0

বইঘর - গ্রন্থকীট

Posted in


বইঘর


বইয়ের খবর
গ্রন্থকীট



                                                                    বই : আমার রাত্রিসুখ 
লেখক : সরিৎ চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশক : সৃষ্টিসুখ 
বিনিময় মূল্য : ১২৫ টাকা 


কুড়িটি নানা স্বাদের ছোট বড় গল্পের এই সংকলনটির প্রথম গুণ এর সুখ পাঠ্যতা। তরতরে ভাষা পাঠককে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ধরে রাখে। এই বইটি পাঠ করার পর গ্রন্থকীটের মনে হয়েছে থ্রিলার ধর্মী কাহিনী রচনায় লেখক সিদ্ধ। 'পরিশোধ' গল্পটির কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে চাই আমরা। উল্লেখ করতে চাই 'টিল ডেথ ডু আস পার্ট' গল্পটির কথাও। অনায়াস দক্ষতায় কয়েকটি নিপুণ আঁচড়ে অ্যালান পোর বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন কাহিনীকার। আমরা মুগ্ধ হয়েছি প্রথম গল্পটি পড়ে। এই গল্পের নামেই বইয়ের নাম। বাঙালী বলতে লেখক যা বোঝেন তার নির্যাস এই কাহিনীটি। আমরা সব খুইয়েছি তবু, 

কারা যেন শব্দ হয়ে আমার 
কানে কানে বলেছে, কথা আছে
আমার সারাটা দিনের ক্লান্তি 
আমার রাত্রিসুখ, বেঁচে আছে। 

'একটি তবায়েফের সাক্ষাতকার' কাহিনীটিও উল্লেখযোগ্য মনে করি আমরা। পড়ে দেখলাম এই ছোট গল্পটি আসলে ঋতবাক থেকে প্রকাশিত 'দিলনাজ' উপন্যাসের বীজ। লেখকের নিজের আঁকা প্রচ্ছদটিও মনকাড়া। সব মিলিয়ে পাঠকের বইঘরে স্থায়ী আসন দাবী করতে পারে 'আমার রাত্রিসুখ।'


#

বই : আমার কীরাম জানি লাগে
কবি : প্রান্ত পলাশ 
প্রকাশক : চৈতন্য
বিনিময় মূল্য : ১৪০ টাকা


চর্যাগীতি'র ভুসুকুর প্রথম গানটা মনে আছে? সেই যে

[কায় হরিণী] মেলি অচ্ছহু কীস
বেটিল হাক পড়অ চৌদীস
অপণা মাংসেঁ হরিণা বৈরী
খনহ ন ছাড়অ ভুকু অহেরি।
তিন চ্ছুপই হরিণা পিবই ন পাণী 
হরিণা হরিণির নিলঅ ণ জাণী।
হরিণী বোলঅ "হরিণা সুণ হরিআ তো
এ বণ চ্ছাড়ী হোহু ভান্তো।
তরঙ্গন্তে হরিণার খুর ন দীসঅ
ভুসুকু ভণই মূটা হিঅহি ণ পইসঈ।।

অতি সম্প্রতি এর এক অনুবাদ চোখে পড়েছে গ্রন্থকীটের। অনুবাদও নয় ঠিক। এক জটিল, বহুমাত্রিক সৃজন। 

কারিই বা বুকি ধরি, কারিই বা দি ছাইড়ে?
এত আবাজ চাদ্দিকি, আর কিছু যে নাই রে! 
নিজির গোশের জন্যি, শালা, হরিণই শত্তুর
একবার বাগে পালি আহা ছাড়ে না রাজপুত্তুর!
দুঃখে হরিণ ঘাস খালে না, না খালে সে পানি
কোন দ্যাশে ও লো সখা সেই হরিণের রানি?
রানি কচ্ছে, 'ও পাগল, বাড়াই দে না ঠোঁট,
চিরতরে ছাইড়ে দে বন, এক্ষুনি যা, ফোট!'
শুনে হরিণ ছুটতি থাকে, যায় না দেখা পা
বুঝলি ভালো ভুসুকু তত্ত্ব, না বুঝলি যাহ! (ভুসুকুর গান)

হাজার বছরের পুরোনো বাঙলা আর একেবারে হালের বাংলাদেশের কথ্য বাংলার সংলাপ এই কবিতায় ভাষা বুঝে নিচ্ছে তার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। শালীন / অশালীনের আড়াআড়িকে থোড়াই কেয়ার করে স্বভাব নির্মল শব্দ জানিয়ে দিচ্ছে যে কবিতা আসলে এক ভাষা সৌধ। এই আদ্যন্ত স্মার্ট, নাগরিক এবং সেল্ফ রিফ্লেকসিভ্ নির্মাণের মধ্য দিয়ে তরুণ বাংলাদেশী কবি প্রান্ত পলাশ বুঝিয়ে দিচ্ছেন কী অসীম শক্তি ধরে তাঁর লেখনী।

কবি তাঁর উত্তরঔপনিবেশিক অবস্থানের স্বরূপ স্পষ্ট বুঝতে পারেন। তাই তিনি বলে ওঠেন 

তুমি দ্যাশে আছ নিকি, নাইকা নাইকা
থাকিলে বুঝিতে, ক্যামনে বাঙালিপাখি
উড়িয়া উড়িয়া যায়

আমার চোখির মদ্যি ঘুণগুঁড়ি পড়ে
চোখ কচলাই, মুখ কচলাই, সব লাল দেখি
প্যাট থিকা পইড়েই খালি শুনতিছি
বাঙাল - বীরত্বগাথা, বিটিশ পাকিরে...

ওগো রাই তুমি কও, আমি আন্ধা নিকি
আমার চোখির সামনি এত্ত বড় ফাঁকি! 

ওগো রাই ওগো রাই কনে গেলা কনে
আমারে কান্দন দাও বুক - মাঝখানে। (ওগো রাই)

এই কান্নাই ডিসপ্লেসমেন্ট্ আর এলিয়েনেশনকে যাপনের বহুস্তরে নিরিখ করে রাগ - ঘেন্না মিশে বিদ্রূপ হয়ে ফেটে পড়ে 

আমার কীরাম জানি লাগে; ও মা, মাগো
যেদিকি রাখিচ্ছি পা পাসপোর্ট কয় ভাগো
ভ্রমি নিজ দ্যাশে, ভ্রমি দ্যাশে - দ্যাশে 
আমিও হতিছি মা চ্যাতবোধ ছাড়া 
দেখিলে কিশোরী চাঁদ হই যাচ্ছে খাড়া...

শ্রীরাম শ্রীরাম, মোরে মারি ফ্যালো
আকাশের থিকা ফ্যালো বাজ,
অখন পণ্যের তুমি
একদিন হবা মাগিবাজ! (আমার কীরাম জানি লাগে)। 

প্রান্ত পলাশ আদ্যন্ত আধুনিক কবি। এতটাই আধুনিক যে তিনি জানেন ভাষায় গড়া অস্তিত্ব আর জীবন চর্যার ক্ষণিকতা। বহতা ভাষা কাউকে অমরত্ব দান করে না। দান করে পঠন, বিবিধ বয়ান যা আবার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক নির্ধারকের অধীন। এই মহাবিশ্বও তিলে তিলে মরছে। বনের মর্মরধ্বনি আর নক্ষত্রের মৃত্যু মহাকালের প্রেক্ষায় সমার্থক। তবুও, চেতনায়, মননে আজও শ্রী আর কল্যাণ বোধ আছে মানুষের। সেটা হয়তো রয়ে যেতেও পারে

তারার বর্ণালি ছুঁড়ে রেখে যাওয়া অপুষ্ট ইঙ্গিতে 
বেজে ওঠে শ্রীকল্যাণ, দুলে ওঠে উপকূলে ঘর

কবির মৃত্যু আছে, আছে কবিতারও ---- নক্ষত্রমর্মর (নক্ষত্রমর্মর)

এ কবিকে আমরা বলতে চাই এতদিন কোথায় ছিলেন? বইটির অঙ্গ সৌষ্ঠব দেখার মতো। সবার ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা উচিত এই কবিতার বই। বারবার পড়ার জন্য।




বই : এক পৃথিবীর ছবি
কবি : সুজাতা চৌধুরী 
প্রকাশক : মনফকিরা 
বিনিময় মূল্য : ৯০ টাকা 


এই কবিতার বইটি অতি দৃষ্টিনন্দন। হাতে নিলেই পড়তে ইচ্ছে হয়। পাতা ওল্টালে চোখে পড়ে ছত্রে ছত্রে এক রোমান্টিক কবিমনের প্রকাশ। গ্রন্থকীটের ভালো লাগে এই মরমী উচ্চারণ 

আমি বৃষ্টি হতে চাই
যার জন্য পৃথিবী 
জন্মের পর জন্ম --
জন্মের পর জন্ম -- অপেক্ষা করে। 

ভাল লাগে যখন কবি বলেন 

শরীরটা তোর সত্যি শুধু 
মনের কথা ভুলিস। 
সাবধানে তুই চলিস 

বা 

আমার কাছেই রঙের বাক্স
আছে রঙ আর তুলি 
জারুল রঙের বিষণ্ণ প্রেমের 
ছবিটুকু এঁকে রাখি

অথবা

সৃষ্টির বীজে পৃথিবীকে 
পূর্ণ করেও নদী বড় উদাসীন
বড় মোহহীন বয়ে যায়। 

সব মিলিয়ে বইটি বেশ।

0 comments: