প্রাচীন কথা - মিথিল ভট্টাচার্য্য
Posted in প্রাচীন কথা
প্রাচীন কথা
পরাহত ভাগ্যনায়ক
মিথিল ভট্টাচার্য্য
(পঞ্চম পর্ব)
মহাসামন্ত অক্রুরকে সারথি করে কালের রথের চাকা এগিয়ে নিয়ে যায় কৃষ্ণ এবং বলরামকে মথুরার বুকে অপেক্ষা করা তাদের অপ্রত্যাশিত ভবিষ্যতের দিকে। বৃন্দাবনের প্রাণের পুতুল এবার পা রাখতে চলে তার ভবিষ্যৎ জীবনের কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে। একটু একটু করে মহাসামন্ত অক্রুর এর রথ বৃন্দাবনের বুক থেকে এগিয়ে চলে মথুরার পথে, আর অনিবার্য কর্তব্যের বন্ধন স্বীকার করে নিয়ে নিজের অবশ্যম্ভাবী ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে সেই ষোল বছরের কিশোর। অন্তরের উপর তাকে স্থান দিতে হয় মস্তিষ্ককে, নিজের ভাবাবেগকে দূরে সরিয়ে অগ্রাধিকার দিতে হয় কূটনৈতিক চিন্তাকে।
একটু একটু নীল দিগন্ত স্পর্শী চাঁদোয়া অন্তর্হিত হয়ে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক চিত্রটি তার চোখের সামনে ফুটে উঠতে থাকে। মথুরার রাজা কংস তার মাতুল, সেই এতদিন তাকে হত্যা করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে, কারণ কংসের অবর্তমানে মথুরার উত্তরাধিকারী সে। কংস যাদব গোষ্ঠীর চিরশত্রু জরাসন্ধের সাথে বৈবাহিক এবং মৈত্রী উভয় সূত্রে আবদ্ধ। তাই যাদব গোষ্ঠী তার মাতুলকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে তাকে সিংহাসনে বসাতে চায়। আর সেই কারণে তার মাতুল তার মাতা পিতা এবং মাতামহকে কৌশলে নিজের দুর্গে বন্দী করে রেখেছেন এবং আজ অব্দি তার মাতার গর্ভের সমস্ত সন্তানদের একের পর এক হত্যা করে চলেছেন। এই অংশ অব্দি দৃশ্যটি নিঃসন্দেহে নিষ্ঠুর এবং যন্ত্রণাদায়ক, কিন্তু যুক্তিযুক্ত। তার মাতুল নিজেকে রক্ষা করার জন্য তাকে নিজের পথ থেকে সরিয়ে দিতে চায়। রাজনীতির এই অংক চূড়ান্ত নিষ্ঠুর হলেও বুঝতে কোনোও অসুবিধা হয়না। কিন্তু অস্পষ্ট এর পরের অংশটি, তার মাতুল হঠাৎ করে তাকে কেন ফিরিয়ে আনতে চাইছেন মথুরায়? হঠাৎ করে এমন কি হলো যাতে নিজের চির প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে সেস্বেচ্ছায় নির্বাসনে যেতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন? যিনি নিজের ছয় ভাগ্নেকে এবং এক নিরপরাধ বালিকাকে বিনা দ্বিধায় নিজে হাতে হত্যা করতে পারেন তিনি অকস্মাৎ এই ভাবে বিবেকবান এবং সংবেদনশীল কিভাবে হয়ে যেতে পারেন? আর যদি সত্যি তা ঘটে থাকে তবে তিনি এখনো অব্দি নিজের ভগ্নী, ভগ্নিপতি এবং পিতাকে কেন মুক্তি দেননি, যার মনে সত্যি বিবেকের দংশন সে তো কোনও অতিনাটকীয় পরিস্থিতির অপেক্ষা করবেনা। তবে? তবে কেন এই নিমন্ত্রণ? একি সত্যি ভালোবাসার নিমন্ত্রণ, নাকি নিমন্ত্রণের আড়ালে লুকিয়ে আছে কোনও মরণ ফাঁদ?
নিজের গভীর দৃষ্টি তুলে অক্রুরের দিকে তাকালো কৃষ্ণ। অক্রুরের দৃষ্টিতে, তার মুখে লেগে থাকা অনুভূতির ছাপে খুঁজে নিতে চাইলো তার অন্তরের প্রকৃত বাসনা! না এই মানুষটি সত্যি নিরপরাধ, এর দুই চোখে এবং ঠোঁটের কিনারায় লুকিয়ে আছে তা এক নির্মল প্রাপ্তির প্রকাশ। এই মানুষটি সত্যি বিশ্বাস করেছে তার মাতুলের প্রতিটি কথা। এ এক স্বপ্নলোকের অধিবাসী, যে নিজের স্বপ্নকে সত্যি হতে দেখে নিজের চোখ আবৃত করে রেখেছে বাস্তবের নোংরা রূপের থেকে। এই মানুষটিকে এখন কিছু বললেও এ বিশ্বাস করতে পারবেনা, নিজের স্বপ্নকে কিছুতেই ভেঙে যেতে দেবেন না এই সরল মহাসামন্ত ।
একমুহূর্তের জন্য সব ভুলে কৃষ্ণ নিজেও চাইলো অন্তত একবার বিশ্বাস করতে মথুরাধিপতির দেখানো মিথ্যের জালকে, কিন্তু না! তার সুতীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক তাকে সে অনুমতি দিলনা। যে চিত্র তার শান্ত ধীর মস্তিষ্ক তার সামনে তুলে ধরছে তা কোনও পারিবারিক মেলবন্ধনের চিত্র নয়, বরং এক ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে চিন্তে হত্যার পরিকল্পনার চিত্র, যে কারণে তারা বৃন্দাবনে চলে আসবার পর মহারাজ কংস নিজে প্রয়াস না করে কালিয় সর্দারকে ব্যবহার করেছিলেন, ঠিক সেই কারণেই তিনি এবার তার শিকারকে পারিবারিক সম্প্রীতি এবং সিংহাসনের লোভ দেখিয়ে নিজের বোনা মৃত্যুর জালের দিকে টেনে আনতে চাইছেন। আর সেই কাজে নিজের অজান্তেই নিজেকে ব্যবহৃত হতে দিয়েছেন এই স্বপ্ন দেখে চলা সরল মানুষটি। নিজের দৃষ্টি অক্রুরের থেকে সরিয়ে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলরামের দিকে ফেরালো কৃষ্ণ।
অক্রুর এর দৃষ্টিকে এড়িয়ে কৃষ্ণ মৃদু স্বরে বলে উঠলেন "মথুরায় ভিন্ন জাতের অভ্যর্থনা অপেক্ষা করবে আমাদের জন্য ভ্রাতা, মহাসামন্ত নির্দোষ কিন্তু অতিরিক্ত মাত্রায় সরল। নিজের অজান্তেই তিনি আমাদের নিয়ে চলেছেন চক্রান্তের জালের দিকে, প্রস্তুত থেকো "
একটিও শব্দ উচ্চারণ করলেন না তার অগ্রজ। কিন্তু তার মুখের পেশীগুলিতে নিঃশব্দে ফুটে উঠল সকল ভাবাবেগ বর্জিত লৌহ কঠিন সুদৃঢ় ব্যক্তিত্বের আভাস।
অবশেষে সারা রাতময় এক সুদীর্ঘ যাত্রার পর কৃষ্ণ এবং বলরামকে নিয়ে প্রভাত মুহূর্তে মথুরার নিকট সীমান্তে প্রবেশ করে মহাসামন্ত অক্রুর এর রথ। বৃন্দাবন থেকে মথুরার সুদীর্ঘ পথে আর্যাবর্তের ভবিষ্যৎ ভাগ্যনায়কের রথের দুই চাকা এক সুগভীর চিহ্ন ফেলে রেখে মথুরার রাজকুমারকে নিয়ে ক্রমশ এগিয়ে আস্তে থাকে মথুরা নগরীর সীমান্তে, বহু বহু দূরে একটু একটু করে যেন ফুটে উঠতে থাকে কৃষ্ণের কল্পলোকের রহস্যময় নগরী, একসময় মহাসামন্ত অক্রুর কৃষ্ণের দিকে চেয়ে হাসি মুখে বলে ওঠেন "রাজকুমার ঐ দেখুন মথুরার রাজ প্রাসাদ, আপনার জন্মভূমি"
কৃষ্ণ দেখতে পেলেন সূর্যোদয়ের মুহূর্তে ঊষার আলো এসে পড়েছে মথুরার শ্বেত পাথরের নির্মিত শুভ্র রাজপ্রাসাদের উপর, যেন এক সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে নিজের ভবিষ্যৎ নায়ককে পেয়ে এক নির্মল হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তার জন্মভূমি। কৃষ্ণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তার জীবনের সমস্ত রহস্যকে নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখা এই সুবিস্তৃত প্রাসাদের দিকে। এই প্রাসাদেই এক কারাগারে বন্দী হয়ে রয়েছেন তার জন্মদাতা এবং জন্মদাত্রী, তার বৃদ্ধ মাতামহ। এই রাজপ্রাসাদেই মথুরার সিংহাসনে আসীন হয়ে রয়েছেন তার জীবনের সবথেকে বড় শত্রু, এই রাজপ্রাসাদ থেকেই রচিত হয়েছে তাকে হত্যা করার অসংখ্য পরিকল্পনা এবং সর্বশেষে এই রাজপ্রাসাদের বাধ্য করা হয়েছিল মর্যাদাবান গুরু কালিয় সর্দারকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে হত্যা করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে অংশ নিতে। এতদিন অব্দি তার সমস্ত প্রশ্ন এক অধরা কল্পনার মতো লুকিয়ে ছিল এই রাজপ্রাসাদের গর্ভে, কিন্তু এত কাল পর অবশেষে সে পা রাখতে চলেছে তার জীবনের সব থেকে গভীর রহস্যের গর্ভে।
ভোরের আলোর সাথে তাল মিলিয়ে রথের চাকা মথুরার সীমান্ত অতিক্রম করে ক্রমশ প্রবেশ করতে থাকে মথুরা নগরীর অন্তরে। আর একটু একটু করে কৃষ্ণের জীবনের সবথেকে বড় প্রহেলিকা আরো দৃশ্যমান হয়েউঠতে থাকে তার চোখের সামনে। শ্বেত পাথরে নির্মিত ঐ রাজপ্রাসাদ যেন এক অদ্ভুত ব্যাকুল স্বরে আহ্বান করছে তার উত্তরসূরীকে। আর মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে তাকিয়েছিলো তার জীবন পথের এই নতুন রঙ্গমঞ্চের দিকে। …
আচমকা একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদে নিজের কল্পনার জাল কেটে বাস্তবে ফিরে আসে সে, তার চার পাশের লোকজন চিৎকার করে ছুটে পালাচ্ছে। কিছুসময়ের জন্য স্তম্ভিত হয়ে যায় সে, আর শুধু সেই নয় তার ভ্রাতা বলরাম এবং তাদের সাথী মহাসামন্তও একই ভাবে হতচকিত হয়ে পরে। আচমকা কি এমন ঘটলো মথুরা নগরীর বুকে ?
আচমকা কৃষ্ণের চোখ পরে দূর থেকে তাদের দিকে ছুটে আসা কালো রঙের এক বিশাল পর্বতের দিকে, সাক্ষাৎ মৃত্যুর রূপ নিয়ে কালো রঙের এক ভয়ঙ্কর পর্বত যেন অস্থির ভাবে ছুটে আসছে তাদের পিষে মেরে ফেলবার জন্য, মহাসামন্ত অক্রুর প্রচণ্ড আতঙ্ক ভরা স্বরে বলে ওঠেন "সারথি রথ সরাও, আর এক মুহূর্তের দেরি হলে আমরা সবাই পিষে যাবো ওর তলায়, এই মুহূর্তে রথ সরাও"
সারথি কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে ওঠেন "রথের চাকা মাটিতে বসে গেছে মহা সামন্ত, রথ থেকে নেমে চাকা তুলতে হবে"
অক্রুর আতঙ্কে নীল হয়ে যান, তিনি কৃষ্ণ এবং বলরামকে বলেন "সর্বনাশ, আপনারা রথ থেকে এইমুহূর্তে নেমে যান রাজকুমার না হলে আর রক্ষা নেই, এই কাল আমাদের সবাইকে পিষে মারবে ।"
অক্রুর বলতে না বলতে সাক্ষাৎ শমনের মতো প্রচণ্ড গর্জন করে ঐ কালো পর্বত এক ভয়ঙ্কর গতিতে ছুটে এসে দাঁড়ায় কৃষ্ণ এবং বলরামের রথের সামনে । এক অজানা আক্রোশে সে ফুঁসছে, যেন এই মুহূর্তেই সে পিষে মারবে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই চারজন তুচ্ছ মানব সন্তানকে। নিজের কালো গভীর চোখ দুটি তুলে এই সাক্ষাৎ মৃত্যুর দিকে এক অদ্ভুত রহস্যে ভরা সুগভীর দৃষ্টিতে তাকালেন মথুরার ভবিষ্যৎ ভাগ্যনায়ক।
একটা অদ্ভুত মিষ্টি তীক্ষ্ণ শিসের শব্দ যেন এই আতঙ্কের পরিবেশ কে বিদীর্ণ করে স্তম্ভিত করে দেয় প্রত্যেক ব্যক্তিকে। অক্রুর স্তব্ধ হয়ে দেখেন মথুরার কিশোর রাজকুমার এক অদ্ভুত রহস্যময় হাসি ঠোঁটের কিনারায় নিয়ে মায়াবীদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে এই সাক্ষাৎ মৃত্যুর অবতার গজরাজের দিকে । আর অদ্ভুত ভাবে তার সামনে এসে এই সাক্ষাৎ মৃত্যুর অবতার ও থমকে দাঁড়িয়ে রয়েছে, যেন স্বয়ং মৃত্যু দেব মৃত্যু দানের আগের মুহূর্তে অযাচিত ভাবে পরেগেছেন কোনো অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ের সামনে। তার দুই চোখে মিশে আছে এক অদ্ভুত সংশয় আর অবিশ্বাস। কৃষ্ণ এক এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে এই সাক্ষাৎ মৃত্যুর দিকে। প্রচণ্ড আতঙ্কে মহাসামন্ত প্রায় চীৎকার করে বারণ করে উঠতে গেলেন, "কি করছেন রাজকুমার? দাঁড়ান।"
কিন্তু পর মুহূর্তেই একটা দৃঢ় মুষ্টি তাকে স্তব্ধ করে দিলো। তার সামনে পর্বতের মতন এসে দাঁড়ালেন, কৃষ্ণের ইস্পাত কঠিন অগ্রজ স্বল্পভাষী বলরাম। মৃদু অথচ দৃঢ় স্বরে তিনি বলে উঠলেন "দাঁড়ান মহাসামন্ত, কানু যা করছে ওকে করতে দিন। ও জানে ও কি করছে।"
কিছু মুহূর্তের জন্য বিমূঢ় হয়ে গেলেন অক্রুর, তারপর কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে দেখলেন একটু একটু করে গজরাজের দিকে আরো এগিয়ে গেছেন মথুরার ভবিষ্যৎ নায়ক। দিশেহারার মতো তিনি আবার বলে উঠতে গেলেন "কিন্তু কুমার।..."
কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে বলরামের উদ্যত তর্জনী তাকে স্তব্ধ করে দিলো, "এখন আর একটাও কথা নয় মহাসামন্ত, আপনি শুধু কানুর উপর ভরসা রাখুন।"
আতঙ্কে নীল হয়ে মহাসামন্ত অক্রুর দেখলেন কৃষ্ণকে ওই অদ্ভুত সুমধুর শিস দিতে দিতে গজরাজের আরো কাছে এগিয়ে যেতে , গজরাজের দৃষ্টিতে এখনো যেন লেগে রয়েছে এক অজানা সংশয়। আগের মতন ক্ষিপ্ত হয়তো সে আর নেই, কিন্তু এখনও মাঝে মাঝেই এক গম্ভীর স্বরে সে দিয়ে উঠছে প্রচণ্ড হুঙ্কার।
আতঙ্কে রুদ্ধবাক দর্শক হয়ে অক্রুর দেখলেন হাসি মুখে নিয়ে গজরাজের একেবারে সামনে এসে দাঁড়ালো ষোলো বছরের এই কিশোর। মধুর শিস দিতে দিতে সে তার হাত এগিয়ে দিচ্ছে এই সাক্ষাৎ মৃত্যুর দূতের দিকে। এক মুহূর্তেরজন্য যেন আবার হিংস্র হয়ে উঠতে গেলো গজরাজ। যেন মুহূর্তের মধ্যে পিষে ফেলতে চায় সে এই তুচ্ছ মানব সন্তান কে। গলা দিয়ে একটা অস্ফূট আর্তনাদ বেরিয়ে এলো অক্রূরের, কিন্তু পরমুহূর্তেই তিনি দেখলেন এক মুখ হাসি নিয়েতার অদ্ভুত শিস ধ্বনির সামান্য কিছু বদল করলেন কৃষ্ণ।এই অদ্ভুত ধ্বনি যেন আরো বেশি মোহময় হয়ে উঠলো, আর তার সাথে ধীরে ধীরে আবার শান্ত হয়ে উঠলো ক্ষিপ্ত গজরাজ।
বিনা কোনো দ্বিধায় হাত বাড়িয়ে গজরাজের বিশাল শরীরে এক অদ্ভুত ভঙ্গীতে হাত বোলাতে লাগলেন কৃষ্ণ। কিছু খন্ড মুহূর্তের জন্য হৃদধ্বনি যেন থেমে গেলো মহাসামন্তের। আর গজরাজও যেন এক প্রচন্ড বিস্ময়ে সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো এই ক্ষুদ্র মানব সন্তানের দিকে। তারপর হতবাক মহাসামন্তের বিমূঢ় দৃষ্টির সামনে ওই কালরূপী প্রকাণ্ড দানবাকৃতি পশুও যেন এক অবোধ প্রাণীর মতো শুঁড় তুলে অভিবাদন জানালো এই তরুণ মানব সন্তানকে।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেননা মহাসামন্ত অক্রুর। একোন মায়া দেখাচ্ছে এই অদ্ভুত কিশোর! কোন মহামন্ত্রে সে বশ করলো এই সাক্ষাৎ মৃত্যুর অবতারকে?
শুধু এখানেই অবসান হলোনা তার বিস্ময়ের। স্তব্ধ হয়ে তিনি দেখলেন , নিজের পেছনের পা কৃষ্ণের চোখের সামনে নিয়ে এলো এই মূক প্রাণী, একটা অব্যক্ত স্বরে সে যেন কিছু বলতে চাইছে এই কিশোরকে। কৃষ্ণ কি দেখতে পেলেন, বুঝতে পারলেননা অক্রুর। কিন্তু দেখলেন কয়েক মুহূর্তের জন্য ওই মধুর হাসি মুছে গিয়ে একটা তীব্র ঘৃণার ছাপ ফুটে উঠতে ওই তরুণ মুখে।
আলতো করে হাত বাড়িয়ে দিয়ে গজরাজের পেছনের পা থেকে একটা তীক্ষ্ণ কিছু যেন চোখের পলকে বার করে নিয়ে আসলো কৃষ্ণ। একটা তীব্র আর্তনাদ বেরিয়ে এলো গজরাজের কণ্ঠ থেকে, কিন্তু সেই আর্তনাদে আর মিশে নেই কোন ক্রোধ বা হিংস্রতা, বরং ফুটে উঠেছে এক তীব্র যন্ত্রণা আর অসহায়তার ছাপ।
আরেকবার ওই অদ্ভুত শিস ধ্বনি করে উঠলো কৃষ্ণ আর তারসাথে আলতো করে তার হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো ওই বিশাল প্রাণীর দেহে। এই অদ্ভুত স্নেহের পরশে ওই দানবাকৃতি প্রাণীটিও যেন ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে ক্লান্ত শরীরে ধীরপায়ে সরে সরে দাঁড়ালো রাজপথের এক ধারে। আর তারপর পিছন ফিরে রাজপথ থেকে ফিরে যেতে লাগলো অজানা পথে তার পিলখানার দিকে। কৃষ্ণ তখনও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন ওই দানবাকৃতি প্রকাণ্ড প্রাণীটির দিকে। পথের প্রায় অন্যপ্রান্তরে পৌঁছে গিয়ে সে একবার পিছন ফিরে তাকালো এই ক্ষুদ্র মানব সন্তানের দিকে, শংকিত হয়ে উঠলেন অক্রুর "আবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলোনা তো ওই চলমান বিভীষিকা?" কিন্তু না ,তার আশংকাকে ভুলপ্রমাণিত করে কৃষ্ণের দিকে ফিরে নিজের শুঁড় তুলে একটা অদ্ভুত বৃংহন করে উঠলো গজরাজ। না জানি নিজের ভাষায় কি বোঝাতে চাইলো এই মূক প্রাণী? কৃতজ্ঞতা না কোনো অজানা প্রতিশ্রুতি? আর তারপরেই ধীর গতিতে সে হারিয়ে গেলো নগরের পথের বাঁকে।
কৃষ্ণ অবশেষে এইবার তাদের দিকে ফিরে তাকালেন, অক্রুর এতক্ষনে দেখতে পেলেন কৃষ্ণ গজরাজের পা থেকে কি বার করে নিয়েছিলেন? কৃষ্ণ তার ডান হাতে ধরে রয়েছে একটি সুতীক্ষ্ণ রক্তাক্ত অঙ্কুশ, কেউ যেন ইচ্ছে করেইবিদ্ধ করেছিল ওই মহাকায় প্রাণীটিকে এই ধারালো অস্ত্রটি দিয়ে, আর সেই যন্ত্রণাতেই এতক্ষণ পাগলের মতো হয়ে গিয়ে এক চলমান মৃত্যু দূতে পরিণত হয়েছিল ওই অবোলা প্রাণীটি।
অক্রুর নিজের স্তব্ধ দশা থেকে অবশেষে বাস্তবের মাটিতে ফিরে আসেন, কি হলো এতক্ষণ? তার নিজের চোখের সামনে একি অদ্ভুত মায়া ঘটে গেলো গেলো এই কয়েক মুহূর্তে? কে এই ষোলো বছরের বালক? একি সত্যি মথুরার এত দিনের প্রতীক্ষার ফল? না কি কোনও ছদ্মবেশী মায়াবী! কিভাবে বশ করলো ও ওই সাক্ষাৎ কালকে?
আর নিজেকে সংযত রাখতে পারেননা মহাসামন্ত। ব্যাকুল স্বরে তিনি বলে ওঠেন "এতক্ষণ এখানে একি ঘটে গেলো রাজকুমার? ক্ষিপ্ত গজরাজ, তারপর আপনি এগিয়ে গেলেন ওর দিকে, গজরাজ অদ্ভুত ভাবে শান্ত হয়ে নিজের পথে ফিরে গেলো।...আর এখন আপনার হাতে এই ধারালো অঙ্কুশ, এসবের অর্থ কি ?”
মধুর হাসিটি মুছে গিয়ে একটা চাপা ক্রোধ যেন ফুটে উঠলো কৃষ্ণের মুখে কয়েক মুহূর্তের জন্য, একটা দৃঢ় স্বরে সে বলে উঠলো "কিছু মানুষ নিজেদের পাশবিক ইচ্ছায়, যন্ত্রণা দিয়ে পাগল করে দেওয়ার প্রয়াস করেছিল ওই নিরীহ অবোলা প্রাণীটিকে, আর প্রচণ্ড যন্ত্রণায় দিশেহারা হয়ে ছুটে এসেছিলো বেচারা আমাদের রথের দিকে। না পারছিলো কাউকে বোঝাতে ওর কষ্টটা আর না কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছিলো ওই যন্ত্রনা থেকে মুক্তির।"
অক্রুর ব্যগ্র স্বরে বলে ওঠে "সে না হয় বুঝলাম রাজকুমার, কিন্তু আপনি কিভাবে শান্ত করলেন ওই সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত কে? এ কোন মায়া দেখালেন আজ আপনি?"
কৃষ্ণ হাসি মুখে বলে উঠলেন "এ কোন মায়া নয় মহাসামন্ত। এ শুধু হলো ভালোবাসার পরশে এই অবোধ প্রাণীগুলির যন্ত্রণার সহভাগী হয়ে ওঠার কিছু গোপন কৌশল। একটা কথা জেনে রাখবেন এই সমস্ত প্রাণীই কখনও অকারণে কাউকেই আঘাত করতে চায়না।যখন সে কাউকে, বিশেষ করে মানুষকে আঘাত করে তখন তার পেছনে একটাই কারণ থাকে, তার নিজের বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম। সে সংগ্রাম নিজের খিদে মেটানোর জন্য হোক কি আত্মরক্ষার জন্য। তাই এই প্রাণীটিকে এই রকম দিশেহারা হয়ে ছুটে আসতে দেখে আমিও বুঝতে পেরেছিলাম, যে কোনও কিছু থেকে আত্মরক্ষা করার জন্যই অক্ষম চেষ্টা করে যাচ্ছে বেচারা, কিন্তু ওই অবোধ প্রাণী বুঝে উঠতে পারছিলো না যে কিভাবে মুক্তি পাবে ওই প্রচণ্ড যন্ত্রণা থেকে, আর সেই কারণেই এক অজানা আক্রোশে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল সে।"
অক্রুর ব্যাকুল স্বরে বলে ওঠে "কিন্তু রাজকুমার আপনি এখনও আমাকে বললেননা যে কিভাবে আপনি শান্ত করলেন ওকে, আর ওই অদ্ভুত শিস ধ্বনি কোথায় শিখলেন আপনি ওই অদ্ভুত ধ্বনি?"
কৃষ্ণের মুখে আবার ফিরে আসে তার চিরপরিচিত ওই মোহময় হাসিটা , মধুর স্বরে সে বলে ওঠে "এ আমার এক গুরুর শিক্ষা মহাসামন্ত। তিনি আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন এই সমস্ত অবলা প্রাণীদের ভালোবাসায় ছোঁয়ার ভাষা, সে কাহিনী না হয় অন্য আরেকদিন শোনাবো আপনাকে, এবার চলুন যাওয়া যাক"
মথুরার রাজপ্রাসাদের দিকে কিছু সময়ের জন্য একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো মথুরার ভবিষ্যৎ ভাগ্যনায়ক, তারপর একটা গাঢ় স্বরে সে বলে উঠলো "মাতুল নিশ্চয়ই খুব অধীর আগ্রহে অনেক সময় ধরে প্রতীক্ষা করছেন আমাদের,আর তাকে অপেক্ষায় রাখা সঠিক হবেনা, চলুন মথুরার রাজপ্রাসাদ অপেক্ষা করছে আমাদের।"
হতভম্ব অক্রুর অবশেষে কোনোমতে ফিরে আসেন বাস্তবের মাটিতে, স্তম্ভিত ভাবে কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে, হঠাৎ করে তার হাতদুটি জড়ো করে তিনি বলে ওঠেন "যেমন আপনার ইচ্ছা রাজকুমার, আসুন বহু বছর ধরে এই প্রাসাদ রয়েছে আপনার প্রতীক্ষায়।"
মহাসামন্তের রথের চাকা বহু চেষ্টায় অবশেষে তুলে নিতে সক্ষম হন তার সারথি। রথে উঠে আসেন কৃষ্ণ। তাকে, বলরামকে আর মহাসামন্ত অক্রুরকে নিয়ে অবশেষে রথ আবার এগিয়ে চলে মথুরার শ্বেত পাথরে নির্মিত রাজপ্রাসাদের দিকে...
(ক্রমশ)
এই গুরুদেব কি কালীয় সর্দার???
ReplyDelete