0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সুহোত্র

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


ঋতহাস
সুহোত্র



যতদূর বুঝতে সমর্থ হয়েছি তাতে অনুমান ক'রি যে, ঋতবাক ঋত এবং বাক্ উভয়কেই তার যাপনের অংশ করতে চায়। বড় দুরূহ এ সাধনা। আরও অগ্রসর হওয়ার পূর্বে এই শব্দ দুটির অর্থ প্রণিধানের প্রয়াসী হওয়া যাক। দুটি শব্দেরই আকর ঋকবেদ। ঋগ্ বেদের দশম মণ্ডলের ত্রিষ্টুপ ছন্দে রচিত ৭১তম সুক্ত জ্ঞানসুক্ত নামে পরিচিত। এখানে বৃ্হস্পতিকে বন্দনা করা হ'লেও এর মূল প্রতিপাদ্য হ'ল বাক্ এর উৎপত্তি আর তার অপরিহার্যতা। হৃদয়ের গহনে সঞ্চিত ছিল উৎকৃষ্ট ও অমলিন জ্ঞান। ছাঁকনির সাহায্যে শক্তুকে ছাঁকবার মতন ক'রে সেই জ্ঞানকে ধীমান ব্যক্তিবর্গ সযত্নে বার করে আনলেন বাক্ এর সাহায্যে। বাক্ ভাষা দিল জ্ঞানকে। কিন্তু, এই বাক্ এর অধিকারীভেদ আছে। ভাষা ব্যবহার ক'রে সকলেই কিন্তু সম্যকভাবে বাক্ এর পরিচিতি লাভ সকলের দ্বারা সম্ভব নয়। 

উত ত্বঃ পশান্ন দদর্শ বাচমুত ত্বঃ শৃণ্বন্ন শৃণোত্যেনাম্।
উত ত্বস্মৈ ত্বন্বংবি সস্রে জায়েব পত্য উশতী সুবাসাঃ।।

অনেকেই শব্দকে দেখেও দেখতে অক্ষম, শুনেও শুনতে অপারগ। মুষ্টিমেয় কতিপয় ভাগ্যবানের সম্মুখে বাক্ স্বেচ্ছায় নিরাবরণ মূর্তিতে স্বপ্রকাশ হন যেমন ভাবে 'উশতী জায়া' বা সুন্দর পোশাকে সজ্জিতা ভার্যা প্রেমভরে নিজের দেহকে অনাবৃত করেন পতির সম্মুখে। এই বাক্ এরই সাধনা তবে ঋতবাকের। এবং, সে ঋতকেও অর্চনা ক'রে। 

স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে ঋত এর সংজ্ঞা নিয়ে। বৈদিক চিন্তনে এ শব্দের গুরুত্ব অপরিসীম। ঋত এর শ্লোক সমূহ বধিরদের কর্ণ উন্মোচন করেছিল; ঋতের সাহায্যে অগ্নি অমরত্ব লাভ করেন: " ঋতম্ সপন্তঃ অমৃতম্ এবৈঃ।" অর্থাৎ ঋত দেবতাদেরও আজ্ঞাধীন নয়; বরং তাঁরাই এর অনুগামী। এই শব্দের অর্থ নিরূপণ কালে পণ্ডিতগণ ভিন্নমত। কেউ বলেন " Everything that is ordered in the universe has rita for its principles. It corresponds to the universals of Plato"; কারও মতে এর অর্থ "order of the universe"; আবার কেউ একে "physical and moral order" বলে অভিহিত করেন। একটি বিষয় যা এইসকল সংজ্ঞা থেকে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় তা হ'ল এই যে ঋত এক অমোঘ, অলঙ্ঘ্য নিয়ামক। প্রশ্ন হ'ল এই ঋত কি অপরিবর্তনীয়? তা বোধহয় নয়। ঋক্‌বেদ সংহিতার দশম মণ্ডলের ১০৫ সংখ্যক সুক্ত এক ঋতহীন পরিবেশের বর্ণনা দান করে: 

যজ্ঞং পৃচ্ছাম্যবমং স তদ্দূতো বি বোচতি।
ক্ব ঋতং পূর্ব্যং গতং কস্তদ্বিভর্তি নূতনো বিত্তং মে অস্য রোদসী।। 

সর্বদেবের আদিভূত যজ্ঞের নিকট আমার প্রশ্ন অতীতের সেই ঋত এখন কোথায় গমন করেছে? কে সেই নূতন যিনি তাকে ধারণ করেন? এই পরিস্থিতিতে উপনীত হয়েও ঋত এর ওপর বিশ্বাস রাখেন বৈদিক কবি : ব্যুর্ণোতি হৃদা মতিং নব্যো জায়তামৃতম্ -- আমি দৃঢ় চিত্তে ঘোষণা করছি নূতন ক'রে ঋতের জন্ম হ'ক। এই নবীকরণের ইচ্ছা থেকেই বোঝা যায় যে ঋত কালভেদে নবরূপ ধারণ করে। সুতরাং ঋত হ'ল an order of both the outer and inner worlds as they are at this moment। সরলার্থে বর্তমানে যে সঙ্গতি, সামঞ্জস্য আর সুশৃঙ্খলা মেনে চলে বহির্বিশ্ব ও ন্যায়বোধ, নীতিবোধ নির্ধারিত অন্তর্বিশ্ব তারই নাম ঋত। এবং যে বস্তু বা অনুভব যে অবস্থায় আছে তাকে সেরকম ভাবে বর্ণনা করারই নাম সত্য কথন : "তদবতি তৎপ্রকারকঃ অনুভবো যথার্থঃ।" দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তী বলেন, "যে বিশেষ্য বস্তুত যে ধর্মবান, তার বিষয়ে সেই ধর্মকেই বিধেয় বিশেষণ হিসেবে অনুভব করা বা বলাটাই সত্য জানা বা সত্য কথা বলা। পান্না যদি অনুভবের বিশেষ্য হয় তবে তার বিষয়ে সবুজ- বিধেয় লাগানো সত্য হবে যদি এবং কেবল যদি পান্নাতে সত্যিই সবুজ রঙ থাকে।" সুতরাং মীমাংসা করা যেতেই পারে যে ঋত এবং সত্য সমার্থক। 

ঋতবাকের ধর্ম তবে বাক্ এর সহায়তায় সত্যকে প্রকাশ। বিবিধ উপায়ে বাক্ সত্যকে প্রকাশ করতে পারে। তবে, আমরা মনে করি এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায় হ'ল কৌতুকের দ্বারা সত্যের প্রকাশ। আমরা শ্রী অরিন্দম চক্রবর্তীর মতের অনুগামী হয়ে বলতে চাই সত্যের সঙ্গে হাস্যের এক প্রত্যক্ষ সংযোগ আছে। ভরত তাঁর নাট্যশাস্ত্রে বলেন : "এতেন সর্বে রসা হাস্যে অন্তর্ভূতা ইতি দর্শিতম্" : এর দ্বারা দেখানো হ'ল সমস্ত রসই হাস্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে। অধ্যাপক চক্রবর্তী বলেন যে অতি অকিঞ্চিৎকর অস্তিত্বের অধিকারী ব্যক্তি মানুষ অনেক সময়ই বিশ্বাস করে যে তার প্রাতিস্বিকতা বা individualism তাকে এই মহাবিশ্বে এক পুরোভূমিতে প্রতিস্থাপিত করেছে। এই অহং প্রকৃতবিচারে কৌতুকজনক।" এই আমির সোনার থালাতেই ঢাকা আছে সত্যের নির্মম -- নিরহং আমি - আমার হীন পরম সর্বময় সাধারণ মুখ।... নির্মোহ ফুসফুস উজাড় করা খোলা হাসি -- অথবা নম্র আত্মবিলোপকারী পরিমিত কৌতুকের স্মিত বিহসিত সামান্য বৈপরীত্যময় রঙ্গকৌতুক সেই আবরণ পুরোপুরি সরাতে না হোক একটু আলগা করতে -- একটু খুলে ধরতে সাহায্য করে।" সত্য এবং যাপনের বিবিধ অসংগতি থেকে উদ্ভূত হাস্য প্রসঙ্গেই বের্গসঁ বলেন "Laughter is Corrective।" 

ষোড়শ শতাব্দীতে ফরাসী দেশে বসে তাঁর দেশবাসীকে এক হাসির মন্ত্র দিয়েছিলেন রাবলে। সে এক বিশেষ দর্শন। জীবন সম্পর্কে, জগৎ সম্বন্ধে এক নির্মোহ নিরাসক্তি নিয়ে, এক দার্শনিক বিচ্ছিন্নতা বোধ নিয়ে এক নির্বিকার অট্টহাস্যে অদৃষ্টকে পরিহাস করার, সমস্ত সৃষ্টি তথা অস্তিত্বকে হাস্যকর ভাবার এই হাসি দর্শনের নাম পাঁতা গ্রুয়েলিজম। 

এ হাসির অধিকার সকলের জন্য নয়। এক বিশেষ দার্শনিক অবস্থান থেকেই এ হাসির উদ্ভব। এই হাস্য দর্শনের এক অপর দিকও আছে। জগৎসৃষ্টি সম্বন্ধে এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গীও এক প্রসন্ন সকৌতুক মনোভাবের জন্ম দিতে পারে। এক উদার গম্ভীর হাসির দৃষ্টিকোণ থেকেও বিশ্ববীক্ষণ সম্ভব। কালিদাসের হিমালয়ের বিশালত্বকে ত্রম্বকের অট্টহাসির সঙ্গে তুলনা অকারণ নয়। 

বঙ্গসাহিত্য জগতে অন্তত একজন স্রষ্টার উল্লেখ আমরা করতে পারি যাঁর এক নিজস্ব হাস্যদর্শন ছিল। নাম তাঁর সুকুমার রায়। পুণ্যলতা চক্রবর্তী তাঁর স্মৃতিকথায় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সম্বন্ধে এক বিচিত্র তথ্য দিয়েছেন। রাগ বানাতেন তিনি। কারো ওপর রাগ হলে তিনি তার সম্বন্ধে উদভট গল্প মুখে মুখে বলে গিয়ে তাকে হাস্যকরতার চরম সীমায় পৌঁছে দিতেন। হাসির অট্টরোলে রাগ ভেসে যেত। পরিণত বয়স তাঁর এই প্রবণতাকে পূর্ণতা দিয়েছে আর তারই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাঁর অভিজ্ঞতা ও মনন প্রসূত এক বিবিক্তি তথা নিরাসক্তি ও তার থেকে উদ্ভুত এক প্রসন্নতা। এই প্রসন্ন কৌতুক তাঁকে জীবনকে সহাস্যে পর্যবেক্ষণ করার সামর্থ্য দিয়েছে।

এইখানে আমরা দুটি কবিতার কথা স্মরণ করতে পারি। কাতুকুতু বুড়ো আর রামগড়ুরের ছানা। ধমক দিয়ে ঠাসা জগতের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ, সুড়সুড়ি দিয়ে হাসানোর বিরূদ্ধে প্রতিবাদ। কিন্তু, কোন জগৎ? যে কবিতাদুটির কথা উল্লেখ করা হ'ল সে দুটি প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৩২২ ও ১৩২৫ এ সন্দেশের জৈষ্ঠ সংখ্যায়। ঈষৎ সচেতন হলেই আমরা লক্ষ্য করি যে সে সময়টি হ'ল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। একদিকে বাঙালী ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের সর্বস্ব উজাড় করা আত্মসমর্পণ ইংরেজের কাছ থেকে হোমরুলের প্রত্যাশায় আর অন্যদিকে যুদ্ধান্তে শাসনের কড়া ফাঁস। এই চূড়ান্ত অসংগতির হাস্যকরতার ছায়া এই কবিতা দুটিতে পড়ে। অতিশয়োক্তি মনে হ'লে বারেক কাতুকুতু বুড়োর যে গল্পে হাসির চেয়ে কান্না আসে বেশি তার দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। কেষ্টদাসের পিসির নয়। সেটি এক যোদ্ধা রাজার গল্প। "এক যে ছিল যোদ্ধা রাজা --হোঃ হোঃ হোঃ হি হী, / তার যে ঘোড়া হাঃ হাঃ হা ডাকত সেটা চীঁহি / ছুটত যখন হেঃ হেঃ হে সবাই বলত বাহা / হোঃ হোঃ হোঃ হীঃ হীঃ হি হেঃ হেঃ হে হাহা" এই উৎকট হাসিতে ভরা রাজার ঘোড়ার ছুটের গল্পে গড়া ধমক দিয়ে ঠাসা দুনিয়ায় হাসি নিষেধ। যে হাসি মনকে প্রসন্ন করে সে হাসির ঠাঁই এখানে নেই। তাই হাস্য রসিককে হাসির সন্ধান করতে হয় শুধু অসংগতির মধ্যেই নয়। প্রসন্নতা রক্ষার জন্য তিনি প্রকৃতিতেও হাসির দেখা পান। সেই কারণেই রামগড়ুরের ছানার "ঝোপের ধারে ধারে রাতের অন্ধকারে / লাখ জোনাকির চক্ষু ঠারা হাসতে শেখায় কারে?" বদলে গিয়ে হয় "ঝোপের ধারে ধারে রাতের অন্ধকারে / জোনাক জ্বলে আলোর তালে হাসির ঠারে ঠারে"। আলোর তালে হাসির ছন্দ!

এ দাবী আমরা করছি না যে সুকুমার এই সামাজিক অসংগতির রূপক ভাষ্য হিসেবে তাঁর হাস্য রসের বিশ্ব গড়েছেন। আমাদের বক্তব্য এই, যে বিশ্ব তিনি গড়েন সেখানে প্রতিটি ঘটনার মূলগত অসংগতি তাদের হাস্যকর করে তুলতে পারে। সুকুমার সেই হাসির সম্ভাবনার উৎসে পৌঁছতে চান। আর সে উৎস কখনও রাবলের মতো সৃষ্টির মধ্যে কমিক এর বোধ। আবার কখনও অস্তিত্বের আনন্দের বোধ। অসংখ্য সম্ভাবনার বিভিন্ন পারম্পর্য ভেঙে দিচ্ছে সংগঠিত জগতের গাম্ভীর্য। খুলে যাচ্ছে এক উদ্দাম অট্টহাসির উৎসমুখ। এই হাসিরই প্রাণপুরুষ হিজিবিজবিজ।

বাংলা ১৩২৯ সালের জৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র সংখ্যার সন্দেশে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পায় হযবরল। সুকুমার মারা যান ঠিক এর পরের বছর। ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৩। আর তার পরের বছর ২২শে সেপ্টেম্বর, ১৯২৪ এ হযবরল গ্রন্থাকারে প্রকাশ লাভ করে। সে বছরই (পৌষ, ১৩৩১) প্রবাসীতে প্রকাশিত গ্রন্থ সমালোচনা লিখল : "ছোটছেলেদের একচিন্তা আর একচিন্তা হইতে লাফাইয়া লাফাইয়া চলে। তাহাদের মধ্যে ক্ষীণ যে যোগসূত্র থাকে তাহা সবসময় ধরিতে পারা যায় না। গ্রন্থকার সেইরকম লম্ফনশীল চিন্তা গুলিকে গাঁথিয়া একটি গল্পের সৃষ্টি করিয়াছেন। ইহা তাঁহার শিশুমনের ও শিশু মনোভাবের আশ্চর্য পরিচয়।" শিশু মনোভাব? অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে যদি হযবরল এর বিচার দৃশ্যটির কথা মনে করি তাহলেই কিন্তু এই অভিধায় সংশয় জন্মায়। আসামী যোগাড়, ভাড়া করা সাক্ষী, মান শব্দের উকিলি ভাষ্য, ঘুমন্ত হাকিম আর সবার ওপরে এই সব উদ্ভট ঘটনা দেখে হিজিবিজবিজের অট্টহাসি।

এ তো চূড়ান্ত প্রাপ্তমনস্ক এক দ্রষ্টার এক অসার আইনি ব্যবস্থাকে সকৌতুক পর্যবেক্ষণ। এই বিচার দৃশ্য প্রকাশিত হয় ১৩২৯ এর ভাদ্র সংখ্যার সন্দেশে। আর ঐ সংখ্যাতেই প্রকাশ পায় একুশে আইন। কৌতুকের বাতাবরণে যে আইনের শাসনে ত্রস্ত সমাজের রূপ দেখা যায় তার সাথে অরওয়েলের জ্যেষ্ঠভ্রাতা শাসিত সমাজচিত্রের খুব একটা পার্থক্য অন্তত আমার চোখে ধরা পড়ে না। ব্রিটিশ রাজের প্রতিশ্রুত রুল অফ ল আর বাস্তব সত্য অবস্থার মধ্যের অসংগতি তখন আমাদের কাছে স্পষ্ট।

আসলে, বারংবার, বিভিন্নভাবে তাঁর প্রায় সমস্ত রচনায় সুকুমার তাঁর সমকালীন সমাজের অসংগতি ও স্ববিরোধ ভরা বাস্তব আচরণের দিকে কৌতুকভরে চেয়েছেন। দেখেছেন রাজাদের নেড়া বেলতলায় কবার যায় তা নিয়ে চিন্তায় গলদঘর্ম হতে, দেখেছেন বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাইদের মাঝির জীবনের হিসেব কষতে, দেখেছেন গ্রন্থবিলাসীকে পাগলা ষাঁড়ে তাড়া করলে কি করতে হয় কেতাবে তার নিদান খুঁজতে। তিনি দেখছেন প্রায় প্রতিটি আচরণের একটা হাস্যকর সম্ভাবনা আছে। জীবনের প্রায় সব ঘটনা পরম্পরাই কোন না কোন ভাবে খুলে দিতে পারে হাসির উৎসমুখ। কমনসেন্স বর্জিত দৈনন্দিনতাই হয়ে ওঠে ননসেন্স। তাঁর এই ভাবনারই বাণীরূপ হিজিবিজবিজ এবং তার হাসি।

একটি কথা ভুললে চলবে না। সেটি হ'ল যে সময় হযবরল লেখা চলছে সেই সময় সুকুমার জেনে গেছেন যে তিনি দুরারোগ্য কালাজ্বরে আক্রান্ত। এবং আসন্ন মৃত্যুর সঙ্গে তিনি বোঝাপড়ায় আসতে চাইছেন তাঁর নিজস্ব দর্শনের ওপর নির্ভর করে। এই বোঝাপড়ার চেষ্টারই ফল পরিণতি হযবরল। এই রচনার এক বছরের মধ্যে আবোলতাবোল এর ডামি কপির জন্য তিনি লিখবেন তাঁর শেষ লেখা। একদিকে মেঘমুলুকের ঝাপসারাত, অন্যদিকে বেবাক লোকের বোঝার তোয়াক্কা না করে কথার প্যাঁচে কথা কাটা। মৃত্যুর মুখের ওপর তুড়ি মেরে জীবনের অসংগতিকে তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ারডিম বলে হাসতে হাসতে গানের পালা সাঙ্গ করা। হাস্য দর্শনের পূর্ণরূপ দেবে তাঁর জীবনচর্যা। 

একদিকে সত্য আত্মরূপ, অপরদিকে মৃত্যুর অন্ধকার। এই দুই এর মাঝখানে সকৌতুক হাস্যের উৎসার। অস্তিত্ব বা অন্তরতম স্বরূপ যেন হাসি। আমরা হিজিবিজবিজ এর হাসি আর হাসতে হাসতে মারা যাওয়ার কপট আতঙ্কের মধ্যে যেন ফরাসী দার্শনিক জর্জ বাতাই এর কথার প্রতিধ্বনি শুনি : হাসতে হাসতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলে কেমন হয়( Can someone really laugh to death)?

আমরাও প্রশ্ন করতে চাই। ঋতকে, সত্যকে বাক্ এর হাস্যোজ্জ্বল রূপের দ্বারা প্রকাশ করলে কেমন হয়? কেমন হয় ঋতবাক যদি কখনও হয়ে ওঠে ঋতহাস? আমরা তার নবরূপদর্শন পিয়াসী হয়ে রইলাম প্রতীক্ষারত।।



ঋণস্বীকার : 
১) ভারতীয় দর্শন -- দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।
২) মননের মধু -- অরিন্দম চক্রবর্তী।
৩) ঋগ্বেদ সংহিতা --- অনুবাদ রমেশচন্দ্র দত্ত।

0 comments: