1

ধারাবাহিক - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক


দিনমণি
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়



পূর্বকথা--

দেশে তখন ইংরাজ রাজত্ব চলিতেছে, তৎসত্বেও নানা স্থানে স্বাধীন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজা ও জমিদারেরা বসবাস করিতেছিলেন, তাঁহারা নিজেদের মত করিয়া রাজ্য শাসন করিতেন, রাজন্য প্রথার বিলুপ্তি ঘটে নাই। যদিও দেশের সর্বত্র স্বাধীনতার আগুন জ্বলিয়া উঠিয়াছিল।

সেই সময়ে অখ্যাত এক গ্রামের সম্পন্ন গৃহস্থ হইতে এক বালক গৃহত্যাগ করে। এই গৃহত্যাগের সাক্ষী ও সহায়ক ছিলেন ওই পরিবারেরই আশ্রিতা, অনাথা এক বৃদ্ধা রমণী। বালকটির পিতামাতা অপেক্ষাও তিনি ছিলেন তাহার আপন। বালকটি আর কেহ নহে, সেই সম্পন্ন পরিবারের গৃহকর্তার চতুর্থ ও কনিষ্ঠ সন্তান জ্ঞানতোষ। একই দিনে বালকের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার কারণে গৃহে পুলিশের পদার্পণ ঘটে, যুবকটি ফেরার হয়, কোনও সন্ধান পাওয়া যায় না। ভ্রাতাটির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাহায্য করার এবং স্থানীয় রেললাইনে বোমা রাখার অভিযোগ পাওয়া যায়।

কিন্তু গৃহসুখে প্রতিপালিত বালকটির গৃহত্যাগের কারণ কি? তবে কি সেও ভ্রাতার ন্যায় স্বদেশী সংগ্রামে লিপ্ত? 

গৃহত্যাগী বালকের সংবাদ বেলা বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে বাটীস্থ সকলের কর্ণে প্রবেশ করিয়াছে, গৃহকর্তা পারুলবালা নামক বধূটিকে ডাকাইয়া জিজ্ঞাসাবাদ করিতে করিতে বধূটি ভয়ে সংজ্ঞা লুপ্ত হইয়াছেন। বালকের সংবাদ এখনও পাওয়া যায় নাই, কিন্তু যে বৃদ্ধার সহিত বালকটির এত অন্তরঙ্গতা, সেই দিনমণি ভয়ে, দুশ্চিন্তায় দুর্বল শরীরে সংজ্ঞা লুপ্ত হইলেন।

অন্দর মহলেও ভারি ঝড় উঠিল। শিবতোষ দারুণ রোষে সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করিবার জন্য ডাকাডাকি করিলেও পারুলবালার কাণ্ড-কারখানা দেখিয়া ভীত হইলেন, পরে বিস্তর চ্যাঁচামেচি করিতে লাগিলেন। বাটিস্থ সকলে তাঁহার ব্যবহারে ভীত সন্ত্রস্ত হইল। বাস্তবিক সেদিন কি ঘটিয়াছিল...?

অতঃপর.........



পর্ব - ৮

শিবতোষ প্রথমে ভীত, সন্ত্রস্ত হইলেন, পরে ধাতস্থ হইয়া হাঁকডাক শুরু করিলেন। স্বামীর চীৎকার শুনিয়া শিবতোষ গৃহিণী ঘরের বাহিরে আসিয়া বড় বধূকে ভূমিতলে পড়িয়া থাকিতে দেখিলেন। একবার স্বামীর দিকে চাহিয়া বুঝিতে চেষ্টা করিলেন ঠিক কি হইয়াছে, তাহার পর প্রাণপণে সাহায্যের আশায় চীৎকার করিতে লাগিলেন। ততক্ষণে অনেকেই ছুটিয়া উপরে আসিয়া পড়িয়াছেন। সুন্দরি এবং মালতী ব্যতীত আশা নাম্নী অপর এক মহিলা, যিনি মাত্র চার বৎসর হইল স্বামী নিরুদ্দেশ হইলে অবস্থার বিপাকে পড়িয়া এই গৃহের আশ্রয়ে আসিয়াছেন, তিনিও তাহাদের মধ্যে আছেন। জ্ঞাতি সম্পর্কে শিবতোষের তিনি ভ্রাতৃবধূ। তাহারা ধরাধরি করিয়া বধূকে গৃহিণীর ঘরের দিকেই আনিতেছিল কিন্তু শ্বশুরের বিছানায় ঘরের বৌকে শোয়ানো ঠিক হইবে না বুঝিয়া ‘আরাম ঘরের’ ভূমিতে পারুলবালাকে শুয়াইলেন। চোখেমুখে জলের ছিটা দিতেই পারুলবালা ঊঠিয়া বসিলেন কিন্তু ভয়ে তড়িঘড়ি ছুটিয়া পলাইবার জন্য উঠিতে চেষ্টা করিলে মালতী তাহার হাত জোরে চাপিয়া ধরিল। সুন্দরি পারুলবালাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, শিবতোষ কি বলিয়াছেন? শিবতোষের নাম শুনিয়া বধূ আবার ভীতা হইল, মালতীর হাত ছাড়াইয়া উঠিবার উপক্রম করিতেই শিবতোষের গলা শুনা গেল। পারুলবালা ভয়ে আবার বসিয়া পড়িল। শিবতোষ গৃহিণীকে ইশারা করিয়া বধূকেই পুনরায় জিজ্ঞাসা করিতেছেন—রণো কোথায়, পুলিশ আবার বৈকালে এলে সব তছনছ করবে। আর জ্ঞান কি করেছে, সেও স্বদেশী হলো! কোথায় সে, ডাকো তাকে, এক্ষুণি ডাকো। প্রিয় কই? আমি সবাইকে ভিতর বারান্দায় আসতে বলছি, কেউ যেন বাদ না যায়, আমি সবাইকে শুধুতে চাই। বাড়ির সবাই যে যেখানে আছে, ডাকো...এই যা তো, মালতী, ঘরের মেয়েদেরও ডাকবি, যা...’

মালতী শিবতোষের নির্দেশে নিচে নামিয়া আসিল। ঘরে, আঙ্গিনায় এবং অন্যান্য স্থানে যে বা যাহারা ছিল, ছিলেন, সকলকে নিচের ভিতর বারান্দায় যেখানে দ্বিপ্রহরে আহারের জন্য সারি সারি আসন পাতা হয়, সেইখানে উপস্থিত হইবার আদেশ হইল। এখনও দ্বিপ্রহরের আয়োজন সম্পূর্ণ হয় নাই, তাহার মধ্যে এই কাণ্ড ঘটিয়া গেল। অনেকেই একে অপরের মুখপানে চাহিতে লাগিল, কেহ কেহ নিম্নস্বরে আলোচনা করিতে লাগিল প্রকৃত ঘটনা কি ঘটিয়াছে।

শিবতোষ গৃহিণীসহ নিচের বারান্দায় নামিয়া আসিলে মৃদু গুঞ্জন শুরু হইল। পুরুষেরা একদিকে দাঁড়াইয়া আছেন। অপরদিকে মেয়ে-বৌগুলি একগলা ঘোমটা টানিয়া ভয়ে স্থির হইয়া আছে, এই বুঝি ঘরে বাজ পড়িল। শিবতোষ প্রথমে চিন্তা করিয়াছিলেন নিম্নস্বরে কথা কহিবেন, কিন্তু উদ্বেগ চাপিয়া রাখিতে পারিলেন না। রণতোষ এবং কনিষ্ঠ পুত্রটির কথা বলিতে গিয়া তাঁহার কন্ঠস্বর কম্পিত হইল। গৃহিণী কাঁদিয়া ফেলিলেন। শিবতোষের কথার মাঝখানেই বলিয়া উঠিলেন, কেহ যেন গণৎকারের নিকট গিয়া জানিয়া আসেন, তাঁহাকে সুখবর দিতে পারিলে খুশি করিয়া দিবেন। শিবতোষের পিতা-মাতা নাই, শ্বশুর-শাশুড়ির অবর্তমানে গৃহিণী অনেক স্বাধীনতা পাইয়াছেন। নচেৎ তাঁহারা থাকিলে শিবতোষের কথার মাঝখানে কথা কহিতে পারিতেন না। এই বাটীতে এখন তিনিই সম্মানীয়া গৃহিণী। রণতোষের কথায় প্রিয়তোষ পিতাকে কিছু বলিতে গেলেন, কিন্তু সর্বসমক্ষে তাহা বলিলেন না, পিতার সহিত পশ্চাতে কথা কহিবেন, এইরূপ স্থির করিলেন। জ্ঞানতোষের কথায় শিবতোষ ঈষৎ ভ্রুকুটি করিলেন, বুঝি ইহা মাষ্টার ছোঁড়ার কাজ, সেই তাহাকে ভুলাইয়া লইয়া গিয়াছে, নতুবা জ্ঞানের মতো সুবোধ বালকের মনে গৃহত্যাগের চিন্তা কে ঢুকাইল? কথা বলিতে বলিতে শিবতোষ সকলের মাঝে কাহাকেও যেন দেখিতে পাইলেন না। কিন্তু ঠিক কাহার কথা মনে করিতেছেন, ইহা ভাবিয়াও ঠিক করিতে পারিলেন না। পুলিশের সম্মুখে প্রশ্ন উঠিলে কেহ যেন তাহা বাহিরে প্রকাশ না করে এই সম্বন্ধে সকলকে সতর্ক করিয়া দিলেন। গৃহিণীর তখনও চক্ষে জল। দুইটি সন্তান গৃহছাড়া, তাঁহার দুঃখ সর্বাধিক, স্বাভাবিকও বটে। সন্তানেরা মাতাকে ঘিরিয়া না থাকিলেও তিনিই সন্তানের মাতা। তাঁহাকে সান্ত্বনা দিবার জন্য অনেকেই আসিলেন।

শিবতোষ সেইদিকে একবার দৃষ্টিপাত করিয়া বৈঠকখানার দিকে অগ্রসর হইলেন।

শিবতোষ বৈঠকখানা গৃহের দিকে অগ্রসর হইলে ভিতর বারান্দার জমায়েত কিছু ফিকা হইল। যাহারা দ্বিপ্রহরের ভোজনের আয়োজনে ব্যস্ত ছিল, তাহারা নিজ নিজ কার্য্যে প্রবৃত্ত হইলেন। সংসারে যাহাই ঘটুক, ক্ষুধার নিবৃত্তি সকলেরই প্রয়োজন। শিবতোষ নিজেও বৈঠকখানা হইতে নির্দিষ্ট সময়ে অন্দরে আসিবেন, তাহার অন্যথা হইবে না। পুরুষেরাও যাহার যেমন কর্ম থাকে, তাহাতে মনোনিবেশ করিবেন বলিয়া স্থান ত্যাগ করিলেন। শুধু মধ্যম পুত্র প্রিয়তোষ কি যেন গভীর চিন্তায় মাতা ঠাকুরাণীর মুখপানে একবার চাহিয়া ধীরে ধীরে উঠানে বাহির হইয়া আসিলেন, তাহার পর বাহির দরজা দিয়া বাটী হইতে নির্গত হইলেন। কোথায় গেলেন, কি প্রয়োজনে, কাহাকেও কিছু বলিলেন না। গুটিকয়েক বালক বালিকা ভিতর দালান হইতে দক্ষিণের একটি ঘরে বসিয়া খেলা করিতে লাগিল।

পারুলবালার আজিকার ঘটনায় সকলেই বিস্মিত, কৌতুহলও বড় কম নয়। কি কারণে পারুলবালা মূর্ছিত হইয়া পড়িয়াছিল, জানিতে উৎসুক। মহিলাদের কেহ কেহ পারুলবালা ও টুনির সহিত কথা বলিতে ইচ্ছুক, সেই ইচ্ছা প্রকাশ করিলে মালতী পারুলবালাকে লইয়া পড়িল। টুনি মনে মনে কিঞ্চিৎ বিরক্তি অনুভব করিলে শাশুড়ির নিকটে গেল। তিনি তখনও পুত্রদের জন্য চিন্তাচ্ছন্ন এবং দুঃখিত মনে দাঁড়াইয়া ছিলেন। টুনি তাঁহার নিকটে গিয়া কিছু বলিলে তিনি কোনও কথা না বলিয়া টুনির সহিত ধীরে ধীরে দ্বিতলের সিঁড়িতে পা রাখিলেন।

মালতী, সুন্দরি সকলেরই মনে একটিই প্রশ্ন— শ্বশুরঠাকুর কি এমন কথা কহিয়াছিলেন যাহাতে পারুল মূর্ছা গিয়াছে? তাহা কি ভয়ানক কিছু, নাকি অন্যরকম? ভিতর বারান্দার এক কোণে গুটিকয়েক জলচৌকি রক্ষিত আছে, তাহার একটিতে বসাইয়া পারুলকে নানাবিধ প্রশ্ন করিতে লাগিল। ইহাদের মধ্যে সুন্দরিও আছেন, তাঁহার কৌতুহলই সর্বাপেক্ষা প্রবল। কিন্তু পারুলবালা তাঁহাদের একটি কথারও উত্তর দিতেছে না, মুখে কুলুপ আঁটিয়া বসিয়া আছে।বঅকস্মাৎ মালতীর পারুলের সন্তান সম্ভাবনার কথা মনে উদয় হইল। মালতী যুবতী নারী, বিবাহিতা। ভাগ্যে দুই একদিন মাত্র স্বামী সংসর্গ জুটিলেও এইসকল কথা না জানিবার কথা নয়! সে কথা সুন্দরির কানে কানে বলিলে উৎসাহ-উদ্দীপনায় সুন্দরির গৌরবর্ণ মুখখানি আরও রাঙ্গা হইয়া উঠিল। তিনি পারুলকে সেকথা শুধাইলে পারুলবালা এক ঝটকায় চৌকি হইতে উঠিয়া কম্পিত কন্ঠে বলিয়া উঠিল--- এখন কি তামাশা করার সময়, সোনা পিসিমা! উনি এখন বাড়ি নেই, ছোট ঠাকুরপোকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না...আর এখন...’ বলিতে বলিতে পারুলের চক্ষে জল গড়াইয়া পড়িল। স্বামীর জন্য মন হু হু করিয়া উঠিল। সুন্দরি অপ্রতিভ হইলেন।, বুঝি বা মালতী এবং অন্যান্যরাও। কেহ কেহ বলিয়া উঠিলেন-আহা, বাছা ইত্যাদি ইত্যাদি। পারুলবালার হাত ধরিয়া বারান্দার ভিতর দিয়া মালতী তাহাকে দ্বিতলের পানে লইয়া গেল। সুন্দরি কি এক সন্দেহে এক দৃষ্টে পারুলবালার প্রতি চাহিয়া রহিলেন। 

বৈঠকখানায় তখন দূরবর্তী এক গ্রাম হইতে দুই ব্যক্তি আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। তাঁহাদের গ্রামে শিবতোষের কিছু জমি ছিল, শিবতোষ রাজী থাকিলে জমিগুলি তাঁহারা খরিদ করিতে চাহেন। শিবতোষ পূর্বে এইরূপ অপ্রয়োজনীয় জমি বিক্রয় করিয়াছেন, করিয়াও থাকেন, ইহাতে দোষের কিছু নাই। তাঁহার প্রভূত জমি আছে, তাহা হইতে কিছু জমি বিক্রয় করিলে ক্ষতি কিছু নাই, বরঞ্চ ইহাতে কিছু অর্থ আসে। রণতোষের জন্য এখন অনেক অর্থের প্রয়োজন। পুলিশকে কত অর্থদণ্ড দিতে হইবে, কেহ জানে না। এই জমিগুলি বিক্রয় করিলে অনর্থক অন্যত্র জমির খবর লইবার জন্য দৌড়াদৌড়িও কমে। জমি সংক্রান্ত খবরাখবর আদানপ্রদান হইলে শিবতোষ অতিথিদের আহারের কথা ভাবিলেন। শিবতোষের গৃহে অতিথি অভ্যাগতদিগের অভ্যর্থনা একটি সম্মানীয় কাজ। উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন না করিলে নিজেও সেই সম্মান পাওয়া যায় না, শিবতোষ তাহা জানিতেন। টাকার লেন-দেনের হিসাব পরে, অগ্রে অতিথির সম্মান। শিবতোষ মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন দুই ব্যক্তিকে, তাঁহারা কখন বাহির হইয়াছেন, নিতান্ত অসুবিধা না থাকিলে অদ্য দ্বিপ্রহরে শিবতোষের গৃহে দুটি শাকান্ন গ্রহণ করিতে পারেন। এক ব্যক্তির বুঝি কিছু তাড়া ছিল। জানাইলেন, দিনমণি উদিত হইবার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁহারা গৃহ হইতে নির্গত হইয়াছেন, এক্ষণে কথা সারিয়া ফিরিয়া যাইতে ইচ্ছুক। অনেকখানি পথ, বিলম্বের কাজ নাই। শিবতোষ যেন তাঁহাদের কথায় চমকিয়া উঠিলেন। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে ভিতর বারান্দায় কথা বলিবার সময় যাঁহাকে তিনি খুঁজিতেছিলেন, তাঁহাকে মনে পড়িল। অকস্মাৎ তিনি বৈঠকখানা হইতে বাহির হইয়া মালতীর নাম ধরিয়া জোরে জোরে ডাকিতে ডাকিতে অন্দরের উঠানে প্রবেশ করিলেন। বাহিরের লোকজন বৈঠকখানায় বসিয়া আছেন, তাহা মনে রহিল না। মালতীকে এইরূপে উচ্চ স্বরে ডাকার জন্য কেহ বিস্মিত হইল, কেহ মুচকি হাসিল, কেহ মালতীকে ডাকিতে গেল। মালতীর সহিত শিবতোষের এক্ষণে কি প্রয়োজন? 
(ক্রমশঃ)



1 comment:

  1. ইনি কি বংকিমি না বিদ্যাসাগরি কে ইনি?

    ReplyDelete