0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in

 




অধ্যায়-৪


খানকয়েক কুঁড়েঘর, তার চেয়েও খারাপ অবস্থার গোটাকয় দোকান, তহসীল অফিস, থানা, তাড়ির দোকান, ব্লক অফিস, মদের দোকান, কলেজ--- ব্যস্‌, পথচলতি কারো চোখে এইটুকুই ধরা দেবে। একটু এগিয়ে গেলে একটা আমের বাগান--- বেশ ঘন, তাতে একটা কাঁচা ঘর, রাস্তার দিকে পিট,। আর কবাটহীন দরজাটার মুখ জঙ্গলের দিকে।
বৃষ্টির দিনে রাখালের দল গাছের ছায়া ছেড়ে ঘরটার মধ্যে ঢুকে জুয়ো খেলে, বাকি দিন এটা খালিই পড়ে থাকে। কিন্তু খালি থাকলেও লোকজন খালি থাকতে দেয় না যে! মেয়ে-পুরুষেরা সময় সুযোগ বুঝে একে নানা ভাবে ব্যবহার করে থাকে।
শিবপালগঞ্জে এই ঘরটার যা প্রচলিত নাম সেটা শুনলে হেনরি মিলারও ব্যোমকে যাবেন। কলেজের এক মাস্টার তাতে খানিকটে জল মিশিয়ে নাম দিয়েছেন-'প্রেম-ভবন'।
কুঁড়েঘর আর প্রেম-ভবনের মাঝখান দিয়ে চলা সড়কের এ'পাশটা শিবপালগঞ্জের শুধু একটা কোণাকে ছুঁয়েছে। আসল শিবপালগঞ্জ রাস্তার ওপারে। আসল শিবপালগঞ্জকে পাওয়া যাবে বৈদ্যজীর বৈঠকখানায়।
বৈঠকখানার হদিস পেতে হলে একটু গলিঘুঁজির মধ্যে ঢুকতে হবে। দুপাশে খাপরায় ছাওয়া এলোমেলো-ধ্যাবড়া গোছের ঘরবাড়ি। বাড়ির বাইরের রোয়াকগুলো গলা বাড়িয়ে গলির মধ্যে মৌরসীপাট্টা নিয়ে বসেছে। দেখলেই এদের ফিলজফিটা বোঝা যায়--নিজের চৌহদ্দির আশেপাশে খালি জায়গা দেখলেই অন্যের চোখ এড়িয়ে কব্জা কর।

এই সবুজে সবুজে ছাওয়া এলাকায় খোলা মাঠের মধ্যে একটি বাড়ি একটা কোণ আটকে এমন ভাবে গড়ে উঠেছে যে ওদিকে আর এগিয়ে যাওয়া মুশকিল। ওটি বৈদ্যজীর বাড়ি। বৈদ্যভবনের সামনের দিকটা পাকা আর গেঁয়ো স্টাইলে বেশ সম্ভ্রম জাগানো, কিন্তু পেছনের দিকে কাঁচা দেয়াল আর তার পিছে প্রাতঃকৃত্য হয়, তাই কিছু নোংরা পড়ে থাকে। যেমন ঝিলিমিলি এয়ারপোর্ট আর লকলক হোটেলের সারি দিয়ে এদেশের 'সিম্বলিক মডার্নাইজেশন' মাপা হয়, তেমনি এর প্রভাব এই দেহাতি বাড়িটার আর্কিটেকচারেও দেখা যাচ্ছে।এর থেকে প্রমাণিত হয় যে দিল্লি হোক কি শিবপালগঞ্জ, কাজের ক্ষেত্রে দেশি বুদ্ধি সর্বত্র এক।
বাড়িটার সামনের ভাগ, যাতে বাঁধানো রোয়াক, বারান্দা আর একটা বড় কামরা রয়েছে, বৈঠকখানা নামে প্রখ্যাত। ইঁট-বালি মাথায় করে বয়ে নিয়ে যাওয়া মজদূরও জানে যে বৈঠকখানার মানে শুধু ইঁট-চূণ-সুরকির তৈরি বাড়িটা নয়। ১০ নং ডাউনিং স্ট্রীট, হোয়াইট হাউস, ক্রেমলিন -এসব বাড়ির নাম না, ক্ষমতার নাম।

থানার থেকে ফিরে এসে রূপ্পনবাবু দেজ্খতে পেলেন - দরবার-এ-আম, অর্থাৎ,বারান্দায় খুব ভীড় জমেছে ,অমনি চলার গতি বেড়ে গেল। পরনের ধূতি ফড়ফড় করতে লাগল।
বৈঠকে ঢুকতেই উনি জানতে পারলেন যে ওনার মামাতো ভাই রঙ্গনাথ শহর থেকে ট্রাকে চড়ে এসেছে; কিন্তু রাস্তায় ড্রাইভার ওর থেকে দু' টাকা উসুল করেছে।

একটা রোগাভোগা লোক ময়লা গেঞ্জি আর ডোরাকাটা আন্ডারওয়ার পরে এই নভেম্বর বিকেলের শীত-শীত আবহাওয়ার মধ্যেও দিব্যি খুশি-খুশি বসে আছে।
ওর নাম হল মঙ্গল, কিন্তু লোকে ডাকে শনিচর বলে। চুলে পাক ধরেছে, সামনের দাঁত ক'টা পড়ে গেছে।ওর পেশা বলতে বৈদ্যজীর বৈঠকে বসে থাকা। ও সাধারণতঃ শুধু আন্ডারওয়ার পরেই থাকে, আজ গায়ে গেঞ্জি উঠেছে দেখে রূপ্পনবাবু বুঝে গেলেন যে শনিচর "ফর্ম্যাল" হতে চাইছে। ও রূপ্পনবাবুকে একশ্বাসে রঙ্গনাথের সমস্যাটা বলে দিয়ে নিজের নগ্ন উরূতে তবলার কিছু কঠিন বোল বাজিয়ে উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, " আজ বদ্রীভাইয়া এখানে থাকলে কিছু একটা হয়ে যেত।"
রূপ্পনবাবু রঙ্গনাথকে বল্লেন--" তুমি ঠিক করেছ, রঙ্গনাথদাদা। দু'টাকা দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে দিলে। কথায় কথায় খুন-খারাপি উচিৎ নয়।"
রূপ্পনবাবুর সঙ্গে রঙ্গনাথের দেখা হল প্রায় দেড় বছর পরে। রূপ্পনবাবুর সিরিয়াস ভাবটাই ওর কাছে সারাদিনের সবচেয়ে মজার ব্যাপার ধরে নিয়ে ও বলল, " আমি তো মারামারি করতেই যাচ্ছিলাম, কি ভেবে সরে এলাম।"
রূপ্পনবাবু মারপিটের বিশেষজ্ঞ হওয়ার ভঙ্গিতে হাত তুলে বল্লেন-- তুমি ঠিক করেছ। এইসব ঝগড়া-ঝাঁটিতে ইস্টুডেন্ট কমিউনিটির বদনাম হয়।
রঙ্গনাথ এবার ওকে ভাল করে চেয়ে দেখলো। কাঁধের ওপর ধুতির কোঁচা,একটু আগে মুখে পোরা পান, চুলে কয়েক লিটার তেল-স্থানীয় গুন্ডাগিরির যেকোন স্ট্যান্ডার্ডে একদম প্রথমসারির বলে মনে হবে। রঙ্গনাথ কথা পাল্টানোর চেষ্টায় বলল," বদ্রীদাদাকে দেখছি না! উনি কোথায়?"
শনিচর আন্ডারওয়ার ঝাড়তে লাগল, যেন কয়েকটা পিঁপড়েকে ঘরছাড়া করবে। ভুরু কুঁচকে বলল, " আমিও বদ্রীভাইয়ার কথাই ভাবছিলাম। আজ ও থাকলে এতক্ষণে তো--"।
রঙ্গনাথ ওর কথায় কান না দিয়ে রূপ্পনবাবুকে বলল," বদ্রীদাদা এখন কোথায়?"
রূপ্পনবাবু একটু কড়া ভাবে জবাব দিলেন-- শনিচর বলল তো! আমায় বলে যায় নি। হয়তো বাইরে গিয়েছেন। এসে যাবেন। কাল হোক, পরশু হোক বা তরশু--ঠিক এসে যাবেন।"
ওনার কথার ভাবে বোঝা মুশকিল যে বদ্রী ওনার আপন বড়ভাই, ওনার সাথে এক ঘরেই থাকেন। রঙ্গনাথ জোরে শ্বাস টানল।
শনিচর বসে বসেই পা টা লম্বা করল। তারপর শরীরের যে অংশ থেকে বাঁ-পাটা বেরিয়েছে ঠিক সেখানে চামড়ার একটা টুকরোয় চিমটি কেটে চেপে ধরল। ওর চোখ তৃপ্তিতে বুজে গেল। একটু পরে চিমটির জায়গাটায় আস্তে আস্তে হাত বোলাতে বোলাতে ও নেকড়ের মত মুখব্যাদান করে হাই তুলল। তারপর ঝিমধরা স্বরে বলল, "রঙ্গনাথ ভাইয়া শহর থেকে এসেছেন, ওনাকে আর কি বলব? কিন্তু কেউ কোন 'গঞ্জহা'র থেকে দুটাকা তো দূর, একটা কড়ি কেড়ে নিয়ে দেখাক তো?"
'গঞ্জহা' শব্দটা রঙ্গনাথের অপরিচিত নয়;মানে,গঞ্জ অর্থাৎ শিবপালগঞ্জের নিবাসী।এটা একটা টেকনিক্যাল শব্দ যেটাকে শিবপালগঞ্জের অধিবাসী বেশ সম্মানসূচক টাইটেলের মতন ব্যবহার করে থাকে। আশপাশের গাঁয়ের অনেক 'শান্তির পূজারী'ও কখনো কখনো নীচু গলায় পরামর্শ দেন-তুমি ওর সঙ্গে লাগতে যেয়ো না। জান না তো, ও শালা একজন 'গঞ্জহা'।

বৈঠকখানার মেজেতে একটি চোদ্দ-পনের বছরের ছেলেও বসে ছিল। দেখলেই বোঝা যায় যে ও সরকারের শিক্ষা-প্রসারের ফাঁদে পা দেয় নি। শনিচরের কথা শুনে বেশ দম্ভের সঙ্গে বলে উঠলো-" শহুরে ছেলেরা বড্ড সিধেসাদা আর সরল । কেউ আমার কাছে টাকা চেয়ে দেখুক তো---" বলে ও হাতটা হাওয়ায় এমন করে ঘোরাতে লাগলো যেন লরিতে একটা বড় হ্যান্ডল লাগিয়ে প্রাণপণে স্টার্ট করতে চাইছে।সবাই হেসে উঠল, কিন্তু রূপ্পনবাবু আরো গম্ভীর।
উনি রঙ্গনাথকে জিগ্যেস করলেন," তুমি ড্রাইভারকে টাকাটা নিজের থেকে দিলে কি ও ধমকে-ধামকে নিয়ে নিল?"
রঙ্গনাথ প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, "আজকাল তুমি কোন ক্লাসে পড়ছ, রূপ্পন?"
প্রশ্নটা যে পছন্দ হয় নি, সেটা ওনার চেহারায় স্পষ্ট।
-" ক্লাস টেন এ। তুমি বলবে সে তো দু'বছর আগেও পড়ছিলে। কি করব, আমি তো শিবপালগঞ্জে এই ক্লাস টেন থেকে বেরোনোর রাস্তাটাই খুঁজে পাচ্ছিনে। তুমি জান না দাদা, এ দেশের শিক্ষাপদ্ধতি বিলকুল বেকার। বড় বড় নেতারা বলছেন। আমিও সহমত। তারপর ধর এই কলেজের হাল-হকিকত, সেসব তো তুমি কিছুই জান না। যত লুচ্চা ছ্যাঁচড়ের আড্ডা হয়েছে।মাস্টারের দল পড়ানো-টরানো ছেড়ে খালি পলিটিক্স করছে। দিন রাত পিতাজীকে তিতি-বিরক্ত করে ছাড়ছে। খালি এটা করো, সেটা করো, মাইনে বাড়াও, আমার ঘাড়ে তেল মালিশ করো। এখানে কেউ পাশ করতে পারে?
আছে, কিছু নির্লজ্জ ছেলেপুলে আছে, যারা কখনো কখনো পরীক্ষায় পাশ হয়ে যায়, কিন্তু তাতে---"।
কামরাটার ভেতরে বৈদ্যজী রোগীদের ওষুধ দিচ্ছিলেন। আচমকা ওখান থেকেই বল্লেন," শান্ত হও রূপ্পন! এই কু-ব্যবস্থা শীঘ্র সমাপ্ত হবে।"
যেন আকাশবাণী হল," শান্ত হও বসুদেব! কংসের বিনাশকারী ধরাধামে অবতরিত হল বলে।" রূপ্পনবাবু শান্ত হয়ে গেলেন। রঙ্গনাথ ভেতরের কামরার দিকে ঘুরে চেঁচিয়ে বলল, " মামাজী, এই কলেজটার সঙ্গে আপনার কিসের সম্পর্ক?"
" সম্পর্ক"? কামরার ভেতর থেকে বৈদ্যজীর হাসির প্রতিধ্বনি শোনা গেল।" তুমি জানতে চাইছ এই কলেজের সঙ্গে মামার কিসের সম্পর্ক? রূপ্পন, রঙ্গনাথের কৌতূহল নিবারণ কর।"
রূপ্পন বড় বিজনেসম্যানের ঢঙে বলল," পিতাজী কলেজের ম্যানেজার। মাস্টারদের কলেজে ঢোকা-বেরনো সব এনার হাতে।"
রঙ্গনাথের চেহারায় এই কথাটার প্রভাব দেখে আরো বলল," এমন ম্যানেজার পুরো তল্লাটে পাওয়া যাবে না। ভালর জন্যে ভাল, আর হারামীর জন্যে খানদানী হারামী।"
রঙ্গনাথ এই নতুন খবরটা চুপচাপ হজম করল। তারপর কিছু বলতে হবে বলে বলল," তাহলে কো-অপারেটিভ ইউনিয়নের কি হবে? মামাজী ওটারও কিছু ছিলেন না?"
" ছিলেন না, আছেন।" রূপ্পনবাবু একটু চড়া সুরে বল্লেন," উনি ম্যানেজিং ডায়রেক্টর ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।"

বৈদ্যজী ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।
ইংরেজ- শাসনের যুগে উনি ইংরেজদের প্রতি শ্রদ্ধাবনত ছিলেন। দেশি সরকার এলে দেশি শাসকদের প্রতি। উনি অনেকদিনের দেশসেবক। বিগত মহাযুদ্ধের সময় , যখন এই দেশ জাপানী আক্রমণের ভয়ে কাঁপছিল, তখন উনি ফার-ইস্টে লড়ার জন্যে অনেক সেপাই রিক্রুট করিয়েছিলেন। আজকাল দরকার পড়লে নিজের রাজনৈতিক ফ্যাকশনে রাতারাতি অনেক সদস্য ভর্তি করাতে পারেন। আগেও উনি নানাভাবে জনগণের সেবা করেছেন--- যেমন জজের এজলাসে জুরির সদস্য এবং 'অ্যাসেসর' হওয়া, দেওয়ানি মোকদ্দমায় সম্পত্তির রিসিভার হওয়া। ইদানীং উনি কো-অপারেটিভ ইউনিয়নের ম্যানেজিং ডায়রেক্টর এবং কলেজের ম্যানেজার।
গল্পটা হল উনি এই সব পোস্টে কাজ করতে চান না, কেন না ওনার পদের লালসা নেই। কিন্তু এ'তল্লাটে এইসব দায়িত্বপূর্ণ পদে সাহস করে দায়িত্ব নেবে-এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। আর এলাকার যত নব্যযুবক? সবগুলো গোটা দেশের নব্যযুবকদের মতই অকম্মার ঢেঁকি। তাই নিতান্ত বাধ্য হয়ে ওনাকে এই বৃদ্ধবয়সেও এই সব দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে।
বৃদ্ধবয়স! বৈদ্যজীর জন্যে এই শব্দটি মাত্র পাটিগণিতের ফাঁদে পড়ে করতে হল। কর গুনলে ওনার বয়েস বাষট্টি ছাড়িয়েছে। কিন্তু রাজধানীতে থেকে দেশসেবায় রত অগুনতি মহাপুরুষদের মত ওনারও বয়স বেড়েছে, উনি বুড়ো হন নি।
ওই মহাপুরুষদের মত উনিও পণ করেছেন যেদিন মরবেন সেদিনই বুড়ো হবেন, তার আগে নয়। আর সেদিনই মরবেন যেদিন লোকে বিশ্বাস করিয়ে ছাড়বে যে সত্যি সত্যি মরে গেছেন। তার আগে নিজেকে জীবিত ধরে নিয়ে দেশসেবা করেই যাবেন।

সমস্ত বড় পলিটিশিয়ানদের মত উনি পলিটিক্সের মা-মাসি করে থাকেন এবং পলিটিশিয়ানদের নিয়ে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েন না। গান্ধীজির মত উনিও নিজের রাজনৈতিক দলে কোন পোস্ট নেন নি, কারণ উনি দলের মধ্যে তরুণদের উৎসাহ দিতে চান। কিন্তু কো-অপারেটিভ আর কলেজের ব্যাপারে লোকেরা ওনাকে চাপ দিয়ে বাধ্য করল আর উনি সেই চাপ মেনে নিলেন।
বৈদ্যজীর একটি পেশা হল কবরেজি। এই পেশায় দুটো ফর্মূলা ওনার একেবারে ঠোঁটের ডগায়; একটা হল ' গরীবের দাতব্য চিকিৎসা ' আর অন্যটা ' রোগ না সারলে পয়সা ফেরৎ'। এই দুই ফর্মূলায় রোগীদের কতটা আরাম হয় তা বলা বাহুল্য, কিন্তু বৈদ্যজী যথেষ্ট আরাম পাচ্ছেন।
উনি সমস্ত রোগকে দু'ভাগে ভাগ করেছেন,-- প্রকট রোগ আর গুপ্ত রোগ। প্রকট রোগের চিকিৎসা প্রকট ভাবে হয় আর গুপ্ত রোগের চিকিৎসা গুপ্ত ভাবে। সমস্ত রোগের জন্যে ওনার একটাই থিওরি---সব রোগের মূল কারণ ব্রহ্মচর্য্যের ক্ষয়। কলেজের ছেলেদের কান্তিহীন, শিড়িঙ্গে চেহারা দেখলে প্রায়ই উনি এই থিওরি ঝাড়তে থাকেন । কেউ যদি বলে যে ছেলেদের অপুষ্টির কারণ গরীবি এবং ঠিকমত খেতে না পাওয়া তো উনি ধরে নেন যে ব্যাটা আসলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্রহ্মচর্য্যের গুরুত্বকে ছোট করে দেখছে। আর কে না জানে যে কেবল চরিত্রহীনেরাই ব্রহ্মচর্য্যের গুরুত্ব মানে না। দারিদ্র ও আধপেটা খাওয়ার কথা যে তুলবে সেই চরিত্রহীন।

ব্রহ্মচর্য ক্ষয়ের ফলাফল নিয়ে উনি বেশ ভয়-জাগানো লেকচার দিয়ে থাকেন। সক্রেটিস, সম্ভবতঃ ওনাকে কি অন্য কাউকে, বলেছিলেন যে জীবনে তিনের পর চতুর্থবার ব্রহ্মচর্য ক্ষয় করার আগে নিজের কবর খুঁড়ে নেয়া ভাল। এই ইন্টারভিউয়ের উনি এমন ছবির মত বর্ণনা করেন যে লোকে ভাবে সক্রেটিস ব্রহ্মচর্যের ব্যাপারে আজও ওনার অবৈতনিক কন্সালট্যান্ট। ওনার মতে ব্রহ্মচর্য নষ্ট করার সবচেয়ে বড় ক্ষতি হল লোকে পরে চাইলেও নষ্ট করতে পারে না। সংক্ষেপে, ব্রহ্মচর্য নষ্ট করতে হলে আগে ব্রহ্মচর্যকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার।
ওনার এইসব লেকচার শুনে কলেজের তিন-চতুর্থাংশ ছেলে জীবনের প্রতি হতাশ হয়ে গেছল। কিন্তু ওরা যে একসাথে আত্মহত্যা করেনি তার কারণ বৈদ্যজীর ঔষধালয়ের একটি বিজ্ঞাপনঃ
" হতাশ নবযুবকদের জন্যে আশার বার্তা"।
এই 'আশা' যদি কোন মেয়ের নাম হত তাহলেও ছেলের দল এতটা উৎসাহিত হত না। কিন্তু ওরা জানে যে এই আশার বার্তা আসছে একটি 'গুলি' থেকে , যেটা দেখতে ছাগলের নাদির মত, কিন্তু পেটে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে শিরায় শিরায় নাচে রক্তধারা।

একদিন বৈদ্যজী রঙ্গনাথকে চেপে ধরে ব্রহ্মচর্য্যের গুণ বোঝাতে শুরু করলেন। উনি এক উদ্ভট বায়োলজি আওড়ালেন যার হিসেবে কয়েক মণ খাবার খেলে কয়েক ছটাক রস তৈরি হয়। তারপর রস থেকে রক্ত, রক্ত থেকে আরো কিছু, এই ভাবে চলতে চলতে শেষে গিয়ে এক ফোঁটা বীর্য তৈরি হয়। উনি প্রমাণ করে ছাড়লেন যে এক ফোঁটা বীর্য বানাতে যা খরচ হয় সেটা একটা অ্যাটম বোমা বানানোর খরচকেও ছাড়িয়ে যায়। রঙ্গনাথের বোধোদয় হল যে এ পোড়ার দেশে অমূল্য কিছু রয়েছে তো তা হল বীর্য। উনি বললেন যে বীর্যের অনেক শত্রু, সবাই চায় অন্যের বীর্য লুঠ করতে। কোন রকমে যদি তোমার বীর্য রক্ষা করতে পারো, তো ধরে নাও যে তোমার চরিত্র বেঁচে গেল।
বোঝা গেল যে আগে হিন্দুস্থানে বীর্যরক্ষার ওপর খুব জোর দেয়া হত। একদিকে ঘি-দুধের নদী বয়ে যেত, তো অন্যদিকে বীর্যের। লেকচারের শেষে উনি একটি সংস্কৃত শ্লোক শোনালেন যার অর্থ হল -- এক ফোঁটা বীর্যের পতন হলে মানুষ মরে যায়, কিন্তু এক ফোঁটা তুলে নিতে পারলে জীবন ফিরে পায়।
সংস্কৃত কানে যেতেই শনিচর হাতজোড় করে বলে উঠলো---" জয় ভগবান কী!"
ও মাথা নুইয়ে মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে শ্রদ্ধা ও আবেগের বশে নিজের পশ্চাৎদেশকে প্রায় ছাতের দিকে উঁচু করে তুলল। বৈদ্যজী আরো বার খেয়ে রঙ্গনাথকে বললেন," ব্রহ্মচর্য্যের কথা নিজের মুখে কি বলব! কিছুদিন যাক, আয়নায় মুখ দেখলে নিজেই বুঝতে পারবে।"
রঙ্গনাথ মাথা নেড়ে ভেতরবাড়িতে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালো। মামার এই স্বভাবের কথা ও আগে থেকেই জানত। দরজার পাশে রূপ্পনবাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন। রঙ্গনাথকে ফিসফিসিয়ে বললেন," চেহারায় কান্তি আনার জন্যে আজকাল ব্রহ্মচর্য্য লাগে না। ক্রিম-পাউডার লাগালেই কাজ হয়ে যায়।"

0 comments: