13

প্রবন্ধ - কণিষ্ক ভট্টাচার্য

Posted in




প্রবন্ধ


তার চে বরং 
কণিষ্ক ভট্টাচার্য

।। এক ।।
বেন অ্যান্ড জেরির একটা আইসক্রিম ব্র্যান্ড আছে যার নাম ‘চেরি গেভারা’। তাদের আইসক্রিমের লেবেলে বলা হয়, “চেরির বৈপ্লবিক সংগ্রাম থেঁতলে গেছে কারণ তারা আটকা পড়েছে চকোলেটের দুটো স্তরের মাঝে। তাদের স্মৃতি আপনাদের মুখে বেঁচে থাকুক।” আইসক্রিম শেষ করার পরে আপনার হাতে আপনার হাতে থাকবে একটি কাঠি, যেমন থেকে থাকে আর কি। কিন্তু ঠিক তেমন নয়, বরং তাতে লেখা থাকবে, “আমরা শেষ অবধি কামড় দেব, ছাড়ব না।”
এক ফরাসি ব্যবসায়ীর একটি পারফিউম ছিল। চে পারফিউম বলে সেটা বিখ্যাত। নাম ‘চেভাগন’। পণ্যটির বক্তব্য, “পারফিউমটি তাঁদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত যারা বিপ্লবীর অনুভূতি ও গন্ধ পেতে চান।”
২০০৮ সালে রেনল্টের অনুসারী শিল্প, গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা ডাসিয়া একটা বিজ্ঞাপন তৈরি করে তাদের নতুন লোগান এম সি ভি স্টেশন ওয়াগনের জন্য, যার নাম ছিল ‘রেভলিউশন’। সেই বিজ্ঞাপনে ফিদেল কাস্ত্রোর ভূমিকায় এক অভিনেতা একটা দুর্গম গ্রামে গিয়ে পৌঁছন। সেখানে তাঁকে অভিবাদন জানান আধুনিক যুগের অন্য বিপ্লবীরা। বিজ্ঞাপন যেখানে শেষ হয় সেখানে আমরা দেখি, একটা প্যাশিও গাড়ির পিছনে দাঁড়িয়ে আর্নেস্তো চে গেভারা কার্ল মার্ক্সকে বলেন, “এটা একটা নতুন বিপ্লবের সময়।” মার্ক্স উত্তর দেন, “চে এটা তা-ই, যা মানুষ চায়।”
আমেরিকান ফুড চেইন ‘টাকো বেল’ একটা চিহুয়াহুয়া কুকুরকে চে-র সাজে সাজিয়ে তাঁকে দিয়ে বিজ্ঞাপনে বলায়, “আমি টাকো ভালবাসি।” কেন চে-কে এইভাবে ব্যবহার করা হল? এই প্রশ্ন করায় টাকো বেলের বিজ্ঞাপন অধিকর্তা চাক বেনেট জানান, “আমরা এক হিরোয়িক লিডারকে চাইছিলাম একটা টাকো বিপ্লবের জন্য।”
১৯৭০ সালে ইতালীয় কোম্পানি ‘অলিভেত্তি’ তাদের বিক্রি বাড়ানোর জন্য বিজ্ঞাপনে চে-র ছবি ব্যবহার করে লেখে, “যদি আমরা ওকে ভাড়া করতাম!”
পেরুতে গেলে আপনি কিনতে পারেন ‘এল চে সিগারেট’। আবার ‘এল চে কোলা’ তাদের নিট মুনাফার পঞ্চাশ শতাংশ দেয় এনজিও-কে। তাদের স্লোগান, “পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে গেলে তোমাদের অভ্যাস পরিবর্তন করো।” – এই অভ্যাস অবশ্য একটা নির্দিষ্ট কোলা খাওয়ার অভ্যাস।
‘স্মার্নফ ভদকা’ চে-র ছবি তাদের বিজ্ঞাপন আর বোতলে ব্যবহারের চেষ্টা করে ২০০০ সালে, কিন্তু আলবের্তো কোর্দা অনেক আইন আইন আদালত করে তা বন্ধ করতে সক্ষম হন।


।। দুই ।।
কে এই আলবার্তো কোর্দা? ১৯৬০ সালে সহযোদ্ধার মৃত্যুর খবর পেয়ে যখন তাঁকে শেষবার দেখতে আসেন আর্নেস্তো চে গেভারা, তখন চে-র একটা ছবি তোলেন আলবের্তো কোর্দা, তাঁর ‘লেসিয়া’ ক্যামেরায়। সেই ফ্রেমে অপর এক সহযোদ্ধার প্রোফাইল ছিল চে-র ডান দিকে। আর বাঁ দিকে ছিল পাম গাছের কিছু পাতা। সহযোদ্ধার মৃত্যুতে শোকার্ত, স্তম্ভিত অথচ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ চে-র ঘাড় ছিল কিছুটা ডান দিকে হেলানো। কানের পাশ দিয়ে নেমে আসা চুল, অবিন্যস্ত গোঁফদাড়ি আর মাথায় সেই কালো ব্যারেট। এই ছবিকে কিছুটা ক্রপ করা হয়। বাদ যায় অপর সহযোদ্ধার প্রোফাইল আর পাম গাছ। ছবিটা টিল্ট করা হয় কিছুটা যাতে বাঁকা ঘাড় সোজা হয়, সাবজেক্ট দাঁড়ায় হাফ বাস্ট। এই ছবিটাই পরবর্তীকালে, মানে ৯ অক্টোবর ১৯৬৭ সালে বলিভিয়ায় চে গেভারার নির্মম হত্যার পরে ‘Guerrilleor Heroico’ নামে এক স্টাইলাইজড ইমেজ হিসেবে বিশ্বজুড়ে এক প্রতীকে পরিণত হয়েছে। অথচ মাঝে মাঝেই দেখা যায় এই প্রতীকায়নের কারণগুলি বিপরীতধর্মী। এই প্রতিমা আসলে বিজয়প্রার্থীর এক বর্গীয়-প্রতিমায় রূপান্তরিত হয়েছে। আবার রূপান্তরিত হয়েছে আদর্শবাদের প্রতীকেও, এমন একজন মানুষ যিনি কোনও মহৎ উদ্দেশ্যে প্রাণ পর্যন্ত করতে পারেন এবং অনায়াসে। এই ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে এক চিহ্নক। ‘চে-স আফটার লাইফ : দ্যা লেগাসি অব অ্যান ইমেজ’-এ এই ছবির প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কে যেমন বলেন মিশেল ক্যাসি, “এটা এমন একটা ছবি যা যে-কোনও কারও যে-কোনও কিছু, বা সবার কাছে সবকিছুকেই চিহ্নিত করে।”


।। তিন ।।
তাই অর্বুদ অর্বুদ পোস্টার, ক্যাপ, চাবির রিং, মাউস প্যাড, ওয়েস্ট বিন, পতাকা, বেরেট, ন্যাপস্যাক, ব্যান্ডানা, টিশার্ট, রুমাল, বেল্ট, ওয়ালেট, ঘড়ি, জিপো লাইটার, পকেট ফ্লাস্ক থেকে চটিজুতো, ট্যাটু থেকে বিকিনি পর্যন্ত আক্ষরিক অর্থেই সবকিছুতেই চে-র প্রতিমা-প্রতীক ব্যবহৃত হয়। এমনকি নরওয়ের বার্জেনের রাস্তার গ্রাফিত্তিতে স্বয়ং চে-কেই আপনি দেখতে পাবেন চে-টিশার্ট পরিহিত অবস্থায়। বস্তুত চে-র বৈপ্লবিক প্রতিমা কেবল এক ফ্যাশন অ্যাকসেসরিজে পরিণত হয়েছে।
কী না পাবেন আপনি চে-কে নিয়ে, ভিডিওগেমস অবধি। আজকে নয়, ভিডিও গেমসের প্রায় আদিযুগে ১৯৮৭ সালেই জাপানে ‘গেভারা’ গেমসে আপনি স্বয়ং চে-কে পাবেন ‘ফ্যামিকন’ এডিশনে। ২০০১ সালে ‘ট্রপিকো’র ‘এল প্রেসিডেন্ট’ গেমে চে হলেন প্রেসিডেন্ট, আর বলিভিয়ায় চে-র নির্মম হত্যাকাণ্ডের সময় উপস্থিত CIA এজেন্ট ফেলিক্স রড্‌রিগেজকে নায়ক করে আপনি নিজে হাতে বারবার চে-কে হত্যা করতে পারেন, রড্‌রিগেজকে চালনা করে ‘প্লে স্টেশন- টু’তে ‘জাস্ট কজ’ নামের গেমে। আবার ‘গ্লোবাল ফান মোবাইল’ এনেছে ‘এল চে’ নামে ফোন। ‘এল চে’ ফোনের মডেলগুলি হল অ্যাসল্ট রাইফেল, গ্রেনেড, রকেট লঞ্চারের মিনিয়েচার।


।। চার ।।
চে-প্রতীক ব্যবহারের প্রধানত তিনটি ধরণ দেখা যায়। 
প্রথমত, চে মানুষটি কে, তিনি কী করেছিলেন, সমাজ বদলের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান কী – এগুলি জেনে তাঁর পক্ষে বাঁ বিপক্ষে একটি অবস্থান নেওয়া এবং তদনুসারে সেই প্রতীক ব্যবহার। 
দ্বিতীয়ত, চে এবং তাঁর জীবন ও কাজ সম্পর্কে অবগত হয়ে সচেতনভাবে তাকে তরলীকৃত করে কেবল এক স্টাইলাইজড ইমেজ হিসেবে ব্যবহার, যাতে সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান স্মরণীয় না হয়ে কেবল পরিপ্রেক্ষিতহীন এক জনপ্রিয় মুখ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। যেহেতু আবিশ্ব যুব সমাজের একটা বিরাট অংশের মধ্যে তাঁর যে সচেতন বা অসচেতন জনপ্রিয়তা তাকে নিজের ব্যবসার কাজে লাগানো যায়। স্মরণীয়, যারা ভারতসহ সাত কি আটটি দেশে প্রচলিত ক্রিকেট নামক খেলাটি দেখেন না তারাও শচীন রমেশ তেন্ডুলকরকে চেনেন, কর্পোরেটের বিজ্ঞাপনে তিনি ব্যবহৃত হন সেই মানুষদের কথা ভেবেও। তাঁর জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে কর্পোরেট। সেই চাপে তাঁকে ভারতরত্নও দিতে হয়।
তৃতীয়ত, সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে চে সম্পর্কে একটা ইতিবাচক অবস্থান গ্রহণ।
এই তিনটি অংশে স্পষ্টতই দুইটি পক্ষ। এই দুটি পক্ষ আদর্শগত ভাবে ভিন্ন অবস্থানে আছে সচেতন ভাবেই। একটি সমাজতান্ত্রিক পক্ষ অপরটি পুজিবাদী পক্ষ। মার্ক্সবাদী মতাদর্শ প্রচলিত প্রচলিত ব্যবস্থার মূলে আঘাত করা র‍্যাডিক্যাল দর্শন বলেই জন্ম থেকে নানা আক্রমণে আক্রান্ত। বিগত শতকের শেষ দশকে এই আক্রমণ তীব্রতর হওয়ার কারণ পূর্ব ইউরোপে এর প্রায়গিক ব্যর্থতার প্রকাশ। আবার যেখানেই সমাজতন্ত্র আত্মরক্ষার জন্য আপোষ করেছে পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির ব্যবস্থার সঙ্গে, সেই প্রতিটি আপোষ তাঁর আদর্শগত অবস্থানকে দুর্বল করেছে এবং জনমানসে আকর্ষণ হারিয়েছে। অথচ পূর্বতন সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় পুঁজিবাদ ব্যক্তিমুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েও ন্যূনতম মানবিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত করেছে মানুষকে।
যে আদর্শগত আক্রমণের মাধ্যমে মার্ক্সীয় মতাদর্শের পতন ঘটানোর চেষ্টা হয়েছে তা উত্তর আধুনিকতাবাদ, যা র‍্যাডিক্যাল ভঙ্গির আড়ালে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের স্বার্থসিদ্ধ করে। মার্ক্সবাদী মতাদর্শ মূলত ইউরোপীয় যুক্তিবাদ ভিত্তিক বস্তুবাদী মতাদর্শ, যা এনলাইটমেন্টের তাত্ত্বিক যে বিজ্ঞান-প্রগতির আন্তঃসম্পর্কনির্ভর প্রগতিতত্ত্ব তাঁর ধারাবাহিকতায় আগত। এই ধারাবাহিকতাটাই অস্বীকার করে উত্তর আধুনিকতা। যা লেখক বা বাচকের ‘টেক্সট’কে স্বীকার করে যা এই মতানুসারে একটি ‘নির্মাণ’ এবং টেক্সটের অবনির্মাণ বা বিনির্মাণের মাধ্যমে পাওয়া যায় এর অপর কোনও বিপরীত বাচন, যা একটি পাল্টা টেক্সট। কিন্তু এই নির্মাণ-বিনির্মাণের আবর্তে সত্য বা বাস্তবের কোনও স্থির অবস্থান নেই। সেখানে বাস্তব হল সম্ভাব্য সব ব্যাখ্যার এক অবিরাম স্রোত। কোনও একটি টেক্সট যদি কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ে শেষ কথা বলতে চায় তবে সেটা হবে আধিপত্যবাদী টেক্সট।
ফলে উত্তর আধুনিক চিন্তায় সত্য বা বাস্তবের কোনও চরম বাচন নেই। এমনকি সত্যকে কোনও নির্দিষ্ট টেক্সটের মাধ্যমে খোঁজার প্রয়োজনও নেই। বাচন-প্রতিবাচনের মধ্যে দিয়ে কোনও মাস্টার ডিসকোর্স পাওয়া যাবে না। এই ভাবে ধারাবাহিকতাটিকে অস্বীকার করে গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ বা মহাবাচনের বিরোধিতার মাধ্যমে এই মতাদর্শ শেষ বিচারে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের পক্ষে দাঁড়ায়। 
কী ভাবে? এই মতানুসারে সত্যের কোনও বাচন নিরপেক্ষ অস্তিত্ব নেই। ভূগোল সংক্রান্ত টেক্সট যদি হয়, ‘পৃথিবী গোলাকার’। তাঁর পাল্টা টেক্সট হবে, ‘পৃথিবী থালার মতো চ্যাপ্টা’ – কিন্তু বাস্তব সত্য কী তা কখনওই বলা যাবে না। -- কারণ এই সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক সত্যও উত্তর আধুনিকের কাছে একটি টেক্সট, যার একটি পাল্টা টেক্সট আছে এবং এর কোনও শেষ নেই। সত্যের বাচন নিরপেক্ষ অবস্থান না থাকায় তা আসলে ভাববাদ। যা এনলাইটমেন্ট-যুক্তিবাদ-বস্তুবাদ-প্রগতিতত্ত্বের ধারাবাহিক জ্ঞানচর্চাকে পিছনের দিকে অর্থাৎ ভাববাদে টেনে নিয়ে গিয়েও নিজেকে ‘উত্তর আধুনিক’ দাবি করে।


।। পাঁচ ।।
আমেরিকান টিভি সিরিজ ‘আমেরিকান ড্যাড’-এ ছেলে কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন হয়ে যাচ্ছে জেনে বাবা একদিন প্রবল উত্তেজিত হয়ে ছেলের অনুপস্থিতিতে ছেলের ঘরে ঢুকে কমিউনিজম সংক্রান্ত সমস্ত জিনিসপত্র নষ্ট করে ফেলে। শেষ পর্যন্ত ঘরের দেয়ালে চে-র পোস্টার দেখে হঠাৎ থেমে যায়। ছেঁড়ে না, বলে – “ This we can agree on, ‘Planet of the Ape’ was a fine picture” – মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। 
চল্লিশ বছর ধরে চে-কে নিয়ে অজস্র সিনেমা, তথ্যচিত্র, নাটক, গান, টেলি-শো, বই, পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। পৃথিবী জুড়ে বহু দেশ ও ভাষার পাশাপাশি এ দেশেও ২০০৯ সালে তৈরি হয়েছে বলিউড থ্রিলার ‘সিদ্ধার্থ দ্যা প্রিজনার’। পরিচালক প্রয়াস গুপ্তা, মুখ্য ভূমিকায় রজত কাপুর। ট্রিশা জিফ দুটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে। প্রথমটি ‘Personal Che’ দ্বিতীয়টি ‘Chevolution’। সুপার মডেল জিসেলে ব্যান্ডবেন চে-র ছবিসহ বিকিনি পরে হাঁটেন সাও পাওলো ফ্যাসান উইকে জুলাই ২০০২ সালে। কয়েক বছর আগে কলকাতার সদ্যজাত শপিং মলে চে-র ছবিসহ বাথরুম স্লিপার বিক্রি হয়েছে। রোলিং স্টোন ম্যাগাজিনের কভার পেজে জনি ডেপকে দেখা গেছে গলায় চে পেন্ডেন্ট পরে। দিয়াগো মারাদোনা, মাইক টাইসন, ব্রিটিশ ফুটবলার জ্যাবেন ক্যুরি, আর্জেন্টাইন ফুটবলার সেবাস্তিয়ান ভেরনো, ইতালীয় ফুটবলার ফ্যাব্রিজিও মিকোলি, সুইডিশ বক্সার জোয়ানেমা টার্কসন, সাউথ আফ্রিকান ফুটবলার মার্ক ফিস – প্রত্যেকের শরীরে ট্যাটুতে অঙ্কিত আছেন চে। মুন্তাদার আল জাইদির সাংবাদিক জিন জর্জ ডাব্লিউ বুশকে জুতো ছুঁড়েছিলেন, সাংবাদিকরা তাঁর ঘরের দেয়ালেও দেখা পেয়েছিলেন ‘গেরেলিয়েরো হিরোয়িকো’র। আবার পারভেজ মুশারফ, পাকিস্তানের সেনা শাসকের জার্মান শেফার্ড কুকুরের নাম চে।


।। ছয় ।।
২০০৯ সালের এপ্রিলে পোল্যান্ডের মন্ত্রী এলজিবিটা রজাডজিসসেওয়াস্কা ফ্যাসিস্ট ও টোটালেটেরিয়ান প্রচার আটকাতে সে দেশের পুলিশ আইনে সংশোধন আনেন। নতুন আইন অনুসারে সে দেশে চে গেভারার ছবি সম্বলিত টিশার্ট বা সোভিয়েত জ্যাকেট আর পরা যাবে না। পড়লে দু বছরের জেল।
আজারবাইজানের রুউফ মামাদোভ দাবার এক গ্র্যান্ড মাস্টার, যিনি চে টিশার্ট পরেই আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন। তাঁর মতে, “আমি চাই না আমার পিতার মুখচ্ছবি যে কেউ না ভেবেচিন্তে ব্যবহার করুক। তাঁকে আমি অযুত সংখ্যক জিন্সের পিছনের পকেটে স্টিকার হিসেবে দেখতে চাই না। যারা চে টিশার্ট পরে তারা যেন স্থিতাবস্থার পক্ষে না দাঁড়ায়, যেন সমাজের থেকে আরও বেশি দাবি করতে পারে, তারা যেন ভালো মানুষ হয়।”
আবার অস্ট্রেলিয়ান পাঙ্ক ব্যান্ডের ‘দ্যা ক্ল্যাপ’ অ্যালবামের “The Che Guevara T shirt wearer” গানের কোরাস লাইন হল, “You are a Che Guevara T shirt wearer, and you have no idea who he is.”
ব্রিটিশ রাজনীতিক জর্জ গলওয়ের বক্তব্য, “যদি মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ যারা চে-র টিশার্ট পরেন তারা জানেন তিনি কে, কীসের পক্ষে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন, সেটাও কিন্তু বহু কোটি। একই সঙ্গে তার পুরোটাই যৌবন – যারা পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে চায়। কিন্তু ১০ শতাংশের বহু বেশি তার পরিচয় জানেন। জানবেন, যদি কোথাও চে-র ছবি থাকে তার কারণ তাঁর লড়াই – প্রাণত্যাগ – যা পৃথিবীর ফ্যাসানেবলতম।”


।। সাত ।।
রেগিস ডেবরে বলিভিয়ার জেলে চে-র সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। তিনি পরবর্তী কালে লেখেন, “চে হলেন আধুনিক খ্রিস্ট, কিন্তু আমার মনে হয় তিনি আরও তীব্রভাবে অত্যাচারিত হয়েছেন। ২০০০ বছর আগের তার ঈশ্বরের মুখোমুখি হয়ে প্রাণত্যাগ। কিন্তু চে জানতেন যে তার কোনও ঈশ্বর নেই এবং তাঁর মৃত্যুর পরে আর কিছুই থাকবে না।”
সুজানা ওসিয়ানা একজন নার্স ছিলেন, যিনি চে-কে হত্যার পরে তাঁর মৃতদেহ পরিষ্কার করেছিলেন। সুজানা বলেছিলেন, “উনি ঠিক জিশু খ্রিস্টের মতো, তাঁর তীব্র চোখ, দাড়িগোঁফ, লম্বা চুল...” কিন্তু তিনি চে-র সেই হাতের পাতার কথা উল্লেখ করেননি, যা কেটে নেওয়া হয়েছিল চে-র মৃতদেহ থেকে।
জর্জ সি কাস্তেন্দা বলেন, “... যেন মৃত গেভারা তাকিয়ে আছেন তাঁর হত্যাকারীদের দিকে এবং তাঁদের ক্ষমা করে দিচ্ছেন আদর্শের জন্য প্রাণ দেওয়া মানুষের যন্ত্রণার থেকে। জার্মান নাট্যকার পিটার ওয়েইসের মনে হয়, “Christ taken down from the cross”। চে-কে নিয়ে ‘লাস্ট সাপার’ আঁকা হয়েছে। বলিভিয়ায় চে ও তাঁর বিপ্লবী সহযোগীদের যাত্রাপথকে কেন্দ্র করে ‘হোলি গ্রেইল অব চে গেভারা’ নামে ট্যুরিজম আছে। এমনকি আছে ‘সেন্ট আরনেস্তো চার্চ’। তাই হানা চার্লটন লেখেন, “সম্ভবত মোনালিসার ছবির থেকে বেশি, জিশুখ্রিস্টের ছবির থেকেও, বিটলস বা মনরোর থেকে ঢের বেশি চে-র ছবি প্রজন্মের পর প্রজন্মের কল্পনাকে ধারণ করে আছে।”


।। আট ।।
কিন্তু কেন এমন হল, কেন এমন হয় – এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের যেতে হবে ফ্র্যাঙ্কফুট স্কুলে থিওডোর অ্যাডোরনো (১৯০৩-১৯৬৯) এবং ম্যাক্স হরখেইমারের (১৮৯৫-১৯৭৩) কাছে, ১৯৪৪ সালে ‘কালচার ইন্ডাস্ট্রি’ শব্দবন্ধ যারা প্রথম ব্যবহার করেন ‘Dialectic of Enlightenment’ বইতে। এই বইয়ের ‘The Culture Industry: Enlightenment as Mass Deception’ অধ্যায়ে বলা হয়, “Pop culture is a factory product of film, radio, magazine – that are used to manipulate mass society into passivity, consumption of easy pleasure of pop culture made available by the mass com media make people control to cultivation of false psychological need that can only be made and satisfied by the product of capitalism. No matter how difficult their economic circumstances.” তাঁরা দেখান, চে-র মৃত্যুর বহু আগে, ‘গেরিলিয়েরো হিরোয়িকো’র অনেক আগেই যে, মাস প্রোডিউসড কালচার প্রযুক্তিগত ভাবে ও বৌদ্ধিক ভাবে কত বেশি ক্ষতিকর তথাকথিত হাই আর্টের থেকে। ফলে চে-র মুখ রশোমন এফেক্টের মতো কাজ করে গেছে যারা তা দেখেছেন তাঁদের প্রত্যেকের মনে আলাদা রকম ভাবে। আর আত্র উপভোক্তা ও দর্শকেরা প্রকৃত বিপ্লবাত্মক বোধকে তরল করে নিয়েছেন চে-র মুখের ছবি দিয়ে। কারণ পপ আর্টের নৈর্ব্যক্তিকীকরণ, সাধারণীকরণ, তরলীকরণ চে-র মুখকে সকলের জন্য নালিয়ে এনেছে, পপ আর্টের তত্ত্ব চে-কে প্রশ্ন-পরিপ্রশ্নহীন, প্রতিফলনহীন, নির্বিষ, নিরীহ বস্তুতে পরিণত করেছে তাঁর পুনঃ-পুনঃ-পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে। এক ঐকান্তিক বিপ্লবী পুঁজিবাদের পণ্যতে পরিণত হয়েছেন, কারণ capitalism devours everything – even its worst enemies.
--- --- --- 
(‘কালি কলম ইজেল’ পত্রিকায় জানুয়ারি ২০১৪ সালে প্রকাশিত সমনামী প্রবন্ধের পরিমার্জিত রূপ এই প্রবন্ধ।) 

13 comments:

  1. এমন একটি লেখায় কোনো মন্তব্য নেই কেন ? প্রতীকপ্রেমীরা কী ভাবছেন জানলে ভালো হত । সত্তার অসহনীয় লঘুতা ফাঁস হয়ে যাক কেই বা চায় !

    ReplyDelete
  2. এমন একটি লেখায় কোনো মন্তব্য নেই কেন ? প্রতীকপ্রেমীরা কী ভাবছেন জানলে ভালো হত । সত্তার অসহনীয় লঘুতা ফাঁস হয়ে যাক কেই বা চায় !

    ReplyDelete
  3. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  4. কিছু প্রশ্ন থেকেই গেল, চে'র আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত fashionable, Fashion মানে তো popular, আত্মত্যাগ যদি জনপ্রিয়ই হল,তবে শুধু stylized icon হয়েই থেকে গেলেন কেন চে?কোটি কোটি কানে তাঁর battle cry পৌঁছালেও, তাঁর রাইফেলটা কেউ তুলে নিতে এল না.. পুনঃউৎপাদন কি একটা জলন্ত আগুনকে এতটাই নির্বিষ করে দিয়েছে যে তাকে অনায়াসে টি-শার্টে ধারণ করা যায়? চে public sentiment এ স্থান করে নিলেন কিসের জোরে, যদি তাঁর বক্তব্য এই পাব্লিকের অবস্থানের বিপরীতই হয়?.. চে পরে ঘুরে বেড়ানো লোকজনের ১০ শতাংশেরও অনেক বেশি যদি জানে,চে কে, তবে সব কিছু এত স্থিতিশীল রয়েছে কি করে?
    ঘটনাচক্রে, আরো একটা প্রশ্ন এসে যায়, প্রতীক'প্রেমী',বলা ভাল প্রতীক'ব্যবহারকারী'রা কি ভাবছেন, তা যদি কিছু মুষ্টিমেয় লোকই ভেবে যান, তবে তারা কি ভাববে?

    ReplyDelete
  5. খুব ভালো লেখা হয়েছে।

    ReplyDelete
  6. একটি অসামান্য তাত্ত্বিক লেখা।

    ReplyDelete
  7. ভীষণ ভাল লাগল পড়ে।

    ReplyDelete
  8. আপাত তাত্বিক লেখাটির শেষে পৌঁছে দেখলাম কিছু আত্মস্থ করতে পারলাম না। শুধু কিছু তথ্য থেকে গেল রেশ হিসেবে। আমার অক্ষমতাই হবে।

    ReplyDelete
  9. ভীষণ ভালো লাগলো প্রবন্ধটি। সাথে রেখে দেওয়ার মতো, রেখে দিলামও

    ReplyDelete
  10. খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  11. "Capitalism devours everything" -- শেষমেশ চে'র ব্যাপারে তবে কি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন?

    ReplyDelete
  12. দারুণ লেখা 💝💝💝

    ReplyDelete