ছোটগল্প - সাম্য দত্ত
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
সন্ধানে ধন্দায়
সাম্য দত্ত
কাঠমাণ্ডু, ১৮৮৯
টরে টক্কা টরে টক্কা টক্কা টক্কা টরে টরে
হঠাৎ দেখলে মনে হবে, লোকটা বুঝি বাঘের মুখে পড়েছিল। নিতান্ত কোনও হিংস্র শ্বাপদের নখরাঘাত না পড়লে, গায়ের ময়লা জামাটা ওভাবে ছিঁড়ে ফালাফালা হয় না। অবশ্য, আদ্যিকালের চটের বস্তার মতো যে পোশাকটা হাঁটুর কাছে এসে ফুরিয়ে গেছে, সেটাকে জামা বলাটাও একরকম বাতুলতা।
উল্টানো পাখির বাসার মতো চুলে ডিসেম্বরের ঠাণ্ডা হাওয়া লাগিয়ে, লোকটা হেঁটে যাচ্ছিল রাস্তা ধরে। কাঠমাণ্ডুর ছেলেছোকরারা বেজায় আমোদগেঁড়ে, রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ানো পাগলমাত্রেই তাদের তামাসার পাত্র। যেমনটা আর পাঁচজন পাগলের কপালে জুটে থাকে, বেয়াদব ছেলেদের দল এই লোকটাকেও তাড়া করেছিল পেছন পেছন। লোকটার চাহনিতে কিন্তু পাগলামির লেশমাত্র নেই। বরং ছেলেদের টিপ্পনী শুনে আর আচমকা গায়ে এসে পড়া ঢিলের হাত থেকে নিজেকে আড়াল করতে যখন ঘুরে তাকাচ্ছে, চোখের তারায় ফুটে উঠছিল একটা বিরক্তির আভাস। কোনও অবস্থাপন্ন লোক ভাগ্যদোষে বিপর্যয়ে পড়লে যেরকম অসহায় ভাবে গুমরাতে থাকে, এই লোকটার হাবভাবও কতকটা সেইরকম।
পাহারাওলা মদন তামাং-এর দয়া হয়েছিল। বিচ্ছু ছোঁড়াগুলোর হাত থেকে উদ্ধার করে, রাতের মতো পাগলটাকে আশ্রয় দিয়েছিল থানায়। লোকটা বোধহয় অসুস্থ। কপালে হাত দিয়ে মদন তামাং দেখলো, জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা। লক আপের এককোণে শুয়ে আছে কুণ্ডলী পাকিয়ে, আর জ্বরের ঘোরে ভুল বকে চলেছে অনর্গল। যদি নাম-ধাম কিছু জানা যায়, সেই আশাতেই পাগলের মুখের কাছে কৌতুহলী কান নিয়ে গেছিল মদন, আর তারপরেই...
বড়কর্তা পিটার ল্যানডন বয়সে নিতান্তই তরুণ, ইয়র্কশায়ারে ফেলে আসা কৈশোরের ছাপ মুখ থেকে এখনও পুরোপুরি মুছে যায়নি। শীতের রাতে কাঁচা ঘুম ভাঙানোয় ছোকরা সাহেব যে বিস্তর চটেছে, সে সাহেবের কিড়িমিড়ি গালাগাল শুনেই মদন বুঝে গিয়েছিল। কিন্তু উপায় কী? মদন তামাং নিজে লেখাপড়া তেমন শেখেনি বটে, কিন্তু তার এক ভায়রাভাই আছে গোর্খা রেজিমেন্টে। ভায়রা লোকটি বেশ চালাকচতুর। তার মুখে রাজনীতির যেটুকু হাল হকিকত মদন শুনেছে, তা'তে এই পাগলের প্রলাপ যদি একবর্ণও সত্যি হয়, তাহলে তো...
স্পষ্ট শোনার তাগিদে, পাগলটার ঠোঁট প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে 'ল্যাণ্ডো সাহিব'-এর কান। চোখদুটো গোল, উত্তেজনায় সর্বাঙ্গের লোম খাড়া হয়ে গেছে। কর্তার এই বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে যাওয়া ভাবখানা দেখে, মনে মনে একটু হাসল মদন।
-অব কী গর্নি, সাহিব? হমি এক তার পাঠাউনা গর্নুপর্ছ?
-"তার? ইউ মিন টেলিগ্রাম?" এতক্ষণে ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা কাটিয়ে উঠে মুখ খুললেন ল্যানডন, "ওহ্, ইয়েস ইয়েস! উই মাস্ট ইনফর্ম ক্যালকাটা অ্যাবাউট দিস। গুডনেস তামাং! ইউ হ্যাভ ডান আ ফিনোমিনাল জব। ওহ্!" সহর্ষে হাতে হাত ঘষছেন সাহেব, "আই অ্যাম গোয়িং টু বি রিওয়ার্ডেড ফর দিস!"
তার মানে? খেটে মরবে এই মদন তামাং আর পুরস্কারটি পকেটে পুরবে তুমি নিজে! বটে রে! ব্যাটাচ্ছেলে, তুই তো লেপের তলা থেকে বেরোতেই চাইছিলি না!
কলকাতায় একটা টেলিগ্রাম করতে হবে, এখনই! হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়লেন পিটার ল্যানডন। ভালোই হলো! নেপালী ভাষাটা এতদিনে মোটামুটি আয়ত্তে এসেছে, পাহারাওলা মদন তামাং-এর দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা শব্দগুলো কানে গেলে, সাহেব মোটেও প্রীত হতেন না।
| |
-টেলিওলজি!
কপালের ওপর নেমে আসা চুলগুলোকে শক্ত মুঠোয় পাকিয়ে ধরে, কথাটা মনে মনে উচ্চারণ করলেন ভূতনাথ সমাদ্দার। মাথার ঘন চুলে সদ্য শৈত্যের রঙ ধরতে শুরু করেছে, আলগোছে টান দিতেই খানকতক পাকা চুল উঠে এলো হাতে। "টেলিওলজি!" আবার বললেন ভূতনাথ, এবারও মনে মনে। হতেই হবে, এ নির্ঘাত তাই!
-শঙ্কু! ও শঙ্কু, আছিস তো বাপ? নাকি পালালি?
লোডশেডিং-এর ভূতুড়ে অন্ধকারে লেখার টেবিলখানা আলো করে বসেছিলেন ভূতনাথ সমাদ্দার। টেবিলের ওপরে কম্পমান মোমবাতির শিখার সামনে খোলা পড়ে আছে লেখার খাতাটা। একটা হাত অবাধ্য চুলগুলোকে শাসন করতে ব্যস্ত, অন্য হাতটা বেখেয়ালে টরেটক্কা তুলেছে টেবিলের ওপর। ভূতনাথের হাঁক শুনে, এবার জবাব এল টেবিলের তলা থেকে:
-এজ্ঞে, আছি বইকি! তবে, পালাবার উপায় থাকলে কি আর অ্যাদ্দিন পড়ে থাকি? কোনকালে... তা, কী আর করব বলুন? মাথার ওপরে ভগোমান রয়েছেন। তাঁর ইচ্ছে, তিনি ফেবিকল দিয়ে সেঁটে দেছেন আপনার সনে।
-ওরে ব্যাটা! খুব চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শিখেছিস তো! আচ্ছা, বল দেখি, টেলিওলজি মানে কী? দেখি তোর বিদ্যের দৌড়।
-ওই দেকো! এই বোশেখ মাসে ওলের খপর কোথ্থেকে পাবো? আর আপনাকেও বলিহারি কত্তা! ওল মুখে দিলেই তো গলা কুটকুটিয়ে মরেন, তবু আপনার নোলা যায়নেকো।
-তুই একটা আস্ত ইডিয়ট! ওলের কথা কে বলেছে? হচ্ছে টেলিওলজির কথা, মানে বুঝিস?
-এজ্ঞে না! আমি বাপু মুখ্যুস্যুখ্যু মানুষ, অত কটরমটর বুলি শিখে কাজ নেই। শেষটায় আপনার মতো ব্যোমভোলা হয়ে ঘুরে মরি আর কী!
-থাম থাম! ওরে গাধা, এই যে আমরা নিত্যদিন ঘুম ভেঙে ওঠা থেকে আবার ঘুমুতে যাওয়া অবধি এত এত ঘটনার সাক্ষী থাকি, তার কিছু হয়তো আমরাই ঘটাচ্ছি, কিছু ঘটছে আমাদের ঘিরে, আবার কিছু ঘটনার সঙ্গে হয়তো আমাদের সরাসরি কোনও যোগ নেই, তবুও তারা ঘটছে তো! কিন্তু কেন? এই যে ঘটনার ঘনঘটা, এর কারণটা কী? ভেবে দেখেছিস সেকথা?
-এজ্ঞে না।
-থাক, তোর আর ভেবে কাজ নেই! তবে জেনে রাখ, এই প্রত্যেকটি ঘটনাই ঘটছে, ভবিষ্যতে এদের দ্বারা বড় কোনও উদ্যেশ্য সাধিত হবে বলে। ওই উদ্যেশ্যটাই আসল, বর্তমানের ঘটনাগুলো নিমিত্তমাত্র। মোটমাট এই ব্যাপারটাকেই বলে টেলিওলজি। বুঝেছিস? এই যেমন ধর, তুই গতকাল বাজার থেকে মাগুর মাছ আনলি... আনলি তো? কেন আনলি? না, আজ আমার পেটটা বেগরবাঁই করবে, আর আমার একটু পাতলা ঝোল খাবার প্রয়োজন পড়বে, সেই জন্য! কিন্তু তুই তো আর এতশত ভেবে আনিসনি, ওই টেলিওলজি তোকে দিয়ে করিয়ে নিলে। তেমনই, আজ সন্ধ্যে থেকে লোডশেডিং কেন? না, আমার মাথায় চমৎকার একটা ভূতের গল্পের প্লট আসবে বলে, আর ঠিক এইরকম পরিবেশ না পেলে লেখাটি খুলবে না- অ্যাজ সিম্পল অ্যাজ দ্যাট! এইবার বুঝেছিস?
কল্প-ইতিহাসের গল্প বলায় আধুনিক লেখকদের মধ্যে ভূতনাথ সমাদ্দার অপ্রতিদ্বন্দী। প্রাচীনকালের কাহিনী তাঁর কলমে নতুন করে পাবার জন্য পত্রিকাওয়ালাদের ভেতর হুড়োহুড়ি লেগে যায়। ঐতিহাসিক উপন্যাস সমগ্রের নতুন খণ্ড ছেপে বেরোনোর অপেক্ষা, বইয়ের দোকানগুলোতে যেন চৈত্র সেলের ভিড় ভেঙে পড়ে।
কিন্তু, এর মধ্যেও একটু কথা আছে। ভূতনাথ সমাদ্দার ঐতিহাসিক কাহিনী লেখেন, এবং ভালোই লেখেন তা'তে সন্দেহ নেই, কারণ তাঁর নাম শুনলেই প্রকাশকের মুখে যে হাইভোল্টেজ হাসি ফুটে ওঠে, সেও তাঁর সাফল্যের বার্তাই বহন করে। কিন্তু লেখক হিসেবে ভূতনাথের একটা দোষ আছে। দোষ না বলে অবশ্য সাহেবি কেতায় অবসেশন বলাই ভালো। তাঁর প্রায় সবকটি গল্পেই... আর প্রায়ই বা বলছি কেন, নিয়ম করে প্রত্যেকটি রচনাতেই তিনি অলৌকিক অনুষঙ্গ টেনে আনেন। এই গল্পে যদি আলেকজাণ্ডারের আত্মা নামিয়ে থাকেন, পরেরবার নির্ঘাত স্মরণ করবেন সম্রাট কনিষ্কের স্কন্ধকাটাকে। আর ঠিক এই কারণেই বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদীর দল তাঁর ওপর বেজায় খাপ্পা। ভূতনাথের অবশ্য তা'তে কিছু এসে যায় না। জিজ্ঞেস করলে মুচকি হেসে বলেন, "ভূত কথাটার তো দু'রকম মানেই হয়! একদিকে ভূতের অর্থ যেমন অতীত, আবার অন্যদিক থেকে ভাবলে, সেই মানেটাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রেত বা ঘোস্ট বা ফ্যান্টম। তা, আমার গপ্পে নাহয় দু'ধরনের মানেই বহাল রইলো! তা'তে ক্ষতি কী, অ্যাঁ?"
তবে, এইবেলা একটা গুপ্তকথা সেরে রাখা ভালো। ভূতনাথ সমাদ্দার ভৌতিক গপ্প লিখিয়ে হিসেবে যত দরেরই হন না কেন, ছেলেবেলা থেকেই তাঁর ভূতের ভয়টা কিঞ্চিৎ বেশি। ঘর অন্ধকার করে তিনি শুতে পারেন না, সারারাত একটা টিউবলাইট গাঁকগাঁক করে জ্বলে। বাইরে একটা পেঁচা কিম্বা কুকুর ডেকে উঠলে বুকের ভেতরটাও কেমন ছমছম করে ওঠে। এমনকি একলাটি বসে ভূতের গপ্প লিখতেও পারেন না, চাকর শঙ্কাহরণকে ঠায় বসে পাহারা দিতে হয়।
এইমুহূর্তে, এই লোডশেডিং-এর ঝুঁঝকো আঁধারে বসে লিখতে লিখতেও ভূতনাথবাবুর একটু ভয়ই করছে। তাই, গলাটা একবার সজোরে খাঁকরে নিয়ে, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, "হ্যাঁ রে শঙ্কু, ভূত বলে কিছু হয়না, তাই না?"
-হয়নাই তো! আপনি মিছিমিছিই ভয় পেয়ে মরেন! এই দেখুন না, গত শুক্কুরবার সন্ধ্যেবেলা, হারুর দোকান থিকে তেলেভাজা কিনে ফিরছি, মোড়ের মাথায় ভাদুড়ী-ঠাকমার সনে দেকা। তা, তাঁকেও এই কতাখানাই শুধোলাম। তিনি তো বেশ জোর গলায় বললেন, "না রে শঙ্কু, ওসব ভূত-প্রেত বলে কিচ্ছুটি নেই! সব ছেলেভুলোনো গাঁজাখুরি গপ্প।"
-"কে? কার সঙ্গে দেখা হলো বললি? ভাদুড়ী-ঠাকমা? যাহ্!" গলায় অবিশ্বাসের সুর ঢেলে, শঙ্কুর কথাটাকে উড়িয়ে দিতে চাইলেন ভূতনাথবাবু, "তিনি তো গত আশ্বিন মাসেই দেহ রেখেছেন। তাঁর শ্রাদ্ধে পাত পেড়ে খেয়ে এলি, মনে নেই? তাঁকে তুই দেখবি কেমন করে?"
-বা রে! চম্যচক্ষে দেখলুম বলেই না বলছি! তা বাবু, দেহ থাকুক আর নাই থাকুক, একজন বিচক্ষণ মনিষ্যি তো বটে! সেই তিনি কি আর মিছে কতা কইবেন?
-যাহ্! কী আবোলতাবোল...
-এই দেকুন! আপনার কতাও তো কত শুধোলেন! বললেন, "হ্যাঁ রে, সেই হাড়বজ্জাত অলপ্পেয়ে ভুতোটার কী খবর? কাজকম্ম কিছু ধরেছে, নাকি এখনও সেই ভাঁওতাবাজির গপ্প লিখেই পেট চালায়? ওকে বলে দিস, আমি এবার থেকে ওর ওপর কড়া নজর রাখব।"
এই কথায় ভূতনাথবাবুর ভয় পাবার বিলক্ষণ কারণ আছে। ভাদুড়ী-ঠাকমার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বরাবরই আদায়-কাঁচকলায়। ছেলেবেলায় ভাদুড়ীদের বাগানে আম পাড়তে যেতেন, সেই থেকেই বুড়ি তাঁর ওপর হাড়ে-চটা। শঙ্কু ব্যাটার কথা যদি একবর্ণও সত্যি হয়...
-হ্যাঁ রে শঙ্কু, কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন হয়, শুনেছিস তো? তোর নাম যে 'শঙ্কাহরণ' রেখেছিল, তাকে একবাট্টি হাতের কাছে পেলে...
নাহ্! এইবেলা মনঃসংযোগ না করলে, এত চমৎকার একখানা গল্পের প্লটটাই মাথা থেকে ভ্যানিশ করে যাবে! লেখার তাগিদে ইতিহাসের হরেকরকম বই তাঁকে হামেশাই নেড়েচেড়ে দেখতে হয়, এই গল্পটার আইডিয়াও ভূতনাথবাবু পেয়েছেন একটা বই থেকে- ঐতিহাসিক সল ডেভিডের 'দ্যা ইণ্ডিয়ান মিউটিনি।' সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম নেতা ধন্ধুপন্থ নানাসাহেবের নাম কে না জানে? পেশোয়া দ্বিতীয় বাজীরাও-এর দত্তকপুত্র নানাসাহেব ইংরেজদের জব্বর লড়াই দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না, কানপুরের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে, নানাসাহেব বিঠুর ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। গেলেন তো বটে, কিন্তু কোথায়? এইখানেই ঐতিহাসিকরা নিরুত্তর। নানা মুনির নানা মত আছে বটে, কিন্তু কোনওটাই তেমন পাকাপোক্ত নয়। আর ইতিহাসের দৌড় যেখানে শেষ, ভূতনাথ সমাদ্দারের কল্পনাও সেখান থেকেই শুরু।
পেটের ভেতর ভুসভুসিয়ে ভেসে ওঠা ভয়টাকে কষে দমন করে, খাতাখানা আবার কাছে টেনে নিলেন ভূতনাথবাবু। ফেলে আসা গপ্পের খেই আবার ধরে নিয়ে, নতুন করে আঁচড় কাটা হতে লাগলো খাতার পাতায়:
"...কিন্তু ধৃত ব্যক্তিই যে নানাসাহেব, সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যাইবে কীপ্রকারে? মেজর ডেভিডসনের খেয়াল হইল, কানপুরের সিভিল সার্জন উলফম্যান সাহেব কিয়দকাল নানাসাহেবের চিকিৎসা করিয়াছিলেন। তৎক্ষণাৎ টেলিগ্রাফের তারে বার্তা ছুটিল আজমেঢ় হইতে কানপুর। কানপুরে স্বীয় চেম্বারে বসিয়া ডক্টর উলফম্যান সেই বার্তা পড়িলেন বটে, কিন্তু পাঠান্তে তাঁহাকে বিশেষ উৎফুল্ল মনে হইল না।..."
| |
কানপুর, ১৮৭০
টক্কা টরে টক্কা টরে টরে টক্কা টরে টরে
সদ্য পাওয়া টেলিগ্রামটা হাতে নিয়ে, ভুরু কুঁচকে বসে ছিলেন ডক্টর রিচার্ড উল্ফম্যান। ঠোঁটের কোণে পাইপটা যেরকম জোরসে কামড়ে ধরেছেন, পাইপের শরীরে প্রাণ থাকলে বোধহয় ত্রাহি ত্রাহি আর্তনাদ ছাড়ত। নাহ্! টেলিগ্রামের বিষয়বস্তু অপ্রত্যাশিত নয়, ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আলাদা আলাদা শহর থেকে এরকম বার্তা তিনি আগেও পেয়েছেন। কখনও কলকাতা, কখনও মেবার, এইবারেরটা এসেছে আজমেঢ় থেকে। তবে প্রত্যেকবার এই টেলিগ্রামটা হাতে পাবার আগে এমন একটা ব্যাপার ঘটে যায়, বুদ্ধি দিয়ে উল্ফম্যান সাহেব যার কোনও ব্যাখ্যা পাননি।
কানপুরের ধনী ব্যবসায়ী শেঠ বদ্রীদাসের খুকখুকে কাশি। কোলা ব্যাঙ যেভাবে লম্বা জিভ ছুঁড়ে দিয়ে শিকার ধরে, ঠিক তেমনিভাবে দেড় হাত লম্বা জিভ বের করে, সামনের চেয়ারে বসে ছিলেন বদ্রীদাস। শেঠজীর মুখখানাও অবিকল ব্যাঙের মতো। জিভটা একহাতে চেপে ধরে, হাঁ-মুখের ভেতরটা খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছিলেন ডক্টর উল্ফম্যান, হঠাৎ চমকে উঠে প্রশ্ন করলেন, "হোয়াট?"
-অঁক?
-হোয়াট ডিড ইউ জাস্ট সে?
-অঁক অঁ!
-ডিডন্ট ইউ সে সামথিং অ্যাবাউট আ টেলিগ্রাম? জাস্ট নাউ?
এইবার শেঠজীর চোখেমুখে যে ভাবটা ফুটে উঠলো, সেটা হুবহু গাড়ির নীচে চেপ্টে যাওয়া ব্যাঙের মতোই ফ্যালফ্যালে। ডক্টর উল্ফম্যান অধৈর্য হয়ে একটা ধমক দিতে যাচ্ছিলেন, আর ঠিক তখনই ধাঁ করে ব্যাপারটা মনে পড়ে গেল।
আরে, ঠিক এরকমটাই তো হয়! যতবার এই বার্তা এসেছে, ততবারই ঠিক আগের মুহূর্তে মাথার ভেতর থেকে কেউ যেন জানিয়ে দিয়েছে- আসছে, আসছে... আবার তলব আসতে চলেছে। আর জানানোর পদ্ধতিটাও ভারি অদ্ভুত! কোনও ফিসফিসে কন্ঠস্বর বা গুরুগম্ভীর দৈববাণী নয়, এই আগাম সতর্কবার্তা আসে টেলিগ্রাফের মর্সকোডে। এবারও কথাটা শেঠ বদ্রীদাসের মুখ থেকে আসেনি, এসেছে তাঁর নিজের মাথার ভেতর থেকে:
"টেলিগ্রাম... টেলিগ্রাম ফ্রম আজমেঢ়... টু
আইডেন্টিফাই নানাসাহেব... "
আর কী আশ্চর্য! জানান দেবার অল্পক্ষণের মধ্যেই সত্যি সত্যিই একখানা টেলিগ্রাম এসে হাজির হয়! কেবল তাই নয়, ডক্টর উল্ফম্যানের মাথার ভেতর বসে থাকা এই অলৌকিক ঘোষকের অনুমান অভ্রান্ত, জায়গাটাও প্রতিবার ঠিক ঠিক মিলে যায়!
আজমেঢ়ের সামরিক পদাধিকারী মেজর ডেভিডসন জানিয়েছেন, দিন সাতেক আগে যুদ্ধাপরাধী নানাসাহেব সন্দেহে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে তাঁকে আইডেন্টিফাই করা নিয়ে, কারণ আজমেঢ়ে কেউই নানাসাহেবের আসল চেহারার সঙ্গে পরিচিত নয়। ডক্টর উল্ফম্যান যেহেতু পূর্বে নানাসাহেবের চিকিৎসা করেছেন, তিনি নিশ্চয়ই এই সংশয় দূর করতে পারবেন, তাই অতি সত্বর তাঁকে আজমেঢ়ে আহ্বান করা হচ্ছে। ডক্টর উল্ফম্যান যেন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্তব্যবোধে কালবিলম্ব না করে চলে আসেন, ইত্যাদি প্রভৃতি।
হুঃ! নানাসাহেব না ঘোড়ার ডিম! ডক্টর উল্ফম্যান জানেন, এবারেও সেই বুনো হাঁসের পেছনে ধাওয়া করাই সার হবে, আদত নানাসাহেবের সন্ধান এরা কোনওদিনই পাবেন না। সেই যে জেনারেল ক্লাইডের হাত এড়িয়ে নানাসাহেব নেপালে ঢুকে পড়লেন, সেই থেকেই তাঁর আর কোনও সুলুকসন্ধান নেই। ইস! যদি সেদিনই লোকটাকে ধরে ফেলা যেত, তাহলে আজ আর এই হয়রানি পোহাতে হতো না। কম্পানির সেনা তো তাঁকে রাপ্তি নদীর তীর অবধি তাড়িয়ে নিয়েও এসেছিল, তবু... ধুর ধুর! যতসব অপদার্থের দল! উল্ফম্যান সাহেব মনে মনে ফুঁসতে থাকেন।
এই নাটকের শুরু সেই মহাবিদ্রোহের পর থেকেই। বিদ্রোহের আগুন যদিও বা নেভানো গেল, আগুন লাগানোর অন্যতম হোতা নানাসাহেব যেন ভোজবাজির মতোই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। শোনা গেল, কয়েক হাজার সঙ্গীসাথী আর আটটি ধনরত্নে বোঝাই হাতি নিয়ে নানাসাহেব আশ্রয় চেয়েছেন নেপালের জঙ্গবাহাদুর রাণার কাছে। তা বেশ, রাণার সঙ্গে দর কষাকষি করে তবুও নাহয় তাঁকে ফেরত পাবার একটা আশা ছিল। সরকারি মহলে সেইরকম তৎপরতাও শুরু হয়ে থাকবে, হঠাৎ শোনা গেল- নানাসাহেব আর বেঁচে নেই! কেউ বললে ম্যালেরিয়ায় ভুগে ভুগে, আবার কারও মতে তরাইয়ের নরখাদক বাঘের হাতেই প্রাণ গিয়েছে তাঁর। মোটকথা, মৃত্যুর পদ্ধতি নিয়ে সংশয় থাকলেও, ধন্ধুপন্থ নানাসাহেব যে আর স্থূলদেহে বিদ্যমান নেই, এ ব্যাপারে সকলেই তখন একমত। এমনকি খোদ জঙ্গবাহাদুরও সরকারি ভাবে সেই কথাই জানিয়ে দিলেন।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো ইংরেজ সরকার। এতদিন প্রবল পরাক্রমশালী ব্রিটিশ সিংহের গলায় অস্বস্তিকর হাড়ের মতোই বিঁধে ছিলেন নানাসাহেব। এখন তিনি ইহলোক ত্যাগ করা মানে, মিউটিনির অভিশপ্ত অধ্যায়টিরও এখানেই পরিসমাপ্তি হলো বলা চলে। হ্যাপি এণ্ডিং! কলকাতায় একচোট অকাল ক্রিসমাস পালন হয়ে গেল।
আহা, গল্পটা যদি এখানেই শেষ করা যেত! কিন্তু না, পোড়াকপালে রিচার্ড উল্ফম্যানের ভাগ্যে অত সুখ সইবে কেন? কানপুরের এই প্রৌঢ় সিভিল সার্জেনটি নির্ঘাত গত জন্মে কোনও গুরুতর অপরাধ করেছিলেন, কারণ এরপর ইতিহাসের গতিপথ যেদিকে মোড় নিল, তা'তে তাঁর কপালে দেখা দিল অপরিসীম দুর্ভোগ।
| |
"নিরুদ্দেশ নানাসাহেবকে ঘিরিয়া এই যে নাট্যরঙ্গ, অতঃপর তাহার দ্বিতীয় অঙ্ক আরম্ভ হইল। ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত হইতে নানারকম নানাসাহেবের খবর আসিতে শুরু করায়, কলিকাতার ইংরাজ কর্তাব্যক্তিদের তখন পাগল হইবার উপক্রম। আর সরকারি কর্তারা চিরকালই 'লড়ো জওয়ান' নীতিতে বিশ্বাসী, তাঁহারা নিজেরা যত না ক্ষেপিলেন, ততধিক ক্ষেপাইয়া তুলিলেন কানপুরের এই ডাক্তারটিকে। বারোমাস পেটের অসুখে ভুগিতেন নানাসাহেব, রিচার্ড উল্ফম্যান কোনকালে একবার নানার চিকিৎসা করিয়া থাকিবেন, সেই পাপে এখন তাঁহার দৌড়বাজির অন্ত রহিল না। যখনই কোনও নানাসাহেবের গ্রেপ্তারীর খবর আসে, তখনই সনাক্তকরণের জন্য ডাক পড়ে উল্ফম্যান সাহেবের, আর তাঁহাকেও কাজকর্ম শিকেয় তুলিয়া হিল্লি-দিল্লি ছুটিয়া বেড়াইতে হয়।
ভোগান্তির শুরু হইল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী এই নগর কলিকাতায়। বিদ্রোহের পর সবে চারটি বছর অতিক্রান্ত হইয়াছে, সংবাদ আসিল, করাচীতে ধৃত এক ব্যক্তির সহিত পলাতক নানাসাহেবের মুখের অদ্ভুত মিল রহিয়াছে। ব্যাস! আর যাইবে কোথায়? জাহাজের খোপে বাঁধিয়া সেই হতভাগ্যকে আনা হইলো রাজধানীতে। লোকটি গুরুতর অসুস্থ, বড়কর্তাদের হুকুম পাইয়া ডক্টর উল্ফম্যান যখন তড়িঘড়ি ছুটিয়া আসিলেন, তখন তাহাকে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হইয়াছে। চিনিতে বিলম্ব হইল না, একঝলক দেখিয়াই উল্ফম্যান জানাইলেন, এ ব্যক্তি কদাপি নানাসাহেব হইতে পারে না। এক্ষণে ধৃতের এক আত্মীয় কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইলে, তাহার নিকট হইতে জানা গেল, এই ব্যক্তির নাম হরজী ব্রহ্মচারী। সিপাহী বিদ্রোহের সহিত কোনওরূপ সম্বন্ধ থাকা তো দূর, লোকটি করাচীর ফুটপাতে লোহালক্করের সামান্য ব্যবসা করে। শেষটায় নিঃসন্দেহ হইয়া সরকারি কর্তারা যখন হরজীকে নিষ্কৃতি দেওয়াই মনস্থ করিলেন, ততদিনে যক্ষ্মায় ভুগিয়া ভুগিয়া তাহার প্রাণবায়ু নির্গত হইয়াছে।
হরজীর ক্ষেত্রে সনাক্তকরণের প্রক্রিয়াটি যতটা সহজ হইয়াছিল, মেবারের যমুনাদাসের বেলায় কিন্তু তদ্রূপ হইল না। যমুনাদাস কানপুরে আসিয়াছিল গোয়ালিয়রের রাজা জয়াজীরাও সিন্ধিয়ার নিকট সাহায্যপ্রার্থী হইয়া, সিন্ধিয়া তাহাকে নানাসাহেব সন্দেহে ইংরেজদের হাতে ধরাইয়া দিলেন। যমুনাদাসকে প্রথমটায় দেখিয়া উল্ফম্যান সাহেবেরও ধোঁকা লাগিল। তিনি বলিলেন, মুখের গড়নে ঈষৎ মিল থাকিলেও, এই ব্যক্তিই যে নানাসাহেব, সেকথা নির্দ্বিধায় বলা কঠিন। শশ্রুগুম্ফের আধিক্যের হেতু চেহারাটি স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে না। তৎক্ষণাৎ নাপিত ডাকিয়া তাহার গোঁফ-দাড়ি কামাইয়া দেওয়া হইল, সন্দেহ নিরসনের জন্য মারাঠি বেশভূষাও পরানো হইল- তদ্যপি ডক্টর উল্ফম্যানের সন্দেহ ঘুচিল না। তখন মওব্রে টমসন নামে এক অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান সেনানী আসিয়া উপস্থিত হইলেন।"
পূর্ণচ্ছেদটা টানতেই মনটা বিরক্তিতে ভরে গেল। হাতের কলমটাকে ঠকাস করে ছুঁড়ে ফেলে, হতাশায় মাথার চুলগুলো আরেকবার খামচে ধরলেন ভূতনাথ সমাদ্দার। হ্যাঁচকা টানের চোটে আবারও একগাছি সাদা চুল পটপট করে ছিঁড়ে গেল। নাহ্! লেখাটা মোটেই দাঁড়াচ্ছে না! প্লটটা জমে উঠতে উঠতেও যেন মাঝপথে খেই হারিয়ে ফেলছে। আর হবে নাই বা কেন? তাঁর গল্পের যে প্রধান আকর্ষণ, সেই ভূতেরই তো এখনও দেখা নেই! সবচেয়ে বড় কথা, গল্পের প্রায় অর্ধেক লেখা হয়ে গেল, কার ভূত নামানো হবে, এখনও সেইটেই ঠিক করে উঠতে পারেননি ভূতনাথবাবু। লর্ড ক্যানিং- এর? পিটার ল্যানডনের? নাকি খোদ নানাসাহেবেরই? ধুর ধুর! কল্পনাশক্তির পাল্লা এরকম কুড়ি ওয়াটের হলে, লেখালেখি ছেড়ে আলুর ব্যবসায় মন দেওয়া উচিত।
ইস্কুলের ফার্স্ট বয়রা যেমন ঘড়ি ধরে পড়তে বসে, তেমনই রুটিন মেনে রোজ ঠিক সন্ধ্যে সাতটায় লোডশেডিং হচ্ছে। এদিকে লেখার কাজও ফেলে রাখলে চলে না, সম্পাদকের তাড়া আছে। ভূতনাথবাবু আজও তাই মোমবাতি জ্বেলে লিখতে বসেছিলেন। ঘন্টা দুয়েক নাগাড়ে লেখার পর এখন সেই মোমবাতি নিভু-নিভু হয়ে এসেছে। এইটাই স্টকের শেষ মোমবাতি, আধখানা গলে যাবার পরেই তাই শঙ্কুকে পাঠিয়েছিলেন মোড়ের দোকানে, নতুন এক বাণ্ডিল মোমবাতি কিনে আনতে। কিন্তু শঙ্কু ব্যাটা সেই গেছে তো গেছেই! ঘড়ির মিনিটের কাঁটা এর মধ্যে পুরো একপাক ঘুরে ফেলেছে, ভূতনাথবাবুর ভৃত্যের আর আসার নাম নেই।
খুব পাড়া বেড়ানো স্বভাব হয়েছে ব্যাটার! মনে মনে শঙ্কুকে লম্বকর্ণ, উটকামণ্ড, অলম্বুষ ইত্যাদি বলে গালাগালি দিলেন ভূতনাথবাবু। অবশ্য, এইমুহূর্তে শঙ্কুর হাজির থাকাটা তেমন জরুরী নয়, গপ্পে ভূতের আবির্ভাব এখনও হয়নি, কিন্তু হতে কতক্ষণ? দুম করে একখানা সরেস ব্রেন ওয়েভ যদি খেলে যায়, তাহলে... তাহলে একা এই অন্ধকার বাড়িতে ভূতনাথবাবুর কী হবে? আচ্ছা, জানলার পরদাটা দু'বার নড়ে উঠল না? বাইরে ওটা কী ডাকছে? কুকুর না পেঁচা?
শিরদাঁড়ার কাছটা কেমন শিরশির করছিল, একটা সিগারেট ধরিয়ে, বেলজিয়ান কাঁচের বড় আয়নাটার সামনে এসে দাঁড়ালেন ভূতনাথ সমাদ্দার। পুরু ময়লা জমেছে আয়নার কাঁচে, ভূতনাথবাবুর চেহারাটা কেমন লম্বাটে দেখাচ্ছে। নাহ্! শঙ্কুটার মাইনে কাটতেই হবে এ মাসে, ব্যাটাচ্ছেলে বড্ড ফাঁকিবাজ হয়েছে!
কিন্তু ভূত কি আজকাল এতই মহার্ঘ হয়ে উঠেছে? একখানা আস্ত সিগারেট পুড়ে ছাই হয়ে গেল, তবু মনের মতো একপিস ভূত পাওয়া গেল না? ধ্যাত্তেরি!
ভূতের ভাবনায় বড্ড বেশি মশগুল হয়ে পড়েছিলেন ভূতনাথবাবু, নইলে খেয়াল করতেন, আয়নার কাঁচে যে ছায়াটা পড়েছে, সেটা তাঁর চেয়ে নাহোক ইঞ্চি ছয়েক লম্বা। ছায়াটার মতো ইওরোপীয় ধাঁচের চওড়া কাঁধ, সাতপুরুষের খড়দানিবাসী ভূতনাথবাবুর কস্মিনকালেও ছিল না। তাঁর মুখের গড়ন মোটেই অমন চৌকো নয়, আর ছায়ার পরণে তাঁর মতো স্যাণ্ডো গেঞ্জিও নেই, দস্তুরমত সাহেবি পোশাক।
ভূতনাথবাবু এসবের কিছুই খেয়াল করেননি। যখন করলেন, ছায়াটা ততক্ষণে আয়না ছেড়ে বেরিয়ে এসে কোটের ধুলো ঝাড়তে লেগেছে।
তারপর, সেই ছায়া যখন হ্যাণ্ডশেক করার জন্য ডানহাতখানা তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিল, ভূতনাথ সমাদ্দারের পক্ষে আর সজ্ঞানে থাকা সম্ভব হলো না।
বেহুঁশ হবার আগে ভূতনাথবাবু শুনতে পেলেন, ছায়াটা বলছে, "গুড ইভনিং! আয়্যাম ডক্টর রিচার্ড উল্ফম্যান। নাইস টু মিট ইউ, বাবু!"
| |
রাজভোগ খেতে কে না ভালোবাসে? অন্তত আমাদের ভূতনাথবাবু যে খুব ভালোবাসেন, তা'তে কোনও সন্দেহ নেই। কেবল তাঁর রক্তে শর্করার মাত্রাটা একটু বেশি বলে, শঙ্কাহরণ তাঁকে চোখে-চোখে রাখে, রাজভোগের ধারেকাছে বড় একটা ঘেঁষতে দেয় না। তবুও ফাঁক পেলেই ভূতনাথ সমাদ্দার দু'একটা রাজভোগ চেখে দেখেন বইকি!
কিন্তু, রাজভোগ দেখে যতই চোখ চকচক করুক, চোখটাই যদি বিস্ময়ে গোল্লা পাকিয়ে রাজভোগের চেহারা নেয়, তাহলে দেখতে খুব একটা ভালো লাগে কি? লাগে যে না, সেটা ভূতনাথবাবু বিলক্ষণ টের পেলেন, যখন দেখলেন, একটু আগে দেখা সেই সাহেবি ছায়াটা তাঁর ডান কানের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে আসছে।
ভূতনাথবাবুকে উঠে বসতে দেখে ছায়াটা বলল, "যাক! জ্ঞান ফিরেছে তাহলে! আমি তো ভাবলাম... তোমার মাথার ভেতর ঢুকে গল্পের প্লটখানা একটু দেখে এলাম, বুঝলে? মন্দ জমাওনি, তবে... কী হলো? অমন ভ্যাবলা মেরে গেলে কেন?"
হাঙরের মতো প্রকাণ্ড হাঁ করে ছায়াটার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন ভূতনাথবাবু। এবার কোনওমতে আমতা আমতা করে বললেন, "আজ্ঞে, আপনি? মানে, আপনাকে তো ঠিক... "
-সেকি হে! একটু আগেই যে পরিচয় দিলুম! আর তাছাড়া, নিজেই তো আমাকে নিয়ে গপ্প ফেঁদেছ। এখন চিনতে না চাইলে হবে?
-তার মানে... তার মানে, আপনিই ডক্টর রিচার্ড উল্ফম্যান! যাহ্! তা কীকরে হবে?
-কেন? হবে না কেন?
-মানে, আপনি তো আর ঠিক ইয়ে নন... মানে, বাস্তব চরিত্র। আপনি হলেন গিয়ে আমার কল্পনা।
বস্তুত, এই কথাটা মনে হওয়াতেই, ভয়-ভয় ভাবটা এতক্ষণে অনেকটা কমে এসেছিল। কিন্তু এইবার ছায়াটা নাক-মুখ কুঁচকে, জিভটা বিচ্ছিরি ভাবে উল্টে আর চোখদুটো ট্যারা করে এমন একটা ভেঙচি কাটলে যে, শিরদাঁড়ায় সেই শিরশিরে ভাবটা আবার ফিরে এল।
-ইঃ! বাস্তব চরিত্র নই, কল্পনা! বললেই হলো? শোনো হে, আমার নাম রিচার্ড উল্ফম্যান, সান অফ লেট টমাস উল্ফম্যান, আদি নিবাস বার্মিংহ্যাম, জন্ম ১৮৩২, মৃত্যু... ওই দেখো! কী হলো? মৃত্যু শুনেই আবার পিলে চমকে গেল নাকি? অ্যাই অ্যাই! খবরদার, ভিরমি খাবে না বলে দিচ্ছি!
সত্যিই ভয়ানক জোরে আবার একটা ভিরমি পাচ্ছিল, বুক ভরে দম নিয়ে সেটাকে সামাল দিলেন ভূতনাথ। কিন্তু মাথার ভেতর ঘিলুগুলো যেমন তালগোল পাকিয়ে ছিল, তেমনটাই রইল, মুখে বাক্যি জোগালো না।
-কী হে! কী ভাবছো? কেমন করে হলো, তাই তো? বলি, টেলিওলজি মানে বোঝো?
ভূতের মুখে টেলিওলজি! ভূতনাথবাবু আবার সেইরকম প্রকাণ্ড মুখব্যাদান করতে যাচ্ছিলেন, রিচার্ড উল্ফম্যানের ভূত খপ করে মুখটা চেপে ধরল।
-এসবই হচ্ছে টেলিওলজির খেলা, বুঝলে? নানাসাহেবের অন্তর্ধান নিয়ে তুমি একখানা গপ্প ফেঁদে বসবে, আর তার মুখ্য চরিত্র করবে আমাকেই, তাই এক অদৃশ্য টেলিওলজিকাল শক্তির টানে আমি এই ঘটনার জালে জড়িয়ে পড়ি। নইলে ভাবো, নানাসাহেবকে চাক্ষুষ দেখেছে, এমন লোকের অভাব ছিল নাকি? কানপুরেরই আরেক ডাক্তার রেমণ্ড হিক আমার থেকেও বেশিদিন ধরে নানার চিকিৎসা করেছে। লখনৌয়ের মেজর ব্রুকস ছিলেন, পেইন্টার হিগিন্স... কই তাঁদের তো ডাকলে না! যত নাকাল হতে হলো এই আমাকেই! উফফ্! কী হয়রানিটাই না গেছে! এখন অবিশ্যি বুঝতে পারছি, তুমি কিস্যু না বুঝেই আমার নামখানা ব্যবহার করেছ। ইচ্ছাকৃত হলে, তোমার ঘাড়টি আজ মটকে রেখে যেতাম।
বারেবারে ভিরমি দমন করাটা ক্রমশ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে। ভূতনাথবাবু প্রাণপণে চেপে গিয়ে কেবল বললেন, "অ্যাঁ!"
-ইয়েস বাবু, ইউ কজড মি আ লট অফ ট্রাবল থ্রু ইওর টেলিওলজিকাল ফোর্স।
-কিন্তু... কিন্তু স্যার, আমার-আপনার মাঝে যে বিস্তর সময়ের ব্যবধান। প্রায় দেড়শো বছর! এতদূর থেকে কি...
লোকটা, থুড়ি, ভূতটা এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। "লিসন বাবু, তোমরা জ্যান্ত লোকেরা সময়ের রহস্য কিছুই অনুধাবন করতে পারো না। তোমরা মনে করো টাইম জিনিসটা লিনিয়ার, অ্যাজ সিম্পল অ্যাজ আ স্ট্রেট লাইন। তারপর, নিজেদের সুবিধামতো তাকে ভূত, বর্তমান আর ভবিষ্যতে ভাগ করে নাও। দ্যাটস রাবিশ! সময় আসলে কীরকম জানো? মনে করো একটা জটপাকানো সুতোর বল, তুমি এই সেঞ্চুরিতে বসে, সেই গোলার একপ্রান্তের সুতো ধরে টান মেরেছ, আর সেই টানে নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরির আমি সারাজীবন মাথার মধ্যে মর্সকোড শুনে মরেছি। গট ইট?
| |
-হুঁ... তা, কোথায় যেন ছিলে?
-আজ্ঞে, মেবার। মওব্রে টমসন।
-আরে ছো ছো! ওটি একটি মর্কট। দেখেটেখে বললে, মুখের বাঁদিকটা নানাসাহেবের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে বটে, কিন্তু ডানদিকটা এক্কেবারে আলাদা। বোঝো!
-তারপর?
-বিঠুরের আপ্টেদের সঙ্গে নানাসাহেবের কুটুম্বিতা ছিল। শেষটায় আপ্টে বুড়োই চিনতে পারলো, "আরে, ই তো যমনাদাস হ্যায়! যমনাদাস নানাসাহেব কবসে বন গয়া?"
-অতএব বাতিল?
-বাতিল। এরপরের ডাক এলো আজমেঢ় থেকে। সে গল্প তো তুমি ইতিমধ্যেই লিখে ফেলেছ। মিথ্যে দৌড় করানোর জন্য মেজর ডেভিডসনকে কষে ধমক দিয়েছিলাম।
-বেশ! তারপর?
-দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেল। এর মধ্যে নিদেনপক্ষে কয়েক হাজার নানাসাহেবের খবর ভেসে উঠেছে। আর বলাবাহুল্য, প্রতিবারই আইডেন্টিফিকেশনের জন্য ডাক পড়েছে এই শর্মার। বাপরে বাপ! খুব একচোট দৌড়ঝাঁপ গেছে সেই সময়।
শেষটায়, ওই আঠারোশো পঁচাশি সালের পর থেকে, এই ভুয়ো খবরের স্রোতে যেন একটু ভাটা পড়লো। সরকারের ওপরতলাতেও বোধহয় একটু গা-ছাড়া ভাব এসে থাকবে, কারণ আমার কাছে ঘনঘন টেলিগ্রাম আসাটাও বন্ধ হলো। আর হবে নাই বা কেন? নিঃসম্বল নানাসাহেবের পক্ষে এতদিন লুকিয়ে থাকা অসম্ভব, তাঁর মৃত্যুর খবরটাকেই এবার সত্যি বলে ধরে নিতে হয়। আর যদি বা তিনি কপালজোরে বেঁচেও থাকেন, তা থাকুন না! অন্তত যতদিন না নতুন কোনও উৎপাত করছেন, তদ্দিন তাঁকে নিয়ে বিশেষ দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
আমি শেষ টেলিগ্রামটা পাই ছিয়াশি সালে। তারপর, ধন্ধুপন্থ নানাসাহেবের রহস্যজনক অন্তর্ধান মামলা একরকম তামাদিই হয়ে গেল।
বিয়ে বাড়ির ভোজে পোলাও-কালিয়ার পরেই কাউকে ঘাড় ধরে তুলে দিলে তার মনের অবস্থাটা যেরকম দাঁড়ায়, ভূতনাথবাবুর হালও কতকটা সেইরকম। অন্তরে গভীর অতৃপ্তি নিয়ে তিনি তাকিয়ে ছিলেন উল্ফম্যানের প্রেতাত্মার দিকে। তাঁর মন বলছিল, এই গল্পের এখানেই সমাপ্তি নয়, দই-মিষ্টি থেকে পান অবধি সবই এখনও বাকি। তাঁর মনের কথাটা পড়ে ফেলেই বোধহয় সাহেব-ভূত একটু হাসলো:
-হোয়াট, বাবু? গল্পের এরকম পানসে ফিনিশিং বুঝি তোমার পছন্দ হলো না?
-হে হে... মানে, বুঝতেই তো পারছেন, স্যার! আমি লেখক মানুষ, ক্লাইম্যাক্সটা তেমন তেমন না হলে...
-হুঁ... আই আণ্ডারস্ট্যাণ্ড! বাট, ইউ গেসড ইট রাইট, গল্প এখনও ফুরোয়নি। তবে, এরপর যা বলব, তা একান্তই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। কোনও সরকারি নথিতে এসবের উল্লেখ নেই, নো হিস্টোরিয়ান এভার ডকুমেন্টেড ইট।
-বেশ, বলুন।
-নাইন্টি টু কি থ্রি হবে, একদিন কানপুরে আমার চেম্বারে বসে রোগী দেখছি, একটি অল্পবয়সী যুবককে গুটিকয় লোক মিলে ধরাধরি করে নিয়ে এলো। একনজর দেখেই বুঝলাম, ছোকরা অপ্রকৃতিস্থ। ঘোলাটে চোখ, ফ্যালফ্যালে চাহনি। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কী যেন দেখে, আর থেকে থেকেই উন্মাদের মতো চেঁচিয়ে ওঠে, "ওই, ওই আবার এসেছে! আবার এসেছে লোকটা!"
বুঝলাম, ভাগ্যের নিদারুণ মারে ছেলেটি এই কাঁচা বয়সেই মস্তিষ্কের সুস্থতা হারিয়েছে। তখনকার দিনে, মাথার ব্যারামের তেমন কোনও চিকিৎসা ছিল না। তবুও তার সঙ্গের লোকেদের বললাম, কিছুদিনের জন্য আমার কাছে রেখে যেতে। এসব ক্ষেত্রে রোগীর সঙ্গে আন্তরিক ভাবে কথা বললেও অনেক ফল হয়।
ছেলেটি টানা একমাস ছিল আমার কাছে। রোজ দুঘন্টা করে চলত তার কাউন্সেলিং। আর এই পর্বেই, ছোকরার বিচিত্র অভিজ্ঞতার যে বয়ান তার মুখে শুনেছিলাম, তা'তে ভুলতে বসা নানাসাহেবের অধ্যায়টি যেন নতুন করে খুলে গেছিল আমার চোখের সামনে।
-এই ছেলেটা কে স্যার? কী নাম?
-পরিচয় জানতে চাও? ছেলেটি আমার স্বজাতি, নাম- পিটার ল্যানডন।
| |
পিটার ল্যানডন যখন ছোট্টটি, তখন প্রতিরাতেই ঘুমের ঘোরে মজার মজার স্বপ্ন দেখতেন। ড্রাগনের পিঠে চড়ে দূর দেশে পাড়ি দেবার স্বপ্ন, দুর্গের মধ্যে দৈত্যের সঙ্গে যুদ্ধ করার স্বপ্ন... আরও কত কী! আর সেইসব মজাদার স্বপ্নের আবেশে, ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরতে গিয়ে, হামেশাই ছিটকে পড়তেন বিছানা থেকে। তখন সে কি যন্ত্রনা, বাপরে বাপ!
ঠিক একইরকম অনুভূতি হলো, তাঁর পাঠানো তারের উত্তর কলকাতা থেকে এসে পৌঁছনোর পর। না, এবার আর টেলিগ্রাম নয়, সরকারি সিলমোহর দেওয়া নাতিদীর্ঘ একটি চিঠি। কাঁপা-কাঁপা হাত আর দুরুদুরু বুক নিয়ে চিঠিটা খুলেছিলেন ল্যানডন। পুরস্কার যে তিনি পাচ্ছেনই, সে বিষয়ে অবশ্য সন্দেহের লেশমাত্রও ছিল না। মনের মধ্যে আশা-নিরাশার যেটুকু দোলাচল, তা কেবল পুরস্কারের রকম আর পরিমাণ ঘিরে।
মাথায় একশোটা বাজ একসঙ্গে আছড়ে পড়লেও বোধকরি পিটার ল্যানডন এতখানি হতবাক হতেন না, যতটা হলেন এই চিঠিটা পড়ে। ইম্পিরিয়াল গভর্নমেন্ট অফ ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ার পক্ষ থেকে এক উচ্চপদস্থ আমলা মিস্টার প্যাটারসন লিখেছেন:
"ডিয়ার মিস্টার ল্যানডন, দিস ইজ টু ইনফর্ম ইউ দ্যাট দ্যা গভর্নমেন্ট ইজ নট ইন্টারেস্টেড অ্যাবাউট নানাসাহেব এনি মোর। আফটার ইনভেস্টিগেটিং মোর দ্যান আ থাউজ্যাণ্ড রিউমারস রিগার্ডিং নানাসাহেব ইন দ্যা পাস্ট টু ডেকেইডস, উই হ্যাভ রিচড আ কনসেনশাস দ্যাট দি অ্যাবস্কণ্ডিং রেবেল ইজ নো লঙ্গার অ্যালাইভ।
ইউ মে রিলিজ ইওর ক্যাপটিভ নাউ।
থ্যাঙ্কিং ইউ... "
মানে? এই লোক নানাসাহেব নয়? একে ছেড়ে দিতে হবে? উফফ্! এই অপদার্থ আমলাগুলো নিজেদের ভেবেছেটা কী? আবার একখানা 'পুনশ্চ' জুড়ে দিয়েছে, 'ভবিষ্যতে এই ধরণের ছেলেমানুষি আর বরদাস্ত করা হবে না।' বটে! পদের গরমে ধরাকে সরা জ্ঞান করা এই হামবাগগুলোর চাইতে ঢের ভালো ভাবে জানেন পিটার ল্যানডন, কাঠমাণ্ডুর রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো পাগলটা নানাসাহেব না হয়ে যায় না।
প্রথম রাতে এই পাগল যখন জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করছিল, তখন এই মাথামোটা আমলাগুলো তার কথা শুনতে আসেনি। কিন্তু ল্যানডন শুনেছেন, নিজের কানে শুনেছেন। আর সেইদিন থেকেই তাঁর ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে- এই পাগলই পলাতক নানাসাহেব।
"বিঠুর... বিঠুর... আমি বিঠুরের নানাসাহেব, ধন্ধুপন্থ নানাসাহেব... ইংরেজ... ইংরেজ আমার পেশোয়াই কেড়ে নিয়েছে, জঙ্গবাহাদুর রাণা ঠকিয়েছে আমায়... বদলা চাই, বদলা... প্রতিশোধ "
আর কেবল এটুকুই নয়, পাগলটার আচ্ছন্ন চেতনা একের পর এক আবৃত্তি করে যাচ্ছিল বিদ্রোহের টুকরো টুকরো ঘটনা। এত খুঁটিনাটি, এত নিখুঁত বর্ণনা আর কার পক্ষে দেওয়া সম্ভব?
আর এই মূর্খের দল কিনা তাকেই ছেড়ে দিতে বলে? অসম্ভব! দরকারে গভর্নরকে পত্রাঘাত করবেন ল্যানডন, তা'তেও না হলে দরবার করবেন খোদ মহারাণীর কাছে, কিন্তু এত সহজে হাল ছাড়বেন না।
নাহ্! পুরস্কারটা ফস্কে যাবার শোকে একটু বেশিই জেদ দেখিয়ে ফেলেছিলেন ল্যানডন। তাঁর সেই জেদ কিন্তু ধোপে টিকল না। নেপালের রাণা বিনা বিচারে কাউকে গারদে আটকে রাখার ঘোর বিরোধী, জানাজানি হলে চাকরি যাবে ল্যানডন সাহেবের। অগত্যা, তেতোমুখ করে হলেও সেই পাগলকে একদিন মুক্তি দিতেই হলো।
যাবার সময়, একটা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে পাগলটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন সাহেব। পাশে দাঁড়ানো মদন তামাং-এর মুখ ভাবলেশহীন, গভীর মনোযোগ সহযোগে ছাদের ফাটল দেখতে ব্যস্ত। পাগলের অবশ্য এসব কিছুতেই কোনও হেলদোল নেই, দিব্যি গুটিগুটি পায়ে রওনা দিল লকআপ ছেড়ে। যেতে যেতে ল্যানডন সাহেবের সামনে এসে হঠাৎ একবার থমকে দাঁড়ালো, তারপর তার শতচ্ছিন্ন জামাটার কোনও গোপন প্রকোষ্ঠ থেকে কী যেন একটা বের করে, ছুঁড়ে দিল সাহেবের দিকে। আর তার পরেই, এক দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল থানা ছেড়ে।
জিনিসটা কুড়িয়ে নিয়ে আলোর সামনে ধরলেন ল্যানডন। প্রথমটায় চিনতে পারেননি, পশুপতিনাথ মন্দিরের সামনে বসা বুড়ো দোকানদারটার কাছে নিয়ে যেতে যখন ব্যাপারটা খোলসা হলো, তখন কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
সেটা আর কিছুই নয়, নানাসাহেবের পিতা দ্বিতীয় বাজীরাও-এর আমলে নাগপুরের ট্যাঁকশালে তৈরি তামার কয়েন।
| |
রোব্বারের অলস সকালটা ভূতনাথবাবুর কাটছিল খবরের কাগজের পাতা উল্টে। তাঁর নতুন উপন্যাস 'সন্ধানে ধন্দায়' ছেপে বেরোনোমাত্র হইচই ফেলে দিয়েছে। প্রায় প্রত্যেকটি দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সমালোচকরাই তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কেউ কেউ তো একধাপ এগিয়ে একে সর্বকালের সেরা ঐতিহাসিক উপন্যাস অবধি বলে দিয়েছেন।
এহেন সাফল্যের পর যেকোনও সাহিত্যিকেরই উচ্ছ্বসিত হওয়া সাজে, এমনকি মনে একটু অহঙ্কারের ভাব দেখা দেওয়াও কিছু বিচিত্র নয়। কিন্তু ভূতনাথ সমাদ্দার যেন ঠিক খুশি হতে পারছিলেন না। সবকটা সমালোচনা আদ্যপান্ত পড়ে দেখেও তাঁর মুখে হাসি ফুটলো না, ভুরুদুটো যেমন কুঁচকে দ্বিতীয় বন্ধনীর মতো হয়ে ছিল, তেমনই রয়ে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে পড়তে যাচ্ছিলেন, এমন সময় মোবাইল ফোনটা আর্তনাদ করে উঠে জানান দিলে, 'কালের কলমচি' পত্রিকার সম্পাদক সর্বেশ্বর সরখেল তাঁকে স্মরণ করেছেন।
গম্ভীর স্বরে বলা 'হ্যালো'র উত্তরে রসিক হায়নার মতোই এক রাউন্ড হেসে নিলেন সরখেল:
-হে হে, প্রাতঃপ্রণাম সমাদ্দারমশাই, প্রাতঃপ্রণাম! নতুন নভেলখানা তো জব্বর নামিয়েছেন, স্যার! গতকালই হাতে পেলাম, উফফ! এক্কেবারে ফাস্টোকেলাস!
-হুঁ!
-তা, এত চমৎকার লেখাটা ওদেরই দিলেন তাহলে? ওই 'দৈনিক দামামা'কে?
-উঁ! হুঁ... তেমনটাই কথা দেওয়া ছিল।
-সে তো বটেই, সে তো বটেই! কথা দিলে তো কথা রাখতেই হয়। তা, বলছিলাম কী স্যার, মানে, হে হে... পঁচিশে বৈশাখ তো এসে পড়লো বলে, এইবেলা একটা পাকা কথা যদি এদিকেও দিতেন... আচ্ছা, মরণোত্তর রবীন্দ্রনাথকে নিয়েই তো একখানা জম্পেশ উপন্যাস হতে পারে, তাই না স্যার? মানে ধরুন, পদ্মার বুকে ভাসমান ভুতুড়ে নৌকো, তা'তে ভাসমান কবিগুরুর ভূত...
-সরি সর্বেশ্বরবাবু, আমি কল্প-ইতিহাস লেখা ছেড়ে দিয়েছি। অন্য কিছু ভাবুন।
-অ্যাঁ!
-বললাম, দু'রকম ভূত মিশিয়ে গাঁজাখুরি গপ্প লেখা আমি ছেড়ে দিয়েছি। ওসব আর পারব না।
-সেকি স্যার? আপনি হচ্ছেন দ্যা গ্রেট ভূতনাথ সমাদ্দার, ভূতের গল্পের মুকুটহীন সম্রাট, আর আপনি বলছেন-
-ধ্যার মশাই! ভূতের কী বোঝেন আপনি? নিজের চোখে ভূত দেখেছেন কখনও? গপ্প শুনেছেন সেই ভূতের মুখে? তা নয়, 'মুকুটহীন সম্রাট!' ফুঃ!
-কিন্তু... কিন্তু স্যার, ভূতের কথা নাহয় বাদই দিলাম, তাবলে ইতিহাস...
-ইতিহাস? ইউ মিন অতীত? আচ্ছা, যদি বলি সময় জিনিসটা মোটেই সরলরৈখিক নয়, প্যাঁচে প্যাঁচে প্যাঁচালো সুতোর গোলার মতো, বুঝবেন কিছু? ঘটে ঢুকবে আপনার?
-অ্যাঁ!
-হ্যাঁ। ওসব মতলব, বাজে মতলব রাখুন, বুঝেছেন? তার চেয়ে... শুনুন মশাই, একটা ফ্যান্টাস্টিক রম্যরচনা মাথায় আছে, নেবেন নাকি? কী হলো? ও মশাই...
অসাধারণ! খুব ভালো লাগল!
ReplyDeleteঅনবদ্য। অসাধারণ।
ReplyDeleteঐতিহাসিক উপন্যাস লেখা ছাড়লে চলবে কেন ! ইতিহাস আর ভূত দুয়ের কম্বিনেশনটা যে বড় স্বাদু তাতো এইমাত্র বুঝে উঠেই কমেন্ট বক্সে এলাম I
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো!! ভূতনাথ মশাইয়ের কলম দীর্ঘজীবী হোক!!
ReplyDelete