0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক


জলরেখা 
নন্দিনী সেনগুপ্ত


১৯ 

‘হ্যাঁ গো ঠাম্মা, এই শাড়ি, এইরকম শাড়ি পরেই যেতে হবে।’ নীরু হাত বোলায় লাল পাড় সাদা তাঁতের শাড়িটায়।

‘দ্যাখ বাপু। সে তো আমার লাল পাড় সাদা গরদটাও আছে, ওইটাও পরে যেতে পারিস।’ এষা আলমারির পাল্লা খুলে উবু হয়ে বসেন। 

‘না, না, অত দামী শাড়ি বের কোর না ঠাম্মা। এইটেই ঠিক আছে।’ নীরু আঁতকে ওঠে।

এষা হেসে ফেলেন নীরুর রকমসকম দেখে। বলেন, ‘তোকে কে বলল যে গরদ বেশি দামী শাড়ি? আর এই শাড়ি তুলে রেখে দিয়ে হবেই বা কি? আমি ত হাল্কা ছাপা শাড়ি ছাড়া কিচ্ছুটি গায়ে ঠেকাতে পারি না। তুই পরলে তাও ও শাড়ি সদ্ব্যবহার হবে। নইলে কোনদিন দেখব আলমারিতে পড়ে থেকে থেকে ভাঁজে ভাঁজে ফেটে গেছে।’

নীরু অবাক হয়, ‘ওরকম হয় নাকি ঠাম্মা? পড়ে থাকতে থাকতে আপনাআপনি শাড়ি ভাঁজে ভাঁজে ফেটে যায়?’

এষা ঘাড় নাড়েন, ‘হয় রে হয়। ব্যবহার না হলে, নাড়া চাড়া না পড়লে মানুষে মানুষে সম্পর্ক অবধি নষ্ট হয়ে যায়, কেটে যায়, ছিঁড়ে যায় বাঁধন, আর এ তো জড়পদার্থ! ব্যবহার না হলে সে ঠিকঠাক থাকবে কি করে বল?’ 

‘কিন্তু ঠাম্মা, আমি ত শাড়ি ঠিকভাবে সামলাতে পারি না। তোমার অত সুন্দর গরদ, যদি ধুলোময়লা লেগে নোংরা হয়?’ বেজার মুখ করে নীরু। 

‘হলে হবে। যতই দামী হোক শাড়ি, তোর থেকে তো আর বেশি নয় তার দাম।’ কেটে কেটে বলেন এষা। নিচু হয়ে বের করে আনেন লালপাড়ে জরির সুতো টানা সাদা জমির মসৃণ গরদখানা।... ‘নে বাপু, মিটল ত শাড়ির ঝামেলা। এখন চল দেখি ব্লাউজ, পেটিকোট কি আছে তোর মাপের। নইলে আজ সন্ধেবেলায় কিনতে যেতে হবে।’ এষা উঠে বসেন খাটে। ‘যা নিয়ে আয় দেখি ওই আলনায় আমার লাল ব্লাউজ দুটো আছে। যদি হাত আর বডিটা একটু ছোট করে সেলাই করে দিই, মনে হয় তোর হয়ে যাবে।’ নীরু হাত নাড়ে... ‘না ঠাম্মা, লাল ব্লাউজ তো পরতে বলেনি মিস। বলেছে ইস্কুলের ইউনিফর্মের যে স্কার্ট ব্লাউজ, সেই সাদা ব্লাউজের উপরেই শাড়ি পরে যেতে ফাংশানের সময়।’ 

এষা একটু অবাক হন। ‘সত্যি রে নীরু, যেমনি তুই, তেমনি তোর ইস্কুলের দিদিমণি! কি উদ্ভট দেখাবে রে তোদের। ওইরকম শার্টের কলারওয়ালা ব্লাউজের উপর শাড়ি পরে কেউ?’ 

নীরু হাসে, ‘না গো ঠাম্মা! মিস নিজেও তো অমন পরেন।’ 

‘অ্যাঁ? বলিস কি?’ এষা জোরে জোরে হেসে ওঠেন... ‘তোদের দিদিমণিও ওইরকম কলারওয়ালা শার্টের মতো ব্লাউজ পরেন শাড়ির সঙ্গে?’ 

‘হেসো না ঠাম্মা’... নীরু চুপ করাবার ভঙ্গীতে আঙুল রাখে ঠোঁটে। ‘যা দাপট না নীলিমা মিসের! গোটা ইস্কুল কাঁপে। বিদেশ থেকে পড়াশুনা করে এসেছে। বিয়ে করেনি। ইস্কুল তার ধ্যানজ্ঞান সব। ইংরেজি উচ্চারণ যা সুন্দর, কি বলব! একদম সায়েবদের মতো। ওইরকম শার্টের মতো ফুলহাতা ব্লাউজের সঙ্গে কড়া মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করা শাড়ি পরে। একদম পাটে পাটে ভাঁজ করা কাঁধের আঁচল একটা রূপালী ব্রোচ দিয়ে আটকায়। চুলে টাইট করে ক্লিপ, কাঁটা আর নেট দিয়ে একটা খোঁপা করে আসে রোজ। হাঁটে একদম গটগট করে। পা ঢাকা পাম্পশু পরে সবসময়। শীত গ্রীষ্ম বারোমাস। কখনও চটি ফটফট করে হাঁটে না। দেখলে বুঝবে। সব্বাই ভয়ে মরে।’ 

এষা চোখ বড় বড় করেন, ‘তাই বুঝি? তাহলে তো তোর নীলিমা মিসকে একবার দেখতেই হচ্ছে।’ 

‘কেন, কেন? আমি বুঝি দুষ্টু মেয়ে? সে তো যারা দুষ্টু মেয়ে তাদের বাড়ি থেকে গার্জেন কল হয়।’... রেগে ওঠে নীরু। ‘আমার কেন হবে?’

‘আহাহা, চটিস কেন? শুধু কি দুষ্টু মেয়েদের গার্জেনরাই দেখা করতে যায়? ভালো মেয়েদের গার্জেনরা কি এমনি এমনি যেতে পারেনা? তুইই তো বললি যে তোর নীলিমা মিস নাকি দেখবার মতো। সেইজন্য তো আমি দেখতে যেতে চাইলাম। আর অমনি দোষ হলো? নাহ... তোরও মনে হয় ওই নীলিমা মিসের মতোই মেজাজ হয়ে যাচ্ছে।’... মুখ টিপে হাসেন এষা... ‘তবে হ্যাঁ, আমি ত আবার চটি ফটফট করেই হাঁটি। দেখিস বাপু, তোদের ইস্কুলে আমাকে ঢুকতে দেবে তো?’ 

‘যাও আমি জানি না। আমি বুঝি তাই বলেছি?’ মুখ গোমড়া করে নীরু। 

‘ওরে বাবা, এইটুকুতে মেয়ের রাগ হলো। এখন ভাব দেখি এখানে নয়ন থাকলে তো তোর নীলিমা মিসকে নিয়ে কতকিছু বলতে শুরু করত, তখন কোথায় যেতিস শুনি?’ এষা কৌতুকপূর্ণ স্বরে বলেন। 

‘হ্যাঁ গো ঠাম্মা। দাদা থাকলে দাদাকে নীলিমা মিস নয়, আমাদের সংস্কৃত পড়ান যিনি সেই লেখা মিসের কথা বলতাম।’... মুহূর্তে রাগ ভুলে ফিক করে হাসে নীরু। 

‘লেখা মিস? তিনি আবার কি করেছেন?’ প্রশ্ন করেন এষা।

‘জানো ঠাম্মা, লেখা মিস হচ্ছেন নীলিমা মিসের একদম উলটো।’ 

‘উলটো? কিরকম শুনি?’

‘মানে ওই যে ... স্কুলে কেমন যেন ন্যাতানো শাড়ি পরে আসে। চুল ঠিকমত বাঁধেনা। চশমা ভুলে যায় সবসময়। চটি ফটফট করে হাঁটে। আস্তে আস্তে কথা বলে... আর ... আর জানো... ওঁকে না কেউ মানতেই চায়না। ওঁর ক্লাসে বেজায় গোল করে সবাই।’ 

‘তাই বুঝি সবাই তোরা ওঁকে নিয়ে হাসাহাসি করিস?’

‘হ্যাঁ ঠাম্মা! সব্বাই করে। কিন্তু জানো, আমার না ভারি কষ্ট হয় ওঁকে দেখে। ওঁর মুখটা না কেমন যেন দুঃখী দুঃখী।’ 

এষা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। নিজের মনে মনে বিড়বিড় করে বলেন... ‘ও নীরু! যদি নিজের এই অনুভূতিপ্রবণ মনটা বাঁচিয়ে রাখতে পারিস চিরদিন... ব্যস... সামনের পথে জীবনের যা কিছু শিক্ষা বাকিটুকু জীবন থেকে হয়ত তুই নিজে নিজেই আহরণ করে নিতে পারবি। নাহ... আমার চিন্তা কিসের? ঠিক পথেই সব চলছে।’ 

‘কি বলছ ঠাম্মা?’ নীরু জিজ্ঞাসা করে।

‘নাহ... কিছু না, কিছু না রে...’ নিজের অজান্তেই দুগাল বেয়ে জল পড়তে থাকে এষার। 

0 comments: