0

ধারাবাহিক - রাজর্ষি পি দাস

Posted in


ধারাবাহিক

ফেরা - ৫
রাজর্ষি পি দাস


০৬। ০৭। ২০১৯ 
কলকাতা 


লেখাটা বড় হয়ে গেল, ভেবেছিলাম অর্পিতার সঙ্গে আর চালাকি না করে সত্যি কথা বলব! তাই হয়ত বেশি লেখা হয়ে গেল! 

আজ ভোররাত থেকেই অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। জানলা দরজা দিয়ে ওপাশের কিছু দেখা যাচ্ছে না! আমি আমার রুটিন অনুযায়ী সাবিত্রী থেকে জল নিয়ে ঘুণোর হাত থেকে ওষুধ নিয়ে পেটে চালান করে এককাপ চা হাতে নিয়ে বসেছি ডাক্তার অর্পিতার চার্ট নিয়ে! ইতিমধ্যে দশটা দাগ পড়েছে। আজ এই বৃষ্টির দিনে ‘পেট শপ বয়েজ’ শুনলে হয় না! হোক, হোক! “জাস্ট গিভ মি ওয়ান মোর চান্স...” 



নবমী 

অনেকক্ষণ---না ৩০০০+ ক্ষণ ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করছি গীরিন দাদুর পিঠের গল্পটা মনে করার। পিঠের টুকরোগুলোকে কে ফেলে গেছিল রাজকুমারী না রাক্ষস! নাকি রাজকুমার? পিঠে গাছের গন্ধ শুঁকে শুঁকে একা আবিস্কার করেছিল রাজকুমারীকে পিঠেগাছের গুঁড়িতে বাঁধা অবস্থায়? নীলা জ্যোৎস্না, হ্যাঁ গিরিন দাদু নীলা জ্যোৎস্নাই বলতেন, নীলা জ্যোৎস্নায় রাক্ষস ছোট্ট পিঠে গাছে ঠ্যাং ঝোলাতে ঝোলাতে বলত- কিরে, পিঠে চাই না রাজকুমারী ... পিঠেসাপটা, পুলি, চষি, মালপোয়া চারদিকে ঝুলে আছে। হাত বাড়ালেই পেড়ে ফেলা যাবে, নাকে এখন গন্ধ লেগে আছে, আর গল্পটা যেদিনই শুনতাম ঠিক এই জায়গায় আসলেই জীবে জল এসে যেত, আজও এসে গেল। সেই সকাল থেকে কিছু খাইনি। আমার সামনে এখন বিশাল বুদ্ধ পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদের এপারে আদিগঙ্গা, পাশে গড়িয়া গাড়িব্রিজ, নীচে চাঁদের আলোয় গঙ্গাস্নানে উত্তেজিত ৪ – ৫টা সাদা শুয়োর। এক মাতাল সাথী বলে ওঠে, একেই বলে “শুদ্ধ শুয়োর। খাতি যা লাগবে না!” 

আমি ঠিক আদিগঙ্গার জল ছুঁই ছুঁই একটা সাময়িক চুল্লুর ঠেকে বসে। ক্ষিদের পেটে চুল্লু ঢুকে পেটের প্রোটিন চেঁছে খাওয়ার চিনচিনে ব্যাথাতে পিঠের গন্ধ মিশে আমার রোমান্টিক অনুশীলনকে বেশখানিকটা আশকারা দিল। গিরিন দাদু আমার দাদু না হয়েও বরাবর নাতি-স্নেহ আর প্রশ্রয় দিতেন। দাদুর অভাব বোধ করিনি। আমার ঠাকুমা বা দিদিমাও গিরিন দাদুর মতো আমার রক্তের ঠাকুমা দিদিমা ছিলেন না, আমি ডাকতাম বউ বলে। তবে ওটা ছিল আচার, এখন এই চুল্লু হাতে আচার চলবে না। 

বউ তোমার সাথে অনেকদিন গল্প হয়নি, একটু সবুর কর। 

কিন্তু বউয়ের কথা মনে পড়ল কেন। ও, আজ বুদ্ধ পূর্ণিমা! আজ বুদ্ধ জন্মেছিলেন বৌকে ছেড়ে যাবেন বলে! কিন্তু গৌতমের বউ কি বুদ্ধের প্রেমিকা ছিলেন? প্রেমিকা হওয়া কতটা জরুরি বউ হবার জন্য, বা উল্টোটা- তুপু আমার প্রেমিকা – নাঃ, প্রেমিকা কি করে হবে! ও তো জানেই না আমি ওকে ভালোবাসি। তাহলে বউ হতে আপত্তি কোথায়! তিনটে শুয়োর হঠাৎ একটা শুয়োরের পিঠে চাপতে চাইছে। বিকট আওয়াজে মনে হলো চাঁদ আর ব্রিজটা বেঁকে গেল। 

ব্যাপারটা আবার শুরু থেকে শুরু করা যাক, আমি তুপুকে ভালোবাসি, তুপু জানে না আমি কী বাসি, তাই আমিও জানি না তুপু কি বাসে? কিন্তু মাঝমধ্যেই আমার দাড়ি খামচে দশবারোটা দাড়ি উপড়ে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে বলে – বুড়ো তোকে কে বিয়ে করবে?

ওর স্ফীত নাকের পাটা আমাকে যে কোনও মুহূর্তে, সে স্মৃতি হোক আর দৃশ্যমান স্থির এবং শক্ত করে দেয়। বাকী রইল ওর চোখ। ওর চোখ আমাকে অপরাধী নয়, শয়তান বা কবি নয়, ঈশ্বর করে দিতে পারে। ওর শরীরের ওমের জন্য স্পর্শ দূরের কথা, পাশে চুপচাপ বসে থাকার জন্য, আমি একটা দিনও অনশন করতে পারি না; তবু তুপু আমার। ভীষণভাবে, মারাত্মকভাবে আমার। ওর জন্য কাউকে খুন করতে পারবো না, কিন্তু না মরে নিজেকে বারবার খুন করতে পারবো আজীবন। পকেটে দশ টাকা আছে। ২ টাকার গাঁজা + ৫০ পয়সার বাতাসা + এক টাকার চারমিনার + ৫০ পয়সার বিড়ি + কলের জল ফ্রি। হাতে ৬ টাকা থাকবে। কাল সকালে ২ টাকার কচুরি- হ্যাঁ, সকালের খাবারটা ঠিকঠাক হওয়া চাই, এয়ার ফোর্সের অতটুকুই বেঁচে আছে + কফি হাউসে যাওয়ার বাস ভাড়া এপিঠ ওপিঠ মিলিয়ে ৩ টাকা + দুবার চা, তারপর? এই তারপর শব্দটা ফাঁক পেলেই আচ্ছা আচ্ছা মানুষকে নাড়িয়ে দেয়। যেমন-- মাথা কাজ করছে না, গাঁজা চাই, রুটি তরকার বদলে বাতাসা চাই। গিরিন দাদু কোথায় তোমার পিঠে গাছ! 

রাত ১ টার সময় মামার বন্ধ দোকানে টাকা তারপর টিনের দরজায় প্রথমে হাত ডলে দেওয়া, তারপর চাপড়--আমি কবিতা লিখি বলে মামা মানে এই মুদি দোকানের মালিক আমার অত্যাচার অল্পবিস্তর সহ্য করে দেন। এরপর আরেক মামা আছে, তুপুর বাবা, মামা বলেই ডাকি, সবাই আমার মায়ের ভাই, প্রথম মামা বাতাসা দিল, দ্বিতীয় মামা শুতে দেয়! 

দ্বিতীয় মামার বাড়িতে, মানে তুপুর বাড়িতে খাবো না বলে শুতে দেবে না এমন তো কথা হয়নি। একটা বাবুই পাখীর বাসার মতো ছোট্ট দরজা, কিন্তু সবার জন্য পরিমিত শয্যা টানটান। তাছাড়া ‘খাব না’ এ তো আমারই রুক্ষ ঘোষণা ছিল। রুক্ষতার কারণ আমার বাজার করতে না পারা আর দ্বিতীয় কারণ মামার আর্থিক অবস্থা, আমি গরিব বলে মামা কেন ডেইলি মাছ কিনতে পারবে না! মামা তো আমার মামা, আমার বয়সে বড়। গরীব কেন হবে? প্রতিদিন টানাটানি করে খাওয়ার অবসান ঘটাতে একদিন মামীর অনেক অনুরোধকে নস্যাৎ করে দুহাত ছড়িয়ে বলেছিলাম --- নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। মামাকে কি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে বসেছিলাম, কারণ তুপু সারাদিন ‘বাবা বাবা’ করত! 

আর এই ‘মিল-বর্জন’ ঘোষণার পর প্রত্যেক রাতে দরজা খোলার পর রাত্রি ১১,১২,১ টা হোক মামী হাসতে হাসতে বলত ---এ কী তোর পা দেখতে পাচ্ছি না তো! দাঁড়িয়ে আছিস কি করে! 

তারপর পেছন থেকে আকুতি---খেয়েছিস তো, বাড়িতে আলুসেদ্ধ ভাত আর ডাল আছে। 

নিকুচি করেছে আলুসেদ্ধ ভাত! 

আমি চোখ চেপে সোজা একটা ৫ বাই ৮ ফুট ঘরে ৩ বাই ৬ ফুট টানটান বিছানার নীচে, বাতাসা ভরা পেট নিয়ে টানটান নীল নাইলন মশারীর ভিতরে, টানটান বিছানাকে এলোমেলো করে চিতপটাং! মামী নিঃশব্দে একটা ভয়ংকর ৬ ইঞ্চি ব্লেডের সিলিং ফ্যান চালিয়ে- আমি ততক্ষণে আউট! একঘুমে সকাল ৭টা। আমি ও বাড়ির জল স্পর্শ না করে বেরিয়ে পড়ি। না, আমি তুপুর মুখ দেখবো না। আমাদের ঝগড়া চলছে। আমার বয়স ৩০, তুপুর বয়স ১২! 

এদিকে পেপসি ঢুকছে। পেপসি কারখানা করবে বলে গড়িয়া উত্তাল! সাথে রামকৃষ্ণ নগরের লোকজন সমীরের বেসুরো গান শুনে শুনে পাগল হয়ে সমীরকে পাগলা গারদে দেওয়া যায় কিনা ভেবে ভেবে চায়ের দোকান ফাটিয়ে দিচ্ছে! 

সমীর মুখার্জি গৌতমদার, মানে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’, ‘নাগমতি’ সিনেমার ক্যামেরা অ্যাসিট্যান্ট ছিল। ক্রমশঃ গৌতমদার বিশেষ স্নেহের পাত্র হয়ে ওঠে। গৌতমদা কিছুদিন হলো মারা গেছেন আর তারপরের রাতেই নাকি গৌতমদা সমীরকে স্বপ্নে এসে বলে গেছেন ওঁর গানের ধারা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায় শুধু সমীরের। স্বপ্নে এহেন উত্তরাধিকার পাওয়া সমীর সাতদিনের মধ্যেই বেপোরয়া হয়ে উঠেছে। প্রায় চব্বিশ ঘন্টা হাতে গীটার বা গাঁজার কল্কে আর গলায় গান। আর সমীরের সংসর্গে দুটোই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। একে তো গানগুলো উদ্ভট, পাড়ার লোকেদের কাছে অচেনা, তার সাথে বেসুরোপনা আর গীটারের ঝ্যাং ঝ্যাং—আমিও সমীরকে দেখলেই পালাই! কিন্তু কত পালাবো, এক রাস্তায় থাকি—প্রায় শুনতে হয় গৌতমদার গান সমীরের গলায়! আশায় আশায় বসে আছি—সমীরের গলায় শুনলে যে কোনও মানুষ জীবন থেকে আশা শব্দকে বাদ দিতে বাধ্য! কিন্তু সমীর বলে ওর সাথে নাকি সরস্বতী রাতে এসে গান গেয়ে যায় আর ও সাদা হাঁসকে ভালো করে স্নান করিয়ে দেয়! কেন? গৌতমদা আসে না কেন? সমীর বিরক্ত হয়। দু’দিন পর দেখা গেল সমীরের পাড়ার গলিতে দুটো রাজহাঁস প্যাঁক প্যাঁক করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। 

তো একদিন রাতে ঠিক হলো সকালে সমীরকে পেপসি বিরোধী ধর্নায় নিয়ে গিয়ে গান গাওয়াতে হবে। সমীর তো শুনেই রাজি। ও জানতে চায়, মিক্সার থাকছে কি? আর মাইক্রোফোন কোন কম্পানীর? আমি বাধ্য হয়ে রাত্রিবেলা এক উঠতি নকশাল ছেলের সাথে হাত মিলিয়ে একটা রাজহাঁস তুলে হোটেল বিক্রী করে দিই। ফলাফল হাতেনাতে, সকালবেলা সমীর পাড়ার প্রায় সবার বাড়ির সামনে গিয়ে খিস্তি করা শুরু করল! পেপসি বিরোধীদের দেখলেই প্রায় মারে আর কি। ওদিকে বিকেলে শুনলাম সিপিএম আর এক নকশাল গ্রুপের মধ্যে গড়িয়া কলেজে পেপসি বিরোধীতা নিয়ে খণ্ডযুদ্ধ হয়ে গেছে। নকশাল গ্রুপের অভিযোগ সিপিএম নাকি পেপসি গ্রুপের কাছে বিক্রী হয়ে গেছে। আর বিকেলবেলা সমীর আবিষ্কার করল বাকী একটা সাদা হাঁসের গায়ে কারা যেন গাড়ির লাল রঙ স্প্রে করে ছেড়ে দিয়েছে। আর সরস্বতীর বাহনের সেকি কষ্ট, শুকিয়ে যেতে যেতে একটিবারের জন্য ডানা ঝাপ্টে ঘাড় সোজা করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় আস্তে আস্তে মরে গেল! সমীরের মদ আনতে দেরী হয়েছিল। তখন গ্রীন লেভেল হিট হুইস্কি, পাইট এনে যখন ঢালল, লাল রঙ গলতে গলতে ডানার জট খুলে গিয়ে পালক নরম হয়ে এল কিন্তু প্রাণ ফিরে এল না! আর এসব পুরোটাই ঘটল তুপুদের বাড়ির সামনে! পুরোটা তুপু দেখল। 

সে রাতে তুপুর আমার সাথে ঝগড়া মারামারির পর্যায়ে পৌঁছোয়! আঁচড়ে চুল টেনে আমাকে রক্তাক্ত করে দেয়! কারণ আমার প্রিয় রঙ লাল! তুপুর বিশ্বাস আমার বন্ধুরাই হাঁসের গায়ে গরম লাল প্লাস্টিক পেইন্ট ঢেলে দিয়েছে। আমি ওই রাত দশটার সময় সেই নকশাল ছেলেটিকে খুঁজতে বেরোলাম, মাথায় রক্ত চেপে গেছে। একটা হাঁস সরিয়েছিলাম সমীরকে থামানোর জন্য, আর ও পুরো ব্যাপারটাকে নিজের রাজনীতির স্বার্থে কাজে লাগাল! 

এগারোটা নাগাদ খুঁজে পেলাম একটা নতুন অর্ধেক তৈরি বহুতলের ভিতরে। ওরা চার পাঁচজন বিড়ির আগুনে কথা বলছিল। আমি ঢুকেই বললাম – এদিকে এসো তো! ও জবাবে বলল –- এই তো রাজা এসে গেছে, রাজা আজ রাতে এই ঘোড়াটা তোমার কাছে রাখবে? বিড়ির আগুনে চিনতে পারি কালো রিভল্বারকে! এ তো সার্ভিসের রিভল্বার, এয়ার ফোর্সে অনেকবার গুলী চালিয়েছি, ভীষণ পরিচিত, কিন্তু আজ মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল! 

আমি নিঃশব্দে নীচে নেমে গেলাম! মামার বাড়ির দিকে যেতে যেতে শুনলাম আশেপাশে কোথাও সমীর গান গাইছে—ভালোবাসি স্বপ্নের মায়াজাল বুনতে, ভালোবাসি...খুব একটা বেসুরো মনে হলো না কিন্তু!


0 comments: