0

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়




সময় স্থির নয়। ঘটনা পরম্পরাও অ্যাবসার্ড নাটককে মনে পড়াচ্ছে মাঝে মাঝে। যেমন সদ্য ঘটে যাওয়া কালা ধন সফেদ করার কর্মকাণ্ড। একটা বিষয় লক্ষ্য ক'রে অবাক না হয়ে পারিনি। চূড়ান্ত অসুবিধের মধ্যে পড়েও মানুষ দিব্যি ঠাট্টা, তামাসা করছে তা নিয়ে। লিখছে চুটকি, আঁকছে কার্টুন। রবীন্দ্রনাথের কথা মনে এল। পঞ্চভূত প্রবন্ধাবলীতে তিনি বলেছেন, কৌতুক সুখের আতিশয্য নয়। হঠাৎ অসঙ্গতি, বিড়ম্বনা বা লজ্জার পীড়া থেকেই উঠে আসে কৌতুক। হাসির আড়ালে একরকম নিয়মভাঙার আমোদ থাকে। লুকোনো থাকে নিয়মতান্ত্রিকতাকে পরিহাস। কৌতুকরস রসাভাস থেকে সৃষ্ট। আমরা দন কিহোতের হাওয়াকলের দিকে বর্শা তুলে ঘোড়া ছোটানো দেখে হাসি। কারণ, বীররসাভাস। কোনও সদর্থক পদক্ষেপ না ক'রে নিরন্নের দুঃখে চোখের জল ফেলা দেখে আমরা হাসি। কারণ, করুণ রসাভাস। ‘আমি প্রণত - আমি ভক্ত’ ব'লে ভৈরব হুংকারে আমরা হাসি। কারণ শান্ত রসাভাস। আমরা হাসি। হেসে চলি। আর সেই মানুষটিকে স্মরণ করি এই গত মাসের তিরিশ তারিখে যাঁর জন্মদিন গেল। ইচ্ছে হয় ডেকে ব'লি, "মশাই গো, নেমে আসুন। ঋতবাককে উপহার দিন আর একটা আবোলতাবোল বা হযবরল। আপনাকে বড় দরকার এখন।" 

ঋতবাক সত্যকথা বলে। সত্যপথে চলে। আর সত্য আর ঘটে চলা ঘটনাবলীর অসংগতি দেখে হাসে। হাসছে। ভবিষ্যতেও হাসবে। আপনারাও থাকুন হাস্যমুখে, হাস্যসুখে।

শুভেচ্ছা নিরন্তর

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সুহোত্র

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


ঋতহাস
সুহোত্র



যতদূর বুঝতে সমর্থ হয়েছি তাতে অনুমান ক'রি যে, ঋতবাক ঋত এবং বাক্ উভয়কেই তার যাপনের অংশ করতে চায়। বড় দুরূহ এ সাধনা। আরও অগ্রসর হওয়ার পূর্বে এই শব্দ দুটির অর্থ প্রণিধানের প্রয়াসী হওয়া যাক। দুটি শব্দেরই আকর ঋকবেদ। ঋগ্ বেদের দশম মণ্ডলের ত্রিষ্টুপ ছন্দে রচিত ৭১তম সুক্ত জ্ঞানসুক্ত নামে পরিচিত। এখানে বৃ্হস্পতিকে বন্দনা করা হ'লেও এর মূল প্রতিপাদ্য হ'ল বাক্ এর উৎপত্তি আর তার অপরিহার্যতা। হৃদয়ের গহনে সঞ্চিত ছিল উৎকৃষ্ট ও অমলিন জ্ঞান। ছাঁকনির সাহায্যে শক্তুকে ছাঁকবার মতন ক'রে সেই জ্ঞানকে ধীমান ব্যক্তিবর্গ সযত্নে বার করে আনলেন বাক্ এর সাহায্যে। বাক্ ভাষা দিল জ্ঞানকে। কিন্তু, এই বাক্ এর অধিকারীভেদ আছে। ভাষা ব্যবহার ক'রে সকলেই কিন্তু সম্যকভাবে বাক্ এর পরিচিতি লাভ সকলের দ্বারা সম্ভব নয়। 

উত ত্বঃ পশান্ন দদর্শ বাচমুত ত্বঃ শৃণ্বন্ন শৃণোত্যেনাম্।
উত ত্বস্মৈ ত্বন্বংবি সস্রে জায়েব পত্য উশতী সুবাসাঃ।।

অনেকেই শব্দকে দেখেও দেখতে অক্ষম, শুনেও শুনতে অপারগ। মুষ্টিমেয় কতিপয় ভাগ্যবানের সম্মুখে বাক্ স্বেচ্ছায় নিরাবরণ মূর্তিতে স্বপ্রকাশ হন যেমন ভাবে 'উশতী জায়া' বা সুন্দর পোশাকে সজ্জিতা ভার্যা প্রেমভরে নিজের দেহকে অনাবৃত করেন পতির সম্মুখে। এই বাক্ এরই সাধনা তবে ঋতবাকের। এবং, সে ঋতকেও অর্চনা ক'রে। 

স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে ঋত এর সংজ্ঞা নিয়ে। বৈদিক চিন্তনে এ শব্দের গুরুত্ব অপরিসীম। ঋত এর শ্লোক সমূহ বধিরদের কর্ণ উন্মোচন করেছিল; ঋতের সাহায্যে অগ্নি অমরত্ব লাভ করেন: " ঋতম্ সপন্তঃ অমৃতম্ এবৈঃ।" অর্থাৎ ঋত দেবতাদেরও আজ্ঞাধীন নয়; বরং তাঁরাই এর অনুগামী। এই শব্দের অর্থ নিরূপণ কালে পণ্ডিতগণ ভিন্নমত। কেউ বলেন " Everything that is ordered in the universe has rita for its principles. It corresponds to the universals of Plato"; কারও মতে এর অর্থ "order of the universe"; আবার কেউ একে "physical and moral order" বলে অভিহিত করেন। একটি বিষয় যা এইসকল সংজ্ঞা থেকে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় তা হ'ল এই যে ঋত এক অমোঘ, অলঙ্ঘ্য নিয়ামক। প্রশ্ন হ'ল এই ঋত কি অপরিবর্তনীয়? তা বোধহয় নয়। ঋক্‌বেদ সংহিতার দশম মণ্ডলের ১০৫ সংখ্যক সুক্ত এক ঋতহীন পরিবেশের বর্ণনা দান করে: 

যজ্ঞং পৃচ্ছাম্যবমং স তদ্দূতো বি বোচতি।
ক্ব ঋতং পূর্ব্যং গতং কস্তদ্বিভর্তি নূতনো বিত্তং মে অস্য রোদসী।। 

সর্বদেবের আদিভূত যজ্ঞের নিকট আমার প্রশ্ন অতীতের সেই ঋত এখন কোথায় গমন করেছে? কে সেই নূতন যিনি তাকে ধারণ করেন? এই পরিস্থিতিতে উপনীত হয়েও ঋত এর ওপর বিশ্বাস রাখেন বৈদিক কবি : ব্যুর্ণোতি হৃদা মতিং নব্যো জায়তামৃতম্ -- আমি দৃঢ় চিত্তে ঘোষণা করছি নূতন ক'রে ঋতের জন্ম হ'ক। এই নবীকরণের ইচ্ছা থেকেই বোঝা যায় যে ঋত কালভেদে নবরূপ ধারণ করে। সুতরাং ঋত হ'ল an order of both the outer and inner worlds as they are at this moment। সরলার্থে বর্তমানে যে সঙ্গতি, সামঞ্জস্য আর সুশৃঙ্খলা মেনে চলে বহির্বিশ্ব ও ন্যায়বোধ, নীতিবোধ নির্ধারিত অন্তর্বিশ্ব তারই নাম ঋত। এবং যে বস্তু বা অনুভব যে অবস্থায় আছে তাকে সেরকম ভাবে বর্ণনা করারই নাম সত্য কথন : "তদবতি তৎপ্রকারকঃ অনুভবো যথার্থঃ।" দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তী বলেন, "যে বিশেষ্য বস্তুত যে ধর্মবান, তার বিষয়ে সেই ধর্মকেই বিধেয় বিশেষণ হিসেবে অনুভব করা বা বলাটাই সত্য জানা বা সত্য কথা বলা। পান্না যদি অনুভবের বিশেষ্য হয় তবে তার বিষয়ে সবুজ- বিধেয় লাগানো সত্য হবে যদি এবং কেবল যদি পান্নাতে সত্যিই সবুজ রঙ থাকে।" সুতরাং মীমাংসা করা যেতেই পারে যে ঋত এবং সত্য সমার্থক। 

ঋতবাকের ধর্ম তবে বাক্ এর সহায়তায় সত্যকে প্রকাশ। বিবিধ উপায়ে বাক্ সত্যকে প্রকাশ করতে পারে। তবে, আমরা মনে করি এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায় হ'ল কৌতুকের দ্বারা সত্যের প্রকাশ। আমরা শ্রী অরিন্দম চক্রবর্তীর মতের অনুগামী হয়ে বলতে চাই সত্যের সঙ্গে হাস্যের এক প্রত্যক্ষ সংযোগ আছে। ভরত তাঁর নাট্যশাস্ত্রে বলেন : "এতেন সর্বে রসা হাস্যে অন্তর্ভূতা ইতি দর্শিতম্" : এর দ্বারা দেখানো হ'ল সমস্ত রসই হাস্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে। অধ্যাপক চক্রবর্তী বলেন যে অতি অকিঞ্চিৎকর অস্তিত্বের অধিকারী ব্যক্তি মানুষ অনেক সময়ই বিশ্বাস করে যে তার প্রাতিস্বিকতা বা individualism তাকে এই মহাবিশ্বে এক পুরোভূমিতে প্রতিস্থাপিত করেছে। এই অহং প্রকৃতবিচারে কৌতুকজনক।" এই আমির সোনার থালাতেই ঢাকা আছে সত্যের নির্মম -- নিরহং আমি - আমার হীন পরম সর্বময় সাধারণ মুখ।... নির্মোহ ফুসফুস উজাড় করা খোলা হাসি -- অথবা নম্র আত্মবিলোপকারী পরিমিত কৌতুকের স্মিত বিহসিত সামান্য বৈপরীত্যময় রঙ্গকৌতুক সেই আবরণ পুরোপুরি সরাতে না হোক একটু আলগা করতে -- একটু খুলে ধরতে সাহায্য করে।" সত্য এবং যাপনের বিবিধ অসংগতি থেকে উদ্ভূত হাস্য প্রসঙ্গেই বের্গসঁ বলেন "Laughter is Corrective।" 

ষোড়শ শতাব্দীতে ফরাসী দেশে বসে তাঁর দেশবাসীকে এক হাসির মন্ত্র দিয়েছিলেন রাবলে। সে এক বিশেষ দর্শন। জীবন সম্পর্কে, জগৎ সম্বন্ধে এক নির্মোহ নিরাসক্তি নিয়ে, এক দার্শনিক বিচ্ছিন্নতা বোধ নিয়ে এক নির্বিকার অট্টহাস্যে অদৃষ্টকে পরিহাস করার, সমস্ত সৃষ্টি তথা অস্তিত্বকে হাস্যকর ভাবার এই হাসি দর্শনের নাম পাঁতা গ্রুয়েলিজম। 

এ হাসির অধিকার সকলের জন্য নয়। এক বিশেষ দার্শনিক অবস্থান থেকেই এ হাসির উদ্ভব। এই হাস্য দর্শনের এক অপর দিকও আছে। জগৎসৃষ্টি সম্বন্ধে এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গীও এক প্রসন্ন সকৌতুক মনোভাবের জন্ম দিতে পারে। এক উদার গম্ভীর হাসির দৃষ্টিকোণ থেকেও বিশ্ববীক্ষণ সম্ভব। কালিদাসের হিমালয়ের বিশালত্বকে ত্রম্বকের অট্টহাসির সঙ্গে তুলনা অকারণ নয়। 

বঙ্গসাহিত্য জগতে অন্তত একজন স্রষ্টার উল্লেখ আমরা করতে পারি যাঁর এক নিজস্ব হাস্যদর্শন ছিল। নাম তাঁর সুকুমার রায়। পুণ্যলতা চক্রবর্তী তাঁর স্মৃতিকথায় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সম্বন্ধে এক বিচিত্র তথ্য দিয়েছেন। রাগ বানাতেন তিনি। কারো ওপর রাগ হলে তিনি তার সম্বন্ধে উদভট গল্প মুখে মুখে বলে গিয়ে তাকে হাস্যকরতার চরম সীমায় পৌঁছে দিতেন। হাসির অট্টরোলে রাগ ভেসে যেত। পরিণত বয়স তাঁর এই প্রবণতাকে পূর্ণতা দিয়েছে আর তারই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাঁর অভিজ্ঞতা ও মনন প্রসূত এক বিবিক্তি তথা নিরাসক্তি ও তার থেকে উদ্ভুত এক প্রসন্নতা। এই প্রসন্ন কৌতুক তাঁকে জীবনকে সহাস্যে পর্যবেক্ষণ করার সামর্থ্য দিয়েছে।

এইখানে আমরা দুটি কবিতার কথা স্মরণ করতে পারি। কাতুকুতু বুড়ো আর রামগড়ুরের ছানা। ধমক দিয়ে ঠাসা জগতের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ, সুড়সুড়ি দিয়ে হাসানোর বিরূদ্ধে প্রতিবাদ। কিন্তু, কোন জগৎ? যে কবিতাদুটির কথা উল্লেখ করা হ'ল সে দুটি প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৩২২ ও ১৩২৫ এ সন্দেশের জৈষ্ঠ সংখ্যায়। ঈষৎ সচেতন হলেই আমরা লক্ষ্য করি যে সে সময়টি হ'ল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। একদিকে বাঙালী ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের সর্বস্ব উজাড় করা আত্মসমর্পণ ইংরেজের কাছ থেকে হোমরুলের প্রত্যাশায় আর অন্যদিকে যুদ্ধান্তে শাসনের কড়া ফাঁস। এই চূড়ান্ত অসংগতির হাস্যকরতার ছায়া এই কবিতা দুটিতে পড়ে। অতিশয়োক্তি মনে হ'লে বারেক কাতুকুতু বুড়োর যে গল্পে হাসির চেয়ে কান্না আসে বেশি তার দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। কেষ্টদাসের পিসির নয়। সেটি এক যোদ্ধা রাজার গল্প। "এক যে ছিল যোদ্ধা রাজা --হোঃ হোঃ হোঃ হি হী, / তার যে ঘোড়া হাঃ হাঃ হা ডাকত সেটা চীঁহি / ছুটত যখন হেঃ হেঃ হে সবাই বলত বাহা / হোঃ হোঃ হোঃ হীঃ হীঃ হি হেঃ হেঃ হে হাহা" এই উৎকট হাসিতে ভরা রাজার ঘোড়ার ছুটের গল্পে গড়া ধমক দিয়ে ঠাসা দুনিয়ায় হাসি নিষেধ। যে হাসি মনকে প্রসন্ন করে সে হাসির ঠাঁই এখানে নেই। তাই হাস্য রসিককে হাসির সন্ধান করতে হয় শুধু অসংগতির মধ্যেই নয়। প্রসন্নতা রক্ষার জন্য তিনি প্রকৃতিতেও হাসির দেখা পান। সেই কারণেই রামগড়ুরের ছানার "ঝোপের ধারে ধারে রাতের অন্ধকারে / লাখ জোনাকির চক্ষু ঠারা হাসতে শেখায় কারে?" বদলে গিয়ে হয় "ঝোপের ধারে ধারে রাতের অন্ধকারে / জোনাক জ্বলে আলোর তালে হাসির ঠারে ঠারে"। আলোর তালে হাসির ছন্দ!

এ দাবী আমরা করছি না যে সুকুমার এই সামাজিক অসংগতির রূপক ভাষ্য হিসেবে তাঁর হাস্য রসের বিশ্ব গড়েছেন। আমাদের বক্তব্য এই, যে বিশ্ব তিনি গড়েন সেখানে প্রতিটি ঘটনার মূলগত অসংগতি তাদের হাস্যকর করে তুলতে পারে। সুকুমার সেই হাসির সম্ভাবনার উৎসে পৌঁছতে চান। আর সে উৎস কখনও রাবলের মতো সৃষ্টির মধ্যে কমিক এর বোধ। আবার কখনও অস্তিত্বের আনন্দের বোধ। অসংখ্য সম্ভাবনার বিভিন্ন পারম্পর্য ভেঙে দিচ্ছে সংগঠিত জগতের গাম্ভীর্য। খুলে যাচ্ছে এক উদ্দাম অট্টহাসির উৎসমুখ। এই হাসিরই প্রাণপুরুষ হিজিবিজবিজ।

বাংলা ১৩২৯ সালের জৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র সংখ্যার সন্দেশে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পায় হযবরল। সুকুমার মারা যান ঠিক এর পরের বছর। ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৩। আর তার পরের বছর ২২শে সেপ্টেম্বর, ১৯২৪ এ হযবরল গ্রন্থাকারে প্রকাশ লাভ করে। সে বছরই (পৌষ, ১৩৩১) প্রবাসীতে প্রকাশিত গ্রন্থ সমালোচনা লিখল : "ছোটছেলেদের একচিন্তা আর একচিন্তা হইতে লাফাইয়া লাফাইয়া চলে। তাহাদের মধ্যে ক্ষীণ যে যোগসূত্র থাকে তাহা সবসময় ধরিতে পারা যায় না। গ্রন্থকার সেইরকম লম্ফনশীল চিন্তা গুলিকে গাঁথিয়া একটি গল্পের সৃষ্টি করিয়াছেন। ইহা তাঁহার শিশুমনের ও শিশু মনোভাবের আশ্চর্য পরিচয়।" শিশু মনোভাব? অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে যদি হযবরল এর বিচার দৃশ্যটির কথা মনে করি তাহলেই কিন্তু এই অভিধায় সংশয় জন্মায়। আসামী যোগাড়, ভাড়া করা সাক্ষী, মান শব্দের উকিলি ভাষ্য, ঘুমন্ত হাকিম আর সবার ওপরে এই সব উদ্ভট ঘটনা দেখে হিজিবিজবিজের অট্টহাসি।

এ তো চূড়ান্ত প্রাপ্তমনস্ক এক দ্রষ্টার এক অসার আইনি ব্যবস্থাকে সকৌতুক পর্যবেক্ষণ। এই বিচার দৃশ্য প্রকাশিত হয় ১৩২৯ এর ভাদ্র সংখ্যার সন্দেশে। আর ঐ সংখ্যাতেই প্রকাশ পায় একুশে আইন। কৌতুকের বাতাবরণে যে আইনের শাসনে ত্রস্ত সমাজের রূপ দেখা যায় তার সাথে অরওয়েলের জ্যেষ্ঠভ্রাতা শাসিত সমাজচিত্রের খুব একটা পার্থক্য অন্তত আমার চোখে ধরা পড়ে না। ব্রিটিশ রাজের প্রতিশ্রুত রুল অফ ল আর বাস্তব সত্য অবস্থার মধ্যের অসংগতি তখন আমাদের কাছে স্পষ্ট।

আসলে, বারংবার, বিভিন্নভাবে তাঁর প্রায় সমস্ত রচনায় সুকুমার তাঁর সমকালীন সমাজের অসংগতি ও স্ববিরোধ ভরা বাস্তব আচরণের দিকে কৌতুকভরে চেয়েছেন। দেখেছেন রাজাদের নেড়া বেলতলায় কবার যায় তা নিয়ে চিন্তায় গলদঘর্ম হতে, দেখেছেন বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাইদের মাঝির জীবনের হিসেব কষতে, দেখেছেন গ্রন্থবিলাসীকে পাগলা ষাঁড়ে তাড়া করলে কি করতে হয় কেতাবে তার নিদান খুঁজতে। তিনি দেখছেন প্রায় প্রতিটি আচরণের একটা হাস্যকর সম্ভাবনা আছে। জীবনের প্রায় সব ঘটনা পরম্পরাই কোন না কোন ভাবে খুলে দিতে পারে হাসির উৎসমুখ। কমনসেন্স বর্জিত দৈনন্দিনতাই হয়ে ওঠে ননসেন্স। তাঁর এই ভাবনারই বাণীরূপ হিজিবিজবিজ এবং তার হাসি।

একটি কথা ভুললে চলবে না। সেটি হ'ল যে সময় হযবরল লেখা চলছে সেই সময় সুকুমার জেনে গেছেন যে তিনি দুরারোগ্য কালাজ্বরে আক্রান্ত। এবং আসন্ন মৃত্যুর সঙ্গে তিনি বোঝাপড়ায় আসতে চাইছেন তাঁর নিজস্ব দর্শনের ওপর নির্ভর করে। এই বোঝাপড়ার চেষ্টারই ফল পরিণতি হযবরল। এই রচনার এক বছরের মধ্যে আবোলতাবোল এর ডামি কপির জন্য তিনি লিখবেন তাঁর শেষ লেখা। একদিকে মেঘমুলুকের ঝাপসারাত, অন্যদিকে বেবাক লোকের বোঝার তোয়াক্কা না করে কথার প্যাঁচে কথা কাটা। মৃত্যুর মুখের ওপর তুড়ি মেরে জীবনের অসংগতিকে তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ারডিম বলে হাসতে হাসতে গানের পালা সাঙ্গ করা। হাস্য দর্শনের পূর্ণরূপ দেবে তাঁর জীবনচর্যা। 

একদিকে সত্য আত্মরূপ, অপরদিকে মৃত্যুর অন্ধকার। এই দুই এর মাঝখানে সকৌতুক হাস্যের উৎসার। অস্তিত্ব বা অন্তরতম স্বরূপ যেন হাসি। আমরা হিজিবিজবিজ এর হাসি আর হাসতে হাসতে মারা যাওয়ার কপট আতঙ্কের মধ্যে যেন ফরাসী দার্শনিক জর্জ বাতাই এর কথার প্রতিধ্বনি শুনি : হাসতে হাসতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলে কেমন হয়( Can someone really laugh to death)?

আমরাও প্রশ্ন করতে চাই। ঋতকে, সত্যকে বাক্ এর হাস্যোজ্জ্বল রূপের দ্বারা প্রকাশ করলে কেমন হয়? কেমন হয় ঋতবাক যদি কখনও হয়ে ওঠে ঋতহাস? আমরা তার নবরূপদর্শন পিয়াসী হয়ে রইলাম প্রতীক্ষারত।।



ঋণস্বীকার : 
১) ভারতীয় দর্শন -- দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।
২) মননের মধু -- অরিন্দম চক্রবর্তী।
৩) ঋগ্বেদ সংহিতা --- অনুবাদ রমেশচন্দ্র দত্ত।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - শিবাংশু দে

Posted in


প্রবন্ধ


সোনালি খোলস
শিবাংশু দে



'সোনালি খোলসে'র উপমানটি আমি উপনিষদ থেকে নিয়েছি। যেখানে বলা হয়েছে সত্য কেউ দেখেনি, কারণ তা এক মণিময় পাত্রে সংরক্ষিত আছে। মানুষের যাবতীয় প্রয়াস ঐ পাত্রের বিচ্ছুরিত আলোয় চমক লাগিয়ে ফিরে আসে। অল্পপ্রাণ মানুষ ঐ বিচ্ছুরিত আলোর ঝলসানিটিকেই 'সত্য' ভেবে মোহিত থাকে। আমাদের দেশে ঈশ্বরকেই আদিকবি বা কবিগুরু মনে করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথও সেই রকমই লিখেছেন। তাই নিপাতনে সিদ্ধ হিসেবে সমস্ত 'কবি'ই ঈশ্বরের অংশ এরকম ভাবায় কোনও ক্ষতি নেই। সে তো বিশ্বাসীদের কাছে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই ঈশ্বরের রূপের প্রকাশ। কবিও বা তার বাইরে কেন থাকে। ঈশ্বরের অংশী যে সে কী করে অল্পপ্রাণ, দুর্বল হতে পারে? এভাবে তো ভাবাই যায়। 

কবিতা নিয়ে কয়েকটি মৌল প্রশ্ন অনেকের মতো আমারও মনে সতত জেগে থাকে। গত অন্তত তিরিশ বছর ধরে তার সন্ধান করি। বাল্মীকি থেকে শুরু করে অসংখ্য দেশিবিদেশি প্রিয়জন, যাঁদের মধ্যে কবি, জ্ঞানী, শিল্পী বা নিজের মতো ইতর মানুষজন সবাই রয়েছেন, কিন্তু নানা সংশয়ে এখনও আচ্ছন্ন থাকি। কবিতা বিষয়ে কোনও আপ্তবাক্য প্রকাশ করার স্পর্ধা করিনা। নিজে সংশয়ে থেকে অবস্থান নিতে পারার দৃঢ়তা আমার নেই, সে কথা স্বীকার করার মধ্যেই শান্তি। বিষয়টি ব্যাপক ও বিশাল। অধিক বিস্তৃত হতে গেলে পাঠকদের পক্ষে বাহুল্য হয়ে যায়।

শব্দকে তো ব্রহ্ম বলা হচ্ছে। অস্যার্থ, পবিত্রতম নির্মান। প্রতিটি শব্দের নিজস্ব আত্মা আছে। তাকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করার মধ্যেই সিদ্ধি। তাই শব্দ কোনও সোনালি খোলস হতে পারেনা। তবে শব্দের মায়ায় ভুলে অনেকেই 'আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া ঘুরে মরি পলে পলে....'। একজন সচেতন কবি এই প্ররোচনার ঊর্দ্ধে উঠতে পারবেন এটা প্রত্যাশিত। যেমন নির্জন স্বাক্ষরে প্রথম স্তবকের পরেই 'রয়েছি সবুজ মাঠে, ঘাসে...' যেই শুরু হলো কবিতা এগিয়ে যেতে লাগলো 'আমি সেই পুরোহিত'এর দিকে। মনেই পড়বে না এই কবিতা কোনও দিন 'তুমি তা জানোনা...' বলে শুরু হয়েছিলো। যদিও এভাবে জীবিত বা মৃত কবিদের মাংসকৃমি খোঁটার কোনও প্রয়োজন আমি বোধ করিনা। এ তো এক শাস্ত্রীয় সংগীত উপভোগ করার মতো ব্যাপার। আমি স্বরলিপি, সুরসংস্থান কাগজে লিখে বোঝাবার চেষ্টা করি, সুরের নন্দনলোক আরও দূরে চলে যায়। কোন কবিতা কখন কীভাবে আমাকে ট্রিগার করবে তার বোধহয় কোনও সহজ সমীকরণ নেই।

কবিদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটি ঠিক ভক্ত ও ভগবানের নয়। সেখানে ফুল, চন্দন, মালা, নারায়ণশিলার কোনও স্থান নেই। এমন কী রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও কোনও মুগ্ধতা, বাণিজ্য বা নগরকীর্তনেরও অভিলাষ নেই বিন্দুমাত্র। সম্পর্কটির নাম আমি ঠিক জানিনা, তবে সেটি অসম্ভব জীবন্ত। আবার জীবনানন্দের 'বোধ' মনে পড়ে যায়। সম্পর্কটি শীতে ক্লিষ্ট হয়, গ্রীষ্মে ক্লান্ত হয়, বর্ষায় ভিজতে যায়। মনে হয় যতদিন এই গ্রহে বসবাস থাকবে, "আমি তারে পারিনা এড়াতে, সে আমার হাত রাখে হাতে, সব চিন্তা, প্রার্থনার সকল সময়...' 

ভক্তের অধিকার আমার নেই, কারণ ভক্ত প্রশ্ন করেনা। তার আত্মনিবেদনেই সুখ। আমাদের সংস্কৃতিতে ভক্তের অধিকার চিরকাল মহিমান্বিত করা হয়েছে। নচিকেতার চাইতে প্রহ্লাদের অবস্থান আমাদের গুরুবাদী ঐতিহ্যে সর্বদাই উচ্চকোটীতে। প্রহ্লাদ হওয়া আমার ভবিতব্য নয়। আমি আসলে ডাকঘরের অমল, রাজার চিঠির জন্য বসে থাকি। রাজা তো জানেইনা। 

কবিতা একটা এমন শিল্পমাধ্যম, যা মানুষের বৌদ্ধিক অহমচেতনাকে পরিস্রুত করে গভীরতর চৈতন্যবোধের দিকে গড়িয়ে দেয়। কবিতা বোঝার বা বিশ্লেষণ করার শিল্প নয়। এর স্পর্শ অনেক গহন অভিসারী। আমাদের বাল্যকাল থেকে আমরা যে ধরনের কবিতা অভ্যাস করে থাকি তা পাঠ্যবই থেকে কোনও পদ্যের দু-চার পংক্তি তুলে পরীক্ষার খাতায় 'ব্যাখ্যা লিখহ' নামক ব্যায়ামের সঙ্গেই সাঙ্গ হয়। আমাদের কবিতা পড়তে শেখার জন্য কেউ কখনও উৎসাহ বা প্রশ্রয় দেয়না। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা কবিতার কোনও মূল্য তো দেয়ইনা, বরং নিতান্ত নিরুৎসাহ করে। ছাপমারা কেরানি বা মিস্ত্রি তৈরির কারখানার জগতে কবিতা একটি প্রকৃত threat। 

কবিতার সিদ্ধি বিচারে তার অন্তরতর স্পর্শকেই স্বীকার করি, তার শরীরের ভূমিকা পরে আসে। কবিতার শরীর craft থেকে আসে, আত্মাটা স্বতস্ফূর্ত। কবিতার craft একটি শ্রমসংকুল শিল্প। শিখতে হয়। তাকে আয়ত্ব করতে শুধু সহজাত শিল্পবোধই যথেষ্ট নয়, গহন শ্রমও স্বীকার করতে হয় যথেষ্ট সময় নিয়ে। কবিতাকে সহজগ্রাহ্য করার জন্য নাটকীয়তার আশ্রয় নিতে হয়। তবে এই'নাটকীয়তার' পরিমাপ নির্ণয়সাপেক্ষ। যেন রান্নার লবণ বা ছবির পটের লাল ছোপ। না হলে চলেনা আবার অধিকন্তু সর্বনেশে। ছন্দ, অন্ত্যমিল, লয়, যতি, ঘাত, শ্লেষ, ব্যঞ্জনা, প্রভৃতি সঠিক সামঞ্জস্যে মিলিয়ে দিতে পারলে কবিতার আত্মা স্বীকার্য শরীর ধারণ করতে পারে। এই কলাকৌশলটি স্থান-কাল-পাত্র সাপেক্ষে পরিবর্তনশীল। তাই সার্বভৌম পৃথিবীতে কবিতার শরীরে অভিযোজনজনিত হাজার পার্থক্য চোখে পড়ে। 

কবিতার প্রধান শর্ত হচ্ছে তাকে কবিতা হয়ে উঠতে হবে। কার কলম থেকে পত্রস্থ হয়েছে তা গৌণ। এই যে শর্তটি, অর্থাৎ লেখাটি কবিতা হয়ে উঠলো কি না, তার কিন্তু কোনও সর্বজনগ্রাহ্য সূত্র নেই। একই রচনা পাঠক বা শ্রোতা সাপেক্ষে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কোন লেখাটি কোন পাঠকের হৃদয়ের তন্ত্রীতে অনুরণন সৃষ্টি করবে এবং কখন করবে, তারও কোনও স্থির সিদ্ধান্ত নেই। কবিবিশেষের কোনও রচনা যদি আপ্লুত করে তবে এটা জানিত যে শ্রোতার ভিতরের বারুদ নিজেই তৈরি হয়েছিলো, কবিতাটি শুধু ফুলকির কাজ করেছে। তা বলে তার সার্থকতাকে তুচ্ছ করা যায়না, স্বীকার করতেই হয়। 

সোনা চোখ ঝলসে দেয়। কিন্তু তা ধাতব নির্মাণ। মানবসত্ত্বার অংশ নয়। কবিতার শিকড় মানবসত্ত্বার গভীরতম মাটিতে। তার গৌরব অন্তর্লীন। বিজ্ঞাপনে যেন তার মুখ না ঢেকে যায়।


0 comments:

0

প্রবন্ধ - সোমেন দে

Posted in


প্রবন্ধ


ঠাকুর এবং সাঁই : আরশি নগরের দুই পড়শি 
সোমেন দে



লালন সাঁইয়ের আখড়ার জায়গা কুষ্টিয়া জেলায় বিরাহিমপুর পরগণার ছেউরিয়া গ্রাম যদি ঠাকুরবাড়ির জমিদারির মধ্যে না পড়তো, তাহলে লালন ফকিরকে আমরা চিনতাম কিনা - সে সন্দেহ থেকেই যায়। কারণ এই বাংলার বহু গুণী বাউল ফকিরদের,গম্ভীরা, ভাটিয়ালি আলকাপ ঝুমুর গানের রচয়িতাদের গান কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে, অথবা তাদের রচনা মুখে মুখে ফিরে হয়ত বেঁচে আছে, কিন্তু তাদের নাম কেউ জানেনা। প্রধানত রবীন্দ্রনাথের চেষ্টাতেই লালন ফকিরের নাম এবং তাঁর কাজের কথা দুনিয়ার সামনে উঠে আসে। একটা বিতর্ক যদিও অমীমাংসিত থেকে যায় যে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা। 

এ বিষয়ে এখনও নিশ্চিত ভাবে বলার মতো কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনিতে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহের জমিদারির ভার নেন ১৮৯০ সালে। তার ঠিক এক বছর আগে লালন সাঁই দেহ রাখেন। তাই দুজনের সামনাসামনি না হওয়ারই কথা। তবে জমিদারির ভার পাবার আগেও দু’বার তিনি এসেছিলেন শিলাইদহতে। তখন কি তাঁদের সাক্ষাৎ হয়েছিল? লালনের প্রথম জীবনীকার বসন্ত কুমার পাল মহাশয় তাঁর বইতে সে রকম একটি ইঙ্গিত দিয়েছেন। পাল মহাশয়ের বই ‘মহাত্না লালন ফকির’ বইয়ের ভূমিকা লেখেন বঙ্গীয় পুরাণ পরিষদের সভাপতি শ্রী অজিত কুমার স্মৃতিরত্ন। তিনি এই ভূমিকায় লেখেন – ‘নিরক্ষর পল্লীবাসী হইতে আরম্ভ করিয়া আমরা শুনিয়াছি জ্ঞানবৃদ্ধ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত ফকিরের সহিত ধর্মালাপ করিয়া পরিতৃপ্ত হইয়াছেন। শিলাইদহে মহাকবি রবীন্দ্রনাথের সহিত প্রথম যেদিন ভাবের বিনিময় হয় তাহা জাহ্নবী-যমুনা মহামিলনের ন্যায় রসোচ্ছ্বাসের সঙ্গম রচনা করে।’

এই বইতেই এক জায়াগায় শ্রী বসন্ত কুমার পাল নিজেও লেখেন – ‘সর্বজনবরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথও বহুবার ফকিরকে কাছারী বাড়িতে লইয়া ভাবময় সঙ্গীতের আলোচনায় মুগ্ধ হইয়াছিলেন। আমার ধারণা গুণগ্রাহী ঠাকুর পরিবারই প্রথমে ফকিরের অত্যুচ্চ ভাবধারা উপলব্ধি করেন।’ 

অবশ্য এই ‘ভাবময় সঙ্গীতের আলোচনা’র কোনও প্রতক্ষ্যদর্শীর বিবরণ তিনি উল্লেখ করেননি। 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘মনের মানুষ’ এ লেখক একটু কায়দা করেই লালন ফকির এবং রবীন্দ্রনাথের দেখা হওয়ার ব্যাপারটি খোলসা করেননি। কারণ তিনি উপন্যাসে দেখাচ্ছেন যেবার শিলাইদহে গিয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে লালন ফকিরের দেখা হয়, সে বারে যদিও জ্যোতিদাদার সঙ্গে কিশোর রবি শিলাইদহতে এসেছিলেন, কিন্তু ঠিক যে সময়ে লালন ফকির জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বজরায় এসেছেন, সে সময় রবি নদীর চড়ায় বালি হাঁস দেখতে চলে যান। লালন ফকির আসার পর জ্যোতি দাদা তাঁকে ডাকাডাকি করেও পাননি। এখানে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে লালন ফকিরের কথোপকথনের একটি দীর্ঘ বিবরণ আছে। সেখানে বলা হয়েছে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এক বন্ধুর কাছে লালন ফকিরের গানের সুখ্যাতি শুনেছিলেন। তাই শিলাইদহতে এসে লোক পাঠিয়ে তাঁকে নিজের বজরায় নিয়ে আসেন। প্রথমে লালন ভেবেছিলেন তাঁকে বুঝি শাস্তি দেওয়ার জন্যে ধরে আনা হয়েছে। তারা যে জমিদারের জমিতে এক জঙ্গলের মধ্যে আখড়া করেছে এ বোধহয় তারই শাস্তি। জমিদারের সঙ্গে কথা বলে সে ভুল ভাঙ্গে। জমিদারকে তিনি গান শোনান। তার গানের দর্শন নিয়ে আলোচনা হয়। তারপর লালন ফকির জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেন তাদের আখড়ার জায়গাটিকে নিষ্কর করে দেওয়ার জন্যে। সঙ্গে সঙ্গে নায়েব শচীনবাবুকে নির্দেশ দেন এই গ্রামটিকে নিষ্কর হিসেবে পাট্টা করে দেওয়ার জন্য। এই গোটা ব্যাপারটা চলাকালীন কিন্তু কিশোর রবি, যে বালি হাঁস দেখতে গেছলো সে ফিরে আসেনি। 

এই উপন্যাসের শেষে অবশ্য লেখক বলে দিয়েছেন এই উপন্যাসটি লালন ফকিরের তথ্যভিত্তিক ঐতিহাসিক জীবনকাহিনী হিসেবে একেবারেই গণ্য করা উচিত নয়। আবার তিনি এও বলেছেন এই উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ চরিত্র হিসেবে আসেননি কারণ ‘পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যে’ প্রমাণিত হয় যে দুজনের সাক্ষাৎ ঘটেনি। 

তবে একটি তথ্য জেনে খুব আশ্চর্য লাগে যে, বসন্ত কুমার পাল মশায় ‘মহাত্না লালনফকির’ ১৯৩৯ সালে এই বইটি লেখার সময় রবীন্দ্রনাথকে একটি চিঠি দিয়ে জানতে চান যে, তাঁর সঙ্গে লালন সাঁইএর দেখা হয়েছিল কি না। এই চিঠির উত্তর আসে রবীন্দ্রনাথের একান্ত সচিব সুধীর চন্দ্র কর মশাইয়ের কাছ থেকে। তিনি এই চিঠিতে কি এক অজানা কারণে ব্যাপারটা স্পষ্ট করেননি। চিঠির উত্তরে কর মশাই লেখেন – ‘ফকির সাহেবকে তিনি জানতেন বটে, কিন্তু সে তো বহুদিন আগে; বুঝতেই পারেন এখন সে সব সুদূর স্মৃতির বিষয় তাঁর মনে তেমন উজ্জ্বল নয়।’ 

বসন্ত কুমার পাল নামটির সঙ্গে সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ পরিচিত ছিলেন। কারণ এর আগে প্রবাসীতে বসন্ত কুমার পাল মশাই যখন লালনের উপর একটি প্রবন্ধ লেখেন রবীন্দ্রনাথ সেই প্রবন্ধের প্রসংসা করেন। এ ব্যাপারে বসন্তকুমার পাল লেখেন, ‘এবার অন্য কোথাও নহে, সাহসে ভর করিয়া অশরণের শরণ প্রবাসী সম্পাদক মহাশয়ের দ্বারস্ত হইলাম; আমি বাণীতীর্থের নবীন যাত্রী, অজ্ঞাত অখ্যাত হইলেও ভাবগ্রাহী জনার্দনের অনুকম্পা লাভে সক্ষম হইলাম। বিগত ১৩৩২ সাল ও তাহার পরবর্তী সময়ে আমার প্রবন্ধ প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত হইল; শুধু তাহাই নহে ফকিরের তত্ত্বকথা প্রকাশ সম্মন্ধে সেই সময় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যে উক্তি করেন, তাহাও যে আমার উদ্যমের উপরই প্রযোজ্য, ইহা তিনি পাঠক পাঠিকাদের জানাইয়া দেন।’ 

যে লেখকের লেখা একদা তিনি প্রশংসা করেছিলেন সেই লেখকের চিঠি নিজে উত্তর না দেওয়া রবীন্দ্রনাথের স্বভাবধর্মী নয়। তাই রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিতে বিষয়টি অনুজ্জ্বল হয়ে যাওয়াটা একটু অদ্ভুত লাগে। 

বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি যে তাঁর শেষ দিন পর্যন্ত কি রকম সজাগ ছিল তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। আর তা ছাড়া এই ঘটনার ১৪ বছর আগেও ভারতীয় দর্শন কংগ্রেসে রবীন্দ্রনাথ লালনের গানের ইংরেজী অনুবাদ করে পড়ে ছিলেন। অর্থাৎ তখন পর্যন্ত তিনি লালন ফকিরের রচনা নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। 

রবীন্দ্রনাথের আগে যখন শিলাইদহের জমিদারি তাঁর জ্যোতিদাদার সেই সময় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে যে লালন সাঁইয়ের দেখা হয়েছিল, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের আঁকা একটি লালনের স্কেচ। 

পরে কিছুটা এই স্কেচ থেকে কিছুটা কল্পনা থেকে নন্দলাল বসু একটি ছবি আঁকেন। আমরা সাধারণত এই ছবিটি বা আর অন্যদের হাতে এর কিছু কপি ছবি দেখে থাকি। এটি না থাকলে লালন ফকিরের চেহারা সম্বন্ধে আমাদের কোনও ধারনা থাকত না। 

রবীন্দ্রনাথের লালন সম্মন্ধে প্রথম আগ্রহ জন্মায় শিলাইদহ অঞ্চলের বাউলদের কাছে লালনের গান শুনে। এর মধ্যে ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ গানটি তাঁর বিশেষ প্রিয় ছিল। ‘গোরা’ উপন্যাসে এই গানটি কোলকাতার রাস্তায় এক বাউলের কণ্ঠে শুনে বিনয়ের মনে যে ভাবনার উদয় হওয়ার কথা রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছিলেন, সেটি হয়ত তাঁর নিজেরই কোনও সময়ের ভাবনা। এই গানের মর্মবাণীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিজের জীবন জিজ্ঞাসার কিছু মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। 

‘গোরা’র সেই অংশটিতে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। 

‘আজ সকালবেলায় কী করিবে তাহা ভাবিয়া না পাইয়া তাহার মনটা চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল। পাশের বাড়ির ছাতের উপরে গোটা-তিনেক কাক কী লইয়া ডাকাডাকি করিতেছিল এবং চড়ুই-দম্পতি তাহার বারান্দার এক কোণে বাসা-নির্মাণ-ব্যাপারে পরস্পরকে কিচিমিচি শব্দে উৎসাহ দিতেছিল-- সেই সমস্ত অব্যক্ত কাকলি বিনয়ের মনের মধ্যে একটা কোন্‌ অস্পষ্ট ভাবাবেগকে জাগাইয়া তুলিতেছিল।

আলখাল্লা-পরা একটা বাউল নিকটে দোকানের সামনে দাঁড়াইয়া গান গাহিতে লাগিল--

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়,
ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতেম পাখির পায়

বিনয়ের ইচ্ছা করিতে লাগিল বাউলকে ডাকিয়া এই অচিন পাখির গানটা লিখিয়া লয়, কিন্তু ভোর-রাত্রে যেমন শীত-শীত করে অথচ গায়ের কাপড়টা টানিয়া লইতে উদ্যম থাকে না, তেমনি একটা আলস্যের ভাবে বাউলকে ডাকা হইল না, গান লেখাও হইল না, কেবল ঐ অচেনা পাখির সুরটা মনের মধ্যে গুন্‌ গুন্‌ করিতে লাগিল।’

আবার জীবনস্মৃতির একটি প্রবন্ধে একই গানের উল্লেখ করেছিলেন-

‘ইহার অনেকদিন পরে একদিন বোলপুরের রাস্তা দিয়া কে গাহিয়া যাইতেছিল--

খাঁচার মাঝে অচিন পাখি কম্‌নে আসে যায়
ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতেম পাখির পায়।

দেখিলাম বাউলের গানও ঠিক ঐ একই কথা বলিতেছে। মাঝে মাঝে বদ্ধ খাঁচার মধ্যে আসিয়া অচিন পাখি বন্ধনহীন অচেনার কথা বলিয়া যায়-- মন তাহাকে চিরন্তন করিয়া ধরিয়া রাখিতে চায় কিন্তু পারে না। এই অচিন পাখির নিঃশব্দ যাওয়া-আসার খবর গানের সুর ছাড়া আর কে দিতে পারে!’ 

দুজনে সাক্ষাৎ হোক বা না হোক, রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে থাকাকালীন বিভিন্ন সময়ে লোক পাঠিয়ে লালনের আখড়া থেকে কিছু গান সংগ্রহ করেন। ১৩২২ সনে প্রবাসী পত্রিকায় এই সংগৃহীত গান থেকে কুড়িটি গান প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথ লালনের আখড়া থেকে দুটি খাতা সংগ্রহ করে তাঁর এস্টেটের কর্মচারী বামাচরণ ভট্টাচার্যকে দিয়ে গানগুলি কপি করিয়েছিলেন। 

এই দুটি খাতা নিয়ে লালন ফকিরের শিষ্যদের মধ্যে প্রচুর ভুল ধারনা এখনও আছে। এমন কি অনেকে এও মনে করেন রবীন্দ্রনাথ লালনের লেখা চুরি করে নিজের বলে চালিয়েছেন। 

এই খাতার হাতের লেখা কার এ নিয়ে দু’ রকম মত আছে। কেউ বলেন এ লেখা বামাচরণ ভট্টাচার্য মশায়ের, আবার কেউ বলেন এ লেখা মনিরুদ্দিন শাহ ফকিরের। তবে ১৯৫৮ সালে ডক্টর শ্রী মতিলাল দাস এবং শ্রী পীযূষ কান্তি মহাপাত্রের সম্পাদনায় কলকাতা বিশ্ববদ্যালয় থেকে প্রথম ‘লালন-গীতিকা’ নামে লালনের গানের সঙ্কলন প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের ভুমিকায় সম্পাদক লেখেন - রবীন্দ্রসদনে যে দুটি মূল খাতা রক্ষিত আছে তাতে দেখা যায় লেখা বাংলায় হলেও তা লেখা হয়েছে উর্দু ভাষার মতো উল্টোদিক দিয়ে, মানে ডান থেকে বামে। খাতার শেষ পৃষ্ঠাই আসলে প্রথম পাতা। 

এতে মনে করা যেতে পারে লেখাটি মনিরুদ্দিন শাহ ফকিরের হওয়া সম্ভব। 

তবে এই পাঠ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজে সম্ভবত সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই তিনি পরে আবার শান্তিদেব ঘোষের বাবা কালীমোহন ঘোষকে ছেঁউড়িয়াতে পাঠান।

সব মিলিয়ে বিশ্বভারতীর সংগ্রহে ২৯৮টি গান পাওয়া যায়। ডাঃ মতিলাল দাশ কুষ্টিয়া মহকুমার মুন্সেফ থাকাকালীন নিজস্ব আগ্রহে ৩৭১ টি গান সংগ্রহ করেন।

লালন গীতিকার গানগুলি মোটামুটি ভাবে এই ভাবে পর্যায়ভুক্ত করা যায় –

১ ) বাউল গান, ২ ) বৈষ্ণব ভাব সম্পন্ন গান। বৈষ্ণব ভাব সম্পন্ন গানগুলির মধ্যে রাধা কৃষ্ণ লীলা বিষয়ক কিছু আবার গৌরাঙ্গ লীলাবিষয়ক।

আর বাউল পর্যায়ের গানগুলির মধ্যে দুটি ভাগ। একটিতে সেই mystic জগতের কথা, সহজিয়া রূপকের মধ্যে দিয়ে জীবনের গূঢ় তত্ত্বের কথা বলা। এই জায়াগাটিই রবীন্দ্রনাথকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষিত করেছিল।

বাউল গানের আর এক ভাগে আছে কিছু বাউলদের সাধন পদ্ধতির কথা বলা আছে। 

লালনের গান মূলত তত্ত্ববহুল। মূল বিষয় দেহতত্ত্ব এবং আত্নতত্ত্ব। গানের ভাব অনেক সময় অস্পষ্ট। গানের ভাব এক আলো আঁধারির mystic জগতের মধ্যে চলা ফেরা করে। তাঁর গানে আমাদের বাউল দর্শনের সঙ্গে কিছুটা সুফি দর্শনের মিশ্রণ আছে। অনেকে তাঁর সঙ্গে পারস্যের কবি রূমির রচনার মিল খুঁজে পান। লালন ফকির শুধু গান লিখেই ক্ষান্ত হতেন না। তিনি ঘোড়ায় চড়ে পূর্ব বঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়াতেন। অনেকটা ধর্ম প্রচারকের মতন। 

রবীন্দ্রনাথ তাই ছাত্রদের কাছে বলেছিলেন – ‘মফস্বলে ভ্রমণ করিতে করিতে দেখিতে পাই যে হয়ত পল্লীর নিভৃত ছায়ায় কোন ব্যাক্তি এক নতুন ধর্মসম্প্রদায় সংগঠন করিতেছেন। তাঁহার ভদ্র সম্প্রদায়ে বিশেষ পরিজ্ঞাত নহেন, কিন্তু সমাজের মধ্যে তাঁহারা কি বলিতে এসেছেন, কি বলেছেন এটা জানা উচিত, এইগুলি সংগ্রহ করিতে পারিলে ভারতবর্ষের মধ্যে যে সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্মমত প্রচলিত হইতেছে, অজ্ঞাতে ও অলক্ষিতে, যে সকল শক্তি সমাজের মধ্যে কাজ করিতেছে তাহা অনেকটা বুঝা যাইবে। আমি এইরূপ এক ধর্মপ্রচারকের বিষয় কিছু জানি – তাঁহার নাম লালন ফকির। লালন ফকির কুষ্টিয়ার এক হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ... এই লালন ফকিরের মতে মুসলমান জৈন মত সকল একত্র করিয়া এমন একটি জিনিষ তৈয়ার হইয়াছে যাহাতে চিন্তা করিবার অনেক বিষয় হইয়াছে। এ বিষয়ে সকলের মন দেওয়া উচিত।’ 

এখানে বোঝা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ লালন ফকিরকে একজন ধর্মসম্প্রদায়ের সংগঠক হিসেবে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর একটি গান ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’র উপন্যাসে এবং স্মৃতিকথায় উল্লেখের কথা আগে লেখা হয়েছে। কিন্তু লালনের কোনও গান থেকে সুর নেওয়ার কথা শোনা যায়নি। বরং শিলাইদহের পোস্টম্যান গগন হরকরার দুটি গানের সুরের আদল নিয়ে দুটি বিখ্যাত গান রচনা করেন।

‘হরিনাম দিয়ে জগৎ মাতালে আমার এগলা নিতাই’ থেকে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেও আসে’ এবং ‘আমি কোথায় পাবো তারে আমার মনে মানুষ যে রে’ থেকে আমার ‘সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। 

তবে লালন ফকিরের গানের ভাবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা গানের কিছু মিল অনেকে খুঁজে পান। লালনের গানে যে অপৌত্তলিক গূঢ় আধাত্নিকতার রহস্যময় ভাব আছে তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ হয়ত ব্রাহ্মদর্শনের কিছু মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। সেটাই এক সময় তাঁকে লালন সম্মন্ধে উৎসাহিত করে। তবু কেউ কেউ যে দুজনের রচনায় কোথাও কোথাও মিল খুঁজে পান, সেটা হয়ত নেহাত সমাপতন। উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে একটি লালন ফকিরের রচনা – 

‘ মিলন হবে কতদিনে। 
আমার মনের মানুষের সনে।
ঐ রূপ যখন স্মরণ হয়
থাকে না লোক লজ্জার ভয়
লালন ফকির ভেবে বলে সদাই
ও প্রেম যে করে সেই জানে।’

এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যে রচনার মিল আছে বলে কেউ কেউ মনে করেন, সেটা হলো - 

‘আমার মিলন লাগি তুমি
আসছ কবে থেকে।
তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায়
রাখবে কোথায় ঢেকে।
কত কালের সকাল-সাঁঝে
তোমার চরণধ্বনি বাজে,
গোপনে দূত হৃদয়-মাঝে
গেছে আমায় ডেকে।’ 

পঞ্চান্ন বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ‘বাউল গান’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে এ দেশে হিন্দু-মুসলমানের বিরুদ্ধ ধারাকে যাঁরা মেলাবার চেষ্টা করে যথার্থ মানসতীর্থ হয়ে উঠেছেন, তেমন কয়েকটি নামের উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। সে নাম গুলি হলো রামানন্দ, কবীর, দাদু, রবীদাস এবং নানক। এখানে তিনি লালনের নাম উল্লেখ করেননি। একটু বেশি বয়সে রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত এই বাংলার বাউল-ফকিরদের জীবনযাপনের ধরণ এবং তাদের কিছু মতবাদ নিয়ে নিরুৎসাহিত হয় পড়েন। তিনি এক জায়াগায় উল্লেখ করেছেন ‘বাউলের সুর ও বাণী কোনও এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে’। আমরা জানি, এ রকম অনেক কিছুই তাঁর মনে এসে মিশেছে কোনও এক সময়ে। কিন্তু সে সবের প্রভাব চিরস্থায়ী হয়নি। তাঁর যাত্রাপথের আনন্দগানের ভাব বদলে বদলে গেছে। 

শিলাইদহের কুঠিবাড়ির অভিজাত মানুষজনদের তাঁদের জমিদারী এলাকার এক গ্রাম ছেউরিয়ার প্রজারা দূর থেকে একটু সম্ভ্রমের চোখেই দেখতেন। হুজুর বা মহারাজ বলে সম্বোধন করতেন। ঠাকুর বাড়ির শুধু জ্যোতিরিন্দ্রনাথই নয়, হয়ত সত্যেন্দ্রনাথ, জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গেও লালন ফকিরের সাক্ষাত হয়ে থাকবে । রবীন্দ্রনাথের ভাগনী সরলাদেবী ভারতী পত্রিকায় ‘লালন ও গগন’ বলে একটি প্রবন্ধ লেখেন। ভাইঝি ইন্দিরাদেবী বীণা-বাদিণী পত্রিকায় লালনের দুটি গানের স্বরলিপি প্রকাশ করেছিলেন। এতে বোঝা যায় কুঠিবাড়ির ঠাকুরদের জমিদারীর এক বিশেষ প্রজাকে নিয়ে সে বাড়িতে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। 

তবুও এই দুই ব্যাক্তিত্বের মাঝে যে ‘কত শত কত মতো’ আবরণ ছিল সেটাও বোঝা যায়। সেটা চেষ্টিত, নাকি স্বাভাবিক - তা বলা মুসকিল। 

ভেবে নেওয়া যেতে পারে রবীন্দ্রনাথ এবং লালন ফকির কোনও এক সময়ে ভৌগলিক ভাবে খুব কাছাকাছি এসেও তাঁরা সেই আরশিনগরের পড়শি হয়ে রয়ে গেছিলেন। 

‘বাড়ির কাছে আরশি নগর সেথা এক পড়শি বাস করে।
আমি একদিন না দেখিলাম তারে।।
গিরাম বেড়ে অগাধ পানি 
ও তার নাই কিনারা নাই তরণী পারে 
মনে বাঞ্ছা করি দেখবো তারে 
কেমনে সে গাঁইয়ে যাইরে।।’ 






তথ্য ঋণ -

মহাত্না লালনফকির – বসন্ত কুমার পাল
লালন সমগ্র – মোবারক হোসেন খান
মনের মানুষ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় 
লালন সাঁই কুবির গোঁসাই – সুধীর চক্রবর্তী

0 comments:

2

প্রবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


বাংলার গান বাঙালির গান
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



সংগীতের উৎসের পৌরাণিক ব্যাখ্যায় গান বিনোদনের সামগ্রী রূপেই বর্ণিত। বলা হয়েছে যে বেদমন্ত্র গীতযোগ্য তাইই ‘সামবেদ’। কিছু গানকে বলা হতো ‘অরণ্যগেয়’ কিছু গানকে ‘গ্রামগেয়’। সঙ্গীত শাস্ত্রীরা বলেন এই ‘গ্রামগেয়’ গানগুলিই উত্তর কালের ভারতীয় সঙ্গীত। তাহলে ‘অরণ্যগেয়’ গানগুলি কি? সম্ভবত অ-সংস্কৃত ও বৈদিক ব্রাহ্মণদের অ-গেয়, অনার্যদের কর্মকালীন গানগুলিই ছিল ‘অরণ্যগেয়’ গান। ভরতের নাট্যশাস্ত্রে সামবেদকেই গানের উৎস বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ভরতের নাট্যশাস্ত্রে বলা হয়েছে যেহেতু নারীর বেদ চর্চার অধিকার ছিলনা। তাই তাদের শিক্ষা ও তৃপ্তির জন্য ব্রহ্মা সৃষ্টি করলেন পঞ্চম বেদ – নাট্যবেদ। সমাজের সর্বজনের তৃপ্তির জন্য ঋকবেদ থেকে ‘আবৃত্তি’, সামবেদ থেকে ‘গান’, যযুর্বেদ থেকে ‘অভিনয়’ এবং অথর্ব বেদ থেকে ‘রস’ সমূহ নিয়ে ‘বেদ চর্চায় অনধিকারী নারী’দের শিক্ষা ও তৃপ্তির জন্য সৃষ্টি হলো পঞ্চম বেদ। অথচ গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধেও মেয়েদের গান করাকে হীনবৃত্তি বলে মনে করা হতো। 

পৌরানিক ব্যাখ্যায় গান হলো দেবভোগ্য বিনোদনের সামগ্রী, গীত-বাদ্য, ইত্যাদি গন্ধর্বদের বিদ্যা বা ‘গান্ধর্ব’, তাদের পৃথক জগত। তারা দেবতা নন, কিন্তু ‘দেবতুল্য’। গন্ধর্বলোকের উল্লেখ বেদ-পুরাণে আছে, তারা ‘অনার্য’ নয়। অনার্যদের গান বেদ পুরাণ স্বীকৃত ছিলনা। আমাদের অতি পরিচিত লোকগাথা বেহুলা-লখীন্দরের কাহিনি আমরা জানি – সর্প দংশনে মৃত লখীন্দরের দেহে পুনরায় প্রাণ সঞ্চার করতে দেবতারা সম্মত হয়েছিলেন সদ্য বিধবা তরুণী বেহুলার দ্বারা তাঁদের নৃত্য-গীতের মাধ্যমে বিনোদিত করার শর্তে। সঙ্গীত যে দেবভোগ্য বিনোদন সামগ্রী এটা প্রতিষ্ঠিত করতেই মনুষ্য রচিত এই কল্প-কথা। তারপর যখন শ্রেণী বিভাজন হলো গান হয়ে গেলো রাজসভায় বন্দি – রাজা-বাদশাদের বিনোদন সামগ্রী। তানসেন থেকে যদুভট্ট কিংবা আরও পরে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ সৃষ্ট নব্য জমিদারদের বাগান বাড়ির সঙ্গীত বিলাস তো সেই একই পরম্পরা। ‘জনপদের গান’ কিন্তু ছিল বাংলার পল্লীতে পল্লীতে লোক-আচার ও ধর্মিয় আবেগ ও আচারের মধ্যে।

রাজসভার গান এখানে আলোচ্য নয়, বিষয় বাংলা গানের বিবর্তন - সেকাল থেকে একালে পৌঁছানোর জন্য তার পথ-পরিক্রমাটিকে বোঝা, কারণ বাংলা গানের শিকড় কোনওদিনই রাজসভার গান বা ওস্তাদি গানের মধ্যে ছিলনা। মুঘল বাদশাহ আকবরের দরবারে মিয়া তানসেন যখন রাগসঙ্গীতের প্রবাদ পুরুষ হয়ে উঠেছেন তখন কিন্তু সেই সুর বাংলার পল্লীতে এসে পৌঁছায়নি। বাঙালি তার গান তৈরি করেছে তার আপন জীবন-ছন্দ দিয়ে, নিজস্ব ধারায় কাব্যের আশ্রয়ে। পণ্ডিত দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, পল্লীবাংলার নিজস্ব সুরকে হিন্দি মনসা মঙ্গলে ‘বাঙ্গাল রাগ’ বলে উল্লিখিত হয়েছে। পণ্ডিত দীনেশচন্দ্র লিখেছেন “ইহা আমাদের চির পরিচিত ‘ভাটিয়াল রাগ’। এই সুর কোনও প্রচলিত ধারার ধার ধারে না, উহা পল্লীহৃদয়ের সমস্ত করুণ রস নিংড়াইয়া লইয়া আত্মপ্রকাশ করিত। এই নদীমাতৃক দেশের ইহা নিজস্ব সুর”। গান কেন বাঙালির এত কাঙ্খিত প্রাণের জিনিস তা রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সংগীত চিন্তা’ গ্রন্থে জানিয়েছেন “আত্মপ্রকাশের জন্য বাঙালি স্বভাবতই গানকে অত্যন্ত আপন করে চেয়েছে...গানকে ভালোবেসেছে বলেই সে গানকে আপন হাতে, আপন মনের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করতে চেয়েছে।” শুরুর লগ্ন থেকেই বাংলা গান ছিল জনপদের গান এবং কাব্য আশ্রিত। সমাজের রূপান্তর বা এগিয়ে চলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে গান নানান রূপে, নানান ধারায় প্রবহমান থেকেছে, সমৃদ্ধ হয়েছে।

বাংলায় শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের সময়কালে বাংলা যে ভক্তি রসের প্রবল ধারায় মথিত হয়েছিল, সেটাই বাংলার প্রথম নবজাগরণ কাল। সেই সময়কাল বাংলা গানেরও প্রথম নব জাগরণ কাল। তারও প্রায় পাঁচশ বছর আগে চর্যাপদ কালে মঙ্গল কাব্য সমূহে যে গান তাও নিশ্চিত ভাবেই জনপদের গান। কিন্তু সে গানের গায়ন রীতি বা ধারাবাহিকতা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়না। কেন যায়না তার একটা কারণ হতে পারে – প্রায় সমসাময়িক কালেই ঘটে গিয়েছিল মুসলমান আক্রমণ ও ইসলামের প্রবেশ। তবুও সুফি ও ভক্তি আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে, ঘটে গিয়েছিল শ্রী চৈতন্য দেবের আবির্ভাবে বাংলার প্রথম নব জাগরণ – বাংলা গানেরও নবজাগরণ। চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস প্রমুখের কীর্তনকে বলা হতো মহাজন পদাবলী। ‘কীর্তন’ই বাংলার প্রথম নিজস্ব সঙ্গীত ধারা। ১৫৮২ খৃস্টাব্দে নরোত্তম দাস ঠাকুর প্রবর্তন করেন ‘কীর্তন’ গানের। সমকালে মুঘল সম্রাট আকবর বাদশার দরবারে, মিয়া তানসেন উজ্জ্বলতম রত্ন রূপে বিরাজমান। সুতরাং আর একবার বলতে হয় বাংলা গান তার জন্মলগ্ন থেকেই জনপদের গান, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তার কোনও শিকড় কোনওদিন ছিলনা। সেই জন্যই প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীত শাস্ত্রে কীর্তন গানের কোনও উল্লেখ পাওয়া যায়না। কীর্তন গানেরও নানান ঘরাণা বা গায়ন। যেমন নরোত্তম দাস ঠাকুর প্রবর্তিত ‘গরাণহাটি ঘরাণা’, মনোহর দাস সৃষ্ট ‘মনোহরশাহী ঘরাণা, পদকর্তা বিপ্রদাস ঘোষ প্রবর্তিত ‘রেনেটি ঘরাণা’, গোকুলানন্দ প্রবর্তিত ‘ঝাড়খণ্ডী ধারা’, ইত্যাদি। বাঙালির আপন সঙ্গীতধারায় আর এক বিশিষ্ট অবদান ‘আগমনী গান’। এ গানও বাঙালির নিজস্ব। আগমনী গানে বাৎসল্য ও করুণরসের অপূর্ব সমাবেশ দেখা যায়। এ গানের বিষয়বস্ত্ত পল্লীবাংলার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাদের গার্হস্থ্য জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এবং বাস্তবতার এক নিখুঁত চিত্র পাওয়া যায় আগমনী গানে। আগমনী গানের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন রামপ্রসাদ সেন। পরবর্তী সময়ে আরও যাঁরা এ গান রচনায় বাংলার সঙ্গীতভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কমলাকান্ত ভট্টাচার্য (আনু. ১৭৭২-১৮২১), রামবসু (১৭৮৬-১৮২৮) ও দাশরথি রায় (১৮০৬-১৮৫৭), প্রমুখ। 

মধ্যযুগের বাংলাগানের ধারায় আর একটি অসামান্য সংযোজন বাউল গান। অনুমান করা হয় খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে কীর্তন গানের উদ্ভবের সমকালে বা তারও আগে বাউল সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল। কারণ মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণ বিজয় ও কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ গ্রন্থে বাউল শব্দটির ব্যবহার আছে। একালের লোক-আঙ্গিক বাংলা গানের ধারায় বাউল সুরের জনপ্রিয়তা প্রবলতম। অবশ্য বাউল গান লোকপ্রিয় হয়ে ওঠে লালন শাহ বা লালন ফকীরের সৃষ্টিগুনে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে। ১৯ শতকের মাঝামাঝি হরিনাথ মজুমদার বা কাঙ্গাল হরিনাথও (১৮৩৩) এই গানের সার্থক প্রচারক ছিলেন। দুশো বছর পরে আজকের নবীন প্রজন্মের কাছেও সমান লোকপ্রিয় বাউল গান। লালন তাঁর সমগ্র জীবনচর্যার মধ্য দিয়ে জাত-ধর্মের বিরুদ্ধে তীব্র জেহাদ বজায় রেখেছিলেন তাঁর গানে। বাউল দর্শন মানবমুখী ও জীবন নির্ভর লালনের গানেরও মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মানুষ। রামমোহন রায়ের সমসাময়িক ছিলেন লালন। প্রায় একই সময়ে দুজনের জন্ম। রামমোহনের আধুনিক চিন্তা আঘাত করেছিল সমাজের অন্ধত্ব, কু-প্রথা ও কু-সংস্কারকে। অশিক্ষায় আচ্ছন্ন গ্রামীণ লোকচিত্তে কি আলোড়ন চলছিল তার লেখা-জোখা আমরা প্রায় কিছুই জানি না। লালন প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় অন্নদাশঙ্কর রায়ের মন্তব্য উদ্ধার করি। তিনি লিখেছেন, দেশের শিক্ষিত নাগরিকমহলে যে সময়ে রেনেশাঁস বা নবজাগরণ চলছিল, সেই সময়েই চলেছিল অশিক্ষিত গ্রামীণ লোকচিত্তে অন্য এক আলোড়ন। এ সম্বন্ধে ইতিহাস এখনও লেখা হয়নি। সে রকম ইতিহাস যখন লেখা হবে তখন লালনকে তাঁর যথার্থ পরিপ্রেক্ষিতে পাওয়া যাবে।

প্রাক আধুনিক যুগ বা মুঘল যুগের শেষ পর্বে বাংলা কাব্য সঙ্গীতে আবির্ভাব হয়েছিল রায়গুণাকর ভরত চন্দ্রের (১৭১৩-১৭৬১)। তাঁর রচিত ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যে, আদিরসের প্রাধান্য থাকলেও এটি মধ্যযুগের বাংলা সঙ্গীত ধারার উল্লেখযোগ্য নিদর্শন রূপেই মান্য। প্রায় সমকালেই সৃষ্ট হয়েছিল হরু ঠাকুর (১৭৩৯) প্রবর্তিত ‘কবিগান’। কিন্তু অষ্টাদশ শতকে বাংলা গানে আধুনিক কাব্য সঙ্গীতের ছন্দময়তা প্রথম আসে রামপ্রসাদ সেনের শ্যামা বিষয়ক গানে। আজ আড়াইশ বছর পরেও সে গানের প্রতি বাঙালির মুগ্ধতা কিছুমাত্র কমেনি। ‘মন রে কৃষিকাজ জানো না / এমন মানব জমিন রইলো পতিত / আবাদ করলে ফ’লতো সোনা’ এ শুধু সঙ্গীত ছন্দই নয়, আধুনিক কাব্যের মতো এক দার্শনিক সত্যকেও প্রকট করে। এবং কখন? যখন কলহপ্রবণ, পরশ্রীকাতর, আত্মমর্যাদাহীন বাঙালি খাল কেটে কুমির আনার মতো ঔপনিবেশিক শক্তিকে তাদের নয়া শাসনকর্তা রূপে আহ্বান জানাতে চ’লেছে। ‘রামপ্রসাদ বৈষ্ণবদের ভাব আত্মস্ত করে কঠোর শাক্ত ধর্মকে কোমল শ্রী দান করেছিলেন। রাজনৈতিক বিপ্লব ও দুর্ভিক্ষাদি নানা বিপদে পড়িয়া বাঙলা তখন নয়নজল দিয়া মাতাকে পূজা করিতে চাহিয়াছিল’ – রামপ্রসাদের গান সেই শত সহস্র বঙ্গসন্তানের নয়নজল – আকুল কন্ঠের ‘মা’ ডাক। রামপ্রসাদ সেনের (১৭২১-১৭৮১) সঙ্গীত রচনা কাল বা তার জীবন কালেই ঘটে গেছে পলাশির যুদ্ধ, বাংলায় দুশো বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত্তি স্থাপন এবং রায়গুণাকরের মৃত্যু। বিস্ময়কর এই যে, প্রায় আড়াইশো বছর আগে লোকান্তরিত রামপ্রসাদ সেন আজও বেঁচে রয়েছেন তাঁর গানে। তাঁর গান যেন উদার আকাশের বিশালতা, সুরের মাধুর্যে মনের সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রণা, বিক্ষোভ বিদ্বেষ মুছে দেওয়ার শক্তি নিয়ে এখনও বাংলার কাব্যসঙ্গীতের ভাণ্ডারে অক্ষয় ঐশ্বর্য হয়ে রয়েছে।

রামপ্রসাদ তাঁর সৃষ্টির মধ্যগগনে থাকাকালীন আরও আধুনিকতার ছোঁয়া নিয়ে এল ‘বাংলা টপ্পা গান’, প্রবর্তন করলেন রামনিধি গুপ্ত বা নিধু বাবু (১৭৪২ – ১৮২৯)। টপ্পা গানের উৎপত্তি পাঞ্জাবে হলেও রামনিধি গুপ্ত বা নিধু বাবুই বাংলায় টপ্পা গানের প্রচলন করেন। কাব্যছন্দ আশ্রিত টপ্পা গান বাংলার নিজস্ব গান হয়ে ওঠে – হয়ে ওঠে বাংলা কাব্য সঙ্গীতের দিক-দর্শনী। টপ্পা গান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কথা – এ তো অত্যন্ত বাঙালির গান। বাঙালির ভাবপ্রবণ হৃদয় অত্যন্ত তৃষিত হয়েই গান চেয়েছিল, তাই সে আপন সহজ গান আপনি সৃষ্টি না করে পারেনি (সঙ্গীত চিন্তা)। 

রামপ্রসাদী এবং টপ্পা গানের প্রায় সমকালেই সৃষ্টি হয়েছিল হরু ঠাকুর ও রাম বসু প্রবর্তিত ‘কবিগান’ (১৭৩৯)। ভারত চন্দ্র রায় গুণাকরের ‘বিদ্যা সুন্দর’ থেকে রামনিধি গুপ্তর টপ্পা গান – এ সবই প্রবর্তিত হয়েছিল মধ্য যুগের সেই সময়ে যখন ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল শাসনের গ্রন্থি শিথিল হতে শুরু করেছে। বাংলাতে তখন স্বাধীন নবাব আলিবর্দী খাঁর শাসন। বাংলা গান প্রাক-আধুনিক যুগে প্রবেশ করতে চলেছে। 

মধ্যযুগের আর একটি আঞ্চলিক সঙ্গীত ধারা ‘আখড়াই গান’। শান্তিপুরে এই গানের উৎপত্তি ১৮ শতকের গোড়ায়, নিধুবাবুর মাতুল কলুই চন্দ্র সেনকে বাংলায় আখড়াই গানের প্রবর্তক বলা হয়। আদতে ‘আখরাই গান’ উত্তর ভারতের ‘আখাড়া গানে’র এক বিবর্তিত রূপ। সেই হিসাবে ‘আখড়াই’ অনেক প্রাচীন সঙ্গীত ধারা। বাংলাতে এসেও এই গান নানা ভাবে বিবর্তিত হয়েছে। মালদহ, নদীয়া কিংবা হুগলীতে ভিন্ন ভিন্ন রূপে আখড়াই গান পরিবেশিত হতো। শেষে বাবু কলকাতায় এসে আখড়াই গান মার্জিত হয় কলুই চন্দ্র সেনের হাতে। এই গানের দুটি পর্যায় থাকতো – ‘খেউড়’ ও ‘প্রভাতি’। পরে এই গানেরই আর একটি রূপ ‘হাফ আখড়াই’ সৃষ্টি হয়, নিধু বাবুরই এক শিষ্য মোহন চাঁদ বসু উদ্ভাবন করেন ‘হাফ আখড়াই’। এই রীতির গানও বেশি দিন স্থায়ী হয়নি, কারণ ততদিনে এসে গেছে ‘পাঁচালি’ গান ও আরও আকর্ষণীয় ‘থিয়েটারের গান’। ‘আখড়াই গান’ কবিগানেরই আর এক রূপ একথাও মনে করা হয়। কারণ কবি গানের চারটি পর্যায়ের দুটি পর্যায় ছিল ‘খেউড়’ ও প্রভাতি’ – আখড়াই গানেও তাই। অনেক গবেষক বলেন অস্লীল আদিরসাত্মক ‘খেউড়’ থেকেই কবিগানের উৎপত্তি। কবিগানের তিনটি মূল বৈশিষ্ট – সংলাপ ধর্মী গান অর্থাৎ গানের মধ্যে প্রশ্ন ও উত্তর। খেউড়’ বা অশ্লীলতার প্রয়োগ এবং হেঁয়ালি মূলক তত্ত্বের প্রয়োগ। প্রায় গ্রাম্য মেয়েদের ‘ঝুমুর’ গানেও প্রশ্নোত্তর মূলক গান থাকতো, তবে তা নৃত্য সহযোগে। তাই অনেক গবেষক মনে করেন ‘ঝুমুর’ থেকেই ‘কবি গানে’র উৎপত্তি। এগুলি সবই আঞ্চলিক গানের বিভিন্ন রূপ মাত্র, নানান নানান রূপে বিবর্তিত হয়েছে- পরিমার্জিতও হয়েছে। প্রথমে ‘কবি গানে’ ‘খেউড়’ বা অস্লীলতার প্রয়োগ হতো, আবার সেই কবিগানই নদীয়ায় বৈষ্ণব প্রভাবে গীত হতো কৃষ্ণ উপাখ্যানকে বিষয়বস্তু করে। কবিগানের বিবর্তনে ‘ঝুমুর’ গানের প্রভাব ছিল, এতে গবেষকদের কোনও সংশয় নেই। অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত কলকাতার বাবু সমাজে ‘কবি গান’ অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। রাম বসু, হরু ঠাকুর, ভোলা ময়রা, এন্টনি ফিরিঙ্গি, মাধব ময়রা, প্রমুখ ছিলেন সেকালের প্রসিদ্ধ কবিয়াল। 

এই আলোচনার ক্ষেত্রে, বাংলা গানে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব-পরবর্তী সময়কালকে আধুনিক যুগ বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছি, কারণ তখন থেকেই বাংলা গান আধুনিকতার ছোঁয়া পেলো – যথার্থ অর্থে আধুনিক হতে শুরু করলো। রবীন্দ্রনাথই বাংলা গানের মুক্তিদাতা -এই উচ্চারণে কোন সংশয় নেই। প্রাক-আধুনিক পর্বের বাংলা গানের ধারায় সর্বাধিক উল্লখযোগ্য সংযোজন দাশরথী রায়ের (১৮০৬-১৮৫৮) ‘পাঁচালি গান’। দাশরথী রায়কে ‘পাচালি’র জনক না বলে এ গানের শ্রেষ্ঠ রূপকারই বলা উচিত। দাশরথী রায়ের অনেক আগে থেকেই পল্লী বাংলার এবং উড়িষ্যার বৈষ্ণব সম্প্রদায় এ গান গাইতেন। পরে নব্য বাবু সমাজের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে ‘পাঁচালি’ গায়ন রীতি ও সুরে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে, কৃষ্ণ উপাখ্যান থেকে রামায়ণ, মহাভারত ও মঙ্গল কাব্য এ গানের বিষয় বস্তু হয় এবং কীর্তন, আখড়াই, টপ্পা ও কবি গানের কিছু সংমিশ্রণ ঘটে। আধুনিক ‘পাচালি’গানের প্রথম রূপকার ছিলেন লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাস। আনুমানিক ১৮২০তে লক্ষ্মীকান্তর মৃত্যু হয়, দাশরথী রায় তখন কিশোর । লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাসের পর শুরু হয় দাশরথী রায়ের পাঁচালির যুগ। প্রাক আধুনিক যুগের আরও এক সঙ্গীত ধারা গোবিন্দ অধিকারীর (১৭৯৯-১৮৬১) ‘যাত্রা গান’। 

১৮৫৮তে ‘পাঁচালি’ গানের শ্রেষ্ঠ রূপকার দাশরথী রায়ের মৃত্যু আর তার তিন বছর পরে রবীন্দ্র নাথের জন্ম। রবীন্দ্রনাথের স্পর্শে বাংলা গান আধুনিক হবে, কিন্তু কি ছিল তার আবির্ভাব পূর্ববর্তী বাংলা গান, কেমন ছিলো বাঙালির গান শোনার কান? চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলার সমাজে নতুন মধ্যশ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল সেই মধ্যশ্রেণীর ‘বাবু কালচার’ বাঙালির রুচি বিকৃতি ঘটিয়েছিল, সে কথা আমরা ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ বা ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ’ গ্রন্থে জেনেছি। তাদের রুচি তখন আদিরসাত্মক ‘কবিগান’, ‘আখড়াই’, ‘হাফ আখড়াই’, ‘ঝুমুর’, ‘তরজা’, ‘পাঁচালি’, ইত্যাদিতে। রবীন্দ্রনাথ যখন বাল্য বয়সে ‘ব্রহ্মসঙ্গীত’ রচনা করছেন, দাদা জ্যোতিরীন্দ্রনাথের গান গাইছেন, শাস্ত্রীয় গায়নের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি প্রতিভা যদুভট্টর কাছে তালিম নিচ্ছেন, বাঙালি সমাজ তখন মেতে আছেন সেই সব নিম্ন রুচির গানে। ‘কীর্তন’, ‘রামপ্রসাদী’, ‘টপ্পা’, দাশরথী রায়ের ‘পাচালি’, এমনকি ‘আখড়াই’ গানের পরিশীলিত কাব্য ভাষা থেকে কলকাতার ‘নব্য বাবু সমাজ’ মেতেছিল নিম্নরুচির গানে তথাপি, বিদ্যাসুন্দর থেকে থিয়েটারের গান – বাংলা গানের এই যে ধারা, তা নিশ্চিত ভাবেই ‘জনপদের গান’, তাই শাস্ত্রীয় গান, যাতে বাংলা গানের শিকড় ছিলনা রবীন্দ্রনাথকে আকর্ষণ করেনি। ‘কবিগান’কে ‘নষ্ট পরমায়ু কবির দলের গান’ বলে আখ্যায়িত করেও বলেছেন – ‘তথাপি এই গান আমাদের সাহিত্য এবং ইতিহাসের একটি অঙ্গ – এবং ইংরাজ রাজ্যের অভ্যুদয়ে যে আধুনিক সাহিত্য রাজসভা ত্যাগ করিয়া পৌরজনসভায় আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছে এই গানগুলি তাহারই প্রথম পথপ্রদর্শক’ (সঙ্গীত চিন্তা)।

রবীন্দ্রনাথ বাংলা গানের মুক্তি ঘটালেন সত্য – কিন্তু সেই মুক্তির প্রস্তুতিতে আরও একটি সঙ্গীত ধারা সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলেছিল সেটি হলো- ‘থিয়েটারের গান’। কত যে কালজয়ী থিয়েটারের গান বাংলা গানের বৈভব বৃদ্ধি করেছে তা পৃথক আলোচনার বিষয়। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তখন সমাজ সংস্কার, শিল্প-সাহিত্যে-শিক্ষা-সংস্কৃতি - সবেতেই এক অভূতপূর্ব জোয়ার। থিয়েটারে গান হয়ে উঠেছিলো বাঙালির সহজলভ্য বিনোদন সামগ্রী। ১৭৯৫এ রুশ পর্যটক গেরেসিম লেবেডফ কর্তৃক ‘দি ডিসগাইস’ নাটকের অনুবাদ ‘কাল্পনিক সঙ বদল’ নাটকের মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে বাংলা থিয়েটারের সূচনা হয়েছিল, কিন্তু সে থিয়েটারের কোনও ধারাবাহিকতা ছিলনা, কেমন ছিল সে থিয়েটারের গান তাও জানার উপায় নেই। বাঙালিকে অপেক্ষা করতে হলো আরও ৬৩ বছর, যখন রাম নারায়ণ তর্করত্ন প্রথম অভিনয়োপযোগী বাংলা নাটক ‘কুলিন কূল সর্বস্ব’ লিখলেন। এরপর জমিদার বাড়ির আঙ্গিনার থিয়েটার কলকাতার নব্য অভিজাত শ্রেণীর সবচেয়ে আদরের বিনোদন সামগ্রী। বাঙালির থিয়েটারে বিবর্তন আমার আলোচ্য বিষয় নয়, তবু ছুঁয়ে যেতে হবে বাঙালির গান শোনার কান তৈরী হওয়া এবং বাংলাগানের আধুনিক হয়ে ওঠার প্রস্তুতিপর্বটিকে বোঝার জন্য। ১৮৫৯এ বাংলার নাট্যক্ষেত্রে প্রবেশ করলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, তাঁর প্রথম নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’ অভিনীত হলো ‘বেলগাছিয়া থিয়েটার’এ। এবং শর্মিষ্ঠা নাটকের গীতিকার রূপে বাংলা থিয়েটারে প্রবেশ করলেন মহাকবি গিরীশ চন্দ্র ঘোষ ১৮৬৪তে। তারপর জমিদার বাবুদের আঙ্গিনার বন্দিদশা থেকে বাংলা থিয়েটার মুক্তি পেলো ‘ন্যাশনাল থিয়েটারের’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ১৮৭২এ, থিয়েটার হয়ে গেলো সর্বসাধারণের। গানই ছিলো সেকালের থিয়েটারের প্রাণ, জনপ্রিয়তার সেরা উপাদান। নাটকে একাধিক গান সংযোজিত না হলে সে নাটক দর্শক আনুকুল্য পেতোনা। ক্ষীরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ‘আলিবাবা’ নাটকে ৩৬টি গান ছিল। নাটকের গানই ক্ষীরোদ প্রসাদকে নাট্যকার রূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল, ‘ধন ধান্যে পুষ্প ভরা’ সহ দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের প্রায় সব গানই থিয়েটারের গান। বাঙালির গান শোনার কান প্রস্তুত, গানই তার সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত প্রাণের জিনিস, সেকথা চতুর ইংরাজ বণিকদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। ইতিমধ্যে টমাস আলভা এডিসন তাঁর অত্যাশ্চর্য ‘ফোনোগ্রাফি’ যন্ত্র আবিস্কার করেছেন। একটি মোম নির্মিত চোঙাকৃতির আধারে ধ্বনি মুদ্রণ করে পুনরায় তা শোনার এই যন্ত্রটিই পরিচিত হলো ‘গ্রামোফোন’ বা বাঙালির ‘কলের গান’ নামে। উনিশ শতকের একদম শেষ প্রান্তে এদেশে ‘কলের গান’ চলে এলো, আর কালো গালার চাকতিতে ধ্বনি-মুদ্রিত বাংলা গান সেই যন্ত্রবাহিত হয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তের অন্দর মহলে পৌঁছে গেলো, উন্মুক্ত হয়ে গেলো এক নতুনতর বিনোদন সামগ্রীর বিপণন দরজা। গ্রামোফোন কম্পানী বিজ্ঞাপন করতো ‘সুখী গৃহকোণ শোভে গ্রামোফোন’। ১৯০২তে অমরেন্দ্র নাথ দত্তর এমারেল্ড থিয়েটারের দুই নৃত্য-গীত শিল্পী শশিমুখী ও ফণীবালার কন্ঠে গীত দুটি বাংলা গান রেকর্ড করা হলো। শশীমুখীর কন্ঠে ‘সরল মনে সরল প্রাণে’ এবং ফণীবালার কন্ঠে ‘আমি কি কেবলই কুসুমেরই’ – এই দুটি গানই কলের গানের প্রথম ধ্বনি-মুদ্রিকা বা রেকর্ড। 

সেই শুরু। বাংলা গানের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো, বাংলা গান ‘সেকাল থেকে একালে’ প্রবেশ করলো। বাঙালির জনপদের গান হয়ে গেলো বিপনন সামগ্রী। সে কথা লিখবো আর একটি নিবন্ধে। হয়তো সে নিবন্ধের শিরোনাম হবে ‘গানের একাল – গানের আকাল’।


2 comments:

0

প্রবন্ধ - কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


গানে ও কবিতায় রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান ভাবনা 
কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় 



রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা যেন এক অতলান্ত মহাসাগর। তিনি কবি, গীতিকার, নাট্যকার, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, সমালোচক, শিক্ষাবিদ, শিল্পী, দার্শনিক, সুরকার, গায়ক, সমাজ সংস্কারক, স্বাধীনচেতা ও মানব বন্ধু। তিনি বিজ্ঞানী না হয়েও ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। তাঁর প্রতিভার ব্যাপ্তি বিশাল। তাঁর কর্ম ছিল বহুমুখী। সৃজনে ছিলেন তিনি কালজয়ী। 

আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। তাঁর সাহিত্যে, কাব্যে, সঙ্গীতে প্রবেশ করার সাধ্য আমার নেই। তাই আমার এই প্রবন্ধে আমি খুঁজে বেড়ানোর চেষ্টা করব বিজ্ঞানমনস্ক রবীন্দ্রনাথকে, প্রকৃতিপ্রেমী রবীন্দ্রনাথকে। 

ইদানীং অনেক লেখাতেই দেখি রবীন্দ্রনাথকে বিজ্ঞানী হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস। কিন্তু বিজ্ঞানী বলতে যা বোঝায় তা তিনি কোনওদিনই ছিলেন না। তিনি নিজেও কোনওদিন তা দাবী করেননি। তবে বিজ্ঞানের নির্যাসটুকু গ্রহণ করেছিলেন মনেপ্রাণে। তাঁর এই বিজ্ঞানমনস্কতার শুরু একেবারে শৈশবে। তখন তিনি নর্মাল স্কুলের ছাত্র। সেখানেই তাঁর বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। তিনি তাঁর জীবনস্মৃতি গ্রন্থে লিখেছেন-

“মাঝে মাঝে সীতানাথ দত্ত মহাশয় আসিয়া যন্ত্র তন্ত্র যোগে প্রাকৃতবিজ্ঞান শিক্ষা দিতেন। এই শিক্ষাটি আমার কাছে বিশেষ ঔৎসুক্যজনিত ছিল। জ্বাল দিবার সময় তাপসংযোগে পাত্রের নিচের জল পাতলা হইয়া উপরে উঠে, উপরের ভারী জল নিচে নামিতে থাকে এবং এইজন্যই জল টগ্‌বগ্‌ করে— ইহাই যেদিন তিনি কাচপাত্রে জলে কাঠের গুঁড়া দিয়া আগুন চড়াইয়া প্রত্যক্ষ দেখাইয়া দিলেন সেদিন মনের মধ্যে যে কিরূপ বিস্ময় অনুভব করিয়াছিলাম তাহা আজও স্পষ্ট মনে আছে….। যে-রবিবার সকালে তিনি না আসিতেন, সে-রবিবার আমার কাছে রবিবার বলিয়াই মনে হইত না।” 

মহাকাশের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় কিশোর বয়সে। ডালহৌসি পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে বাবার কাছে জ্যোতির্বিজ্ঞানের শিক্ষা মহাকাশ সম্পর্কে তাঁর কৌতুহল অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। বিশ্বপরিচয় গ্রন্থে তিনি এ বিষয়ে লিখেছেন-

“…তিনি আমাকে নক্ষত্র চিনিয়ে দিতেন, গ্রহ চিনিয়ে দিতেন, শুধু চিনিয়ে দেওয়া নয়, সূর্য থেকে তাদের কক্ষচক্রের দূরত্বমাত্রা, প্রদক্ষিণের সময় এবং অন্যান্য বিবরণ আমাকে শুনিয়ে যেতেন। তিনি যা বলে যেতেন তাই মনে করে তখনকার কাঁচা হাতে আমি একটা বড় প্রবন্ধ লিখেছি। স্বাদ পেয়েছিলুম বলেই লিখেছিলুম— জীবনে এই আমার প্রথম ধারাবাহিক রচনা আর সেটা বৈজ্ঞানিক সংবাদ নিয়ে।” 

এরপরে তিনি লিখেছেন- 

“তারপর বয়স আরও বেড়ে উঠল।… সহজবোধ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই যেখানে যত পেয়েছি পড়তে ছাড়িনি।… ক্রমাগত পড়তে পড়তে মনের মধ্যে বৈজ্ঞানিক একটা মেজাজ স্বাভাবিকভাবে হয়ে উঠেছিল।…” 

রবীন্দ্রনাথের এই স্মৃতিচারণ থেকে বোঝা যায় তাঁর এই বিজ্ঞান ঔৎসুক্য এবং বিজ্ঞানমনস্কতা সারাজীবন ধরেই ছিল। কাব্যে, নাটকে, গানে তিনি এর সাক্ষর রেখে গেছেন। চিন্তাভাবনায় এমনকী নানা পরিকল্পনাতেও আমরা খুঁজে পাই তাঁর বিজ্ঞানমানসিকতার পরিচয়। যেমন ‘জন্মদিনে’ বই-এর একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন-

“যেমন সুদুর ওই নক্ষত্রের পথ 
নীহারিকা জ্যোতির্বাষ্প মাঝে 
রহস্যে আবৃত 
আমার দূরত্ব আমি দেখিলাম তেমনি দুর্গমে— 
অলক্ষ্য পথের যাত্রী অজানা তাহার পরিণাম।” 

‘জন্মদিনে’ পূর্ণিমার রাতে জ্যোৎস্নার মোহমুগ্ধ আকর্ষণে কবিকে যেমন গাইতে শুনেছি— “আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে….” তেমন ‘পত্রপুটের’ একটি কবিতায় চাঁদের রূঢ় বাস্তবের কাব্যিক বর্ণনায় বলেছেন-

“শুনেছি একদিন চাঁদের দেহ ঘিরে 
ছিল হাওয়ার আবর্ত। 
তখন ছিল তার রঙের শিল্প 
ছিল সুরের মন্ত্র 
ছিল সে নিত্য নবীন। 
দিনে দিনে উদাসী কেন ঘুচিয়ে দিল 
আপন লীলার প্রবাহ। 
কেন ক্লান্ত হল সে আপনার মাধুর্যকে নিয়ে। 
আজ শুধু তার মধ্যে আছে 
আলোছায়ার মৈত্রীবিহীন দ্বন্দ্ব— 
ফোটে না ফুল 
বহে না কলমুখর নির্ঝরিনী।” 

মহাকাশের বুকে অপার রহস্য নিয়ে বিরাজ করছে সূর্য। কবির আফসোস ছিল এই ভেবে যে সেই রহস্যের খোঁজ তিনি কোনও দিনই পাননি। তাঁর সেই আক্ষেপ ব্যক্ত হয়েছে ‘শেষ লেখা’ বইয়ের একটি কবিতায়-

“প্রথম দিনের সূর্য— 
প্রশ্ন করেছিল 
সত্তার নূতন আবির্ভাবে— 
কে তুমি, 
মেলেনি উত্তর 
বৎসর বৎসর চলে গেল 
দিবসের শেষ সূর্য 
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম সাগরতীরে। 
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় 
কে তুমি! 
পেলনা উত্তর।” (শেষ লেখা) 

বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড গড়ে ওঠার মূলে রয়েছে অনু-পরমাণু। বিজ্ঞানের এই সত্য তাঁর জানা ছিল। তাই তিনি ‘বিচিত্রিতা’-তে লিখেছিলেন- 

“যত বাণী, যত সুর 
যত রূপ, তপস্যার যত বহ্নিলিখা 
সৃষ্টিচিত শিখা 
আকাশে আকাশে লিখে 
দিকে দিকে 
অনু পরমাণুদের মিলন ছবি।” 

দূরন্ত গতিতে ছুটে চলা মুক্ত পরমাণু কবির চোখে ‘বিদ্রোহী’। একে তরঙ্গরূপে যে শৃঙ্খলিত করা যায় তা কবির জানা ছিল। ‘নটরাজ’ কাব্যগ্রন্থে তাই তিনি লিখেছেন- 

“নৃত্যের বলে সুন্দর হল 
বিদ্রোহী পরমাণু, 
পদযুগ ঘিরে জ্যোতি-মঞ্জীরে 
বাজিল চন্দ্রভানু।” 

রাতের আকাশে ভেসে ওঠে লক্ষ-কোটি নক্ষত্র। সৌরজগতের মতো তাদের ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে কত গ্রহ-উপগ্রহ। বিজ্ঞানের এই সত্য ধরা পড়েছে কবির গানে-

“অসীম আকাশে অগণ্য কিরণ, কত গ্রহ উপগ্রহ 
কত চন্দ্র তপন ফিরিছে বিচিত্র আলোক জ্বালিয়ে-” 

প্রাণের উদ্ভব নিয়েও রবীন্দ্রনাথের ছিল প্রবল আগ্রহ। তার হদিস পাওয়া যায় ‘পরিবেশ’ কাব্যগ্রন্থে। সেখানে তিনি লিখেছেন-

“বহু লক্ষ বর্ষ ধরে জ্বলে তারা, 
ধীরমান অন্ধকারে কালস্রোতে 
অগ্নির আবর্ত বুকে ওঠে। 
সেই স্রোতে এ ধরণীর মাটির বুদবুদ 
তারই মধ্যে এই প্রাণ 
অণুতম কালে 
কণাতম শিখা লয়ে 
অসীমের করে সে আরতি।” 

চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে শিশু বেড়ে উঠুক। মনের আনন্দে খেলার মধ্য দিয়ে সে শিক্ষা নিক। কল্পনার ডানা মেলুক। কিন্তু বড়দের শাসনে তার সেই কচি মনের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। ইচ্ছেগুলো কোনও দিনই বাস্তব রূপ পায় না। সহজপাঠের প্রথম ভাগে শিশুর সেই ইচ্ছে প্রকাশ পায় যখন সে বলে-

“দুই হাত তুলে কাকা বলে, থামো থামো, 
যেতে হবে ইস্কুলে, এই বেলা নামো। 
আমি বলি কাকা, মিছে করো চেঁচামেচি, 
আকাশেতে উঠে আমি মেঘ হয়ে গেছি।” 

বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক যে নিবিড় সে সত্যটি ধরা পড়েছে রবীন্দ্রনাথের গানে-

“আকাশ ভরা সূর্য তারা, বিশ্বভারা প্রাণ 
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান 
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।” 
                                                     (গীতবিতান) 

পরিবেশ দূষণের সমস্যা আজ বিশ্বব্যাপী। তবুও আমরা এ বিষয়ে সচেতন হতে পেরেছি কি? এ ব্যাপারে এখনও প্রশ্ন আছে। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু এ ব্যাপারে বহুদিন আগে ১৯৪০ সালে লেখা ‘সানাই’ কবিতায় আমাদের সাবধান করে দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন-

“ওদিকে ধানের কল দিগন্ত কালিমা ধূম্র হাত 
ঊর্ধে তুলি, কলঙ্কিত করিছে প্রভাত। 
ধান পচানির গন্ধে 
বাতাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে 
মিশাইছে বিষ। 
থেকে থেকে রেলগাড়ী মাঠের ওপারে দেয় শিষ। 
দুই প্রহরের ঘন্টা বাজে।” 

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মুক্ত মনের মানুষ। কুসংস্কারের বেড়াজালে তিনি নিজেকে কোনও দিনই আবদ্ধ রাখেন নি। বৈজ্ঞানিক যুক্তি ব্যতিত তিনি কখনওই কোনও মন্তব্য বা ব্যাখ্যা গ্রহণে রাজী হতেন না। একটা ঘটনার কথা বলি। ১৯৩৪ সালের ১৫ জানুয়ারি বিহারে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। সে সময় অনেকেই বলেছিলেন, বিহারের মানুষের অস্পৃশ্যতা জনিত পাপের কারণে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়। রবীন্দ্রনাথ গর্জে উঠেছিলেন এই ধরণের অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। তিনি বলেছিলেন, এটা কোনও বিধাতার কোপ নয়— একটা প্রাকৃতিক ঘটনা। 

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ শুধু বিজ্ঞানমনস্কই ছিলেন না, ছিলেন প্রকৃতি প্রেমিকও। এই প্রকৃতিপ্রীতি থেকেই তাঁর মনে এসেছিল তপোবন ভাবনা, যার সার্থক রূপ শান্তিনিকেতন। 

রবীন্দ্রপ্রতিভার ব্যাপ্তি বিশাল। যেন এক মহাসাগর। হাজারো মণিমুক্তোয় সম্পদশালী সেই মহাসাগরের গভীরতা মাপার সাধ্য আমার নেই। আমি ডুবুরি নই। সামান্য এক সমুদ্র-পর্যটক মাত্র। তাই সেই সাগর বেলায় দাঁড়িয়ে দু’একটা মণিমুক্তো খোঁজার চেষ্টা করেছি মাত্র।



0 comments:

0

বিশেষ রচনা - সাম্য দত্ত

Posted in


বিশেষ রচনা


তিন এক্কে তাতা 
সাম্য দত্ত



আপনি যদি মনে করেন, ভরপেট ভাত আর পাশে পাশবালিশ পেলেই একটি নিটোল ভাতঘুম সেরে নিতে পারবেন, তাহলে বলতে হয়, আপনি ঘুমিয়েই আছেন, এখনও ঘুমোতে শেখেননি। ঠিক যেরকম এবং যতখানি ঘুমলে তাকে তোফা ঘুম বলা চলে, সেরকম ঘুম এক তোফা- অর্থাৎ উপহার বিশেষ। ভাতের গরম আর পাশবালিশের নরম ছাড়াও আরেকটা জিনিস লাগে। এতক্ষণ যে বইটা পড়তে পড়তে চোখের পাতা বুজে আসছিল, সেইটা আড়াআড়ি বিছিয়ে দিন বুকের ওপর। এইবার চোখ বুজেই দিব্যি টের পাবেন, ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসি আপনার মাথার কাছটিতে বসে ইকির-মিকির খেলছেন। আর পায়ে-পায়ে ঘুমপরী নেমে আসছেন আপনার চোখে। ব্যস! এরপর শুধু মনে মনে 'আয় ঘুম, যায় ঘুম, দত্তপাড়া দিয়ে' দু'কলি ভেঁজে নিন। ওই মনে মনে হলেই হবে। এই দেখুন, আপনি এক্কেবারে ঘুমিয়ে কাদা!

এত জোগাড়যন্ত্র করে যেই না একটা ফুরফুরে ঘুম এসেছে, নাকটাও হয়তো ফুরফুর করে বার দুই ডেকে উঠেছিল...বেমক্কা বারকতক হাঁচি হাঁচতে গিয়ে, হাঁউ-মাঁউ-কাঁউ মানুষের গন্ধ পাঁউ করে খাট থেকে প্রায় ছিটকেই পড়েছি। ধড়মড় করে উঠে বসে, চোখটোখ কচলে নিয়ে দেখি, একটা সাহেবসুবো গোছের লোক, পেন্সিলের মতো খাড়াই নাক আর সেই নাকে রসগোল্লার মতো চশমা, প্যাটপ্যাট করে আমার দিকে চেয়ে আছে। এইবার লোকটা তার পেন্সিলের মতো নাকটা কুঁচকে সিঙাড়ার মতো করে, ভয়ানক রকমের একটা ভেচকুরি কেটে বলল, "যাক বাবা, উঠেছ তাহলে!" 

আমি খুব চটেমটে বললাম, "কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলে কেন শুনি?" লোকটা বলল, "ওমা, তোমার নাক ডাকছিল যে!"

-তা'তে কী হলো?

-তাও বুঝি জানো না? শোনো, সেই একজন লোক ছিল, সে মাঝেমাঝে এমন ভয়ঙ্কর নাক ডাকাত যে, সবাই তার উপর চটা ছিল। একদিন তাদের বাড়ি বাজ পড়েছে, আর অমনি সবাই দৌড়ে তাকে দমাদম মারতে লেগেছে। হোঃ হোঃ হোঃ..."

এইবার আমার বেজায় রাগ হলো, তেড়ে উঠে বললাম, "তুমি বাপু লোক ভালো নও!" 

লোকটা অমনি মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করলে, "উঁহু.. লোক নয়, লোক নয়, আমার নাম হলো শ্রোডিঙ্গার। আমার নাম শ্রোডিঙ্গার, আমার ভাইয়ের নাম শ্রোডিঙ্গার, আমার পিসের নাম শ্রোডিঙ্গার।"

-তার চেয়ে বললেই হয়, তোমার গুষ্টিশুদ্ধু সবাই শ্রোডিঙ্গার।

লোকটা, থুড়ি, শ্রোডিঙ্গারটা একটু ভেবে বলল, "তা তো নয়। আমার মামার নাম কোয়ান্টাম। আমার মামার নাম কোয়ান্টাম, আমার খুড়োর নাম কোয়ান্টাম, আমার শ্বশুরের নাম কোয়ান্টাম।"

শ্বশুরের নাম কোয়ান্টাম শুনে কেমন যেন একটু সন্দেহ হলো। বললাম, "ঠিক বলছ?"

শ্রোডিঙ্গারটা আবার একটু ভেবে বলল, "না না, আমার শ্বশুরের নাম কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রিটেশন।"

-যত্তসব বাজে কথা! তোমার নাম যাই হোক, আমার নাকে রুমাল ঢুকিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছিলে কেন?

একথা শুনে শ্রোডিঙ্গারটা মনে হলো খুব দুঃখ পেল। মুখখানা বেগুনভাজার মতো বিষণ্ণ করে বলল, "না হে, রুমাল নয়, ওটা আদতে একটা বেড়াল।"

-বেড়াল কীরকম? 

-কীরকম শুনবে? তাহলে... অ্যায়! এই দেখ নোটবই, পেন্সিল এ'হাতে, এই দেখ ভরা সব কিলবিল লেখাতে। পড়ে দেখ দেখি, কিছু বোঝো কিনা!

পড়ে অবিশ্যি আমি কিছুই বুঝিনি, কিন্তু পাছে সেকথা বললে শ্রোডিঙ্গারটা আবার দুঃখ-টুঃখ পেয়ে বেগুনভাজার মতো বিষণ্ণ হয়ে যায়, তাই খুব খানিকটা ঘাড়-টাড় নেড়ে হুঁ হুঁ করে গেলাম।

শ্রোডিঙ্গার খুশি হয়ে বলল, "হ্যাঁ, বাক্সের মধ্যে বেড়ালটা যেই না ঢুকেছে, অমনি একখানা রেডিওঅ্যাক্টিভ এলিমেন্ট ছেড়ে দিয়েছি।"

-বেড়ালের তালব্য শ-এ আকার ল-এ আকার! তারপর?

-তারপর... হো হো হো... সেকথা বলতেও আমার বেজায় হাসি পাচ্ছে... রেডিওঅ্যাক্টিভ এলিমেন্টটা যেই অ্যাক্টিভ হবে, অমনি দিকে দিকে রেডিওবার্তা রটে যাবে... আর সঙ্গে সঙ্গে... হি হি হি...উফ্! গেল গেল, নাড়ি-ভুঁড়ি সব ফেটে গেল... ফ্লাস্কের বিষাক্ত গ্যাস বেরিয়ে এসে-

-পুসিক্যাট পপাত চ!

-এবং মমার চ! মার্জার মায়ের ভোগে! হা হা হা, ভাবো দেখি, কী মজার ব্যাপার! 

-কিন্তু...রুমাল তাহলে আসছে কোথ্থেকে?

শ্রোডিঙ্গার এবার হঠাৎ হাসি-টাসি থামিয়ে খুব গম্ভীর হয়ে বলল, "সেইখানেই তো হিসেবটা মিলছে না।"

-"মিলবে না কেন?" আমি তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলাম, "এ তো খুব সোজা হিসেব।"

-"না হে, তুমি ব্যাপারটা তলিয়ে ভাবছ না। অঙ্কটা এলসিএমও নয়, জিসিএমও নয়। সুতরাং হয় ত্রৈরাশিক, নাহয় ভগ্নাংশ।" বলেই শ্রোডিঙ্গারটা ছকাছক করে মাটিতে একটা ছক কেটে বলল, "মনে কর, এলিমেন্টটা অ্যাক্টিভই হলো না আদৌ। তখন?" 

-কোয়ায়েটলি ভেবে দেখলে, কোয়ায়েট পসিবল। তেজস্ক্রিয় আদপেও সক্রিয় হলো না, তার তেজ হয়তো আগাগোড়া নিষ্ক্রিয়ই থেকে গেল, নিষ্কৃতি পেলে না একটুও। এ তো হতেই পারে। পদার্থ অপদার্থের মতো আচরণ করতেই পারে।

-তাহলে তো বাতাসে বিষও মিশল না! ফলে বেড়ালটার কড়া জানও এযাত্রায় আর কড়কে গেল না।

-হুঁ! তাহলে বেড়ালটাকে এখন কী বলব? বেড়াল তো বেঁচে থাকতে পারে, আবার টেঁসেও যেতে পারে।

-পারেই তো! তাই, জীবিত বলতে পারো, মৃত বলতে পারো, আবার একসঙ্গে দুটোই বলতে পারো।

-দুটোই? কীরকম? 

শ্রোডিঙ্গার এবার একচোখ বুজে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে বিচ্ছিরি ভাবে হেসে বললে, "তাও বুঝলে না?"

আমি ভারি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। মনে হলো, 'একসঙ্গে দুটোই' ব্যাপারটা আমার বোঝা উচিত ছিল। তাই থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি বলে ফেললাম, "হ্যাঁ হ্যাঁ, এ তো বোঝাই যাচ্ছে।"

শ্রোডিঙ্গার মাথা নেড়ে বলল, "হ্যাঁ, বাক্স যতক্ষণ না খোলা হচ্ছে, দ্যা বেড়াল ইজ বোথ ডেড অ্যান্ড অ্যালাইভ।"

-তা তুমি বাস্ক খুলে কী দেখলে?

শ্রোডিঙ্গার খানিকক্ষণ চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, "ওইখানেই তো মুশকিল, হিসেবটা ওখানেই ঘেঁটে গেল। খুলে দেখলাম, বেড়াল-টেড়াল কিচ্ছুটি নেই। জীবিত, মৃত, জীবন্মৃত- কিস্যু লয়। তার বদলে, ওই রুমালটা পড়ে আছে।"

-ওইটে?

-হুঁ।

আমি অবাক হয়ে বললাম, "তা, এতে মুশকিলের কী আছে? ছিল বেড়াল, হয়ে গেল রুমাল। ছিল ডিম, হয়ে গেল দিব্যি একটা প্যাঁকপ্যাঁকে হাঁস। এ তো হামেশাই হচ্ছে।"

-ঠিক! ঠিক বলেছ। উত্তরটা মিলছিল না, তোমার ওই বইটা দেখতেই সব পরিষ্কার হয়ে গেল।

-আমার বই? ও, যেটা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ওইটে? 

-ইয়েস! ওই বইতেও ঠিক এই কথাটাই লিখেছে।

-কী লিখেছে?

-ওই তুমি যা বললে, "এ তো হামেশাই হচ্ছে।"

এইবার আমার বেজায় রাগ হয়ে গেল। বললাম, "তখন থেকে খালি আবোলতাবোল বকছ। দিলে তো মাথাটা গরম করিয়ে! আমার বাপু রাগ হলেই আবার খিদে-খিদে পায়। এখন কী খাই বল দেখি? দেখ না ফ্রিজিডেয়ারটা হাঁটকে, কিছু পাও কিনা।"

শ্রোডিঙ্গার আবার সেরকম ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে হেসে উঠল। "উঁহু! সেটি হবার নয়, সে হবার যো নেই। ফ্রিজিডেয়ার বিলকুল ফাঁকা, কিস্যুটি নেই। তবে হ্যাঁ, এইটে মনে রেখো- নেই, তাই খাচ্ছ, থাকলে কোথায় পেতে?" বলেই আবার একটা ভেচকুরি কেটে জানলা গলে পালিয়ে গেল।

নেই বললেই হলো! শ্রোডিঙ্গারের কথায় প্রথমটা খুব রেগে গেসলাম। তারপর যেই মনে পড়ল, মামার আনা মিহিদানার হাঁড়িটা এখনও ফ্রিজেই আছে, অন্তত দুপ্পুর অবধি তাকে সেখানেই স্বমহিমায় বিরাজমান দেখেছি, অমনি রাগ-টাগ গলে জল হয়ে গেল। চুলোয় যাক শ্রোডিঙ্গার, হমারে পেটমে চুহা দৌড় রাহা হ্যায়।

ফ্রিজের একদম নীচের তাক থেকে মিহিদানার হাঁড়িটা যেন আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। তাক বুঝে, যেই না তাকে বগলদাবা করে তার ঢাকনা খুলেছি- আচমকা ফুটফাট দুমদাম ধুপধাপ শব্দে তাণ্ডব কোলাহলে সারা বাড়িটা একেবারে কাঁপিয়ে তুলল। মনে হলো যেন, যত রাজ্যের মিস্ত্রিমজুর সব একযোগে ছাদ পিটতে শুরু করেছে, দুনিয়ার যত কাঁসারি আর লাঠিয়াল যেন পাল্লা দিয়ে হাতুড়ি আর লাঠি ঠুকতে লেগেছে। আমি তো ভয়ের চোটে হাঁউমাঁউ করে হাত থেকে হাঁড়ি-টাঁড়ি ফেলে দিয়ে, পড়ার বইয়ে যাকে 'কিংকর্তব্যবিমূঢ়' বলে, তারও এককাঠি ওপরে উঠে একেবারে 'কিংকংকর্তব্যবিমূঢ়' হয়ে হাঁ করে বসে রইলাম।

কতক্ষণ ওভাবে বসে ছিলাম জানি না, হঠাৎ একটা বিটকেল গুরুগম্ভীর আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠতে হলো। চেয়ে দেখি একটা দেড় হাত লম্বা বুড়ো, তার পা পর্যন্ত সবুজ দাড়ি, আর মাথাভরা টাক। সেই টাকে আবার খড়ি দিয়ে কবিতা লিখেছে। বুড়োটার হাতে একটা হুঁকো, তা'তে কল্কে-টল্কে কিচ্ছু নেই, সেটাকেই দূরবীনের মতো করে চোখের সামনে ধরে আমাকে দেখছে। তারপর পকেট থেকে কয়েকটা রঙিন কাঁচ বের করে সেগুলো দিয়ে আবার কিছুক্ষণ দেখল। দেখা-টেখা শেষ হলে, তেমনি ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, "অন্তমিলটা মিলিয়ে দাও তো হে! চটপট!"

আমি দস্তুরমতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, "মিল? কিসের মিল?" 

-উঁহু উঁহু! 'কিসের'-এর সঙ্গে তো অনেক কিছুই মিল দেওয়া যায়। এই যেমন ধর- পিসের, সিসের ইত্যাদি প্রভৃতি। ও তো খুব সোজা, সবাই পারে। ওকথা বলছি না। ওই শ্রোডিঙ্গার যে লাইনটা বললে, তার সঙ্গে মিল দিয়ে একখানা লাইন ভেবে বের করো দেখি! তবে বুঝব, তুমি কেমন কবি!

ব্যাজার মুখ করে বললাম, "আমি ওসব পারি না।"

-"পারবে না? তুমিও পারবে না? ইস! তোমার ওপর যে বড্ড ভরসা ছিল হে!...নাহ্! তেত্রিশ বছর কাটলো, একটা মিল আর মিলল না।" বুড়োটা মনে হলো হতাশ হয়েছে, ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, "তবে আমারও তোমার মতোই দশা হয়েছিল। তাই না প্রথম লাইনটা লিখতে পারলুম।"

-কীরকম? 

-গল্পটা তোমায় বলিনি, না? আচ্ছা শোনো... আমার নাম কবি কালিদাস। আমি হলাম হাফটাইম কবি, বুঝলে?

-হাফটাইম কেন?

-আগে ফুলটাইম কাব্যচর্চা করতুম। তারপর আমার ব্রাহ্মণী সেনকো গোল্ডে খাতা খুললেন। তাই, এখন দিনের মিনিমাম একটা সময়, মিনি নামের মিনি সাইজের একটা মেয়েকে টিউশনি পড়াতে হয়। তা সেদিনও মিনিবাস থেকে নেমে মিনির বাড়ির দিকেই যাচ্ছি, এমন সময় চোখে ঝিলমিল লেগে গেল।

-কানা হয়ে গেলে নাকি?

-উঁহু! কানা নয়, মিহিদানা। মিষ্টির দোকানের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে তা'তেই চোখ আটকে গেসল। কিনেই ফেললুম, এক হাঁড়ি।

-তাপ্পর? 

-এমনিতে আমার ছাত্রীটিকে পড়ানোর বিশেষ ঝঞ্ঝাট নেই, বুঝলে? 'নদী শব্দের রূপ কর' বলে চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়লেই হলো। মিনিও স্লেট নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে লেগে যায়। তা সেদিনও মিহিদানার হাঁড়িটা চেয়ারের তলায় রেখে সবে চোখদুটো বুজেছি, মিহি স্বপ্নের দানায় চোখের পাতা ভারি হয়ে এসেছে, অমনি- ঠিক ওইরকম শব্দকল্পদ্রুম! বাসরে বাস! একলাফে চেয়ার-টেবিল ডিঙিয়ে ঘরের মধ্যিখানে গিয়ে পড়েছি।

-বলো কী!

-তবে আর বলছি কী! ঠাসঠাস দ্রুমদ্রাম শুনেই খটকা লেগেছিল। গোলমাল একটু কমলে পর, হাঁড়ি খুলে দেখি, ওমা! মিহিদানা কই, এ তো চীনেপটকা!

-অ্যাঁ! 

-হ্যাঁ। আর তাই দেখেই না ওই লাইনখানা ভেবে ফেললুম! ওই মিহিদানা নেই দেখেই তো! রাজা বিক্রমাদিত্যের সভাকবি আবার স্বভাবকবি কিনা-

'নেই, তাই খাচ্ছ, থাকলে কোথায় পেতে?'

কিন্তু ওই এক লাইনই। মনের মতো একপিস মিল, সে অমিলই থেকে গেল। অনেক মাথা চুলকেও আর কল্কে পেলাম না। তা বাপু, একটু দেখবে নাকি মাথা খাটিয়ে? 

এবার আমি বড় বাড়াবাড়ি রকমের বিরক্ত হয়ে গেলাম। "একে ওই শ্রোডিঙ্গার না কুলাঙ্গার কে একটা এসে কাঁচা ঘুমটা চটকে দিলে, তার ওপর হাঁড়ির মিহিদানা পটকা হয়ে ফাটতে লেগেছে, এত সব দেখেশুনে আমার আর কাব্যি-টাব্যি পাচ্ছে না। যাও তো বাপু, জ্বালিয়ো নাকো মোরে! বিদেয় হও, পথে যেতে যেতে ওসব ভাবার অনেক মওকা পাবে।"

এই অবধি যেই না বলেছি, বুড়োটা বেজায় উত্তেজিত হয়ে আট দশ পাক বনবন করে ঘুরে নিলে। "কী বললে, কী বললে? পথে যেতে যেতে? অ্যাঁ! তাই বললে তো? ওরে মা রে, মেশোমশাই রে, মিলেছে রে, মিলেছে! ও শ্রোডিঙ্গার, ভাই আমার, শুনে যা! মিল গয়া মিল !

'নেই, তাই খাচ্ছ, থাকলে কোথায় পেতে? 
কহেন কবি কালিদাস, পথে যেতে যেতে।'

কেয়াবাত! ওরে বুধো রে! বিভূষণ-বিভীষণ-বিভূতিভূষণ সব বাগিয়ে নিয়েছি রে! 'কহেন কবি কালিদাস...' হুঁ হুঁ বাবা, 'পথে যেতে যেতে।' কেয়াব্বাত!

"হঠাৎ কেন দুপুর রোদে চাদর দিয়ে মুড়ি
চোরের মতন নন্দগোপাল চলছে গুড়ি গুড়ি"

অত খপরে আপনের কী মশয়? তবে, ধরেই যখন ফেলেছেন, তখন বলি- যাচ্ছিলুম ওই গড়ের মাঠে। কী করব বলুন? যার চোখে ঘুম নেই, পেটে খিদে... না, তা অবিশ্যি আছে, কিন্তু খাবার মতো কিচ্ছুটি নেই, গোদের ওপর বিষফোঁড়া দুটো উমনো আর ঝুমনো এসে যার কানের কাছে হযবরল বকে গেল- জানবেন সে বেচারা নন্দগুপির জীবনে আনন্দও নেই। আর যার পকেট গড়ের মাঠ, সে বেচারা ওই গড়ের মাঠ ছাড়া আর যাবেই বা কোথা? খোলা হাওয়া খেতে অন্তত ট্যাক্সো লাগে না বলেই তো শুনিচি!

কিন্তু চৌকাঠও মাড়াতে হলো না, উঠোনের দিক থেকে একটা প্রলয়ঙ্কর ‘দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম দেরে দেরে দেরে হায় হায় প্রাণ যায় হোক কলরব’ শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখি- বাসরে! উঠোনময় যেন গাজনের মেলা বসেছে। একদল লোক, দেখে ভিনদেশী মনে হলেও কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকল অথচ ঠিক চিনতে পারলুম না- তারা দিব্যি উঠোনখানা দখল করে বেজায় হৈচৈ জুড়ে দিয়েছে। ভাঁড়ার ঘরটা মেরামতির জন্য ইঁট আনিয়ে রাখা হয়েছিল, একটা গোলগাল রাজাগজার মতো দেখতে লোক সেই ইঁটের পাঁজার ওপর কেমন হুতুমথুম হয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। তার পাশেই একটা ঠোঙায় করে বাদামভাজা রাখা, রাজার মতো দেখতে লোকটা তার থেকে মাঝেমাঝে দু’চাট্টে করে মুখে ফেলছে, ফেলেই আবার গালে হাত দিয়ে আকাশপাতাল কী যেন ভাবতে লাগছে! আমার কেমন সন্দেহ হলো, লোকটা খাচ্ছে বটে, কিন্তু যেন গিলছে না! এদিকে একদল লোক, বোধহয় এই রাজাগজাটার প্রজাই হবে, কান্নার সুরে একটানা বিলাপ করে যাচ্ছে: 

হায় কী হলো
রাজা বুঝি ভেবেই মলো
ওগো রাজা মুখটি খোলো...

দেখেশুনে ব্যাপারস্যাপার তো কিছুই বোধগম্য হলো না! কাকে শুধোই ভাবছি, দেখি এককোণে দুটো লোক চুপটি করে বসে। তার মধ্যে যে লোকটা একটু বুড়োমতো, সে দেখি আমার সেই বইটা কোথ্থেকে কুড়িয়ে এনে ভারি মনযোগ দিয়ে পড়তে লেগেছে। ভাবলাম বলি, না জিজ্ঞেস করে আমার বইয়ে হাত দিয়েছে কেন? তা যেই না বুড়োটাকে ডাকতে গেছি, পাশের লোকটা চোখ বড়বড় করে আর মুখের সামনে আঙুল এনে ‘শশশশ’ গোছের আওয়াজ করল। কী আর করা? বাধ্য হয়ে তাকেই ফিসফিসিয়ে শুধোলাম, "বাপু হে, তোমরা কারা? আর এই যে উঠোনময় গাজনের মেলা বসিয়ে ফেলেছ, তোমাদের মতলবটা কী? 

লোকটা প্রায় আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, "শোনো খোকা, আমরা সক্কলে আসছি সেই গলদেশ থেকে। গলের নাম শুনেছ?

-হুঁ, শুনেছি বইকি! জ্যাঠামশাই বলেছেন, গলদেশের পুরোটাই রোম সাম্রাজ্যের অধীনে। রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার...

-"পুরোটা? উঁহু... ঠিক পুরোটা নয়। একটা গ্রাম এখনও রোমানরা দখল করতে পারেনি।" লোকটা খুব গর্ব গর্ব মুখ করে বুক বাজিয়ে বলল, "সেই গ্রামের অধিবাসীবৃন্দের তরফ থেকে অভিনন্দন গ্রহণ করো। আমরাই এখনও রোমানদের ঠেকিয়ে রেখেছি।" 

-ও, আর ওই লোকটা, ওই যে... রাজাগজার মতো দেখতে, উনি কিনি? 

-ওই ইঁটের উচ্চাসনে আসীন আমাদের দলপতি মহামান্য ভাইটালস্ট্যাটিস্টিক্স। তাঁর ঠিক সামনে...ওই যে দেখছ...ওই বামনাকৃতি বীর যোদ্ধাটি হলেন আমাদের গ্রামের গর্ব, অ্যাস্টেরিক্স। পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর প্রাণের বন্ধু ওবেলিক্স... আর ইনি হচ্ছেন জেরিয়াট্রিক্স, ইনি ম্যাট্রিক্স... 

-তা ভালোমানুষের পো, তোমার নাম কী গো?

-অ্যাপেন্ডিক্স। আর আমার পাশে বসে আছেন, গ্রামের প্রধান পুরোহিত, শ্রদ্ধেয় শ্রী এটাসেটামিক্স। কিন্তু শশশশ... ওনাকে বিরক্ত করো না যেন, উনি এখন এই সঙ্কট থেকে আমাদের উদ্ধার করার উপায় খুঁজছেন।

-সঙ্কট? সঙ্কট কেন?

-সে অনেক কথা... আমাদের গ্রামের চারদিকে রোমানদের চারচাট্টে সৈন্যশিবির। তবু যে ওরা আমাদের সমঝে চলে, কেন জান? এই এটাসেটামিক্স এটার সাথে সেটা মিক্স করে এমন এক জাদু শরবত তৈরি করতেন, তাই খেয়েই আমাদের দেহের ওজন উনিশটি মন, শক্ত যেন লোহার মতন।

-কেমন? কেমন?

-আরে আমরা সবাই হাতি লুফি, খেলাচ্ছলে যখন-তখন। বাচ্চারা খুব কাঁদলে পরে, আনি দুটো রোমান ধরে। মনের সুখে মেরে - ধরে, ছেলেরা হাতের সুখ করে।

-বা রে! ভারি তো মজার ছেলেখেলা!

-"বললে বেশি ভাববে শেষে, এসব বুঝি ফেনিয়ে বলা।" বলেই অ্যাপেন্ডিক্স হঠাৎ যেন কেমন উদাস হয়ে গেল। "কিন্তু দারুণ দিনগুলো আচমকাই এভাবে নিদারুণ হয়ে যাবে, কে আর ভেবেছিল? একদিন সকালে উঠে...বয়স হয়েছে তো... এটাসেটামিক্স দেখলেন শরবতের ফর্মুলা কিছুতেই মনে পড়ছে না! ব্যস! গ্রামশুদ্ধু সক্কলে চোখে ধোঁয়া দেখতে লাগলাম।" 

বলতে বলতেই দেখলাম অ্যাপেন্ডিক্সের মুখটা কেমন করুণ হয়ে গেল। শেষটায় আর সামলাতে না পেরে ‘হায় হায় প্রাণ যায় হায় হুকু হায় হুকু হায় হায়’ বলে ভেউভেউ করে কেঁদেই ফেললে। তাকে এমন আকুল হয়ে কাঁদতে দেখে, আমারও চোখদুটো কেমন ভিজে ভিজে ঠেকছিল। ভাবছিলাম, শ্রোডিঙ্গারের সেই রুমালটা থাকলে এই সময় খুব কাজে দিত, এমন সময়-

বলা নেই কওয়া নেই, এটাসেটামিক্স যার নাম, সেই ভারিক্কি চালের বুড়োটা সুড়ুৎ করে উঠে দাঁড়ালো। তারপর দমাদ্দম করে নিজের বুকে গোটা দশ কিল মেরে হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে উঠল, "পেয়েছি, আমি পেয়েছি! ও ছোটকা, ইউরেকা! ওরে, কে আছিস? দৌড়ে গিয়ে চারণকবিকে ডেকে আন।" 

-ও বাবা, তোমাদের মধ্যে আবার একজন চারণকবিও আছে নাকি?

-"আছে বইকি!" অ্যাপেন্ডিক্স জবাব দিলে, "সবুর করো না, এই এল বলে।" 

বলতে না বলতে, দুটো লোক মিলে একটা কোমর পর্যন্ত লম্বা চুল আর গোড়ালি অবধি লম্বা দাড়িওলা জন্তুকে ধরেবেঁধে হাজির করলে। জন্তু বলাই ভালো, কারণ একঝলক দেখে সে মানুষ না ভূত, বাঁদর না প্যাঁচা, সাম্প্রদায়িক না সেকুলার টের পাওয়া যায় না। এটাসেটামিক্স তাকে দেখেই তার কানেকানে কীসব কানাকানি করলে, তারপর সকলকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বলল, "ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রমহোদয়গণ, এইবার চারণকবি মিঠেগলিক্স তার মিঠে গলায় আমাদের একটা গান শোনাবে। আশা করছি, এই গান আমাদের যোদ্ধাদের মধ্যে নতুন শক্তি সঞ্চার করবে।"

ওমা, এটাসেটামিক্সের কথা পড়তে পেল না, দেখি সবাই গুটিগুটি পালানোর মতলব করছে। কেউ বলে, "উনুনে শুয়োর রোস্ট করতে দিয়ে এসেছি, পুড়ে যাবে," তো কেউ বলে, "আমি যাই, এখনও অনেকগুলো মেনহির বিলি করা বাকি আছে।" হালচাল সুবিধার নয় বুঝেই বোধহয় এটাসেটামিক্স তড়িঘড়ি চারণকবির হাতে আমার বইটা গুঁজে দিলে আর মিঠেগলিক্সও গলা খাঁকারি দিয়ে বইয়ের একটা পাতা থেকে সুর করে পড়তে লাগলে:

"ওই আমাদের পাগলা জগাই নিত্যি হেথায় আসে
আপন মনে গুনগুনিয়ে মুচকি হাসি হাসে
চলতে গিয়ে হঠাৎ যেন ধাক্কা লেগে থামে
তড়াক করে লাফ দিয়ে যায় ডাইনে থেকে বামে।"

অবাক হয়ে দেখি, এতক্ষণ যারা পালাই পালাই করছিল, তারাই কেমন যেন থমকে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করে শুনছে। ওদিকে, মিঠেগলিক্স কিন্তু থামেনি, একটানা গেয়েই চলেছে:

"ভীষণ রোখে হাত গুটিয়ে সামলে নিয়ে কোঁচা
'এইয়ো' বলে ক্ষ্যাপার মতো শূন্যে মারে খোঁচা।"

এই অবধি শুনেই অ্যাস্টেরিক্স, ওবেলিক্স, ভাইটালস্ট্যাটিস্টিক্স; যেখানে যত গল ছিল, কেউ আনন্দে তুড়িলাফ দিচ্ছে, কেউ বা ডন বৈঠক দিতে লেগেছে, কেউ আবার হুমহাম গুমগাম মুগুর ভাঁজতে ভাঁজতে দুমদাম পেশী ফোলাচ্ছে।

"উৎসাহেতে গরম হয়ে তিড়িংবিড়িং নাচে
কখনও যায় সামনে তেড়ে, কখনও যায় পাছে।
এলোপাথাড়ি ছাতার বাড়ি ধুপুসধাপুস কত
চক্ষু বুজে কায়দা খেলায় চর্কিবাজির মতো..."

গান থামামাত্র সবকটা গল, রাজা-প্রজা-বাচ্চা-বুড়ো-সেবাইত-পুরোহিত সবাই মিলে লম্ফঝম্প আর হইহল্লা জুড়ে দিলে:

"রোমান ধরে মারো, সবাই রোমান ধরে মারো
মাথায় ঢেলে ঘোল, ওদের উল্টো গাধায় তোল
কানের কাছে পিটতে থাকো চোদ্দ হাজার ঢোল।"

যেন রোমান ধরে ঠ্যাঙাবার জন্যে একযোগে সবার ঠ্যাং-এ সুড়সুড়ি, হাত নিশপিশ। কারো যেন আর তর সইছে না, 'নিঃশেষে প্রাণ' পরিস্থিতি পুরো। স্পষ্ট শুনতে পেলাম, যেতে যেতে ওই মোটা ওবেলিক্স আবার আব্দার জুড়েছে, "আমাকে কিন্তু দুটো রোমান বেশি দিতে হবে, হুঁ! আগেরবার আমার ভাগে কম পড়েছিল।"

তালগোল আর ডামাডোল থামলে পর খেয়াল হলো, গোলমালের সুযোগে গলগুলো আমার বইটা নিয়েই চম্পট দিয়েছে। তা যাকগে! বইয়ের নামটা মনে রেখেছি, মামাকে বললেই এনে দেবে'খন। 'সুকুমার সাহিত্য সমগ্র।'



0 comments: