0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in





উন্নয়ন বা আর্থিক বিকাশ এবং মানবমূল্যের বিকাশ কি পরিপূরক নয়?

[পশ্চিম ভারতের উপকূল আরব সাগর ঘেঁষে আমাদের গুজরাত রাজ্যের জনতা এ মাসের প্রথম সপ্তাহে বিধানসভা নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের নতুন সরকার তৈরি করে নিচ্ছে। এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হবার আগে হয়ত নতুন সরকার শপথ নেবে।

নিঃসন্দেহে গুজরাত ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্প ইত্যাদির পাটিগণিতে ভারতের সামনের সারির একটি রাজ্য। মিডিয়ায় হরদম শুনি গুজরাত মডেলের গুণগান। কিন্তু আমাকে বিচলিত করেছে দু’মাস আগের খবরের কাগজে একটি ঘটনার রিপোর্ট এবং তার সম্পর্কিত ভিডিও। এ নিয়ে সেই সময় মামলা আদালতে গিয়েছে এবং অনেকের চোখে পড়েছে। এবার আসল কথায় আসি। ]

আমরা জানি যে রাষ্ট্রের কাজ নাগরিককে সুরক্ষা দেওয়া। তার জন্যে প্রশাসন এবং পুলিশ বিভাগকে দক্ষ এবং সজাগ থাকতে হয়। সেটা আদর্শ পরিস্থিতি।

কিন্তু বাস্তবে? রাষ্ট্র যদি রামের কথায় শ্যামকে বা শ্যামের কথায় রহিমকে মারতে থাকে তাহলে সেটা কি রুল অফ ল বা আইনের শাসন বলা যাবে? অথবা যখন একজনের কথিত অপরাধে তাকে আদালতে না পাঠিয়ে তার পারিবারিক ঘর বা বৌয়ের বাড়ি বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে দেয়?

সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়ানো অগুনতি ভিডিও’র মধ্যে একটি ইদানীং অনেকের নজর কেড়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, কোন এক জনপদের রাস্তায় চার-পাঁচজন লোককে, একের পর এক, খোলাখুলি বিজলী ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে বেধড়ক লাঠিপেটা করা হচ্ছে। যাদের পেটানো হচ্ছে তারা ক্রমাগত হাত জুড়ে অনুনয় বিনয় করছে, আর মেরো না! আর উপস্থিত জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ছে, হাততালি দিচ্ছে; যেন কোন উৎসব বা স্টেডিয়ামে ক্রীড়াপ্রতিযোগিতা চলছে।

জায়গাটা কোথায়? যারা মারছেন তাঁরা কে? যাঁদের পেটানো হচ্ছে তাঁরাই বা কারা?

কিন্তু একটা ব্যাপার সবার নজরে এলো যে যাঁরা পেটাচ্ছেন তাঁদের একজনের কোমরের বেল্ট সংলগ্ন হোলস্টারে রিভলবার। তবে কি এঁরা সাদা পোষাকের পুলিশ? সন্দেহ পোক্ত হল যখন দেখা গেল খানিকক্ষণ পেটানোর পর তাঁরা বন্দীদের টেনে নিয়ে একটি পুলিশ ভ্যানে তুলে দিলেন।

সংবাদমাধ্যমের সূত্রে যদ্দুর জানা গেছেঃ

জায়গাটা গুজরাত রাজ্যের খেড়া জেলার মাতার তালুকের উন্ধেলা গাঁয়ের একটি চৌমাথার চত্বর। তারিখ ৪ অক্টোবর। ওই চৌমাথায় রয়েছে একটি মন্দির, যার গায়ে লাগা একটি মাদ্রাসা এবং উল্টোদিকে মুখোমুখি একটি মসজিদ।

লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছিলেন যিনি তাঁর পরিচয় পুলিশ ইন্সস্পেক্টর এ ভি পরমার; আর যিনি মারখাওয়া লোকদের পকেট থেকে ওয়ালেট এবং মোবাইল বের করে নিচ্ছিলেন তিনি হলেন সাব-ইন্সপেক্টর ডি বি কুমাওত। দুজনেই খেড়া জেলার স্থানীয় ক্রাইম ব্র্যাঞ্চের সঙ্গে যুক্ত। রাজ্যের ডিজিপি জানিয়েছেন যে তদন্ত শুরু হয়েছে, দোষ প্রমাণিত হোলে নিশ্চয়ই শাস্তি পাবে।

আর যারা মার খেয়েছে তাঁদের পরিচয় এখনও প্রকাশ করা হয় নি। তবে পুলিশ সূত্রে বলা হয়েছে ওরা সবাই মুসলমান সম্প্রদায়ের।[1]

৬০০০ জনসংখ্যার এই গাঁয়ে হিন্দু-মুসলিম অনুপাত প্রায় সমান সমান। এঁরা স্পষ্ট করে চিহ্নিত করা আলাদা পাড়ায় বসবাস করেন।

ঘটনা সম্পর্কে গাঁয়ের নবনির্বাচিত সরপঞ্চ ইন্দ্রবদন সিং বলেন যে উনি এখানে এই চৌমাথায় সোমবার একটি গরবা অনুষ্ঠানের আয়োজন করিয়ে ছিলেন। শান্তিভঙ্গের আশংকায় আগে থেকেই পুলিশ মোতায়েন ছিল। বলা হয় যে কিছু দুষ্কৃতি গরবা চলার সময় সেখানে ঢিল ছোঁড়ে।

স্থানীয় নিবাসী রবীন্দ্র প্যাটেলের কথায় -- যখন জানা গেল যে কিছু উপদ্রবকারী ধরা পড়েছে, তখন ভিড় একত্রিত হয়। আমরা পুলিশকে বলি ওদের উচিত শিক্ষা দিতে। ওদের মধ্যে অন্ততঃ আটটা এমন লোক আছে যারা সবসময় অন্যদের ওসকায়, ভয় দেখায়।

তাই পুলিশ ওদের পেটালে সবাই খুশিতে হাততালি দেয়। এত বছরের অপমান সহ্য করে ভেতরে ভেতর ফুঁসছিলাম, কয়েক দশকের মধ্যে এই প্রথম ন্যায় পেলাম।

এবার দেখুন গুজরাতের গৃহমন্ত্রী ওই ঘটনাটির প্রেক্ষিতে কী বলছেন?

গুজরাত বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আলোচনা সভায় শ্রোতাদের প্রশ্নোত্তরের সময় উনি বলেন – মানবাধিকার কি শুধু যারা পাথর ছোঁড়ে তাদের জন্যে? যারা ওই পাথরের ঘায়ে আহত হল সেই শিশু ও মেয়েদের কি মানবাধিকার নেই? সময় এসেছে এ নিয়ে ভাববার। গুজরাত পুলিশ কঠিন পরিশ্রম করেছে যাতে আমাদের বোনেরা আমাদের তরুণেরা অনেক রাত পর্য্যন্ত গরবা নাচতে পারে, দোকানদারেরাও তাদের জীবিকা অনুযায়ী মাঝরাত্তির পর্য্যন্ত তাদের ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারে।

যদি ওরা যা করেছে সেটা দেখে আপনাদের ভালো লেগে থাকে তাহলে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাকে নয়, গুজরাত পুলিশকে ধন্যবাদ দিন। [2]

স্বয়ং গৃহমন্ত্রী যদি বেঁধে পেটানোর ঘটনায় পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করে আম জনতাকে ওদের সমর্থনে দাঁড়াতে বলেন তাহলে ওই পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে ওঁর অধীনস্থ পুলিশ বিভাগ নিরপেক্ষ তদন্ত করবে এবং দোষীদের শাস্তি দেবে—এটা কি আমরা বিশ্বাস করতে পারি?

হ্যাঁ, সংবাদসূত্রে জানা গেছে ওই ঘটনায় উন্ডহেলা গ্রামের ৪৩ জন মুসলিম বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে এফ আই আর রুজু করা হয়েছে। গ্রেফতারের আশংকায় অনেক ঘরেই তালা ঝুলছে।

আর পরে তদন্তে দেখা গেছে যে পুলিশ আগে যাদের গ্রেফতার করে থানায় পুরেছে, স্থানীয় জনতার দাবিতে তাদেরই কয়েকজনকে বার করে এনে মাঝরাত্তিরে চৌমাথায় বেঁধে পিটিয়েছে।

এছাড়া সবিনয়ে বলতে চাই যে মানবাধিকার নিয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের ব্যখ্যানটি সর্বৈব ভুল।

কেউ পাথর ছুঁড়ে আহত করলে সেটা অপরাধ, মানবাধিকার উল্লংঘন নয়। সেই অপরাধের জন্যে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডে শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। ব্যক্তি আইন ভেঙে অন্য নাগরিক বা ব্যবস্থার ক্ষতি করলে সেটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বা সমূহের বিরুদ্ধে অপরাধ; মানবাধিকার উল্লংঘন নয়।

কিন্তু রাষ্ট্র যদি আইন অনুমোদিত পদ্ধতি বা ‘ডিউ প্রসেস অফ ল’ পালন না করে কোন ব্যক্তির শরীর বা সম্পত্তির ক্ষতি করে –সেটা মানবাধিকার উল্লংঘন। অর্থাৎ মানবাধিকারের প্রশ্নটি কেবল রাষ্ট্র ও ব্যক্তি নাগরিকের সুরক্ষার প্রেক্ষিতেই অর্থবহ হয়, অন্যথা নয়।



এই ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনটে প্রশ্ন উঠে আসে—

এক, মানবাধিকার ব্যাপারটা কী?

দুই, সরকারের কোন বিভাগ, বিশেষ করে পুলিশ কি ডিউ ডিলিজেন্স বা আইনসম্মত পদ্ধতি অবলম্বন না করে যা খুশি তাই করতে পারে? সেটা জনতাকে ত্বরিত ন্যায় বা হাতে-গরম জাস্টিস দেওয়ার অজুহাত হলেও?

তিন, আমাদের সংবিধান কি পুলিশকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার দিয়েছে?

আমি তিনটে প্রশ্ন নিয়েই কথা বলতে চাই, কিন্তু শুরু করব রিভার্স অর্ডারে, মানে আগে তিন নম্বর।

সংবিধান কি পুলিশকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার দিয়েছে?

বিগত ২৭ নভেম্বর, ২০১৯ তারিখে হায়দ্রাবাদের কাছে পশু চিকিৎসক দিশাকে চারজন গণধর্ষণ করে হত্যা করে। মিডিয়ায় দেশজুড়ে কভারেজের পর জনমানস ক্রোধ এবং আবেগে উদ্বেল। সাইবেরাবাদ পুলিশ অপরাধীদের পরের দিনই গ্রেফতার করে এবং আটদিন পর ৬ ডিসেম্বর ভোরে হায়দ্রাবাদের উপকণ্ঠে কথিত এনকাউন্টারে চারজনকেই মেরে ফেলে, তাদের মধ্যে দু’জন নাবালিক।

নাগরিকেরা খুব খুশি, পুলিশেরা প্রকাশ্যে সম্মানিত হলেন; কিছু সাংসদ এবং অধিকাংশ রাজনৈতিক দলও ‘ত্বরিত ন্যায়’ প্রদানের জন্য পুলিশের প্রশংসা করলেন। হায়দ্রাবাদ সরকারের প্রবীণ মন্ত্রী টি এস শ্রীনিবাস যাদব বললেন যে সরকারের সমর্থন ছাড়া পুলিশ এমন দ্রুত অ্যাকশন করতে পারত না।

কিন্তু সুপ্রীম কোর্ট নিযুক্ত জাস্টিস শিরপুরকর কমিশন তদন্তের পর এই সিদ্ধান্তে এলেন যে ওই এনকাউন্টারের ঘটনাটি সাজানো। উনি তাঁর রিপোর্টে ওই সাজানো এনকাউন্টারের জন্য দোষী ১০ জন পুলিশের বিরুদ্ধে খুনের মামলা চালানোর সুপারিশ করেছেন।

মামলাটি এখন, কমিশনের রিপোর্ট সহ, হাইকোর্টে বিচারাধীন।

কথা হচ্ছে, শিরপুরকর কমিশন এমন রায় কেন দিল?

অভিযুক্তরা কি একটি অসহায় মেয়েকে বর্বর অত্যাচার ও হত্যার অপরাধে দোষী নয়? এইসব জঞ্জালকে পৃথিবীর বুক থেকে চটপট সরিয়ে দিয়ে পুলিশ কি ঠিক করে নি, যাতে আমরা নাগরিকেরা নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারি এবং আমাদের মেয়েরা নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের নিজের ইচ্ছেমত জীবনযাপন করতে পারে?

আমার পালটা প্রশ্নঃ

তাহলে আর বিচারব্যবস্থা , মানে এতগুলো আদালত, সেশন ও জেলা কোর্ট , আবার দুই স্তরের আপিল করার কোর্ট—হাইকোর্ট এবং সুপ্রীম কোর্ট—থাকার দরকার কি? শুধু পুলিশ থাকলেই হল। ওদের যাকে মনে হবে অপরাধী, সেই অপরাধী। ওরাই বিচার করবে এবং শাস্তি দেবে। কোন উকিলের কথা কাটাকাটি, তারিখ পে তারিখ, এসবের দরকার নেই।

সোজা কথায়, যাকে পুলিশ দেগে দিয়েছে অপরাধী বলে সেই অপরাধী; তার কথা শোনার দরকার নেই।

ভেবে দেখুন, তাহলে আমাদের দেশ কি ক্রমশঃ একটি আদিম সমাজের কৌম আইনের বা মাওবাদী এবং সন্ত্রাসবাদীদের ক্যাঙারু কোর্টের অধীন হয়ে যাবে না? কোন সভ্যদেশে এমন হতে পারে?

আসলে কমিশনের রায়ের ভিত্তিতে রয়েছে আমাদের সংবিধান এবং ক্রিমিনাল জুরিসপ্রুডেন্সের কিছু মৌলিক নীতি। পুলিশের কাজ শাস্তি দেয়া নয়। আর প্রত্যেক অভিযুক্তেরই বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তার পক্ষ না শুনে তাকে দোষী ঠাউরানো যায় না। অনেক ঘটনায় আমরা দেখেছি যে পুলিশ যাকে অপরাধীকে ধরে ফেলেছি বলে পেশ করেছে পরে দেখা গেছে যে সে নির্দোষ।

তাহলে পুলিশের কাজ কি? পুলিশের দায়িত্ব বলতে দুটো।

প্রথমতঃ পাহারা এবং নজরদারির মাধ্যমে অপরাধ ঘটিত হবার সম্ভাবনাকে আটকানো।

দ্বিতীয়তঃ অপরাধ ঘটিত হলে তদন্ত করে অভিযুক্তদের প্রমাণ সহ আদালতের সামনে পেশ করা। শাস্তি দেওয়া পুলিশের কাজ নয়।

বিচার বিভাগের কাজ সেই প্রমাণ গুলো খতিয়ে দেখা এবং অভিযুক্তদের বক্তব্য শোনা; তারপর তুল্যমূল্য বিচার করে সিদ্ধান্তে আসা যে অপরাধী দোষী কিনা এবং অপরাধের গুরুত্ব বুঝে তার শাস্তির পরিমাণ ঠিক করা।

আমাদের দেশের ক্রিমিনাল জুরিসপ্রুডেন্স অনুযায়ী আদালতে প্রমাণ না হওয়া পর্য্যন্ত কেউ দোষী বা অপরাধী নয়, অভিযুক্ত মাত্র। আর কাউকেই, এমনকি জঘন্যতম অপরাধের অভিযুক্তকেও, তার বক্তব্য না শুনে শাস্তি দেওয়া যায় না।

‘ত্বরিত ন্যায়’ আধুনিক রাষ্ট্রের এবং সংবিধানের গোড়ায় কুড়ুলের কোপ দিচ্ছে।

রাষ্ট্র, তিনটে অঙ্গ, ডিউ ডিলিজেন্স বা আইনসম্মত উপায়

যে কোন সভ্য দেশে এবং আধুনিক রাষ্ট্রে শারীরিক শাস্তি দেওয়ার অধিকার কেবল মাত্র রাষ্ট্রের। কোন নাগরিক অন্য নাগরিকের গায়ে হাত তুললে সেটা আইনতঃ অপরাধ। তাই আজকের অবধারণায় শিক্ষক ছাত্রকে বেধড়ক পেটালে জেলে যাবেন। এমনকি বাবা ছেলেকে ঠ্যাঙালে বা স্বামী স্ত্রীর গায়ে হাত তুললে সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেই গণ্য হবে।

এর ব্যতিক্রম শুধু আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে। তাই পুলিশও নকল এনকাউন্টারের সময় বলে যে অপরাধী পালাতে চেষ্টা করছিল এবং পুলিশের উপর পালটা হামলা করছিল। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছে।

আধুনিক রাষ্ট্রের পরিচয় সে দেশে আইনের শাসন রয়েছে কি নেই।

রুল অফ ল মানে রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি অঙ্গ – আইনসভা, প্রশাসন (পুলিশ সমেত) এবং বিচারব্যবস্থা সংবিধান নির্ধারিত পদ্ধতিতে নিজের নিজের দায়িত্বপালন করবে। কেউ অন্যের এক্তিয়ারে দখল দেবে না।

পুলিশ আইন প্রণয়ন করতে পারে না, সেটা আইনসভার মানে সংসদ ও বিধানসভার কাজ। পুলিশ শাস্তি দিতে পারে না, সেটা বিচারবিভাগের কাজ।

পুলিশের মাধ্যমে ত্বরিত ন্যায় বাস্তবে সেই বেড়া ভেঙে বিচার বিভাগের এলাকায় প্রবেশ করা মাত্র।

পুলিশ তার খেয়ালখুশি মত কাজ করতে পারে নাঃ

রুল অফ ল’এর আরেকটি অর্থ-- নাগরিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের প্রতিটি পদক্ষেপ আইন নির্ধারিত পদ্ধতিতে হতে হবে। পুলিশও তার ব্যতিক্রম নয়।

তদন্তের খাতিরে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হলে, কারও শরীর বা ঘর বা অফিস তল্লাসি করতে হলে তাদের ক্রিমিনাল প্রসিডিওর অ্যাক্ট নির্ধারিত পদ্ধতি মেনে চলতে হয়। তাই সার্চ ওয়ারেন্ট লাগে, গ্রেফতারের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ লাগে, তল্লাসি করে জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করতে হোলে সিজার লিস্ট বানাতে হয় এবং পঞ্চনামা করে নিরপেক্ষ সাক্ষীর দস্তখত নিতে হয়।

গুজরাতের ঘটনাটির ভিডিও এবং বাসিন্দাদের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে এখানে পুলিশ আইনসম্মত উপায়ে তার দায়িত্ব পালন করেনি। পাথর ছোঁড়ার জন্য অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে ভ্যানে তুলে নিয়ে যাওয়া এবং থানায় জেরা করা যথেষ্ট ছিল।

এখানে রাষ্ট্রের একতরফা আচরণের বিরুদ্ধে অভিযুক্ত মুসলিম যুবকদের সম্মান এবং মর্যাদা নিয়ে বাঁচার সংবিধান প্রদত্ত অধিকার অবশ্যই লঙ্ঘিত হয়েছে। পুলিশ মন্ত্রীর বয়ান আদৌ রাষ্ট্র এবং প্রশাসনের ছবি উজ্বল করে নি।

কিন্তু তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল জনতার পুলিশকে আইন হাতে নিতে উসকে দেওয়া এবং সেটাকে মহিমামণ্ডিত করা।

একটি উলটো ঘটনাঃ

কর্ণাটকের বিদার জেলায় একটি মহম্মদ গওয়ান নামের সুপ্রাচীন মাদ্রাসা রয়েছে। ১৪৬০ সালে নির্মিত দক্ষিণের বাহমণী সুলতানেতের সময়কালীন এই মাদ্রাসাটি ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে প্রসিদ্ধ। এটি হেরিটেজ বিল্ডিং এবং ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগ এর রক্ষণাবেক্ষণ করে।

গত ৬ই অক্টোবর, বৃহস্পতিবার বিজয়াদশমীর মিছিল গিয়ে ওই ঢুকে সেখানে নারকোল ফাটিয়ে পুজা অর্চনা করে। ভিডিও ভাইর‍্যাল হওয়ায় একটি অভিযোগের ভিত্তিতে ন’জনের বিরুদ্ধে এফ আই আর হয়েছে কিন্তু এখন অবধি কেউ গ্রেফতার হয়নি।[3]

পুলিশের অধিকার নিয়ে জনমানসে নিহিত কিছু ভুল ধারণাঃ

পুলিশ কি কথা বের করার জন্যে তদন্তের স্বার্থে কোন অভিযুক্তকে টর্চার করতে পারে?

না, সেটা অপরাধ। তাই পুলিশ কাস্টডিতে নেওয়ার সময় এবং কোর্টে পেশ করার সময় অভিযুক্তের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। আর থানায় জোর করে কোন স্বীকারোক্তি নিলে সেটা আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হবে না( এভিডেন্স অ্যাক্টের সেকশন ২৫ এবং ২৬)।

শুধুমাত্র যে বয়ান অভিযুক্ত একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে স্বেচ্ছায় ক্রিমিনাল প্রসিডিওর অ্যাক্টের ধারা ১৬৪ নির্ধারিত পদ্ধতিতে দিয়ে সাইন করেছে সেটাই আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রাহ্য হবে।

কারণ, এ না হলে পুলিশ ভয় দেখিয়ে বা যন্ত্রণা দিয়ে কাউকে এমন অপরাধ স্বীকার করিয়ে নেবে যা সে করেনি। এছাড়া কেউ চাইলে নিজের অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে স্বীকারোক্তি দিতে অথবা কোন দলিল দিতে এই বলে অস্বীকার করতে পারে যে ‘কাউকে নিজের বিরুদ্ধে প্রমাণ বা স্টেটমেন্ট দিতে বাধ্য ‘করা যায় না। এটি সংবিধান প্রদত্ত অধিকার --আর্টিকল ২০(৩)।

পুলিশ এবং প্রশাসনের দায়িত্ব আইনসম্মত উপায়ে অপরাধ প্রমাণ করা, জোর করে স্বীকারোক্তি লিখিয়ে নয়। তার বৈজ্ঞানিক উপায় আছে।

তাই কাউকে সন্দেহের বশে গ্রেফতার এমনকি জেরা করতে হলেও আইন সম্মত পদ্ধতি মেনে করতে হবে। যেমন মহিলাদের রাত্রিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় ডেকে পাঠানো যায় না। সন্দেহাস্পদ মহিলাকে তার বাড়িতে গিয়ে পরিবারের লোকজনের সামনেই জেরা করতে হবে।

পুলিশের মাধ্যমে ‘ত্বরিত ন্যায়’ বা instant justice এর ধারণাটির উৎস কী?

ভারত সরকারের প্রাক্তন স্পেশাল ডায়রেক্টর (ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো)এবং ভূতপূর্ব সেন্ট্রাল ইনফর্মেশন কমিশনার যশোবর্ধন আজাদ জানাচ্ছেন যে এই অবধারণাটি কলোনিয়াল।[4] এটির প্রয়োগ বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিবাদীদের দমন করতে শুরু করেছিল। প্রায় এক শতাব্দী আগে (১৯২৪ সালে) রাম্পা বিদ্রোহী নেতা আল্লুরি সীতারাম রাজু্র হত্যা তার মধ্যে একটি।

রাজু তখন মাদ্রাজ ফরেস্ট অ্যাক্ট ১৮৮২র বিরুদ্ধে ইস্টার্ন ঘাট পার্বত্য এলাকার আদিবাসীদের সংগঠিত করছিলেন। পুলিশ তাঁকে বন্দী করে আদালতে পেশ না করে গুলি করে হত্যা করে।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী গত ১৫ই অগাস্টে সমস্ত কলোনিয়াল ঐতিহ্য মুছে ফেলার ডাক দিয়েছেন। তবে তাঁর মূল রাজ্য গুজরাতের গৃহমন্ত্রী এ’ব্যাপারে ঠিক অবহিত ন’ন মনে হচ্ছে।

শুধু তাই নয়, স্বাধীন ভারতে পুলিশ এনকাউন্টারে কথিত অপরাধীর মৃত্যুর ঘটনা বড় কম নয়। যশোবর্ধন আজাদ জানাচ্ছেন যে ১৯৫০ থেকেই পুলিশের বিরুদ্ধে-- ডাকাত দমনে, পাঞ্জাব, জম্মু-কাশ্মীর, উত্তর পূর্বে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহী এবং বিভিন্ন রাজ্যে মাওবাদী দমনে-- সাজানো এনকাউণ্টারের অভিযোগ উঠেছিল।

কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রকের বয়ান অনুযায়ী ১ জানুয়ারী ২০১৭ থেকে ৩১ জানুয়ারি ২০২২ পর্য্যন্ত পুলিশ এনকাউন্টারে মৃত্যুর খতিয়ান নীচে দেওয়া হলঃ[5]

রাজ্য মৃত্যুর ঘটনা

ছত্তিশগড় ১৯১

উত্তর প্রদেশ ১১৭

অন্য ১৩টি রাজ্য ৩৪৭

মোট ৬৫৫



জনতার নিজের হাতে বিচার এবং শাস্তির কিছু ঘটনাঃ

· অভিজিৎ নাথ এবং নীলোৎপল দাস আসামে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পরা গুজবের ভিত্তিতে উন্মত্ত জনতা তাদের গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে এবং সেই দৃশ্য ভিডিও করে গর্বের সঙ্গে মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়।[6]

· ত্রিপুরা পুলিশ বলছে, গত ২৭ এবং ২৮ জুন, ২০১৮, একই ভাবে গুজব ছড়িয়ে ছেলেধরা সন্দেহে চারজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। এর মধ্যে একজন মহিলাও আছেন। আর আছেন সুকান্ত চক্রবর্তী যাঁকে সরকার গ্রামে পাঠিয়েছিল ছেলেধরার মিথ্যে গুজব ঠেকাতে।

· বিবিসি বাংলার রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৮ সালের মে এবং জুন মাসের ভেতর ছেলেধরা সন্দেহে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অন্ততঃ ১৪ জন মানুষকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। [7]

· ১৯৮২ সালে কলকাতার বিজন সেতুতে উন্মত্ত জনতা ছেলেধরা সন্দেহে ১৭ জন আনন্দমার্গীকে পুড়িয়ে মারে।

· এবার কর্ণাটকের গল্প। ঝারখণ্ড থেকে বেঙ্গালুরুতে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে আসা ৩৩ বছরের আদিবাসী যুবক সঞ্জয় টুডুকে, গত ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ , দরগা মহল্লার কাছে ছেলেধরা সন্দেহে বেধড়ক ঠ্যাঙানো হয়। ডেপুটি পুলিশ কমিশনারের বয়ান অনুযায়ী হয়সালা থানার পুলিশ ওকে জীবিতাবস্থায় থানায় নিয়ে গিয়ে বলে কমপ্লেইন কর, আর তোমাকে আমরা হাসপাতালে ভর্তি করে দিচ্ছি।

কিন্তু ও দুটো প্রস্তাবেই রাজি না হয়ে থানা থেকে বেরিয়ে যায়, বলে আমি আমার গৃহনগরে ফিরে যেতে চাই। ও তখন একটু মত্ত, কিন্তু সজ্ঞানে ছিল। পরের দিন ২৪ তারিখে ওকে আইটি আই কলোনির ফুটপাথে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এখন কয়েকজন পুলিশের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে।[8]

জনতা কেন আইন নিজের হাতে তুলে নেয়?

এটা অবশ্যই দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার প্রকাশ।

নিঃসন্দেহে ভারতে বিচারব্যবস্থা এবং পদ্ধতি ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। আমরা বলি বটে—জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনায়েড’। কিন্তু বিচারব্যবস্থার সংস্কার আমাদের প্রাথমিকতা নয়।

দেখুন, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১২ সালের গণধর্ষণের নির্ভয়া কাণ্ডে অপরাধীরা দ্রুত গ্রেফতার হয়েছে। অথচ, বিচার শেষ করে তাদের শাস্তি দিতে সময় লেগে গেল ৬ বছর।

পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অফ ইণ্ডিয়ার একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ধর্ষণের মামলায় ৭০% বৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র ১০% কেসে বিচার প্রক্রিয়া ২০১৮ নাগাদ শেষ হয়েছে। তার মধ্যে আবার ৭৩% ছাড়া পেয়ে গেছে।

দিশা কেসটিতে সুপ্রীম কোর্টের গঠিত কমিটি প্রশাসন এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের ঢিলেমির জন্যে তিরস্কার করেছে।[9]

সেজন্যেই আজও, মানে ৬ অগাস্ট ২০২২ নাগাদ, সুপ্রীম কোর্টে ৩৪টি পদের তিনটি রিক্ত, হাইকোর্টের অনুমোদিত ১১০৮ পদের মধ্যে রিক্ত পদ ৩৮০। আর জেলা এবং নিম্ন আদালতে ২৪, ৬৩১ পদের মধ্যে ৫৩৪২টি খালি পড়ে রয়েছে। ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশে সর্বস্তরে অনুমোদিত পদের সংখ্যাই যে অনেক কম সেকথা নাই তুললাম।

আমাদের কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রী কিরেন রিজ্জু বিগত ১৬ জুলাই তারিখে জয়পুরে এক সেমিনারে চিন্তা প্রকট করে বললেন যে দেশের বিচারালয়ে ৫ কোটি কেস ঝুলে রয়েছে। এর মধ্যে ৪ কোটি কেস নিম্ন আদালতের। এর মধ্যে ক্রিমিনাল কেসের সংখ্যা ৩ কোটি। সুপ্রীম কোর্টে লম্বিত রয়েছে প্রায় ৭১০০০ কেস।[10]

সেখানে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রমন্না বলেন যে এর কারণ সর্বস্তরে পদ খালি পড়ে থাকা এবং বিচারব্যবস্থার অপ্রতুল পরিকাঠামো।

ফলে সাধারণ মানুষ ন্যায় পেতে অনেক সময়ই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা বা প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের কাছে সাহায্য চাইতে যান। এর ফলে গড়ে ওঠে মাফিয়া এবং সন্দিগ্ধ নায়ককে কেন্দ্র করে কিছু মিথ এবং প্রভামণ্ডল। সোশ্যাল মিডিয়া ও সিনেমায় এরকম চরিত্রকে মহিমামণ্ডিত করা হয়।

এর থেকে এক ধাপ এগোলেই জনমানসে পুলিশের এনকাউন্টারকে ন্যায়োচিত বলে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। গড়ে ওঠে ‘এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট’ বলে নতুন নায়কের কিংবদন্তী। আমরা খেয়াল করিনা যে আসলে আমরা সিভিক সোসাইটির ধারণার বিরুদ্ধে এক সমান্তরাল মাফিয়া সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছি, তাকে গ্রহণযোগ্য করে তুলছি।

এর বিষময় ফল দেখা যায় দেশের আইন প্রণয়নের দায়িত্বে থাকা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রোফাইলে।

অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস (এ ডি আর) সাংসদ এবং বিধায়কদের এফিডেভিট অধ্যয়নের ভিত্তিতে বলছে যে ওঁদের নিজেদের ঘোষণা অনুযায়ী ৩৬৩ জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস চলছে। এর মধ্যে বিধায়ক ২৯৬ জন এবং সাংসদ ৬৭। এঁদের মধ্যে ৪ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং ৩৫ জন বিভিন্ন রাজ্যের মন্ত্রী।

এঁদের মামলা ৭ থেকে ১০-১১ বছর ধরে বিচারাধীন, তাই তাঁরা নির্বাচনে দাঁড়ানোর যোগ্যতা হারান নি।[11]

দু’দশকের লোকসভা নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে বিজয়ী প্রত্যাশীদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস থাকার হার বেড়েই চলেছে। ২০০৯ সালে ৫৪৩ জন বিজয়ী সাংসদের মধ্যে ১৬২ জনের (৩০%) ক্রিমিনাল কেস ছিল, যার মধ্যে ৭৬ জনের (১৪%) বিরুদ্ধে ছিল খুন, রেপ গোছের সিরিয়াস চার্জ। ২০১৯ সালের ফল বেরোলে দেখা গেল উপরোক্ত দুটো অনুপাত বেড়ে হয়েছে ৪৩% এবং ২৯%।

আরও চিন্তার বিষয়, যাঁর বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস চলছে তাঁর জেতার সম্ভাবনা ১৫.৫% , অথচ যাঁর প্রোফাইল নিষ্কলংক ভালোমানুষের তাঁর চান্স মাত্র ৪.৭%! [12]

ত্বরিত ন্যায়, বুলডোজার এবং মানবাধিকার

ত্বরিত ন্যায়ের মানসিকতা একদিক থেকে দেখলে ভীড়ের হিংস্র মানসিকতা। যার বশবর্তী হয়ে আমরা রাস্তায় পকেটমার! পকেটমার! চিৎকার শুনে ভিড়ের মধ্যে অজানা অচেনা লোকের গায়ে হাত তুলি, তাকে নিরাপদে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ভাবি না।

এই আদিম হিংস্রতার বশেই আমরা মর‍্যাল পুলিশ হয়ে অনৈতিক জীবনযাপনের কথিত দোষে বা কারও ঘরভাঙার সত্যি অথবা কাল্পনিক অপবাদে প্রকাশ্য রাস্তায় কোন মহিলার গায়ে হাত ওঠাই। ঘরে গয়না বা দামি জিনিস হারালে প্রথমেই কাজের দাদা বা মাসিকে নিজেরাই শারীরিক নিগ্রহ করতে শুরু করি।

এই মানসিকতা একদিকে আমাদের অবচেতনে গেড়ে বসা পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রকাশ। আমরা মনে করি রাষ্ট্র আমাদের পিতাসম। তার কাছ থেকে আমরা চাই সুরক্ষা এবং ন্যায়। কাজেই রাষ্ট্রকে আমরা প্রশ্ন করি না। ধরে নিই যা করছে আমাদের ভালর জন্যেই করছে।

পুলিশ আমাদের চোখে সেই পিতৃতন্ত্রের ক্ষমতার প্রতীক। আমরা চাই কড়া রাষ্ট্র, কড়া পুলিশ। যদি ছাত্রদের কষে বেত না লাগাবে তবে কিসের মাস্টার! যদি অপরাধীদের না পেটাবে তো কিসের পুলিশ! রাষ্ট্র এর সুযোগ নেয়। পুলিশ যাকে ধরে আমরা মেনে নিই যে সে অপরাধী। তাকে সামাজিক বয়কট করি।

কিন্তু খেয়াল করি না যে পুলিশ যাদের রাষ্ট্রবিরোধী এবং ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত বলে জেলে ভরছে তাদের মধ্যে কতজন পরে নির্দোষ প্রমাণিত হয়। কতজনের জীবনের এবং যৌবনের দামি বছরগুলো জেলে পচে শেষ হয়। ছাড়া পেয়ে বেরিয়ে আশে ভাঙাচোরা মানুষ, যাকে কেউ কাজ দিতে চায় না। মিথ্যে অভিযোগে জেল খেটে বিনা ক্ষতিপূরণে মাথা নীচু করে ঘরে ফেরে কতজন?[13]

মানবাধিকার কী, খায় না মাথায় দেয়?

মানবাধিকার কোন আকাশ থেকে খসে পড়া আলাদা আইন নয়। এ হল রাষ্ট্রের একতরফা বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে একা ব্যক্তিমানুষের সুরক্ষার গ্যারান্টি।

অর্থাৎ রাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দেওয়া যে কোন নাগরিকের বিরুদ্ধে সমষ্টির স্বার্থ রক্ষার অজুহাতে তুমি আমার মৌলিক অধিকার কেড়ে নিতে পার না। তুমি ভগবান নও। তোমাকে নিজের আচরনের জন্যে জবাবদিহি করতে হবে ন্যায়ালয়ের কাছে।

আমার সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার, রোজগার করার, যাতায়াত করার, নিজের ইচ্ছে মত ধর্মপালনের, পরিবার প্রতিপালনের যে গ্যারান্টি সংবিধান দিয়েছে আমি কোন অপরাধে অভিযুক্ত হলেও তা স্বতঃ খারিজ হয়ে যায় না।

আমি যেমন নাগরিক হিসেবে আইন মেনে চলতে বাধ্য, রাষ্ট্রও আইন নির্ধারিত পথে চলতে বাধ্য। তা না হলেই মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে। মানবাধিকার সবার রয়েছে; পুলিশেরও আছে। পু

লিশ হিসেবে নয়, ব্যক্তি হিসেবে, এবং রাষ্ট্রের এলোমেলো কাজের বিরুদ্ধে। যেমন সেই পুলিশ মানুষকে যদি লঘু অপরাধে সরকার গুরুদণ্ড দেয়, নিয়মবহির্ভূত ভাবে দূরে ট্রান্সফার করে, ইঙ্ক্রিমেন্ট বা প্রমোশন যোগ্যতা সত্ত্বেও আটকে দেয় ইত্যাদি।

কিন্তু কেউ পাথর ছুঁড়ে আহত করলে সেটা অপরাধ, মানবাধিকার উল্লংঘন নয়। সেই অপরাধের জন্যে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডে শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে।

বুলডোজার দিয়ে কারও পৈতৃক ঘর বা স্ত্রীর সম্পত্তি যে ঘর সেটা বিনা বিচারে ভেঙে দেওয়া একই ভাবে ত্বরিত ন্যায়ের একটি প্রকাশ। এখানে প্রশাসন বিচারবিভাগের এক্তিয়ারে ঢুকে পড়ছে। শাস্তি নির্ধারণের অধিকার তো পুলিশ কেন, প্রশাসনেরও নেই। আদালত সেটা ঠিক করলে প্রশাসন তার প্রয়োগ করবে মাত্র।

এ ব্যাপারে গুয়াহাটি হাইকোর্ট আসাম রাজ্যকে একটি ঘটনায় নোটিশ জারি করেছে।

এছাড়া একজনের দোষে তার পরিবার মায় বাচ্চাদের গৃহহারা করা অবশ্যই সেই মহিলা ও শিশুদের মানবাধিকার লঙ্ঘন। ওরা কোন দোষ না করেও রাষ্ট্রের হাতে শাস্তি পাচ্ছে।

রাষ্ট্রকেও বিধিসম্মত ভাবে কাজ করতে হবে।

মানবাধিকারের অবধারণা রাষ্ট্রকে স্বেচ্ছাচারী হতে বাধা দেয়।

===========================================================================






[1] ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৭ অক্টোবর, ২০২২।


[2] ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৮ অক্টোবর, ২০২২।


[3] ঐ, ৭ অক্টোবর, ২০২২।


[4] ঐ , ২ জুন, ২০২২।


[5] ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২ জুন, ২০২২


[6] এন ডি টি ভি বাংলা, ১০ জুন, ২০১৮।


[7] বিবিসি বাংলা, ১ জুলাই, ২০১৮।


[8] ঐ, ৮ অক্টোবর, ২০২২।


[9] যশোবর্ধন আজাদ, তাঁর ‘দ্য স্কার অফ ইন্সট্যান্ট জাস্টিস’ প্রবন্ধে।


[10] স্ক্রোল ডট ইন, ৬ অগাস্ট, ২০২২।


[11] ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ২৩ অগাস্ট, ২০২১।


[12] হিন্দুস্থান টাইমস্‌ ১১ অগাস্ট, ২০২১।


[13] দ্য ক্যুইন্ট, ‘বাইজ্জত বরী’, ২৫ জানুয়ারি, ২০২২।

0 comments: