0

প্রাচীন কথা - সুষমা ব্যানার্জী

Posted in




প্রাচীন কথা


উপেক্ষিতা
সুষমা ব্যানার্জী 


ঊর্ধশ্বাসে দৌড়াইতে দৌড়াইতে রুমা যখন যাত্রাস্থলে পৌঁছাইলো, তাহার কিছু বিলম্ব হইয়া গিয়াছিল। আর্যশ্রেষ্ঠ রাম, অনুজ লক্ষ্মণ, মহারাজা সুগ্রীব, মহাবীর হনুমান সকলের যুদ্ধাভিষেক সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে। ভগিনী তারা তাহাকে চক্ষু দিয়া ভর্ৎসনা করিয়া ইশারায় অঙ্গদকে দেখাইয়া দিলেন। মেটে সিঁদুর কপালে দিয়া বুনোফুলের মালা পড়াইয়া অঙ্গদকে বরণ করার সময়টুকুর মধ্যে একবারের নিমিত্তও অঙ্গদ বিমাতা রুমার চক্ষুর দিকে তাকায় নাই। একপক্ষে রুমার জন্য ইহা ভালোই হইয়াছে কারণ সেই দৃষ্টিতে ঘৃণা ব্যতীত আর কিছুই থাকিত না রুমা জানে।

ঘৃণা কি রুমা নিজেকেই কম করিয়াছে? মহান আয়ুর্বেদ আচার্য সুষেণের কনিষ্ঠা কন্যা সে। পিতার মতের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছায় বরণ করিয়াছিল বালীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা সুগ্রীবকে। আহা কি রূপ ছিল সুগ্রীবের! কাঁচা সোনার মতো গাত্রবর্ণ। তেজে তাঁহাকে প্রদীপ্ত অগ্নির ন্যায় দেখাইত। সুগ্রীবের বিদ্বান বলিয়াও খ্যাতি কম ছিল না। কিন্তু সিংহাসনের প্রতি তীব্র আসক্তি!! ভোগের প্রতি আসক্তি! সুগ্রীবের এই আসক্তিই রুমার জীবনে কাল হইয়াছে। 

এইসকল চিন্তার মধ্যেই দুইটি দলে বানরসেনাকে বিভক্ত করিয়া নরচন্দ্রমা রামচন্দ্র উত্তরফাল্গুনী নক্ষত্রে রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা আরম্ভ করিলেন। একটি দলের সেনাপতি করিলেন অগ্নিপুত্র নীলকে। পথপরীক্ষার নিমিত্ত শতসহস্র দ্রুতগামী বানরসৈন্য লইয়া অগ্রে তাহাদের পাঠাইয়া দিলেন। দুর্গম বনে গিয়া গুপ্তশত্রু অন্বেষণও তাহাদের অপর কার্য ছিল। অপর দলে ছিলেন স্বয়ং প্রভু রাম। মহারাজা সুগ্রীবকে বানরসৈন্য পরিচালনার ভার দিয়া লক্ষ্মণ, হনুমান, জাম্বুবান প্রমুখ সমভিব্যাহারে চলিলেন।

যাইবার পূর্বে সুগ্রীব যখন তারার নিকট বিদায় লইলেন, মুহূর্তের জন্য হইলেও ক্রোধে অগ্নিবর্ণ হইল রুমার মুখশশি। তবে, তৎক্ষণাৎ সেই অপমান সে গিলিয়া লইল প্রতিবারের ন্যায়। তাহাদের যাইবার পথের দিকে অনিমেষনেত্রে চাহিয়া রহিল রুমা যতক্ষণ পর্যন্ত না শেষ বানরটিও বিন্দুতে মিলিয়া যায়। ধূলায় তাহার বসন এবং কেশরাশি পিঙ্গল হইয়া গিয়াছে। বানর দাসী পরিবৃত হইয়া মহারাণী তারা কিষ্কিন্ধ্যার রাজভবনে চলিলেন। কেহ রুমাকে ডাকিল না। সে যে মহারাজ্ঞী তা প্রায় সকল বানরেরাই ভুলিয়াছে। কেবলমাত্র কিছু অনুচরী রুমার অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া রহিল। 

রাজপ্রাসাদে ফিরিতে তাহার মন চাহিতেছে না। শীতল ছায়াবৃত দিব্যমাল্যশোভিত কাঞ্চন নির্মিত তোরণ-সমন্বিত রাজপ্রাসাদটি অতি মনোহর। রুমা কল্পনাচক্ষে দেখিল অতঃপর ভগিনী তারা প্রাসাদে ফিরিয়া মৈরেয় মদ্য পান করিয়া দুঃখ ভুলিবার চেষ্টা করিবেন। কিন্তু রুমা? সে কি করিবে? তাহাকে একপ্রকার শূন্যতা গ্রাস করিল। মহা পরাক্রমশালী রাজা রাবণের সহিত যুদ্ধ করিয়া কয়জন বানরই বা প্রাণ লইয়া ফিরিবে? কেন যে এইরূপ বন্ধনে জড়াইলেন সুগ্রীব, তাহা রুমা বোঝে। রাজ্যপাট পাইবার আশায় রামচন্দ্রকে দিয়া বালী নিধনের প্রতিদান স্বরূপ এই যুদ্ধযাত্রা। রুমা বুঝিতে পারেনা, একক বালীর প্রাণের বিনিময়ে এতগুলি বানরের প্রাণ লইয়া ছিনিমিনি খেলিবার অধিকার সুগ্রীবের পাওয়া উচিৎ ছিল কি? মহাধার্মিক রামচন্দ্রই বা কি কারণে কোনও আর্য নৃপতির সহায়তা না লইয়া বানর সৈন্যদের যুদ্ধ করিতে উৎসাহিত করিলেন? তবে কি তাহাদের প্রাণের মূল্য নাই? সে রাজনীতি ভালো বুঝিতে পারে না। পিতাঠাকুরকে প্রশ্ন করা যাইত কিন্তু তিনিও যুদ্ধে গিয়াছেন। সে ভাবিতেছিল পিতাঠাকুরের সহিত আর সাক্ষাৎ হইবে কি না। তাহার চক্ষু জলে ভরিয়া যায়। আর সুগ্রীব? তিনিও কি.....? ভয়ে কম্পিত হইল রুমার অন্তস্থল। 

বালীর রাজত্বে তাহারা বেশ সুখেই ছিল কিষ্কিন্ধ্যার গিরিনগরীতে। মহাবলী বালী ছিলেন একাধারে বীর, তেজস্বী এবং উদার। কনিষ্ঠ ভ্রাতা সুগ্রীবের প্রতি তাঁর অপরিসীম স্নেহের পরিচয় রুমা একাধিকবার পাইয়াছে। কিন্তু নিজে রাজা হইবার আশা বোধকরি সুগ্রীব বরাবর পোষণ করিয়াছেন। নতুবা মহাদানব দুন্দুভির পুত্র মায়াবীর পশ্চাতে ধাবিত হইয়া বালী যখন গহ্বরের মধ্যে প্রবেশ করেন, কনিষ্ঠ সুগ্রীবকে তিনি তাঁহার শ্রীচরণের দিব্য দিয়া বাহিরে অপেক্ষা করিতে বলেন। নিজে বিপদের ভার লইয়া সেই অজানা বৃহৎ দুর্গম গহ্বরে প্রবেশ করিলেন রাজ্যকে বিপন্মুক্ত করিতে। আর সুগ্রীব! তাঁহার একবৎসরের অনুপস্থিতির সুযোগ লইয়া রাজসিংহাসন অধিকার করিলেন। শুধু তাহাই নহে সুগ্রীব ভাতৃজায়া তারাকেও ভার্যা রূপে গ্রহণ করিলেন। তাহাদের সমাজে বহুবিবাহ নিন্দনীয় নয় কিন্তু শত্রুর সহিত যুদ্ধরত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার নির্গমনের মুখ প্রস্তরখণ্ড দিয়া রুদ্ধ করিয়া জেষ্ঠভ্রাতার মাতৃতুল্যা স্ত্রীকে ভার্যা রূপে গ্রহণ করা! এই কি একজন ধার্মিক প্রবরের কার্য হইল? বালী ফিরিয়া আসিয়া রুমার সহিত যে দুর্ব্যবহার করিয়াছিলেন, তাহার জন্যেও কিছুটা হইলেও কি সুগ্রীব দায়ী নহেন?

প্রশ্নগুলি রুমার মাথায় অনবরত ঘুরিতে থাকে। তাহাদের সম্প্রদায়ে মহারানীর রাজকার্য সম্পর্কিত মতামত গৃহীত হয়না। তারার কথা পৃথক। তিনি সর্বজ্ঞা। মহামতি বালীও তারার মতামত গ্রাহ্য করিতেন। কিন্তু রুমার কথা শুনিলে সুগ্রীবের রাজা হওয়া হইত না। এত সবের পরেও সুগ্রীবকে ত্যাগ করিবার কথা সে ভাবিতে পারেনা। পিতার অমতে তাহাদের বিবাহ, সুতরাং পিতৃগৃহে ফিরিবার আর আশা নাই। সর্বোপরি সুগ্রীবকে সে মন, প্রাণ দিয়া ভালোবাসে। তাই যুদ্ধে গমনোদ্যত সুগ্রীবের কল্যাণের নিমিত্ত পশুপতির আরাধনা করিতে সে রাজপ্রাসাদের দিকে অগ্রসর হয়। 

পূজাস্থলে প্রবেশ করিবার কিছু পরে তাহার মন একটু শান্ত হয়। মহাদেব পশুপতির চরণে সুগ্রীবের সমস্ত অপরাধের জন্য ক্ষমা চাহিয়া সুগ্রীবের প্রাণভিক্ষা করে। তৎসহ সকল বানরসৈন্যের সুরক্ষা প্রার্থনা করিয়া দ্বিতীয় বার ধ্যানমগ্ন হইল সে।

রাত্রি এখন গভীর। সমস্ত চরাচর নিদ্রাচ্ছন্ন। সেই দিনটির পর থেকে তাহার রজনী নিদ্রাহীন কাটিয়া যায়। তাহার সহিত উলুক এবং কিছু রাতচরা পক্ষী জাগিয়া থাকে। একটি একটি করিয়া নক্ষত্রাদির মুছিয়া যাওয়া দেখে গবাক্ষ দিয়া। অতঃপর চন্দ্র অস্তমিত হইলে শয্যায় ফেরে সে। নক্ষত্রাদির মধ্যেই তাহার অনাগত সন্তান খুঁজিয়া ফেরে। বালীর মৃত্যুর পর সুগ্রীবের রাজ্যাভিষেক হইবার কিছুদিনের মধ্যেই বহুবছর বাদে তাহার গর্ভধারণ হয়। কিন্তু সুগ্রীবকে জানাইবার পূর্বেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাহা নষ্ট হইয়া যায়। পিতাঠাকুর গোপনে সাহায্য করিয়া ছিলেন সেই সময়। আরও গোপনে রুমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়াছিল। কারণ এ সন্তানের পিতৃপরিচয় লইয়া তাহাদের সমাজে কানাকানি হইত এবং সুগ্রীবই যে এর পিতা তাহা সুগ্রীব নিজেও বিশ্বাস করিতেন কিনা তাহা লইয়া রুমার যথেষ্ট সন্দেহ রহিয়াছে। তাহা ব্যতীত চিরকাল অঙ্গদকেই আপন সন্তান মানিয়া আসিয়াছে সে; অঙ্গদ রুমাকে যতই ঘৃণ্য মনে করুক না কেন। তাই ভ্রাতৃহত্যার পাপ তাহার সন্তানকেও বহিতে হইবে কিনা তাহা রুমা জানেনা; বিশেষত সুগ্রীব যাহার পিতা। কিন্তু এসকলই যুক্তি। তাহার মাতৃহৃদয় ইহাতে সন্তুষ্ট হয়না। যে সন্তান অঙ্কুরিত হইবার পূর্বেই বিনষ্ট হইয়া গিয়াছে তাহার নিমিত্ত প্রত্যহ সে অশ্রুপাত করিয়া থাকে। তাহার অনুচরীরা কেহ কেহ তাহার এই গোপন অশ্রুবিসর্জনের বিষয়টি জানে। কিন্তু সঠিক কারণ জানেনা। তাহারা তারা কর্তৃক রুমার ভাগ্যবিপর্যয়ই ইহার কারণ বুঝিয়া লয়। ইহাই তাহারা স্বাভাবিক মনে করিয়া থাকে। 

কিন্তু আজ রুমার হৃদয় বাঁধ মানিতেছিল না। তাহার সকলি শূন্য করিয়া দিয়া কে যেন চলিয়া গিয়াছে। আহা, সে সন্তানও যদি থাকিত! তাহার মুখচুম্বন করিয়াও এ দীর্ঘ কাল কাটাইয়া দেওয়া যাইত। পশুপতি কেন তাহার সাথেই এমন করিলেন? সুগ্রীব, অঙ্গদের কিছু হইলে এই বানর সাম্রাজ্য রক্ষা করিবে কে? ভাবিতে ভাবিতে উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করিয়া উঠিল সে। আজ আর সে তাহার ভাবাবেগ সংবরণ করিবার চেষ্টা করিল না। 

তাহার ক্রন্দনের স্বর দ্বাররক্ষীর কর্ণ ছাপাইয়া তারার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল। তারার তখন মৈরেয় নেশা কাটিতেছিল। রুমার ক্রন্দন শুনিয়া সে ভাবিতেছিল, আহা! কাঁদুক বেচারী! বড় কষ্ট তাহার..




0 comments: