প্রবন্ধ - শিবাংশু দে
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
সোনালি খোলস
শিবাংশু দে
'সোনালি খোলসে'র উপমানটি আমি উপনিষদ থেকে নিয়েছি। যেখানে বলা হয়েছে সত্য কেউ দেখেনি, কারণ তা এক মণিময় পাত্রে সংরক্ষিত আছে। মানুষের যাবতীয় প্রয়াস ঐ পাত্রের বিচ্ছুরিত আলোয় চমক লাগিয়ে ফিরে আসে। অল্পপ্রাণ মানুষ ঐ বিচ্ছুরিত আলোর ঝলসানিটিকেই 'সত্য' ভেবে মোহিত থাকে। আমাদের দেশে ঈশ্বরকেই আদিকবি বা কবিগুরু মনে করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথও সেই রকমই লিখেছেন। তাই নিপাতনে সিদ্ধ হিসেবে সমস্ত 'কবি'ই ঈশ্বরের অংশ এরকম ভাবায় কোনও ক্ষতি নেই। সে তো বিশ্বাসীদের কাছে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই ঈশ্বরের রূপের প্রকাশ। কবিও বা তার বাইরে কেন থাকে। ঈশ্বরের অংশী যে সে কী করে অল্পপ্রাণ, দুর্বল হতে পারে? এভাবে তো ভাবাই যায়।
কবিতা নিয়ে কয়েকটি মৌল প্রশ্ন অনেকের মতো আমারও মনে সতত জেগে থাকে। গত অন্তত তিরিশ বছর ধরে তার সন্ধান করি। বাল্মীকি থেকে শুরু করে অসংখ্য দেশিবিদেশি প্রিয়জন, যাঁদের মধ্যে কবি, জ্ঞানী, শিল্পী বা নিজের মতো ইতর মানুষজন সবাই রয়েছেন, কিন্তু নানা সংশয়ে এখনও আচ্ছন্ন থাকি। কবিতা বিষয়ে কোনও আপ্তবাক্য প্রকাশ করার স্পর্ধা করিনা। নিজে সংশয়ে থেকে অবস্থান নিতে পারার দৃঢ়তা আমার নেই, সে কথা স্বীকার করার মধ্যেই শান্তি। বিষয়টি ব্যাপক ও বিশাল। অধিক বিস্তৃত হতে গেলে পাঠকদের পক্ষে বাহুল্য হয়ে যায়।
শব্দকে তো ব্রহ্ম বলা হচ্ছে। অস্যার্থ, পবিত্রতম নির্মান। প্রতিটি শব্দের নিজস্ব আত্মা আছে। তাকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করার মধ্যেই সিদ্ধি। তাই শব্দ কোনও সোনালি খোলস হতে পারেনা। তবে শব্দের মায়ায় ভুলে অনেকেই 'আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া ঘুরে মরি পলে পলে....'। একজন সচেতন কবি এই প্ররোচনার ঊর্দ্ধে উঠতে পারবেন এটা প্রত্যাশিত। যেমন নির্জন স্বাক্ষরে প্রথম স্তবকের পরেই 'রয়েছি সবুজ মাঠে, ঘাসে...' যেই শুরু হলো কবিতা এগিয়ে যেতে লাগলো 'আমি সেই পুরোহিত'এর দিকে। মনেই পড়বে না এই কবিতা কোনও দিন 'তুমি তা জানোনা...' বলে শুরু হয়েছিলো। যদিও এভাবে জীবিত বা মৃত কবিদের মাংসকৃমি খোঁটার কোনও প্রয়োজন আমি বোধ করিনা। এ তো এক শাস্ত্রীয় সংগীত উপভোগ করার মতো ব্যাপার। আমি স্বরলিপি, সুরসংস্থান কাগজে লিখে বোঝাবার চেষ্টা করি, সুরের নন্দনলোক আরও দূরে চলে যায়। কোন কবিতা কখন কীভাবে আমাকে ট্রিগার করবে তার বোধহয় কোনও সহজ সমীকরণ নেই।
কবিদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটি ঠিক ভক্ত ও ভগবানের নয়। সেখানে ফুল, চন্দন, মালা, নারায়ণশিলার কোনও স্থান নেই। এমন কী রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও কোনও মুগ্ধতা, বাণিজ্য বা নগরকীর্তনেরও অভিলাষ নেই বিন্দুমাত্র। সম্পর্কটির নাম আমি ঠিক জানিনা, তবে সেটি অসম্ভব জীবন্ত। আবার জীবনানন্দের 'বোধ' মনে পড়ে যায়। সম্পর্কটি শীতে ক্লিষ্ট হয়, গ্রীষ্মে ক্লান্ত হয়, বর্ষায় ভিজতে যায়। মনে হয় যতদিন এই গ্রহে বসবাস থাকবে, "আমি তারে পারিনা এড়াতে, সে আমার হাত রাখে হাতে, সব চিন্তা, প্রার্থনার সকল সময়...'
ভক্তের অধিকার আমার নেই, কারণ ভক্ত প্রশ্ন করেনা। তার আত্মনিবেদনেই সুখ। আমাদের সংস্কৃতিতে ভক্তের অধিকার চিরকাল মহিমান্বিত করা হয়েছে। নচিকেতার চাইতে প্রহ্লাদের অবস্থান আমাদের গুরুবাদী ঐতিহ্যে সর্বদাই উচ্চকোটীতে। প্রহ্লাদ হওয়া আমার ভবিতব্য নয়। আমি আসলে ডাকঘরের অমল, রাজার চিঠির জন্য বসে থাকি। রাজা তো জানেইনা।
কবিতা একটা এমন শিল্পমাধ্যম, যা মানুষের বৌদ্ধিক অহমচেতনাকে পরিস্রুত করে গভীরতর চৈতন্যবোধের দিকে গড়িয়ে দেয়। কবিতা বোঝার বা বিশ্লেষণ করার শিল্প নয়। এর স্পর্শ অনেক গহন অভিসারী। আমাদের বাল্যকাল থেকে আমরা যে ধরনের কবিতা অভ্যাস করে থাকি তা পাঠ্যবই থেকে কোনও পদ্যের দু-চার পংক্তি তুলে পরীক্ষার খাতায় 'ব্যাখ্যা লিখহ' নামক ব্যায়ামের সঙ্গেই সাঙ্গ হয়। আমাদের কবিতা পড়তে শেখার জন্য কেউ কখনও উৎসাহ বা প্রশ্রয় দেয়না। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা কবিতার কোনও মূল্য তো দেয়ইনা, বরং নিতান্ত নিরুৎসাহ করে। ছাপমারা কেরানি বা মিস্ত্রি তৈরির কারখানার জগতে কবিতা একটি প্রকৃত threat।
কবিতার সিদ্ধি বিচারে তার অন্তরতর স্পর্শকেই স্বীকার করি, তার শরীরের ভূমিকা পরে আসে। কবিতার শরীর craft থেকে আসে, আত্মাটা স্বতস্ফূর্ত। কবিতার craft একটি শ্রমসংকুল শিল্প। শিখতে হয়। তাকে আয়ত্ব করতে শুধু সহজাত শিল্পবোধই যথেষ্ট নয়, গহন শ্রমও স্বীকার করতে হয় যথেষ্ট সময় নিয়ে। কবিতাকে সহজগ্রাহ্য করার জন্য নাটকীয়তার আশ্রয় নিতে হয়। তবে এই'নাটকীয়তার' পরিমাপ নির্ণয়সাপেক্ষ। যেন রান্নার লবণ বা ছবির পটের লাল ছোপ। না হলে চলেনা আবার অধিকন্তু সর্বনেশে। ছন্দ, অন্ত্যমিল, লয়, যতি, ঘাত, শ্লেষ, ব্যঞ্জনা, প্রভৃতি সঠিক সামঞ্জস্যে মিলিয়ে দিতে পারলে কবিতার আত্মা স্বীকার্য শরীর ধারণ করতে পারে। এই কলাকৌশলটি স্থান-কাল-পাত্র সাপেক্ষে পরিবর্তনশীল। তাই সার্বভৌম পৃথিবীতে কবিতার শরীরে অভিযোজনজনিত হাজার পার্থক্য চোখে পড়ে।
কবিতার প্রধান শর্ত হচ্ছে তাকে কবিতা হয়ে উঠতে হবে। কার কলম থেকে পত্রস্থ হয়েছে তা গৌণ। এই যে শর্তটি, অর্থাৎ লেখাটি কবিতা হয়ে উঠলো কি না, তার কিন্তু কোনও সর্বজনগ্রাহ্য সূত্র নেই। একই রচনা পাঠক বা শ্রোতা সাপেক্ষে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কোন লেখাটি কোন পাঠকের হৃদয়ের তন্ত্রীতে অনুরণন সৃষ্টি করবে এবং কখন করবে, তারও কোনও স্থির সিদ্ধান্ত নেই। কবিবিশেষের কোনও রচনা যদি আপ্লুত করে তবে এটা জানিত যে শ্রোতার ভিতরের বারুদ নিজেই তৈরি হয়েছিলো, কবিতাটি শুধু ফুলকির কাজ করেছে। তা বলে তার সার্থকতাকে তুচ্ছ করা যায়না, স্বীকার করতেই হয়।
সোনা চোখ ঝলসে দেয়। কিন্তু তা ধাতব নির্মাণ। মানবসত্ত্বার অংশ নয়। কবিতার শিকড় মানবসত্ত্বার গভীরতম মাটিতে। তার গৌরব অন্তর্লীন। বিজ্ঞাপনে যেন তার মুখ না ঢেকে যায়।
0 comments: