0

সম্পাদকীয়

Posted in








পর্দা জুড়ে খয়েরি রঙা অন্ধকার আর তার মধ্য দিয়ে মাঝবয়সী উপবীতধারী এক পুরুষ পায়ের আঙুলে দড়ি বেঁধে অসীম ক্লেশে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন একটি লাশ। সৎকারের উদ্দেশে। মৃতদেহটি এক দলিতের। কন্যাদায় থেকে মুক্ত হবার জন্য যে গ্রামের উচ্চবর্ণের প্রতিভূ সেই ব্রাহ্মণের গৃহে ভৃত্যের কাজ করতে সম্মত হয়েছিল। মৃত্যুর পরও যাতে নিম্নবর্গের সেই মানুষটির ছোঁয়াচ না লেগে যায়, তার জন্যই সেই বিশেষ ব্যবস্থাপনা। 

মুন্সি প্রেমচন্দের ছোটগল্প অবলম্বনে ১৯৮১ সালে নির্মিত সত্যজিৎ রায়ের ছবি 'সদগতি'র এই দৃশ্য দেখতে দেখতে শিউরে উঠেছি আমরা। ভুলে গেলে চলবে না 'সদগতি' কাহিনি আকারে প্রকাশ পেয়েছিল চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার পাঁচ দশক আগে। তার অর্থ পঞ্চাশ বছর পরেও বদলায়নি এই দেশ। তেমনই প্রাসঙ্গিক রয়ে গিয়েছিল অস্পৃশ্যতার বিষয়টি। 

আর সম্প্রতি সারাদিনের অজস্র টুকরো খবরের মধ্যে চোখ আটকে গেল একটি চমকপ্রদ মানচিত্রে। একটি সমীক্ষার ফলাফল বলছে দেশের অধিকাংশ অঞ্চল প্রবলভাবে এখনও বহাল রেখেছে আদিম সেই প্রথা! আজও। শিরদাঁড়া দিয়ে বরফঠান্ডা স্রোত নেমে গেল তৎক্ষণাৎ। 

চিত্রটি সঠিক হলে সামাজিক এই দূষণ এখনও গ্রাস করে রেখেছে ডিজিটাল ভারতকে। বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা ভারতবর্ষের উন্নয়নের কার্পেটের তলায় লুক্কায়িত এ কোন দেশ? নানা জাতি, ধর্ম আর কৃষ্টির এই মিলনভূমির সর্বত্র কমবেশি শোণিত-চিহ্ন! প্রতিনিয়ত সামাজিক সমতার সোচ্চার ঘোষণা কি প্রকৃতপক্ষে এক রাজনৈতিক ঢক্কানিনাদ? মুখোশের আড়ালে না-দেখা মুখটি কি তবে ভয়াল? উজ্জ্বল আলোকবর্তিকার সন্নিকটে বসবাস করে নিকষ আঁধার - এই তত্ত্বের কাছেই কি পরাজয় ঘটবে আমাদের? বারংবার?

সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।

শুভেচ্ছা অফুরান!

0 comments:

2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in






পর্ব ১

ইতিহাসের কাল ঠিক কবে শুরু হয়েছে তাই নিয়ে আমাদের পণ্ডিতি মাঝে মাঝেই তার সীমাবদ্ধতা জানান দিচ্ছে। এই পণ্ডিতরা ঘোষণা করলেন যে মাত্র পাঁচ হাজার বছর আগেও মানুষ কোনোরকমে বেঁচে থাকতে শিখল। আর তারপরেই কেউ নতুন কোনও প্রত্নখনন উপলক্ষে জানালেন, উঁহু, মানুষ অন্তত দশহাজার বছর আগেই সমাজবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। মানুষের সভ্যতার নিরিখে পৃথিবীদখলকারী জীব হিসেবে সে নিতান্তই অর্বাচীন। এভাবেই ক্রমউন্মোচন ঘটেই চলেছে।

যেমন, এখনও পর্যন্ত আমরা জানতাম আর্যসভ্যতা একটি বহিরাগত শক্তি। যা উত্তর পশ্চিম থেকে এসে আমাদের ভূমিপুত্রদের উচ্ছেদ করেছিল। সিন্ধুবাসীরা বিজিত হয়েছিল এই সভ্যতা দ্বারা। হয়ত প্রচলিত শব্দ এই সভ্যতা। আসলে সভ্য বোঝাতে হয়ত একে ব্যবহার করেননা কোনও ইতিহাসবিদ। তারপর তো জানা গেলো, ভুল। সভ্য মানুষ এই ভূখণ্ডে বহুকাল ধরে বাসা বেঁধে আছে। আর্যরা কিছু বহিরাগত নয়। উত্তর পশ্চিম দিকের যাযাবর গোষ্ঠীগুলির ভাষা হিসেবে এদের এই নাম দেওয়া হয়। বহিরাগত নয় এইজন্য বলা, সেসময়ে কিন্তু ভারতবর্ষের সীমা এমন করে দেগে দেওয়া ছিলনা। এশিয়া মাইনরকেও নিজস্ব ভূমি বলা চলত।

সম্প্রতি আইয়াইটির গবেষণাগার থেকে একটি তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। দক্ষিণ উপকূলে সাগরের অগভীর অংশে নিমজ্জিত এক প্রাচীন নগর। জোয়ারের জল সরে গেলে যার স্থাপত্য জেগে ওঠে। মুগ্ধ করে উপকূলবাসী জেলেদের। জানা গেল, এই নগরের বয়স নাকি দশ হাজার বছর! তাহলে? মানুষের সভ্যতার সময় মাত্র দশ হাজার বছর নয় তো! দেখা গেলো, বৈদিক সভ্যতার যে গ্রামভিত্তিক গঠন ছিল, যে পুরোহিততন্ত্র তাকে পরিচালনা করত, তার চেয়েও অনেক বেশি উন্নত সভ্যতা ছিল দক্ষিণ উপকূলের এই সভ্যতা গুলো। সিন্ধু সভ্যতা তো তার উৎকর্ষের উচ্চতা প্রমাণ করে দিয়েছে অনেক আগেই। এখন দেখা যাচ্ছে যে এই সভ্যতাগুলো নগরভিত্তিক। বৈদিক সভ্যতার সঙ্গে এগুলোর সমান বৈপরীত্য।

মাদ্রাজ শহর থেকে কিছু দূরে পূর্ব উপকূলে, বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সাগর তটে এমন একটি নাগরিক সভ্যতার নিদর্শন মেলে। মহাবলীপুরম নামটা সকলেই শুনেছেন। সপ্তম শতাব্দীর চোল রাজাদের তৈরি স্থাপত্য। কিন্তু যা অনেকেই জানেন না, তা হল, এরও বহু আগে এই অঞ্চলে নাগরিক সভ্যতার উন্মেষ ঘটে গেছে। বহু খ্রিস্টপূর্বাব্দ আগেই। গত সুনামির সময়ে মহাদেশীয় তল খানিক সরে যাবার ফলে মাটির গভীরে প্রোথিত সেই অবশেষ খানিক বেরিয়ে পড়েছে। স্থানীয় মানুষ, যারা এ নিয়ে চর্চা করছেন, তাদের কাছ থেকে জানা গেলো, এই সাগর তট থেকে পুরাকালে বাণিজ্যবহর যাত্রা করত নানাদিকে। বড় বড় অর্ণবপোত তাদের সম্ভার নিয়ে যেত বহির্দেশে বানিজ্যে। এখন উদ্বৃত্ত সম্পদ এমন কি ছিল? যা দিয়ে রপ্তানি সম্ভব? ছিল কৃষিজ উদ্বৃত্ত। এ অঞ্চল ছিল কৃষিজ সম্পদে ভরপুর। সেই সম্পদ উৎপন্ন করতে প্রয়োজন একটি কুশলী ও শক্তিশালী জাতি। সেই শক্তিশালী দীর্ঘকায় পেশিবহুল মানুষকে, খর্বকায় শিথিলপেশি পুরোহিত মাতব্বরেরা নাম দিলো অসুর। অসুর একটি জাতি বিশেষ। এ নিয়ে পরের কোনও পর্বে লিখব। এই শক্তিশালী মানুষদের মধ্যে ছিল শক্তিশালী স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েই। এরা সকলে মিলে সমৃদ্ধ নগর গড়ে তুলেছিল। এদের অস্তিত্ব ছিল গণে। রাজত্বে নয়। এমনই কোনও এক নগরের একটি উঁচু টিলায়, (কেননা দক্ষিণ উপকূলে, লাল পাথরের টিলা আছে) কোনও এক ভূয়োদর্শী পুরুষ ডেকে নিলেন বাকিদের। তিনি জানালেন, একার জমি নয়, সম্মিলিত জমিতে চাষ করলে মিলবে বেশি উদ্বৃত্ত। তা নিয়ে বানিজ্যে যাওয়া যাবে। সকলে সেই নিয়মে রাজী হলে সেই পুরুষটি নিজের বিবেকের কারণেই সম্মিলিত জনগণকে বিপদ আপদে রক্ষা করার ভার নিলেন। মহাবলী। এই নামেই হয়ত তাঁকে সকলে ডেকেছিল।

সমান ভাবে নিজের মাটিতে কাজ করলেও বিদেশে সাগর পাড়ি দিয়ে বানিজ্যে যেত পুরুষ। মেয়েরা তখন ঘরবাড়ি পরিবার শিশু বৃদ্ধ, কৃষি জমি, ইত্যাদি সামাল দিত। এই সময়ে কোনও এক রমণী অসীম ক্ষমতাবলে এই অপেক্ষাকৃত দুর্বল মানুষদের দেখাশুনোর ভার নিলো। এর সাহায্যে এগিয়ে এলো কমবয়সী রমনীকুল। এদের প্রত্যেকেরই পরিশ্রমের ফলে সুগঠিত শরীর। এইসব রক্ষয়িত্রীদের কারো কারো মূর্তির অবশেষ দেখা যায়। আধুনিক কালের মতো এদের পেটে সিক্স প্যাকের অস্তিত্ব নজরে পড়ে। সুরক্ষার কারণে এরা পশুদের পোষ মানিয়ে তাদের বাহন করে দস্যুদের মোকাবিলা করত। অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত তীর ধনুক, খড়গ, তরবার। বন্যজন্তু পোষ মানানোর কথা অদ্ভুত লাগলেও সত্যি। আফ্রিকার আরণ্যক উপজাতিরা সিংহ পোষ মানায় এখনও। লায়ন হুইস্পারার এরা। সেসময়ে দক্ষিণের উপজাতিরাও বন্য জন্তু পোষ মানানো এবং তাদের সঙ্গে ভাষা বিনিময় জানত। পুরুষের অনুপস্থিতিতে এইসব নগরে এই বীরাঙ্গনা রমণীরা শক্তির উৎস ছিল। পাওয়া যায় কোটরাপ্পা বলে এক রমণীর নাম। যিনি এতটাই শক্তিশালী ছিলেন যে কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁকে দেবী হিসেবে পুজো করতে শুরু করেছিল তার গণের মানুষজন। তিনি সিংহবাহিনী। অবশ্যই সিংহ তাঁর পোষা ছিল!

এই রমণী যেমন শৌর্যের প্রতীক ছিলেন তেমনই আরেক রমণী ছিলেন। তিনি মধ্যবয়স্কা। পৃথুলা। বৃহৎ উদরা। বৃহৎ উদরের তাৎপর্য হল, তিনি বহুজনের জননী। তিনি উর্বরা। তাঁর স্তনভারে অবনত শরীর বুঝিয়ে দেয় যে তিনি বহুজনের স্তন্যদায়িনীও বটে। এই রমণী জননী এবং উর্বরা শক্তির প্রতীক। অতএব জন্মদান পালঙ ও রক্ষণ, এই তিন প্রকার কর্মে নিযুক্ত রমণীরা গণের পুরুষদের সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন সেই নগর সভ্যতার কালে।

পুরোহিততন্ত্র যখন দক্ষিণ উপকূল গ্রাস করতে এলো, তখন বুদ্ধিতে বলীয়ান কিন্তু শরীরে হীনবল একদল মানুষকে সেনা হিসেবে ব্যবহার করল। এদের বলা হল শিবগণ। মানে শিবের সৈন্য। অর্থাৎ, পুরুষ রাজার অধীনস্থ সেনা। অথচ হীনবীর্য। এখনও দক্ষিণের পর্বতগাত্রে খোদিত কোটরাপ্পা দেবীর সঙ্গে দেখা যায় বালকসুলভ খর্বকায় একদল সৈন্য। এরা শিবগণ। কিন্তু কি উপায়ে এরা কোটরাপ্পাকে নিজেদের পক্ষে এনেছিল? তবে কি সেই আদিকাল থেকেই নারীশরীর আর রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে জমির দখলকে একযোগে ব্যবহার করা হয়েছিল? নারীশরীরের মালিকানা, একগামিনী নারী ও বহুগামী পুরুষের সেই ঐতিহ্য কি ততটাই প্রাচীন? ধর্ষিতা, আহত নারী কি তখনই সংস্কারে আচ্ছন্ন হয়েছিল যে, যে পুরুষ তার ধর্ষক সেই আসলে তার স্বামী? তার ঔরসে জাত পুত্রই আসলে উত্তরাধিকারী? তখনও কি ভূসম্পত্তির মালিকানায় নারী ব্রাত্য ছিল? মনে হয়না কিন্তু। গণের পরিচালিকা নারী অবশ্যই নিজস্ব ভূসম্পত্তির মালিক ছিল। কারণ পরিবার পালনের দায়িত্বও তারই ছিল।

কিন্তু বৈদিক সভ্যতার আগে তেমন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছেনা।

কোটরাপ্পা দেবীর সঙ্গে পরবর্তীতে, আর্য আগ্রাসনের পর, দক্ষিণী যে পুরুষের সংঘাত হয়, তিনি মহাবলী। তাঁর মুখাবয়বে মহিষের মুখ। তিনিই কি মহিষাসুর? এভাবেই তো অসুরদলনীকে চিত্রায়িত করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে আবিষ্কৃত স্থাপত্যের মধ্যে বহু বৃষ বা মহিষের মূর্তি। কৃষিকাজের জন্য এদের ব্যপক প্রচলন ছিল নিশ্চয়! আবার শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে এরা কম ছিলনা। অতএব পাশবিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জমিকে উর্বরা করে তোলা, বীজ বপন করা, ইত্যাদি কর্মের মধ্যে দিয়ে নারীর পরিচালন শক্তি ও পুরুষের পেশিশক্তির প্রকাশ দেখা যাচ্ছে। তখনও নারীপুরুষ সভ্যতার দুটি পক্ষ। যার শক্তি সেকালে পুরোহিততন্ত্রকে আশঙ্কিত করেছিল। তাই বিচ্ছিন্নতাবাদের আশ্রয় তারাও নিয়েছিল। কি উপায়ে সেই বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হল, বিশদে না জেনেও বলা যায়, কূটকৌশলই তাদের অস্ত্র ছিল। মহাভারত রামায়ণের মহাকব্যিক বিস্তারেও আমরা সেই রাজনীতির খেলা দেখতে পাই। চতুরতার সঙ্গে শক্তিশালী শত্রুর মোকাবিলা।

দক্ষিণ উপকূলের এই সভ্যতার সূত্রটি রেখে গেলাম। শেষে মিলন ঘটবে বৃহত্তম ভারতের অবশিষ্ট আদি জনসভ্যতার সঙ্গে।



পর্ব ২

সিন্ধু জনগোষ্ঠী যে মাতৃকুলভিত্তিক ছিল তার একটি প্রমাণ পাওয়া যায় হরপ্পার সমাধিক্ষেত্র থেকে। সমাধিক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া যায় নারীদের মাতৃকুল অনুযায়ী সমাধিস্থ করা হয়েছিল। একই পরিবারের নারীদের সম্ভবত একই ক্ষেত্রে সমাধি দেওয়া হয়েছিল। প্রতিটি গৃহে মাতৃদেবীর কাদামাটির মূর্তি ছিল। একটি অনুমান এ থেকে করা সম্ভব যে নারীর অবস্থান থেকেই পরিবারের অবস্থান সুচিত হতো। কিন্তু তাই বলে নারী এখানে সম্মানজনক অবস্থানে থাকতনা। তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে হরপ্পার কঙ্কালগুলোর দন্তসংক্রান্ত গবেষণায়। দেখা গেছে নারীদের তুলনামূলক ভাবে অনেক কম যত্ন নেওয়া হতো। তাদের খাদ্যে মাংসের পরিমাণ অনেক কম ছিল। তাহলে মাতৃতান্ত্রিক বলব কেন? কারণ এসবই সিন্ধুর সম্পন্ন সময়ের কথা। যখন সভ্যতার উৎকর্ষ ভীষণ ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তখন সমাজে নারীর অবস্থান পুরুষের ক্ষমতার আওতায় এসে পড়েছে। এর আগে, গোষ্ঠীর প্রধান হিসেবে নারীই ছিল প্রধানা। কৃষিক্ষেত্রে, শিল্প উৎপাদনে তার ভূমিকা ছিল প্রধান। পুরুষ তখন উদ্বৃত্ত সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণে, জলধারার রক্ষণে ব্যস্ত। সভ্য নগর গড়ে ওঠার আগে গ্রামগুলির চারিদিকের বন্য এলাকার থেকে বাঁচতে পুরুষের পেশী শক্তি কাজে লেগেছিল। নারী তখনও সৃষ্টিশক্তি। কি কৃষিতে কি সন্তান প্রসবে। কিন্তু ধীরে ধীরে নগর গড়ে উঠল। উদ্বৃত্ত সম্পদের প্রাচুর্য বৈদেশিক বানিজ্যে প্রেরণা দিলো। পুরুষ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হল। কারণ বৈদেশিক বানিজ্যে নারীর ভূমিকা ছিল নগণ্য। তার প্রধান ভূমিকা ছিল নিজের ক্ষেত্রে। ফলে, বানিজ্যে উদ্ভুত সম্পদ গেলো পুরুষের হাতে। এলো বণিক সম্প্রদায়। তাদের সঙ্গে সঙ্গে এলো পুরোহিত সম্প্রদায়। তারা তখনও নারীকে মাতৃকা মূর্তিতে পূজা করে চলেছে। কারণ সৃষ্টিরহস্যে নারীর অবিসংবাদী ভূমিকা তারা অস্বীকার করতে পারছেনা। কিন্তু অন্যদিকে তারা নারী নির্যাতনের বিভিন্ন পন্থা খুঁজে বার করছে। এই বণিক সম্প্রদায় ও পুরোহিত সম্প্রদায় মিলেই যে একটি শক্তিশালী সিন্ধু রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল সে একদিন প্রমাণ হবে। আপাতত সিন্ধুতে নারীর অবস্থানের দুয়েকটি প্রমাণ দিই। নৌশেরা থেকে পাওয়া গিয়েছে একটি কাদামাটির প্লেট। তাইতে একজন নারী একটি চ্যাপ্টা পাথরের ওপর বেলন দিয়ে শস্যদানা চূর্ণ করছে। সিন্ধুর বাসভবনে পাওয়া অসংখ্য তকলি থেকে অনুমান করা যায় ঘরে ঘরে নারীরাই সুতো কাটত। ঘূর্ণমান হস্তচালিত জাঁতা এবং চরকার উদ্ভাবন তখনও হয়নি। সুতরাং উভয় প্রকার কাজই পরিশ্রমসাধ্য ছিল। পুরুষ এসব কাজে নিযুক্ত হয়েছে সে প্রমাণ কোনও চিত্রেও পাওয়া যায়নি।

একেবারে অন্য একটি দিক উত্থাপন করি। সিন্ধুর নানা ভাস্কর্যর মধ্যে একটি নৃত্যরতা নারীমূর্তির কথা সর্বজনবিদিত। নারীটি নগ্নিকা। দুই বাহু অলঙ্কারে ভূষিত। এমন নগ্নিকা মূর্তি যে দেবীমূর্তি নয় তা বলাই বাহুল্য। তবে এ কিসের মূর্তি? কোনও নগরনটীর কি? নারীর সেই আদিম ব্যবহার! কোনও মুগ্ধ সেবাক্রেতা অতঃপর ভাস্কর্যটি তৈরি করেছেন! মাতৃকৌলিক হোক বা মাতৃতান্ত্রিক হোক, কেন্দ্রীভুত ক্ষমতার মধ্যে রাষ্ট্রের উদ্ভবের মধ্যে নারীর মনুষ্যত্ব চিরকাল পদদলিত।

চোখ ফেরাই আরেকটু অর্বাচীন কালে। দেখে নিই একটি অন্য প্রেক্ষিত । দক্ষিণ ভারতে অনার্য যে মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল, তার উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে গীতি থাডানির দুটি বইতে। Sakiyani: Lesbian Desire in Ancient and Modern India এবং Mobius Trip বই দুটিতে তার গবেষণার কথা জানাচ্ছেন গীতি। গীতি স্বনামধন্য। তিনি একজন শিক্ষাবিদ। কারোর অস্তিত্বের সঙ্গে ‘সমকামী’ শব্দবন্ধ জুড়ে দেওয়ার যে রেওয়াজ থেকে আমরা এখনও মুক্ত হতে পারিনি, গীতির পরিচয় খুঁজলে তার উদাহরণ মিলবে। যাই হোক, তিনি তার বইতে লিখছেন, ভারতের, বিশেষত দক্ষিণ ভারতের উপকূল জুড়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছিল যোগিনী মন্দির। যোগিনী বৌদ্ধ ধর্মে ব্যবহৃত ডাকিনী শব্দটির সঙ্গে প্রায় সমার্থক। এই মন্দিরগুলো আর্য মন্দিরের মতো নয়। এগুলি বৃত্তাকার। মাথায় কোনও ছাদ নেই। উন্মুক্ত। পরিধি জুড়ে যে প্রাচীর, তার কুলুঙ্গিতে থাকত দেবদেবীর মূর্তি। মাঝের বৃত্তাকার চত্বরে একটি বৃহৎ যোনিপ্রস্তর। গীতি জানাচ্ছেন, এইসব তথাকথিত যোগিনীরা, (যাদের আমরা একসময়ের শক্তিময়ী নারী ভাবতেই পারি) ছিলেন সর্বৈব স্বাধীন। তাদের মন্দির চত্বরে সম্ভবত কৌল চক্রের মতো চক্র বসত। সেখানে নারীই প্রধানা। সক্রিয়। পুরুষ খানিক নিষ্ক্রিয়। কিন্তু চক্রে স্ত্রী পুরুষ উভয়ের সম্মিলিত চর্চার কথা তো সকলেই জানেন। আর্যরাই ধর্মাচরণকে সম্পূর্ণ স্ত্রীমুক্ত করে। তাদের তৈরি শাস্ত্রই বিশাল তালিকা তৈরি করেছে যুগে যুগে। নারীর কিসে কিসে অধিকার নেই, সেই তালিকা দাখিল করতে গেলে, মৈনাক পর্বত যদি কলম হয়, আর সাত সমুদ্র যদি কালি হয় , তাও বোধ হয় লিখে শেষ করা যাবেনা।

গীতির লেখার মধ্যে প্রকটরূপে বর্তমান, প্রাচীন ভারতে নারী সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ছিল। তার অবস্থান পুরুষের মতোই সমান মর্যাদাপূর্ণ ছিল। অতএব সিন্ধুপরবর্তী সময়ে ধর্মের হাত ধরে নারী আবার স্বমহিমায় উপস্থিত।

এবার ফিরে দেখব, ভারতীয় পুরাণের দিকে। পুরাণ রামায়ন ও মহাভারতের কাল। একটি কাহিনী শোনাবো। এ কাহিনী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাষ্যে লিখিত।

বৈবস্বত মনুর কন্যা ইলা। ইক্ষ্বাকুর ভগ্নী। যদিও বায়ুপুরাণ ও ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে ইলাকে মেয়েই বলেছে, বিষ্ণুপুরাণ কিন্তু জানাচ্ছে, ইলা প্রথমে পুরুষ হয়েই জন্মেছিলেন। পরে নারী হন। বা কিম্পুরুষ। যার নাম সুদ্যুম্ন। এই সুদ্যুম্ন চন্দ্র বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তার প্রতিষ্ঠিত বংশ ঐল বংশ নামেও পরিচিত। রামায়ণে আছে, ইলা নাকি মৃগয়াতে গিয়ে ভুলবশত সহ্যাদ্রি পর্বতে অবস্থিত পার্বতীর শরবনকুঞ্জে ঢুকে পড়েছিলেন। সেখানে শিব ছাড়া অন্য পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। তাই পার্বতীর অভিশাপে তিনি নারী হয়ে যান। ওই কুঞ্জে নাকি বৃক্ষলতা পর্যন্ত নারী। এই অভিশাপের ফলে ইলার সঙ্গের পারিষদেরাও নারী হয়ে যান। বা কিম্পুরুষ। ইলা বাধ্য হয়েই বনে রয়ে গেলেন। এখন নারী ইলাকে দেখে বনে তপস্যারত চন্দ্রপুত্র বুধ মোহিত হয়ে পড়েন। তিনি নাকি প্রগাঢ় তপস্বী। তবুও সংযমের বাঁধ ভাঙছে। তিনি ইলাকে প্রেম নিবেদন করলেন। সম্ভবত ইলারও এছাড়া কোনও উপায় ছিলনা সমাজে ফেরবার। তাই তিনি বিবাহ করলেন বুধকে। এরপর নাকি একমাস অন্তর অন্তর ইলার লিঙ্গ পরিবর্তিত হতে থাকে। যেসব মাসে তিনি নারী সেসব মাসে তিনি বুধের সঙ্গে দাম্পত্যে মেতে থাকতেন। আর যখন তিনি পুরুষ তখন তিনি ব্রহ্মচর্যে কাল কাটাতেন। কিন্তু শেষরক্ষা হলনা। কিম্পুরুষ রূপে ইলার অস্তিত্ব সিদ্ধ হলনা। কারণ ন মাস পর তার একটি পুত্র হল। নাম পুরুরবা।

স্কন্দপুরাণ কিন্তু বলছে ইলা নাকি মেয়ে হতেই চেয়েছিল। স্বেচ্ছায় সে নারী হবার জন্যেই শরবনে প্রবেশ করে। ইলার পুত্রসন্তান হতে একটি প্রত্যক্ষ ফল এই, যে, ইলার পিতা তাকে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন। কারণ তিনি নারী। সম্পত্তি পান পুরুরবা। মানে কিম্পুরুষ ইলার সন্তান। কারণ তিনি পুরুষ।

এই কাহিনীটি অবশ্যই রূপকধর্মী। শিবপার্বতীর গোপন মিলনস্থলে ঢুকে পড়ে তিনি অপরাধ করেছিলেন। কেন? তন্ত্রের স্রষ্টা শিব ও তন্ত্রের প্রধান দেবী পার্বতীর মিলন তো স্বর্গীয়! তাহলে তা দেখা অপরাধ কেন? যৌনতার ওপরে বিধিনিয়ম? নাকি শিব ও পার্বতীর বৈদিক দেবতারূপে উত্তরণের ফল? এবং শাস্তি হিসেবে ইলা কিম্পুরুষে পরিবর্তিত হলেন। একই অঙ্গে নারী ও পুরুষের চিহ্ন ধারণ করলেন। মানে তার স্বাভাবিক চিহ্ন বিলোপ করা হলো। ভয়ংকর! প্রাচীন ধর্মীয় আচারকে গিলে ফেলে তাইতে বৈদিক শিলমোহর লাগানর কাজ শুরু হয়েছে তো আগেই। তাই শিব পার্বতী এখন আর লোকায়ত দেবতা নন। তারা এখন বৈদিক দেবদেবী। ইলার সঙ্গে সঙ্গে তার অনুচরবর্গও কিম্পুরুষে পরিবর্তিত হলো।

বুধ যে তাকে বিবাহ করলেন সেও বাহ্যিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে। হয়ত তিনি অনুধাবন করতে পারেননি যে ইলা কি নিদারুন শাস্তি পেয়েছেন।

এ পর্যন্ত সব ঠিক। কিন্তু এরপরে ইলা একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। পুরুরবা। কেমন যেন মনে পড়ল চিত্রাঙ্গদার কথা। তবে কি ইলা মেয়ে হয়েই জন্মেছিল? পিতা কন্যারূপ গোপন করে ইলাকে সুদ্যুম্ন সাজিয়ে জগতে পেশ করেছিলেন? যাতে কোনভাবেই সম্পত্তি অন্য বংশে না যায়? আর সুদ্যুম্নবেশী ইলা গভীর অরন্যে মিলিত হলেন বুধের সঙ্গে! ঠিক যেমন পুরুষবেশী চিত্রাঙ্গদা ব্রহ্মচারী অর্জুনের প্রেমে পড়েছিল। প্রেমের সঙ্গে কারই বা যুদ্ধ চলে! তিনি নিশ্চয় নিজের কথা খুলে বলেছিলেন বুধকে। অরন্যেই তারা ঘর বাঁধলেন। পিতার মিথ্যাকে সত্য প্রমাণিত করতে ইলা একমাস অন্তর নিজেকে পুরুষরূপে পেশ করতেন। তবু শেষরক্ষা হলনা। তিনি সন্তানের জন্ম দিলেন। আর পিতাও দৌহিত্রকেই সম্পত্তি প্রদান করলেন। ইলা বঞ্চিত হলেন সম্পত্তি থেকে। কারণ তিনি নারী। নারী হয়ে সম্পত্তির অংশ পেলে সে সম্পত্তি জামাতার হবে। ইলার এই মিথকে ভাঙলে এই তো চোখে পড়ে!



পর্ব ৩

সম্ভবত আর্য জাতিসত্ত্বা বলতে যে বহিরাগত তত্ত্বটিতে এতদিন ধরে ঐতিহাসিকদের নির্ভরতা ছিল সেটি এখন নিরসনের পথে । এই ভূখণ্ডের উত্তর পশ্চিমাংশ জুড়ে যে যাযাবর জাতি ক্রমান্বয়ে বাসস্থান পরিবর্তন করে করে শেষ পর্যন্ত সরস্বতী অববাহিকায় থিতু হয়েছিল তাদেরই আমরা আর্য বলি । ঊষর বন্য পরিবেশে থাকতে থাকতে এই যাযাবর গোষ্ঠীগুলির মানুষজন রুক্ষ্ম স্বভাবের হয়ে পড়েছিল । স্বভাবে নম্রতা ছিলোনা বললেই চলে । ক্রমাগত যুদ্ধবিবাদের ফলে তাদের স্বাভাবিক ক্রুরতা ভীষণ বেশি ছিল । বন্য পশুকে এরা ব্যবহার করতে শিখেছিল । বুনো ঘোড়াকে বশ মানিয়ে তাইতে সওয়ার হয়ে এরা ভূখণ্ডের মধ্য থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ প্রান্তের স্থিতিশীল সম্পন্ন জাতিগুলিকে আক্রমণ করত । শান্তিপ্রিয় ও সম্পন্ন সেসব মানুষ যুদ্ধবিমুখ ছিল । বহির্বানিজ্যে উন্নত মানুষজন পারস্পরিক সম্পর্কে ক্ষমতা বা প্রভুত্ব নয় , সৌহার্দ্য রক্ষা করতে জানত । কারণ তাইই ছিল তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মূল কারণ । ফলে ধারালো অস্ত্রের সামনে , দুরন্ত গতির অশ্বারোহীর সামনে তারা হার স্বীকার করল । নিহত হলো । লুণ্ঠিত হলো । আর এই যাযাবর নৃশংস গোষ্ঠীগুলিই প্রথম বিজিত পক্ষের নারীদের লুণ্ঠন ও ধর্ষণের দ্বারা প্রতিরোধ ব্যর্থ করতে শুরু করে । বস্তুত তেমন অকাট্য পাথুরে প্রমাণ হাতে না থাকলেও কিছু কিছু ঘটনার উল্লেখ করলে বোঝা সম্ভব । দাস বা শুদ্র বলে আর্যরা যাদের চিহ্নিত করত তারা ত বিজিত গোষ্ঠীর মানুষ ছিল । এই দাসেদের বা বন্দীদের কাজ ছিল সমাজের বাকি তিন বর্ণের সেবা । কেমন সেবা ? শুদ্র নারী যদি নিজের স্বাধীন অবস্থানে কোনও কুলের প্রধানাও হয়ে থাকেন , আর্য দলপতির দ্বারা বিজিত ও ধর্ষিত হয়ে তাঁর প্রধান কর্ম বা শাস্তি হয়ে দাঁড়ালো পুরুষের শয্যায় যাওয়া । সে পুরুষ গোষ্ঠীপতি স্বয়ং হতে পারে বা তার অতিথিও হতে পারে । বৈদিক সাহিত্যে এমন ভূরি ভূরি কাহিনী ছড়িয়ে আছে , যেখানে গৃহে আগত ঋষি , যিনি কিনা ব্রহ্মজ্ঞ বেদজ্ঞ ইত্যাদি ইত্যাদি , তাঁর সেবার জন্য এক বা একাধিক নারী কামনা করবেন । সুন্দরী , পীনবক্ষা, গুরুনিতম্বিনী নারী দর্শনে তাঁরা এমন কামার্ত হয়ে পরেন যে যেখানে সেখানে রেতঃপাত ঘটে যায় সেইসব উর্দ্ধরেতা ঋষির । নারী তাদের কাছে স্খলিত রেতর আধার মাত্র । কামনার উপশম মাত্র । মানুষ নয় ।

ফিরে আসি পূর্ব প্রসঙ্গে । যারা ভাবছেন আর্যরা ত সাংঘাতিক বিদগ্ধ , পণ্ডিত , ও ধর্মবেত্তা, তাঁরা এমন অসভ্য হীন কর্ম কেন করবেন ? তাদের বলি , মেধার উৎকর্ষ থাকলেই যে চারিত্রিক উৎকর্ষ থাকবে এমনটা নাই হতে পারে । বিশেষ করে আর্য ধারণায় নারীকে যখন অবমানব ভাবাটা চেতনায় গেঁথে গিয়েছে । সুতরাং পণ্ডিত ও ধার্মিক একই সঙ্গে ধর্ষক ও পীড়ক । এরকমই আরেকটি ঘটনাকালের সাক্ষী কি আমরা ইতিহাসে পাইনি ? যখন ইসলাম শাসকের দল উত্তর পশ্চিম প্রান্ত ধরে ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছিল । ইতিহাসের পাতা ভরে আছে অজস্র নারীর হত্যা ধর্ষণ ও লুণ্ঠনে । কখনো কোনও সুলতান দয়াপরবশ হয়ে বেগম করেছেন পরধর্মের নারীকে । সে বিচ্ছিন্ন ঘটনা । আসলে এটি যুদ্ধনীতি । নারীকে পদদলিত করে অধিকার করতে পারলে দুটি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় । একটি প্রজনন অপরটি সম্ভোগ । প্রজননের দ্বারা নিজ গোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ে । যুদ্ধে লড়বার লোক বাড়ে । আর সম্ভোগ ত ক্ষমতা প্রদর্শনের সেরা উপায় ! ফলত দেখা গেলো , এমন শত শত গোষ্ঠীর হয়ত কুলমাতৃকা ছিলেন যে নারী তিনিই পীড়িত হলেন । উপরন্তু তাঁর সম্পদ ও ভূমি গ্রাস করা হলো ।

ভারতের মাটিতে ঋক বেদের রচনা শুরু হয়েছিল আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দীর আশেপাশে । আর সর্বাপেক্ষা অর্বাচীন সুক্তটি রচিত হয় খ্রীষ্টিয় পঞ্চম শতকে । অর্থাৎ বৈদিক যুগের ব্যপ্তি সতেরো থেকে আঠেরো শতক ।

এই গেলো প্রাচীন অধিবাসীদের পরাজয়ের অষ্পষ্ট ইতিহাস এবং মাতৃতন্ত্রের অবসানের প্রহর । পূর্ব ও দক্ষিণের দুর্গম (পর্বত ও দুরন্ত নদনদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন ) অঞ্চলগুলি অবশ্য তখনও অগম্য ছিল । ফলত আর্য সভ্যতার প্রভাব এসব অঞ্চলে সমকালে প্রায় ছিলোনা বললেই চলে ।

একবার ঋক বেদ ঘাঁটি বরং । দেখতে পাচ্ছি একটি প্রাচীন রচনা । যেখানে ঊষাকে এক সুন্দরী ও সুসজ্জিতা রমণী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে । হাস্যমুখী বধূ যেমন স্বামীর সামনে নিজের রূপ উন্মোচন করে তেমনি ঊষা তাঁর রূপ উন্মোচন করেন । তাঁকে বলা হয়েছে নির্লজ্জা । সমাজে নারীর বিচরণের ক্ষেত্রে কি তবে তখনই একরকম নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়ে গিয়েছিল ? লজ্জার ধারণাই বা এলো কিভাবে ? এবং কেন ? শরীর ঢাকতে মানুষ যে পোষাকের ব্যবহার শুরু করে সে ত শীত গ্রীষ্ম থেকে বাঁচতে ! প্রাকৃতিক কারণেই । তবে লজ্জা নিবারণের প্রশ্নটি কবে থেকে উঠল ? বিশেষত নারীর ক্ষেত্রে ? পুরুষ যদি যৌবনবতী নারীকে দেখে কামাতুর হয়ে পড়ে তবে সে দোষ নারীর । সেটিই তার লজ্জা । অতএব আচ্ছাদন দাও । লজ্জা নিবারণ করো । শুধু সেই পুরুষের সামনে নগ্ন হও যে তোমাকে অধিকার করেছে।


পর্ব ৪

মাতৃতন্ত্রে মাতৃআরাধনা এবং মাতৃত্বর গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সেই সময় পেরিয়ে আমরা এসে পড়েছি মাতৃতন্ত্রের কণ্ঠরুদ্ধ হচ্ছে যখন, সেই কালে। সৃষ্টির প্রকাশ যখন প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে নারীর মধ্যেই দেখা যেত তখন মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করেছে, সমীহ করেছে। নারীর ঋতুকালকে পবিত্র কাল ধরা হয়েছে। কারণ রজঃস্বলা নারী প্রাণদানের উপযোগী শরীর পেয়েছে। সে তাই ঈশ্বরী। আরাধনা করতে হয় তাকে। সেই ধারণা বদলে গিয়ে দেখতে পাচ্ছি, ঋতুমতী নারী অশুদ্ধ। অশুচি। দেবতার স্থানে, পুজার স্থানে তার প্রবেশ নিষেধ। আশ্চর্য! কিন্তু এমনটা হলো কি করে? আরেকটু দেখা যাক। ঋক বেদের পুরুষসুক্ত। সেখানে পুরুষকে সহস্রচক্ষুর সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। সে সর্বময়। সর্বাত্মক অস্তিত্বে সে বিশ্বে নিজেকে প্রকাশ করছে। কেমন করে? যেমন করে তার রেত নিম্নগামী হয়ে সৃষ্টি করছে প্রাণ। সেটিই সৃষ্টিবীজ। নারী ধারয়িত্রী। পুরুষ শুচি। সর্বকালে সে পবিত্র। কারণ তার শরীরে রেত সৃষ্টি হয়। নারী নির্বীজ। সে শুধুই ধারণ করে। যেমন করে এই পৃথিবী ধারণ করে বীজ। উদ্ভিদ তার ভুমিকে উদ্ভিন্ন করে জেগে ওঠে। তাই ঋতুকালে নারীস্পর্শ অনুচিত। রজঃস্বলা নারী স্নান শেষে পুরুষের সঙ্গে মিলনে যাবে। কিন্তু তাই কি? বিজ্ঞান কি বলছে? শুধুই শুক্র প্রাণের বীজ? গমনশীল বলে? নারীর ডিম্বাশয় থেকে যে ডিম্বাণু ঋতুচক্রের বিশেষ সময়ে শুক্র দ্বারা নিষিক্ত হয় সেটিই তো ভ্রূণ হয়ে ভবিষ্যতের আলো দেখার অপেক্ষা করে! ডিম্বাণু স্থিত। স্বাভাবিক! পুরুষ তো সদা সঞ্চরণশীল। নারী তো সেই কোন কাল থেকে আপন ঐশ্বর্যে স্থিত! কিন্তু কি অদ্ভুতভাবে ধীরে ধীরে নানা গভীর দর্শনের মধ্যে দিয়ে জানানো হলো, পরম পুরুষ ঈশ্বর। নারী শুধু মানবী নয়, অবমানবী। তার মধ্যে রেত জন্মায়না। সেই রেত উর্দ্ধমুখী হয়ে সে উর্দ্ধরেতা হতে পারেনা। আর যার রেত নিম্নভুমি থেকে ওপরে না গিয়েছে সে আর সেই ঈশ্বরীয় আলো দেখবে কি করে? প্রাণের আলো? কারণ শুক্রই তো প্রাণ, ব্রহ্ম! (ছান্দোগ্য উপনিষদ – ৮/১২) এ একরকম বুঝিয়ে দেওয়া গেলো যে ঈশ্বর অতএব পুরুষ। অথচ আলোর আবার লিঙ্গভেদ হয় বলে আমরা জানিইনা। এইভাবে নারীর সৃষ্টিশীলতাকে একেবারে শূন্য করে দেওয়া হলো। বীজ না পড়লে যেমন প্রাণ জন্মাবেনা তেমনই বন্ধ্যাভূমিতে বীজ পড়েও প্রাণের উন্মেষ ঘটবেনা। সুতরাং নারীর সৃষ্টিশীলতা প্রয়োজন বৈকি!

এরপর ঘটল অদ্ভুত সব সামাজিক পরিবর্তন। ঋকবেদের কাল ধরা হয় খ্রিষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দী বরাবর। সূত্রগুলি সেইসময় লিপিবদ্ধ করা শুরু হয়েছে। আমরা দেখতে পেলাম সেই বৈদিক সময়ে নারীকে কিভাবে অবমানবীর মর্যাদা দেওয়া শুরু হলো।

একটি অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিই। স্ত্রী গর্ভবতী হলে পুংসবন অনুষ্ঠান করতে হতো (অথর্ব বেদ)। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে শুধুমাত্র পুত্রসন্তানের জন্যই এই যজ্ঞ। সমস্ত প্রার্থনাগুলিও পুত্রের জন্য, কন্যাসন্তান জন্মানোয় বাধা দেয়। এরপরের অনুষ্ঠানটি ভয়াবহ। সীমন্তোন্নয়ন। এতে যে নারীর স্বামী পুত্র জীবিত, শুধু তারাই গর্ভিণীর সামনে বীনা বাজিয়ে নাচবে গাইবে। তারপর রান্না করা ভাতের একটি পিণ্ড তার সামনে ধরে জিজ্ঞেস করবে – কি দেখছ? সে উত্তর দেবে – সন্তান। তারা উত্তরে বলবে – বীরপ্রসবিনী হও। (গোবহিলা গৃহ্যসূত্র) এইভাবে অনুষ্ঠান চলাকালে যাবতীয় প্রার্থনা স্বামী ও সন্তানের দীর্ঘজীবনের কামনা করে করা হয়ে থাকে। কোথাও নারীটির দীর্ঘ জীবনের প্রার্থনা নেই। কারণ সন্তান জন্মের পর তার মৃত্যু হলে স্বামী স্ত্রীর সৎকারের পরদিনই বিবাহ করতে পারে।

পুত্র জন্মের পর মায়ের ভুমিকা কি ছিল? পটভূমিকায় মাতা হিসেবে তার নাম বহন করা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ পিতা তার হাত ধরে বাইরের পৃথিবীতে আনে। পাঁচ বছর বয়স হলেই সে গুরুগৃহে যায়। মাতার সংস্রব ত্যাগ করে। কি অপরূপ কৌশলে নারীকে তার ন্যায্য অধিকার, সন্তানসঙ্গের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।

মাতৃতন্ত্রের লুপ্তির আরও কারণ থাকতে পারে। প্রবন্ধে শুধু কিছু তথ্যকে হাতে রেখে একটি আলোচনার অবতারণা করা হয়েছে।

[শব্দের মিছিলে ২০১৭/১৮ তে ধারাবাহিক প্রকাশ]

2 comments:

0

প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার

Posted in




















বছর খানেক আগে দেশের চিকিৎসাক্ষেত্রে এক শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। ব্যাপারটা কি? না, এবার থেকে হিপোক্রেটিক ওথ-এর পরিবর্তে না কি চালু হতে পারে বা হতে চলেছে চরক শপথ। বলাবাহুল্য, চিকিৎসাক্ষেত্রে এটি একটি বড়সড় বদলের ইঙ্গিত। কেননা, চিকিৎসকেরা তাঁদের চিকিৎসা ডিগ্রির শেষে হিপোক্রেটিক ওথ বা হিপোক্রেটিক শপথ নিয়েই চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বা চিকিৎসা পেশায় আসার অধিকার পান। গোটা বিশ্ব জুড়ে এই ব্যাপারটা চলছে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ এমনকি শতাব্দীর পর শতাব্দী। ঠিক এই বিতর্কের সময়েই বা প্রসঙ্গে আমাদের মাথায় প্রশ্ন আসতে পারে আর আসাটাই বরং স্বাভাবিক– কে এই হিপোক্রেটাস, যাঁর নামে হিপোক্রেটিক ওথ সেই প্রশ্নের উত্তর নিয়েই আমরা এই প্রবন্ধে আলোচনা করব। আসলে, আমাদের এই প্রবন্ধে আলোচ্য ব্যক্তিটি হলেন প্রাচীন গ্রীক  চিকিৎসক ও দার্শনিক হিপোক্রেটাস (অনেকের মতে– হিপোক্রেটিস) (Hippocrates)।

হিপোক্রেটাস-কে বলা হয় চিকিৎসাবিদ্যার জনক। তাঁর জীবন সম্পর্কে বিশেষভাবে কিছুই জানা যায়নি। তিনি মোটামুটি ৪৬০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে গ্রীসের ঈজিয়ান বা এজিয়ান সাগরের বুকে অবস্থিত কস নামক দ্বীপে জন্মেছিলেন। তাঁর পিতাও ছিলেন একজন চিকিৎসক। পিতার চিকিৎসক হিসেবে কাজকর্ম দেখে পুত্রেরও ছোটবেলা থেকেই চিকিৎসাবিদ্যার প্রতি আকর্ষণ জন্মায়। ছোটবেলা থেকেই হিপোক্রেটাস ছিলেন লেখাপড়ায় বেশ আগ্রহী। আর তাঁর এই অসীম

আগ্রহ ও অসধারণ মেধা দেখে তাঁর পিতা সেকালের সেরা জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের কাছে তাঁর লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দেন। এমনই একজন মহাজ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন এথেন্সের ডেমোক্রিটাস (যিনি পরমাণুবাদেরও অন্যতম জনক) (খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০ - খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০)(অনেকে উচ্চারণ করেন– দেমোক্রিতোস, ইংরেজিতে Democritus)। ইনি প্রায় গোটা বিশ্ব ভ্রমণ করে প্রকৃতিবিজ্ঞান, গণিত, দর্শন ও চারুশিল্পে বিশাল ও সুগভীর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। এই মহান পণ্ডিতের কাছেই উচ্চশিক্ষা শুরু হয় হিপোক্রেটাসের। গুরু ডেমোক্রিটাসের মতো তিনিও সারা বিশ্বের সেই প্রাচীনকালের শিক্ষাকেন্দ্রগুলোয় যান। প্রাচীন গ্রীসের এথেন্স নগরীতে বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি চিকিৎসাবিদ্যা চর্চা ও অধ্যাপনা করেন। চিকিৎসক হিসেবে তিনি এথেন্সবাসীকে প্লেগ মহামারী থেকে রক্ষা করে এথেন্সবাসীর কাছে সম্মানীয় হয়ে ওঠেন। তিনি যখন চিকিৎসক হিসেবে তাঁর গুরু ডেমোক্রিটাসের চিকিৎসা করেছিলেন তখন তিনি কোনও অর্থ নেননি। ডেমোক্রিটাস ছাড়াও আরও কয়েকজন মহাজ্ঞানী পণ্ডিতদের কাছে হিপোক্রেটাস শিক্ষালাভ করেছিলেন।চিকিৎসকের পুত্র হিপোক্রেটাস গভীর জ্ঞান ও তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা ও যুক্তি দিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অবৈজ্ঞানিক দিকগুলো উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি চারিত্রিক দৃঢ়তার সাথে ও অসাধারণ প্রতিভায় সফলভাবে অল্পদিনের মধ্যেই বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করেছিলেন। এথেন্সে আগত নানান জ্ঞানীগুণীদের সাহচর্যেও তিনি জ্ঞানার্জন করেছিলেন। তিনি এইভাবেই সেই যুগের অন্ধ কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস জর্জরিত চিকিৎসাব্যবস্থাকে একটি পরিপূর্ণ ধারণা তৈরি করে ত্রুটিমুক্ত ও কুসংস্কারমুক্ত করে প্রকৃত চিকিৎসাব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। বহুদূর থেকে রোগীরা আসত নবীন চিকিৎসক ও নতুন মতবাদে বিশ্বাসী হিপোক্রেটসের নবীন চিকিৎসক ও নতুন মতবাদে বিশ্বাসী হিপোক্রেটসের কাছে। এর ফলে এথেন্সের প্রবীণ চিকিৎসকরা এই নবীন চিকিৎসকের সাফল্যে খুব ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। আসলে, হিপোক্রেটাস চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শীতার পাশাপাশি একজন সুচিকিৎসক হিসেবে চিকিৎসাবিদ্যাকে যেসব চিকিৎসক তথা পুরোহিতেরা ভণ্ডামি ও শঠতার

পর্যায়ে নিয়ে গেয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদে গর্জে উঠে বিরোধিতা করেছিলেন। এজন্যে, পুরোহিত সম্প্রদায়ও রেগে তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করতে লাগল। নিরাপত্তাহীনতার ফলে হিপোক্রেটাস এথেন্স পরিত্যাগ করলেন আর এর কিছুদিনের মধ্যেই প্রত্যক্ষ জ্ঞান, যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার ওপর ভিত্তি করে নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতি গড়ে তুললেন। জানা যায় যে,ওই সময়ে গ্রীস দেশে শব-ব্যবচ্ছেদ করা ছিল নিষিদ্ধ। আর এই ব্যাপারটাই চিকিৎসাবিদ্যা ভালোভাবে অধ্যায়ন ও চর্চা করার ক্ষেত্রে ছিল প্রধান বাধা। আর ঠিক এই শব-ব্যবচ্ছেদ না করার জন্যই সেকালের গ্রীক চিকিৎসকেরা শরীরবিদ্যা ও রোগ নিরূপণ বিদ্যায় তেমন পারদর্শী হতে পারতেন না। হিপোক্রেটসের জন্মের সময় গ্রীসের চিকিৎসাবিজ্ঞান কুসংস্কার ও তন্ত্রমন্ত্রের অন্ধকারে আবৃত ছিল। প্রাচীন গ্রীকদের চিকিৎসার দেবতা একজন ছিল যাঁর নাম ‘অ্যাপোলো’। সেই দেবতার হাতে হার্মিসের দণ্ডটিকেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতীক হিসাবে মনে করা হত। প্রাচীন গ্রীসের বিভিন্ন জায়গায় ছিল অ্যাপোলোর মন্দির। তখনকার দিনে লোকেরা অসুস্থ হয়ে পড়লে আরোগ্য কামনায় তারা মন্দিরে পুজো দিত। শুধু পুজো নয় সাথে পশু উৎসর্গও করত। কেননা তখনকার লোকেরা মনে করত যে অ্যাপোলো দেবতার ক্রোধের জন্যই তারা অসুস্থ হয়েছে আর মন্দিরের পুরোহিতরা হল দেবতার প্রতিনিধি আর তাদের ইচ্ছাতেই রোগীর রোগমুক্তি ঘটবে তাই তাদের তুষ্ট করতে পারলেই তারা সেরে উঠবে। আর এই সাধারণ মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে চিকিৎসক পুরোহিতরা তাদের ইচ্ছামতো রোগীদের চিকিৎসার বিধান দিত। এইভাবেই এই এক শ্রেণির পুরোহিতেরা চিকিৎসাবিদ্যাকে নিজেদের জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করেছিল। এই পুরোহিতারা নিজেদের বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চিকিৎসা করলেও তাদের এই চিকিৎসার জ্ঞানকে দেবতা অ্যাপোলোর দান বলে সাধারণ মানুষের কাছে তাদের চিকিৎসাবিদ্যাটি গোপন করে রাখত। আর এভাবেই সেকালের চিকিৎসাবিদ্যা হয়ে  উঠেছিল এক ‘গুপ্তবিদ্যা’ যার অধিকারী থাকত কেবলমাত্র চিকিৎসক পুরোহিত পিতা ও তাদের সন্তানরা। এইরকমই এক চিকিৎসক, অ্যাপোলো মন্দিরের প্রধান

পুরোহিত হেরাক্লিদেস (Heraclides)-এর পুত্র ছিলেন হিপোক্রেটাস। তাই সমাজে তাঁদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি খুবই বেশি ছিল। যার ফলে, হিপোক্রেটাস সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যে লালিত পালিত হয়েছিলেন। হিপোক্রেটাস তাঁর পিতার কাছ থেকে চিকিৎসাবিদ্যার গুপ্তবিদ্যা লাভ করেছিলেন। বলা যায়, চিকিৎসায় তাঁর পিতাই ছিলেন তাঁর শিক্ষাগুরু। তাই তাঁর অস্থি-সংযোজক ঝিল্লী সম্পর্কে, মাংসপেশীর গঠন ও কার্য সম্পর্কে, ভাঙা হাড় জোড়া লাগানো কিংবা সরে যাওয়া হাড়কে পুনরায় সঠিক জায়গায় বসানোর ব্যাপারে এবং আরও ইত্যাদি চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্র সম্পর্কে তাঁর ছিল অগাধ পান্ডিত্য। আর এইসবের পরিচয় পাই তাঁর লেখা চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কিত প্রবন্ধগুলো পড়লে। তিনি এও জানিয়ে গেছেন যে ভাঙা হাড়কে জুড়বার জন্য পাতলা কাঠ কোথায় ও কিভাবে বসাতে হবে এবং তার ওপর কিভাবে পটি বা পট্টি বাঁধতে হবে সে সম্পর্কেও বিস্তারিত কথা। মজার বিষয়, এইসব পদ্ধতি বর্তমান আধুনিক পদ্ধতিরই অনেকটাই কাছাকাছি। অর্থাৎ, হিপোক্রেটাস হলেন প্রথম অস্থিচ্যুতি ও অস্থিভঙ্গের চিকিৎসাসহ শল্য-চিকিৎসার প্রচলনকারী। তৎকালীন যুগে গ্রীসে শরীরচর্চা বিষয়টি খুব গুরুত্বের সাথে দেখা হত আর এই গুরুত্বটা এতটাই মারাত্বক ছিল যে স্পার্টায় অসুস্থ ও বিকলাঙ্গ  শিশুদের হত্যা করা হত কেননা গ্রীকদের মতে সুস্থ ও সবল নাগরিকদের বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। এর ফলে তখনকার গ্রীসে শরীরচর্চার জন্য খেলাধুলা ও ব্যায়ামচর্চার জন্য ব্যায়ামাগার গড়ে উঠেছিল। যখন এই সকল ব্যায়ামগারে কোনও দুর্ঘটনা ঘটত তখন হিপোক্রেটাস যেতেন চিকিৎসা করার জন্য। দুর্ঘটনায় অস্থিসংক্রান্ত অসুবিধার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর লব্ধ জ্ঞান দ্বারা চিকিৎসা করতেন বা চিকিৎসার বিধান দিতেন। আর এইভাবেই তিনি শল্য চিকিৎসার সূত্রপাত ঘটান। ক্ষতস্থানে চিকিৎসার ব্যাপারেও তিনি অনেক নির্দেশ দিয়ে গেছেন যা প্রকৃতপক্ষে কার্যকরী ও বাস্তবধর্মী। এমনকি, তিনি জানিয়ে গেছেন অস্ত্রোপচারের ঘর কেমন হবে বা হওয়া উচিত, অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি কেমনভাবে থাকবে বা তার প্রস্তুতি কিভাবে নেওয়া উচিত, অস্ত্রোপচারের পর ক্ষতস্থানের যত্ন কেমনভাবে নেওয়া উচিত ইত্যাদি মূল্যবান বিষয়। রোগীর পথ্য, পরিচর্যা সহ নানান ব্যাপারে তাঁর অনেক মূল্যবান উপদেশ রয়েছে। বলাবাহুল্য, তাঁর পিতার থেকে চিকিৎসাবিদ্যার গুপ্তকথাগুলো জেনেছিলেন কোনও শব-ব্যবচ্ছেদ করার সুযোগ না পেয়েই। নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে হিপোক্রেটাস চিকিৎসাবিদ্যার জ্ঞানলাভ করেছিলেন। হিপোক্রিটাসের মতে, একজন চিকিৎসকের শুধুমাত্র রোগের উপসর্গ থেকে বিধান দেওয়া উচিত নয় বরং রোগীর পারিবারিক ইতিহাস, পেশা, দৈনন্দিন কাজকর্ম তিনি যা করে থাকেন, তাঁর চারপাশের পরিবেশ, বংশানুক্রমিক রোগের ইতিহাস, তাঁর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা সম্পর্কে ভালোভাবে জানা ও বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এগুলো জানলে ও বুঝলে তিনি রোগীর রোগ সহজভাবেই নির্ণয় করে চিকিৎসা করতে পারবেন। মানবদেহের তাপের হ্রাস-বৃদ্ধি যে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তা প্রথম লক্ষ্য করেছিলেন হিপোক্রেটাস। হিউমোরাল মানবদেহ থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন ধরনের রস সংক্রান্ত চিকিৎসা ব্যবস্থারও তিনি প্রচলন করেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, মানুষের দেহ, মানসিকতা, আচার  ব্যবহার এমনকি মৃত্যুরও প্রধান কারণ হল এই দেহ থেকে নির্গত রস। এই রস কখনো ঠান্ডা, কখনো গরম বা আবার কখনো শুকনোও হতে পারে। এই রসের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেহেরও স্বাভাবিক পরিবর্তন হয়ে থাকে। পরবর্তীকালে চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী গ্যালেন (Galen) (আনুমানিক ১২৯ - ২১৬ খ্রিস্টাব্দ) হিপোক্রেটাসের এই হিউমোরাল মতবাদকে সমর্থন ও গ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়।

তখনকার দিনে সন্ন্যাসরোগ বা মৃগীরোগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের তো বটেই এমনকি চিকিৎসকদের মধ্যেও হরেক রকম কুসংস্কার ছিল। সাধারণ এমনকি চিকিৎসকেরাও ভাবতেন যে, ঈশ্বর রেগে গেলে কিংবা ভূতে ভর হলে মানুষের মৃগীরোগ হয়। অতএব, এই রোগ অত্যন্ত মারাত্মক আর এর চিকিৎসা হয় না। অর্থাৎ, এই রোগে আক্রান্ত হলে কেউ সেরে ওঠে না। চিকিৎসক হিপোক্রেটাস এ ধারণা ভ্রান্ত বলে আখ্যা দিলেন আর শুধু তাই নয় বরং উক্ত ভ্রান্ত ধারণাটির নিরসন ঘটালেন।সেই যুগে হিপোক্রেটস তাঁর ‘অন দি স্যাক্রেড ডিসিস' গ্রন্থে লিখেছেন মৃগীরোগ আর দশটি রোগের মতোই একটি রোগ। তিনি বললেন, যতই ভয়ঙ্কর ও মারাত্মক রোগ হোক না কেন, তার নিশ্চয়ই কোনো না কোনো প্রাকৃতিক কারণ থাকবেই। তাই রোগের চিকিৎসার জন্যেও কোনওরকম ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করা অনুচিত বরং প্রকৃতিই হচ্ছে আমাদের চিকিৎসক। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, It is thus with regard to the disease called Sacred: it appears to me to be nowise more divine nor more sacred than other diseases, but has a natural cause from the originates like other affections. Men regard its nature and cause as divine from ignorance and wonder....। অর্থাৎ, ভূতে ভর করার ঘটনা বা ঈশ্বরের ক্রোধের মতো ঘটনার ফলে যে রোগটি হয় তা তিনি নাকচ করলেন। তার পরিবর্তে রোগ সম্পর্কে চিকিৎসকদের মধ্যে এক বৈজ্ঞানিক মনোভাব তিনি গড়ে তুললেন। যার অভাব তখনকার দিনে তো ছিলই এমনকি এখনকার দিনেও কিছুটা হলেও আছে। মানবদেহে সংগঠিত বিভিন্ন ধরনের ঘা, ফোঁড়া, কাটা, পচনের কারণ ও তার প্রতিকার করার উপায় ছিল তাঁর অন্যতম উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার। তিনি এইসব বিষয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, এইসব রোগ অপরিচ্ছন্ন থাকার জন্য ও দূষিত দ্রব্য ব্যবহার করার ফলে হয় এবং বৃদ্ধিলাভ করে। চিকিৎসার জন্যে তাই তিনি উপযুক্ত খাবার, নির্মল বাতাস, পরিস্কার দ্রব্যাদি, আবহাওয়া পরিবর্তন, অভ্যাস ও সুস্থ জীবনযাপন প্রণালী ইত্যাদি দিকগুলোর ওপর গুরুত্ব দিতেন। আবার, উপযুক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই রোগীকে ঔষধ দিতেন না। আসলে তিনি অপ্রয়োজনীয় ও অনির্দিষ্ট ওষুধ রোগীকে দেওয়ার ব্যাপারটা অবৈজ্ঞানিক মনে করতেন। তিনি বলেছেন, If you want to learn about the health of a population, look at the air they  breathe, the water they drink, and the places where they live.। তিনি  আরও বলেছিলেন যে, কোনও রোগ নিয়ে অনুসন্ধান বা গবেষণার ফলে সেই রোগের সঠিক কারণ জানতে হবে তারপর সেই অনুযায়ী রোগের উপযুক্ত ওষুধ প্রয়োগ করে সেই রোগের চিকিৎসা করতে হবে। তাঁর মতে, একজন চিকিৎসকের একমাত্র উদ্দেশ্য হল রোগীর সেবা এবং রোগ নিরাময়ের মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ করে তোলা। হিপোক্রেটাস মনে করতেন যে, চিকিৎসাবিদ্যা অন্যান্য সকল বিদ্যার মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিদ্যা। তাঁর মতে অন্যান্য শিল্পকলার মতো চিকিৎসাবিদ্যাও এক সুন্দর শিল্পকলা। কি অসাধারণ কথা! কিন্তু, দুঃখের বিষয় যে এই শিল্পকলাটি অন্যান্য শিল্পকলার চেয়ে দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে কিছু চিকিৎসকদের অজ্ঞতার জন্যই। তিনি বলেছেন, এই চিকিৎসাবিদ্যার পুনরুজ্জীবনের জন্যে নবীন চিকিৎসকদেরই ভার নিতে হবে। চিকিৎসাবিদ্যার অধ্যাপক হিপোক্রেটাস তাঁর ছাত্রদের জন্য এক সুন্দর ও অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। চিকিৎসাবিদ্যা সমাপ্ত করার পর যখন তাঁরা চিকিৎসক হিসেবে জীবন শুরু করতে যাবেন তখন সেই নবীন চিকিৎসকদের দাঁড় করিয়ে তিনি এক শপথবাক্য পাঠ করাতেন। আসলে, চিকিৎসকরা তাঁদের চিকিৎসাবিদ্যা অর্জনের পর যাতে তাঁদের সেবা ও মহানতার সুমহান আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হন সেজন্যেই তিনি নব্য চিকিৎসকদের শপথ করাতেন। সেই শপথবাক্যটি হলঃ- সারাজীবন ধরে আমি নিষ্ঠাভরে আমার কর্তব্য সম্পাদন করে যাব এবং আমার পেশার পবিত্রতা অক্ষুণ্ন রাখব। সেই শপথ বাক্যে এও বলা হয়ে থাকে চিকিৎসকদের শিক্ষাগুরু অর্থাৎ যাঁরা তাঁদের চিকিৎসাশাস্ত্রে শিক্ষাদান করেছেন বা করতে সাহায্য করেছেন তাঁরা তাদের মাতৃপিতৃতুল্য। তাঁদের সন্তানরা তাদের ভাতৃ ও ভগ্নীসম এবং তারা যদি এই বিদ্যালাভের ইচ্ছুক হয় তাহলে বিনা পারিশ্রমিকে তাদের বিদ্যাদান করা হবে। যে পথ্যাপথ্যের নির্দেশ চিকিৎসকরা দেবেন সেটি তাঁর যোগ্যতা, বিচার ও বিবেচনা অনুসারে রোগীর উপাকারে লাগবে। কোনও ব্যক্তি যদি চিকিৎসকের কাছে কোনও মারাত্মক ও ক্ষতিকারক ওষুধ চায় তাহলে সেই চিকিৎসক কখনোই সেই ওষুধগ্রহণ করার পরামর্শ দেবেন না। রোগী ও পরিবারের সকল তথ্য যা চিকিৎসক জানবেন চিকিৎসার জন্যে তা সেই চিকিৎসক অন্য কোনও কাউকে জানাবেন না অর্থাৎ গোপন রাখবেন। চিকিৎসকদের কর্তব্য যে তাঁরা যেন সবসময় চিকিৎসাশাস্ত্রকে পবিত্র রাখার চেষ্টা করেন। চিকিৎসকরা যেন এই শপথবাক্যকে যথাযথভাবে পালন করে সকল মানুষের কাছে প্রশংসিত হয়ে তাদের জীবন ও বিদ্যাকে সমভাবে সম্মানিত করে তোলেন। আর এটাই হল সেই বিখ্যাত হিপোক্রেটিক ওথ (Hippocratic Oath) (বাংলায় যা ;হিপোক্রেটিসের শপথ বা হিপোক্রেটীয় শপথ নামে পরিচিত) যা ওই নবীন চিকিৎসকদেরকে বলতে হত আর এখনও বলতে হয়। তবে জানা নেই যে, ভারতীয় আয়ুর্বেদাচার্য চরক কোনও ওইরকম শপথবাক্য পাঠ করাতে কিনা। হয়তো আগাম গবেষণা তার হদিস দেবে। তবে, হিপোক্রেটাসের শপথ বিশ্বজুড়ে বেশি বিস্তারলাভ করেছে। আমাদের কাছে যদিও দুজনেই আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধেয়, নমস্য ও প্রণম্য প্রাচীনকালের চিকিৎসক। হিপোক্রেটাস ছিলেন একজন সুচিকিৎসক এবং চিকিৎসাবিদ্যার স্বনামধন্য অধ্যাপক। চিকিৎসকদের হিপোক্রেটাসই প্রথম শিখিয়েছিলেন কোনও রোগের ইতিহাস ও লক্ষণ ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করে তুলনামূলক মূল্যায়নের পদ্ধতির মাধ্যমে চিকিৎসা করতে। বলা যায় যে, তিনিই প্রথম যিনি চিকিৎসাবিদ্যাকে বৈজ্ঞানিক যুক্তি, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও নীতির ওপর দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য ও তত্ত্বগুলো ‘করপাস হিপোক্রেটিকাম (Corpus Hippocraticum বা Hippocratic Corpus) নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা রয়েছে। এই গ্রন্থে চিকিৎসাবিষয়ক প্রায় ৬০ কি তার বেশি চিকিৎসা সম্পর্কিত কাজ বা নিবন্ধ ও গবেষণাপত্র রয়েছে। হিপোক্রেটাস ৩৭০ (মতান্তরে ৩৭৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) নব্বই (কি তার বেশি বয়সে) আমাদের ছেড়ে চলে যান।আসলে, হিপোক্রেটিসের জন্ম ও মৃত্যুসাল যে ঠিক কত সালে সে সম্পর্কে একেবারে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তিনি চলে গিয়ে রেখে গেছেন সারাজীবন ধরে লিখে যাওয়া চিকিৎসাবিদ্যার বহু প্রবন্ধ যা তাঁর ছাত্ররা সংগ্রহ করে যত্ন  সহকারে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন খৃষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে আলেকজান্দ্রিয়া নগরীর বিখ্যাত লাইব্রেরিতে। অনেকের মতে তা এক-দু খণ্ড নয়, বরং মোট সাতাশি খণ্ডের সেই বৃহৎ হিপোক্রেটাসের রচনাবলী ছিল রচনার পরবর্তী পাঁচশো বছর ধরে চিকিৎসকদের কাছে এক অমূল্য গ্রন্থের মতো। এক একটি খণ্ডে চিকিৎসার এক একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তাঁর রচনায় উল্লেখিত চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে ও চিকিৎসকদের চিকিৎসা সম্পর্কে তাঁর সকল নির্দেশাবলী সর্বকালের জন্য প্রাসঙ্গিক।বলা যায়, সেই রচনাবলী ছিল চিকিৎসাবিদ্যার বাইবেল। তিনি সর্বদা চাইতেন যে, সমস্ত অজ্ঞতা, অন্ধকার ও কুসংস্কার দূর করে চিকিৎসাবিদ্যাকে যুক্তিনিষ্ঠ তত্ত্ব ও তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করতে। আর এই কাজের জন্যে ও চিকিৎসাবিদ্যায় বিপুল অবদানের জন্যে গ্রীসের মহান দার্শনিক প্লেটো (Plato) (আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৭ - খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪৮)-র কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন চিকিৎসাবিদ্যার মহাগুরু ও আদর্শ শিক্ষক। আর সর্বযুগের চিকিৎসক তো বটেই এমনকি সাধারণ মানুষের কাছে হয়ে আছেন এক প্রণম্য ও শ্রদ্ধেয় চিকিৎসক আর চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক।




তথ্যসূত্রঃ-

দেশ বিদেশের বিজ্ঞানী – অমরনাথ রায়, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।
নির্বাচিত বিজ্ঞানীদের জীবনী – পৃথ্বীরাজ সেন, আদ্রিশ পাবলিকেশন, কলকাতা।
ছোটদের বিজ্ঞানকোষ (দ্বিতীয় খণ্ড), বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, ঢাকা, বাংলাদেশ।
উইকিপিডিয়া সহ নানান ওয়েবসাইট।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - দিলীপ মজুমদার

Posted in






স্যর মুহাম্মদ ইকবাল ( ১৮৭৭-১৯৩৮) । বা, আল্লামা ইকবাল । পঞ্জাব প্রদেশের এক কাশ্মীরী পণ্ডিত বংশে জন্ম । কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্টস ডিগ্রি আর জার্মানির লুডভিগ ম্যাক্সিমিলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন পি এইচ ডি ডিগ্রি । তিনি ব্যারিস্টারি করতেন , দর্শনচর্চা করতেন।কিন্তু তাঁর বড় পরিচয় তিনি কবি । তাঁর চিন্তা-ভাবনা প্রভাবিত হয়েছিল সুফি কবি জালালউদ্দিন রুমির কাব্য-দর্শনের দ্বারা । রবীন্দ্রনাথ ও ইকবাল প্রায় সমসাময়িক । এক দেশের মানুষ । তবু তাঁদের মধ্যে গড়ে ওঠে নি কোন যোগাযোগ । যেমন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে নি বেগম রোকেয়ার (১৮৮০-১৯৩২) ।

ইকবালের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগের যে একটা ক্ষীণ যোগসূত্র পাওয়া যায় , যে কথা আমরা এই নিবন্ধে আলোচনা করব , তা কিন্তু বেগম রোকেয়ার ক্ষেত্রে নেই । সেই পর্যালোচনা করে পূরবী বসু লিখেছেন একটি বই –‘রবীন্দ্রনাথ ও বেগম রোকেয়া : কাছে থেকেও দূরে ।‘ বেগম রোকেয়ার কর্মক্ষেত্র ছিল কলকাতায় , তবু রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে কেন নীরব রইলেন তিনি , রবীন্দ্রনাথেরও নীরবতা কেন , তা বোঝা যায় না । আমাদের বন্ধু সাংবাদিক অনল আবেদিন এবং তাঁর মতো আরও কিছু মানুষ রবীন্দ্রনাথ ও বেগম রোকেয়ার যোগাযোগহীনতার রহস্য উন্মোচনের কথা বলেন । কিন্তু তথ্যের অসদ্ভাবে তা বোধহয় সম্ভব হবে না ।

ইকবাল ও রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গে ফিরে আসি । দুজনেই কবি । তবে কবি-স্বভাবের পার্থক্য আছে । রফিক জাকারিয়া তাঁদের কবি-স্বভাবের পার্থক্য নির্ণয় করে বলেছেন যে রবীন্দ্রনাথে আছে কমনীয় সৌন্দর্য , আর ইকবালে আছে পৌরুষের দৃপ্ততা । রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে সংগীতের সুর , আর ইকবালে আছে আগুনের তপ্ততা [ “ Tagore brought out romantic in man ; Iqbal the heroic . Tagore exulted in feminine beauty ; Iqbal in masculine strength . There was music in Tagore’s poetry; there was fire in Iqba’s . Tagore was humble ; Iqbal was proud . Tagore was always active ; Iqbal easy going and lazy . “

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ইকবালের সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে ইকবালের আদ্যন্ত নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা দেখা যায় । রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাঁর চেয়ে একটু বেশি সক্রিয় । আমির বাট [ Aamir Butt] তাঁর ‘ Tagore and Iqbal : Views ‘ [ Tagore – animikh Rabindranath –World Press 12 Janury, 2012 ] প্রবন্ধে বলেছেন যে রবীন্দ্রনাথ লাহোরে গেলে ইকবালের মেয়ো রোডের বাসভবনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন । ইকবাল তখন ভাগলপুরে গিয়েছিলেন বলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় নি । ইকবাল ভাগলপুর থেকে ফিরে এসে রবীন্দ্রনাথের আগমন সংবাদ শুনেও নীরব ছিলেন , যোগাযোগের চেষ্টা করেন নি। মহম্মদ ইক্রাম চুঘাটি [ Muhammad Ikram Chughati ] পাকিস্তানের ইকবাল বিশেষজ্ঞ , উর্দু সায়েন্স বোর্ডের ডাইরেক্টর । তিনি তাঁর বই ‘ Iqbal and Tagore’ -এ বলেছেন যে ইকবাল নোবেল পুরস্কারের ব্যাপারে ক্ষুব্ধ ছিলেন । তাই তিনি রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে নীরব ছিলেন, যোগাযোগের চেষ্টা করেন নি ।

১৯৩৭ সালে লাহোরে মুসলিম ব্রাদারহুডের উদ্যোগে যে ইকবাল দিবস পালন করা হয় , তাতে রবীন্দ্রনাথ যে বাণী পাঠান তা হল :

--” স্যার মহম্মদ ইকবালের কবিত্বের প্রতি সমগ্র ভারতের শ্রদ্ধা নিবেদনে আপনাদের সহিত আন্তরিকভাবে যোগদান করিতেছি । উর্দু ভাষায় অনভিজ্ঞতার দরুন আমি তাঁহার রচিত প্রাঞ্জল মৌলিক রচনা পাঠের আনন্দ হইতে বঞ্চিত । এজন্য আমি সততই দুঃখ অনুভব করিয়া থাকি । দীর্ঘকাল জীবিত থাকিয়া তিনি দেশের সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করুন , এই প্রার্থনা করি । “ [আনন্দবাজার পত্রিকা , ১৬ ডিসেম্বর , ১৯৩৭ ] ।

রবীন্দ্রনাথ যখন এই বাণী পাঠাচ্ছেন , তখন ইকবাল জীবিত । কিন্তু তাঁর কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল , তা জানা যায় না । ইকবালের মৃত্যুর পরে ১৯৩৮ সালের ২১ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথ নিম্ন শোকবার্তা পাঠিয়েছিলেন :

--” ইকবালের মৃত্যুতে আমাদের সাহিত্যক্ষেত্রে যে স্থান শূন্য হইল তাহা পূরণ হইতে দীর্ঘকাল লাগিবে। আমাদের সাহিত্য জীবনে ইহা একটি মারাত্মক আঘাত । জগতে আজ ভারতের স্থান অতি সংকীর্ণ ; এই সময়ে ইকবালের মতো একজন কবিকে হারানো তাহার পক্ষে খুবই কষ্টের কথা। কারণ ইকবালের কবিতার একটা বিশ্বজনীন মূল্য ছিল । “ [আনন্দবাজার পত্রিকা , ২২ এপ্রিল , ১৯৩৮ ] ।

ইকবালের কবিতায় বিশ্বজনীন মূল্যের কথা স্বীকার করছেন রবীন্দ্রনাথ । কথাটা সত্য । কিন্তু তাই যদি হয়, তাহলে ইকবাল কেন নোবেল পুরস্কার পেলেন না ? ইকবালের পক্ষ নিয়ে এর আলোচনা করেছেন মিলি গেজেট [ Millie Gazette] ‘ Why wasn’t Iqbal awarded a Nobel’ প্রবন্ধে । তিনি প্রকারান্তরে বলতে চেয়েছেন যে হাফিজের ভাব অপহরণ করেই ‘গীতাঞ্জলি’র কবিতাগুলির উদ্ভব –” While Tagore almost plagiarized Hafiz in his 103 poems in Gitanjali, that won him 1913’s Nobel, Iqbal’s inspiration was devoid of pilfering . “

আবার কেউ কেউ এমনও বলেছেন যে রবীন্দ্রনাথকে নোবেল দেওয়ার পেছনে রাজনীতি আছে।মুসলমানদের অবজ্ঞা করার জন্য ‘হিন্দু’ রবীন্দ্রনাথকে বেছে নিয়েছেন নোবেল পুরস্কারের কর্তারা । তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের পরিবারের সঙ্গে ইংরেজদের দহরম-মহরম ছিল ---” The reasons behind overlooking Iqbal were more political than the perceived lack of profundity , Tagore’s family hobnobbed with the high-ranking English officials and he ( Tagore) had influenced English friends . Though Tagore belonged to Brahmo Samaj , a subdivision of Hinduism , he was viewed by the Brits a ‘refined Upper Class Hindu’ ( Nirad C Chaudhary’s words) and they wanted to project a ‘Hindu’ above a Muslim . “ ( ‘Why wasn’t Iqbal awarded a Nobel’ )

সমস্ত পুরস্কারের পেছনে যে রাজনীতি থাকে , সে ব্যাপারে আমাদের সন্দেহ নেই। দ্বারকানাথ থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে বহু সম্ভ্রান্ত ইংরেজের সঙ্গে যোগাযোগও প্রমাণিত সত্য । কিন্তু ইকবালকে বঞ্চিত করে রবীন্দ্রনাথকে নোবেল দেওয়া হয়েছে তা কি মুসলিম জগত বিশ্বাস করে?  তা যদি হবে , তাহলে ১৯৩২ সালে ইরানের রাজা রবীন্দ্রনাথকে কেন এমন উষ্ম সংবর্ধনা দেন, কেন তেহেরানে তাঁকে নিয়ে মেতে ওঠে মানুষ ? কেনই বা বাগদাদ রাজা নিজে এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা করেন রবীন্দ্রনাথকে ? আমরা অনুমান করতে পারি মুসলিম জগতে রবীন্দ্রনাথের বিপুল সংবর্ধনা কবি ইকবালকে ক্ষুব্ধ করেছিল। এ ব্যাপারে ইকবালের অনুরাগীদের কিছু ভূমিকা থাকা বিচিত্র নয় । তাঁরা ইকবালের অন্তর্নিহিত ক্ষোভে অগ্নিসঞ্চার করেছিলেন হয়তো ; যেমন রবীন্দ্রনাথের তথাকথিত ভক্তরা আধুনিক কবিদের সম্বন্ধে , নজরুল সম্বন্ধে তাতিয়ে তোলবার চেষ্টা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে । 
[লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক ]

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in





৩২

-‘কী হল?’ সৈনিকেরা রাস্তা থেকে চিৎকার করে উঠল সমস্বরে।

-‘একটা গাড়ি’… জবাব দিল ফাইনহালস। দূরবীনের মধ্য দিয়ে গাড়িটা লক্ষ্য করতে লাগল সে। লক্ষ্য করতে করতে শুনতে পেল যে একতলা থেকে ঐ অল্পবয়সী মহিলা বেরিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে। সৈনিকদের সঙ্গে কথা বলছে ঐ মহিলা। চেঁচিয়ে নিচ থেকে তাকেও যেন কিছু একটা বলল সে। কিন্তু ফাইনহালস তার কথা বুঝতে পারল না। কিন্তু সে চেঁচিয়ে নিচে তাকিয়ে বলে উঠল…

-‘গাড়ির ড্রাইভার সৈনিক নয়, সাধারণ নাগরিক। ড্রাইভারের পাশের সিটে যে বসে আছে, সে লোকটা নাৎসিবাহিনীর। গাড়ির পেছনে একটা সিমেন্ট, বালি, কংক্রিটের মশলা মেশাবার যন্ত্র।’

-‘কংক্রিটের মশলা মেশাবার যন্ত্র?’ সবাই নিচ থেকে আবার চেঁচিয়ে প্রশ্ন করে।

-‘হ্যাঁ’ – সে উত্তর দেয়।

ইতিমধ্যে নিচের সবাই খালি চোখেই দেখতে পেয়ে গেছে গাড়িটা। গাড়ির ড্রাইভার, ড্রাইভারের পাশের নাৎসিবাহিনীর লোক, কংক্রিটের মশলা মাখার যন্ত্র সব দেখা যাচ্ছে। পেছন পেছন আরও গাড়ি আসছে। পুরো একটা বাহিনী আসছে। ধুলোর ঝড় ছড়িয়ে গ্রামটা ছাড়িয়ে গাড়িগুলো ভাঙা ব্রিজের ধ্বংসাবশেষের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রথম গাড়িটা থেমে যাবার পরে, দ্বিতীয় গাড়িতে রাখা তাঁবু বানানোর সরঞ্জাম সবাই দেখতে পায়। সবাই প্রথম গাড়িটার দিকে ছুটে যায়; এমনকি মারিয়াও ছোটে তাদের সঙ্গে। লেফটেন্যান্ট ছাড়া সবাই দৌড়ে যায়। গাড়িটার দরজা খুলে উর্দিধারী লোকটা নেমে আসে। লোকটার মাথায় কোনো টুপি নেই।

-‘হাইল হিটলার১, ছেলেরা’… লোকটা চিৎকার করে বলে, ‘এই জায়গাটার নাম কি বার্কজাবা?’

‘হ্যাঁ’… সৈনিকেরা জবাব দেয়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও পকেট থেকে হাত বের করে নিয়ে আসে তারা। লোকটার জামার কাঁধে মেজর পদমর্যাদার লেবেল। সৈনিকেরা জানে না যে লোকটাকে কী বলে সম্বোধন করবে ওরা।

লোকটা ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে… ‘আমরা এসে গেছি। ইঞ্জিন বন্ধ করে দাও।’ তারপর লোকটা সৈনিকদের এবং লেফটেন্যান্টের দিকে তাকায়, কয়েক পা এগিয়ে আসে। লেফটেন্যান্টও এগোয় কয়েক পা। এগিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। বাকি কয়েক পা তাড়াতাড়ি এগিয়ে লেফটেন্যান্ট মুক বাদামি ইউনিফর্ম পরা লোকটির সামনাসামনি দাঁড়ায়। টুপিতে হাত দেয়, জয়ধ্বনি উচ্চারণ করে নিজের নাম বলে। ইউনিফর্ম পরা লোকটিও নিজের হাত তোলে, তারপর মুকের সঙ্গে করমর্দন করে।

-‘ডয়সেন- কন্সট্রাকশন ম্যানেজার’ নিজের পরিচয় দেয় লোকটি… ‘আমরা এখানে ব্রিজটা বানাতে এসেছি।’

লেফটেন্যান্ট সৈনিকদের দিকে তাকায়। সৈনিকেরা মারিয়ার দিকে তাকায়। মারিয়া দৌড়ে বাড়িটার মধ্যে ঢুকে যায়। ডয়সেন খোশমেজাজে তৎপরতার সঙ্গে অন্যান্য গাড়িগুলোকে নির্দেশ দিতে থাকে।

সব কাজ বেশ দৃঢ়, তৎপর ভঙ্গিতে করলেও ডয়সেনের চেহারা দেখে মনে হয় যে তার প্রাণে বেশ দয়ামায়া আছে। সে মিসেস সুসানের কাছে রান্নাঘরটা একবার দেখতে চাইল হাসিমুখে। দেখে বেরিয়ে এসে অবশ্য কিছুই বলল না। পাশে টেমানদের পরিত্যক্ত বাড়িটাতে একবার ঢুকে গেল সে। সাবধানে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল; বেরিয়ে এল হাসিমুখে। তার কিছুক্ষণ পরে তাঁবুর সরঞ্জাম নিয়ে যে গাড়িগুলো এসেছিল, সেগুলো ফিরে গেল টেসার্জির দিকে। লোকটা নিজে টেমানদের পরিত্যক্ত বাড়িটাতে আশ্রয় নিল। কিছুক্ষণ পরে ঐ বাড়ির জানালায় দাঁড়িয়ে ধূমপান করতে দেখা গেল তাঁকে। জানালায় দাঁড়িয়ে বাকি গাড়িগুলো থেকে মালপত্র নামানোর উপরে নজর রাখছিল সে। মালপত্র নামানোর জায়গায় তদারক করছিল অল্পবয়সি এক ছোকরা, যার খাকি বাদামি ইউনিফর্মের কাঁধের লেবেলে বোঝা যাচ্ছিল যে সে সার্জেন্ট। ডয়সেন মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে সেই ছোকরাকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছিল। এতক্ষণে সব গাড়ি চলে এসেছে। সব মিলিয়ে দশটা গাড়ি। জায়গাটা ভর্তি হয়ে গেছে লোহার গার্ডার, বিম, সিমেন্টের বস্তা আর শ্রমিকের ভিড়ে। এক ঘণ্টা পরে ঝার্নির দিক থেকে এল একটা ছোট মোটরচালিত নৌকা।

সকাল থেকে যে কয়জন এসেছে, তাদের মধ্যে তিন নম্বর যে লোকটার পরনে খাকি বাদামি ইউনিফর্ম, সে এলো নৌকা করে। সঙ্গে ছিল দু’জন স্লোভাক মহিলা, যাদের গায়ের রঙ রোদ্দুরে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। নৌকা থেকে নামা মাত্রই কলহাস্যে তাদের অভ্যর্থনা জানাল শ্রমিকেরা।

ফাইনহালস সবকিছুই খুব কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছিল। প্রথমে ভাঙ্গাচোরা পরিত্যক্ত বাড়িটার মধ্যে রান্না করবার জন্য বড় একটা চুল্লি নিয়ে যাওয়া হল। তারপর গাড়ি থেকে তৈরি করা রেলিংএর অংশ, জোড়, স্ক্রু, আলকাতরা মাখানো বিম, কারিগরি যন্ত্রপাতি, রান্নার নানা সরঞ্জাম, কাঁচা বাজার সব নামানো হতে লাগল। বেলা এগারোটার মধ্যে দেখা গেল স্লোভাক মহিলারা আলুর খোসা ছাড়িয়ে খাবারের প্রস্তুতিতে লেগে গিয়েছে। বারোটার মধ্যে সব মালপত্র নামানো হয়ে গেল। সিমেন্ট রাখবার একটা ছাউনি তৈরি হল। ব্রিজ যেখানে তৈরি হবে, সেখানে ঢালু রাস্তার মুখে তিনটে ট্রাক এসে নুড়িপাথর ফেলতে শুরু করল।

কিছুক্ষণ পরে গ্রেস এল তার জায়গায়; ফাইনহালস নিচে গেল। নিচে গিয়ে অবাক হয়ে লক্ষ্য করল যে সরাইখানার উপরে একটা কাঠের সাইনবোর্ড পেরেক দিয়ে এঁটে দেওয়া হয়েছে, যেখানে লেখা আছে ‘ক্যান্টিন’।

পরবর্তী দিনগুলোতে ফাইনহালস খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করছিল ব্রিজ তৈরির কাজ। সে অবাক হয়ে গিয়েছিল সমস্ত কাজের সুচারু এবং নিপুণ পরিকল্পনা দেখে। একটা কাজেও কোনও ভুল নেই, কোথাও কোনও খামতি নেই। নির্ভুল ভাবে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে প্রতিটি জিনিস, গুছিয়ে করা হচ্ছে প্রতিটি কাজ। যেটা যেখানে থাকবার কথা, সেখানেই রাখা হচ্ছে; একটু দূরেও নয়, কাছেও নয়। ফাইনহালস জীবনে এরকম অনেক কন্সট্রাকশন সাইট দেখেছে, কিন্তু এত নিপুণতা, এত পরিষ্কার, এত দ্রুত কাজ সে কোথাও দেখেনি। তার বিস্ময়ের শেষ ছিল না। ঠিক তিন দিনের মাথায় ব্রিজের কংক্রিট পিলারগুলি সব স্থাপন করা হয়ে গেল। যখন শেষ পিলারে ঢালাই চলছে, তখন প্রথম পিলারের মাথায় লোহার বিমের কাঠামোগুলো আটকানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে। চতুর্থ দিনের দিন ব্রিজের উপর দিয়ে পায়ে হাঁটার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেল। এক সপ্তাহ পরে সে লক্ষ্য করল যে নদীর ওপারে ব্রিজের আরও নানা তৈরি অংশ নিয়ে বেশ কিছু ট্রাক এসে দাঁড়িয়েছে। সেই ট্রাকগুলির সাহায্যে ঐ পারের ঢালু অংশ, যেটা ব্রিজের সঙ্গে লেগে থাকবে সেটা তৈরি হল, এবং শেষ মুহূর্তের নানা টুকরো কাজ ইত্যাদি চালানো হয়েছিল।

ব্রিজের উপরে চলাচলের পথ সম্পূর্ণ তৈরি হবার পরে, বাকি কাজ খুব দ্রুতগতিতে এগোতে লাগল। ফাইনহালস খুব কমই পাহাড় কিম্বা জঙ্গলের দিকে লক্ষ্য রাখত। সে সারাক্ষণ ব্রিজের কাজ দেখত। তার খুব ভালো লাগত। এমনকি যখন ড্রিল করতে হত তাকে, তখনও সে শ্রমিকদের কর্মকাণ্ডের দিকেই সর্বক্ষণ তাকিয়ে থাকত।

সন্ধেবেলায় কিম্বা বিকেলের দিকে যখন তার দূরবীনে বসবার কাজ থাকত না, সে নিচে বাগানে গিয়ে বসে থাকত। এক রাশিয়ান যুবক, নাম ছিল তার স্তালিন। স্তালিন গাদলেঙ্কো, সে ভারি সুন্দর বালালাইকা২ বাজাত। পানশালার ভিতরে খানাপিনা, গান বাজনা এমনকি নাচানাচিও হত সন্ধেবেলা। যদিও নাচ একেবারেই বারণ, কিন্তু ডয়সেন সেসব নিয়ে কখনো মাথা ঘামাত না। সে সব সময় খোশ মেজাজে থাকত। চোদ্দ দিনের মধ্যে সে ব্রিজ বানিয়ে ফেলেছিল। যদি এসব নাচাগানা, খানাপিনা একটু কম হত, তাহলে হয়ত সে বারো দিনের মধ্যেই কাজ শেষ করে ফেলত। তাছাড়া ডয়সেন প্রচুর জ্বালানি বাঁচিয়েছিল, কারণ খাবারদাবার, বাজার এসব আনতে সে অন্য জায়গায় গাড়ি পাঠায়নি। টেমানদের রান্নাঘরে রান্না করিয়ে, স্থানীয় বাজার থেকে কাজ চালিয়ে এবং মিসেস সুজানের কাজ থেকে খাবারদাবার কিনেই সবার প্রয়োজন মিটে গিয়েছিল। শ্রমিকেরা যাতে সব খাবারদাবার ঠিক মত পায়, আরামে থাকে, এমনকি ধূমপান ইত্যাদিও করতে পারে, এসব দিকে তার দৃষ্টি ছিল। সে জানত যে ক্ষমতা প্রয়োগ করে, ভয় দেখিয়ে জোরজার করে কাজ করানোর চেয়ে একটু ছাড় দিয়ে খোশমেজাজে নিজে এবং বাকি সবাইকে থাকতে দিলে ভালো কাজকর্ম হয়। সে অনেক ব্রিজ বানিয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অনেকগুলো ব্রিজ অবশ্য যুদ্ধে উড়ে গেছে, তবুও সেগুলো যতদিন ছিল, ততদিন বেশ কাজে লেগেছে। কর্মদক্ষতার কারণে তার কখনই কাজের অভাব হয়নি।

মিসেস সুজানও খুব খোশমেজাজে ছিলেন। আবার ব্রিজটা তৈরি হচ্ছে। যদিও এদিকে যুদ্ধের আঁচ আর সেরকম নেই, তবুও কিছু সৈনিক থাকতে পারে এই সরাইখানায়; তাছাড়া গ্রামের লোকও নদী পেরিয়ে আসতে পারবে এদিকে। শ্রমিকরাও বেশ খোশমেজাজে আছে। তিন দিন অন্তর অন্তর টেসার্জির রাস্তা দিয়ে ছোট, বাদামি রঙের একটা গাড়ি আসে। সরাইখানার সামনে গাড়িটা দাঁড়ায়। গাড়ি থেকে একটা বুড়োটে দেখতে ক্লান্ত লোক নেমে আসে খাকি বাদামি ইউনিফর্ম পরা; কাঁধে ক্যাপ্টেনের লেবেল আঁটা। সব শ্রমিকদের ডাক পড়ে। লোকটা সবার পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দেয়। অনেক টাকা পায় তারা। অনেক টাকা, সেসব দিয়ে তারা সৈনিকদের কাছ থেকে শার্ট, মোজা এগুলো কিনতে পারে ইচ্ছে হলেই। বিকেলে পানাহার করতে পারে ইচ্ছেমত। রান্নার কাজ করতে যে সুন্দরী স্লোভাক মেয়েরা এসেছে, ইচ্ছে হলে তাদের সঙ্গে নাচতেও পারে।

দশ দিনের দিন ফাইনহালস লক্ষ্য করল যে ব্রিজ প্রায় তৈরি। রেলিং লাগানো হয়ে গেছে। ব্রিজের উপরে এবং নদীর দুই পারের ব্রিজের মুখে ঢালু রাস্তার কাঠামো তৈরি। সিমেন্ট, লোহার গার্ডার এসবের কাজ শেষ। এমনকি সিমেন্ট রাখার যে ছাউনি তৈরি হয়েছিল, সেটাও নেই। তার উপর প্রায় অর্ধেক শ্রমিক এবং রান্নাঘরের একজন মহিলা ফিরে গেছে। বার্কজাবা আবার ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে যাচ্ছে। জনা পনেরো শ্রমিক এখনও আছে, ডয়সেন আর খাকি বাদামি ইউনিফর্ম পরা অল্পবয়সি সার্জেন্ট ছোকরা আছে আর রান্নাঘরে কাজ করবার একজন স্লোভাক মহিলা আছে। ফাইনহালস প্রায়ই এই মহিলার দিকে তাকিয়ে থাকে। মহিলা সারা সকাল জানালায় বসে বসে গুনগুন গান গাইতে গাইতে আলুর খোসা ছাড়ায়; মাংসের টুকরো কাটাকুটি, দুরমুশ করা, সব্জি কাটা, পরিষ্কার করা এসব করতে থাকে; মহিলা বেশ সুন্দরী।

মহিলা হেসে উঠলে তার বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা হত। রাস্তার দিকে দূরবীনটা রাখলে টেমানদের পরিত্যক্ত বাড়ির জানালায় বসে থাকা ঐ মহিলাকে সে পরিষ্কার দেখতে পেত; মহিলার চোখমুখ, সূক্ষ্ম গাঢ় ভ্রুযুগল এবং তার সাদা দাঁত এসব দেখতে পেত। মহিলা সব সময় আপনমনে গুনগুন করে গান গেয়ে যেত। সেদিন সন্ধেবেলায় সে পানশালায় গিয়েছিল। নেচেছিল ঐ মহিলার সঙ্গে। প্রায়ই সে তার সঙ্গে নাচে। তার ঘন কালো চোখ সে খুব কাছ থেকে দেখতে পেয়েছে। নিজের হাতের মধ্যে নিয়েছে তার সবল, সাদা বাহুযুগল। তার একটু আশাভঙ্গ হয়েছিল, কারণ মহিলার শরীরে রান্নাঘরের গন্ধ। পানশালার ভেতরে বেশ আর্দ্র, ধোঁয়াটে পরিবেশ। মারিয়া ছাড়া এই মহিলাই এখানে একমাত্র অল্পবয়সি মহিলা। মারিয়া কাউনটারে বসে থাকে। কারো সঙ্গে নাচে না সে। সেদিন রাতে সে এই স্লোভাক মহিলাকে স্বপ্নে দেখল, যার নাম সে এখনও জানে না। পরিষ্কার দেখতে পেল সে এই মহিলাকে স্বপ্নে, যদিও বহুদিন ধরে সে ইলোনা ছাড়া কারো কথা ভাবেনি, এমনকি সেদিন রাতেও ঘুমোতে যাবার আগে সে গভীরভাবে ইলোনার কথাই চিন্তা করছিল।

(চলবে)


১. ‘হাইল হিটলার’ হিটলারের সময়ে তার উদ্দেশ্যে এই শব্দবন্ধের সাহায্যে জয়ধ্বনি দেওয়া হত, যার আক্ষরিক অর্থ হল হিটলার সুরক্ষিত থাকুন।

২. বালালাইকা একধরণের ত্রিভুজাকৃতি রাশিয়ান তারযন্ত্র। কিছুটা গিটারের মত।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in








পাঁচ

বলেই হাত ভরে দিলো সোজা ধানের জমির গর্তে। একটা মাগুর ধরেছি, বলেই মাথা টিপে হাত বের করতেই দেখা গেলো মাছ নয়একটা বড় কালো কেউটে সাপ। বিশু সাপটাকে সাঁ সাঁ করে ঘুরিয়ে সহজেই ছুঁড়ে দিলো দূরে। তারপর তাল কাঁকড়া ধরে ভেজে খাওয়া হলো মাঠে। ভাজার সমস্ত সরঞ্জাম বিশু লুকিয়ে রাখতো একটা পোড়ো বাড়িতে। সাঁতার কাটতে যেতাম নতুন পুকুরে। একবার ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলাম তার প্রখর বুদ্ধির জোরে। মাথার চুল ধরে টেনে তুলেছিলো ডাঙায়।গ্রীষ্ম অবকাশে বট গাছের ডালে পা ভাঁজ করে বাদুড়ঝোলা খেলতাম বিশুর নেতৃত্বে।তারপর ঝোল ঝাপটি। উঁচু ডাল থেকে লাফিয়ে পড়তাম খড়ের গাদায়। এসব খেলা বিশুর আবিষ্কার। তারপর সন্ধ্যা হলেই গ্রামের বদমাশ লোকটিকে ভয় দেখাত বিশু। সুদখোর সুরেশ মহাজন বটগাছের ডাল থেকে শুনলো, কি রে বেটা খুব তো চলেছিস হনহনিয়ে। আয় তোকে গাছে ঝোলাই। সুদখোর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। তারপর থেকে ও পথে যেত না মহাজন। সাদা চুলো গান্ধিবুড়িকে রোজ সন্ধ্যাবেলা নিজের মুড়ি খাইয়ে আসতো অতি আদরে। বিশু বলতো, আমি তো রাতে খাবো। বুড়ির কেউ নেই, আমি আছি তো। শ্রদ্ধায় মাথা নত হত নেতার হাসিতে। একবার বন্যার সময় স্কুল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের নেতা। কোথাও সাঁতার জল কোথাও বুক অবধি জল। একটা সাপ বিশুর হাতে জড়িয়ে ধরেছে। বিশু এক ঝটকায় ঝেরে ফেলে দিলো সাপটা। স্কুল আমাদের যেতেই হবে। সাঁতার কাটতে কাটতে আমাদের সে কি উল্লাস। যে কোনো কঠিন কাজের সামনাসামনি বুক চিতিয়ে সমাধান করার মতো মানসিকতা বিশুর ছিলো। সে সামনে আর আমরা চলেছি তার পিছুপিছু। শেষ অবধি পৌঁছে গেলাম স্কুল। হেড মাষ্টারমশাই খুব বাহবা দিলেন স্কুলে আসার জন্য। তিনি বললেন, ইচ্ছা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।টিফিনের সময় ছুটি হয়ে গেলো। আসার সময় একটা নৌকো পাওয়া গেলো। মাঝি বললেন, আমার বয়স হয়েছে আমি একা অতদূর নৌকা বাইতে পারবো নি বাবু। তাছাড়া আমার এখনও খাওয়া হয় নি।বিশু সঙ্গে সঙ্গে নিজের টিফিন বের করে দিলো। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিফিন বের করে দিলাম। মাঝি ভাই বললেন, এসো সবাই এক হয়ে খেয়ে লি। তারপর নৌকার কান্ডারি হলো বিশু। আর আমরা সবাই মুড়ি মাখিয়ে খেতে শুরু করলাম। মাঝি ভাই ও বিশু খেলো। ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম গ্রামে। মাঝি ভাইকে পারিশ্রমিক দিয়ে বিদায় জানালাম।পরের দিন রবিবার। রঙিন সকাল। আকাশে মেঘের আনাগোনা। কাশের কারসাজি নদীর তীর জুড়ে। বন্যার জল নেমে গিয়েছে। পুজো পুজো ভাব। বিশু কাশফুলের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। কয়েকদিন হলো তাকে দেখা যাচ্ছে না। আমি ঘুরতে ঘুরতে পুজো বাড়ির ঠাকুর দেখতে গেলাম। সেখানে দেখি বিশু হাতে কাদা মেখে শিল্পীকে সাহায্য করছে। তিন দিন ধরে এখানেই তার ডেরা। এখন তার মনে বাজছে ঢাকের ঢ্যামকুড়াকুড়। মন মন্দিরে তার দুর্গা গ্রামদেশ ছাড়িয়ে অভাবি বাতাসে বাতাসে। পুজো বাড়িতে আমাকে দেখেও কোনো কথা না বলে হাঁটতে হাঁটতে বাইরে চলে গেলো।আমি জানি সে এখন চাল, ডাল নিয়ে সর্দার বুড়িকে রেঁধে খাওয়াবে। সে বলে, ওর যে কেউ নেই। ও খাবে কি? বিশুর বাবা বছরে একবার বাড়ি আসেন। তিনি ভারতীয় সৈন্য বিভাগে কাজ করেন। বাড়িতে এলেই বিশুর হাতে হাতখরচ বাবদ তিনি বেশ কিছু টাকা দিয়ে যান। সেই টাকা বিশু লোকের উপকারে কাজে লাগায়।বড়ো অবাক হয়ে ভাবি, ছোটো বয়সে এতবড় মন সে পেল কোথা থেকে?

স্কুলের দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় আমাদের চার বন্ধুর বাড়ির গার্জেনরা শলা পরামর্শ করে হোষ্টেলে থাকার কথা বললেন। দায়িত্ব নিলো বিশু। কিন্তু হেড মাষ্টারমশাই বললেন, সেশনের মাঝে হোষ্টেল পাবি না। ঘর ভাড়া নিয়ে চারজনে থাক। পরীক্ষা এসে গেছে। কাছাকাছি থাকিস তিনটি মাস। রেজাল্ট ভালো হবে।ঘুরে ঘুরে অবশেষে ভাড়া ঘর পেলাম। কিন্তু বাড়িওয়ালার পাশের প্রতিবেশি বললেন, সাবধান ওই বাড়িতে ভূত আছে। আমরা ভয় পেয়ে তিনজনে বলেুু উঠলাম, তাহলে অন্য ঘর দেখি চল।বিশু বললো, টাকা দেওয়া হয়ে গেছে। ভূতের বাড়িতেই থাকবো। বিশু যখন সঙ্গে আছে, ভয় কি তোদের।তার অভয় বাণী ভরসা করে আমরা মাল পত্তর নিয়ে ঢুকে পড়লাম লড়াইয়ের কোর্টে। ক্যাপটেন বিশু বাড়িটা এক চক্কর পাক দিয়ে হাতে একটা লাঠি নিয়ে বললো, চলে আয় ভূতের বাচ্চা। আমরা ওর সাহস দেখে অবাক হতাম। রমেন বলে উঠলো, ভূতের শেষ দেখে ছাড়বো। জীবনের মরণের ভয় একটু বেশি। সে কাঁপা গলায় বলে উঠলো, যদি গলা টিপে ধরে ভূত। বিশু বললো, ভয় নেই, আমি একাই একশো। তোর কিছু হবে না। হলে আমার হবে।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in

 




অধ্যায়-৪


খানকয়েক কুঁড়েঘর, তার চেয়েও খারাপ অবস্থার গোটাকয় দোকান, তহসীল অফিস, থানা, তাড়ির দোকান, ব্লক অফিস, মদের দোকান, কলেজ--- ব্যস্‌, পথচলতি কারো চোখে এইটুকুই ধরা দেবে। একটু এগিয়ে গেলে একটা আমের বাগান--- বেশ ঘন, তাতে একটা কাঁচা ঘর, রাস্তার দিকে পিট,। আর কবাটহীন দরজাটার মুখ জঙ্গলের দিকে।
বৃষ্টির দিনে রাখালের দল গাছের ছায়া ছেড়ে ঘরটার মধ্যে ঢুকে জুয়ো খেলে, বাকি দিন এটা খালিই পড়ে থাকে। কিন্তু খালি থাকলেও লোকজন খালি থাকতে দেয় না যে! মেয়ে-পুরুষেরা সময় সুযোগ বুঝে একে নানা ভাবে ব্যবহার করে থাকে।
শিবপালগঞ্জে এই ঘরটার যা প্রচলিত নাম সেটা শুনলে হেনরি মিলারও ব্যোমকে যাবেন। কলেজের এক মাস্টার তাতে খানিকটে জল মিশিয়ে নাম দিয়েছেন-'প্রেম-ভবন'।
কুঁড়েঘর আর প্রেম-ভবনের মাঝখান দিয়ে চলা সড়কের এ'পাশটা শিবপালগঞ্জের শুধু একটা কোণাকে ছুঁয়েছে। আসল শিবপালগঞ্জ রাস্তার ওপারে। আসল শিবপালগঞ্জকে পাওয়া যাবে বৈদ্যজীর বৈঠকখানায়।
বৈঠকখানার হদিস পেতে হলে একটু গলিঘুঁজির মধ্যে ঢুকতে হবে। দুপাশে খাপরায় ছাওয়া এলোমেলো-ধ্যাবড়া গোছের ঘরবাড়ি। বাড়ির বাইরের রোয়াকগুলো গলা বাড়িয়ে গলির মধ্যে মৌরসীপাট্টা নিয়ে বসেছে। দেখলেই এদের ফিলজফিটা বোঝা যায়--নিজের চৌহদ্দির আশেপাশে খালি জায়গা দেখলেই অন্যের চোখ এড়িয়ে কব্জা কর।

এই সবুজে সবুজে ছাওয়া এলাকায় খোলা মাঠের মধ্যে একটি বাড়ি একটা কোণ আটকে এমন ভাবে গড়ে উঠেছে যে ওদিকে আর এগিয়ে যাওয়া মুশকিল। ওটি বৈদ্যজীর বাড়ি। বৈদ্যভবনের সামনের দিকটা পাকা আর গেঁয়ো স্টাইলে বেশ সম্ভ্রম জাগানো, কিন্তু পেছনের দিকে কাঁচা দেয়াল আর তার পিছে প্রাতঃকৃত্য হয়, তাই কিছু নোংরা পড়ে থাকে। যেমন ঝিলিমিলি এয়ারপোর্ট আর লকলক হোটেলের সারি দিয়ে এদেশের 'সিম্বলিক মডার্নাইজেশন' মাপা হয়, তেমনি এর প্রভাব এই দেহাতি বাড়িটার আর্কিটেকচারেও দেখা যাচ্ছে।এর থেকে প্রমাণিত হয় যে দিল্লি হোক কি শিবপালগঞ্জ, কাজের ক্ষেত্রে দেশি বুদ্ধি সর্বত্র এক।
বাড়িটার সামনের ভাগ, যাতে বাঁধানো রোয়াক, বারান্দা আর একটা বড় কামরা রয়েছে, বৈঠকখানা নামে প্রখ্যাত। ইঁট-বালি মাথায় করে বয়ে নিয়ে যাওয়া মজদূরও জানে যে বৈঠকখানার মানে শুধু ইঁট-চূণ-সুরকির তৈরি বাড়িটা নয়। ১০ নং ডাউনিং স্ট্রীট, হোয়াইট হাউস, ক্রেমলিন -এসব বাড়ির নাম না, ক্ষমতার নাম।

থানার থেকে ফিরে এসে রূপ্পনবাবু দেজ্খতে পেলেন - দরবার-এ-আম, অর্থাৎ,বারান্দায় খুব ভীড় জমেছে ,অমনি চলার গতি বেড়ে গেল। পরনের ধূতি ফড়ফড় করতে লাগল।
বৈঠকে ঢুকতেই উনি জানতে পারলেন যে ওনার মামাতো ভাই রঙ্গনাথ শহর থেকে ট্রাকে চড়ে এসেছে; কিন্তু রাস্তায় ড্রাইভার ওর থেকে দু' টাকা উসুল করেছে।

একটা রোগাভোগা লোক ময়লা গেঞ্জি আর ডোরাকাটা আন্ডারওয়ার পরে এই নভেম্বর বিকেলের শীত-শীত আবহাওয়ার মধ্যেও দিব্যি খুশি-খুশি বসে আছে।
ওর নাম হল মঙ্গল, কিন্তু লোকে ডাকে শনিচর বলে। চুলে পাক ধরেছে, সামনের দাঁত ক'টা পড়ে গেছে।ওর পেশা বলতে বৈদ্যজীর বৈঠকে বসে থাকা। ও সাধারণতঃ শুধু আন্ডারওয়ার পরেই থাকে, আজ গায়ে গেঞ্জি উঠেছে দেখে রূপ্পনবাবু বুঝে গেলেন যে শনিচর "ফর্ম্যাল" হতে চাইছে। ও রূপ্পনবাবুকে একশ্বাসে রঙ্গনাথের সমস্যাটা বলে দিয়ে নিজের নগ্ন উরূতে তবলার কিছু কঠিন বোল বাজিয়ে উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, " আজ বদ্রীভাইয়া এখানে থাকলে কিছু একটা হয়ে যেত।"
রূপ্পনবাবু রঙ্গনাথকে বল্লেন--" তুমি ঠিক করেছ, রঙ্গনাথদাদা। দু'টাকা দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে দিলে। কথায় কথায় খুন-খারাপি উচিৎ নয়।"
রূপ্পনবাবুর সঙ্গে রঙ্গনাথের দেখা হল প্রায় দেড় বছর পরে। রূপ্পনবাবুর সিরিয়াস ভাবটাই ওর কাছে সারাদিনের সবচেয়ে মজার ব্যাপার ধরে নিয়ে ও বলল, " আমি তো মারামারি করতেই যাচ্ছিলাম, কি ভেবে সরে এলাম।"
রূপ্পনবাবু মারপিটের বিশেষজ্ঞ হওয়ার ভঙ্গিতে হাত তুলে বল্লেন-- তুমি ঠিক করেছ। এইসব ঝগড়া-ঝাঁটিতে ইস্টুডেন্ট কমিউনিটির বদনাম হয়।
রঙ্গনাথ এবার ওকে ভাল করে চেয়ে দেখলো। কাঁধের ওপর ধুতির কোঁচা,একটু আগে মুখে পোরা পান, চুলে কয়েক লিটার তেল-স্থানীয় গুন্ডাগিরির যেকোন স্ট্যান্ডার্ডে একদম প্রথমসারির বলে মনে হবে। রঙ্গনাথ কথা পাল্টানোর চেষ্টায় বলল," বদ্রীদাদাকে দেখছি না! উনি কোথায়?"
শনিচর আন্ডারওয়ার ঝাড়তে লাগল, যেন কয়েকটা পিঁপড়েকে ঘরছাড়া করবে। ভুরু কুঁচকে বলল, " আমিও বদ্রীভাইয়ার কথাই ভাবছিলাম। আজ ও থাকলে এতক্ষণে তো--"।
রঙ্গনাথ ওর কথায় কান না দিয়ে রূপ্পনবাবুকে বলল," বদ্রীদাদা এখন কোথায়?"
রূপ্পনবাবু একটু কড়া ভাবে জবাব দিলেন-- শনিচর বলল তো! আমায় বলে যায় নি। হয়তো বাইরে গিয়েছেন। এসে যাবেন। কাল হোক, পরশু হোক বা তরশু--ঠিক এসে যাবেন।"
ওনার কথার ভাবে বোঝা মুশকিল যে বদ্রী ওনার আপন বড়ভাই, ওনার সাথে এক ঘরেই থাকেন। রঙ্গনাথ জোরে শ্বাস টানল।
শনিচর বসে বসেই পা টা লম্বা করল। তারপর শরীরের যে অংশ থেকে বাঁ-পাটা বেরিয়েছে ঠিক সেখানে চামড়ার একটা টুকরোয় চিমটি কেটে চেপে ধরল। ওর চোখ তৃপ্তিতে বুজে গেল। একটু পরে চিমটির জায়গাটায় আস্তে আস্তে হাত বোলাতে বোলাতে ও নেকড়ের মত মুখব্যাদান করে হাই তুলল। তারপর ঝিমধরা স্বরে বলল, "রঙ্গনাথ ভাইয়া শহর থেকে এসেছেন, ওনাকে আর কি বলব? কিন্তু কেউ কোন 'গঞ্জহা'র থেকে দুটাকা তো দূর, একটা কড়ি কেড়ে নিয়ে দেখাক তো?"
'গঞ্জহা' শব্দটা রঙ্গনাথের অপরিচিত নয়;মানে,গঞ্জ অর্থাৎ শিবপালগঞ্জের নিবাসী।এটা একটা টেকনিক্যাল শব্দ যেটাকে শিবপালগঞ্জের অধিবাসী বেশ সম্মানসূচক টাইটেলের মতন ব্যবহার করে থাকে। আশপাশের গাঁয়ের অনেক 'শান্তির পূজারী'ও কখনো কখনো নীচু গলায় পরামর্শ দেন-তুমি ওর সঙ্গে লাগতে যেয়ো না। জান না তো, ও শালা একজন 'গঞ্জহা'।

বৈঠকখানার মেজেতে একটি চোদ্দ-পনের বছরের ছেলেও বসে ছিল। দেখলেই বোঝা যায় যে ও সরকারের শিক্ষা-প্রসারের ফাঁদে পা দেয় নি। শনিচরের কথা শুনে বেশ দম্ভের সঙ্গে বলে উঠলো-" শহুরে ছেলেরা বড্ড সিধেসাদা আর সরল । কেউ আমার কাছে টাকা চেয়ে দেখুক তো---" বলে ও হাতটা হাওয়ায় এমন করে ঘোরাতে লাগলো যেন লরিতে একটা বড় হ্যান্ডল লাগিয়ে প্রাণপণে স্টার্ট করতে চাইছে।সবাই হেসে উঠল, কিন্তু রূপ্পনবাবু আরো গম্ভীর।
উনি রঙ্গনাথকে জিগ্যেস করলেন," তুমি ড্রাইভারকে টাকাটা নিজের থেকে দিলে কি ও ধমকে-ধামকে নিয়ে নিল?"
রঙ্গনাথ প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, "আজকাল তুমি কোন ক্লাসে পড়ছ, রূপ্পন?"
প্রশ্নটা যে পছন্দ হয় নি, সেটা ওনার চেহারায় স্পষ্ট।
-" ক্লাস টেন এ। তুমি বলবে সে তো দু'বছর আগেও পড়ছিলে। কি করব, আমি তো শিবপালগঞ্জে এই ক্লাস টেন থেকে বেরোনোর রাস্তাটাই খুঁজে পাচ্ছিনে। তুমি জান না দাদা, এ দেশের শিক্ষাপদ্ধতি বিলকুল বেকার। বড় বড় নেতারা বলছেন। আমিও সহমত। তারপর ধর এই কলেজের হাল-হকিকত, সেসব তো তুমি কিছুই জান না। যত লুচ্চা ছ্যাঁচড়ের আড্ডা হয়েছে।মাস্টারের দল পড়ানো-টরানো ছেড়ে খালি পলিটিক্স করছে। দিন রাত পিতাজীকে তিতি-বিরক্ত করে ছাড়ছে। খালি এটা করো, সেটা করো, মাইনে বাড়াও, আমার ঘাড়ে তেল মালিশ করো। এখানে কেউ পাশ করতে পারে?
আছে, কিছু নির্লজ্জ ছেলেপুলে আছে, যারা কখনো কখনো পরীক্ষায় পাশ হয়ে যায়, কিন্তু তাতে---"।
কামরাটার ভেতরে বৈদ্যজী রোগীদের ওষুধ দিচ্ছিলেন। আচমকা ওখান থেকেই বল্লেন," শান্ত হও রূপ্পন! এই কু-ব্যবস্থা শীঘ্র সমাপ্ত হবে।"
যেন আকাশবাণী হল," শান্ত হও বসুদেব! কংসের বিনাশকারী ধরাধামে অবতরিত হল বলে।" রূপ্পনবাবু শান্ত হয়ে গেলেন। রঙ্গনাথ ভেতরের কামরার দিকে ঘুরে চেঁচিয়ে বলল, " মামাজী, এই কলেজটার সঙ্গে আপনার কিসের সম্পর্ক?"
" সম্পর্ক"? কামরার ভেতর থেকে বৈদ্যজীর হাসির প্রতিধ্বনি শোনা গেল।" তুমি জানতে চাইছ এই কলেজের সঙ্গে মামার কিসের সম্পর্ক? রূপ্পন, রঙ্গনাথের কৌতূহল নিবারণ কর।"
রূপ্পন বড় বিজনেসম্যানের ঢঙে বলল," পিতাজী কলেজের ম্যানেজার। মাস্টারদের কলেজে ঢোকা-বেরনো সব এনার হাতে।"
রঙ্গনাথের চেহারায় এই কথাটার প্রভাব দেখে আরো বলল," এমন ম্যানেজার পুরো তল্লাটে পাওয়া যাবে না। ভালর জন্যে ভাল, আর হারামীর জন্যে খানদানী হারামী।"
রঙ্গনাথ এই নতুন খবরটা চুপচাপ হজম করল। তারপর কিছু বলতে হবে বলে বলল," তাহলে কো-অপারেটিভ ইউনিয়নের কি হবে? মামাজী ওটারও কিছু ছিলেন না?"
" ছিলেন না, আছেন।" রূপ্পনবাবু একটু চড়া সুরে বল্লেন," উনি ম্যানেজিং ডায়রেক্টর ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।"

বৈদ্যজী ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।
ইংরেজ- শাসনের যুগে উনি ইংরেজদের প্রতি শ্রদ্ধাবনত ছিলেন। দেশি সরকার এলে দেশি শাসকদের প্রতি। উনি অনেকদিনের দেশসেবক। বিগত মহাযুদ্ধের সময় , যখন এই দেশ জাপানী আক্রমণের ভয়ে কাঁপছিল, তখন উনি ফার-ইস্টে লড়ার জন্যে অনেক সেপাই রিক্রুট করিয়েছিলেন। আজকাল দরকার পড়লে নিজের রাজনৈতিক ফ্যাকশনে রাতারাতি অনেক সদস্য ভর্তি করাতে পারেন। আগেও উনি নানাভাবে জনগণের সেবা করেছেন--- যেমন জজের এজলাসে জুরির সদস্য এবং 'অ্যাসেসর' হওয়া, দেওয়ানি মোকদ্দমায় সম্পত্তির রিসিভার হওয়া। ইদানীং উনি কো-অপারেটিভ ইউনিয়নের ম্যানেজিং ডায়রেক্টর এবং কলেজের ম্যানেজার।
গল্পটা হল উনি এই সব পোস্টে কাজ করতে চান না, কেন না ওনার পদের লালসা নেই। কিন্তু এ'তল্লাটে এইসব দায়িত্বপূর্ণ পদে সাহস করে দায়িত্ব নেবে-এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। আর এলাকার যত নব্যযুবক? সবগুলো গোটা দেশের নব্যযুবকদের মতই অকম্মার ঢেঁকি। তাই নিতান্ত বাধ্য হয়ে ওনাকে এই বৃদ্ধবয়সেও এই সব দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে।
বৃদ্ধবয়স! বৈদ্যজীর জন্যে এই শব্দটি মাত্র পাটিগণিতের ফাঁদে পড়ে করতে হল। কর গুনলে ওনার বয়েস বাষট্টি ছাড়িয়েছে। কিন্তু রাজধানীতে থেকে দেশসেবায় রত অগুনতি মহাপুরুষদের মত ওনারও বয়স বেড়েছে, উনি বুড়ো হন নি।
ওই মহাপুরুষদের মত উনিও পণ করেছেন যেদিন মরবেন সেদিনই বুড়ো হবেন, তার আগে নয়। আর সেদিনই মরবেন যেদিন লোকে বিশ্বাস করিয়ে ছাড়বে যে সত্যি সত্যি মরে গেছেন। তার আগে নিজেকে জীবিত ধরে নিয়ে দেশসেবা করেই যাবেন।

সমস্ত বড় পলিটিশিয়ানদের মত উনি পলিটিক্সের মা-মাসি করে থাকেন এবং পলিটিশিয়ানদের নিয়ে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েন না। গান্ধীজির মত উনিও নিজের রাজনৈতিক দলে কোন পোস্ট নেন নি, কারণ উনি দলের মধ্যে তরুণদের উৎসাহ দিতে চান। কিন্তু কো-অপারেটিভ আর কলেজের ব্যাপারে লোকেরা ওনাকে চাপ দিয়ে বাধ্য করল আর উনি সেই চাপ মেনে নিলেন।
বৈদ্যজীর একটি পেশা হল কবরেজি। এই পেশায় দুটো ফর্মূলা ওনার একেবারে ঠোঁটের ডগায়; একটা হল ' গরীবের দাতব্য চিকিৎসা ' আর অন্যটা ' রোগ না সারলে পয়সা ফেরৎ'। এই দুই ফর্মূলায় রোগীদের কতটা আরাম হয় তা বলা বাহুল্য, কিন্তু বৈদ্যজী যথেষ্ট আরাম পাচ্ছেন।
উনি সমস্ত রোগকে দু'ভাগে ভাগ করেছেন,-- প্রকট রোগ আর গুপ্ত রোগ। প্রকট রোগের চিকিৎসা প্রকট ভাবে হয় আর গুপ্ত রোগের চিকিৎসা গুপ্ত ভাবে। সমস্ত রোগের জন্যে ওনার একটাই থিওরি---সব রোগের মূল কারণ ব্রহ্মচর্য্যের ক্ষয়। কলেজের ছেলেদের কান্তিহীন, শিড়িঙ্গে চেহারা দেখলে প্রায়ই উনি এই থিওরি ঝাড়তে থাকেন । কেউ যদি বলে যে ছেলেদের অপুষ্টির কারণ গরীবি এবং ঠিকমত খেতে না পাওয়া তো উনি ধরে নেন যে ব্যাটা আসলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্রহ্মচর্য্যের গুরুত্বকে ছোট করে দেখছে। আর কে না জানে যে কেবল চরিত্রহীনেরাই ব্রহ্মচর্য্যের গুরুত্ব মানে না। দারিদ্র ও আধপেটা খাওয়ার কথা যে তুলবে সেই চরিত্রহীন।

ব্রহ্মচর্য ক্ষয়ের ফলাফল নিয়ে উনি বেশ ভয়-জাগানো লেকচার দিয়ে থাকেন। সক্রেটিস, সম্ভবতঃ ওনাকে কি অন্য কাউকে, বলেছিলেন যে জীবনে তিনের পর চতুর্থবার ব্রহ্মচর্য ক্ষয় করার আগে নিজের কবর খুঁড়ে নেয়া ভাল। এই ইন্টারভিউয়ের উনি এমন ছবির মত বর্ণনা করেন যে লোকে ভাবে সক্রেটিস ব্রহ্মচর্যের ব্যাপারে আজও ওনার অবৈতনিক কন্সালট্যান্ট। ওনার মতে ব্রহ্মচর্য নষ্ট করার সবচেয়ে বড় ক্ষতি হল লোকে পরে চাইলেও নষ্ট করতে পারে না। সংক্ষেপে, ব্রহ্মচর্য নষ্ট করতে হলে আগে ব্রহ্মচর্যকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার।
ওনার এইসব লেকচার শুনে কলেজের তিন-চতুর্থাংশ ছেলে জীবনের প্রতি হতাশ হয়ে গেছল। কিন্তু ওরা যে একসাথে আত্মহত্যা করেনি তার কারণ বৈদ্যজীর ঔষধালয়ের একটি বিজ্ঞাপনঃ
" হতাশ নবযুবকদের জন্যে আশার বার্তা"।
এই 'আশা' যদি কোন মেয়ের নাম হত তাহলেও ছেলের দল এতটা উৎসাহিত হত না। কিন্তু ওরা জানে যে এই আশার বার্তা আসছে একটি 'গুলি' থেকে , যেটা দেখতে ছাগলের নাদির মত, কিন্তু পেটে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে শিরায় শিরায় নাচে রক্তধারা।

একদিন বৈদ্যজী রঙ্গনাথকে চেপে ধরে ব্রহ্মচর্য্যের গুণ বোঝাতে শুরু করলেন। উনি এক উদ্ভট বায়োলজি আওড়ালেন যার হিসেবে কয়েক মণ খাবার খেলে কয়েক ছটাক রস তৈরি হয়। তারপর রস থেকে রক্ত, রক্ত থেকে আরো কিছু, এই ভাবে চলতে চলতে শেষে গিয়ে এক ফোঁটা বীর্য তৈরি হয়। উনি প্রমাণ করে ছাড়লেন যে এক ফোঁটা বীর্য বানাতে যা খরচ হয় সেটা একটা অ্যাটম বোমা বানানোর খরচকেও ছাড়িয়ে যায়। রঙ্গনাথের বোধোদয় হল যে এ পোড়ার দেশে অমূল্য কিছু রয়েছে তো তা হল বীর্য। উনি বললেন যে বীর্যের অনেক শত্রু, সবাই চায় অন্যের বীর্য লুঠ করতে। কোন রকমে যদি তোমার বীর্য রক্ষা করতে পারো, তো ধরে নাও যে তোমার চরিত্র বেঁচে গেল।
বোঝা গেল যে আগে হিন্দুস্থানে বীর্যরক্ষার ওপর খুব জোর দেয়া হত। একদিকে ঘি-দুধের নদী বয়ে যেত, তো অন্যদিকে বীর্যের। লেকচারের শেষে উনি একটি সংস্কৃত শ্লোক শোনালেন যার অর্থ হল -- এক ফোঁটা বীর্যের পতন হলে মানুষ মরে যায়, কিন্তু এক ফোঁটা তুলে নিতে পারলে জীবন ফিরে পায়।
সংস্কৃত কানে যেতেই শনিচর হাতজোড় করে বলে উঠলো---" জয় ভগবান কী!"
ও মাথা নুইয়ে মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে শ্রদ্ধা ও আবেগের বশে নিজের পশ্চাৎদেশকে প্রায় ছাতের দিকে উঁচু করে তুলল। বৈদ্যজী আরো বার খেয়ে রঙ্গনাথকে বললেন," ব্রহ্মচর্য্যের কথা নিজের মুখে কি বলব! কিছুদিন যাক, আয়নায় মুখ দেখলে নিজেই বুঝতে পারবে।"
রঙ্গনাথ মাথা নেড়ে ভেতরবাড়িতে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালো। মামার এই স্বভাবের কথা ও আগে থেকেই জানত। দরজার পাশে রূপ্পনবাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন। রঙ্গনাথকে ফিসফিসিয়ে বললেন," চেহারায় কান্তি আনার জন্যে আজকাল ব্রহ্মচর্য্য লাগে না। ক্রিম-পাউডার লাগালেই কাজ হয়ে যায়।"

0 comments:

0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















(৮)

গোলকপতি বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ওর এই স্বল্পপ্রাণ জীবনের করুণ ইতিহাসটি রাণীমার কাছে বলতে বলতে খানিক ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে আবার নিজেকে তৎক্ষণাৎ সামলে নিতেই বিষণকুমারী এই যুবাটিকে দেখে এবারে যেন নিজেও সামান‍্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন।

তিনি ওকে আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে খুব নীচু স্বরে বললেন যে রাজবাড়ির খাসমহলে নয় ওঁর নিজের মহলেই একটি বিশ্বাসযোগ‍্য লোকের সন্ধানে তিনি চিন্তিত। তাই ও যদি এখন এইধরণের একটা স্থায়ী কাজের ব‍্যবস্থা চায় তাহলে সেটা উনি ভেবে দেখতে পারেন। তবে বেতন হিসাবে কোন তঙ্কা সে পাবেনা। পরিবর্তে তিনি নিজে লেখাপড়া করে দক্ষিণ রায়নার কোন একটি গ্রামে তার থাকার জন‍্য ও চাষযোগ‍্য জমি মিলিয়ে পাঁচ বিঘা জমির বন্দোবস্ত অবশ‍্যই করে দেবেন। এখানে সম্বৎসরে বিঘে চারেক খাস জমির যা ফলন তা একটি বা দুটি পেট চালাতে নেহাত কম হবেনা। আর এই সমস্ত কাজে তার সহায়ক রূপে দুজন বিশ্বাসী কৈবর্ত‍্য মুনিশকেও তিনি তার সাথে দিয়ে দেবেন।

তবে এসবের বিনিময়ে ওকে আড়ত বা রাজবাড়িতে ঘুরে বেড়িয়ে বা যে কোন সূত্রের মাধ‍্যমে রাণীমার বিরোধী সব গোপন ষড়যন্ত্রের খবর জেনে তৎক্ষণাৎ তা রাণীমাকে জানানোর সাথে ও ওঁর খাস খাদ‍্যের মাসিক বাজারটিও করার দায়িত্বটুকুও বর্তাবে।

তবে যেহেতু উনি নিজে একাহারী ও নিরামিষাশী তাই গো- দুগ্ধ ছাড়া আর সব ভোজ‍্যবস্তুই ওকে নিজে মুখে তুলে তারপর রাণীমার মহলে সেটি পাঠানোর ব‍্যবস্থা করতে হবে। খাদ‍্যে বিষপ্রযুক্ত হলে তা রাণীমার আগে তাকেই তা গ্রহণ করে পরিবর্তে রাণীমার জীবনটিও বাঁচাতে হবে।

ইদানীং বাংলায় একদিকে ইংরেজ আর অন‍্যদিকে ওঁর নিজের গর্ভজাত তেজচন্দ্র এরা দুজনেই দুটি পরস্পরবিরোধী ও শত্রুমনস্ক অস্তিত্বের হলেও অন্তত রাণীমাকে গুপ্তহত‍্যার বিষয়ে এরা চরম বৈপরীত‍্যে গিয়ে যথেষ্ট একীভূত হয়ে যেতে যেমন সক্ষম তেমন এই রকম হত‍্যাকল্পে দুটি গোষ্ঠীই বেশ পারদর্শীও বটে। অগত‍্যা ওঁর এই বিশেষ ব‍্যবস্থাটির প্রবর্তন করতে যাওয়া। আজ ওঁর পরলোকগত স্বামী তিলোকচাঁদ বাহাদুর স্বয়ং জীবিত থাকলে এতকিছুর উপদ্রব নাও হতে পারত বলেই তাঁর একান্ত ধারণা।

.....

শহর কলকাতায় এদিকে বেশ শোরগোল শুরু হওয়ার পিছনে যে খানাকুলবাসী তেজোদ্দীপ্ত যুবকটি এবার দায়ী তা নিয়ে আর সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। বিষয়টি বেশ উত্তেজনাপ্রবণ ও সেটি আর সাধারণ কোন্দল বা পরচর্চার মধ‍্যে আর সীমিত নেই।

রামমোহন ও দ্বারকানাথের মত কিছু নব‍্যধনী ও প্রগতিশীল যুবা গত কয়েক বছর ধরে এই শহরে খৃস্টানদের মত দেখাদেখি আর একটি আলাদা দল গড়ে প্রচলিত হিঁদুয়ানির একটা বিরুদ্ধাচরণ করছিলেন। এ শহর এতদিন এসব হুজুগ দেখতে ও চাখতে অভ‍্যস্ত ছিল।কেবল রূপচাঁদ পক্ষীর দলের বিদ্রুপাত্মক খেউড়েই তার নিষ্পত্তিটুকু সবাই মেনে নিলেও এখন আর একটা নতুন বিষয় থেকে এসবের তলে তলে মাথা চাড়া দিচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে।

আর সেটি নিয়েই তামাম শহরে বেজায় গোলমাল শুরু হয়ে গেছে। স্বামীর মৃত‍্যুর পর স্ত্রী সহমরণের মত একটি বিশেষ প্রথা যা তামাম হিন্দুদের একটা গর্বের বিষয় তাকে এবারে খোদ ইংরেজ সরকার রদ করতে উঠে পরে লেগেছেন। এতে এই রামকান্ত রায়ের কনিষ্ঠ সন্তানটির যথেষ্ট হাত আছে বলে শোনা যাচ্ছে। সে নাকি সংস্কৃত, আরবী- ফার্সি এমনকি হিব্রুভাষার মোটা মোটা কেতাব খুলে প্রমাণ করতে চাইছে যে প্রথাটি যে শুধু অমানবিক তাই নয় বরং ভ্রান্ত।

সে নিজে অবশ‍্য পন্ডিত ও বহুভাষাতে পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও মোটেও উদ্ধতস্বভাবের নয়। তার শালপ্রাংশু বাহুযুগল ও বৃষস্কন্ধটির উপর মখমলের আচকান সহ মুসলমানদের মত নৈপূণ‍্যে গৃহিত কাশ্মিরী শালের আবেশটি তার বাবরি ছাঁদের চুল ও ঈষৎ গুম্ফ শোভিত মুখমন্ডলের সাথে একেবারে মানানসই বলে সাধারণের কিঞ্চিৎ সম্ভ্রম আদায় করে থাকে। যদিও এই বাহ‍্যিক গাম্ভীর্যের বাইরে কিন্তু সে কিন্তু একজন রসালাপী যুবক। তার দলের কেউ একজন এসে তাকে তার আসন্ন বিপদের কথাটি জানালে সে সাথে সাথে গোঁফ নাচিয়ে অট্টহাসিতে হেসে বলে ওঠে - " আমায় প্রহার করিতে আসিবে?? বল কী হে বৎস ?? তা সে ব‍্যক্তিটি কয়খান পূর্ণবয়স্ক অজের মাংসাহারে অভ‍্যস্ত..যে আজকাল এত শক্তিধারী হয়েছে ?? "

তবে এ কথা সত‍্যিই যে সে নিজেও একজন ভোজনবিলাসী ও বলশালী যুবক। তার মুখে এই কথাটি শ্রবণে অপরপ্রান্তের বেরাদরটির মুখে কিঞ্চিৎ হাস‍্যের উদ্গম করলেও সে নিজেও জানে গুপ্তিপাড়া থেকে নৈহাটি -ভট্টপল্লী এমনকি সূতানুটির ব্রাক্ষণদের অধিকাংশ রামমোহনের একদা মিত্রস্থানীয় ধনকুবের ও শো'বাজারের জমিদার বাবু রাধাকান্ত দেব বাহাদুর সহ আরো কিছু সমমনোভাবাপন্ন জমিদারদের অর্থেই অন্নপানে অভ‍্যস্ত।

তাই তারা সতীদাহের মত শাস্ত্রীয় প্রথাটির বিরুদ্ধে রামমোহন সহ তার অনুগামীদের সুযোগ পেলে পথেঘাটে বেকায়দায় পেলে এবার থেকে সবলেই প্রতিহত করবে। শোনা যাচ্ছে যে পটলডাঙার কাছে একটি মুক্তপ্রাঙ্গণে তারা একটি জনসমাবেশও আহ্বান করেছে ও তার মাধ‍্যমে রামমোহন বিরোধী সবাই বেশ সরবও হয়েছে। ইংরেজরা বিধর্মী। হিন্দুদের কৌলিক লোকাচার যে বঙ্গদেশে মান‍্য হবে সেটাই স্বাভাবিক। এমনকি এসবের ফলে ইংরেজ বড়লাট বেন্টিঙ্কও যেন বিলেতের আইনসভায় এইবছরে সতীদাহ বিরোধী বিলটিকে আনতে সাহস পেলেন না। যেন এই আইনটি এখুনি পাশ হয়ে গেলে দেশে ইংরেজ বিরোধী একটি অনর্থক ঝড়ের পরিবেশ উদ্ভূত হতে পারে যা তাদের পক্ষেও কোনভাবে এখন কাঙ্খিত নয়।

......

0 comments:

0

গল্প - মনোজ কর

Posted in




















ষষ্ঠ পর্ব

ওয়াটসন এবং ক্লাইভের কলকাতা পুনর্দখল।

মাদ্রাজ কাউন্সিল তখন অপেক্ষা করছিল ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধপরিস্থিতির সংবাদের জন্য। সে সংবাদ অবশ্য এসে পৌঁছেছিল অনেক পরে। এই অপেক্ষার অন্যতম কারণ ছিল যদি ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা খুব শীঘ্র হবার সম্ভাবনা থাকে তাহলে ওয়াটসন এবং ক্লাইভকে দরকার পড়বে করমন্ডল উপকূলে। অবশেষে মাদ্রাজ কাউন্সিলের বৈঠকে ঠিক হল যে সমস্ত খরচের হিসাব রাখার দায়িত্ব থাকবে ক্লাইভের ওপর। মার্লবোরো এবং ওয়ালপোল এই দু’টি বড় জাহাজের জন্য আপাতত ২ লক্ষ টাকা করে ৪ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হল। ক্লাইভকে বলা হল অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজন হলে খরচের সঠিক হিসাব নিকাশ সমেত কলকাতা কাউন্সিল বা মাদ্রাজ কাউন্সিলের কাছে আবেদন জানাতে। টাকার অভাব হবে না। কলকাতা উদ্ধার করতেই হবে। ক্লাইভে সঙ্গে পাঠানো হল দু’টি চিঠি। একটি মাদ্রাজ কাউন্সিলের প্রধানের এবং অন্যটি হায়দ্রাবাদের নিজাম শালাবাত জঙ্গের। এই চিঠি দু’টি সঠিক সময়ে সিরাজের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। সঠিক সময়টি কখন সেটির সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্ব ক্লাইভের উপর দেওয়া হল। এছাড়াও ক্লাইভকে দেওয়া হল তৎকালীন মোগল সম্রাট ফারুখশায়ারের স্বাক্ষর সম্বলিত ফরমানের স্বাক্ষরিত প্রতিলিপি। সঙ্গে দেওয়া হল মোগলরাজের দরবার থেকে বিভিন্ন সুবেদারকে দেওয়া চিঠির প্রতিলিপি যাতে লেখা আছে ব্রিটিশদের যেন দেশের সর্বত্র চুক্তিঅনুযায়ী প্রাপ্য সমস্ত সুযোগ সুবিধা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনওরকম বাধার সৃষ্টি করা না হয়। ক্লাইভের যাত্রা হল শুরু।

যাত্রা শুরু হতে না হতেই সেনাবাহিনীর ভিতর থেকে বাধার সম্মুখীন হতে হল ক্লাইভকে। ৩৯তম রেজিমেন্টের কর্নেল জন আল্ডারক্রন বেঁকে বসল যে সে ক্লাইভের নেতৃত্ব মেনে নেবে না। কারণ ক্লাইভ তার থেকে জুনিয়র এবং ক্লাইভ লেঃ কর্নেলের পদমর্যাদা পেয়েছে মাত্র কিছুদিন আগে। আল্ডারক্রন তার রেজিমেন্টের সেনাদের নিয়ন্ত্রন ক্লাইভের হাতে দিতে চাইল না। শুধু তাই নয় যে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র জাহাজে তোলা হয়েছে সে সমস্ত নামিয়ে নেওয়ার জন্য জেদ করতে লাগল। সরকারি সেনাবাহিনীর একটা অংশ অনেক আগেই কলকাতা চলে গিয়েছিল। কিন্তু তার কারণ ছিল কলকাতার নিরপত্তা জোরদার করা। তখনও সিরাজ কলকাতা দখল করেনি। কিন্তু এখন আল্ডারক্রন ক্লাইভের নিয়ন্ত্রনে সেনাদের ছাড়ার ব্যাপারে বেঁকে বসল। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন অবস্থার সামাল দিলেন এই বলে যে তিনি সরাসরি তাঁর নিজের নেতৃত্বে জল ও স্থলবাহিনীর একটি যৌথ অভিযানের পরিকল্পনা করেছেন। আল্ডাররক্রনের সেনারা একটি অভিযানের অংশহিসাবে যোগ দেবে। সেক্ষেত্রে তাদের নিয়ন্ত্রন ক্লাইভের কাতে থাকবে না। অবশেষে ১৬ই অক্টোবর ,১৭৫৫ এক বিশাল যুদ্ধজাহজের বাহিনী মাদ্রাজ থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

যে সমস্ত জাহাজ এই অভিযানে অংশ নিয়েছিল সেগুলি হল,

কেন্ট – ৬৫ রাজসেনা, ৭৭ কোম্পানি সেনা এবং ৫৯জন সেপাই ও লস্কর।

কাম্বারল্যান্ড- ৯৭ রাজসেনা, ১৫০ কোম্পানি সেনা, ৬৭জন সেপাই ও লস্কর।

টাইগার- ৫৬ রাজসেনা, ১৪৬ কোম্পানি সেনা, ৭০জন সেপাই ও লস্কর।

সালিসবেরি- ৫৮ রাজসেনা, ১৪৭ কোম্পানি সেনা, ৫৭জন সেপাই ও লস্কর।

ব্রিজয়াটার- ৯৬ কোম্পানি সেনা

ওয়ালপোল- ৪১৩ সেপাই ও লস্কর

মার্লবোরো- ৩৬০ সেপাই ও লস্কর

প্রোটেক্টর – ১৩২ সেপাই ও লস্কর

ল্যাপউইং- ৯০ সেপাই ও লস্কর

বোনেটা- ৬০ সেপাই ও লস্কর

এছাড়াও কিছু ছোট দুইমাস্তুল বিশিষ্ট জাহাজ। সব মিলিয়ে ২৭৬ রাজসেনা, ৬১৬ কোম্পানি সেনা এবং ১৩০৮ জন সেপাই ও লস্কর।

যাত্রা শুরু হবার দু-তিনদিনের মধ্যেই খারাপ আবহাওয়ার মুখোমুখি হতে হল এই জাহাজবাহিনীকে। সুতরাং ঘুরপথে তানাসারি এবং আরাকান হয়ে উত্তরে ঝোড়ো হাওয়া এবং নাব্যতাজনিত নানা বাধাবিপত্তির মধ্যে দিয়ে জাহাজবাহিনী এগিয়ে চলল বালাসোরের দিকে। নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনেক দেরি হওয়ার জন্য টান পড়ল খাবার এবং জলের ভাঁড়ারে। ১০ই নভেম্বর অ্যাডমিরাল ওয়াটসন খাবার এবং জলের ওপর নিয়ন্ত্রন শুরু করলেন। দু’দিন পরেই একটি আগুনের সরঞ্জামবাহী একটি জাহাজ ঝড়ের দাপট সহ্য করতে না পেরে শ্রীলঙ্কার পথে পাড়ি দিল। ১৬ই নভেম্বর অস্ত্রবাহী জাহজ মার্লবোরোতে দেখা গেল যান্ত্রিক ত্রুটি। দলছুট জাহাজ মার্লবোরো ত্রুটি সারানোর জন্য চলে গেল মুম্বাই বন্দরের উদ্দেশ্যে। বাকি জাহাজগুলি ১লা ডিসেম্বর এসে পৌঁছলো বালাসোরের কাছে হুগলি নদীর মুখে। হাওয়ার সঙ্গে যুঝতে না পেরে সালিসবেরি এবং কাম্বারল্যান্ড বালাসোরের বেশ কিছু আগে আটকে গেল বালিতে। অনেক চেষ্টায় আবার যাত্রা শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই তীব্র হাওয়ায় কাম্বারল্যান্ড ভেসে গেল ভাইজ্যাগের দিকে। কেন্ট এবং টাইগার হাওয়ার গতিবিধি অনুকুলে আসার জন্য কয়েকদিন অপেক্ষা করে ব্রিটিশ পাইলটদের সহযোগিতায় ৯ই ডিসেম্বর রওনা দিয়ে ১৫ই ডিসেম্বর ফলতা পৌঁছল। কাম্বারল্যান্ড এবং মার্লবোরো ছাড়া সবক’টি জাহাজই ২০শে ডিসেম্বরের মধ্যে এসে গেল। এই দু’টি বড়জাহাজের অনুপস্থিতি অভিযানের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল। প্রায় ২৫০ রাজসেনা এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র আটকে রইল এই জাহাজ দু’টিতে।

অবশেষে নববর্ষের পরেই জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আবার কলকাতা দখল করে নিল ব্রিটিশেরা। ভীতসন্ত্রস্ত মানিকচাঁদ প্রথমদিকে খানিকটা প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও অবশেষে প্রাণের দায়ে পালিয়ে বাঁচল। ফলতা পৌঁছোবার কয়েকদিনের মধ্যেই ক্লাইভ নিজের এবং ওয়াটসনের লেখা দুটি ভয় দেখানো চিঠি এবং তার সঙ্গে মাদ্রাজ থেকে আনা চিঠিগুলি মানিকচাঁদের হাতে দিয়ে সিরাজকে পৌঁছে দেবার কথা বলল। মানিকচাঁদ এই ধরণের দুর্বিনীত ভাষায় লেখা চিঠি নিতে শুধু অস্বীকারই করল না উপরন্তু প্রতিআক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করে দিল। কাম্বারল্যান্ড না পৌঁছোনোর জন্য যে সৈন্যসংখ্যার ঘাটতি ছিল ফলতা থেকে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী এবং ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধপ্রস্তুতির জন্য পূর্বে পাঠানো কয়েকজন সৈন্যকে নিয়ে ২৭শে ডিসেম্বর হুগলী নদীতে রণতরী ভাসিয়ে দিল ক্লাইভ এবং ওয়াটসন । ২৮শে ডিসেম্বর বজবজ থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে মায়াপুরে এসে পৌঁছলো ব্রিটিশ রণতরী। ওয়াটসনের নেতৃত্বে নদীবক্ষ থেকে জলপথে এবং ক্লাইভের নেতৃত্বে স্থলপথে সাঁড়াশি আক্রমণের পরিকল্পনা ব্রিটিশদের।নদীতীর থেকে প্রায় ষোল ঘন্টা অভিযান চালিয়ে স্থলবাহিনী শহরের প্রান্তে এসে পৌঁছল। ক্লান্ত সেনাবাহিনী নিজেরা সুবিধাজনক অবস্থায় আছে ভেবে কোনওরকম সাবধানতা অবলম্বন না করে আক্রমণ শুরু করার আগে একটু নিচু দেখে একটা জায়গায় সকলে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল। কিন্তু একঘন্টার মধ্যেই অতর্কিত আক্রমণে দিশাহারা হয়ে পড়ল ক্লাইভের সৈন্যরা। কলকাতার দক্ষিণদিক থেকে আসা মানিকচাঁদের সৈন্যবাহিনী ব্রিটিশ সেনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পালাবার পথ না পেয়ে পিছু হটতে লাগল ব্রিটিশ সেনারা। কয়েকজন মারা গেল, বেশ কিছু সৈন্য আহত হল। কিন্তু ক্লাইভও যুদ্ধ ছেড়ে পালাবার লোক নয়।কিছুক্ষণের মধ্যেই বেয়নেট হাতে প্রতিআক্রমণে এগিয়ে এল ব্রিটিশ সেনারা। আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলিবর্ষণ করতে করতে এগিয়ে চলল ব্রিটিশ সৈন্যরা। মানিকচাঁদের নেতৃত্বে উল্টোদিক থেকে ছুটে আসা অশ্বারোহী সৈন্যরা গুলিবর্ষণ হচ্ছে দেখে একটু থমকে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মানিকচাঁদের পাগড়ির পাশ দিয়ে প্রায় কান ঘেঁসে উড়ে গেল একটা গোলা। মুহূর্তের মধ্যে মানিকচাঁদের নির্দেশে পিছু হটল সেনাবাহিনী। মানিকচাঁদের ঘোড়া একদৌড়ে এসে থামল কলকাতায়। সেই রাত্রেই দুর্গ দখল করে নিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। এই দুর্গ দখলের পিছনে একটা গল্প আছে। ক্যাপটেন আয়ার কুটের কথা ছিল দুর্গ আক্রমণের। পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাপটেন কুট ক্লাইভের অনুমতির অপেক্ষা করছিল।কিন্তু ক্লাইভের অনুমতি নির্ধারিত সময়ে এসে পৌঁছলো না। প্রায় সন্ধ্যা সাতটার সময় দুর্গের গেট ভেঙ্গে ভেতরে ঢোকার জন্য ক্লাইভের অনুমতি এসে পৌঁছল। প্রস্তুতি নিশ্ছিদ্র এবং পাকাপাকি করার জন্য এই অতিরিক্ত সময় নিয়েছিল ক্লাইভ। সূর্যাস্তের পর অন্ধকার নেমে এলে নিঃশব্দে কেন্ট নামের যুদ্ধজাহাজ থেকে দুটি বড় কামান নামিয়ে আনা হল। কামান দুটি সঙ্গে নিয়ে ২০০ সেপাই এবং ১০০ নৌসেনা সঙ্গে নিয়ে দুটি বড় বাহিনী এগিয়ে চলল দুর্গের দিকে। এই আক্রমণের নেতৃত্বে ছিল ক্যাপটেন কুট। কিন্তু ইতিমধ্যে যুদ্ধজাহাজ থেকে কামান নামানোর সময় একজন নৌসেনা মত্ত অবস্থায় দলছুট হয়ে আগেভাগে দুর্গের দরজায় পৌঁছে কোমরের পিস্তল বের করে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে জয়ধ্বনি দিতে শুরু করে। এইসব শুনে সৈন্যরা ক্যাপটেন কুটকে পিছনে ফেলে রেখে হৈ হৈ করে দুর্গের ভেতর ঢুকে পড়ে। আশ্চর্যজনকভাবে বিনা বাধায় দুর্গ দখল করে নেয় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। ইতিহাসে কিন্তু এই দুর্গ জয়ের নায়ক হিসাবে ক্যাপটেন কুটের নামই লেখা রইল। এদিকে মানিকচাঁদ বজবজ থেকে পালিয়ে এসে মাত্র ৫০০ জন সৈন্যকে আত্মসমর্পণের উপদেশ দিয়ে দুর্গে রেখে হুগলিতে এসে সবাইকে নিজের দুর্গতির কথা জানিয়ে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। ছ’মাস আগে ব্রিটিশ সেনাদের সম্বন্ধে যে অবজ্ঞাজনক কথাবার্তা বলেছিল সেগুলো গিলে নেওয়া করা ছাড়া এই মুহূর্তে আর কিছু করার ছিলনা মানিকচাঁদের। ৩০শে ডিসেম্বর ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বজবজ থেকে তান্না ফোর্টের কাছকাছি একটা জায়গায় নোঙ্গর করে একটাও গুলি খরচ না করে বিনাবাধায় তান্না ফোর্ট দখল করে নিল। যদিও বেশ কয়েকটা কামান রাখা ছিল এদিক ওদিক কিন্তু সেগুলো চালানোর কোনও লোক ছিলনা। মানিকচাঁদের কাছ থেকে ব্রিটিশদের হাতে নাজেহাল হওয়ার খবর পেয়ে আগেভাগেই পাততাড়ি গুটিয়েছে তান্না ফোর্টের রক্ষীবাহিনী।

২রা জানুয়ারি ক্লাইভ হুগলির পূর্বতীরে আলিগড়ে নেমে বিশাল সেনাবাহিনী সঙ্গে করে কলকাতার দিকে রওনা হয়ে গেল। সকাল ন’টা নাগাদ যুদ্ধজাহাজ কেন্ট এবং টাইগার প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই করে ফোর্ট উইলিয়মের ঘাটে নোঙ্গর করল। হাওয়ার গতিবিধির সমস্যার জন্য সঠিক অবস্থানে নোঙ্গর করতে অসুবিধা হচ্ছিল নাবিকদের। এই সুযোগে হুগলি নদীতে টহলরত সিরাজের সৈন্যরা গোলা ছুঁড়ে কেন্ট-এর ৯জন এবং টাইগারের ৭ জন সৈন্যকে খতম করে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্রিটিশ রণতরী থেকে ছুটে আসা ঝাঁকে ঝাঁকে গোলা ধ্বংস করে দিল সিরাজের রণতরীগুলো। ১১টার কিছু আগে নবাবের সেনাবাহিনীর একজনও রইল না দুর্গে তথা কলকাতায়। ব্যান্ড বিউগিল সহযোগে ব্রিটিশ পতাকা উড়িয়ে দুর্গ বিজয় ঘোষণা করল লর্ড ক্লাইভ। পরের দিন ড্রেক এবং কাউন্সিলের পুরনো সদস্যদের ডেকে তাদের হাতে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দিল অ্যাডমিরাল ওয়াটসন। একসপ্তাহের মধ্যে হুগলি আক্রমণ করে সিরাজের অবশিষ্ট সেনাঘাঁটিগুলো ধ্বংস করে ক্লাইভ। কলকাতা এবং কলকাতার পার্শ্ববর্তী সমস্ত এলাকা নবাবের সেনাদের হাত থেকে মুক্ত করে অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করল ক্লাইভ এবং ওয়াটসন । পরের কাজের দায়িত্ব পুনর্গঠিত কলকাতা কাউন্সিলের।

0 comments: