ধারাবাহিক - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
Diary Entry - 08
5th. July, 1942. Sunday.
প্রিয় কিটী,
গত শুক্রবার ইহুদি বিদ্যালয়ের (এখন যেখানে আমরা পড়ি) বার্ষিক রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমি এবার প্রথম থেকেই বার্ষিক পরীক্ষায় খুব একটা ভাল ফল করব, এমন কিছু আশা করিনি। করার কথাও নয়। যে অবস্থার মধ্যে দিয়ে আমি আর আমার পরিবার বর্তমানে চলেছি, তাতে পড়াশুনা ভাল হওয়ার কথাই নয়। সেদিক থেকে দেখলে, আমার ফলও খুব একটা খারাপ হয়নি। একটাতে আমি বেশ খারাপ গ্রেড নম্বর পেয়েছি। বীজগণিতে পাঁচ গ্রেড নম্বর, দুটো বিষয়ে ছয় গ্রেড নম্বর আর বাকীগুলোতে সাত বা আট গ্রেড নম্বর পেয়েছি। বাড়িতে আমার গ্রেড নম্বর দেখে সবাই বেশ খুশী। অবশ্য পরীক্ষায় আমি কত গ্রেড নম্বার পেলাম বা আমি কি’রকম করলাম সে ব্যাপারে আমার মা আর বাবার দৃষ্টিভঙ্গি অন্যদের চেয়ে একদম আলাদা। আমার অভিভাবকরা একটু অন্য প্রকৃতির। আমি সন্তুষ্ট হলেই তাঁরা খুশী। তাঁরা চান আমরা যেন পড়াশুনাটা করি। তাতেই তাঁরা খুশী। আমার ফলাফল ভাল হলো না খারাপ হলো, কম পেলাম, না বেশী পেলাম, এসব নিয়ে বেশী তাঁরা বেশী চিন্তাও করেন না। বকাবকিও করেন না। শুধু মনে করিয়ে দেন, আরও ভাল করে পড়তে হবে। পড়াশুনাটা করতে হবে।
এই ছবিটি অ্যানির দশমতম জন্মদিনে তোলা হয়। ছবির একেবারে ডান দিক থেকে প্রথম জন হোল মারথা (Martha ); ডান দিকের দ্বিতীয় জন হলো, লেটজী (Letje); ডানদিকের তৃতীয় জন হলো মেরী বস (Meri Bos); তার পাশে ক্যাথে ইগেডী (Kathe “Kitty” Egydi) ছবিতে কিটী সব থেকে গাঢ রঙের স্কার্ট পড়ে আছে। এই কিটী অবশ্য সেই কিটী নয়, যাকে সম্বোধন করে অ্যানি তার ডাইরি লিখেছিল; ডান দিক থেকে পঞ্চম জন হলো জুল্টেজী কেটেল্লাপের (Juultje Kethellaper), এই মেয়েটি অ্যানির অন্যান্য বন্ধুদের থেকে বেশ লম্বা; ষষ্ট, সপ্তম ও অষ্টম জনে মধ্যে একজন অ্যানি, বাকি দুজনের নাম জানা যায়নি। একেবারে বাম পাশে দাঁড়িয়ে আছে লুসী (Lucia “Van” Dijk)। এদের বিস্তৃত পরিচয় নীচে “অনুবাদকের সংযোজিত অংশ”- এর মধ্যে দেওয়া হলো।
আমার মা আর বাবা মনে করেন, আমি যদি আমার রেজাল্টের নম্বর দেখে পড়াশুনার মাত্রাটা বুঝতে পারি তা’হলে, আজ ফল খারাপ হলেও তা আমি নিজে নিজেই ঠিক করে নেব। আর নিজে থেকেই পড়াশুনায় ‘সিরিয়াস’ হয়ে উঠব। তখন সব কিছু আস্তে আস্তে ভাল হয়ে যাবে। অর্থাৎ তাঁদের মতে রেজাল্ট নিয়ে বেশী চিন্তা করার দরকার নেই। আমি কিন্তু তাঁদের সঙ্গে একমত নই। আমি আমার রেজাল্ট নিয়ে চিন্তা করি। আমি কখনই খারাপ ছাত্রী হিসাবে চিহ্নিত হতে চাই না। ফলাফল আর বয়সের ভিত্তিতে যখন আমার স্কুলের মন্টেসরী বিভাগের সপ্তম মানে থাকে উচিৎ ছিল, তখন আমায় আমার বর্তমানের ইহুদি স্কুলের শিক্ষিকাগণ সেকেন্ডারী বিভাগের জন্য মনোনীত করেছিলেন। অন্যান্য ইহুদি বাচ্ছারা যখন ইহুদি স্কুলের মন্টেসরী বিভাগে যাচ্ছিল, তখন আমার বাবা ইহুদি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকাকে একটু অনুরোধ করাতেই তিনি আমাকে এবং লীসকে সেকেন্ডারী বিভাগে ভর্তি করে নিয়েছিলেন। আর তাতেই কিছুটা হলেও আমাদের চাপ একটু বেড়ে গিয়েছিল। হয়ত আমাদের বাবারা এবং আমাদের প্রধান শিক্ষিকা, আমাদের উপর এই বিশ্বাস ও আস্থা রেখেছিলেন যে, আমরা আরও ভাল করার চেষ্টা করব। আমরাও চাইনি বাবা-মা আর প্রধান শিক্ষিকার বিশ্বাসের অমর্যাদা করতে। আমার বোন মারগটেরও ফলাফল প্রকাশিত হয়েছিল। যথারীতি সে খুব ভাল ফল করেছিল। অস্বীকার করা যায় না সে আমাদের চেয়ে পড়াশুনায় অনেক বেশী ‘সিরিয়াস’। সেটা তার রেজাল্টেই দেখা যায়।
অ্যানের দিদি মারগট। ১৯৪১ সালে এই ছবিটা তোলা হয়
মারগট এমনিতেই বুদ্ধিমতি ছিল। তাই তার পক্ষে বিশেষ সম্মান সহ পরের ক্লাসে উত্তীর্ণ হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। আর সেটাই সে হয়েছিল। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফলের ওপর বিশেষ পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা আমাদের স্কুলে কিছু ছিল না। অর্থাৎ ক্লাসে কে কোন স্থান অধিকার করেছে, সে বিষয়ে রেজাল্টে কিছু উল্লেখ থাকত না। তাই তার রেজাল্টে বুদ্ধিমত্তার আভাস, প্রাপ্ত নম্বর বা গ্রেডে থাকলেও, তার কোনও বিশেষ উল্লেখ “মতামত” কলমে থাকত না। আমাদের বাবা ইদানীং বেশীরভাগ সময় বাড়িতেই থাকতেন। ইহুদি হিসাবে তার উপর সামাজিক অনেক বিধিনিষেধ এমনিতেই চেপে বসেছিল। তাঁকে তাঁর নিরাপত্তার কারণেই কিছুটা অন্তরীণ অবস্থায় থাকতে হতো। আর, ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে অন্তরীণ অবস্থা থেকে তাঁর বিশেষ কিছু আর করার ছিল না। বাইরের অস্থির অবস্থার করণে ব্যবসার অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল, যে সেখানে বিশেষ কিছু করার মতো ছিল না বললেই চলে। আর যদি বা ছিল, বা যতটুকু ছিল, তা’ও ক্রমেই অনাবশ্যক হয়ে পড়ছিল। ইহুদিদের উপর ব্যবসা সংক্রান্ত বিধিনিষেধের জেরে বাবার “ওপেক্টা” (Opekta) নামের কম্পানীটি, শ্রী কোওফুইস-এর (Mr. Koophuis) নিয়ন্ত্রণাধীন ট্রাভিস এন. ডি. কম্পানীর সাথে মিশে গিয়েছিল, আর মিঃ ক্রেলার তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন কোলেন এন্ড কোঃ (Kalen & Co.) কম্পানীর অংশীদ্বারত্বের মধ্যে দিয়ে তা অধিগ্রহণ করে নেন ।
ছবির বাম দিক থেকে ‘মিয়েপ গীস’; জোহানেস ক্লেলম্যান (Johannes Klelman); ভিক্টর গুস্টাভ ক্যুগলার (Victor Kuglar); মাঝখানে বসে, ওটো ফ্রাঙ্ক; এবং তাঁর পাশে বসে বেপ ভোস্কুজিল (Bep oskuijil)। এই চারজন, ওটো ফ্রাঙ্কের অন্তরীণ অবস্থায় তাঁর ব্যবসার ভার নেন। এমন কি ব্যবসাকে রক্ষা করার স্বার্থে তাঁরা ওটো ফ্রাঙ্কের প্রতিষ্ঠিত ওপেক্টার মালিকানা ক্যুগলারের পরিচালনাধীনে ট্রাভিস এন. ডি. নামাঙ্কিত কম্পানির মধ্যে অধিগৃহীত করেন। কারণ ১৯৪০-৪১ সালে জার্মান সরকার সিদ্ধন্ত নেয় যে, ইহুদি মালিকানাধীন সমস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সরকারী নোটিশে বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হবে। এই পরিস্থিতিতে ওটো ফ্রাঙ্ক তাঁর এই চার বিশ্বস্ত সহযোগীকে নিয়ে হস্তান্তকরণের পরিকল্পনা করেন।
কয়েকদিন আগে আমরা আমাদের বাড়ির পাশের ছোট গলি পথটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আসছিলাম। তখন প্রথম বাবা আমাদের বললেন, শীঘ্রই আমাদের কোনও গোপন জায়গায় আত্মগোপন করতে হবে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, পৃথিবীতে এমন কি ঘটেছে, যে তিনি হঠাৎ এ’কথা আমাদের বললেন। তিনি বললেন,
“ঠিক হয়ত এই মুহূর্তে তেমন কিছু ঘটেনি, বা ঘটার কোনও প্রত্যক্ষ আভাসও পাওয়া যাচ্ছে না। তবুও অ্যানি, তুমি ত’ জান গত প্রায় বছরখানেক ধরে আমরা অন্যদের কাছ থেকে আমাদের খাবার-দাবার, জামাকাপড় এমনকি আসবাবপত্র পর্যন্ত নিয়ে চলেছি। নিজেদের নামে সংগ্রহ করার কোনও ক্ষমতা বা সরকারী অনুমোদন আমাদের নেই। আমরা চাই না জার্মানরা আমাদের সবকিছু বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে আমাদের কপর্দকশূন্য করে দিক। তার চেয়েও বড় কথা, আমরা চাই না, আমরা জার্মানদের খপ্পরে গিয়ে পড়ি। তাই আমার মতে কিছু ঘটার আগেই, স্বইচ্ছায় ও পরিকল্পিতভাবে আমাদের আত্মগোপন করা প্রয়োজন। আর তা করাও উচিত। ধরা দেওয়ার জন্য চুপচাপ অপেক্ষা করে থাকা আদৌ সমীচীন হবে না।”
“কিন্তু বাবা কখন আমাদের যেতে হবে?” সত্যি কথা বলতে, বাবা এতটাই গম্ভীর আর কঠিনভাবে আমাদের কথাগুলো বললেন যে, আমার মনে মনে ভয় হতে শুরু করল।
বাবা বললেন, “তুমি এ’সব নিয়ে বেশী চিন্তা করো না। আমরা সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক করব। তুমি তোমার এই কিশোরীর জীবনটাতে তোমার মতো করে যতদূর সম্ভব আনন্দ আর খেলাধুলা উপভোগ কর।” ব্যাস, আর কোনও কথাই বললেন না। হায়, এই বিষাদ-ময় সত্য কথাটা যেন তাড়াতাড়ি আমাদের জীবনে বাস্তবায়িত না হয়। এটাই প্রার্থনা।
তোমার অ্যানি
-----------------------------------------------------------------------------------------
অনুবাদকের সংযোজিত অংশ -
১) ভিক্টর গুস্টাভ ক্যুগলার (Victor Gustav Kuglar): অ্যানি তার ডাইরিতে ক্যুগলারকে মিঃ ক্রেলার (Mr. Kraler) নামে উল্লেখ করেছে। ক্যুগলার তথা ক্রেলার ছিলেন ডাচ নাগরিক। তিনি মিঃ ফ্রাঙ্ক ও মিঃ ভ্যান ড্যানের সাথে একসাথে ব্যবসা করতেন। মিঃ ফ্রাঙ্ক ও মিঃ ড্যান দুজনেই হিটলারের ইহুদি নিধনের ভয়ে, গোপন অ্যানেক্স ভবনে আত্মগোপন করতে বাধ্য হলে, মিঃ ক্রেলার তাঁর আর তিনজন সহকর্মীর সাথে অফিস বিল্ডিং এবং অ্যানেক্স লুকিয়ে থাকা পরিবারগুলির দেখাশুনা করতেন। তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন।
ভিক্টর গুস্টাভ ক্যুগলার বা মিঃ ক্রেলার
২) জোহানেস ক্যোলম্যান (Johannes Klelman): অ্যানি তার ডাইরিতে ক্যোলম্যানকে মিঃ কোওফুইস (Mr. Koophuis) নামে উল্লেখ করে। মিঃ কোওফুইস ছিলেন ডাচ নাগরিক। তিনি মিঃ ক্রেলারের সঙ্গে ওটো ফ্রাঙ্ক ও মিঃ ড্যানের ব্যবসা দেখাশুনা করতেন। নেদারল্যান্ডে ইহুদি সম্প্রদায়ের ব্যবসা নিষিদ্ধ করে দেওয়াতে তিনি ইহুদিদের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠিত ব্যবসার দায়িত্ব নেন। এ’ছাড়াও যে সমস্ত ইহুদি আত্মগোপন করে থাকতে বাধ্য হয়েছিল, তিনি তাদের নিজ দায়িত্বে লুকিয়ে খাদ্য সরবরাহ করার ভার নিয়েছিলেন।
জোহানেস ক্যোলম্যান (Johannes Klelman)
৩) মারথা ভ্যান দেন বরগ (Martha) অ্যানির স্কুলের বন্ধু ছিল। মারথা জাতিগত ভাবে ইহুদি হলেও, জার্মান বাহিনী তাকে হত্যা করেছে, এ’রকম কথা শোনা যায়নি।
৪) রীয়া “লেটজী” স্যুইলেন্স (Rei “Letje” Swillens) লেটজী অ্যানির মন্টেসরী স্কুলে অন্যতম প্রিয় বন্ধু ছিল। স্কুলে সারাক্ষণ অ্যানির সাথে থাকত। অ্যানি তার গোপন কথা লেটজিকে নির্দ্বিধায় বলত। লেটজীর পরবর্তীকালের স্মৃতি কথা থেকে আমরা জানতে পারি, অ্যানির এক মামাকে নাৎসিরা ইহুদি বলে ধরে নিয়ে গিয়ে বন্দী করে। পরে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়, এবং সে স্থায়ীভাবে আমেরিকায় চলে যায়। রীয়া স্যুইলেন্সরা ছিল খ্রিষ্টান। তাই তাদের পরিবার যুদ্ধের সময় অ্যামডারস্টামে নিরপেক্ষভাবে থাকতে পেরেছিল। বড় হয়ে লেটজী শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নেন। এবং অ্যামস্টেল্ভেনে (Amstelveen) স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। অ্যানির দশমতম জন্মদিনে লেটজীও নিমন্ত্রিত ছিল।
৫) মেরী বস (Mary Bos) মেরী বসও অ্যানির মন্টেসরী স্কুলের বন্ধু ছিল। পাতলা গড়নের মেরী খুব ভাল ছবি আঁকতে পারত। আর তার জন্যে বন্ধু মহলে তার বেশ কদর ছিল। অ্যানি তার ডাইরিতে মেরী বসের কথা বেশী না লিখলেও, এক জায়গায় লিখেছে, যে একদিন স্বপ্ন দেখেছে, যে সে আর পিটার শিফফ একসঙ্গে মেরীর আঁকা ছবি দেখছে। মেরী তার বাবার সঙ্গে ১৯৪০ সালে আমেরিকা চলে যায়। যাওয়ার আগে অ্যানি তাকে একটি সুন্দর বিদায় সম্বর্ধনা লিখে দিয়েছিল। মেরী আমেরিকায় গিয়ে, অ্যানির কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। পরে অ্যানির ডাইরি পড়ে তার অ্যানির কথা মনে পড়ে। সে জানতে পারে অ্যানি ও তার পরিবার জার্মানিদের কতটা অত্যাচার সহ্য করে কষ্টকর মৃত্যুকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। মেরী বব শ্ন্যেডারকে বিবাহ করে। মেরী বব এখনও বেঁচে আছেন ও আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
৬) ক্যাথে “কিটী” ইগ্যেডি (Kathe “Kitty” Egyedi) কিটী অ্যানি অপেক্ষা মেরী বসের কাছের বন্ধু ছিল। মেরী বস বাবার সাথে আমেরিকায় চলে যাওয়ার পরও কিটী তাকে অনেকদিন পর্যন্ত নিয়মিত চিঠি লিখত। ১৯৪২ সালের ৯ই জুলাইয়ের (এই দিন অ্যানিরা সপরিবারে তাদের নির্ধারিত গোপন আস্তানায় চলে যায়) কয়েকদিন আগে, কিটী অসুস্থ অ্যানিকে দেখতে তার বাড়ি গিয়েছিল। সেদিন সে প্রথম অ্যানির চিন্তাশীল ব্যক্তিত্বময়ী রূপটা উপলব্ধি করে। অ্যানি তার ডাইরিতে যে কিটীর কথা উল্লেখ করেছে, সেই কিটী এই কিটী ছিল না। কারণ অ্যানির সাথে এই কিটীর খুব একটা ঘনিষ্টতা ছিল না। ইহুদি হওয়া স্বত্বেও কিটীদের পরিবার জার্মানির ইহুদি বিদ্বেষের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল। তারা ওই সময় থেরেসিয়ান্সটাডে (Theresienstadt) গোপনে স্বেচ্ছায় অন্তরীণ হয়ে ছিল। কিটীর বাবা ছিলেন দাঁতের ডাক্তার। কিটীও বড় হয়ে বাবার পেশাকেই গ্রহণ করে।
৭) জুল্টেজী কেটেল্লাপের (Juultje Ketellaper) জুল্টেজে অ্যানির মন্টেস্বারীর বন্ধু ছিল। জুল্টেজেকে নাৎসি বাহিনী সপরিবারে সবিবরের (Sobibor) অসামরিক বন্দী শিবিরের গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মেরে ফেলে।
৮) লুসীয়া “লুসী” ভ্যান ডিজক (Lucia “lucie” Van Dijk) লুসী অ্যানির সঙ্গে মন্টেসরীতে একসাথে পড়ত। লুসীর মা জার্মানের নাৎসি সমর্থিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক ব্লকের (National Socialist Block) গোঁড়া সমর্থক ছিলেন। প্রায় যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত তিনি ঐ দলকে সমর্থন করেতেন। লুসীও মায়ের সাথে ব্লককে সমর্থন করত। লুসীর বাবা প্রথমে ঐ দলের সমর্থক থাকলেও পরে তাদের জাতি বিদ্বেষী কার্যকলাপে বিরক্ত ও হতাশ হয়ে, ব্লক থেকে তাঁর সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। লুসী এন. এস. বি.-কে সমর্থন করে শুনে অ্যানি তার প্রতি হতাশ ও মানসিক ভাবে আহতও হয়েছিল। কিন্তু অ্যানিকে তার বাবা ওটো ফ্রাঙ্ক বুঝিয়েছিলেন যে, ওরা তার অপছন্দের রাজনীতি করলেও মানুষ হিসাবে তারা ভাল হতেই পারে। রাজনীতিকে ঘৃণা করতে গিয়ে অ্যানি যদি মানুষকে ঘৃণা করতে শুরু করে, তাহলে সেটা অন্যায়। লুসী নিজেও তার সমর্থনের ব্যাপারে দোলাচলমানতার মধ্যে ছিল। সেও মন থেকে এস. এন. বি. –কে পূর্ণ ভাবে সমর্থন করতে পারেনি। তারপর বাবার পরোক্ষ সমর্থন পেয়ে সে নাৎসিদের তরুণ সংগঠনের সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন করে। তার ঠাকুমাও এই দলটাকে শুধু অপছন্দই করতেন না, বরং ঘৃণা করতেন। ১৯৪২ সালে লুসী এস. এন. বি.- র সঙ্গ ছেড়ে দেয়। যুদ্ধের পর লুসী বিয়ে করে পরবর্তী জীবন অ্যামডারস্টামে কাটিয়ে দেয়।
ন্যাশানাল সোশ্যালিস্ট পার্টি (National Socialist Party) শুধু জার্মানির রাজনীতিতে নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, হিটলারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ন্যাশানাল সোশ্যালিস্ট পার্টির একটি বড় ভূমিকা ছিল। অ্যানির ডাইরির প্রেক্ষাপট যথাযথভাবে অনুধাবন করার জন্য, এই রাজনৈতিক দলটির ভূমিকা পাঠকদের জানা প্রয়োজন। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর হিটলার মিউনিকে তাঁর নাৎসি দল গঠন করেন। ১৯২৯ সালে হিটলার জার্মান প্রজাতান্ত্রের সাধারণতান্ত্রিক সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার এবং বিশ্বের বৃহত্তম আর্থিক বিপর্যয়ের হাত থেকে জার্মানকে রক্ষা প্রতিশ্রুতিকে সামনে রেখে, “নাশিয়নাল সোতসিয়ালিষ্ট পার্টি” –কে সাথে নিয়ে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করেন। (নাশিয়নাল-এর “না”, আর সোতসিয়ালিষ্টের-এর “ৎসি” নিয়ে “নাৎসি” – এই ব্যাখ্যা দিয়েছেন জওহর লাল নেহেরু, তাঁর “বিশ্ব ইতিহাস প্রসঙ্গ” [Glimpses of World History] গ্রন্থে; শ্রী গৌরাঙ্গ প্রেস, সেপ্টেম্বর ১৯৫১; পৃঃ – ৮৮০)। এই দলকে নিয়ে তিনি ১৯২৯ সালে ওয়েমার সাধারণতন্ত্রের ক্ষমতা দখলের প্রথম চেষ্টা করেন। কিন্তু বিফল হন এবং অভ্যুত্থানের চেষ্টার অপরাধে তিনি কারারুদ্ধ হন। কারাগারের ভিতর তিনি তাঁর “মেই ক্যাম্ফ” (Mein Kamf) বইটি লেখেন। পরবর্তীকালে এই বইটাই হয়ে ওঠে, নাৎসিদের বাইবেল। নরডিক জাতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার স্লোগান যেমন জার্মান যুবকদের আকৃষ্ট করেছিল, জাতীয়তাবাদ ও নরডিক জাতির প্রাধান্য জার্মানির ব্যবসায়ীদেরও আকৃষ্ট করেছিল। এর পশ্চাতে ছিল, ইহুদি বণিক ও শিল্পপতিদের একাধিপত্যের প্রতি জার্মান ব্যবসায়ীদের বিরক্তি ও হতাশা। হিটলারের ন্যাশানাল সোশ্যালিস্ট ব্লকের প্রধান কর্মসূচী ছিল - ১) ভার্সাই সন্ধিকে সামগ্রিকভাবে প্রত্যাখ্যান করা; ২) এরিয়ান জার্মান জাতির অধিবাসীদের নিয়ে জার্মান রাষ্ট্র গঠন করা; ৩) জার্মান ইহুদি সম্প্রদায়কে দেশদ্রোহী রূপে চিহ্নিত ও উচ্ছেদ করা; এবং ৪) মার্ক্সবাদের বিরোধীতাকে সামনে রেখে জাতীয় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা ব্যাপকভাবে প্রচার করা। জাতীয় সমাজতন্ত্রের গোপন এজেন্ডা ছিল, “শিল্প ও বাণিজ্য ইত্যাদিতে রাষ্টের কিছুটা নৈব্যক্তিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
Additional information er jonno lekhata aro besi interesting and lively hoye uthche... valo lagche pore...
ReplyDelete