প্রবন্ধ - পিনাকী চক্রবর্তী
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
কয়েকটা ঝরাপাতার গল্প
পিনাকী চক্রবর্তী
মুখবন্ধ :-
লেখাটা পড়ার আগে একবার মনে করিয়ে দিই যে মানুষ পৃথিবীতে এসেছে মোটামুটি ভাবে দশ লক্ষ বছর আগে। আর আমাদের চেনাশোনা মানুষেরা এসেছেন হয়তো তিন থেকে সাত হাজার (?) বছর আগে (ঋগ্বেদের সময় কি তিন হাজার বছর ? আমি ঠিক বলতে পারবো না, তবে আমি ওইদিকে যাচ্ছি না)। শেষ হিমযুগ শেষ হয়েছে এগারো হাজার বছর আগে – গুহামানবের গুহা ছেড়ে বাইরে বেরনোর সময়। আমার কাহিনী কিন্তু এর অনেক আগেকার সময় নিয়ে লেখা...
প্রায় তিরিশ কোটি বছর আগেকার কথা। কারবোনিফেরাস যুগ শেষ হতে চললো, পারমিয়ান যুগ আসছে। গন্ডোয়ানাল্যান্ডের হিমবাহগুলোর বরফ ছাড়ানোর জন্যে ভগবান পৃথিবীকে তখন ডিফ্রস্ট মোডে রেখে হালকা হালকা সেঁকা শুরু করেছেন। সমস্ত গন্ডোয়ানাল্যান্ডের আবহাওয়া তখন একেবারে কুলু বা কাংড়া উপত্যাকার মতো। গরমকালে হাল্কা চাদর গায়ে দিলেই চলে, শীতকালে কাঁপিয়ে দেয়। কিন্তু মোটের ওপর বেশ মনোরম। এখানে ওখানে ছিটিয়ে ছড়িয়ে অজস্র গ্লেসিয়ার তখনও আছে, কিন্তু তাদের যুগ যাব যাব করছে। গ্লোবাল ওয়ারমিং শুরু হয়ে গেছে, এবার গ্লেসিয়ার গলবে, সমুদ্রের জলস্তর বাড়বে। গরমে সেই জলের থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড বেরিয়ে আসবে। তার গ্রীন হাউস এফেক্টে আরও গরম বাড়বে, মাটীতে গাছপালা বাড়বে, ঝড়বৃষ্টি বাড়বে, বাড়বে তুফানী উচ্ছাস... কিন্তু এ সব হবে ধীরে ধীরে, একদিনে নয় ...
সেই বিশালকায় ভূখণ্ডের দক্ষিণ দিকে অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলে গলে সমুদ্রের জলস্তর বাড়িয়ে চলেছে। উত্তরদিকে ভারতের তালচের থেকে বরাকর পর্যন্ত বিস্তৃত হিমবাহ গলা জল প্রধানত শোণ নদের পথ ধরে উত্তরে টেথিস সমুদ্রে গিয়ে মিশছে। অল্পস্বল্প বাঁচাবুচা (হিন্দী বলতে বলতে বাংলাটা এক্কেরে গিয়েছে) জলটা হয় পূবের দিকে মহানদী ধরে বয়ে চলেছে হয় অ্যান্টার্কটিকা নাহয় অস্ট্রেলিয়ার দিকে। সেদিকে কোন হ্রদ বা লেগুন বা জলাভূমিতে মিশবে। আর নাহলে পশ্চিমে শিশু নর্মদা ধরে আফ্রিকার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু এরও গতি হবে ওইরকম কোন জলাভূমিতেই।
ভারতের পূব দিকে খানিকটা সরে আছে অস্ট্রেলিয়া। তার দক্ষিণ ভাগে কিন্তু কিছু না কিছু অশান্তি লেগেই আছে। তাসমানিয়া আর অ্যান্টার্কটিকার সাথে গুঁতোগুঁতিতে সেখানে মাঝে মাঝেই পাহাড়ের সারি মাথা তুলছে আর তার সাথে সাথে এসে যাচ্ছে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। কি উৎপাত ! এই পাহাড় গজালো, এই ভূমিকম্প হলো, এই অগ্ন্যুৎপাত হলো, এই আবার ভূমিকম্প হলো...
ওদিকে এই ঠেলায় দক্ষিণ আর পূব দিকের গ্লেসিয়ারগুলো আরও তাড়াতাড়ি গলছে, কিন্তু সেই জল এসে থেমে যাচ্ছে মাঝের বিরাট বিরাট জলাভূমিতে। সেই জলাভূমিতে গজিয়ে উঠছে আমাদের সুন্দরী কাঠের মতো কিছু গাছ, যারা বেশ লম্বা চওড়া হলেও আসল কায়দা লুকিয়ে আছে তাদের শিকড়ে। সেই শিকড় জলাভূমির জলের ওপর মাথা উঁচু করে হাওয়া টানতে পারে। অন্য গাছের শিকড়ের মতো পচে যায় না। আবার শীতকালে প্রবল গ্রাউন্ডফ্রস্ট হলেও এরা বেঁচে থাকে। শুধু পাতাগুলোকে ঝরিয়ে দেয়। কারণ এমনিতেই রোদ বেশি পাওয়া যায় না তখন। তার ওপর সেই রোদ সবার মধ্যে ভাগ করে নিতে গেলে কারও ভাগেই বেশি কিছু আসে না। তখন কম্পিটিশনে নামতে হয়। যে মাথা বেশী উঁচু করবে, সে একটু বেশী রোদ পাবে, কিন্তু তাতে রান্নাবান্না যথেষ্ট হবে কিনা কে আগের থেকে বলতে পারে ? ফালতুতে নিজেদের মধ্যে মারামারি করতে গিয়ে কারুরই উপকার হবে না ... ধুসসস ... অত পরিশ্রম পোষায় না ! তার থেকে এনার্জি বাঁচাই, পাতা টাতা ঝরিয়ে দিয়ে শুকনো কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আর অপেক্ষা করি কবে বসন্তকাল আসবে। তখন নাহয় আবার পাতা গজিয়ে নিলেই হবে...
এর মধ্যে আবার ভূমিকম্পে আস্ত আস্ত জঙ্গল মাটীর নিচে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। তার ওপর মাটী জমে আবার জঙ্গল হচ্ছে, আর আবার তলিয়ে যাচ্ছে। এই এক ব্যাপার দু তিন কোটি বছর ধরে হয়ে চলেছে, আর পারা যাচ্ছে না, উফফফফ...। সেই গাছপালাগুলো নাকি আবার কুড়ি তিরিশ কোটি বছর পরে কয়লা হয়ে মানুষ না ফানুষ কারা সব সেই সময় পৃথিবীতে রাজত্ব করবে, তাদের কাজে লাগবে।
এই তো সেদিন, একটা আস্ত গ্লসপটেরিস জঙ্গল তার পাতা টাতা ঝরিয়ে শীতের জন্যে তৈরী হচ্ছিলো। জঙ্গলের পথ ধরে নিঃশব্দে হাঁটা চলা করা যায় না শুকনো পাতার খড়র মড়রে। এমনি সময়েই মাটী কাঁপতে লাগলো, আর তার সাথে এলো সেই উৎপাত! অগ্ন্যুৎপাত!! নিমেষে আকাশ ঢেকে গেল আগ্নেয়গিরির ছাইয়ে। যারে কয় ভলকানিক অ্যাশ। সেই ছাই ঝরে পরতে না পরতেই নামলো বৃষ্টি। আর তার পরে পরেই ধ্বসে গেলো মাটী। চাপা পড়ে গেল সব গাছপালা আর তাদের শুকনো পাতা।
তিরিশ কোটি বছর পরে সেই মানুষ নামক প্রাণী তাদের প্রয়োজনীয় কয়লা তুলতে এসে হাজির হলো অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে। মাটী কেটে কয়লা তোলার সাথে সাথে কাটা পড়লো কিছু ভলকানিক অ্যাশের স্তরও। সেই সময়ে তারা দেখতে পেল পাথরের মধ্যে ফসিল হয়ে যাওয়া সেই শুকনো পাতাগুলোকে। ওই অবস্থাতেই ছাইচাপা পড়ে গিয়েছিলো তারা, তাই তাদের রঙও বদলায়নি। তা, মানুষের কি বুদ্ধি গো! ওপরে তুলে এনে সেই পুরোনো পাতার ছাপওয়ালা পাথর বেচতে লাগলো তারা। দরকার নেই বলে তাদের গাছেরা ঝরিয়ে দিয়েছিলো সে পাতাগুলোকে, আজ সেই পাতার ছাপ আছে বলে এক একটা পাথরের টুকরোর দাম উঠলো ৮০ থেকে ১০০ ডলার। তা আমার তো পকেটে অত রেস্ত নেই যে পয়সা দিয়ে সেই আদ্দিকালের পুরোনো আর শুকনো ক’টা পাতা কিনি !!! তাই তাদের ছবিটুকুই তুলে এনেছিলাম সে দেশ থেকে। সেই ছবিই আজ ছাপিয়ে দিলাম নীচে।
এরা হলো অস্ট্রেলিয়ার পারমিয়ান যুগের গ্লসপটেরিসের পাতা, বয়েস কমবেশী ২৮ কোটি বছর ... সাইজের একটা আন্দাজ দিয়ে দিই ... এই পুরো ছবিটা আড়াআড়িভাবে একটা মাথাটেপা বল পয়েন্ট পেনের সমান। ওদেরই মধ্যে একজনের ছবি আবার একটু বড় করে দিলাম। আপনারা দেখুন আঠাশ কোটি বছরের পুরোনো একটা পাতাকে, যে নিজে জমে পাথর হয়ে গিয়েছে, কিন্তু তার শিরা উপশিরাগুলো এখনো বাইরে থেকেই চিনতে পারা যাচ্ছে।
ওপরে যে গন্ডওয়ানা ল্যান্ডের কথা বলা আছে, তার চেহারা সম্পর্কে একটা আন্দাজ দেবার জন্যে একটা ম্যাপ সাথে লাগিয়ে দিলাম।
ছবিটাতে যা দেখা যাচ্ছে,, একটু নজর করলে বোঝা যাবে, বাঁদিক (ম্যাপের বাঁদিক মানে পশ্চিম) থেকে শুরু করলে প্রথমেই আসবে একটু তেরচা ভাবে দক্ষিণ অ্যামেরিকা, তার ডানদিকে সেঁটে আছে আফ্রিকা। এরা সবচেয়ে বেশি করে লেগে আছে বর্তমান নাইজার নদীর মোহানার কাছাকাছি।
এবার আফ্রিকার ডানদিকে নজর ফেললে বোঝা যাবে, সেখানে অনেকেই গুঁতোগুঁতি করে লাইন দিয়ে লেগে আছে। ওপর থেকে (মানে উত্তর দিক থেকে) শুরু করলে দেখা যাবে বর্তমান আরব ভূখন্ডকে। লোহিত সাগরটা নেই - মিশর আর আরব দেশের মাঝখানে, কিন্তু একটা সূক্ষ্ম ফাটল দেখা যাচ্ছে। কালে কালে ওটাই রেড সী-তে পরিণত হবে, যখন আরব দেশ সরে যাবে আফ্রিকার থেকে। যেটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, সেটা হলো পারস্য উপসাগর, আরব দেশের ডানদিক ধরে। সাথে একটু ইরান-ইরাক আর আরো ওপরে তুরস্কের অংশও দেখা যাচ্ছে, কিন্তু অতটা পরিষ্কার ভাবে নয়। আন্দাজ করে নিতে হচ্ছে।
আফ্রিকার ডানদিকে ইথিওপিয়া, ইরিট্রিয়া ধরে লেগে আছে ভারতের রাজস্থান এবং তার সামান্য পশ্চিমের অংশ। ধরে নিন বর্তমানে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ।
দেখে নিয়েছেন ? এবার ভারত ভূখণ্ড ধরে আর একটু নেমে আসুন। ভারতের দাক্ষিণাত্যের পশ্চিম দিক আর আফ্রিকার পূবদিকের মাঝখানে দেখুন লেগে আছে মাদাগাস্কার। আবার দাক্ষিণাত্যের পূবদিকে (মানে ডানদিকে), অর্থাৎ পূর্বঘাট পর্বতমালা ঘেঁষে লেগে আছে অ্যান্টার্কটিকা। বেশ সবুজ আর হলদে রঙ করে বোঝানো আছে এ জায়গা আগে কিছু কিছু জঙ্গলেও ঢাকা থাকতো, আবার একটু ঝোপঝাড় মরুভুমি টাইপের আবহাওয়াও হয়তো ছিলো এখানে, শুধুই আজকের মতো বরফের চাদর মুড়ি দিয়ে থাকতো না সে সবসময়।
ভারতের উত্তর দিকে (এখানে দেখে উত্তরপূর্ব মনে হচ্ছে, কারণ ভারতও আজকের হিসাবে একটু তেরচা হয়েই ছিলো সে সময় ) যে হাল্কা বাদামী অঞ্চলটা আছে, এটা তখনকার টেথিস সমুদ্রের নিচে ছিলো। সেখানের জমা পলিমাটি দিয়ে হিমালয়ের অনেকটা অংশ তৈরি হয়েছে। সেটা অবশ্য অনেক পরের কথা। সে হলো, "যেদিন সুনীল জলধি হইতে ..." ইত্যাদির পরে। আজ থেকে প্রায় ছ'কোটি বছর আগে এই অঞ্চলটাই এসে মূল এশিয়া ভূখণ্ডে ধাক্কা মারে।
মজার ব্যাপারটা কি জানেন ? মূল এশিয়া ভূখণ্ড বলে হয়তো বিশাল কিছু মহাদেশ তেমন একটা ছিলো না সে সময়। ছাড়া ছাড়া আলগা আলগা কয়েকটা লম্বা লম্বা মাটির টুকরো ছিল। সেগুলো এই প্রবল ধাক্কায় সব জুড়ে টুড়ে গিয়ে এক হয়ে গিয়েছিলো। আর কিছু না হলেও, অন্তত এইজন্যেই ভারতবর্ষকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর। যাই হোক ...
হ্যাঁ, যা বলছিলাম ... সেই হবু হিমালয়ের ডানপাশে দেখা যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, আর কি আশ্চর্য ! সেই পুরাকালের অস্ট্রেলিয়ার মাথার ওপর প্রায় অবিকৃত অবস্থায় পাপুয়া নিউ গিনিকেও দেখা যাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জর বাকি অংশের কিন্তু টিকিটিরও দেখা নেই। অদ্ভূত, না ?
না, তেমন অদ্ভূত কিছু নয়, কিন্তু সেটা আবার অন্য গল্প। সব গল্প কি একদিনেই শুনে নিলে চলবে ? একটু বাকি রেখে দেওয়া ভালো। ওতে ক্ষিদে বাড়ে !
ইতিহাস ভূগোলের চেনা লেসনে কেন যে এমন করে পড়ায়না !! অপেক্ষায় রইলাম ।
ReplyDelete