undefined
undefined
undefined
ধারাবাহিক - সুবল দত্ত
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত
।।৬।।
হাত মেলানোর সময় সৌমজিত মিঃ ইভানোভিচের চোখে চোখ রাখতে পারলোনা। মুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নিতে বাধ্য হলো। চকচকে পারদর্শী আকাশনীল কঠিন মারবেলের মতো চোখের মণি সোজা তার ভিতর অব্দি যেন ঢুকে যাচ্ছে। সে যেন তার গোপন ইচ্ছে অনিচ্ছে সবকিছুই পড়ে ফেলছে। অসম্ভব হিপনোটিক। চোখে চোখ মেলানো যায় না। চোখ ফিরিয়ে থাকলেও মনে হচ্ছে তার সারা অঙ্গ সমেত তার মানসিক স্থিতি ওই লোকটা জিভ বার করে চেটে চলেছে। মাঝে মাঝেই প্রবল মানসিক শক্তি দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করছে সমু। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হচ্ছে ভারী কিছুতে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ছে আশরীর। সৌমজিত তার আর্মি জীবনে এরকম পরিস্থিতির সামনা কখনও করেনি। এ এক অদ্ভুত অবাস্তব ব্যাপার। এই আর্মীদের স্পেশ্যাল টাস্কফোর্সে হিপনোটিজম ট্রেনিং এর কথা সৌমজিতের অবশ্য শোনা, কিন্তু এত দেশ ঘুরেছে কোথাও কোনওদিন কোনও আর্মি গ্রুপে দেখেনি। কোনও কোনও দেশের টপসিক্রেট সার্ভিসের হাইপ্রোফাইলের অফিসারদের কয়েকজনকে হিপনোটিজম শেখানো হয়। মিলিটারি ইনটেলিজেন্ন্সএ সম্মোহনের ব্যবহার যে কত বিপজ্জনক একবার এক সেমিনারে সেই ব্যাপারে খুব আলোচনা হয়েছিল। সমুর মনে পড়েনা তার আর্মি ট্রেনিংএ, মানে অস্ত্রশিক্ষা থেকে ম্যানেজমেণ্ট ট্রেনিং অব্দি, কোথাও মানসিক শক্তি দিয়ে অন্যপক্ষকে বশ করার কোনও বিদ্যাচর্চা ছিল কি না। এই রাশিয়ান অফিসারটি কি সেইরকমই কিছু করছে? ওকে জিজ্ঞেস করতে হবে। সমু দেখল ওই দোভাষী লোকটাও তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। প্রাণপণে মনসংযোগ করে শরীর মন চোখ শক্ত করে রাশিয়ান অফিসারের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,- টেল মি মিস্টার সারগেই ইভানোভিচ, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ? দোভাষী লোকটি তর্জমা করে অফিসারটিকে রাশিয়ান ভাষাতে বলল আর সমুর দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল – আপনি বাংলাতে বলতে পারেন স্যার। আমার এতে বরং সুবিধেই হবে।
শালা! আমাকে আন্ডার এসটিমেট করিস হারামজাদা! ঝাঁ করে রাগ চেপে গেল মাথায় সৌমজিতের। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি বুঝে নিজেকে গুটিয়ে নিল। দোভাষী এপয়েন্টেড হয়েছে ওদের তরফ থেকে। আর এই পরিবেশে ওকে বোঝানো যাবেনা ও কত ছোটো আর আমি কত উঁচুতে। আর একটু মাথা ঠাণ্ডা হতে সৌমজিত বুঝল বিনা সন্মোধনে একটা বাজে সস্তা মার্কা ইংরেজি কথা ব্যবহার হয়েছে। মার্জিত রুচিসম্পন্ন কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু সার্ভিস লাইফের শুরু থেকেই এই ব্যাপারটা তার আসেনা। তার চেয়ে উঁচু পদবী ছাড়া কারও সাথে কথা বলতেই আপনা আপনিই মেজাজটা রুক্ষ হয়ে যায়। নিষ্ঠুরতায় যে সৌমজিত আনন্দ পায় সে কথা তার সব সাবর্ডিনেটরাই জানে। অনেককে সামান্য অছিলায় চাকরি থেকে ফায়ার করে দেবার বদনাম হেডকোয়ার্টারে আছে। কয়েকটা নিরপরাধের কোর্টমার্শালের কেসও আছে। ঐসব নির্বিবাদে কোনওকিছু না ভেবেচিন্তেই করে ফেলে।
সৌমজিত আরও একটু সহজবোধ করলো। একরকম ভালোই হলো। এই দোভাষীটা বরং ওর উপকারই করেছে। হঠাৎ করে ওকে রাগিয়ে দিতে একটা আচ্ছন্ন সম্মোহক আড়ষ্ট ভাবটা কেটে গেছে। ও সহজভাবে অফিসারটির চোখে চোখ রাখতেই দেখল ওর নীল সবুজ চোখের ভাষা একেবারেই বদলে গেছে। ওর চোখে কৌতুক। অফিসারটি হেসে কথা বলা শুরু করল। দোভাষী সঙ্গে সঙ্গে অনুবাদ করতে লাগলো। রাশিয়ান ভার্সেস ইংরেজি ও বাংলা। রাশিয়ান সাহেব কিছু ইংরেজি শব্দেরও ব্যবহার করতে লাগলেন।
সারগেই: গুডমর্নিং মেজর জেনারেল। দেখছি যতটা টাফ আপনাকে লাগে তার চেয়ে অনেক বেশি। আনপেনিট্রেবল।
সৌমজিত: কেন? কেন এইরকম কথা উঠল? কি দেখে বললেন কথাটা? কেউ কি আমার নিয়ে কিছু বলেছে?
সারগেই: না না, কেউ কিছু বলেনি। আমি কিছু জেনেও আসিনি। কেবল আপনাকে স্টাডি করতে চেষ্টা করছিলাম।
আপনি রিয়ালি একটা ব্যতিক্রমি চরিত্র। প্লীজ ডোন্ট টেক ইট আদারওয়াইজ টেক ইট এজ আ ফান,
আপনি হাইলি এগ্রেসিভ আর অফেনসিভ।
সৌমজিত: এইটাই কি আমাদের মিটিংএ আলোচ্য বিষয় মিঃ ইভানোভিচ?
সারগেই : সরি স্যার। আই এপোলোজাইজ ফর দ্যাট। নাউ লিভ ইট। কাজের কথায় আসা যাক। এখানে তো
আমাদের তিনদিনের রুটিন একসারসাইজ। বিগ্রেডিয়ার আর কমাণ্ডার রুটিন ম্যাপ রিহার্স করছে।
আমাদের বুলস্ আই কি ওই শিমুলিয়া পাহাড়ের গা? রকেট লঞ্চার কি পাহাড়ের উপরে?
সৌমজিত: তাইতো আমাদের চুক্তির ব্রীফে আমাদের সুপ্রীম বসেরা সাইন করেছেন। ওনাদের আদেশ আমরা চেঞ্জ
করার কে?
সারগেই: এই ব্যাপারেই তো আমাদের আর আপনাদের কয়েকজন পারসোনেল হাইলি কনডেম করছে। আমরা তো জানতামই না যে উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের একটা দুর্লভ গবেষণার বিষয় ওই শিমুলগাছের শিকড় আর অর্জুন গাছটির ব্যাপার। পাহাড়ের উপরে ওই গাছদুটো না কেটে ফেললে হাই প্রিসিসেনের রকেট লঞ্চার ইনস্টল্ড হবে না।
সৌমজিত: কিন্তু এটা তো করতেই হবে। আমরা রুটিনের বাইরে যেতে পারিনা।
সারগেই: আপনাদের সাথে আমাদের এই একটা ব্যাপারেই তফাত। নিজের স্বার্থ নিজের উদ্দেশ্য সফল করার জন্যে দেশকে পর্যন্ত আপনাদের কেউ কেউ বিক্রি করে দিতে পারে। অর্জুন গাছের লাল রস দিয়ে কুষ্ঠ রোগ নিরাময় হয়। তাই আমরা ওই গাছকে পুজো করি। আমি জানি ১৯৫৫ সালে রাশিয়া চেয়েছিল আপনাদের দেশে আকন্দ গাছের ও অর্জুন গাছের চাষ করবে। তা থেকে ড্যাপসোন ওষুধের কারখানা বসাবে। রাশিয়ায় তখন লেপ্রসি এপিডেমিক। আপনাদের এখানেও তখন তাই। কিন্তু আপনাদের অর্থমন্ত্রীর একগুয়েমী আর লোভের জন্যে তা হলো না। মার্ক কম্পানীকে বাজে এন্টিবায়োটিকের লাইফ লং পেটেন্ট দিয়ে দিলেন। আর আপনারা ওই বহুমূল্য ভেষজ চিনতেও পারলেননা। আপনাদের দেশে লেপ্রসি বেড়েই চললো।
সৌমজিত: এসব আমাকে বলে কি লাভ?
সারগেই: (একটু ঝুঁকে একদৃষ্টিতে ওর চোখে চোখ রেখে) এই শিমুলিয়াতেই কেন জয়েন্ট এক্সসারসাইজের ব্যবস্থা করলেন? আমি ডেড শিওর আপনিই এতে ইনিসিয়েটিভ নিয়েছেন। স্বীকার করুন। আমি কিন্তু সব জেনে যাচ্ছি।
সৌমজিত: (হাঁসফাঁস করতে করতে উঠে দাঁড়ায়) কি সব ইডিয়টিক আনপার্লিয়ামেণ্টারি কথাবার্তা! রাবিশ! আপনি আমাকে হিপনটাইজ করছেন।
সারগেই: (হো হো করে হেসে ওঠে) বলেছিলামনা! আ টাফ গাই। কিছুতেই কিছু করা গেল না। কিন্তু শুনুন মেজর জেনারেল। আমরা এই মিশনকে কনডেম করছি। তাছাড়াও আপনি ওই বস্তির মাঝে ওদের কুঁড়েঘরের পাশ দিয়ে ট্রেঞ্চ খুঁড়তে বলেছেন। এটা সরাসরি শোষণ। আমরা সাচ্চা কম্যুনিষ্ট। এসব বরদাস্ত করব না। তাছাড়া তিনদিন পর জঙ্গলে উগ্রবাদী মারার জন্যে কোম্বিংগ অপারেশন চালাবেন কাকে মারার জন্যে? কিল অর কেপচার লিস্টে কয়েকটা আদিবাসীর নাম আছে দেখলাম। সেই কয়েকটা অসহায় বঞ্চিত আদিবাসীকে মারার জন্যে? এমেজিং! যারা খেতে পায়না, আশ্রয় নেই, পরার কাপড় নেই....
সারগেই উঠে পড়লেন। কথার ফুলঝুরি ছুটল। কিন্তু দোভাষী চুপ করে গেল। আর সে তর্জমার ভাষা পেল না। কথা বলতে বলতে ইংরেজিতে চিত্কার করে স্টপ ইট স্টপ ইট বলে বেরিয়ে গেলেন সারগেই ইভানোভিচ।
0 comments: