ধারাবাহিক - সুদেব ভট্টাচার্য
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
সদগুরু
সুদেব ভট্টাচার্য
পর্ব ২
সৌরপতি প্রত্যুষ তাঁর অন্তিম শয্যায় শুয়ে আছেন। প্রচণ্ড এক কষ্টে তাঁর শ্বাস দ্রুত আসা যাওয়া করছে। তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর শিষ্যরা। উত্তরের জানলা খুলে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকেই ভগবান তাঁর রশ্মি পাঠাচ্ছেন তাঁকে। এই রশ্মির রেখা ধরেই কিছুক্ষণের মধ্যেই সৌরপতি পাড়ি দেবেন সূর্যলোকে। দিবাকরম আর ধর্মকাম এসে দাড়ালেন তাঁর মাথার কাছে। তাঁদের দেখে এই কষ্টের মধ্যেও এক সরল হাসির রেখা ফুটে উঠল সৌরপতির মুখে। তিনি অতি ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, 'আমার মৃত্যুর পরে দিবাকরম, ধর্মকাম ও কিরণজ্যোতি -এই তিনজন মঠের পরবর্তী সৌরপতি হবে। আমাকে ভগবান সেরকম সংকেতই দিয়েছেন। আমার অবর্তমানে এই তিনজন সন্ন্যাসী দীক্ষা দিতে পারবেন এবং সূর্যদেবের প্রধান সেবাইত হিসেবে কাজ করবে।'
সবাই মাথা নত করে তাঁর কথাতে সায় দিল। সৌরপতি প্রত্যুষের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। তাই কিরণজ্যোতি তাঁর মুখে একটু জল দিলেন।
সৌরপতি প্রত্যুষ আবার বলতে লাগলেন, 'তোমরা নিজেদের মধ্যে বিবাদ কোরো না। মনে রেখো, সূর্যপ্রাপ্তিই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। এই নশ্বর দেহের কোনও মূল্য নেই আমাদের কাছে। ভগবান প্রাপ্তিই আসল সুখ। তাই আমার শিক্ষাগুলি মনে রেখো তোমরা। দিবাকরম, তোমার ওপরে আমার অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা রয়েছে। তুমি এই সূর্যমন্ত্র সারা পৃথিবীবাসীর কাছে পৌঁছে দেবে একদিন। আমাকে কথা দাও তুমি, পুত্র।'
দিবাকরমের চোখে জল ভরে আসছে। তিনি নিজেকে চিরদিন দীন হীন ভেবে এসেছেন। তিনি এতবড় দায়িত্ব পালন করবেন কি করে? তবু এই সময় অবিশ্বাসকে প্রশ্রয় দেওয়া চলে না। তিনি গুরুদেবের পা স্পর্শ করে বললেন, 'কথা দিলাম।'
সৌরপতি প্রত্যুষের চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা জল বেড়িয়ে ঝরে পড়ল বালিশে। তাঁর মুখে এখন প্রশান্তির হাসি। সময় আগত বুঝে দিবাকরম জোরে জোরে, সূর্যগায়ত্রী পড়ে শোনাতে লাগলেন তাঁর কর্ণকুহরে। সবাই সমবেত স্বরে তাই অনুসরণ করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে সৌরপতির মুখ হাঁ হয়ে গেল, প্রাণবায়ু মিশে গেল সূর্যরশ্মির সাথে। ধর্মকাম জানলার ধারে দাঁড়িয়ে সূর্যের দিকে প্রণাম নিবেদন করলেন, তারপর জানলার কপাট রুদ্ধ করে দিলেন। সবাই একে একে এসে গুরুদেবের পায়ে সূর্যমুখী ফুল রেখে তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধাটুকু উজাড় করে দিল। একমাত্র দিবাকরমের মনে শুধু ঘুরতে থাকল সৌরপতির শেষ কথাগুলি।
*******
সৌরপতি প্রত্যুষের দেহাবসানের পর একবছর কেটে গেছে। এখনও দিবাকরম নিজেকে গুছিয়ে উঠতে পারেননি। এদিকে তিনি গুরুর অনুজ্ঞাও ভুলতে পারছেন না। তিনি কীভাবে সূর্যদেবের কথা ছড়িয়ে দেবেন সমগ্র পৃথিবীর বুকে? একদিন নিজের গুরুর প্রতিমূর্তির সম্মুখে বসে এসবই চিন্তা করছিলেন নব সৌরপতি। এখন এই মঠে তিনি ছাড়াও আরও দুজন সৌরপতি রয়েছেন - ধর্মকাম ও কিরণজ্যোতি। ওঁরা নিজেদের মত করে গুটিকতক শিষ্যও বানিয়ে ফেলেছেন। খুবই ধর্মপ্রাণ ওঁরা। ওঁদের দেখে দিবাকরম মুগ্ধ হন সর্বক্ষণ। তবে তিনি মনে মনে এটাও বুঝতে পারেন যে কিরণজ্যোতি হয়ত তাঁকে কিঞ্চিৎ ঈর্ষা করেন। অনেক ভেবে তিনি এই ঈর্ষার একটা সম্ভাব্য কারণও খুঁজে পেয়েছেন। সন্ন্যাসের আগে দিবাকরম যখন সুখব্রত ছিলেন, তখন তাঁর অগাধ পয়সা ছিল। তিনি ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের উচ্চশিক্ষিত ভদ্রলোক। ইংরাজীও বেশ অনেকক্ষণ টানা বলতে পারেন। আর তাই তাঁর কথা বাচনভঙ্গী সহজেই মানুষকে আকৃষ্ট করে। অন্যদিকে কিরণজ্যোতি গ্রাম্য মানুষ, কথাতেই ভাষার টান রয়েছে। তাই হয়ত তাঁর জনপ্রিয়তাও খানিক কম দিবাকরমের চেয়ে। এছাড়া আর কোনও কারণ খুঁজে পাননি দিবাকরম। তিনি নিজে কখনও কুব্যাবহার করেননি কিরণজ্যোতির সঙ্গে। কারণ তিনি তাঁর সন্ন্যাস জীবনে যেটুকু সারমর্ম অনুধাবন করতে পেরেছেন তাতে তিনি জেনেছেন যে জাগতিক শিক্ষার কোনও মূল্যই নেই আসলে। তাঁর এই জ্ঞান, পাণ্ডিত্য সবই তাই সূর্যেন্দ্রীয় প্রীতি ইচ্ছায় সমর্পিত। আর সন্ন্যাস গ্রহণের পর কেউ দরিদ্র থাকতে পারে না। তাদের সকলের এখন একটাই পরিচয় তারা মহান সৌরপতি প্রত্যুষের শিষ্য। এই মঠের দেওয়ালের ভিতরে এই ভিন্ন আর কোনও পরিচয় থাকতে পারে না।
একদিন নিজের ভাবী কর্তব্য সম্পর্কে নানা কথা চিন্তা করছিলেন সৌরপতি দিবাকরম। এমন সময় ধর্মকাম প্রবেশ করলেন সেই ঘরে। প্রকৃত গুরুভাইয়ের মতোই দিবাকরমের মনোভার লাঘব করার জন্য সচেষ্ট হলেন তিনি। দিবাকরম তাঁকে খুলে বললেন তাঁর মনের সমস্ত কষ্ট এবং গুরুদেবের দেহ রাখার আগে তাঁর প্রতি বলে যাওয়া সেই অমোঘ বাণীর কথা। সব কিছু শুনে ধর্মকাম তাঁকে বোঝালেন যে ঈশ্বরের নাম প্রচারেই দিবাকরমের সন্ন্যাসজীবনের সার্থকতা। আর সেই নাম প্রচারের মূল ভিত্তিই হলো বই। জনসাধারণের জন্য লিখিত একটি সহজবোধ্য পুস্তক ছাড়া পৃথিবীতে সূর্যদেবের প্রচার প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তাই প্রথমেই দিবাকরমের উচিত সৌরদের সমস্ত পুঁথি দিয়ে একটি পুস্তক রচনা করা। এবং যেহেতু ইংরাজীতে তিনি পারদর্শী তাই সেই বেদ, পুঁথি, ইত্যাদি গ্রন্থগুলি তাঁকে যথাযথ ভাবে অনুবাদ করতে হবে যাতে দেশের বাইরেও সমস্ত মানুষের কাছে সেটা সহজবোধ্য হয়ে যায়। দিবাকরম এতক্ষণে যেন দিশা পেলেন একটা। ধর্মকামের মুখ থেকে যেন আসলে তিনি গুরুর আদেশই পেলেন। তিনি মনোস্থির করলেন যে সমস্ত সৌরপুঁথি তিনি অনুবাদ করবেন ইংরাজীতে। এবং তারপর তাঁর আসল কাজ শুরু হবে।
*********
শেষ দশ বছর ধরে দিবাকরম হাতের কাছে যা পেয়েছেন শুধু পড়েছেন। কোনারক সূর্যমন্দিরে গেছেন অনেকবার। সূর্যের মহিমার সন্ধানে তিনি যতই অতলে ডুব দিয়েছেন ততই যেন তিনি বিস্মিত হয়েছেন। তাঁর মনে হচ্ছে প্রতিধাপে তিনি সূর্যলোকে চলে যাচ্ছেন। এই তো তাঁর প্রভু কোল পেতেই রয়েছেন। সূর্যের প্রাচীনত্ব সীমাহীন। তাই শুধু হিন্দু ধর্মই নয়, পৃথিবীর সমস্ত পেগান ধর্মের পথে তিনি সন্ধান করেছেন পরম সত্যের। তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ আত্মার উপলব্ধি। তাই এই ক’বছরে ইনকা সভ্যতা, মিশর সভ্যতা - সবকিছু তিনি কন্ঠস্থ করে ফেলেছেন। দশখানা সৌরপুঁথি ইংরেজীতে ভাষান্তরও করে ফেলেছেন। তিনি বুঝতে পারছেন এদিকের কাজ তিনি অনেকটাই গুটিয়ে এনেছেন। এবারে আসল কাজ সাধন করার পালা। কিন্তু সেখানেই তাঁর সন্দেহ হচ্ছে প্রবল।
দিবাকরমের বয়স এখন প্রায় সত্তর বছর। তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন। অথচ এখনও তাঁর কানে সৌরপতি প্রত্যুষের বাণী স্পষ্ট বেজে ওঠে - 'কথা দাও পুত্র।' কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সে তিনি আর কি বা করতে পারবেন? ধর্মকাম গত হয়েছেন দু’বছর আগেই। এখন এই মঠে অবশিষ্ট রয়েছেন দুইজন সৌরপতি মাত্র। তাঁরা চলে গেলে এই বিশাল কর্মকাণ্ড কে সামলাবে? যোগ্য উত্তরসূরির জন্য ভগবানের সঙ্কেত না পেলে তিনি তো কাউকে নির্দিষ্টও করতে পারবেন না সৌরপতি পদের জন্য।
একদিন হেমন্তের বিকেলে শেষ বইটা অনুবাদের পর দিবাকরম যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।এতদিনের নিরলস পরিশ্রম তাঁর অনেকটাই লাঘব হলো। কিন্তু এরপরের পদক্ষেপ কি হবে সেই নিয়ে তিনি বেশ ধন্দেই ছিলেন। বিকেল হয়ে আসছে, সান্ধ্যপূজার সময় আসন্ন। সৌরপতির দেহেও যেন ক্লান্তি নেমে আসছে। দিবাকরম এগিয়ে চললেন গর্ভগৃহের দিকে। সূর্যাস্ত না হলে পুজো শুরু করা যাবে না। তাই তিনি অপেক্ষা করছিলেন মন্দিরপ্রাঙ্গণে। আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি হারিয়ে গেলেন মেঘের ওপারের জগতে। যেখানে তাঁর গুরু আছেন, আছেন গুরুভাই ধর্মকাম। ওঁরা এখন রোহিতাশ্বের ন্যায় সূর্যের সেবা করে চলেছেন অহরহ। তাঁর ভাগ্যে কি আছে সেখানে পৌঁছনো? বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হবার পরেও সূর্য আকাশে রয়েছে দেখে একটু অবাকই হলেন সৌরপতি। আজকে তো আরও আগেই সূর্যাস্ত হবার কথা। তবে কি ভগবান তাঁকে কোনও সঙ্কেত দিতে চাইছেন?
এমন সময় কিরণজ্যোতি এলেন পুজো দেখবার জন্য। আকাশে সূর্য দেখে তিনি বললেন, 'বিকেলের পরেও আকাশে আলো! এর মানে এখনও অনেক কাজ বাকি। তাই না বন্ধু?'
দিবাকরম চমকে উঠলেন। সবকিছু তাঁর সামনে পরিস্কার করে দিলেন সূর্যদেব। সত্যিই তো তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু অক্ষম তো নন। তাঁর এখনও অনেক কাজ বাকি। গুরুদেবকে দেওয়া কথা তাঁকে রাখতেই হবে। তিনি সম্মতিতে মাথা নেড়ে বললেন, 'হ্যাঁ আপনি যথার্থই বলেছেন। আমার এখন অনেক কাজ বাকি। ভাবছি আগামী পরশুই আমি বেড়িয়ে পড়ব। এখানে আর কিছুতেই মন টিকছে না। আসলে ঘর থেকে অনেক দূরে আমাকে প্রভুর কিরণ পৌঁছে দিতে হবে, সেই আভাসটাই যেন দৃঢ় হচ্ছে ক্রমশ। তাই আমার এতদিনের সঞ্চিত যৎসামান্য পুঁজি নিয়েই আমি বিদেশ যাত্রা করব।'
কিরণজ্যোতি সম্মতিতে মাথা নাড়লেন। আর এতক্ষণে সূর্যদেবও যেন আকাশে সচল হলেন। ধীরে ধীরে তিনি হারিয়ে গেলেন পশ্চিমের চক্রবালে। দুই সন্ন্যাসী কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম নিবেদন করলেন।
0 comments: