0

প্রবন্ধ - দিলীপ মজুমদার

Posted in






স্যর মুহাম্মদ ইকবাল ( ১৮৭৭-১৯৩৮) । বা, আল্লামা ইকবাল । পঞ্জাব প্রদেশের এক কাশ্মীরী পণ্ডিত বংশে জন্ম । কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্টস ডিগ্রি আর জার্মানির লুডভিগ ম্যাক্সিমিলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন পি এইচ ডি ডিগ্রি । তিনি ব্যারিস্টারি করতেন , দর্শনচর্চা করতেন।কিন্তু তাঁর বড় পরিচয় তিনি কবি । তাঁর চিন্তা-ভাবনা প্রভাবিত হয়েছিল সুফি কবি জালালউদ্দিন রুমির কাব্য-দর্শনের দ্বারা । রবীন্দ্রনাথ ও ইকবাল প্রায় সমসাময়িক । এক দেশের মানুষ । তবু তাঁদের মধ্যে গড়ে ওঠে নি কোন যোগাযোগ । যেমন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে নি বেগম রোকেয়ার (১৮৮০-১৯৩২) ।

ইকবালের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগের যে একটা ক্ষীণ যোগসূত্র পাওয়া যায় , যে কথা আমরা এই নিবন্ধে আলোচনা করব , তা কিন্তু বেগম রোকেয়ার ক্ষেত্রে নেই । সেই পর্যালোচনা করে পূরবী বসু লিখেছেন একটি বই –‘রবীন্দ্রনাথ ও বেগম রোকেয়া : কাছে থেকেও দূরে ।‘ বেগম রোকেয়ার কর্মক্ষেত্র ছিল কলকাতায় , তবু রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে কেন নীরব রইলেন তিনি , রবীন্দ্রনাথেরও নীরবতা কেন , তা বোঝা যায় না । আমাদের বন্ধু সাংবাদিক অনল আবেদিন এবং তাঁর মতো আরও কিছু মানুষ রবীন্দ্রনাথ ও বেগম রোকেয়ার যোগাযোগহীনতার রহস্য উন্মোচনের কথা বলেন । কিন্তু তথ্যের অসদ্ভাবে তা বোধহয় সম্ভব হবে না ।

ইকবাল ও রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গে ফিরে আসি । দুজনেই কবি । তবে কবি-স্বভাবের পার্থক্য আছে । রফিক জাকারিয়া তাঁদের কবি-স্বভাবের পার্থক্য নির্ণয় করে বলেছেন যে রবীন্দ্রনাথে আছে কমনীয় সৌন্দর্য , আর ইকবালে আছে পৌরুষের দৃপ্ততা । রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে সংগীতের সুর , আর ইকবালে আছে আগুনের তপ্ততা [ “ Tagore brought out romantic in man ; Iqbal the heroic . Tagore exulted in feminine beauty ; Iqbal in masculine strength . There was music in Tagore’s poetry; there was fire in Iqba’s . Tagore was humble ; Iqbal was proud . Tagore was always active ; Iqbal easy going and lazy . “

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ইকবালের সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে ইকবালের আদ্যন্ত নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা দেখা যায় । রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাঁর চেয়ে একটু বেশি সক্রিয় । আমির বাট [ Aamir Butt] তাঁর ‘ Tagore and Iqbal : Views ‘ [ Tagore – animikh Rabindranath –World Press 12 Janury, 2012 ] প্রবন্ধে বলেছেন যে রবীন্দ্রনাথ লাহোরে গেলে ইকবালের মেয়ো রোডের বাসভবনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন । ইকবাল তখন ভাগলপুরে গিয়েছিলেন বলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় নি । ইকবাল ভাগলপুর থেকে ফিরে এসে রবীন্দ্রনাথের আগমন সংবাদ শুনেও নীরব ছিলেন , যোগাযোগের চেষ্টা করেন নি। মহম্মদ ইক্রাম চুঘাটি [ Muhammad Ikram Chughati ] পাকিস্তানের ইকবাল বিশেষজ্ঞ , উর্দু সায়েন্স বোর্ডের ডাইরেক্টর । তিনি তাঁর বই ‘ Iqbal and Tagore’ -এ বলেছেন যে ইকবাল নোবেল পুরস্কারের ব্যাপারে ক্ষুব্ধ ছিলেন । তাই তিনি রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে নীরব ছিলেন, যোগাযোগের চেষ্টা করেন নি ।

১৯৩৭ সালে লাহোরে মুসলিম ব্রাদারহুডের উদ্যোগে যে ইকবাল দিবস পালন করা হয় , তাতে রবীন্দ্রনাথ যে বাণী পাঠান তা হল :

--” স্যার মহম্মদ ইকবালের কবিত্বের প্রতি সমগ্র ভারতের শ্রদ্ধা নিবেদনে আপনাদের সহিত আন্তরিকভাবে যোগদান করিতেছি । উর্দু ভাষায় অনভিজ্ঞতার দরুন আমি তাঁহার রচিত প্রাঞ্জল মৌলিক রচনা পাঠের আনন্দ হইতে বঞ্চিত । এজন্য আমি সততই দুঃখ অনুভব করিয়া থাকি । দীর্ঘকাল জীবিত থাকিয়া তিনি দেশের সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করুন , এই প্রার্থনা করি । “ [আনন্দবাজার পত্রিকা , ১৬ ডিসেম্বর , ১৯৩৭ ] ।

রবীন্দ্রনাথ যখন এই বাণী পাঠাচ্ছেন , তখন ইকবাল জীবিত । কিন্তু তাঁর কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল , তা জানা যায় না । ইকবালের মৃত্যুর পরে ১৯৩৮ সালের ২১ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথ নিম্ন শোকবার্তা পাঠিয়েছিলেন :

--” ইকবালের মৃত্যুতে আমাদের সাহিত্যক্ষেত্রে যে স্থান শূন্য হইল তাহা পূরণ হইতে দীর্ঘকাল লাগিবে। আমাদের সাহিত্য জীবনে ইহা একটি মারাত্মক আঘাত । জগতে আজ ভারতের স্থান অতি সংকীর্ণ ; এই সময়ে ইকবালের মতো একজন কবিকে হারানো তাহার পক্ষে খুবই কষ্টের কথা। কারণ ইকবালের কবিতার একটা বিশ্বজনীন মূল্য ছিল । “ [আনন্দবাজার পত্রিকা , ২২ এপ্রিল , ১৯৩৮ ] ।

ইকবালের কবিতায় বিশ্বজনীন মূল্যের কথা স্বীকার করছেন রবীন্দ্রনাথ । কথাটা সত্য । কিন্তু তাই যদি হয়, তাহলে ইকবাল কেন নোবেল পুরস্কার পেলেন না ? ইকবালের পক্ষ নিয়ে এর আলোচনা করেছেন মিলি গেজেট [ Millie Gazette] ‘ Why wasn’t Iqbal awarded a Nobel’ প্রবন্ধে । তিনি প্রকারান্তরে বলতে চেয়েছেন যে হাফিজের ভাব অপহরণ করেই ‘গীতাঞ্জলি’র কবিতাগুলির উদ্ভব –” While Tagore almost plagiarized Hafiz in his 103 poems in Gitanjali, that won him 1913’s Nobel, Iqbal’s inspiration was devoid of pilfering . “

আবার কেউ কেউ এমনও বলেছেন যে রবীন্দ্রনাথকে নোবেল দেওয়ার পেছনে রাজনীতি আছে।মুসলমানদের অবজ্ঞা করার জন্য ‘হিন্দু’ রবীন্দ্রনাথকে বেছে নিয়েছেন নোবেল পুরস্কারের কর্তারা । তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের পরিবারের সঙ্গে ইংরেজদের দহরম-মহরম ছিল ---” The reasons behind overlooking Iqbal were more political than the perceived lack of profundity , Tagore’s family hobnobbed with the high-ranking English officials and he ( Tagore) had influenced English friends . Though Tagore belonged to Brahmo Samaj , a subdivision of Hinduism , he was viewed by the Brits a ‘refined Upper Class Hindu’ ( Nirad C Chaudhary’s words) and they wanted to project a ‘Hindu’ above a Muslim . “ ( ‘Why wasn’t Iqbal awarded a Nobel’ )

সমস্ত পুরস্কারের পেছনে যে রাজনীতি থাকে , সে ব্যাপারে আমাদের সন্দেহ নেই। দ্বারকানাথ থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে বহু সম্ভ্রান্ত ইংরেজের সঙ্গে যোগাযোগও প্রমাণিত সত্য । কিন্তু ইকবালকে বঞ্চিত করে রবীন্দ্রনাথকে নোবেল দেওয়া হয়েছে তা কি মুসলিম জগত বিশ্বাস করে?  তা যদি হবে , তাহলে ১৯৩২ সালে ইরানের রাজা রবীন্দ্রনাথকে কেন এমন উষ্ম সংবর্ধনা দেন, কেন তেহেরানে তাঁকে নিয়ে মেতে ওঠে মানুষ ? কেনই বা বাগদাদ রাজা নিজে এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা করেন রবীন্দ্রনাথকে ? আমরা অনুমান করতে পারি মুসলিম জগতে রবীন্দ্রনাথের বিপুল সংবর্ধনা কবি ইকবালকে ক্ষুব্ধ করেছিল। এ ব্যাপারে ইকবালের অনুরাগীদের কিছু ভূমিকা থাকা বিচিত্র নয় । তাঁরা ইকবালের অন্তর্নিহিত ক্ষোভে অগ্নিসঞ্চার করেছিলেন হয়তো ; যেমন রবীন্দ্রনাথের তথাকথিত ভক্তরা আধুনিক কবিদের সম্বন্ধে , নজরুল সম্বন্ধে তাতিয়ে তোলবার চেষ্টা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে । 
[লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক ]

0 comments: