিটল ম্যাগ থেকে আনন্দবাজার, কফি হাউজ থেকে বটতলা, পণ্ডিত থেকে অজ্ঞ। তাঁর নামে "ভজ গৌরাঙ্গ" বলে উদ্বাহু নৃত্য করে সাহেবরা, আর অতীতে সাহেব তাড়িয়ে ভারত স্বাধীন করতে যাওয়া বাঙালিরাও তাঁর প্রেমে মাতোয়ারা! ব্রাহ্মণ আর চণ্ডাল এই আন্দোলনে পরস্পরের হাত ধরে নৃত্য করেছে। চৈতন্যের নামে এই আন্দোলনে কবির সঙ্গে অকবির আঁতাত হয়, কেজোর সঙ্গে অকেজোর মিত্রতা হয়। এই আন্দোলন সমস্ত গৌড়বঙ্গীয়দের মহামিলনমেলা।


বৈষ্ণব আন্দোলনের একটা সাত্ত্বিক অভিমুখ ছিল। এখন আমরা বলতেই পারি যে রাজসিক গুণাবলী চাই, ইসলামের আগ্রাসনের সামনে সাত্ত্বিক সাধনা যথেষ্ট নয়। মনে রাখতে হবে যুদ্ধ শুধু বন্দুক দিয়ে হয় না। বাঙালিকে বাঁচানোর যে যুদ্ধ, সেটা শুধু তরবারি দিয়ে হবে না, শ্রীকৃষ্ণের বাঁশিও চাই। বাঙালির সহজিয়া চেতনা এক বিরাট সম্পদ, বাঙালিকে সমস্ত বিদেশী কমিউনিজমের অভিঘাত থেকে এই সহজিয়াই তো রক্ষা করে। কারণ, সাম্যের দর্শন তো বাংলার সহজিয়াদের নিজস্ব। চৈতন্যের মধ্যেই তার সর্বোৎকৃষ্ট প্রকাশ। অন্তর্ধান নিয়ে রহস্যময় আলোচনাকে প্রশ্রয় না দিয়ে চৈতন্যের জীবনবোধ, ধর্মান্দোলন বা সমাজসঙ্গস্কার নিয়ে আরও বেশি করে আলোচনা হোক। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জাতির অভিজ্ঞান। চৈতন্য-আন্দোলন বনমালীর পরজন্মে রাধা হওয়ার আন্দোলনও বটে। সেজন্য এ আন্দোলন পুরুষতান্ত্রিকতাকে সমূলে আঘাত করে। সহজিয়া সাম্যের চেতনা শুধু তাত্ত্বিক স্তরে নয়, ব্যবহারিক স্তরেও ছিল।


।।৪।।


১৪৪৩ শকাব্দের রথযাত্রার পর মহাপ্রভুর ভাব পরিবর্তনের শুরু। তখন তাঁর বয়স ৩৬ বছর। তিনি ক্রমশ অন্তর্মুখী হতে থাকেন। ১৪৪৯ শকে হরিদাস ঠাকুরের দেহত্যাগের পর, তাঁর অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। যিনি দূর করেছিলেন সমাজের গ্রহণ, প্রেম রসে ভক্তিযোগে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন ভক্তদের – সেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শেষ জীবনের এই দিব্যোন্মাদের ঘটনাবলী নিয়ে আধুনিক সময়ে বহু গবেষক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ১৫১৫ থেকে ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দ বা ১৪৩৬ থেকে ১৪৫৫ শোকাব্দ – এই সমকাল জুড়ে চৈতন্যের জীবনযাপন সম্পর্কে যে সমস্ত তথ্য পাওয়া যায়, তা বেশ পরস্পর বিরোধী। এক দিকে বলা হচ্ছে – রাজা প্রতাপরুদ্র দেব চৈতন্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে, প্রতি পদক্ষেপে তাঁর পরামর্শ নিয়ে চলছেন। তার ফলে শ্রীমন্দিরের পাণ্ডাদের একাংশ থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বিদ্যাধর পর্যন্ত – সকলে বিরক্ত। কারণ, রাজার কাছে তাদের গুরুত্ব এর ফলে অনেক কমে গেছে। ওপর দিকে বলা হচ্ছে, কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা চৈতন্যের নাকি রাধাভাব হত। তিনি কৃষ্ণবীরহে মাটিতে মুখ ঘষতে ঘষতে প্রায়ই রক্তাক্ত হতেন। সমুদ্রের নীলাভ রঙে আকৃষ্ট হয়ে যখন-তখন দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপ দিতেন। চৈতন্যকে গম্ভীরায় কঠোর পাহারায় আটকে রাখা হত। যে ব্যক্তি রাজকার্য পরিচালনায় সহায়ক, তাঁর তো প্রখর বুদ্ধি, বিচক্ষণতা ও বিশ্লেষণ শক্তি। তিনিই আবার এত আবেগপ্রবণ! যিনি নবদ্বীপে থাকাকালীন নবাবের আঞ্চলিক প্রতিনিধি কাজীর বিরুদ্ধে জনমত স্থাপন করে, আন্দোলন করেছিলেন – তিনিই আবার রাধাভাবে বিভোর হয়ে ‘হা কৃষ্ণ’ বলে ক্রন্দনরত? এ যেন কিছুতেই বিশ্বাস হয় না! জগদানন্দের মাধ্যমে অদ্বৈত আচার্যের সেই বিখ্যাত হেঁয়ালি কি চৈতন্যের প্রতি একটা সতর্কবাণী ছিল? সেটি হল –


“বাউলকে কহিও লোকে হইল আউল।
বাউলকে কহিও হাটে না বিকায় চাউল।।
বাউলকে কহিও কাজে নাহিক আউল।
বাউলকে কহিও ইহা কহিয়াছে বাউল।।”


এটা শোনার পর থেকে চৈতন্যদেবের মধ্যে বিরহযন্ত্রণা বেড়ে গেছিল। বিভিন্ন জীবনী থেকে জানা যায়, চৈতন্যকে বিষাদ গ্রাস করেছিল। অদ্বৈতের এই ছড়ায় সম্ভবত উৎকলের অবস্থা সম্পর্কে চৈতন্যকে সতর্ক করা হয়েছে, প্রেমধর্মের চাউল আর হাটে বিক্রি করতে দেওয়া হচ্ছে না, এবং এসময়ে উড়িষ্যায় বসে বৈষ্ণবধর্মের প্রচারে কাজ নেই, বিপদ হতে পারে। অর্থাৎ এখানে চৈতন্যবিরোধী ষড়যন্ত্রের কালো মেঘ ঘনিয়ে আসার সাঙ্কেতিক বার্তা দেওয়া হয়েছে। মহাপ্রভুকে নাকি এই সময়ে বৃন্দাবন নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা ও যোগাড়যন্ত্রও শুরু করেছিলেন গৌড়ীয় বৈষ্ণবেরা। বৃন্দাবনে তাঁর জন্য বাসস্থানও নির্দিষ্ট হয়েছিল। সে পরিকল্পনা সফল হয়নি। সার্বভৌম কিন্তু দেখতে পাচ্ছি নীলাচল ত্যাগ করে কাশীধামে চলে যাচ্ছেন। অদ্বৈতের এই সাঙ্কেতিক বার্তা আসার পরে বেশিদিন চৈতন্য বাঁচেন নি। এই সাঙ্কেতিক বার্তার অর্থ অবশ্য এটাও হতে পারে, যে বৈষ্ণব আন্দোলন সিদ্ধিলাভ করেছে, লোকের ভাণ্ডার পূর্ণ হয়েছে, অতএব মহাপ্রভু এইবার ভবলীলা সাঙ্গ করতে পারেন। কিন্তু বৈষ্ণব আন্দোলনের তখনকার গতিপ্রকৃতি নিয়ে পড়লে দেখা যায়, সে অর্থটি একেবারেই লাগসই নয়। অনেকের মতে এই বার্তায় অদ্বৈতর দলের সঙ্গে নিত্যানন্দের দলের বিরোধের আভাস আছে, তবে সেটা একেবারেই যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত নয় বলে আমি মনে করি।


তাঁর চলে যাওয়ার দিনটা সেই বছরের আষাঢ় মাসে। ইংরেজিতে ২৯ জুন ১৫৩৩ – সেদিন কোনও প্রাকৃতিক গ্রহণ ছিল না। তবে মানুষের তৈরি গ্রহণ ছিল। তাই মাত্র সাতচল্লিশ বছর বয়সে মহাপ্রভুর চলে যাওয়া‚ বলা ভাল অন্তর্ধানের উপর থেকে রহস্য মুছল না আজও। দেবত্বে উত্তীর্ণ হয়ে গেলে, সেই মহামানব সম্পর্কে অনেক জাগতিক সত্যই সামনে আনা হয় না। তাই মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যের মৃগী ছিল কিনা‚ গদাধর ও মহাপ্রভুর সম্পর্কের সমীকরণে কোনও ভিন্নধারার মাধুর্য্যময় ভাব ছিল কিনা, জগন্নাথ মন্দিরে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল কিনা – ইত্যাদি সব প্রশ্নই বিলীন হয়ে যায় কালের গর্ভে। শুধু তিতো ওষুধের মতো জোর করে গেলানো হয় – তাঁর জগন্নাথ বিগ্রহে বিলীন হওয়ার তত্ত্ব।


এমন বহু মানুষ রয়েছেন যাঁরা মহাপ্রভুর উদার ধর্মভাবে ভাবিত চিত্তের সৌন্দর্যের কোনও পরিমাপ করতে পারেন না, অথচ চৈতন্য মহাপ্রভু কেমন করে দেহ রাখলেন তাই নিয়ে চুল ছিঁড়তে শুরু করেন। আমাকেও যদি সেই দলভুক্ত করা হয় ক্ষতি কিছু নেই। সব চেয়ে আশ্চর্যতম ঘটনা হল – মহাপ্রভু কবে শুক্তো দিয়ে ভাত খেয়েছিলেন অথবা কবে মালপোয়া প্রসাদ গ্রহন করেছিলেন, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে বিখ্যাত দুই জীবনী গ্রন্থ “চৈতন্য-চরিতামৃত” অথবা “চৈতন্য-ভাগবত”এ। এমনকি কৃষ্ণদাস কবিরাজ “চৈতন্য-চরিতামৃত”এ হরিদাস ঠাকুরের তিরোধানকে কেন্দ্র করে এক অসামান্য চিত্র রচনা করেছেন। কিন্তু এক অদ্ভূত নৈঃশব্দে এড়িয়ে গিয়েছেন স্বয়ং চৈতন্য মহাপ্রভুর তিরোধান-পর্ব। বিনা কোন শব্দে, বিনা রস-কিরণ সম্পাতে! উক্ত বিষয় কোনও শব্দই উচ্চারণ করেননি সনাতন গোস্বামী, রূপ গোস্বামী, কবি কর্পূর অথবা বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামীর মতন মহামান্য ব্যক্তিত্বরাও!


যে কোন বৈষ্ণবীয় তিথিতে মহাপ্রভুর নৃত্য ও সংকীর্তনের কথা এক অতিশয়ী ভাবনায় বর্ণিত হয়। অথচ, যিনি সকল কিছুরই মধ্যমণি, গৌড়ীয় ধর্মের প্রবক্তা ও কর্তা – সেই চৈতন্য মহাপ্রভুর তিরোধান প্রসঙ্গে সকলেই নৈঃশব্দের সঙ্গী হয়ে পড়েন। কেন? এতেই কি মহাপ্রভুর চরম অলৌকিক ভগবত্তার প্রতিষ্ঠা হতে পারে? আমি মনে করি, অভ্যুদয়শালী ব্যক্তিদের মহিমা প্রকাশ করবার জন্য তাঁর জন্ম-মৃত্যুর অলৌকিকতার প্রয়োজন হয়না। তাঁদের এক একজনের কর্মজীবন এমনই মহিমাময় যে, তা অঅনুকরণীয়। সাধারণজন হাজার চেষ্টা করলেও যিশুখ্রিস্ট, বুদ্ধদেব বা চৈতন্যদেব তো দূর অস্ত; রবীন্দ্রনাথ বা বিদ্যাসাগর হতে পারবে না। তা হলে মহাপ্রভুর তিরোধান প্রশ্নে এতো রাখঢাক্ গুড়গুড় কেন? পাঁচশো বছর পরেও মনের মধ্যে ভয়ঙ্কর এই প্রশ্ন কেন মাথা তুলে দাঁড়ায় – মহাপ্রভুর সেচ্ছাধৃত মর্ত-শব-শরীর কোথায় গেল?


শ্রীরামকৃষ্ণ কর্কট রোগগ্রস্থ হয়ে “এ ঘর থেকে ও ঘর”এ চলে গিয়েছেন, এতে কি এঁনাদের ভগবত্তা প্রতিষ্ঠিত হয় নি? মর্তলীলার মনুষ্যশরীর লুপ্ত করতে নিমিত্ত একটা তো লাগবেই, তাতে অবতার হিসাবে পূর্ণপ্রতিষ্ঠায় কি কোনও বাঁধা থাকে? এবং এই জায়গাতেই মহাখটকা – কোথায় গেল চৈতন্য-শব-শরীর? এ সম্পর্কে কেন এত অহেতুক নীরবতা? তাঁর মৃত্যু নিয়ে মতবাদ অনেক, কিন্তু কি আশ্চর্য মিল এক জায়গায়! সেই আশ্চর্যতর মিলটি হল – মৃত্যু যেমন করেই হোকনা কেন, অদ্যাবধি চৈতন্য মহাপ্রভুর পঞ্চভৌতিক শব-শরীরের কোনও হদিস পাওয়া যায়নি কেন! চৈতন্য অন্তর্ধানের পরববর্তী কালে, প্রায় অর্ধ শতক ধরে বঙ্গীয় বৈষ্ণব সমাজ উৎকলে কোণঠাসা হয়ে ছিল। আতঙ্কিত অবদমিত অবস্থায় কোনও জীবনীকারই কি তাহলে স্পষ্ট করে লিখতে পারেননি মহাপ্রভুর করুণ পরিণতি?


এইবার অন্তরের এই সমস্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর অনুসন্ধান করি – সালটা ছিল ২০০০ পুরীর বিখ্যাত শ্রী জগন্নাথ মন্দিরের সংস্কার কার্য চলার সময় হঠাৎ-ই গর্ভগৃহ থেকে উদ্ধার হল একটি আস্ত নরকঙ্কাল! দৈর্ঘ্যতে যা ছিল প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি। চারিদিকে হৈ-হৈ পড়ে গেল। মাসাধিক কাল ধরে চলল প্রবল বিতর্ক। পরীক্ষা করে জানা গেল মৃত ব্যক্তি ছিলেন অত্যন্ত দীর্ঘাঙ্গী এবং যার মৃত্যু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিচার করে বেশিরভাগ মানুষ তখন এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হলেন যে, কঙ্কালটি বাংলার ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব শ্রী চৈতন্য দেবের! একই সঙ্গে, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা শ্রীচৈতন্যের সমুদ্রে লীন হবার তত্ত্বও খারিজ হওয়ার পাশাপাশি, পুরীর মন্দিরে তাঁকে হত্যা করবার বিষয়টিও আবারও জনসমক্ষে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে জগন্নাথ মন্দিরের মধ্যে শ্ৰীচৈতন্যকে ‘গুমখুন’ করা হয়েছিল, এই অভিমত সর্বপ্রথম প্রচার করেন, ঐতিহাসিক ড. নীহাররঞ্জন রায়।


“চৈতন্যদেবকে গুম খুন করা হয়েছিল পুরীতেই এবং চৈতন্যদেবের দেহের কোন অবশেষের চিহ্নও রাখা হয়নি কোথাও। এবং তা হয়নি বলেই তিনটে কিংবদন্তী প্রচারের প্রয়োজন হয়েছিল।… এই বয়সে শহীদ হবার ইচ্ছে নেই বলেই বলতে পারবো না, ঠিক কোথায় চৈতন্যকে খুন করা হয়েছিল।”
– নীহাররঞ্জন রায়
(সপ্তডিঙ্গা, বর্ষ ২, সংখ্যা ২)


৫-৮-১৯৭৬ তারিখে, পুরীর আনন্দময়ী আশ্রমের ড. জয়দেব মুখোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে ড. রায় লিখলেন, ‘‘শ্ৰীমহাপ্ৰভু চৈতন্যদেবকে গুমখুন করা হয়েছিল পুরীতেই এবং চৈতন্যদেবের দেহের কোন অবশেষের চিহ্নও রাখা হয়নি কোথাও। এবং তা হয়নি বলেই তিনটি কিংবদন্তী প্রচারের প্রয়োজন হয়েছিল”। তিনি আরও লিখেছেন, ‘‘ওই গুমখুনের সমস্ত ব্যাপারটাই একটা বহুদিনের চিন্তিত, বহুজন সমৰ্থিত চক্রান্তের ফল। কে বা কারা ওই চক্রান্ত করেছিলেন, সে সম্পর্কে আমার একটা অনুমান আছে, কিন্তু তা বলতে পারব না। কারণ এখনও আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে চাই। চৈতন্যদেব, গান্ধী martyr হতে পারেন, কিন্তু আমার martyr হওয়ার বিন্দুমাত্র বাসনা নেই”।


একথা সত্য যে, জয়দেব’বাবুর অসামান্য লেখাটি পড়ে আমরা আলোড়িত হয়েছি। তবে আমরা ভুলে যাই যে, তাঁর লেখাটি আসলে উপন্যাস। সেখানে বক্তব্যের স্বপক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ দেওয়া নেই। ‘কাঁহা গেলে তোমা পাই’ বইটিতে জয়দেব’বাবু চৈতন্য-অন্তর্ধান সম্পর্কে দুটি সম্ভাব্য সমাধানের কথা বলেছিলেন। একটি অবশ্যই গুপ্তহত্যার কথা। দ্বিতীয়টি, চৈতন্যদেব পুরী থেকে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন। আমরা জয়দেব’বাবুর প্রথমটি ধরে বসে থাকি। দ্বিতীয় মতটির কথা আমরা বিবেচনা করি না। কারণ, মৃত্যুর কথা প্রচার করে, পুরী ছেড়ে চৈতন্যের অন্যত্র চলে যাওয়ার তত্ত্বটা – কেমন যেন নেতাজির অন্তর্ধানের সঙ্গে মিলে যায়! জয়দেব’বাবু ছাড়াও আরও দু-একজন গবেষক দাবি করেছেন, সকলের অলক্ষে পুরী ছেড়ে চৈতন্যদেব কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে শেষ জীবন অতিবাহিত করেন। তা হলে তো উক্ত সম্প্রদায়ের প্রচারানুযায়ী বলতে হয়, তিনি ২০০ বছর জীবিত ছিলেন! যা চরম অবাস্তব! জয়দেব’বাবুর বইটির দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হলে, উনি কি মত প্রকাশ করতেন, তা আমাদের অজানা। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই যে প্রচলিত ধারণা – জয়দেব’বাবু প্রথম বইটি প্রকাশিত হবার অল্প সময়ের মধ্যেই নিহত হয়েছিলেন, কিন্তু বাস্তব তা নয়। উনি প্রথম বইটি প্রকাশের পরে দীর্ঘ ১৪-১৫ বছর জীবিত ছিলেন। সেই সময়ের মধ্যে ওঁর অন্য বই প্রকাশিত হয়েছিল। ‘কাহা গেলে..’র দ্বিতীয় খন্ড কেন প্রকাশিত হয়নি, সেটি কিন্তু আজও রহস্যময়। এ নিয়ে অবশ্যই গবেষণা হওয়া উচিত।


আধুনিক জনমানসে বিধৃত conspiracy theory-র প্রাথমিক জন্মদাতার নাম অবশ্যই রায়বাহাদুর দীনেশ চন্দ্র সেন। সূত্র, তাঁর Ramtanu Lahiri Fellowship Lectures for the year 1919 and 1921-এর অন্তর্গত ‘Chaitanya and His Age’ নামক বক্তৃতা। ১৯২২ সালে তা প্রকাশ পেল বইয়ের আকারে। ২৬৪ পৃষ্ঠায় দীনেশ বাবু লিখলেন, “Chaitanya was in the Jagannath temple when he suffered from high fever. When the priests apprehended his end to be near they shut the gate against all visitors. This they did to take time to burying him within the temple. If he left the world at 4 p.m. the doors we know were kept closed till 11 p.m. – this time was taken for burying him and repairing the floor after burial. The priests at 11 p.m. opened the gates and gave out that Chaitanya was incorporated with the image of Jagannath. So according to one account he passed away at 11 p.m. But the better informed people knew that he had passed away at 4 p.m., when the door was closed... They buried him somewhere under the floor of the temple and would not allow any outsider to enter it until the place was thoroughly repaired and no trace left after his burial as I have already stated. This is the only rational explanation that may be advanced for explaining their conduct in shutting the temple gate.”


শুধু ডঃ রায় বা ডঃ সেনই নন – খগেন্দ্রনাথ মিত্র, গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরি, ডঃ অমূল্যচন্দ্র সেন, দুর্গাপদ চট্টোপাধ্যায়, ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায়, মালীবুড়ো, ঔপন্যাসিক সমরেশ বসু – এঁদের সবার ধারণা, চৈতন্যদেবকে গুমখুন করা হয়েছিল। একদা চৈতন্যদেবের মৃত্যুরহস্য উদঘাটন করতে গেলে, আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে খুনের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। খগেন্দ্রনাথ মিত্র ও ডঃ দীনেশ সেন নিন্দিত হয়েছিলেন। ডঃ অমূল্য সেনের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়েছিল। তবুও শত বিপদ ও মৃত্যুভয়ের মাঝেও ওঁরা চৈতন্যের মৃত্যুর ঘটনাটিকে ‘homicide’ বলেছিলেন।


তবে চৈতন্য-অন্তর্ধান অনুসন্ধানে যে রচনাগুলি গুরুত্ব সবথেকে বেশি, সেই ওড়িয়া ভাষায় লিখিত গ্রন্থগুলোয় প্রায় ব্যতিক্রমহীন ভাবে বলা হয়েছে – তিনি অক্ষয় তৃতীয়ার দিন মারা গিয়েছিলেন। বাঙালিদের লেখা গ্রন্থে ভিন্ন বিবরণ(আষাঢ় মাসে তাঁর নশ্বর লীলার অবসান), কিন্তু অক্ষয় তৃতীয়া বলে দাবি করা উড়িয়া রচনাসমূহের কয়েকটি প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ, কাজেই তা আমাদের সঙ্গত কৌতূহলের উদ্রেক করে। ওড়িয়া গ্রন্থগুলি এক এক করে আলোচনা করি –


ঈশ্বরদাসের চৈতন্যভাগবত বলে, অক্ষয় তৃতীয়ার দিন চৈতন্য বৈকুন্ঠে গমন করেছিলেন। তিনি নগর পরিক্রমা করে তারপর জগন্নাথ মন্দিরে ঢুকে শ্রীবিগ্রহে চন্দনলেপন করেন(প্রসঙ্গত চৈতন্য জগন্নাথ বিগ্রহের নিকটে যেতেন না, দূর থেকেই দর্শন করতেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে জগন্নাথের স্পর্শে তিনি ভাবপ্লাবিত হতেন। তবে প্রথমবার পুরী গিয়ে তিনি যখন জগন্নাথকে আলিঙ্গন করতে যান, তখন তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল পাণ্ডারা। বাসুদেব সার্বভৌম এসে না বাঁচালে, হয়ত সেদিনই চৈতন্যকে পাণ্ডারা মেরে ফেলত। তবে চৈতন্যের জগন্নাথ সন্নিকটে না যাওয়ার রাজনৈতিক কারণও থাকতে পারে। যেই চৈতন্য, যিনি দীর্ঘ চব্বিশ বছর নীলাচলবাসের সময় জগন্নাথকে স্পর্শ করলেন না, গর্ভগৃহেই প্রবেশ করলেন না; সেই তিনি এতবছর পরে এইভাবে স্বহস্তে জগন্নাথে চন্দনলেপন করতে গেছিলেন! এটি চমকপ্রদও বটে) এবং এই সময় জগন্নাথ মুখব্যাদান করেন, তাঁর মধ্যে চৈতন্য অন্তর্হিত হন। এই ঘটনার পরে রাজা প্রতাপরুদ্রের ক্রোধ প্রজ্জ্বলিত হলে, প্রভু ‘‘জগন্নাথ’’ স্বয়ং ক্রোধ নিবারণ করতে চন্দনযাত্রা/চন্দনবিজয় সম্পূর্ণ করতে আদেশ দেন। এখানে বলা দরকার, অক্ষয়তৃতীয়ার দিন জগন্নাথের চন্দনযাত্রা হয়। ঈশ্বরদাস আরো জানান, চৈতন্যের মৃতদেহ ‘‘জগন্নাথের আদেশেই’’ প্রাচী নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে ঘটনাসমূহ বেশ পরস্পর-বিরোধী।


প্রসঙ্গত, চৈতন্য হত্যার কিনারা করতে গিয়ে যিনি খুন হয়েছিলেন পুরীতে, সেই জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের হাতে একটি ওড়িয়া গ্রন্থ এসেছিল। বৈষ্ণবদাস রচিত ‘‘চৈতন্য গৌরাঙ্গ চকড়া’’ নামে এই পুঁথিটি পুরীনিবাসী পদ্মশ্রী সদাশিব রথশর্মা, গঞ্জাম জেলায় আবিষ্কার করেন। এই কীটদষ্ট পুঁথির কিয়দংশ তিনি জয়দেববাবুকে দিয়েছিলেন। বলা হয়, চৈতন্যের মৃত্যু নিয়ে এই পুঁথিতে কিছু বিস্ফোরক তথ্য ছিল। দুঃখের কথা, জয়দেব’বাবু খুন হওয়ার পরে সে পুঁথির আর কোনও চিহ্ন পাওয়া যায় নি! জয়দেব’বাবুর গ্রন্থ ‘কাঁহা গেলে তোমা পাই’ পড়লে জানা যায়, এ পুঁথির রচয়িতা বৈষ্ণবদাস নিজের চোখে জগন্নাথের চন্দনবিজয়ের পরে, রাত দশটায় গরুড় স্তম্ভের পেছনে চৈতন্যের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছিলেন। তবে দিন-ক্ষণ, মাস-তারিখ নিয়ে কিছু বলা নেই।


ওড়িষ্যার পঞ্চসখা সম্প্রদায়ের দিবাকরদাসও লিখে গেছেন, কলিকালে বেঁচে থাকা নিরর্থক বিবেচনায় নিজধামে গমন করবার বাসনা থেকে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন চৈতন্য লীন হয়েছিলেন জগন্নাথ অঙ্গে। পঞ্চসখার আরেকজন অচ্যুতানন্দ, ইনি বলছেন অক্ষয় তৃতীয়ার আগের দিন গভীর রাতে(সম্ভবত অক্ষয় তৃতীয়া তিথি শুরু হয়ে গেছিল) চৈতন্যর মৃত্যুর কথা। স্থান অবশ্য সেই জগন্নাথমন্দির এবং লীলাবসান ওই শ্রীবিগ্রহে লীন হয়েই।


মাধব পট্টনায়ক চৈতন্য সমসাময়িক এবং তিনি চৈতন্যলীলার প্রত্যক্ষদর্শী(লীলাবসানেরও বটে)। অক্ষয় তৃতীয়ার আগের অমাবস্যায়(রুক্মিণী অমাবস্যা) পথে নামসঙ্কীর্তনে নৃত্যরত চৈতন্যর পায়ে ইঁটের খোঁচা লাগে এবং ফলে তিনি গুরুতর অসুস্থ হন। তাঁকে ধরাধরি করে জগন্নাথ মন্দির প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে তাঁর শুশ্রূষা চলে, যদিও কোনও কবিরাজ-বৈদ্যকে ডাকা হয়নি। গরম জলের সেঁক দেওয়া হয়েছিল মাত্র। তাঁর শারীরিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি ঘটতে থাকে, সারা দেহ ফুলে যায়। লক্ষণীয়, কয়েকদিন ধরে অসুস্থ, অথচ কোনও বৈদ্যকে ডাকা হয়নি। অবশেষে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন ব্রাহ্মক্ষণে(খুব ভোরে) জগন্নাথ মন্দিরেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। চন্দনযাত্রায় যোগ দিতে প্রতাপরুদ্র আসছিলেন। তিনি সোজা মন্দিরে এসে পৌঁছলে, চৈতন্যের মৃতদেহের সামনেই আলোচনাসভা বসে। রায় রামানন্দ বলেন, গৌড়ীয়রা নানা কুকথা বলবে; হয়ত গৌড়ের ‘‘ম্লেচ্ছ’’ রাজাকে উড়িষ্যা আক্রমণ করতে উৎসাহ দেবে; কাজেই এ শবদেহ বাইরে নিয়ে গিয়ে কাজ নেই। ‘কইলি বৈকুণ্ঠ’(নবকলেবরের পর জগন্নাথের পুরোনো দারুমূর্তি যেখানে সমাধিস্থ হয়)-তে চৈতন্যকে সমাধি দেওয়া হোক। প্রতাপরুদ্র সম্মতি জানালে, জগন্নাথ মন্দিরের দরজা বন্ধ করে চৈতন্যর নশ্বর দেহটিকে পুঁতে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়। সেই ভীষণ কার্য সমাপনান্তে মন্দিরের দরজা খুলে চন্দনযাত্রায় আগত ভক্তদের বলা হয়, চৈতন্য জগন্নাথদেহে লীন হয়ে গেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এরপর থেকে কোইলি বৈকুণ্ঠে জগন্নাথের দারুমূর্তি সমাহিত করার সময় – একটা নির্দিষ্ট গভীরতার বেশি খনন করতে দেওয়া হয় না।


মানুষের পক্ষে মূর্তিতে লীন হওয়া সম্ভব নয়, সেযুগেও গল্পটা বিশ্বাস করেনি লোকে। কিন্তু বৈষ্ণব ভক্তদের পাণ্ডাচক্র সম্বন্ধে সন্দেহকে ধামাচাপা দিতে এই জগন্নাথে লীন হওয়ার কাহিনী প্রচারিত হয়। জগন্নাথে লীন হওয়ার কাহিনী যাঁরা প্রচার করেছিলেন, সেই পঞ্চসখা সম্প্রদায়ের ঘনিষ্ঠ মাধবের বর্ণনা পড়লেই বোঝা যায় যে, তাঁরা নিজেরাও জানতেন – এটি গল্পগাছা। কারণ, লীন হওয়ার গল্প প্রচারের পাশাপাশি চৈতন্যর মৃতদেহ নিয়ে কী করা হবে, সে নিয়েও বন্দোবস্ত সমান তালে চলছে। মানুষ মরণশীল। শ্ৰীচৈতন্যও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তারও মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু কী বঙ্গীয়, কী ওড়িয়া – সব চরিৎকারই তাঁর মৃত্যুর ধরণ, স্থান, সময় ও তারিখ সম্পর্কে কোনও নির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি। চরিৎকারগণ একই চৈতন্যদেবকে নিয়ে লিখেছেন, অথচ এই মৃত্যুর ব্যাপারে এদের গরমিল চোখে পড়ার মত। অবশ্য মনে রাখতে হবে, স্বরূপ দামোদর, রায় রামানন্দ, গদাধর পণ্ডিত ও অচ্যুতানন্দ এবং শিখী মাহাতি ছাড়া বাকিরা কেউই মহাপ্রভুর শেষলীলার প্রত্যক্ষদর্শী নন। অন্যরা কেউ কেউ আবার ১০০-১৫০ বছর পরের লোক। এঁদের কেউ কেউ বলেছেন, মহাপ্ৰভু দেহত্যাগ করেছেন বৈশাখ মাসের সন্ধ্যায়; কেউ বলেছেন আষাঢ় মাসের শুক্লা সপ্তমীতে; কেউ বলেছেন, আষাঢ় শুক্লা সপ্তমীতে রবিবার তৃতীয় প্রহরে; কেউ বলেছেন, ফাল্গুনী পূর্ণিমায়। আশ্চর্যের ব্যাপার, স্বরূপ দামোদরের সেই পুঁথি বেমালুম বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিল পুরী থেকে। আজ পর্যন্ত তার কোনও খোঁজ মেলেনি। ঐতিহাসিকদের মতে, এই পুঁথিতে নিশ্চয়ই এমন কিছু স্বরূপ দামোদর লিখেছিলেন, যেটা ‘চৈতন্য-বিরোধী’রা মেনে নিতে পারেন নি। সে জন্যই পুঁথিটি লোপাট করা হয়। তাছাড়া পুরীতে চৈতন্যের কোনও সমাধি মন্দিরও নেই। যত গোলমাল এখানেই! এখন দেখা যাক, শ্ৰীচৈতন্যের বাংলা-চরিৎকারগণ তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে কী বলেছেন –


১.) অচ্যুতানন্দ, দিবাকর দাস, ঈশ্বর দাস, ঈশান নাগর, লোচন দাস – এঁদের মতে শ্ৰীচৈতন্য জগন্নাথের কালো অঙ্গে ‘লীন’ হয়ে গেছেন।
২.) জয়ানন্দ, নরহরি, সদানন্দ – এঁদের মতে, বাঁ পায়ে ইটের আঘাত পেয়ে চৈতন্য তোটা গোপীনাথের মন্দিরে আশ্রয় নেন, পরে সেখানেই তিনি ‘অন্তর্হিত' হন। কিন্তু, তাঁর মায়াশারীর পড়েছিল।
৩.) বৃন্দাবন দাস এ সম্পর্কে সম্পূৰ্ণ নীরব। সম্প্রতি বৃন্দাবন দাসের পুঁথির শেষের কিছু অংশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাতে তিনিও ‘অন্তর্ধান' কথাটিই বলেছেন।
৪.) বাংলার কৃষ্ণদাস কবিরাজ বলেছেন, 'চৌদ্দশত পঞ্চান্নে হইল অন্তর্ধান' ও ‘চৈতন্যের শেষলীলা রহিল অবশেষ'। অপর স্থানে বলেছেন, ‘প্রভুর যে শেষলীলা স্বরূপ দামোদর/সূত্র করি গাঁথিলেন গ্রন্থের ভিতর।’
৫.) সমুদ্রতীরে বিদ্যুতের মত ‘অন্তর্হিত’ হওয়ার কথা বলেছেন গোবিন্দ।
৬.) আদি চরিৎকার মুরারী গুপ্ত, কবি কর্ণপুর এ সম্পর্কে কিছুই বলেননি।
৭.) লোচনদাস তাঁর চৈতন্যমঙ্গলে বলেছেন, “একদিন প্ৰভু, একমাত্র গদাধর’কে সঙ্গে নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করেন। কিন্তু প্ৰভু একাই মন্দিরে প্রবেশ করার পর ‘কপাট’ আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যায়। পিছনে ভক্তরা এসে কান্নাকাটি শুরু করতে একজন পাণ্ডা ভেতর থেকে এসে খবর দিল যে প্ৰভু জগন্নাথে লীন হয়ে গেছেন।”


এ সম্পর্কে বর্তমান ঐতিহাসিকদের অনেকে কি কি প্রশ্ন তুলেছেন? তা হলে পরিষ্কার একটা আভাস পাওয়া যাবে যে, চৈতন্যের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে হয়নি। তাঁদের প্রশ্ন, তিনি জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করার পর, কি করে এত বড় ও ভারী চারটি প্রবেশপথের দরজা আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে গেল? তা হলে কি তাঁরই কিছু ঘনিষ্ঠ পার্ষদ ‘Judas’-এর ভূমিকা নিয়েছিল? কারণ, লোচনদাস জানিয়েছেন, ‘প্ৰভু’ যখন একাকী মন্দিরে প্রবেশ করলেন তখন ‘দুয়ারে নিজ লাগিল কপট’। জগন্নাথ মন্দিরের ওই বিশাল বিশাল দরজাগুলি কীভাবে নিজেই লেগে গেল, তা একমাত্র জগন্নাথদেবই বলতে পারবেন। ঐতিহাসিকদের মতে, সে সময় মন্দিরের ভেতরে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাই চট করে দরজা বন্ধ করেন। তা যদি না হয়, তা হলে পিছনে পিছনে তাঁর ভক্তরা যখন ‘ঘুচাহ কপাট প্ৰভু দেখি বড় ইচ্ছা’ বলে দরজা ধাক্কাধাক্কি করছেন, তখন নিজে লেগে যাওয়া কপাট খুলে গেল না কেন? শ্ৰীচৈতন্যের সঙ্গে কিন্তু মন্দিরে প্রবেশ করতে স্ক্যান হয়েছিলেন গদাধর পন্ডিত, স্বরূপ দামোদর ও গোবিন্দ। বৃন্দাবনদাস ঠাকুর তাঁর অপ্রকাশিত চৈতন্য ভাগবতের অবশিষ্ট অংশে বলেছেন, “আচম্বিতে গদাধর হইল অন্তর্ধান”। কীভাবে গদাধর আচমকা ‘অন্তর্হিত’ হলেন? বাকি দু’জনই বা কথায় গেলেন? তাঁরাও কি জগন্নাথের অঙ্গে লীন হলেন? অন্ধকার মন্দিরে লুকিয়ে থাকা শত্রুর দল তাঁদেরও কি গুম করে দিয়েছিল? এই যে প্রায় সমস্ত পণ্ডিত বলছেন, শ্রীচৈতন্যকে হত্যা করা হয়েছিল — স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে কে হত্যা করেছিল চৈতন্য’কে? পণ্ডিতদের মতে, এই ঘৃণ্য কাজের দায়িত্ব ছিল জগন্নাথ মন্দিরের দ্বাররক্ষী বাহিনীর তৎকালীন প্রধান দলপতির ওপর। তার নাম ছিল, ‘দীনবন্ধু প্রতিহারী’। সে নাকি, ‘বুকের ওপর বসে, গলা টিপে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরেছিল প্রভুকে’। ২৯শে জুন — বাঙলার ইতিহাসে এক কালো দিন। ১৪৫৫ শকাব্দের আষাঢ় মাস, শুক্লা সপ্তমী তিথি। রবিবার। সময় দুপুর তিনটে। চৈতন‍্যদেব পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে শেষবার ঢুকেছিলেন।


প্রশ্ন হল, চৈতন্যের শবদেহটা কীভাবে ও কোথায় হত্যাকারীরা পাচার করল? পুরীর ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের প্রাক্তন কর্মসচিব স্বামী অভিনবানন্দজির মতে, মহাপ্রভুর দেহটিকে মণিকোঠার রত্নবেদীর নিচেই ‘সমাধিস্থ’ করা হয়েছিল। ডঃ দীনেশ সেনের ধারণাও তাই। দুর্গাপদ চট্টোপাধ্যায় ও সমরেশ বসু, দু'জনেই আঙ্গুল তুলেছেন গোবিন্দ বিদ্যাধর ভোই-এর দিকে। ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায় যা যা লিখেছিলেন, তার মধ্যে এও রয়েছে — ‘কইলি বৈকুণ্ঠ’ অথবা ‘তোটা গোপীনাথে’র মন্দিরে সমাধি দেওয়া হয়েছিল। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও চৈতন্য বিশেষজ্ঞ পদ্মশ্ৰী সদাশিব রথ শর্মার মতে, তোটা গোপীনাথের বাঁধানো উঠানের বাম পাশ ঘেঁষে যে দুটি ছোট তুলসী মন্দির আছে, তার অপেক্ষাকৃত পুরনোটি চৈতন্যের সমাধি মন্দির।


মালীবুড়োর ‘শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য’ আমাদের জানাচ্ছে, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের উদ্ধত প্রকৃতির পাণ্ডাদের মধ্যে একটা ভীষণ নেতিবাচক মনোভাব চালু আছে। এই পাণ্ডাদের অনেকেই গর্ব করে বলে যে, চৈতন্যকে তাদের পূর্বপুরুষেরা হত্যা করেছিল। কেন করেছিল? এর কারণ হিসাবে এরা বলে, চৈতন্য নাকি বাংলার মুসলমান শাসকের চর ছিলেন! আর তাই চৈতন্যর উড়িষ্যায় আগমনের পরেই প্রথমবারের জন্য গৌড়ের মুসলমান শাসক ওড়িষ্যায় সফলভাবে হামলা করতে পেরেছিল। সাহসীজন এ ব্যাপারে পুরীতে গিয়ে উড়িয়া পাণ্ডাদের মধ্যে খোঁজখবর করে দেখতে পারেন — এরকম একটা কথা চালু আছে কি না। চৈতন্য আন্দোলনের ফলে উড়িষ্যায় মুসলমান হামলা হয়েছিল, এই বক্তব্য এমনই জোরালো হয়ে ওঠে ক্রমে, যে প্রভাত মুখার্জি, তাঁর ‘The History Of Medieval Vaishnavism In Orissa’ গ্রন্থে এটিকে রীতিমত তথ্য ও যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করেছেন, অর্থাৎ এটি উড়িয়ে দেওয়ার মত অকিঞ্চিতকর প্রলাপ নয়, অনেক ওড়িষ্যাবাসী এতে বিশ্বাস করেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি যে চৈতন্যর সাম্যময় ভক্তি আন্দোলনের ফলে পাণ্ডাদের মৌরসীপাট্টায় খুবই বাধা পড়ছিল। এজন্য চৈতন্যের নামে এই অপবাদটি ছড়ানো হয়েছিল এবং তাকে হত্যা করা হয় মন্দিরের ভেতরেই।


উক্ত বিষয়ে অতি সম্প্রতি ওড়িষ্যার এক জনপ্রিয় লেখক ডঃ বিবুধারঞ্জন রচিত গ্রন্থ ‘সে কৌঁঠি’র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত গ্রন্থে অনুবাদক ডঃ অজয় কুমার পাণ্ডা নির্দ্বিধায় চৈতন্যের গুমখুনের দিন সম্পর্কে জানিয়েছেন, “It was the afternoon of the Saptami Tithi(the 7th day) in the month of Ashadha(the 4th month as per the Hindu calender), the 29th June 1533 AD(Sunday) as per the Gregorian calendar.” এই গ্রন্থে আরও জানানো হয়েছে, “...Sri Chaitanya was murdered behind the Garuda Stambha inside the temple by the assassins.” কেবলমাত্র চৈতন্যই নন। তাঁর সঙ্গে সেই সময় শ্রীমন্দিরে প্রবেশ করতে সক্ষম স্বরূপ দামোদর, গদাধর পন্ডিত ও গোবিন্দ — এই তিন ঘনিষ্ঠ পার্ষদকেও হত্যা করা হয়েছিল। “All the four dead bodies were buried under the floor of the temple. In order to destroy the traces and to repair thoroughly after burial, time was required. Thus, the temple was closed from 4 to 11 p.m. for the visitors.” বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে গণমাধ্যম এতটাই সক্রিয় ও শক্তিশালী যে, সকলের অলক্ষে কোনো কিছু আজ আর ধামা-চাপা দেওয়া তেমন সহজ নয়। জনপ্রিয় এই ওড়িয়া গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।


চৈতন্যদেব পুরীতে গিয়ে ১৫১০ সালে প্রথমবার জগন্নাথদেবের গর্ভগৃহে প্রবেশ করার পরে, মানুষটি ২৩ বছর ধরে গর্ভগৃহে আর প্রবেশ করেন নি। কেবল বাইরে থেকে প্রণাম করে চলে আসতেন। তাহলে তাঁকে গর্ভগৃহে হত্যার পরিকল্পনা করা কিভাবে সম্ভব? একজন যেখানে প্রবেশই করেন না, সেখানে হত্যা করার জন্য লোকজন কেন পরিকল্পিতভাবে উপস্থিত থাকবে? বরং গরুড় স্তম্ভের নিকটে তাঁকে হত্যা করা অনেক সহজ। কারণ, জগন্নাথ দর্শনের নিমিত্তে চৈতন্য দৈনিক একবার করে অন্ধকারাচ্ছন্ন নাটমন্দিরের উক্ত স্থান পর্যন্ত যেতেন। আমাদের মধ্যে চৈতন্যদেব সম্পর্কে একাকী, উদাসীন সন্ন্যাসীর ধারণা থাকলেও, আসলে পুরীতে চৈতন্যদেব মোটেই একাকী থাকতেন না। চৈতন্যদেবের দেহরক্ষী হিসেবে সর্বদাই থাকতেন কাশীশ্বর। এই কাশীশ্বর একজন বলশালী ব্যক্তি ছিলেন এবং ছিলেন ঈশ্বরপুরীর শিষ্য। কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখেছেন, ‘‘লোক ঠেলি পথ করে কাশী বলবানে... প্রভুরে করান লঞা ঈশ্বর দর্শন/ লোক ভিড় আগে সব করি নিবারণ।’’


একে তো ‘কাশীশ্বর’ সর্বদাই সঙ্গে থাকতেন, তার উপর গর্ভগৃহের বাইরে থাকত অগণিত ভক্ত। এঁদের সকলের মাঝে চৈতন্যদেবকে জোর করে গর্ভগৃহে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। চৈতন্য নিজেও ছিলেন বলশালী – প্রথমবার জগন্নাথ দর্শনের সময়ে রক্ষীদলের প্রধান ‘অনন্ত প্রতিহার’কে তিনি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন। এই ‘অনন্ত’ পরবর্তীকালে চৈতন্যদেবের পরম ভক্ত হয়ে পড়েন। অনন্ত প্রতিহার ছাড়াও জগন্নাথ মন্দিরের কিছু পাণ্ডা এবং দায়িত্ববান ব্যক্তি চৈতন্যদেবের অনুগামী ছিল। তাছাড়া, কাশী মিশ্র এবং বাসুদেব সার্বভৌমের প্রবল প্রতিপত্তি ছিল মন্দিরে। সর্বোপরি রামানন্দ রায় ও স্বরূপ দামোদর চৈতন্যদেবকে কখনই একাকী ছাড়তেন না। সর্বোপরি মহারাজ প্রতাপরুদ্রের চৈতন্যপ্রীতির কথা সকলের জ্ঞাত ছিল। এত কিছু বাঁধা পার করে আচার-বিচার ও নিয়ম-কাননে পরিপূর্ণ জগন্নাথ মন্দিরে একদল লোকের পক্ষে চৈতন্যদেবকে হত্যা করা তখনই সম্ভব, যখন সর্ষের মধ্যে ভূত থাকে। অনেক চৈতন্য-গবেষকেরই বিশ্বাস, তৎকালীন উৎকল-সাম্রাজ্যের ক্ষমতালোভী মন্ত্রী গোবিন্দ বিদ্যাধর সিংহাসনের লোভে চৈতন্যদেবকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। এই বিষয়ে গোবিন্দ বিদ্যাধরকে সে সময়ে সাহায্য করেছিল শ্রীমন্দিরে কিছু পরশ্রীকাতর পুরোহিত ও পাণ্ডার দল। হয়তো চৈতন্যের পার্ষদের মধ্যেও দু-চার’জন বিষয়টার সঙ্গে যুক্ত ছিল। এরপরও আমি কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত প্রকাশ না করে, এইটুকু জানাতে পারি – চৈতন্যের জীবনের কয়েকটি ঘটনার পর্যালোচনা করলে, আমরা দেখতে পাব – চৈতন্যের মৃত্যু আদৌ স্বাভাবিকভাবে হয়নি। তাই সকলের বিচারের আশায় কয়েকটি প্রশ্ন ও তথ্য রাখলাম –


১.) অদ্বৈত আচার্য্য চৈতন্যকে হেঁয়ালি রচনার দ্বারা গুমখুন নিয়ে সাবধান করেছিলেন। তা বুঝেও কেন চৈতন্য নীরব রইলেন?
২.) চৈতন্যের মৃত্যু-সংবাদ পেয়ে চৈতন্যশিষ্য পুরীর রাজা প্ৰতাপ রুদ্র প্রাণভয়ে কটকে পালিয়ে গেলেন। তিনি কি রাজসিংহাসন হারানোর ভয় পেয়েছিলেন? তাঁরও কি প্রাণনাশের সম্ভাবনা ছিল?
৩.) চৈতন্যের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাবৎ চৈতন্যপন্থী ও গৌড়ীয় বৈষ্ণবেরা উৎকল ছেড়ে চলে গেলেন কেন? কেন অনেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন? নাকি তাঁদেরকেও গুমখুন করা হল?
৪.) চৈতন্যের অন্তর্ধানের পর তাঁর অন্যতম পার্ষদ স্বরূপ দামোদরকে আর জীবিত অবস্থায় দেখা গেল না কেন? দেখা গেল দামোদরের ‘হৃদয় ফেটে প্রাণ বাহির হইয়া গিয়াছে’। প্রকৃত অর্থে শত্রুর অস্ত্রের আঘাতে তো হৃদয় বিদীর্ণ হওয়ারই কথা। কিন্তু তাঁর, গদাধর পন্ডিত ও গোবিন্দের মৃত দেহের কি পরিণতি হল – তা জানা গেল না কেন?
৫.) তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যে উৎকলের সিংহাসনে বসলেন ষড়যন্ত্রকারী গোবিন্দ বিদ্যাধর। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘ভোই রাজবংশ’।
৬.) ড. দীনেশচন্দ্র সেনের ‘Chaitanya and His Age’ গ্ৰন্থ থেকে জানা যাচ্ছে, “For fifty years after the ‘Tirodhan’ of the great teacher, the Vaishnav community lay exervated by the great shock. Their Kirtan music which had taken the whole country by surprise, stopped for a time after that melancholy went and was not heard for nearly half a century in the great provinces of Bengal and Orissa.” জগন্নাথের দারুবিগ্রহে চৈতন্য যদি সত্যিই বিলীন হতেন, তাহলে তো এমনটা হওয়ার কথা নয়!
৭.) চৈতন্যদেব যদি সত্যিই জগন্নাথ বিগ্রহ লীন বা বিলীন হতেন। তাহলে যেই তিথিতে তা হয়েছেন, সেই তিথি নিয়ে একটা মাত্র সঠিক তথ্য কেন তাঁর জীবনীকাররা দিতে পারলেন না?
৮.) পুরীর শ্রীমন্দির-চত্তরের ভিতরে অবস্থিত সমস্ত মন্দিরের আকার এক না হলেও, তার গড়ন ও গঠন প্রায় এক। এই ‘রেখ-দেউল’ শৈলীর মন্দিরগুলি ছাড়াও এমন চারটি মন্দির আছে, যা বেশ বেমানান। উত্তর দিকের হস্তীদ্বার দিয়ে প্রবেশ করলে ‘কইলি বৈকুণ্ঠ’এ বা জগন্নাথের শ্মশানে যাওয়া যায়। তিনটি মন্দির এর নিকটে ও অপরটি আনন্দবাজারের নিকটে অবস্থিত। এই চারটি মন্দিরের মধ্যে যেটি সবচেয়ে বড়, তার উচ্চতায় ৬/৭ ফুট। উক্ত মন্দির-গাত্রে ‘সমাধি মন্দির’ লেখা আছে। এর পাশেই জগন্নাথের ফুলের মালা তৈরির ঘর। উড়িষ্যার সাধারণ কোনো গ্রামে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির মৃত্যুর পর নির্মিত সমাধি মন্দির বা স্মৃতি-মন্দির যেমন হয়, এই চারটি মন্দির ঠিক তেমন দেখতে। প্রতিটি মন্দিরের ভিতরেই কোনো বিগ্রহ নেই। তার বদলে দেখা যায় পাথরের পাদপদ্মের চিহ্ন। এগুলি কাদের সমাধি মন্দির? পাণ্ডাদের এই নিয়ে প্রশ্ন করলে, তাদের অনেকে রেগে যায়, অনেকে বিরক্ত হয়, অনেকে বাঙালি বুঝে – উত্তর না দিয়ে চলে যায়! কেন?
৯.) চৈতন্যকে নিয়ে ইতিহাসনিষ্ঠ আলোচনায় একদল বাঙালি আবার প্রাণপণে ব্যাগড়া দিয়ে থাকে। চৈতন্য গবেষণায় যা যা এদের মনঃপূত হয় না, সেগুলো নিষিদ্ধ করার চেষ্টা গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের এই দল প্রতিবাদ করেই চলেছে। প্রকাশ্যে এরা বলে যে, চৈতন্য ঐশ্বরিক চরিত্র – তাঁর ওপরে মানবতা আরোপ করে, তাঁকে পাণ্ডাদের হাতে নিহত দেখালে, বৈষ্ণবধর্মের আধ্যাত্মিক চেতনা নষ্ট হয়ে যাবে। এই সব যুক্তিহীন, হাস্যকর কথা বলে এরা কাদের দালালি করছে?


চৈতন্য যদি জগন্নাথের দারু অঙ্গেই লীন হয়ে গিয়েছিলেন, তা হলে তো সেই ঘটনা মানুষের মনে চৈতন্য এবং বৈষ্ণবপন্থার প্ৰস্ফুরণ ঘটাবার কথা, কিন্তু কাৰ্যত তা দেখা গেল না। উপরন্তু এক নিদারুণ আতঙ্কে উৎকল ও বঙ্গের বৈষ্ণবমণ্ডলী স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ড. জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের মতে, সেই কারণেই চৈতন্যদেবের ওপর লেখা সমস্ত বৈষ্ণব গ্রন্থ ইচ্ছে করে এড়িয়ে গেছে – চৈতন্যের তিরোধানের শেষ মুহূর্তের “অসহ্য বর্ণনাকে”। শুধু তাই নয়, কিছু ওড়িয়া গবেষকের রচনা পড়ে আমার মনে হয়েছে, গুমখুনের অব্যবহিত পূর্বের পাঁচ-সাত বছর, গোবিন্দ বিদ্যধরের ষড়যন্ত্রের ফলে চৈতন্যের জনপ্রিয়তায় শুরু হয়েছিল ভাটার টান। চৈতন্যের সঙ্গে গদাধর পন্ডিত ও এক পিতৃহীন অপূর্ব সুন্দর ওড়িয়া কিশোরের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে পুরীতে শুরু হয়েছিল ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ। তাই নিয়ে কিছু পার্ষদদের সঙ্গে চৈতন্যের মনোমালিন্যও হয়েছিল বলে জানা যায়। যদিও এই সব বিষয়ে বাংলার জীবনীকার ও গবেষকগণ আজও নীরব। এদিকে তুহিন মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “চৈতন্যকে কেন্দ্র করে তথ্যলোপের ঘটনা নতুন কিছু নয়”। তিনি আরও জানাচ্ছেন, “স্বরূপ দামোদরের ‘কড়চা’ আজও আবিষ্কৃত হয়নি, যেমন খুঁজে পাওয়া যায়নি বৃন্দাবনদাস রচিত ‘চৈতন্যভাগবত’এর শেষ অংশ। অনেকেই সন্দেহ করেন, বিশেষ কোনও উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থ দুটিকে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মুরারি গুপ্তের ‘কড়চা’র মূল পুঁথিটিও কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায় নি। … ঐতিহাসিক ড. অমূল্যচন্দ্র সেন-এর লেখা 'ইতিহাসের শ্রীচৈতন্য' গ্রন্থটিও (সেপ্টেম্বর ১৯৬৫) বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়।” আনুমানিক ১৫৪৮ নাগাদ বৃন্দাবন দাস রচিত ‘চৈতন্যভাগবত’ যে “রহস্যজনক ভাবে” অসম্পূর্ণ, তা বারিদবরণ ঘোষেরও মত।


চৈতন্য মহাপ্রভু, তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনে তিনি যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, যে সমাজসংস্কার ও ধর্মসংস্কার করে গেছেন – বারবার সেসব অধ্যয়ন করতে হবে এবং তাঁর মৃত্যু থেকেও শিক্ষা নিতে হবে। পাণ্ডাদের হাতে চৈতন্যর হত্যা শিক্ষা দেয়, পাণ্ডাতন্ত্রের গোঁড়ামি ও সঙ্কীর্ণ হিন্দুত্ববাদ – হিন্দুসমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। চৈতন্যকে আমাদের জাতির সহস্র সহস্র বছরের তারকাখচিত ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম বাঙালিদের একজন বলেই আমাদের মনে করা উচিত। আমি গবেষক নই, চৈত্যপ্রেমী মাত্র। চৈতন্য মহাপ্রভুর অন্তর্ধান নিয়ে যে সমস্ত তথ্য গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে – তা একত্রিত করে রাখলাম। যেখানে ৮০ বছর পূর্বের নেতাজি-অন্তর্ধান নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় না, সেখানে ৫০০ বছর পূর্বে সুকৌশলে ধামাচাপা দেওয়া চৈতন্য-অন্তর্ধান নিয়ে যে কোনো স্থিরসিদ্ধান্তই নেওয়া সম্ভব নয় – তা আমি অন্তত জানি।


।।৫।।


ভারতবর্ষে ভক্তি আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল দক্ষিণ ভারতের আলোয়ার বা আড়বারদের রচনায়, গানে। ‘আড়’ কথার অর্থ নিমগ্ন। ‘আড়োয়ার’এর অর্থ নিমগ্ন ব্যক্তি। হয়তো একটি বিশেষ গভীরতার মধ্যে নিমগ্ন মানুষজন দেবতার উদ্দেশ্যে গান রচনা করতেন। নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষায়, মাতৃ ভাষায় গান লেখার যে চাড় তৈরি করলেন আড়োয়াররা – সেখান থেকে তা চলে আসে মহারাষ্ট্রের দিকে। মধ্যযুগে ভারতীয় ভক্তি আন্দোলনের কোনো গ্রাফ যদি আঁকা হয়, তা হলে দেখা যাবে – তা দক্ষিণ ভারত থেকে মহারাষ্ট্র হয়ে, গুজরাট-রাজস্থান হয়ে উত্তরপ্রদেশ হয়ে সোজা আসাম ও বাংলামুখী। তাই আড়োয়ারদের পরেই নজরে আসে মারাঠী তুকারাম, নামদেব, জ্ঞানদেব। সেখান উঠে গেলেই আমরা পাচ্ছি ‘দাদূ’, যিনি গুজরাটের বিখ্যাত লৌকিক গানের রচয়িতা। তারপর একটু ওপরে উঠলে রাজস্থানের মীরাবাঈকে আমরা পেয়ে যাই। এক্ষেত্রে মীরাবাঈ-এর কথা একটু আলাদা করে এই জন্য বলা দরকার – কারণ, তিনি মধ্যযুগে রাজপুতানার রানার অন্তঃপুরে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন যে, আমি আমার প্রেমিক বলে মনে করি শ্রীকৃষ্ণকে। সমস্ত নিয়ম লঙ্ঘন করে, স্বামীত্বের যে বহিরাবরণ – তাকে অগ্রাহ্য করে তৎকালীন সমাজের বুকে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণকেই প্রাণের সখা ভাবার এই যে অসম্ভব ধৃষ্টতা, তাতে রয়েছে নারীবাদের দীপ্তি। মীরাবাঈ-এর পরে উত্তরদিকে গেলেই নানক, কবীর, রজ্জব। তারপর পূর্বদিকে ঘুরে গেলেই, আসামে শংকরদেব আর বাংলায় শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু। নবদ্বীপে তাঁর নেতৃত্বে চলিষ্ণু, হৃদয়ধর্মী, মানবমুখীন যে ধর্মান্দোলন শুরু হয়েছিল – তা পরবর্তীকালে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম নামে চিহ্নিত।


শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের পূর্বে নবদ্বীপ বৈষ্ণবসমাজ প্রতিষ্ঠার উল্লেখ মেলে মুরারীগুপ্তের কড়চায়। শান্তিপুরের অদ্বৈত আচার্য নবদ্বীপের বৈষ্ণবসমাজে নেতৃত্বের পদে অধিষ্ঠিত থাকায়, ‘চৈতনয়ভাগবত’এ তাঁকে ‘নাঢ়া’ বা ‘মূল’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্মণ সেনের সমসাময়িক কবি জয়দেবের অমর-কাব্য গীতগোবিন্দ, চণ্ডীদাসের সুললিত পদাবলী ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন(অনুঃ পঞ্চদশ শতকের প্রথম দিকে রচিত) বাঙালিকে চৈতন্যের অনেক আগেই বৈষ্ণব ধর্মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। বঙ্গদেশে ভক্তিবাদ প্রচারে মুখ্য ভূমিকা বা অবদান ছিল মাধবেন্দ্রপুরীর। তিনি ছিলেন মধুররসের উপাসক। অদ্বৈত আচার্য ও ঈশ্বরপুরী তাঁর শিষ্য ছিলেন। মাধবেন্দ্রপুরী ও ঈশ্বরপুরী, শঙ্করাচার্যের সম্প্রদায়ভুক্ত সন্ন্যাসী হলেও তাঁরা ভক্তিবাদকে অস্বীকার করেননি। কেশবভারতীও শঙ্করাচার্যের সম্প্রদায়ভুক্ত সন্ন্যাসী এবং সম্ভবত ভক্তিবাদী। একই সম্প্রদায়ভুক্ত দুই সন্ন্যাসী ঈশ্বরপুরী ও কেশবভারতীর নিকট চৈতন্যের যথাক্রমে মন্ত্র-দীক্ষা ও সন্ন্যাস-দীক্ষা গ্রহণ। যদিও কৃষ্ণভক্তির উপর আধারিত ও রাধভাবে ভাবিত বৈষ্ণব ধর্ম চৈতন্যের পূর্বে বঙ্গদেশে পাকাপাকি ভাবে স্থাপিত হয়নি। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না, বঙ্গদেশে ধর্মকে শাস্ত্রীয় বন্ধন থেকে মুক্ত করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সর্বপ্রথম জাতি-ধর্ম-বর্ণের উর্দ্ধে উঠে সর্বসাধারণের মধ্যে ভক্তিবাদ প্রচার করেছিলেন।


সমস্ত শ্রেণীর মানুষকে একত্রিত করে, প্রেম ভক্তির দ্বার খুলে – এক মহাপ্লাবনে বঙ্গদেশকে ভাসিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন চৈতন্য, যার তরঙ্গ আজও বাংলার ধর্ম জগতের মর্মস্থানে দোলা লাগিয়ে যাচ্ছে! চৈতন্যের ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন সমাজের বেশির ভাগ পিছিয়ে পড়া নিঃসহায় মানুষ। সমাজের বিত্তবান শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা বা সহযোগিতা চৈতন্যদেব লাভ করেননি। বরং তিনি ছিলেন সে সময়কার সমাজপতি ব্রাহ্মণ্য ধর্মের রক্ষক ও ধনী বিষয়ভোগীদের চক্ষুশূল। সমাজপতিরা নিম্ন শ্রেণির অন্ত্যজ মানুষদের সর্বদা অস্পৃশ্য করে রাখার কৌশল অবলম্বন করতেন। অস্পৃশ্যরা কোনও রকম ধর্মাচরণের সুযোগ পাওয়ার অধিকারী ছিলেন না। কিন্তু এই যে নতুন অভূতপূর্ব সাধান ধারা, এর আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছিলেন বাংলার উত্তরকালের প্রায় সমগ্র সাধক-কূল। শুধু বৈষ্ণবরাই নয়; শৈব, শাক্ত, সন্ন্যাসী – কেউই এর থেকে বাদ যান নি! শুধু তাই নয়, চৈতন্যই বাংলার প্রথম অবতার কল্প মহাপুরুষ। তাঁর পূর্বে ধর্মের কেন্দ্রস্থলে থাকত জীর্ণ পুঁথির ধূসর দেব, দেবীরা। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি দেব, দেবীদের স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পুজো পেলেন। তখন থেকেই বিপুল মাত্রায় প্রচারিত হল – অবতারের মধ্যে দিয়ে ইশ্বরের প্রকাশ, নয়তো ইশ্বরকে ধরা দুষ্কর। মানুষ কেবল মাত্র মানুষের মধ্যে দিয়েই সেই অসীমকে ছুঁতে পারে। তাই যুগে যুগে যিশু, বুদ্ধের আবির্ভাব। তাই চারদিকে পীর, গুরু, মুরশিদের ছড়াছড়ি। এই যে ধর্মের মানবায়ন, তা বাংলায় চৈতন্যকে দিয়েই শুরু।


এর বাইরেও মহাপ্রভুর প্রভাবেই বাংলা ভাষা পেয়েছিল প্রথম সুললিত কাব্যের ধারা। এর পূর্বেও বহুবিধ কাব্য অবশ্যই ছিল। কিন্তু সেই কাব্যের প্রতিপাদ্য বিষয় – আক্রোশ পরায়ণ দেব-দেবীর মহিমা কীর্তন। একাধারে মানবীয় এবং ঐশ্বরিক প্রেমের রসে জারিত কাব্য রচনা এই প্রথম! চৈতন্যদেবের জীবন-বর্ণনা প্রসঙ্গে ষোড়শ শতকে রচিত চৈতন্যলীলা বিষয়ক গ্রন্থ ও সমসাময়িক পদকর্তাদের রচনাই প্রধান সম্বল ও সম্পদ। ব্যক্তিকে দেবতার আসনে বসিয়ে জীবন-বৃত্তান্ত রচনার মাধ্যমে মহিমা-কীর্তনও বাংলার বুকে চৈতন্যকে কেন্দ্র করেই সর্বপ্রথম সংগঠিত হয়েছিল। আবার, পদাবলী সাহিত্যের হাত ধরেই বাংলার আদি ও অকৃত্রিম পদ কীর্তন বা রস কীর্তন গঠিত হল। শাস্ত্রীয় রাগ রাগিনীময় ধ্রুপদ গীতির সঙ্গে বাংলার নিজেস্ব সুর, ছন্দ, উচ্চারণ এবং গায়কী মিশে সৃষ্টি হোল এমনি এক অভূতপূর্ব সঙ্গীতের – যা হয়ে রইল চিরকালীন। তার সম্পর্কে বলতে ইচ্ছে করে, সঙ্গীতের সুর আর কাব্যের ভাব প্রকাশের নির্ভুল মেলবন্ধন এই কীর্তন। কীর্তন শব্দের সাধারণ অর্থ হল কীর্তির গান বা প্রশংসার গান। যে কোন দেবদেবীর উদ্দেশ্যে কীর্তিমূলক গান প্রযোজ্য হলেও প্রধানত শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে কীর্তিগান বোঝাতে ‘কীর্তন’ শব্দটি বহু কালাবধি এ দেশে প্রচলিত। ডঃ হিতেশরঞ্জন সান্যাল জানিয়েছেন, ঈশ্বর বা দেবতার নামগান বা স্তুতিগান করার প্রথা ভারতীয় সংস্কৃতিতে খুব প্রাচীন।


নামকীর্তনের মহিমা ভাগবত ও অপরাপর প্রাচীন গ্রন্থে বর্ণিত রয়েছে। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য ভক্তদের কাছে নামসংকীর্তনের মহিমা প্রচার করেছিলেন। সংকীর্তন হল সম্যকরূপে কীর্তন। ‘হরের্নাম হরের্নাম হরের্নামৈব কেবলম। কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা।।’ – এই সুপ্রসিদ্ধ শ্লোকটির বিশদার্থ-ব্যাখ্যা করে শ্রীচৈতন্য জগতের সমস্ত শ্রেণীর মানুষকে বুঝিয়ে ছিলেন – কলিযুগে হরিনাম ব্যতীত জীবের গতি নেই। হরিনাম সংকীর্তন কলিযুগে সর্বাভিষ্ট লাভের শ্রেষ্ঠ উপায়। বিধর্মী শাসকের অনিচ্ছা সত্ত্বেও মধ্যযুগীয় সামাজিক ও ধর্মীয় পরিবেশে এরূপ কীর্তনের মাধ্যমে উদাত্তকণ্ঠে নামের মহিমা প্রচার করাকে অবশ্যই বৈপ্লবিক প্রচেষ্টা বলে আখ্যায়িত করা যায়। শ্রীচৈতন্যের ভক্তি ডোরে বাঁধা পড়ে বাঙালি জাতি যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। কীর্তন বা নামসংকীর্তনের দ্বারা ভগবৎ-প্রীতি-লাভের কথা এদেশে তিনিই সর্বপ্রথম প্রচার করেন। কীর্তনের গীতপ্রবাহ বহুধাবিভক্ত বাঙালির ধর্মীয় কারার প্রাচীরে আঘাত হানে, ভক্তির এক অভিন্ন ধারায় মিলিয়ে দেয় বৃহত্তর বাঙালি জনসমাজকে।


ভক্তি মার্গের প্রতি আকৃষ্ট মানুষ ভক্তিগীতের অভিন্ন মিছিলে অংশগ্রহণের ফলে, কীর্তন একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। শ্রীচৈতন্যের নগর সংকীর্তন বৈষ্ণবদের কাছে একটি অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় কর্ম হিসেবে পরিগণিত হয়। এই পন্থায় সমাজের সব ধর্মের মানুষ গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের কীর্তন মিছিলের সদস্যে পরিণত হয়ে উঠেছিল অচিরেই। ঢোল, করতাল মৃদঙ্গ, মন্দিরা সহযোগে নৃত্যগীত ও কৃষ্ণভক্তি মিছিলে সমগ্র বাংলার পথঘাট আজও মুখরিত হতে দেখা যায়। ভারতের অন্য কোনও ভক্তি সংগীতে এই অভিনব মাধ্যমের উপস্থিতি ছিল না। শ্রীচৈতন্যের দর্শনের বাহ্যিক প্রকাশ ছিল এই নগর সংকীর্তন। তৎকালীন ধর্মের তীব্র বেড়াজালকে চূর্ণ করে দিয়ে সাম্যের ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব। শ্রীচৈতন্যের নাম সংকীর্তন, দীর্ঘদিনের অবহেলিত শূদ্র জনগোষ্ঠীকে কৃষ্ণ নামে আপ্লুত হতে সাহায্য করেছিল।


বহু কাল পরে এই কীর্তন গানের ভাব থেকেই জন্ম নেবে পরবর্তী যুগের শাক্ত পদাবলী ও শ্যামা সঙ্গীত! আবার কীর্তন গানের শেষের ‘হরিবোল’ ধ্বনির অনুকরণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাতীয় সঙ্গীতের শেষ ছত্রে লিখবেন “জয় হে, জয় হে, জয় হে”! রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব পদাবলীর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন, বৈষ্ণব সাহিত্য কবি চিত্তে জাগিয়েছিল নানা জিজ্ঞাসা। নানা প্রবন্ধে, কবিতায় তিনি বৈষ্ণব বিষয়ক প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। এমনকি ভানুসিংহ ছদ্মনামে বৈষ্ণব পদাবলিও রচনা করেছিলেন। এমনকি ঊনবিংশ শতাব্দীতে কবি মধুসূদন দত্তও বৈষ্ণবভাবাবেগে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘ব্রজাঙ্গনা’ রচনা করেছিলেন। চৈতন্যের প্রভাবে বাংলা ভাষায় প্রথম জীবনী সাহিত্য রচনার সূত্রপাত ঘটে। ‘মুরারী গুপ্তের কড়চা’, ‘স্বরূপ দামোদরের কড়চা’, বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতনভাগবত’, জয়ানন্দ ও লোচন দাসের ‘চৈতন্যমঙ্গল’, কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ উৎকৃষ্ট চৈতন্যজীবনী কাব্য। লক্ষণীয় তখনও বক্তিস্বাতন্ত্র্যের যুগ আসেনি। অনুবাদ সাহিত্যেও চৈতন্যদেবের প্রভাব কম নয়।


।।৬।।


বাংলার শিল্প ও স্থাপত্য তো নব জীবন লাভ করেছিল চৈতন্যের হাত ধরে। তার উদাহরণ ছড়িয়ে আছে গ্রাম বাংলার মন্দিরে, দেবালয়ের বিগ্রহের অধিষ্ঠানে, স্থাপত্য ভাস্কর্যের অলংকরণে, দারু-ভাস্কর্যে ও পটচিত্রে। একবিংশ শতাব্দীতে বাংলার মন্দির স্থাপত্য বলতে যা পাওয়া যায় তা মূলত রেখ(শিখর) ও সামান্য কিছু পীঢ়া(ভদ্র) দেউল; যেগুলো মূলত কলিঙ্গ স্থাপত্যের অনুকরণে নির্মিত হয়েছিল। পাল, সেন যুগের প্রাচীন শিল্প রীতি ক্রমাগত মুসলমান আক্রমণে সেসময় সম্পূর্ণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। প্রায় ২০০ বছর বিশেষ কোন সৌধ বা উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য রীতি তৈরি হয় নি বাংলার মাটিতে, মন্দির তো দূর অস্ত! এসময় মন্দির স্থাপত্যের বিকাশ যে শুধু রুদ্ধ হয়ে গেল তাই নয়, বেশ কিছু হিন্দু স্থাপত্য ভেঙ্গে মসজিদ নির্মাণও হয়। তারপর হঠাৎ গৌরাঙ্গের এই নব ভাবান্দলনে মরা গাঙে জোয়ার এল। তৈরি হতে লাগলো একের পর এক মন্দির। নতুন অভিব্যাক্তি পেল বাংলার স্থাপত্য।


চৈতন্য ধর্মের মূল কথা – দেবতার মানবায়ন। সেই সত্যকে রুপদান করতে বাংলার সূত্রধর শিল্পীদের ভুলতে হোল গগনচুম্বী মন্দির শিখর গড়া! মাথা তুলল মাটির, খড়ের ছাওয়ার কুঁড়েঘরের অনুকরণে তৈরি চালামন্দির-শৈলী! যেখানে দেবতাও আমাদেরই মতন ঘরে থাকেন! দেবতার সঙ্গে আমাদের কোনও প্রভেদ রইল না। বাংলার স্থপতিরা কলিঙ্গের অনুকরনের রাস্তায় না হেঁটে, বাংলার সমাজ, ভূমিপ্রকৃতি আর জলবায়ুর কথা ভেবে – গ্রাম বাংলার খড়ের চালাকেই তাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে বেছে নিলেন। সেই চালা স্থাপত্য চমৎকৃত করেছিল বাদশা আকবরকে, যিনি বঙ্গের স্থপতিদের নিয়ে প্রাসাদ বানিয়েছিলেন আগ্রা দুর্গে। সেখান থেকে সেই স্থাপত্য রীতি ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ভারতবর্ষে, বিশেষত রাজপুতানায়। একথা বললে একেবারেই উত্যুক্তি হবে না, এই যে বাংলার নিজেস্ব স্থাপত্যের পুনরুজ্জীবন, তা প্রায় সম্পূর্ণ ভাবে চৈতন্য ভক্তি আন্দোলনের ফসল! এরপর এই চালা স্থাপত্য থেকেই সময়ের হাত ধরে এল রত্ন স্থাপত্য। এ সবই বাংলার একান্ত নিজস্ব স্থাপত্যশৈলী। তবে শুধু চালা বা রত্ন মন্দিরই নয়, বরং বাংলার দোলমঞ্চ ও রাস মঞ্চ নির্মাণের সঙ্গেও চৈতন্য আন্দোলনের গভীর যোগসূত্র আছে। শুধু বাংলা মন্দিরের আকৃতিই নয়, বাংলার মন্দির ভাস্কর্যের গায়ে যে অনন্যসাধারন টেরাকোটার কাজ দেখা যায় – বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে বিচার করলে তা শুধু ভারতবর্ষ নয়, পৃথিবীতে বিরল। এই টেরাকোটার কাজসমূহে সৌন্দর্যায়নের জন্য ফুটে উঠেছে মহাকাব্য, পুরাণ আর তৎকালীন বাংলার সমাজ ও রাজনৈতিক জীবন।


এরই সঙ্গে স্ফুরিত হোল চিত্রকলা। ষোলো থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত প্রাপ্ত কয়েকটি পুঁথি পাটায় বৈষ্ণব ভাবধারার চিত্র প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর শুরু চৈতন্যের প্রভাবে। যেহেতু পুঁথি থেকে খুলে পাটাগুলো আলাদাভাবে সংগৃহীত হয়েছে তাই লিপিকাল ও অঙ্কনকাল সঠিকভাবে জানা যায় না।পাটাচিত্রে বা বাংলার লোকচিত্রে, ওড়িয়া ও রাজপুত শিল্পকলার মিশ্রন ঘটেছে। তাছাড়া জৈন চিত্রকলার ছায়া পড়েছে। বীরভূমের একটি সপ্তদশ শতকেত পাটায় মূর্ছিত চৈতন্যদেবকে রাজা প্রতাপ রুদ্রের পদসেবার চিত্রটি পুথিচিত্র পরম্পরার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। পুঁথির বাইরের পাটাচিত্রের জন্মস্থান তো বাংলা বটেই, চৈতন্যের প্রভাবেই তা গেল পশ্চিম ভারত অবধি। উত্তর ভারতীয় ক্ষত্রিয় রাজপুত বংশগুলির মধ্যে বৈষ্ণব আচার্য, গোঁসাইদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে উঠল সমগ্র উত্তর ভারতে। যা ছিল বাংলার, তা হয়ে উঠল সবার!


বিভিন্ন চৈতন্য জীবনীগ্রন্থে, তাঁর চিত্রপট দর্শনের বিবরণ রয়েছে। চৈতন্যদেব শিল্পকলার অনুরাগী ছিলেন। সে সময় পটচিত্রাঙ্কন গৌড়ের অনেক জায়গায় প্রচলিত ছিল। ভাস্কর ও সূত্রধর সম্প্রদায় যেমন পটচিত্র একেছেন বহু যুগ ধরে, জাত পটুয়ারাও দীঘল পট এঁকেছেন। মধ্যযুগে বিভিন্ন শিল্পী সম্প্রদায় নানা রকম চৌকো পট আঁকত। চৈতন্যের উত্থানে তাঁরা প্রভাবিত হন। বিষ্ণুপুরের ফৌজদার সম্প্রদায়, শান্তিপুরের কুম্ভকার সম্প্রদায়ের চৈতন্য-বিষয়ক অনেক ছবিই সংরক্ষিত আছে। বর্ধমানের মেরতলা গ্রামে অসাধারণ চৌখাপট আঁকা হত বলে জানা যায়। সর্বত্র রয়েছে চৈতন্য ও তাঁর জীবনযাপনের চিত্র। শ্রীহরিদাস ৭ টি প্রাচীন চৈতন্য ও বৈষ্ণব চিত্রের উল্লেখ করেছেন –


১/শ্রী বিশাখা দেবীকৃত শ্রীমন মদনগোপালের চিত্রপট।
২/রাধাকুন্ডে মা জাহ্নবার ঘাটে শ্রীমন মহাপ্রভুর চিত্রপট।
৩/কুঞ্জঘাটার রাজবাড়িতে সপার্ষদ মহাপ্রভুর চিত্রপট।
৪/পুরীর রাজবাড়িতে পূর্নাকৃতির চৈতন্যদেব।
৫/মুম্বাই-এর ভোঁসলে হাউসের মহাপ্রভুর চিত্র।
৬/শ্রীরাধাকুন্ডে শ্রীমদ্দাস গোস্বামীর ভজনকুটিরে রস্রাজ মহাভাব চিত্র দিল্লির সুলতান কর্তৃক আদেশে উৎকলীয় সামন্তরাজের চিত্রকর কর্তৃক সাক্ষাদৃষ্ট শ্রী গৌরাংগের অবিকল চিত্র।
৭/শ্রী চৈতন্য সংকীর্ণ শ্রীনিবাস আচার্যপ্রভুর গৃহে ছিল,খিষ্টীয় সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে ইহা নির্মিত, এঁড়েদহ ঠাকুরবাড়িতে বর্তমানে আছে।


মুর্শিদাবাদে কুঞ্জঘাটার রাজবাড়ির একটি চিত্র অনেক সংকলনে মুদ্রিত হয়েছে। ছবিটি তেলরঙে আঁকা। দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন ছবিটি চৈতন্যদেবের জীবনকালেই আঁকা হয়েছিল।এড়েদার চৈতন্য সংকীর্তনের চিত্রটিও সপ্তদশ শতকে অঙ্কিত। এই চিত্রটি সপ্তদশ শতকের বাংলার চিত্রকলার অবিস্মরণীয় উদাহরণ। আঠারো শতকে মুর্শিদাবাদ বাংলার চিত্রকলার প্রধান ক্ষেত্র ছিল। মুঘল যুগের সমাপ্তির পর উত্তর ভারতের শিল্পীরা মুর্শিদাবাদে এসেছিলেন। এর ফলে মুঘল, রাজপুত এবং বাংলা তিন চিত্রকলার সম্মিলিত মিশ্রন হয়েছিল। নসীপুর এই তিন চিত্রকলার মিলনের ক্ষেত্র ছিল। নসীপুর থেকে সংগৃহীত বেহালা সংগ্রহশালায় চৈতন্যদেবের বেড়ানৃত্যের একটি অনুচিত্র রয়েছে। এটা দেশীয় গুয়াশ পদ্ধতিতে আঁকা। সোনার রেখা দিয়ে অবয়বগুলো হাইলাইট করা হয়েছে। এই চিত্রের শিল্পী কিষনগড় থেকে এসেছিলেন ১৭৫০ সালে।এই সময়ের আরেকটি বিখ্যাত অনুচিত্র হল চৈতন্যদেব ও কুকুর। চৈতন্যদেবের প্রভাব শুধু উচ্চবর্নের চিত্রকর ভাস্করদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বাংলার পটুয়ারা চৈতন্যদেবকে অবলম্বন করে পট এঁকেছেন। শত শত মন্দিরে চৈতন্যের দেওয়াল চিত্র আঁকা হয়েছে।


দুঃখের বিষয় হলো বাংলার মধ্যযুগের চিত্রকলার বৃত্তান্ত নিয়ে কাজ হয়েছে সামান্য। তবে একথা স্পষ্ট বোঝা যায় মধ্যযুগের সর্বস্তরের মানুষ এখনকার চেয়ে তখন অনেক বেশি চিত্রকলা উপভোগ করতেন। কয়েকজন শিল্পীর পরিচয় পাওয়া যায় মঙ্গলকাব্য ও জীবনী সাহিত্যে। তার সঙ্গে দারু-তক্ষণ শিল্পের উচ্চমার্গের প্রাচীন নিদর্শনের বেশ কিছুর সন্ধান মিলেছে সমগ্র বাংলা থেকে। এই তক্ষণ কর্মে বাংলার সূত্রধরদের নৈপুণ্য সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। সূত্রধরদের তৈরি কাঠের ঠাকুরগুলো ভারতীয় ভাস্কর্যরীতির এক বিশেষ আঙ্গিককে তুলে ধরেছে। চৈতন্যদেব ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। এর তিন বছর পরে ১৫১৩ সালে তাঁর প্রথম দারু বিগ্রহটি বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী নির্মাণ করান। বলা হয়, যে নিম গাছের তলায় তাঁর জন্ম হয়েছিল; সেই গাছের কাঠ দিয়েই তৈরি হয়েছিল চৈতন্যদেবের দারু বিগ্রহটি। মূর্তির পাদপীঠে খোদাই করা আছে “১৪৩৫ শক, বংশীবদন”। অনুমান, বংশীবদন নামের এক শিল্পী এই মূর্তির রূপকার। আবার অনেক গবেষক মনে করেন, চৈতন্য পরিকর ও পদাবলীকার বংশীবদনের উদ্যোগে এই মূর্তিটি নির্মিত। মূর্তিটি বহু সংস্কারের পর এখন নবদ্বীপে র‍য়েছে। এই মূর্তি থেকেই সে আমলের চৌকো পটের অবয়ব গঠন কেমন ছিল তার স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।


ইতিহাস পড়লেই জানা যায়, পুরীর জগন্নাথদেব বাংলায় জনপ্রিয় হন মধ্যযুগে। বাংলার কাছেই পুরী তীর্থক্ষেত্রের অবস্থান। চৈতন্যদেবের নীলাচলে বাস বাংলার জগন্নাথ সংস্কৃতির উৎস। শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাবে বাংলায় জগন্নাথ সংস্কৃতিতে এক অদ্ভুত জোয়ার আসে। জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রাসহ দারু নির্মিত বাকি দেব-দেবীদের এমন বিগ্রহগুলি মূলত নিমকাঠের। কারণ, নিমকাঠে পোকা হয়না। এর বাইরে রাধা-কৃষ্ণ, বলরাম, অনন্তবাসুদেব, যশোমাধব, ষড়ভুজ চৈতন্য, গৌর-নিতাই, রামচন্দ্রের দারুমুর্তি তো আছেই; দুর্গা, কালী, চণ্ডী, অন্নপূর্ণা, লক্ষ্মী, জগদ্ধাত্রী, বিশালাক্ষী, বাঁশুলি, পঞ্চানন, মনসা, দক্ষিণেশ্বর বা দক্ষিণরায়, নারায়ণী, ইত্যাদি দেবদেবীদেরও দারুবিগ্রহ সমগ্র বঙ্গদেশে জুড়ে দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি নানা বৌদ্ধ দেবদেবী, গোরক্ষনাথ, পির-গাজী-বিবি, ইত্যাদি বিচিত্র সব দারুবিগ্রহেরও সন্ধান পাওয়া গেছে। বাংলার আবহমান ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী এই সব দারুবিগ্রহ নির্মাণের পিছনে অবশ্যই রয়েছে চৈতন্যের ভূমিকা। চৈতন্যদেব শ্রীক্ষেত্র গিয়ে অবস্থান করার ফলেই জগন্নাথের দারু বিগ্রহের বিষয়ে বঙ্গ-সমাজ বিস্তারিত ভাবে জানতে পারে। তারই প্রভাবে দারুবিগ্রহ নির্মাণের পরিমান নদী-নালা ও গাছ-গাছালিতে পরিপূর্ণ বঙ্গে বৃদ্ধি পায়। খোঁজ নিলে জানা যায় – এই সমস্ত মূর্তিগুলি বয়স ১০০ থেকে ৪০০-৪৫০ বছর পর্যন্ত। গ্রাম বাংলার টেরাকোটা-মন্দিরের ফলক নির্মাতাদের পদবী ছিল সূত্রধর। তাঁরাই যে কাঠের কাজও করতেন – সে তথ্য নতুন নয়। এই দারুবিগ্রহসমুহ হয়তো সেই ইঙ্গিতই বহন করে চলেছে। কলকাতার গুরুসদয় দত্ত সংগ্রহশালায় সূত্রধরদের নির্মিত কাঠের মূর্তির নমুনা আজও বর্তমান। তার গঠনশৈলীর সঙ্গে দেব-দেবীদের দারুবিগ্রহগুলির মিল রয়েছে। এছাড়া বর্ধমানের কাটোয়ার দাঁইহাট, নতুনগ্রাম; বীরভূমের একচক্রা; নদীয়ার নবদ্বীপ; মেদিনীপুরের মহিষাদল; দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বারুইপুর, জয়নগর, ডায়মন্ডহারবার, ইত্যাদি স্থানে কাঠের কাজের দক্ষ শিল্পী বা কারিগর সংখ্যায় মুষ্টিমেয় হলেও আজও মেলে।


একথা সত্যি যে কোন সামাজিক বা রাজনৈতিক আন্দোলনের ছাপ স্থাপত্যে ফুটে উঠতে বেশ খানিকটা সময় নেয়; বরং তা অনেক দ্রুত ফুটে ওঠে সঙ্গীত ও সাহিত্যে। উদাহরণ স্বরুপ জানাই, বাংলার বুকেই গত একশ বছরে স্বদেশী আন্দোলন থেকে নকশাল বাড়ি দানা বেঁধেছে – যার ছাপ পরেছে সাহিত্য, সঙ্গীত ও অন্যান্য ক্ষেত্রে। কিন্ত চৈতন্য আন্দোলনের পর থেকে প্রায় দীর্ঘ পাঁচশো বছর কেটে গেলেও, বাংলার বুকে এমন বড় মাপের সামাজিক আন্দোলন হয়নি – যার প্রভাব এসে পরেছে স্থাপত্যে। রাজনীতিক ও সামাজিক পালাবদল এবং যুগের অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলার স্থাপত্যও বদলেছে ঠিকই, কিন্ত চৈতন্য আন্দোলনের তীব্রতায় মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে যেভাবে বাংলার স্থাপত্য ও ভাস্কর্য রীতিতে নিজস্ব সত্তার জন্ম হয়েছিল তা সত্যিই বিরল!


শুধু তাই নয় প্রায় সর্বকালের সমস্ত বাঙালি মনীষীগণ ছিলেন চৈতন্যের দ্বারা প্রভাবিত বা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট। তবে ব্যতিক্রমও ছিল। বিমানবিহারী মজুমদার একটি চিত্তাকর্ষক তথ্য দিয়ে বলছেন, “রামমোহনই, তাঁর লেখায় বাঙালির আধুনিকযুগে প্রথম চৈতন্যবিরোধিতার ডাক দিয়েছিলেন।” হ্যাঁ, রামমোহন সম্পর্কে একটি বিস্মৃত তথ্য হল তিনি চৈতন্যবিরোধী ছিলেন। তবে অদূর ভবিষ্যতে সেই রামমোহনের ব্রাহ্ম আন্দোলনেই চৈতন্যপ্রভাব এসে গেল। ব্রহ্মানন্দ কেশব সেন চৈতন্যের ভক্তি আন্দোলনের আদর্শ গ্রহণ করলেন আর পূজ্যপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, তিনি তাঁর পূর্বজ অদ্বৈতকে স্মরণ করে চৈতন্যয় ফিরলেন। বিমানবিহারী বলছেন গৌড়বঙ্গে চৈতন্যবিরোধিতার কোনও স্থায়ী ধারা নেই, মাঝে-মধ্যে বৃথা চেষ্টা ইতস্তত যা ছড়িয়ে আছে, তা যে কোনও চৈতন্যজীবনীকার অবহেলায় অবজ্ঞা করবেন। কারণ, তা সারবস্তুবিহীন ও অকিঞ্চিৎকর।


সেই গৌরাঙ্গকে আজ শিক্ষিত শহুরে বাঙালি ভুলেছে। রাস্তাঘাটে চলতে গেলে হামেশাই দেওয়ালে আঁকা মনিষীদের ছবি দেখা যায়। সেখানে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, নেতাজি থেকে মাদার টেরেসা পর্যন্ত ঠাঁই পান। শুধু বাদ চৈতন্য! কেন এই অনীহা? এ কি শুধুই শহুরে বাঙ্গালীর আত্মবিস্মৃতি? নাকি পাশ্চাত্য অনুকরণ প্রিয় এক Anglicized জাতির colonial hangover, যা তাকে ব্রিটিশ যুগের বাইরেটা দেখতেই দেয় না! বাস্তবিক, আজ শহুরে বাঙালি যে সংস্কৃতির ধ্বজা উড়িয়ে গর্ব করে, তার প্রায় ষোল আনাই ব্রিটিশ শাসিত যুগের সংস্কৃতি। তার বাইরে কি কিছু নেই আমাদের! অথচ, বাংলাকে চিনতে গিয়ে যখন পথে নামি, তখন বড় প্রকট ভাবে চোখে পড়ে চৈতন্য প্রভাবের চোরা স্রোত। বাউলের গানে, গ্রামের হরিসভার কীর্তনে, লোকসঙ্গীতে, ভানু সিংহের পদাবলীতে, আদিবাসীদের ঝুমুর গানে, কাজী নজরুলের কাব্যে, দ্বিজেন্দ্রগীতির সুরে, অবনীন্দ্রনাথ-নন্দলাল-ক্ষিতীন্দ্রনাথ হয়ে গণেশ পাইনের তুলিতে, সর্বত্র মহাপ্রভুর অবাধ আনাগোনা! অর্ধসহস্রাব্দ পরেও যেন বঙ্গ-জাতির জনক, সমগ্র জাতিকে দুবাহু দিয়ে আগলে রেখেছেন। কিন্তু আধুনিকতায় গা ভাসান বিগত চার-পাঁচ দশকের প্রজন্মসমূহ – তাঁকে চিনছে না, দেখতে পাচ্ছে না। তাঁকে একটু চিনিয়ে দেওয়ার জন্যই এতগুলো কথার অবতারণা। কারণ, চৈতন্যের জন্য চৈতন্যোদয় হওয়া একান্ত প্রয়োজন।


তথ্যসূত্রঃ


১.) চৈতন্য চরিতামৃত, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, আনন্দ পাবলিশার্স।
২.) চৈতন্যভাগবত, বৃন্দাবনদাস, শেষ-একাদশ।
৩.) চৈতন্য ভাগবত, ঈশ্বরদাস।
৪.) চৈতন্যমঙ্গল, জয়ানন্দ।
৫.) Chaitanya and His Age, Dinesh Chanda Sen.
৬.) History of Orissa, R.D. Banerjee, Bharatiya Publishing House, Delhi, Vol 1, P. 338.
৭.) চৈতন্যের দিব্যজীবন, বলরামদাস, চিত্তরঞ্জনদাস, সাহিত্য অ্যাকাদেমি, নিউদিল্লি, ১৯৮২, পৃ.১৮-১৯।
৮.) কাঁহা গেলে তোমা পাই, জয়দেব মুখোপাধ্যায়, প্রাচী পাবলিকেশনস।
৯.) চৈতন্যদেব : ইতিহাস ও অবদান, অবন্তীকুমার সান্যাল ও অশোক ভট্টাচার্য সম্পাদিত, সারস্বত লাইব্রেরী।
১০.) বঙ্গে বৈষ্ণব ধর্ম, রমাকান্ত চক্রবর্তী, আনন্দ পাবলিশার্স।
১১.) নবদ্বীপ তত্ত্ব, কান্তিচন্দ্র রাঢ়ী, সম্পাদনা : শান্তিরঞ্জন দেব, নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদ।
১২.) যুগস্রোস্টা শ্রীচৈতন্য, যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী, ভূমিকা : ড. গৌতম সেনগুপ্ত, নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পর্ষদ।
১৩.) বাঙ্গালার কীর্তনের ইতিহাস, হিতেশরঞ্জন সান্যাল, P.D.F.
১৪.) চৈতন্যের শেষ প্রহর, তুহিন মুখোপাধ্যায়, পত্রলেখা।
১৫.) The murder mystery of Sri Chaitanya, Dr. Bibudharanjan, Translated by : Dr. Ajoy Kumar Panda, BK Classics.
১৬.) বাংলার চিত্রকলা মধ্যযুগ থেকে কালিঘাট, অঞ্জন সেন, সংবেদ প্রকাশনী, ঢাকা।
১৭.) ১৮/০৩/২০২২ তারিখে আনন্দবাজার পত্রিকার শতবর্ষ পূর্তিতে প্রকাশিত ক্রোড়পত্রে জহর সরকারের রচনা ‘ঐতিহ্য আলাদা, দায়িত্বও অনেক’।
১৮.) তমাল দাশগুপ্তের ফেসবুক পেজ এবং তাঁর সম্পাদিত সপ্তডিঙা অনলাইন পত্রিকা।

0 comments: