0

প্রবন্ধ - কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


গানে ও কবিতায় রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান ভাবনা 
কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় 



রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা যেন এক অতলান্ত মহাসাগর। তিনি কবি, গীতিকার, নাট্যকার, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, সমালোচক, শিক্ষাবিদ, শিল্পী, দার্শনিক, সুরকার, গায়ক, সমাজ সংস্কারক, স্বাধীনচেতা ও মানব বন্ধু। তিনি বিজ্ঞানী না হয়েও ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। তাঁর প্রতিভার ব্যাপ্তি বিশাল। তাঁর কর্ম ছিল বহুমুখী। সৃজনে ছিলেন তিনি কালজয়ী। 

আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। তাঁর সাহিত্যে, কাব্যে, সঙ্গীতে প্রবেশ করার সাধ্য আমার নেই। তাই আমার এই প্রবন্ধে আমি খুঁজে বেড়ানোর চেষ্টা করব বিজ্ঞানমনস্ক রবীন্দ্রনাথকে, প্রকৃতিপ্রেমী রবীন্দ্রনাথকে। 

ইদানীং অনেক লেখাতেই দেখি রবীন্দ্রনাথকে বিজ্ঞানী হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস। কিন্তু বিজ্ঞানী বলতে যা বোঝায় তা তিনি কোনওদিনই ছিলেন না। তিনি নিজেও কোনওদিন তা দাবী করেননি। তবে বিজ্ঞানের নির্যাসটুকু গ্রহণ করেছিলেন মনেপ্রাণে। তাঁর এই বিজ্ঞানমনস্কতার শুরু একেবারে শৈশবে। তখন তিনি নর্মাল স্কুলের ছাত্র। সেখানেই তাঁর বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। তিনি তাঁর জীবনস্মৃতি গ্রন্থে লিখেছেন-

“মাঝে মাঝে সীতানাথ দত্ত মহাশয় আসিয়া যন্ত্র তন্ত্র যোগে প্রাকৃতবিজ্ঞান শিক্ষা দিতেন। এই শিক্ষাটি আমার কাছে বিশেষ ঔৎসুক্যজনিত ছিল। জ্বাল দিবার সময় তাপসংযোগে পাত্রের নিচের জল পাতলা হইয়া উপরে উঠে, উপরের ভারী জল নিচে নামিতে থাকে এবং এইজন্যই জল টগ্‌বগ্‌ করে— ইহাই যেদিন তিনি কাচপাত্রে জলে কাঠের গুঁড়া দিয়া আগুন চড়াইয়া প্রত্যক্ষ দেখাইয়া দিলেন সেদিন মনের মধ্যে যে কিরূপ বিস্ময় অনুভব করিয়াছিলাম তাহা আজও স্পষ্ট মনে আছে….। যে-রবিবার সকালে তিনি না আসিতেন, সে-রবিবার আমার কাছে রবিবার বলিয়াই মনে হইত না।” 

মহাকাশের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় কিশোর বয়সে। ডালহৌসি পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে বাবার কাছে জ্যোতির্বিজ্ঞানের শিক্ষা মহাকাশ সম্পর্কে তাঁর কৌতুহল অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। বিশ্বপরিচয় গ্রন্থে তিনি এ বিষয়ে লিখেছেন-

“…তিনি আমাকে নক্ষত্র চিনিয়ে দিতেন, গ্রহ চিনিয়ে দিতেন, শুধু চিনিয়ে দেওয়া নয়, সূর্য থেকে তাদের কক্ষচক্রের দূরত্বমাত্রা, প্রদক্ষিণের সময় এবং অন্যান্য বিবরণ আমাকে শুনিয়ে যেতেন। তিনি যা বলে যেতেন তাই মনে করে তখনকার কাঁচা হাতে আমি একটা বড় প্রবন্ধ লিখেছি। স্বাদ পেয়েছিলুম বলেই লিখেছিলুম— জীবনে এই আমার প্রথম ধারাবাহিক রচনা আর সেটা বৈজ্ঞানিক সংবাদ নিয়ে।” 

এরপরে তিনি লিখেছেন- 

“তারপর বয়স আরও বেড়ে উঠল।… সহজবোধ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই যেখানে যত পেয়েছি পড়তে ছাড়িনি।… ক্রমাগত পড়তে পড়তে মনের মধ্যে বৈজ্ঞানিক একটা মেজাজ স্বাভাবিকভাবে হয়ে উঠেছিল।…” 

রবীন্দ্রনাথের এই স্মৃতিচারণ থেকে বোঝা যায় তাঁর এই বিজ্ঞান ঔৎসুক্য এবং বিজ্ঞানমনস্কতা সারাজীবন ধরেই ছিল। কাব্যে, নাটকে, গানে তিনি এর সাক্ষর রেখে গেছেন। চিন্তাভাবনায় এমনকী নানা পরিকল্পনাতেও আমরা খুঁজে পাই তাঁর বিজ্ঞানমানসিকতার পরিচয়। যেমন ‘জন্মদিনে’ বই-এর একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন-

“যেমন সুদুর ওই নক্ষত্রের পথ 
নীহারিকা জ্যোতির্বাষ্প মাঝে 
রহস্যে আবৃত 
আমার দূরত্ব আমি দেখিলাম তেমনি দুর্গমে— 
অলক্ষ্য পথের যাত্রী অজানা তাহার পরিণাম।” 

‘জন্মদিনে’ পূর্ণিমার রাতে জ্যোৎস্নার মোহমুগ্ধ আকর্ষণে কবিকে যেমন গাইতে শুনেছি— “আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে….” তেমন ‘পত্রপুটের’ একটি কবিতায় চাঁদের রূঢ় বাস্তবের কাব্যিক বর্ণনায় বলেছেন-

“শুনেছি একদিন চাঁদের দেহ ঘিরে 
ছিল হাওয়ার আবর্ত। 
তখন ছিল তার রঙের শিল্প 
ছিল সুরের মন্ত্র 
ছিল সে নিত্য নবীন। 
দিনে দিনে উদাসী কেন ঘুচিয়ে দিল 
আপন লীলার প্রবাহ। 
কেন ক্লান্ত হল সে আপনার মাধুর্যকে নিয়ে। 
আজ শুধু তার মধ্যে আছে 
আলোছায়ার মৈত্রীবিহীন দ্বন্দ্ব— 
ফোটে না ফুল 
বহে না কলমুখর নির্ঝরিনী।” 

মহাকাশের বুকে অপার রহস্য নিয়ে বিরাজ করছে সূর্য। কবির আফসোস ছিল এই ভেবে যে সেই রহস্যের খোঁজ তিনি কোনও দিনই পাননি। তাঁর সেই আক্ষেপ ব্যক্ত হয়েছে ‘শেষ লেখা’ বইয়ের একটি কবিতায়-

“প্রথম দিনের সূর্য— 
প্রশ্ন করেছিল 
সত্তার নূতন আবির্ভাবে— 
কে তুমি, 
মেলেনি উত্তর 
বৎসর বৎসর চলে গেল 
দিবসের শেষ সূর্য 
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম সাগরতীরে। 
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় 
কে তুমি! 
পেলনা উত্তর।” (শেষ লেখা) 

বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড গড়ে ওঠার মূলে রয়েছে অনু-পরমাণু। বিজ্ঞানের এই সত্য তাঁর জানা ছিল। তাই তিনি ‘বিচিত্রিতা’-তে লিখেছিলেন- 

“যত বাণী, যত সুর 
যত রূপ, তপস্যার যত বহ্নিলিখা 
সৃষ্টিচিত শিখা 
আকাশে আকাশে লিখে 
দিকে দিকে 
অনু পরমাণুদের মিলন ছবি।” 

দূরন্ত গতিতে ছুটে চলা মুক্ত পরমাণু কবির চোখে ‘বিদ্রোহী’। একে তরঙ্গরূপে যে শৃঙ্খলিত করা যায় তা কবির জানা ছিল। ‘নটরাজ’ কাব্যগ্রন্থে তাই তিনি লিখেছেন- 

“নৃত্যের বলে সুন্দর হল 
বিদ্রোহী পরমাণু, 
পদযুগ ঘিরে জ্যোতি-মঞ্জীরে 
বাজিল চন্দ্রভানু।” 

রাতের আকাশে ভেসে ওঠে লক্ষ-কোটি নক্ষত্র। সৌরজগতের মতো তাদের ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে কত গ্রহ-উপগ্রহ। বিজ্ঞানের এই সত্য ধরা পড়েছে কবির গানে-

“অসীম আকাশে অগণ্য কিরণ, কত গ্রহ উপগ্রহ 
কত চন্দ্র তপন ফিরিছে বিচিত্র আলোক জ্বালিয়ে-” 

প্রাণের উদ্ভব নিয়েও রবীন্দ্রনাথের ছিল প্রবল আগ্রহ। তার হদিস পাওয়া যায় ‘পরিবেশ’ কাব্যগ্রন্থে। সেখানে তিনি লিখেছেন-

“বহু লক্ষ বর্ষ ধরে জ্বলে তারা, 
ধীরমান অন্ধকারে কালস্রোতে 
অগ্নির আবর্ত বুকে ওঠে। 
সেই স্রোতে এ ধরণীর মাটির বুদবুদ 
তারই মধ্যে এই প্রাণ 
অণুতম কালে 
কণাতম শিখা লয়ে 
অসীমের করে সে আরতি।” 

চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে শিশু বেড়ে উঠুক। মনের আনন্দে খেলার মধ্য দিয়ে সে শিক্ষা নিক। কল্পনার ডানা মেলুক। কিন্তু বড়দের শাসনে তার সেই কচি মনের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। ইচ্ছেগুলো কোনও দিনই বাস্তব রূপ পায় না। সহজপাঠের প্রথম ভাগে শিশুর সেই ইচ্ছে প্রকাশ পায় যখন সে বলে-

“দুই হাত তুলে কাকা বলে, থামো থামো, 
যেতে হবে ইস্কুলে, এই বেলা নামো। 
আমি বলি কাকা, মিছে করো চেঁচামেচি, 
আকাশেতে উঠে আমি মেঘ হয়ে গেছি।” 

বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক যে নিবিড় সে সত্যটি ধরা পড়েছে রবীন্দ্রনাথের গানে-

“আকাশ ভরা সূর্য তারা, বিশ্বভারা প্রাণ 
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান 
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।” 
                                                     (গীতবিতান) 

পরিবেশ দূষণের সমস্যা আজ বিশ্বব্যাপী। তবুও আমরা এ বিষয়ে সচেতন হতে পেরেছি কি? এ ব্যাপারে এখনও প্রশ্ন আছে। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু এ ব্যাপারে বহুদিন আগে ১৯৪০ সালে লেখা ‘সানাই’ কবিতায় আমাদের সাবধান করে দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন-

“ওদিকে ধানের কল দিগন্ত কালিমা ধূম্র হাত 
ঊর্ধে তুলি, কলঙ্কিত করিছে প্রভাত। 
ধান পচানির গন্ধে 
বাতাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে 
মিশাইছে বিষ। 
থেকে থেকে রেলগাড়ী মাঠের ওপারে দেয় শিষ। 
দুই প্রহরের ঘন্টা বাজে।” 

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মুক্ত মনের মানুষ। কুসংস্কারের বেড়াজালে তিনি নিজেকে কোনও দিনই আবদ্ধ রাখেন নি। বৈজ্ঞানিক যুক্তি ব্যতিত তিনি কখনওই কোনও মন্তব্য বা ব্যাখ্যা গ্রহণে রাজী হতেন না। একটা ঘটনার কথা বলি। ১৯৩৪ সালের ১৫ জানুয়ারি বিহারে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। সে সময় অনেকেই বলেছিলেন, বিহারের মানুষের অস্পৃশ্যতা জনিত পাপের কারণে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়। রবীন্দ্রনাথ গর্জে উঠেছিলেন এই ধরণের অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। তিনি বলেছিলেন, এটা কোনও বিধাতার কোপ নয়— একটা প্রাকৃতিক ঘটনা। 

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ শুধু বিজ্ঞানমনস্কই ছিলেন না, ছিলেন প্রকৃতি প্রেমিকও। এই প্রকৃতিপ্রীতি থেকেই তাঁর মনে এসেছিল তপোবন ভাবনা, যার সার্থক রূপ শান্তিনিকেতন। 

রবীন্দ্রপ্রতিভার ব্যাপ্তি বিশাল। যেন এক মহাসাগর। হাজারো মণিমুক্তোয় সম্পদশালী সেই মহাসাগরের গভীরতা মাপার সাধ্য আমার নেই। আমি ডুবুরি নই। সামান্য এক সমুদ্র-পর্যটক মাত্র। তাই সেই সাগর বেলায় দাঁড়িয়ে দু’একটা মণিমুক্তো খোঁজার চেষ্টা করেছি মাত্র।



0 comments: