0

স্মৃতির সরণী - সব্যসাচী ভট্টাচার্য

Posted in

স্মৃতির সরণী


সরকারী খেতাব!
কী করব আমি এখন!
সব্যসাচী ভট্টাচার্য


তখন শেষ বর্ষণ শুরু হয়ে গিয়েছে। চারপাশ উদ্বেল, বাজারী ব্যস্ততায়, উৎসবের ব্যগ্রতায় -- এক সন্ধেবেলায় বাবাকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলাম ছায়া হিন্দোলে --- আচার্য তারাপদ চক্রবর্তীর বাড়ী। নামটি বলা বাহুল্য, আচার্য দেবের দেওয়া। যাদবপুর থানা থেকে ট্রামরাস্তায় যেতে ডানদিকে, লর্ডস মোড়ের কাছে। দোতলায় উঠে দেখা করতে চাইলাম আচার্য দেবের সঙ্গে। উনি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের পরিচয় ও তাঁর কাছে আসার কারণ জানতে চাইলেন -- পরনে ফতুয়া ধুতি। বললাম। মানে, আমার বাবাই বললেন যে আমি সংগীতের চর্চা করি, তাই ওঁর আশীর্বাদ চাই। 

জিজ্ঞাসা করলেন, 'কার কাছে কী শেখ?' 

উত্তর, 'সন্তোষকুমার গাঙ্গুলী, ঈশ্বর গাঙ্গুলী স্ট্রীটে থাকেন।' 

চক্রবর্তী মশাই খুব খুশী হলেন। বললেন, 'ও, তুমি নাকুর ছাত্র! তা সে পাগলটা আছে কেমন? অনেকদিন আসেনি।'

এখানে বলে রাখি তারাপদবাবুর ডাকনাম ছিল 'নকু' আর আমার সে সময়ের গুরুর নাম ছিল 'নাকু।' যাই হোক, আচার্য তারপর আমার স্কুল, পড়াশোনা, তখন কী রাগ শিখছি -- এই সব বিষয়ে জানতে চাইলেন। এর মধ্যে চা, খাবার সব এল। আপত্তি টিঁকলো না, খেতেই হলো। 

এখানে যখন এইসব কথা হচ্ছে তখন কোনও একটা ঘরে গান রেওয়াজ হচ্ছে। আমি এদিক ওদিক তাকাচ্ছি দেখে উনি বললেন, 'আমার ছেলে মানস। চেনো তো? গান শেখাচ্ছে। নিজেও ভালো গায়। মেয়েও ভালো গান করে -- শ্রীলা। তা, বাবা তুমি যখনই ইচ্ছে করবে চলে আসবে; শুনবে। শুনেও অনেক কিছু শেখা যায়।' আমি ক্রমশঃ অবাক হচ্ছিলাম। এত বড় মাপের একজন সংগীত সাধক, শিক্ষক; কত সহজ সরল! 

এবার আমি আমার খাতা এগিয়ে দিলে উনি আশীর্বাণী লিখে দিলেন। এরপর আমি যা করলাম সেটির জন্য পরে আমার খুব অনুতাপ হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম -- 'আপনি পদ্মশ্রী ফিরিয়ে দিলেন কেন?' আমার বাবাও খুব বিব্রত হয়েছিলেন এই প্রশ্ন শুনে। কারণ, উনি জানতেন যে তারাপদবাবু মুহূর্তে রেগে ওঠেন। 

ঠিক তাই হলো! 

আচার্যদেব রাগে জ্বলে উঠে বললেন ---

'পদ্মশ্রী দেখাচ্ছো? পদ্মশ্রী খেতাব ধুয়ে কি আমি জল খাব? আজ বাদে কাল চিতায় উঠব! একটা শেখাবার ভালো জায়গা পেলাম না, যেখানে একটা প্রতিষ্ঠান তৈরী করতে চেয়েছিলাম। ওতে বেশী উপকার হতো। তোমরা বুঝলে না! পদ্মশ্রীর কোনও দরকার ছিল না। এখন স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই আর গাইতেও পারি না।' ---- 

বলে খানিক্ষণ চুপ করে রইলেন, চোখে মুখে বিষণ্ণতা। একটু পরে আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, 'বাবা, রাগ কোরো না। তোমাকে বলিনি। তুমি ছেলেমানুষ, আমার নিজের দুঃখ প্রকাশ করলাম মাত্র।' বাবার দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বললেন, 'মাপ কোরো ভাই।' 

আমাদের কিছু বলার ছিল না। 

প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম। 

মনে মনে বাঙালী জাতটার হয়ে আচার্যদেবের কাছে ক্ষমা চাইলাম।

0 comments: