0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in


ধারাবাহিক


প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত


॥১১॥ 



ভেতর থেকে জেগে উঠলো অন্য এক স্বর 


মেজর জেনারেল সৌমজিত দাস

আজ পদাতিক মহড়ার সপ্তম ও শেষদিন। অত্যাধুনিক কম্পুটার চালিত হাতিয়ারের প্রক্ষেপন ক্ষমতা দুই দেশের ফোর্স এই কদিনে টেস্ট করে নিয়েছে। আধুনিক রাইফেল মেশিনগান মর্টার কামান ও রকেট লঞ্চার ব্যাবহারের প্রশিক্ষণ দুই দেশের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলো। বিশেষ ধরনের আক্রমনের অনুশীলনে ছিল, বারুদ আগ্নেয়াস্ত্র ও আগুন নিয়ে আক্রমণ ও নাইট কমব্যাট। আর ছিল ধুঁয়ো সৃষ্টি করে শত্রুর নজর এড়িয়ে লুকিয়ে থাকার জায়গা খোঁজা।এবং লিপফ্রগিং প্র্যাকটিস। মানে, ধুঁয়োর আড়ালে থেকে একদল গুলি করতে করতে এগিয়ে যাবে আর সেই ফাঁকে আর একদল চোখে ধুলো দিয়ে পাশ কাটিয়ে শত্রুর এলাকাতে পৌঁছে যাবে। এছাড়া ট্রেঞ্চ কাটা বাঙ্কার বানানো ট্যাংক সাঁজোয়া গাড়ি ইত্যাদি সেই আগের মতোই।

শিমুলিয়ার সাদা পাহাড়ের উপর শিমুলগাছ ঘেঁষে একটা টাওয়ার বসানো হয়েছে স্যাটেলাইট সিগন্যাল পাবার জন্যে। যদিওবা সৌমজিত লং রেঞ্জ টারগেট প্র্যাকটিস করার জন্যে ওই শিমুলগাছে একটা টার্গেট ফিক্স করতে চেয়েছিল। কিন্তু সারগেই কোনওমতেই রাজি হলোনা। এমনকি বস্তির ধার ঘেঁষে ট্রেঞ্চ খুঁড়তেও রাজি হয়নি। বলছিল আমরা কোনও কন্ট্রোভার্সিতে যাবো না। মাঝে মাঝেই সৌমজিতের মন বিদ্রোহ করে উঠছে। এই রাশিয়ান ট্রুপের কাছ থেকে যা আশা করেছিল তার সবই বিপরীত হচ্ছে। এদের যেন উদ্দেশ্যই হচ্ছে যতটুকু পারা যায় এখানের ওই নোংরা উপজাতিদের মদদ করা। এতে করে এখানের আদিবাসী পিপলস পার্টির যেন সরাসরি মান্যতা দিচ্ছে ওরা। কিন্তু সরকারী মান্যতায় এইখানে এসে সাম্যবাদী ফলানোর কী মানে হয়?

তবু ভালো। এবারের মহড়াতে ওদের অত্যাধুনিক টেকনোলজি ও বিশেষ সফটওয়ারের দৌলতে একদম ক্লোজড জুম করে সৌমজিত শিমুলিয়ার ঘন বনাঞ্চলের ইঞ্চি ইঞ্চি ভৌগলিক অবস্থান বনজ ও খনিজ সম্পদ দেখে নিতে পেরেছে। কিন্তু একটা বড় উপত্যকা অঞ্চল পাহাড়ে ঢাকা পড়ে যাওয়ায় ওই এলাকার ভারচুয়াল পরিদর্শন হলো না। অবশ্য ওই অঞ্চল এতই দুর্গম সেখানে মনে হয় কারো বসবাস অসম্ভব। যাক একদুটো উদ্দেশ্য সফল তো হয়েছেই! একটা শর্ট লেংথড মিসাইল দিয়ে দু কিলোমিটার জুড়ে কুষ্ঠ রোগের প্রতিষেধক ভেষজের জঙ্গলকে নষ্ট করে দিতে পারা গেছে। অবশ্য ওরা কিন্তু স্বরাষ্ট্র দপ্তরে সঙ্গে সঙ্গে মেলে ছবি সহ কমপ্লেন পাঠিয়ে দিয়েছে। এবারে খুব সাবধানে এগোতে হবে। সৌমজিত দেখেছে ওইসব আয়ুর্বেদিক গুল্ম জোগাড় করতে ও জড়ো করতে প্রায় আধা টুকড়ি সেনাকে ওরা ওখানে ভিড়িয়ে দিয়েছিল। কেন? রাশিয়ানসৈন্যরা নিশ্চয়ই ওগুলো বেঁধে ছেঁদে নিজের দেশে নিয়ে যাবে না? তবে ওই ক্ষয়ে যাওয়া আদিবাসী মানুষগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার কী মানে হয়? যারা দেশের লায়াবিলিটি ছাড়া কিছু নয়? রাশিয়ানরা কি দয়া দেখতে এসেছে? সৌমজিতের ঠোঁটে এক চিলতে বিদ্রুপ ফুটে উঠল।

ওদের কাছে তকনিকী উপায় রয়েছে কিন্তু আমাদের ভারতীয়দের সফটওয়ারের উপর দখল বিশ্ব সেরা। আমাদের কাছে তোমাদের প্রতিটি চালচলন নখদর্পণে। স্যাটেলাইট মাধ্যমে সমস্ত এরিয়া তন্নতন্ন করে সার্চ করে মোট দশটা বস্তি চিহ্নিত করা হয়েছে। আজই দুপুরে মর্টার ছুঁড়ে আর কামান দেগে ওগুলোকে শেষ করতেই হবে। খুব সতর্ক হয়ে, সাবধানে। কারণ, ওই লতাগুল্মভরা জঙ্গল এরিয়া আগুনে নষ্ট হওয়ার খবর ওরা বিদেশদপ্তরে সরকারিভাবে রিপোর্ট করে দিবেই। ছাড়বেনা। অবশ্য আমিও কোনো অংশে কম যাইনা। সেসব ব্যবস্থা করে রেখেছি।

সিডিউলড অপারেশন অনুযায়ী উগ্রবাদী এলাকা ধ্বংস করার ব্যাপারে এদের তো কোনো গরজই দেখছিনা। উপরন্তু সারগেইএর সাথে যখনই টেবিলে বসছি নানা রকমের কমেন্ট নানান বিদ্রুপ! মানুষকে ঘৃণা করা আমার স্বভাব? আমি মিসানথ্রপিস্ট? আমি স্যাডিস্ট? রাগে সৌমজিতের মুখ লাল হয়ে যায়। আমাকে কোন সাহসে ও বলে আমি শ্রেণী শত্রু? বলে, তুমি তোমার নিজের অসহায় বঞ্চিত আদিবাসী ভাইয়ের শত্রু হবার চেষ্টা করছ কিন্তু সত্যিকারের তা নও। তুমি বুর্জোয়া পালিত এক সম্পদ লোভী দালাল।

সৌমজিত উপায়হীন চুপচাপ কথাগুলো হজম করে নেয়। সে জানে সারগেই তাকে প্রোভোক করছে। হঠাত্‍ যদি কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে প্রতিবাদ করতে কিছু করতে উদ্যত হয়,সাথে সাথেই তার প্রতিক্রিয়া। কেননা এটা আন্তর্জাতিক জোটবন্ধন। আসল কথা সারগেইকে দেখলেই সৌমজিতের খুব অস্বস্তি হয়। এমন অস্বস্তি ভাব জীবনে কখনো কারোর সামনে আজঅব্দি হয়নি। ও যেন মনের ভিতরে অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমস্ত ইচ্ছা প্ল্যান সবকিছুই পড়ে নেয়। কি করে? সারগেই একবার কথার পিঠে বলেই দিল, খনিজ সমৃদ্ধ এই এলাকায় কম সে কম তিরিশটি বড় ছোটো মাইন্স আছে। তার মধ্যে একটা ছোটো অথচ বহুমুল্য তামার খনিজ এলাকাটি সৌমজিত মাইন্স ওনারদের কাছথেকে উপহার স্বরূপ পেলেও পেতে পারে। যদি এলাকাটি মুক্ত করে দেওয়া হয় তবে।

মেজর জেনারেল সৌমজিত ভাবে, আশ্চর্য! ও আমার অতি গোপন ইচ্ছা এমন নিখুঁত ভাবে বলে দিতে পারলো কি করে? অথচ আমি কেন পারিনা? সারগেই কি করছে না করছে সেটা জানতে গেলেও একটা অসম্ভব দুর্বোধ্য বাধা আসে। আমি কিছুতেই জানতে পারিনা।

সৌমজিত দেখেছে ওদের ডিউটি যেন পদবীভিত্তিক নয়। উঁচু পদবীর অফিসার ও নিচুতলার হাবিলদারের মধ্যে এত নিখুঁত তাল মেল রয়েছে যে যেকোনও কাজ যে কোনো খবর অতি সঙ্গোপনে হয়। আর আমাকে দিনের মাথায় একদুজনকে ডিসমিস সাসপেনড করতে হচ্ছে। অন্তত আমাকে করতে হচ্ছে। ওরা বলে এতে সেনাদের মধ্যে টাইট বন্ডিং খারাপ হয়ে যায়।

তাইবুঝি ওদের স্নাইপার টিম আমাদের চেয়ে অনেক বেশি স্মার্ট। ম্যাপ দেখে লক্ষ্য স্থির করা,ভৌগলিক পরিবেশ জেনে প্রত্যেককে অবগত করা এইসবের টিম ওয়ার্ক ভীষণ ভালো। আমাদের এইব্যাপারে কমজোরির জন্যে নাকি আমিই দায়ী একথাটা সারগেই বলে। সৌমজিত ভাবল, স্নাইপার এক্সারসাইজ পরে হলেও চলবে। কিন্তু আমার এখন একমাত্র লক্ষ্য এই এলাকা সম্পুর্ণ উপজাতি মুক্ত করা।

এই মহড়ায় রিকনিসন্স নামের একধরণের অনুশীলন ছিল। খুবই গোপনে প্রতিদ্বন্দ্বীর অবস্থান শক্তি ইত্যাদির বিষয়ে জেনে আবার নিজের জায়গায় ফিরে আসাই ছিল এই প্র্যাকটিসের মূল লক্ষ্য। এতে সৌমজিত নিজের বাছা বাছা কয়েকজন চৌকস ফোর্সকে কাজে লাগিয়ে ছিল। ওরা গোপনে রাশিয়ানদের মেডিক্যাল ইউনিটে গিয়ে দেখে এসেছে ক্ষত বিক্ষত একজন আদিবাসী মহিলা এডমিটেড। তার সাথে একজন ফর্সা রোগা ভারতীয় বৃদ্ধ। তাহলে বাবা আর ওই আদিবাসী দাই জেরকা এখানে ? ওদের কাছ থেকেই তাহলে সৌমজিতের বিরুদ্ধে এইসব তথ্য সারগেই পাচ্ছে? বাবার কথা মনে পড়তেই সৌমজিতের প্রচণ্ড রাগ হয়ে গেল। ওই একটা তার জীবনের ভয়ানক বাজে পরিচয়। একটা অপদার্থ ছোটোলোক সমকামী। তাও আবার উপজাতি নোংরা বনমানুষের সাথে।

জেরেকা একটা খুব চালাক আদিবাসী লিডার। অসম্ভব প্রিয় সে খেড়িয়া ও শবরজাতির। দুধ খেড়িয়া ঢেলকি খেড়িয়া ও নানান বনাঞ্চলের আদি জনগণ যেমন গোলগো ভুনিয়া সান্ডি গিদি নাগো। ওরা যদি খবর পায় জেরেকা মরতে বসেছে, আর বাঁচবে না, তখন সব আদিবাসীরা ক্ষেপে উঠবে। আজই যদি চিহ্নিত করা কম সে কম সাত আটটা গ্রামকে মর্টার ও শর্ট রেঞ্জড কামান দিয়ে না ওড়ানো হয় তবে একটা ভয়ানক আন্দোলনের রূপ নিতে পারে। রাশিয়ান সৈন্য তখন হয় চুপ করে থাকবে না হয় যেমন গতিক বোঝা যাচ্ছে ওরা ওদের সাপোর্ট করতে পারে। কিন্তু ওদের আসল লিডার ওই বাস্টার্ড পেরো কোথায়?

0 comments: