0

মুক্তগদ্য - দীপাঞ্জনা মণ্ডল

Posted in


মুক্তগদ্য


প্রতিসরণ
দীপাঞ্জনা মণ্ডল


ইস্কুলের নাম যার নরনারায়ণসেবা, তার বাড়ির নাম কাঙালিভোজন। নামের সঙ্গে ঈশ্বরের কোনও এক সমর্থ নাম জুড়ে দিয়ে খুব সম্মান হয়, ইহা লোকবিশ্বাস (হরিজন)। ঐ একটু মোলায়েম করে বলা আর কি! ধরো, বলির আগে ছাগশিশুর ঘাড়ে-গর্দানে গাওয়া ঘি ডলার মতো অনেকটা। না না, এতে করে এক কোপে ধারালো খাঁড়া নামিয়ে ফেলতে পেরে যে বলি দিচ্ছে তার সুবিধে হয়, এটা একপেশে ভাবনা। একবারে গলা নেমে গেলে তো বলিপ্রদত্তেরও সম্ভাব্য সর্বাধিক সুবিধা। বলি যাকে হতে হবেই, তার ক্ষেত্রে শেষ ইচ্ছে মানে তুলনামূলক কম কষ্টের মৃত্যু। ছাগুলে বুদ্ধি ঘি-এর গন্ধে সুতরাং মানতের সঙ্গত করে। সোজা আঙুলে না উঠলেও ঘি কিছু আঙুল বাঁকিয়ে স্বল্পসঞ্চয় প্রকল্পে রাখা আবশ্যক। ছাগল আঁতেল হলে কি প্যাঁচে খেলত, সেসব অশৈলী কথা না ভাবাই ভাল। অতএব মোলায়েমের মর্ম আছে। অর্থ যা-ই হোক, শেষত অনর্থ ঠেকাতে তুমি কীভাবে বললে সেটা গুরুত্বের। তা দিয়ে তোমার ভবিষ্যৎ কিছু বিনির্মিত হবার সম্ভাব্য সম্ভাবনা নির্মাণ করা যায়।
 
উদ্দেশ্যপ্রবণ বুদ্ধিমত্তা এরকম নামকরণে দড়। কোনও শিশু ভয়ে বা ব্যথায় কাঁদলে এরা বলে, ‘তুমি না সাহসী! তুমি কাঁদছ!!!’ কি গেরো ভাই! ওই বাচ্চাকে পর্যন্ত তার সামনে উপস্থাপিত এক ইতিবাচক বিশেষণের টোপ দেখিয়ে কান্না গিলে ফেলার বীরত্বে বন্দী করে ফেলা হয়। এবার সারাজীবনের জন্য কিছু বার খাওয়ানো পিঠ চাপড়ানির প্রত্যাশায় সে সাহসী হবে নিজের ক্ষমতা মতো। গুণ্ডা হতে পারে, গুণ্ডা ঠেঙাতে গিয়ে শহিদ হতে পারে, মুখের ওপর নিজের বুদ্ধির মাপে বোঝা সত্যি ট্যাঁকটেঁকিয়ে শোনাতে পারে, সরকারি সম্পত্তি অনবরত নষ্ট করতে পারে, ঘুষ নিতে পারে, টেবিলের তলায় মোক্ষম সময়ে ঘুষ এগিয়ে দিতে পারে, প্রেম–প্রস্তাব অনুশীলনসাধ্য প্রকরণে পেশ করতে পারে, শৈল্পিক সুষমামণ্ডিত সত্যির আড়ালে চটচটে দুর্গন্ধের মিথ্যে লুকিয়ে তার মতে বৃহত্তর স্বার্থসিদ্ধি করতে পারে – এসব সে তার জীবনদর্শন অনুযায়ী সাহসিকতা হিসেবেই চিনেছে, জেনেছে, বুঝেছে। সুতরাং সারাজীবন সে হিসেবমতো বাহবা-র দাবিদার। 

এতদ্বারা বোঝা গেল, নামে অনেক কিছু আসে যায়- এই রবিবাণীটি শেক্সপিয়ারবিরুদ্ধ হলেও এ লেখায় তারই সমর্থনে প্রচার। নাম আসলে একটি পরিচয়, সমষ্টি থেকে ব্যক্তিকে আলাদা করবার অবলম্বন। চেনাশোনা এমন অনেক আন্তরিকতা উদযাপনকারী আমাদের আশেপাশে থেকেই থাকেন যাঁরা শৈল্পিক অভ্যাস দক্ষতায় নামকরণ করেন। রাজলক্ষ্মী এদের মুখে রাজু, অনন্যা- অনু ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। পুংবাচক-গুলির বিশেষ বিশেষ উদাহরণ মনে ভেসে উঠলে যে যার মতো মুচকি হাসুন অথবা এক্ষুনি পুরনো কোনও এরকম অভিধাঅর্জনকারীকে ফোন করে ফেলুন। কিন্তু ওই ব্রেক নিয়ে এখানেই ফিরে আসুন। এই নামকরণগুলি অনেক সময়ই চরিত্রবৈশিষ্ট্যের অনুগামী হয়। ধরুন যার বংশগত পাইলস আছে তার বন্ধুমহলে নাম ‘কষ্ট’, তার আর কেষ্ট হওয়া হলো না(অন্তত হবার সম্ভাবনা কমল)। এরকম নাম ভেঙে নাম, ব্যাঞ্জনাময় নাম এসব তেমন একটা প্রভাব রেখে যায় না শেষত। তার কারণ খুব খাজা বা আত্মসম্মান বিধ্বংসী নাম-ও এসব ক্ষেত্রে বহুব্যবহারে খরতা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু ওই যে ‘তুমি তো ছেলে, তোমার চোখে জল কেন’ এ আরোপ জীবনান্তের আগে নিশ্চিহ্ন হতে না দিতে চেয়ে জীবনপণ করে ফেলা যায়; যেমন যায় ‘আ হা, কি ভাল মানুষ তুমি’ অথবা ‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করি’ অথবা ‘আমি জানি তুমি আমার কোনও ক্ষতি হতে দেবে না’ ইত্যকার পরিচয়ের রক্ষাকল্পে। এঁরা মারাত্মক সব গণ্ডি হয়ে উঠবার ক্ষমতা রাখেন। যে নিরীহ মানুষটি সকালে টয়লেটের বন্ধ দরজার আড়ালেই একমাত্র তার ক্ষতি ও ক্ষতের প্রতিশোধ অনুমানের চেষ্টায় একটা ধারালো ছুরি ধারণ করতে চেয়েও ঝরঝরিয়ে কেঁদে পরের অধ্যায়ে যায়, তাকেও ‘তুমি তো প্রয়োজনে তীব্র প্রতিশোধ সক্ষম’ দেগে দিলে তার জ্বালা ফুস হয়ে যেতে সময় নেয় না। সে জানত সে পারে না, সে জানল সে পারতেই পারে। অতএব পেরে ওঠবার দরকার নেই তারপরে। ঘেঁটে ঘ। কিসস্যু বোঝা গেল না। হুম্‌ম। চোরাবালির মধ্যে যে ঘুম নেমে আসে তার থেকে জেগে উঠবার উপায় জানো? 

যথেষ্ট ক্লান্ত হবার পক্ষেও বড় বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়লে দু-হাত পা দিয়ে জড়িয়ে ধরা যায় ঝুরঝুরে বালিদের। যারা নিচে নামে আর নেমে নেমে যায়। আমরা আরও নিচে নিচে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে চেনা না গেলে মুখের ওপর একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলি, সময়। তারপরে ঘুমের সময়টুকু নোনা জল ফুটিয়ে কেটে গেলে পুরনো শ্যাওলাধরা ইঁট বেরিয়ে আসা নিঝঝুম বাড়িগুলোর দরজা নাড়ি। সাড়া পাই, অথবা পাই না। কিচ্ছুতে যায় আসে না কিছু। সাড়া পেলে ভাল, তাকে বলি - আমায় সেই যে ডেকেছিলে গ্লুকোমা বলে, আর একবার ডাকো। ডাক জন্মায়, অচেনা সুরে। শীত করে, জ্বর আসেনা, আমি পায়ে পায়ে ফিরে আসি আতঙ্কে। সাড়া না পেলে দরজার ওপরে কিল, চড়, ঘুষি, মাথা খোঁড়া। তারপরে নখের আঁচরে স্বাক্ষর- এসেছিলাম, সোনার তরী। সেই জ্বরবিহীন শীত মেখে পশ্চাদপসরণ। এরকম বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে সব রাস্তা আর দরজা আর জানলা আর বারান্দা আর ঘরের আভাস এর ওর তার ঘাড়ে পিঠে চেপে পড়ে। এক্কেবারে হারিয়ে যাবার আগের মুহূর্তে সামনের বাড়িকেই নিজের মনে করে আমি ঠিকানা মুখস্থ করতে শুরু করি। কেউ নাম দিয়েছিল ‘আঁকড়ে ধরা’। মনে হয় ঠিক এরকমই হবার ছিল। আমি ঠিকানাটা, বাড়িটা, রাস্তাটা, জানলা, জানলার বাইরের আকাশ, ছাতের ঢাল সঅঅঅব আঁকড়ে ধরে ফেলি। আবার সব গলে যায় আঙুলের ফাঁক দিয়ে। 

অথচ দেখা যায় বাহ্যত, আমার বা আমাদের মাথার ওপরে ছাত, পায়ের নিচে মার্বেল, চোখে ছায়া, মুখে আলো, হাতে কাঁটা-চামচ। অতএব দুঃখ আমাদের বিলাস ব্যক্তিগত। মাঠে মাঠে একা মুখ কালো করে পাখি তাড়ায় যে কাকতাড়ুয়াগুলো, তাদের কালো মুখে অনাবিল হাসি স্পষ্ট প্রতীয়মান, দাঁতের সজ্জা যদিও বিসদৃশ, তবু হাসি নির্বিষ। এত স্পষ্ট যে ওদের কালো মুখ পাদপ্রদীপের আলো পায় না। অন্যদিকে, সকালে জানা গেছিল আশ্চর্য পরিণত চোখ, নাক, কান, মুখ আর ত্বকের বিষয়ে। বেলা গড়াতে জানা গেল চক্ষুদান-ও হয়নি। ধীরে ধীরে পশ্চিমের জানলা গলে পড়তে শুরু করলে ঘরের মেঝেয় বোঝা গেল চাকচিক্য সাময়িক। গোধূলির ক্লান্তি দেখাল মাটি তাল তাল, তারও অন্ধকার গর্ভে কিছু শুকনো খড় গৃহপালিতের বরাদ্দ। আর শক্ত মেরুদণ্ডটি চিহ্নিত হলো ক্ষণিক জ্বালানি হবার যোগ্য কঞ্চি হিসেবে। এই এই এই শুধু। অস্ত্র, শাড়ি, গয়না, অঙ্গরাগ, গঙ্গামৃত্তিকা, খড়, বাঁশ, এমনকি বেশ্যাবাড়ির মাটিটুকুও দেবীত্ব চায় কিনা তিথিনক্ষত্র নিয়ন্ত্রিত, কেউ কখনও জিজ্ঞাসু হয়নি সে বিষয়ে। অতএব বিসর্জনে ‘আসছে বছর আবার হবে’-তেই ঘামতেল সার্থকতা। কাকতাড়ুয়াগুলো একই মেরুদণ্ড নিয়ে সোওওওজা দাঁড়িয়ে থাকে রোদ-জলে। ছেঁড়া জামা রুগ্ন কাঁধ বেয়ে ভারসাম্যে দোলে। একা একটা গোটা মাঠের দায়িত্বে কাকতাড়ুয়া ভয় পায়। পা একটামাত্র বলে ছুটে পালাতে পারে না। অনৈসর্গিক হেসে যায়। ওর দায়িত্বের সীমানা বরাবর সর্পিল বিচ্ছিন্নতা অবিচ্ছিন্ন অন্তর্জালের মতো ছিটিয়ে থাকে। ফলত পাশের কাকতাড়ুয়ার কাঁধে হাত রেখে দুজনেই দুটো করে পা পাবে এমনটা সম্ভাব্যতা পায়না। চাঁদোয়াবিহীন কাকতাড়ুয়া আর থিমওয়ালা মণ্ডপের কেন্দ্রে স্থাপিত প্রতিমার মেরুদণ্ড এক। একজন পার্থিব ফসলের রক্ষক, অন্যে অপার্থিবের। শস্য যারা কেটে নিয়ে যায় গুচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে দুধেল রাতে নদীর নিচে শুয়ে থাকা চোখে অথবা মাঠে একা কাকতাড়ুয়াদের ছরকুটে দাঁতে জিঘাংসা জমে। চাঁদের আলো ওদের শয়তানের শক্তি দেয়। জলের ভেতরে চার অথবা তার থেকে বেশি বাহুতে সাঁতার দিয়ে আর বাতাসে আলগা জামার ডানা মেলে ওরা দুঃস্বপ্ন তৈরি করে।

প্রতিমা আর কাকতাড়ুয়ার পাহারায় থাকা সমস্ত ফসলে অমৃত মেশায় প্রহরীরা। বংশানুক্রমের জীবনে ওমনি মৃত্যুর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়ে যায়। ফসলের গোলা বাঁধবার আকাঙ্খায় ওরা শস্যের গুচ্ছের বদলে কাস্তে চালায় প্রতিবেশীকে লক্ষ্য করে। রক্ত ঝরে আর রক্তবীজ বেড়ে ওঠে। ওরা ছিন্নমস্তা খোঁজে। আর ভুলে যায়, যাকে ওরা ছিন্নমস্তা সাজিয়েছিল তারও ওই কঞ্চির মেরুদণ্ড একটা ছিল। ও মেরুদণ্ড ভাঙে তবু মচকায় না। অবাধ্য মেরুদণ্ডগুলো আর কোনও নামের ভেতরে বন্দনার গণ্ডিতে অথবা সংজ্ঞার বাঁধনে থাকবে না। দেবত্বে বা ক্লাউন হয়ে নয়, প্রান্তিক বা হরিজন হয়ে নয়, ওই কাঙাল বা নরনারায়ণ হয়েও নয়- ওরা ওদের মতো থেকে যেতে পেরে বেঁচে থাকবে। একটা সোজা মেরুদণ্ড আছে তো, আর কিছু উপচারের ভিক্ষে দেবার স্পর্ধা সহ্য করবার দরকার কি!

0 comments: