3

সম্পাদকীয়

Posted in







কী আশ্চর্য অতীন্দ্রিয় সমাপতন! ১৬ জুলাই ১৯৪৫ আর ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩ এক 'বৈবাহিক' সম্পর্কে জুড়ে যাওয়া যেন শুধু সময়ের অপেক্ষা। আটাত্তর বছর আগের জুলাই মাসের ওই দিনটিতে নিউ মেক্সিকোর মরুপ্রদেশে একইসঙ্গে নির্মিত হয়েছিল অসামান্য বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির এক শৃঙ্গ এবং মানবসভ্যতার ইতিহাসের এক অতি কলঙ্কময় অধ্যায়। 'ট্রিনিটি টেস্ট' - কাব্যময় এই নামকরণের আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ! বিশ্ববরেণ্য আরও অনেকের সঙ্গে যে প্রকল্পের নায়ক ছিলেন রবার্ট ওপেনহাইমার। ধোঁয়া, আগুন আর ধ্বংসের মাশরুম আকৃতির মেঘ যখন সূর্যকে ঢেকে ফেলেছে, ভগবৎগীতার একনিষ্ঠ পাঠক ওপেনহাইমারের মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে এসেছিল কৃষ্ণের সেই অমোঘ বাণী, 'এখন আমিই মৃত্যু, সংহারক আমি বিশ্বের'। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে বিপক্ষে আত্মীয়-বন্ধু-পরিজনের মুখোমুখি দ্বিধাদীর্ণ অর্জুনকে উজ্জীবিত করতে কৃষ্ণ উচ্চারণ করেছিলেন কথাগুলি।

ওপেনহাইমারের প্রিয় কবি ছিলেন জন ডান, যাঁর কবিতা থেকে শব্দ ধার করে তিনি নাম দিয়েছিলেন সেই নিরীক্ষার আর ভগবৎগীতা বিরাজ করত তাঁর অন্তরের অন্দরমহলে। কাব্য আর দর্শনে নিবেদিতপ্রাণ ক্ষুরধার এই প্রতিভা কিন্তু চিহ্নিত হয়ে রইলেন সর্বকালীন বিচারে এক বৃহত্তম গণহত্যার নেপথ্যকর্মী হিসাবে। সফল সেই মরুনিরীক্ষার তিন সপ্তাহের মধ্যে নাগাসাকির মাটিতে নেমে এসেছিল 'ফ্যাট বয়' - পারমাণবিক বোমার সর্বপ্রথম নিদর্শনস্বরূপ।

আগামী ২৪ জুলাই ২০২৩ কলকাতায় এক বিশাল গীতা পাঠের আয়োজন হয়েছে, যেখানে গুঞ্জন এমনকি প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিরও। সাহিত্য আর দর্শনের এই উৎকৃষ্ট সপ্তশতী গ্রন্থটির উপাদান আণবিক বোমার সঙ্গে তুলনীয়। এর ব্যবহার সঙ্গত দায়িত্বশীলতা দাবী করে। আমরা সতর্ক থাকব।

সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর।

3 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in






- ওমা তুমি এসে গেছ? এই দেখো আমি এখনো সেই খাতাখানা খুঁজেই চলেছি।

আমার বান্ধবী সোনা তার প্রিয় অধ্যাপিকা এবং লেখিকা শ্রীমতী নবনীতা দেব সেনের সঙ্গে আমার একটি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। অনেকদিন ধরেই খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, ও সেটা পুরন করেছে। তবে আমি যেহেতু সাহিত্যের ছাত্রী নই তাই কী নিয়ে কথা বলব সেবিষয়ে মনে বেশ ধন্দ ছিল। সোনাই সাহায্য করল। বলল, কেন রে, তুই ওঁর রামায়ণের ওপরে অসামান্য কাজ আছে, তাই নিয়ে কথা বলিস। উনি নিজেই কত কিছু বলবেন দেখিস। ভারি ভালোবাসেন কথা বলতে। আর এত আদর করতে পারেন যে তোর মন খারাপ সব ভালো হয়ে যাবে দেখিস। আমি অবশ্য মনে মনে ভেবে নিয়েছি। চুপ করেই থাকব বেশি। উনি নিজে যা বলবেন তাইই তো হীরে কুঁচি!

আমার আপাত অন্যমনস্কতা কাটিয়ে উনি ঘরে এসে বসলেন। আলুথালু খোলা চুলে চওড়া লাল পাড়ের গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি আর খুব বড়ো তৃতীয় নয়নের মতো টিপ নিয়ে তিনি একেবারে উজ্জ্বল। একমুখ হাসি। কিন্তু হাসিতে একটু কুণ্ঠা। কী যেন হারিয়ে গিয়েছে উনি তার হদিশ রাখেননি। শুধুই কি খাতা? আমি ততক্ষণে বসে পড়েছি। খাতা তো পাওয়া যাবেই। ওই কতগুলো ব্যাগের মধ্যে হয়তো গুছিয়ে রেখেছেন। হাতড়ে ঠিক বেরিয়ে পড়বে। এর মধ্যেই ঘরের মধ্যে থেকে আর একটি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। “কোনোদিন জায়গায় জিনিস রেখে মনে করতে পারো? শুধু খুঁজে পাচ্ছিনা আর খুঁজে পাচ্ছিনা”। আবার হাসিমুখে একটা ছায়া খেলে গেল । বললেন – ও মায়ের গলা । খুকু তো আর বড়ো হলোনা! খুকুর কন্যেরা সব বড়ো হয়ে গেল । কিন্তু মা বকাবকি না করলে খুকু ঠিক করে কিছুই করতে পারেনা । আমি অবশ্য রোমাঞ্চিত হচ্ছি। রাধারানী দেবীর গলা!

আবার উনি ঝর্ণার মতো হাসলেন। তারপর বললেন – আচ্ছা বলো তো তুমি আমার কাছে কী চেয়েছিলে? আমি এবার বুঝেছি । নবনীতাদি, মানে নবনীতা দেব সেন ভুলেই গিয়েছেন আমার কী চাওয়ার আছে ওঁর কাছে। আমিও এবার হেসে ফেলি। আমার প্রিয়বান্ধবী ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছে। সে বলেছিল, দিদি কিন্তু বেমালুম ভুলে যান। ওটাই দিদির রোগ। তাই একটু সময় নিয়ে বললাম -দিদি, আপনার পোস্ট ডক্টরাল কাজ তো বাল্মীকি রামায়ণের স্ট্রাকচারাল অ্যানালিসিস নিয়ে। আমি সেটা নিয়েই খুব আগ্রহী।

একজন মানুষ যে কতটা হাসতে পারেন সে সম্পর্কে আমার আগের ধারণা সব ভেঙে চুরমার । এ হাসি থামছে না। বললেন – মা গো! ও তো সেই খাতায় নেই! ও যে ওদের দেশের সম্পত্তি! তা চিন্তা নেই। তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারো। আমি বলব। তা হ্যাঁ গো তুমি কি এর ওপরে কিছু করতে চাইছ নাকি? এবার আমি কুণ্ঠিত – না। সেরকম কিছু নয় যদিও ।

ভেতর থেকে আবার গলা ভেসে এলো, খাতাখানা খুঁজে পেলে? উনি আমায় ইশারা করলেন। একটু বসো। ঘুরে আসি। পাশের ঘরে শুনতে পেলাম চিরকালীন খুকুর কথা।

-মা তোমার শরীর খারাপ। একটু চুপ করে শুয়ে থাকো। একটু কি হরলিক্স খাবে?

– না, ও তোমার বেড়ালকে খাইও । আমার চাই না । শুয়ে তো তোমারও থাকার কথা। ডাক্তার ইনজেকশন দিয়ে যায়নি তোমায়?

এমন অমূল্য কথোপকথন শুনতে আমার একাডেমিক কাজের কথা ভুল হয়ে যাচ্ছে। উনি আবার এলেন । গুছিয়ে বসলেন । এবার আমি লক্ষ করলাম কথা বলার সময়ে ওঁর শ্বাসের স্বর শোনা যাচ্ছে। এতটা অসুস্থ? ইনজেকশন নিয়ে শুয়ে থাকার কথা! আমি উঠে পড়লাম। দিদি পরে আসবো। অন্য দিন। আপনার শরীর এত খারাপ। আপনি বিশ্রাম নিন ।

উনি চোখ বড়ো করে তাকালেন। ছদ্ম গাম্ভীর্যঁ। -বসো চুপ কর। আনমনে বলে উঠলেন, বিছানা আঁকড়ে সারাদিন শুয়ে থাকা? বলো তুমি কি বলছিলে। আমি ততক্ষণে স্থির করে ফেলেছি। আজ একটিও একাডেমিক আলোচনা নয়। ওসবের আমি ছাই কী বুঝি? আজ বরং ওঁর মুখ থেকে গল্প শুনি। হালকা হাসির গল্প। মনটা তো বিশ্রাম পাক। বললাম – দিদি যা জানতে এসেছি তার জন্য নয় আবার আসবো । আজ বরং আপনার থেকে কিছু মজার স্মৃতি শুনি । “মজার স্মৃতি? মজার স্মৃতি তো ভুলে যাই গো! মনে থাকে শুধু দুঃখের স্মৃতি। তবে আমার স্বভাবে দুঃখবিলাস নেই কিনা, তাই সেসবও মজার লাগে। তুমিই বরং বলো কিরকম গল্প শুনতে চাও। তবে তোমার মূল প্রশ্নটা আমার খেয়াল আছে। সীতাকে নিয়ে আমাদের আবেগ তো কম নয়! দেখো, রামকে যতই মর্যাদাপুরুষোত্তম বলে মুনি কবিরা সম্মান টম্মান দিয়ে থাকুন না কেন আদতে তো সে একটি ভীতু পুরুষমানুষ! শুধু ভীতুই নয়, সন্দেহবাতিকও বটে। ও নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কত যে জানলুম কী বলব! বেশির ভাগ মেয়েদের লেখা বা গাথা রামায়ণের নানা ভার্সন পেলুম। অবাক আমি! নিজেদের রোজকার সুখ দুঃখ বঞ্চনা দিয়ে তারা সীতার ছবি এঁকেছে! আর তাতে এতটুকু মিথ্যে নেই! আমি চুপ করে শুনছি। হঠাৎ বলে উঠলেন – ও মেয়ে, তোমার বিয়ে হয়েছে তো দেখি! তা একটু বলো না, নিজের জীবন দিয়ে মহাকাব্য কেমন বুঝছ? খুব দুর্বল জায়গা। আমি চুপ করেই থাকি। দিদি আবার বললেন – এই ধরো তুমি আমার বাড়ি থেকে ফিরবে যখন তখন তো বেশ রাত হয়ে যাবে। কীভাবে যাবে তা নিয়ে আমার তো চিন্তা থাকবেই, এমনকি আমার মা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করবেন, সে মেয়ে পৌঁছেছে তো? তারপর তোমার আবার বাড়ি গিয়ে সব কাজ সারতে হবে। সেসবে দেরি হলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন বিরক্ত হয় না কি? কিংবা ধরো তোমার সহকর্মী পুরুষটির সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব আছে। এই নিয়ে কোনো রাগারাগি হয়না নিশ্চয়? আমি ঘামতে শুরু করি। উনি কী করে এত কিছু টের পেলেন? নবনীতাদি হাসছেন- কী? ঠিক বলেছি তো? আরে বাবা, এ আর না জানার কি আছে? এরকম সাত সতেরো ঝামেলা নিয়েই তো মেয়েদের জীবন। মহাকাব্যের নায়িকা এ থেকে রক্ষা পাবেন কি করে? আমি সাহস সঞ্চয় করলাম –দিদি, সাধারণ ঘরের মেয়েদের এমন করেই কাটে বটে, তবে বিদুষী স্বক্ষেত্রে উজ্জ্বল মানবী নিশ্চয় এই ছকে বাঁধা পড়েন না? খানিক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে ঘরে। যেন এমন প্রশ্নের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। তারপর বলে উঠলেন –স্বক্ষেত্রে উজ্জ্বল হতে কত কাঠখড় পোড়াতে হয় জানো? কত বিষাদ নদী পেরিয়ে জীবনের হাত ধরতে হয়? জানো কি, বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে কি পরিমাণ যুদ্ধ নিজের সঙ্গে করতে হয়? সেসবও তো সীতার জীবনকাহিনী! তাই না? আমি অজান্তে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। মুখ নীচু করে বসে আছি। উনি নিজেই প্রসঙ্গ পালটালেন।

- দেখো আমাদের শহরটা কেমন বদলে গেছে। এখন মেয়েরা আর তেমন সংকোচে ম্রিয়মাণ নয়, বলো? আমার কিন্তু বেশ লাগে। স্বাধীন সব মেয়ে। নিজের ইচ্ছে মতন বাঁচে। কত কত কাজ করছে সব! আমারই কত ছাত্রী আছে চারিদিকে দেশেবিদেশে ছড়িয়ে। এত আনন্দ হয়! অনেকে বলেন বটে, মেয়েরা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে। সাজপোশাকে জীবনধারণে কেমন যেন উদ্দাম। আমি ভাবি বেশ তো। এতকালের পাথর চাপা মন যদি খুলে যায় আর আলো দ্যাখে তবে হোক না একটু উদ্দাম?

আমি মনে মনে ওঁর সব কথাগুলো ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিচ্ছি। এ সুযোগ আর আসবেনা। মনের রেকর্ডারে অনর্গল রেকর্ড করে চলেছি। বাইরে সন্ধ্যে নামছে। ওঁর ঘরের লাগোয়া ছোট্ট বারান্দায় কটা গাছের মাথায় অন্ধকার নামছে। সময় হাতে কম। আমি একবার বলে উঠলাম –দিদি, আপনি জন্ম থেকেই ভাগ্যবতী। কত কত মহৎ মানুষের স্নেহ পেয়েছেন, সংস্পর্শ পেয়েছেন। নিজের বাবা মা তো বটেই, এছাড়াও কত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ! উনি মাথা নাড়লেন –সে বলতে পারো। আমার বাবা তো বট গাছের মতোই বিশাল ছিলেন। আর মায়ের আশ্রয় তো এ জীবনে ঘুচবে না। আমার জীবনে সাহিত্যযোগ অবশ্য বুদ্ধদেব বসুর হাত ধরে, জানো তো? উনি গুরু হয়ে হাত না ধরলে এতটা হতো না। এ ঠিক। আমি একটু অনুযোগের সুরে বললাম – আপনি যে কেন আরও আরও প্রবন্ধ লেখেননি! রম্যরচনা পড়ে আনন্দ পেয়েছি ঠিক কিন্তু আপনার প্রবন্ধগুলো অমূল্য। -না না, তা কেন? আমার বহু একাডেমিক লেখা আছে বইকি! রম্যরচনা যা বলছ ও আমার স্মৃতির ভাঁড়ার। লিখতে খুব ভালোবাসি। এইটুকু জীবনে আনন্দ যদি না দিতে পারলাম তবে আর আসা কেন? ওঁর কণ্ঠস্বর কি ভারী হয়ে উঠছে? ভেতর ঘর থেকে আবার সেই গলা ভেসে আসছে।

-খুকু একটু বিশ্রাম করো এবার। সারাটা দিন কেবল কথা বলা আর ছুটে বেড়ানো। উনি উঠে পড়লেন। আমি নিস্তব্ধ হয়ে দেখছি, আঁচল কাঁধ থেকে ছড়িয়ে লুটিয়ে যাচ্ছে মেঝেয়। খোলা চুল উড়ে যাচ্ছে বাতাসে। ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছেন যেন। ঘরের দেওয়াল সরে সরে যাচ্ছে। মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশ বারান্দা গাছ আর সময়। দ্রুত দিন আসছে দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে, বিকেল গড়িয়ে রাত। জীবন যেন ফাস্ট ট্র্যাকে দৌড়চ্ছে। কিশোরী হাসিখুশি মেয়েটি যেন দ্রুত ছুটে চলেছে অনিবার্য পরিণতির দিকে। চারপাশে তার কত না ভক্ত! কত স্তাবক! কিন্তু শেষপর্যন্ত ভালো বাসা বাড়ির সেই বাসিন্দা ভালোবাসা নিয়ে পথ হাঁটছেন। গন্তব্য সেই কণ্ঠস্বর, খুকু এবার একটু বিশ্রাম নাও।

[শহরতলির ডায়েরি শারদীয়া ২০২০]

0 comments:

0

প্রবন্ধ - সেবিকা ধর

Posted in




















বন্ধু শব্দটি অনেক ব্যাপক।বন্ধু আকাশ হয়ে থাকে আমাদের মাথার ওপর।ছায়া হয়ে তা যেন আমাদের ছায়া দিতে থাকে অনবরত। সেই বন্ধুতার আকাশকে প্রসারিত করার জন্য অনেক অনেক প্র‍য়াস আমাদের জীবন বহমান।আমরা একজন ভালো বন্ধুকে সবসময় পেতে চাই। কিন্তু সঠিক বন্ধুত্বের সংজ্ঞা নিরূপণ করা কঠিন।কেননা বন্ধু হচ্ছে সেই, যে আমার দুঃখে, বিষাদে, কষ্টে, আনন্দে, আহ্লাদে, মৃত্যু এবং জীবনের ছন্দে পাশে থাকবে।সঙ্গে থাকবে ,পিঠে হাত বুলিয়ে দেবে,বুকে হাত বুলিয়ে দেবে, স্পর্শ করবে, নয়তো প্রলেপ দেয় আমাদের কথায়, আমাদের শোকে, বন্ধু সেই। বন্ধুর বিপ্রতীপে আছে শত্রু।তার ব্যাপারে আমরা উপসংহারে কথা বলব।শত্রুদের নিয়েও আমাদের জীবন-যাপনে অনেক তরঙ্গ ওঠে।শত্রুকে চিহ্নিত করা কর্তব্য এবং তাকে সতর্ক করাও কর্তব্য।আবার বন্ধু শত্রু হয়ে যায়।এমনও আছে যে ছিল পরম বন্ধু সেও পরম শত্রু হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় মুখ দেখাদেখি। এবং তারফলে মনের ভেতর তৈরি হয় এক অভূতপূর্ব নীল বেদনার তরঙ্গ।আমরা আমাদের এই কথাবার্তায় এই সাহিত্য যাত্রাপথে খানিকটা বন্ধুত্ব,খানিকটা শত্রুতা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছি।

জীবনের চলার পথে আমরা অনেক মানুষের সাথে পরিচিত হই কেউ আমাদের অনেক বহু কাছের বন্ধু হয়ে যায় আবার কেউ শত্রু। বাস্তব জীবনে চলতে হলে আপনি কখনোই একা চলতে পারবেন না। জীবনে চলার পথে আপনার বন্ধুর প্রয়োজন হবে। আর পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মানুষের অনেক বন্ধুই থাকে। কিন্তু সব বন্ধুই প্রকৃত হয় না। একজন বন্ধুকে চিনতে হলে আপনার অবশ্যই বিপদে পড়তে হবে। আপনি যদি বিপদে পড়েন তাহলেই বোঝা যাবে কে আপনার প্রকৃত বন্ধু আর কে প্রকৃত বন্ধু না। আপনি যখন বিপদে পড়বেন তখন প্রকৃত বন্ধু কখনই আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে না। আর যে আপনার প্রকৃত বন্ধু নয় সে আপনার বিপদে দেখলেই ছেড়ে চলে যাবে।

মানুষের জীবনে বন্ধু অনেককেই থাকে কিন্তু সবাই 'প্রকৃত' হয় না। বিপদে পড়লে অনেক বন্ধু চেনা যায়। প্রকৃত বন্ধু হল এমন একজন যে আপনার হাত কখনই ছাড়বে না সেটা সুখ আর দুঃখ হোক না কেন। আর যারা আপনার বিপদ দেখে ছেড়ে চলে যাবে তারা বন্ধু ছিল না। আমাদের সমাজে প্রত্যেকটা মানুষেরই অনেক বন্ধু থাকে। কিন্তু এর মধ্যে থেকে কে ভালো, কে মন্দ, এটা কেউ বলতে পারবে না। একমাত্র বোঝার উপায় হচ্ছে যদি আপনি বিপদে পড়েন। কেননা বিপদে পড়লে প্রকৃত বন্ধু সঙ্গে থাকে কিন্তু যারা প্রকৃত না তারা কখনই আপনার পাশে থাকবে না। বিপদে পড়লে আপনারা বন্ধু পরিচয় পেয়ে যাবেন।

বন্ধুত্ব জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা। একটা সময়ের পর জীবনকে যেন আমরা বুঝতেই শিখি বন্ধুর হাত ধরে। কিন্তু বন্ধুর সব সংকটে, সব বিপদেই কি আমরা নির্দ্বিধায় পাশে দাঁড়াতে পারি? এমনও তো দেখা যায়, বন্ধুর বিপদে গা বাঁচানর জন্যই আমরা পীঠ দিই। নিজের দোষের কারণে বন্ধু যখন কোনো ঝামেলায় জড়ায়, তখন কি মনে হয় না খামাখা এই ঝামেলায় নিজে না জড়ানই ভালো।

খুবই নির্ভর আর স্বাধীন এ সম্পর্কে সেভাবে ‘কমিটমেন্ট’ শব্দটি উচ্চকিত না থাকলেও, ‘বন্ধু’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু তাদের কথাই মনে হয়, যারা ভালো ও খারাপ সময়ে শর্তহীনভাবে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। তবে এ কথাও ঠিক, বন্ধুকে সাহায্য করার ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় আমরা বুঝে উঠতে পারি না, ঠিক কীভাবে তাকে সাহায্য করব। চাকরিচ্যুতি, সম্পর্কে সমস্যা বা বিচ্ছেদ, অসুস্থতা, পারিবারিক সমস্যা থেকে শুরু করে আইনগত জটিলতা, মামলা, অর্থসংক্রান্ত সমস্যায় ফেঁসে যাওয়া ইত্যাদি নানা জটিলতায় কিন্তু যে কেউ পড়তে পারে।

যেকোনো ধরনের সমস্যা বা বিপদে পড়াই এক ধরনের মানসিক চাপ। এই চাপ কিছুটা হলেও কমান যায় কারও কাছে মনের কথা নির্দ্বিধায় খুলে বললে। কাজেই বন্ধুকে সাহায্য করার প্রথম পদক্ষেপই হবে তার সমস্যার কথা বলতে দেওয়া এবং সম্পূর্ণ মনযোগ দিয়ে তার কথা শোনা। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কোনো ব্যক্তি কিছু শোনার মতো অবস্থায় থাকে না বলে এই সময় কোনো ধরনের মন্তব্য বা বিষয়টার বিশ্লেষণ না করাই ভালো।

বিপদের সময়ে তার দৈনন্দিন কাজে আপনার সামর্থ অনুযায়ী যতটা পারেন সাহায্য করুন। গুজবে কান না দিয়ে বা অন্যের কাছ থেকে না শুনে, সরাসরি বন্ধুকে বিষয়টা নিয়ে জিজ্ঞাসা করুন। তার অবস্থান থেকে তাকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ দিন।

সবকিছু শোনার পর আগে নিজের কাছে পরিষ্কার হোন নৈতিক দিক থেকে বন্ধুর কাজটি সমর্থন না করলেও আপনি তাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত আছেন কিনা। তার কাজের ফলাফলে ভবিষ্যতে যে ঝামেলা বা বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে, সেটার আঁচ আপনি বন্ধুর জন্য নিতে প্রস্তুত কিনা। সম্পূর্ণভাবে বিবেচনা করে সাহায্যের সিদ্ধান্ত নিলে আপনার বন্ধুত্বের হাতটি বাড়িয়ে দিন। আপনি এই বিপদে তার পাশে আছেন, এটা জানানর সঙ্গে সঙ্গে তার এই কাজটির (?) ব্যাপারে আপনার নৈতিক অবস্থান কী তা-ও পরিষ্কারভাবে জানান। কোনোভাবেই বিষয়টা আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে, এই বিষয়ে আপনার মতামত এবং অপারগতা স্পষ্ট করে তাঁকে বলুন।

মুখে বলুন, আচরণে প্রকাশ করুন। তার সঙ্গে বেশি করে দেখা করুন, ফোনে তার খোঁজ নিন। বিপদের সময় বা যেকোনো খারাপ সময়ে আমাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায়, নিজেকে ছোট লাগে বা মনে হয় এ অবস্থা থেকে যেন মুক্তি নেই। এই খারাপ সময়টা যে একসময় আর থাকবে না, সে ব্যাপারে তাকে মুখে বলুন ও আশ্বস্ত করুন। আপনার এই আশ্বাস আর পাশে থাকা এ ধরনের ঘোরপ্যাচ থেকে অবস্থা মোকাবিলা করতে বড় ধরনের শক্তি ও সাহস জোগাবে।

যেকোনো বিপদে আমাদের মন নানা ধরনের যৌক্তিক-অযৌক্তিক আবেগ, যেমন রাগ, কষ্ট, ঘৃণা, অভিমান, ক্ষোভ ইত্যাদিতে আপ্লুত থাকে। এসব আবেগের ঠিক-বেঠিক বিচার না করে তার মন থেকে এসব প্রকাশ করতে সাহায্য করুন। তাকে কাঁদতে দিন, রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, অভিমান তার মতো করে প্রকাশ করতে দিন।

কোনো ঘটনা শুনলে প্রথমেই আমরা ঠিক-বেঠিক বা নৈতিক-অনৈতিকতার বিচারে লেগে যাই। নানা রকম উপদেশমূলক কথা বলি, যা আসলে এক ধরনের বিরক্তি ঘটায়।

কাজেই এই সময় অহেতুক উপদেশ দেওয়া বা অতিরিক্ত বিচার-বিশ্লেষণ করা থেকে আপাতত নিজেকে বিরত রাখুন। বরং তার অবস্থানে গিয়ে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে জানতে চান আপনি কীভাবে তাকে সাহায্য করতে পারেন।

মনে রাখবেন, বন্ধুর পাশে দাঁড়ান মানে এই নয় যে, নীতিগতভাবে না মানলেও তার যেকোনো বিষয়ের সঙ্গে আপনাকে থাকতেই হবে। সাহায্য মানে এই নয় যে কারও বিরুদ্ধে বন্ধুর সঙ্গে প্রতিহিংসায় আপনি যোগ দেবেন। আপনি বন্ধুর জন্য ততটুকুই করবেন, যতটুকু আপনার মন সায় দেবে।

জীবনের নানা জটিলতার জট খুলতে, তার ভার লাঘব করতে সব সম্পর্ককে পেছনে ফেলে আমরা প্রথমেই ছুটে যাই বন্ধুর কাছেই। বলা হয়, বন্ধুত্ব আমাদের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, যার প্রয়োজন আর গুরুত্ব চোখের সামনে ভেসে ওঠে মূলত যেকোনো সংকটে। খুব বেশি আপনার নীতির বিরুদ্ধে না হলে বন্ধুর সেই সংকটে আপনার হাত বাড়িয়ে দিন। আপনারও হয়ত কোনো একসময় কোনো এক বন্ধুর হাতের প্রয়োজন হতে পারে।

এই প্রসঙ্গে এইটি লোককথার অবতারণা করছি।

কোনো এক কালে মণিপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে এক গৃহস্থ ছিল।ঐ গৃহস্থের বসতভিটের খালের পাশে এক বাঁশঝাড় ছিল। সেই বাঁশঝাড়টির গোড়ার মাটি খালের স্রোতে ধুয়ে নিয়ে যায়।তাই গেরস্থ বাঁশঝাড়টিকে রক্ষার জন্য খাল থেকে মাটি তুলে ভরাট করে দেয়।তার মনে প্রত্যাশা বাঁশঝাড়টির গোড়া শক্ত হলে বংশ বিস্তার করবে অর্থাৎ কড়ুল ছাড়বে।

বর্ষার সময়কাল।অবিরাম বর্ষণে বাঁশঝাড়ের গোড়ায় দেয়াল মাটির দেওয়ালগুলো গলতে শুরু কিরে।বাঁচার আশায় মাটির দলা - এভাবেই গলে গলে হারিয়ে যাওয়া আমাদের ভাগ্যলিপি।মাথা উঁচু করে দাঁড়ানর উপায় নেই।

মাটির দলার কথিত বেদনার মতো বাঁশঝাড়ের বুড়ো পাতাগুলো হাওয়ায় উড়ে যেতে থাকল।বাতাসের তীব্র গতিতে উড়ে দিকবিদিকে ছড়িয়ে যায়।কোথাও পুকুরের জলে,আবার কোথাও খালের জলে ছিটকে পড়ে পচে গলে হারিয়ে যায়। আর কখনও ব্যতিক্রমী কিছু পাতা বাঁশঝাড়ের গোড়ায় ঝরে পড়ে যায় তাদের ভাবনা আবার ভিন্ন।ঐগুলো ভাবে, হায়,আমাদের স্বজনদের মতো বাতাসের আক্রমণে খালে- বিলে পড়ে যেতাম তবে তাদের মতো হারিয়ে যেতাম।আর বাঁশপাতা বলে কোনো অস্তিত্বই থাকত না। সত্যিই এভাবে পচেগলে যাওয়াই আমাদের বিধিলিপি।দুর্বল বলেই কি বেঁচে থাকার কোনো অধিকারই নেই?

এই কথাগুলো নীরবে আউড়ে বুকভাঙ্গা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে যায়। এ ধরনের এলোমেলো চিন্তাভাবনার মুহুর্তে কোথা থেকে প্রবল ঘূর্ণি ঝড়ো বাতাস শোঁ শোঁ করে ধেয়ে ছুটে এল।বাঁশগাছের গোড়ার পাতাগুলো দিশেহারা হয়ে এদিক-ওদিক উড়ে যেতে লাগল।তখন এক বাঁশপাতা মাটির শক্ত দলার পাশে এসে উড়ে পড়ল।

তার করুণ অবস্থা দেখে মাটির দলার মন করুণায় ভরে গেল।তারপর মাটির সেই পিণ্ড বলল- ওহে বন্ধু! ভয় কর না কিসের চিন্তা মনে তোমার? আমি শক্তপোক্ত হয়ে তোমার পাশে আছি এই ঘূর্ণিহাওয়া আমার গায়ে লাগে না। তুমি নির্ভয়ে আমার দেহতলে আশ্রয় নাও।বাতাস তোমাকে কাবু করতে পারবে না।

বাঁশপাতাটি এলোমেলো কিছুক্ষণ তাকিয়ে নীরবে মাটির দলার নীচে আশ্রয় নিল।বাতাসের গতি তার ধারেকাছেও যায় নি এবারের মতো সে বেঁচে গেল।ঘূর্ণি হাওয়া থেমে পর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মাটির দলাকে বলে,বন্ধু তোমার স্নেহচ্ছায়ায় আমি রক্ষা পেলাম।নতুবা কোথায় হারিয়ে যেতাম বলা মুস্কিল।তোমার এই উপকার জন্ম-জন্মান্তরে ভুলতে পারব না।

এভাবে কিছুক্ষন অন্তরঙ্গ আলাপের মাঝে তারা দু'জন মজে গেল।তখন আবার হঠাৎ আকাশ গর্জন উঠল।চারদিকে দৈত্যের মতো কালো মেঘে ছেয়ে গেল।এদিক-ওদিক বাদলা মেঘের আনাগোনা। মুহুর্তেই অঝোরে বৃষ্টি নামল।বাঁশপাতা বন্ধু মাটির দলার উপকারের কথা মনে রেখে কৃতজ্ঞ চিত্তে কথা বলা নেই,নিজেই তার ওপরে ছাতার মতো মেলে রইল।বৃষ্টির জল তার গায়ে ছিটেফোঁটা লাগেনি।বৃষ্টি থামার পর মাটির দলা বন্ধুকে জড়িয়ে বলে, বন্ধু এই তো প্রকৃত বন্ধু এভাবেই চিরকাল আমরা একে-অপরকে সাহায্যের হাত প্রসারিত করে বাঁচতে হবে।

বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ানর অঙ্গীকারে দুই বন্ধু আবদ্ধ হল দুই বন্ধু আবার হাসিতে মশগুল হয়ে দিন কাটাতে লাগল।

এমনিভাবে চলার মাঝে আচমকা একদিন ঝোড়ো হাওয়া বৃষ্টি আছড়ে পড়ল।চারদিকে ঝড়-বৃষ্টিতে জল থৈ থৈ করতে লাগল।দুই বন্ধু দিশেহারা হয়ে উঠল।খাল-বিল-নদী-নালা জলের তীব্র স্রোতে ভাসতে লাগল।তখন বাঁশপাতা আর নিজেকে রক্ষে করতে পারল না, জলের স্রোতে ভেসে যেতে যেতে বাঁচার আশা ভঙ্গ হয়ে করুণ সুরে বন্ধু মাটির দলাকে বলে ওঠে, বন্ধু! আমার আর রক্ষে নেই।আর কোনোদিন তোমার সঙ্গে দেখা হবে না।

বন্ধুর করুণ অবস্থা দেখে মাটির দলা অশ্রুভরা কন্ঠে চিৎকার করে ওঠে, বন্ধু! আমিও তোমার পথের পথিক।

ঠিক কিছুক্ষণ পরে অঝোর বৃষ্টির জল তার গায়ে তীব্র আঘাত করতে শুরু করল।ধীরে ধীরে মাটির দলা গলে গলে জলের স্রোতে মিশে গেল।এভাবেই দুই বন্ধু- বাঁশপাতা ও মাটির দলা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

মানুষ মানুষেরই শত্রু হয়। এই মানুষের ভেতরে যে শত্রুতা জন্ম হয়, তা চিহ্নিত করাটা খুুবই কঠিন। পৃথিবীতে ‘কে- শত্রু’ আর ‘কে- মিত্র’ তাকে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে উপলব্ধি করা যায় না। কেবলই প্রয়োজনের সময় কিংবা বিপদের মুহূর্তেই সত্যিকারের শত্রু-মিত্র চেনা যায়।

গৌতমবুদ্ধ একটা কথা বলেছেন,- জগতে শত্রুতার দ্বারা কখনও শত্রুতার উপশম হয় না, মিত্রতার দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়।

খুব গোপন শত্রু প্রকৃত বন্ধু বা কাছের ও দূরবর্তী মানুষের নিকটেই যেন একটা মুখোশে চিত্র। বিদ্রূপ যাকেই করা হোক না কেন তা অবশ্যই নেতিবাচক। এসমাজের ব্যক্তিত্ববান কোনও মানুষকে যদি ঠাট্টা-মশকরা করে অপমান করা হয়, তা হলে সমাজে তিনি যা দিতে পারতেন তা থেকে এ সমাজ বঞ্চিত হবে। সুতরাং এতে সমাজের যে ক্ষতি হয় তাকে সচেতন নাগরিকদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন। শত্রুরাই নিজ ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যেই যেন কৌশলে মিত্রকে ঘায়েল করে শত্রুতার পথ বেছে নেয়। তাদের কাছে এই কঠিন কাজ সহজভাবেই করতে যেন বাধে না। মনে মনে বা প্রকাশ্যে ঘৃণা করে বা ক্ষতি সাধন করে, এ ব্যক্তিরাও মানুষ মানুষের শত্রু হয়।

এবার আমাদের আলোচনার প্রতিপাদ্য বিষয় হলো শত্রু। শত্রু শব্দটা’কে বাংলা প্রতিশব্দের মাধ্যমে নানা ভাবেই যেন মানুষ চিনে থাকে। যেমন বৈরী, অরি, দ্বিষৎ, প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রতিপক্ষ, বিপক্ষ। শত্রুতা করা, শত্রু ভাবাপন্ন ব্যক্তিরা কখনও সমাজের বৃহৎ কর্মকান্ডে থাকতে পারে না। অবশ্য তাদের কখনও না কখনও পতন ঘটেছে। তাই সাক্ষী ইতিহাসের পাতায় আছে। অনেক শাসকের পতন ঘটেছে তাদের নিকট বন্ধু রূপেই লুকিয়ে থাকা শত্রুতার কারণে।

ধন-সম্পদ, প্রাসাদ বা রাষ্ট্র ষড়যন্ত্রের কথা তো হরহামেশাই মানুষের মুখে শোনা যায়। এ ধরনের শত্রুরা নিজ ইচ্ছা বা ক্ষমতাসীনদের দ্বারাই নিয়োজিত এজেন্ট এবং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আঁতাতে নিজসহ ক্ষমতাধর ব্যক্তির ফায়দা হাসিল করার জন্যই গোপনে ও প্রকাশ্যে সংবাদ আদান-প্রদানের কাজে নিয়োজিত থাকে। তাই, মানুষের কল্যাণে এরা কমই আসে, চতুরতা বা কৌশল খাটিয়েই যেন শত্রুতা করে। সুতরাং প্রয়োজনের সময়ে কেবল সত্যিকার মানুষের কেমন পরিচয় লুকিয়ে থাকে তার গভীর মনে সেটা উপলব্ধি করলেই জানা যায়।

সুতরাং এরা সমাজ এবং দলের নীতিনির্ধারকদের অতি আপন জন হয়ে খুব সহজে গুপ্তচর বৃত্তির কাজেই লিপ্ত থাকে। বিপুল জনপ্রিয়তা থাকার পরও অনেক সময় এ সব শত্রুর কারণেই সমাজ বা দল নিজস্ব সিদ্ধান্তকে ফলপ্রসূ করতে পারে না। এই মানুষরা সর্বক্ষণ অপরের খুঁত ধরতে থাকে। তাদের কাছে অন্যদের চিন্তা-ভাবনা, রুচি-পছন্দ, কাজ, পোশাক-আশাক, আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবদের মতো অনেকে অপছন্দ করে। এক কথায় সব কিছুই তাদের চোখেও খারাপ লাগে। পরশ্রীকাতর, প্রতিহিংসাপরায়ণ লোকেরা গোপন শত্রুতা পোষণ করে থাকে। ওদের থেকে অনেক দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়। তাদের কর্ম ও আচার-আচরণে দৃষ্টি দিলে অনেকাংশে পরিষ্কার হয়। তবে 'গভীর জলের মাছ' ধরতে হলে গভীরে নামতে হবে। তাদের কথা বার্তা ,আচরণ এবং গতিবিধির মধ্যে সর্বপ্রথমেই চলে আসে টাকা বিষয়ক ব্যাপার। কৌশলে টাকা নিতে পারলেই লেনদেন চুকিয়ে দেওয়াটাই তাদের কু-চরিত্রে বিরাজ করে।

বাঙালি আবেগপ্রবণ, আর এমন আবেগপ্রবণতাই যেন তাদের আত্মত্যাগের জন্যেই উদ্বুদ্ধ করে। ভালোবাসাতে যেমন আপ্লুত হতে পারে এ-জাতি, তেমনই- নিষ্ঠুরতা বা শত্রুতার চরম রূপও দেখাতে পারে। অদ্ভুত এক দ্বান্দ্বিক চরিত্র ও মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব আছে মানুষের মধ্যে। চরিত্রের এ বৈপরীতধর্মীতা দৃশ্যমান হয় কিছু স্বার্থ হাসিলের জন্যেই তা অকপটে বলা যায়।

সুতরাং, খুব ভালো মানুষ হতে হলে মানুষকে ভালোবাসতে হবে। আর প্রতিটা মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সুন্দর ভাষা বা শিষ্টাচারপূর্ণ ব্যবহারের প্রভাব অনস্বীকার্য। যদি ধর্মের যুক্তি দেখাতে চেষ্টা করি- তাহলে বলা যেতেই পারে, শত্রুর সঙ্গে সুন্দর ভাষায় কথা বলা। পাশাপাশি , ‘মানুষের উচিত শত্রুর নোংরা কথার জবাব খুবই সুন্দর কথায় দিয়ে দেওয়া।’ তুমি অসৎ কাজকে সেই 'নেকি'- পূণ্য দ্বারাই নিবৃত্ত করো যা সবচেয়ে ভালো। তা হলেই দেখা যাবে যে,- আপনার সাথে শত্রুতা যাঁর ছিল তিনি অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়েও গেছে।’’ শত্রুতা নয়- আপোস করতেই হয়, সেটাই তো জ্ঞানীদের সঠিক কাজ। সফলতার অর্জনের পাথেয়- বলা যেতেই পারে। ‘ভালোবাসা’ দিয়েই হবে জয়, আর শত্রুতা দিয়েই হবে পরাক্ষয়।

পৃথিবীতে মানুষ একা বাস করতে পারে না। মিলেমিশেই বসবাসের পাশাপাশি তারা যার যার ধর্ম পালন করে। এই বসবাসের সূত্রে আত্মীয়তার সম্পর্কের বাইরেও অনেক মানুষের সঙ্গে মানুষের নানারকম সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে মধুর ও পবিত্র সম্পর্ক বলা যায় ‘বন্ধুত্ব’। কারণ মানুষ তার বন্ধুর কাছে সুখ-দুঃখের বিভিন্ন কথা অকপটে ব্যক্ত করে। মানুষ তার বন্ধুর বিপদে- আপদেই সবার আগে এগিয়ে আসে এবং বিপদে-আপদে আশার বাণী শোনায়, তারাই তো- সুখ-দু:খের মুহূর্তগুলো ভাগা ভাগি করে উপভোগ করে।

জ্ঞান ও সভ্যতার ‘বাহ্যিক উন্নতি’ যদি আপাতদৃষ্টিতে সমৃদ্ধির উচ্চশিখরে আরোহন করে, তার পরও সে সমাজকে মানবীয় পূর্ণতায় সমৃদ্ধ সমাজ বলা যাবে না। যে সমাজের লোকজন একে- অপরের কাছে অনিরাপদ বোধ করে কিংবা একে-অপরের প্রতি হিংসা বিদ্বেষ পোষণ ও পরস্পরের মঙ্গল কামনা করে না বরং ভেতরে ভেতরে শত্রুতা এবং ক্ষতি কামনা করে, ষড়যন্ত্র করে, অপরের ধন-সম্পদের প্রতি ‘লোভ-লালসা’ লালন করে, সেই সমাজে কোনো রকম শান্তি বা স্বস্তির অস্তিত্ব নেই।

বিপদের বন্ধুই প্রকৃত ‘বন্ধু’। আর যে ‘বন্ধু’ বন্ধুর বিপদের সময় নিজেকে গুটিয়ে রাখে সে বন্ধুরূপী শত্রু। তাই বন্ধু নির্বাচনে সদা সতর্ক থাকতেই হবে। প্রচলিত সর্বজনীন মূল্যবোধ, আইন এবং অধিকার-বিরুদ্ধ কর্মকাণ্ড যখন সংঘটিত হয় তখনই মানুষের প্রতি মানুষের শত্রুতা এবং অবিচার সৃষ্টি হয়। শুধুমাত্র ন্যায়নীতির পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমেই সর্বস্তরের শত্রুতাকে দমন করে 'শান্তি প্রতিষ্ঠা' করা সম্ভব। অভিজ্ঞতার আলোকেই বলতে হয়, যেখানে ন্যায়নীতি আছে সেখানেই শান্তি আছে। আবার যেখানে ন্যায়বিচার নেই কিংবা আদর্শবোধ বা সহনশীলতা নেই, সেখানে কখনও শান্তি বিরাজ করতে পারে না। নিজ ঘর থেকে শুরু করে গোষ্ঠী এবং জাতি সকল ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য।

সর্বশেষে বলতে চাই যে, ‘আমার হাতে কোনো পাথর নেই, আমার সঙ্গে কারও শত্রুতা নেই। আমি কারও সঙ্গে যে দুর্ব্যবহার করি না, কেননা আমি গোলাপ বাগানের মতই সুমিষ্ট’। । আবার ‘‘শত্রুরা শত্রুতা করতে কৌশলে ব্যর্থ হলে তারপর বন্ধুত্বের সুরত ধরে”। সুতরাং মানুষের এই চরিত্রের পরিবর্তন করানটা খুবই কঠিন। তবুও- বুদ্ধির জোরেই শত্রুকে জয় করা প্রয়োজন। নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গেও একমত পোষণ করে বলা যায়,- “আপনি যদি সত্যিকার অর্থেই শান্তি চান,.. আপনাকে আপনার শত্রুদের সঙ্গেই কাজ করতে হবে, তাহলেই তিনি আপনার সহকর্মী হতে পারবেন। তবুও একটি কথা বলতেই চাই যে, হত্যা, সন্ত্রাস, নাশকতা বা গুজবের মতো শত্রুতা না করে সত্য, সুন্দর এবং মঙ্গল পথে সততা দিয়েই নিজেকে উপস্থাপন করা প্রয়োজন। সুতরাং শত্রুতার ওপরেই দাঁড়ান মানুষদের মনোবল কিংবা নিযেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাওয়া নিচু মনের পরিচয়।

আমরা বন্ধুর কথা শুনলাম,আমরা শত্রুর কথা শুনলাম।এর ভাইরেও বন্ধুত্ব থাকে,দুশমনি থাকে। আর বন্ধুতা বা বন্ধুত্ব আছে বলেই আমরা শত্রুতা বুঝতে পারি।কারণ কালো না থাকলে সাদা বা আলো বোঝা যায় না।রাত্রি না থাকলে অনুভব করা যায় না দিন।আমরা বন্ধুত্বের ময়ূরপঙখী নাও বাইতে বাইতে পৌঁছে গেলাম কোনো স্বপ্নের দেশে।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার

Posted in







কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন “পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।” কিন্তু, আমরা অনেকেই হয়তো জানি না যে, এক ধরণের গোল রুটি যা মূলত উত্তর ভারতে ‘চাপাটি’ নামে পরিচিত তা আতঙ্ক ধরিয়ে প্রায় ঝলসে দিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অনেক ব্রিটিশ অফিসারদের এ দেশকে শাসন করার আশা। আসলে, ইতিহাসের পাতায় স্থান পাওয়া অনেক অন্দোলনের কথাই কালের সমুদ্রে আজ হারিয়ে গেছে। আর সেই আন্দোলন যদি হয় রহস্যময়, তাহলে? তাহলে, তো কোনও কথাই নেই। রহস্যময় আন্দোলনই প্রায় অমীমাংসীত অবস্থায় স্থান পায় ইতিহাসের কালের গভীরে।

আমাদের ভারতবর্ষের দীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক ঘটনাই ইতিহাসে লিপিলব্ধ হলেও, সেগুলো সম্পর্কে আমরা তেমন কিছুই জানি না। যদিও আমরা ইতিহাস থেকে অনেক কিছুই শিখেছি, শিখে চলেছি এবং ভবিষ্যতেও শিখব। অনেক রহস্যময় আন্দোলনই আমাদের শিক্ষাদান করে চলে যখন তা সংগঠিত হয়েছিল তখনকার তার সামাজিক প্রভাব ও বিস্তারও আমাদের ভাবিয়ে তোলে। অনেক রহস্যময় আন্দোলনই কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও সেগুলো আমাদের শিহরণ জোগায়, বিস্মিত করে তোলে। এরকমই এক রহস্যময়, প্রায় অজানা আন্দোলনের নাম ‘চাপাটি আন্দোলন’, যে আন্দোলনের অস্ত্র কোনও বন্দুক, রাইফেল বা তলোয়ার কোনও কিছুই ছিল না, ছিল একটি গোল রুটি। যে রুটি হাতের তালুতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে থাপ্পড় মেরে বানানো হয়। তাই, এর আকার চ্যাপ্টা। এর চ্যাপ্টা আকারের জন্য আর থাপ্পড় দিয়ে বানানোর জন্য এর নাম ‘চাপাটি’। ‘চাপাটি’ শব্দটি এসেছে হিন্দি শব্দ ‘চপত’ থেকে যার অর্থ ‘চ্যাপ্টা’। আবার এর অপর অর্থ হল ‘চড়’। এই চাপাটি ভারতীয়দের বিশেষ করে উত্তর ভারতীয়দের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় খাদ্য। এমনকি, ১৬ শতকে আবুল ফজলেরর লেখা আইন-ই-আকবরী থেকে জানা যায় যে, সম্রাট আকবরের পছন্দের খাবারের তালিকাতে ছিল এই চাপাটি। আর, সেই চাপাটি নিয়েই একটা আন্দোলন ঘটে গিয়েছিল ১৮৫৭ সালে দেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা সেপাহী বিদ্রোহের ঠিক আগেই।

কোনও সংগঠিত ঐতিহাসিক আন্দোলন সম্পর্কে জানতে হলে ইতিহাসবিদদের অনেক উপাদানের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। কিন্তু, চাপাটি আন্দোলনের প্রামাণ্য হিসেবে রয়েছে একটি চিঠি আর কিছু লেখা। সেইসব কিছু নিয়েই রোমমন্থন করা যাক রহস্যময় চাপাটি আন্দোলনকে।

এই আন্দোলনের কথা প্রথমবার উল্লেখ করেছিলেন ১৮৫৭ সালের মার্চ মাসে 'ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি'র সামরিক সার্জন ডক্টর গিলবার্ট হেডো। তিনি ব্রিটেনে অবস্থিত তাঁর বোনকে একটি চিঠিতে লেখেন যে, “There is a most mysterious affair going on throughout the whole of India at present. No one seems to know the meaning of it. It is not known where it originated, by whom or for what purpose, whether it is supposed to be connected to any religious ceremony or whether it has to do with some secret society. The Indian papers are full of surmises as to what it means. It is called the chapati movement.” বাংলায় যার তর্জমা করলে দাঁড়ায়, “বর্তমানে গোটা ভারত জুড়ে এক রহস্যময় ঘটনা ঘটে চলছে। কেউ এর অর্থ জানে বলে মনে হয় না। এটি কোথা থেকে শুরু হয়েছে, কার দ্বারা বা কি উদ্দেশ্যে, এর সাথে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত হওয়ার কথা বা কোন গোপন সমাজের সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে কি না তা জানা যায়নি। ভারতীয় পত্রপত্রিকায় এর অর্থ কী তা নিয়ে অনুমানে পূর্ণ। একে চাপাটি আন্দোলন বলে।”

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এই চিঠিতে 'চাপাটি আন্দোলন'-এর কথা উল্লেখ ছিল আর যার ফলেএই চিঠিই ভারতবর্ষের ইতিহাসে 'চাপাটি আন্দোলনের' একমাত্র প্রমাণ হিসেবে গণ্য। আর এই চিঠি থেকে এটা স্পষ্ট যে চাপাটি আন্দোলন কোনও ছোটখাটো ঘটনা ছিল না বরং এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে অনেক ব্রিটিশ অফিসারের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল এই চাপাটি আন্দোলন।

আসলে ঘটনাটি এইরকম। ১৮৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কোনও এক সকাল। মাথুরার ম্যাজিস্ট্রেট মার্ক থ্রনহিল অফিসে এসে হঠাৎ দেখেন যে তাঁর টেবিলে রয়েছে এক টুকরো রুটি। বেশ বিস্মিত হয়েছিলেন তিনি। হঠাৎ রুটি এখানে কে আনল আর কেনই বা আনল? অনুসন্ধান করে থ্রনহিল সাহেব জানতে পারেন যে, রুটিটি এনেছেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা যিনি সেটা পেয়েছেন একজন গ্রামের চৌকিদারের কাছ থেকে। সেই চৌকিদার রুটি কোথা থেকে পেয়েছিল? জানা যায় যে, জঙ্গল থেকে কেউ একজন প্রহরীদের হাতে রুটি তুলে দিচ্ছিলেন আর তার সাথে এটাও বলে দিচ্ছিলেন যে আরও চারটে রুটি বানিয়ে যেন সকলকে বিতরণ করা হয়। আবার, সেই চারজনকেও যেন জানিয়ে দেওয়া হয় তারাও যেন প্রত্যেকে আরও চারটে করে রুটি বানিয়ে বিতরণ করে। অর্থাৎ, এর ফলে জ্যামিতিক অগ্রগতিতে বাড়বে রুটির সংখ্যা। অপর মতে একদিন মার্ক থ্রনহিল সাহেব বাড়ি থেকে থানায় এসে নিজের টেবিলে দেখেন যে, রুটি বা চাপাটি ভর্তি একটি বস্তা পড়ে আছে। তিনি অবাক হয়ে এই বিষয়ে একজন ভারতীয় সেনার কাছে জানতে চাইলেন। সেই সেনা জানান যে, রাতে হয়তো এই বস্তা কেউ রেখে দিয়েছে। মার্ক অবাক হয়ে বলেছিলেন যে, “এই বস্তা ভর্তি চাপাটি কে দেবে?” কয়েকদিন পর খবর এল যে মাথুরার আশেপাশের প্রতিটি গ্রাম ও চৌকিতে এই ধরণের চাপাটির বস্তা পাওয়া যাচ্ছে।

মার্ক থ্রনহিল সাহেব ক্ষান্ত হলেন না। তিনি আরও তদন্ত ও অনুসন্ধান করে জানতে পারেন যে, রুটির ক্রমাগত বিতরণ চলছে উত্তর ভারত এমনকি উত্তরে নেপালের সীমানা থেকে দক্ষিণে নর্মদা নদীর তীরবর্তী এলাকা পর্যন্ত। এই রুটির বিতরণ চলছে প্রায় কয়েকশো মাইল পর্যন্ত বলা যায় দুই থেকে তিনশো কিলোমিটার পর্যন্ত। তিনি এই রুটির বিতরণের তদন্তের নির্দেশ দেন। কিন্তু তদন্তকালে তিনি ভারতীয় সৈন্যদের থেকে কোনও সাহায্য বা সুবিধা পেলেন না। কেননা, সৈন্যরা ও পুলিশেরা নিজেরাই চাপাটি তৈরি এবং বিতরণে সাহায্য করছিলেন। শুধু সাহায্যই নয়, মনে করা হয় যে, ৯০ হাজার কি তারও বেশি ভারতীয় পুলিশ একত্রিত হয়ে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে চাপাটির বস্তা বিতরণ করতেন। তাই, এভাবেই মথুরার ম্যাজিস্ট্রেটের নাকের ডগা থেকেই চাপাটি বিতরণ হয়ে যাচ্ছিল প্রতিটি গ্রামে। ব্রিটিশ অফিসারেরা কড়া প্রমাণ ছাড়াই তদন্ত করে জানতে পারেন যে, এক রাতের মধ্যে এক গ্রাম থেকে তৈরি চাপাটি দীর্ঘ ৩০০ কিলোমিটারের পথ অতিক্রম করে অন্য এক গ্রামে পৌঁছায়! এই বিতরণের ব্যবস্থা তো ব্রিটিশ মেইল ব্যবস্থার থেকেও দ্রুত! নেটিভদের এই অজ্ঞাত কৌশলে মাথাব্যথা ধরে যায় ব্রিটিশ অফিসারদের। মজার ব্যাপার হল এই যে, যারা বিতরণ করত তারা অনেকেই জানত না ব্যাপারটা কী হচ্ছে। গ্রামে একজন অচেনা মানুষ আসতেন এবং চাপাটির একটি বস্তা রেখে দিয়ে চলে যেতেন। যাওয়ার আগে গ্রামবাসীদের বলে দিতেন যে তারা যেন আরও বেশি করে রুটি তৈরি করে অন্য গ্রামে যেন পৌঁছে দেয়। কেন পৌঁছে দিতে হবে তা কেউ বুঝত না। গ্রামবাসীরা তাদের নিজেদের জমির গম থেকে আটা পিষে চাপাটি তৈরি করত আর তা বিতরণ করত। ব্রিটিশ কর্মকর্তারাও কোনও সদুত্তর খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অনেক গুজব ও জল্পনা ছিল চাপাটি ঘিরে। অনেকের মতে এই যে, চাপাটির মাধ্যমে গোপন কোনও বার্তা পাঠানো হচ্ছে। হয়তো ইংরেজ সরকারের বা কোম্পানীর বিরুদ্ধে কোনও গোপন আন্দোলনের পরিকল্পনা চলছে। এরকম আরও কত কি! কিন্তু এসবের কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি, থ্রনহিল সাহেব তাঁর অফিসে চাপাটি খুব গভীরভাবে পরীক্ষা করেও অস্বাভাবিক কিছু পেলেন না। চাপাটিগুলো স্বাভাবিক আকারেরই ছিল। তাতে না ছিল কোনও বার্তা, না ছিল কোনও অস্বাভাবিক চিহ্ন।

ধীরে ধীরে শত শত চাপাটি বিতরণের খবর প্রচার হয়ে গেল ভারতের উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, কলকাতা, মধ্য ভারত, গুজরাট সহ নানান জায়গায়। কিন্তু, এই চাপাটি বিতরণের রহস্যময় আন্দোলনের যে কি উদ্দেশ্য তা কেউই বুঝতে পারছিল না। আবার এদিকে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আগামীদিনে তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা ভেবে ভীত হয়ে উঠল। আর তাই অনেকেরই প্রিয় খাদ্য, এই নিরীহ চাপাটি রুটির অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলা বিতরণের ফলে তাদের ঘুম উড়ে যায়। এদিকে, রুটি বিতরণ তো আইনত অবৈধ কিছু নয়। এই রুটির মধ্যে তো কোনও বার্তা নেই। তাই, রুটির বিতরণকে ব্রিটিশ অফিসাররা গুরুতরভাবে সন্দেহ করলেও একে আইনত প্রতিরোধ করতে পারছিলেন না। তাই, চাপাটি রুটি বহনকারীদের কাউকে গ্রেফতার বা কারুর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করতেও তাঁরা পারছিলেন না।
এই আন্দোলন সম্পর্কে যতই গুজব বা জল্পনা প্রচলিত থাকুক না কেন, অনেকেই মনে করেন যে, সেই সময় মধ্য ভারতে কলেরা রোগ দেখা দিয়েছিল। তাই, সেই রোগে আক্রান্ত পরিবারগুলোকে সাহায্য করতে চাপাটি রুটির বিতরণ করা শুরু হয়েছিল। যদিও এই যুক্তি বা কারণের কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। তাই, ব্রিটিশ অফিসারদের কাছে তো বটেই এমনকি ভারতীয় ইতিহাসবিদদের থেকে শুরু করে আমজনতার কাছেও 'চাপাটি আন্দোলন' ব্রিটিশদের কাছে চিরকালই এক ‘রহস্যময় আন্দোলন’ হিসেবে রয়ে গেছে।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in







৩৪



ফাইনহালস শুনতে পেয়েছিল গাড়ি স্টার্ট দেবার শব্দ। সব শ্রমিকেরা ফিরে যাচ্ছে। ব্রিজের সামনে ঢালু পথে দাঁড়িয়ে সে দেখতে লাগল। ওদের বেশি জিনিসপত্র বাকি নেই আর। রান্নার চুলা, কিছু চেয়ার, আলুর ঝুড়ি, কিছু প্লেট, শ্রমিকদের মালপত্র গাড়িতে তোলা হচ্ছে। শ্রমিকেরা কাজ সেরে চলে এসেছে। গাড়িতে উঠে পড়ছে সবাই। ওদের সবার হাতে শ্নাপের* বোতল। ওরা একটু একটু শ্নাপ খাচ্ছে সবাই। স্লোভাক মেয়েটা সবার শেষে গাড়িতে উঠল। মাথায় একটা লাল স্কার্ফ বেঁধেছে মেয়েটা। মেয়েটার সঙ্গে মালপত্র কিছুই নেই প্রায়, মাত্র একটা নীল কাপড়ের পুঁটলি। ওরা চলে যাচ্ছে দেখে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছিল ফাইনহালস, ভাবছিল একবার সামনে যাবে কি না বিদায় জানাতে; কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরে এলো সে ব্রিজের উপরে।

কাজ শেষ করে ডয়সেন ব্রিজের উপর থেকে নেমে এলো ধীরে ধীরে। হাতে রেঞ্চটা রয়েছে তার। ধীরপায়ে সে ঢুকে গেল টেমানদের বাড়িতে।

মাঝরাত অবধি ফাইনহালস আর গ্রেস ব্রিজের সামনের ঢালু রাস্তার পাশে যে নিচু দেওয়ালটা ছিল, সেই দেওয়ালের আড়ালে বসেছিল। রাতের অন্ধকারে কান খাড়া করে জেগেছিল তারা।

চারদিক নিস্তব্ধ। মাঝেমাঝে জঙ্গলের ভিতর থেকে সান্ত্রীরা বেরিয়ে আসছিল। এক দু’টো ক্লান্ত কথাবার্তা সেরে, জঙ্গলের দিকে চলে যাওয়া সরু পথের দিকে চেয়ে, নীরবতার মধ্যে বসে থাকছিল তারা। কিন্তু কেউই আসেনি সেই পথ ধরে। এমনকি পাহাড়ের উপরেও সব কিছু নিস্তব্ধ। মাঝরাতে আরও দু’জন সৈনিক তাদের জায়গায় যাবার পরে তাদের ছুটি হল। তারা ঘরে এসে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু ভোর হবার আগেই একটা কোলাহলে ঘুম ভেঙে গেল তাদের। বিছানা ছেড়ে গ্রেস পায়ে জুতোজোড়া গলাতে শুরু করল এবং ফাইনহালস খালি পায়ে গিয়ে জানালায় দাঁড়াল। নদীর ওই পারে প্রচুর লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। তারা লেফটেন্যান্টের সঙ্গে কথা বলছে। কিন্তু লেফটেন্যান্ট একেবারেই তাদের ব্রিজে উঠবার অনুমতি দিতে রাজি নন। লোকগুলো সম্ভবত দূরে যেখানে গির্জার চূড়া দেখা যায় জঙ্গলের পিছনে, সেই গ্রাম থেকে কিম্বা পাহাড়ের গ্রাম থেকে এসেছে এখানে। বিরাট মিছিল করে লোকগুলো এসেছে। কোথায় এই মিছিলের শেষ, সেটা দেখা যাচ্ছেনা এখান থেকে। জঙ্গলের ভিতরে এখনও আছে প্রচুর লোক। লোকগুলো ভীষণ চিৎকার করছে, ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর তাদের। ফাইনহালস দেখতে পেল যে মিসেস সুজান চপ্পল পায়ে, গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে ব্রিজের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। লেফটেন্যান্ট তার সঙ্গে কিছু কথা বললেন, তারপর মিসেস সুজানকে দেখা গেল অনেকটা সময় ধরে ওই গ্রামের লোকগুলোর সঙ্গে কথা বলতে। তারপর আবার মিসেস সুজান লেফটেন্যান্টকে কিছু একটা বললেন। ইতিমধ্যে ডয়সেনকেও দেখা গেল; ধীরে ধীরে হাতে সিগারেট নিয়ে হেঁটে গেলেন তিনি ব্রিজের দিকে। প্রথমে তিনি লেফটেন্যান্টের সঙ্গে কথা বললেন, তারপর মিসেস সুজানের সঙ্গে, তারপর গ্রামের লোকজনের সঙ্গে। অবশেষে উদ্বাস্তু মানুষজনের মিছিলটা নদীর ওইদিকের পাড় বরাবর পথ ধরে ঝারনির দিকে যেতে লাগল। অনেকগুলো গাড়ি, ঠেলা, সব মানুষজন, মালপত্র দিয়ে ঠাসা। বাচ্চাকাচ্চা, হাঁসমুরগির বাক্সখাঁচা সব নিয়ে লোকগুলো যাচ্ছে। বিরাট সারি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। ডয়সেন মিসেস সুজানকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছেন এবং ক্রমাগত মাথা নেড়ে যাচ্ছেন।

ফাইনহালস ধীরে সুস্থে পোশাক পরে তৈরি হল এবং বিছানায় শুয়ে রইল। সে ঘুমোবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু গ্রেস তখন দাড়ি কামাতে শুরু করল এবং হালকা শিস দিয়ে গান গাইতে লাগল। কয়েক মিনিট পরে তারা শুনতে পেল দুটো গাড়ির শব্দ। প্রথমে মনে হচ্ছিল যে গাড়িদুটো পাশাপাশি আসছে, তারপর শব্দে মনে হল একটা আরেকটাকে টেক্কা দিতে ব্যস্ত; তারপর কেবলমাত্র একটা গাড়ির শব্দ আরেকটা শব্দকে ঢেকে দিল। ফাইনহালস লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে গিয়ে দেখে যে বাদামি গাড়িটা এসেছে, যেটায় করে প্রায়ই ওদের তহবিলদার এসে বেতন দেয় শ্রমিকদের। গাড়িটা টেমানদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ডয়সেন আরেকজন লোকের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজের দিকে যাচ্ছে। লোকটার খাকি বাদামি ইউনিফর্ম, কাঁধে মেজরের পদমর্যাদার সাজসজ্জার স্ট্র্যাপ। এর মধ্যে দ্বিতীয় গাড়িটাও এসে পড়েছে; একটা ধূসর রঙের গাড়ি। গাড়িটার অবস্থা বেশ সঙ্গিন মনে হচ্ছে, ধুলো ভর্তি, কাদার ছিটে লাগা। গাড়িটা মিসেস সুজানের বাড়ির সামনে থামল।

গাড়ি থেকে প্রাণবন্ত এবং ছোটখাট চেহারার এক লেফটেন্যান্ট বেরিয়ে এসে বলে উঠল, ‘তৈরি হয়ে নিন আপনারা সবাই। যেতে হবে এখান থেকে। পরিস্থিতি সুবিধের নয়। আপনার বস কোথায়?’ ফাইনহালস লক্ষ্য করল যে ছোটখাট চেহারার লেফটেন্যান্টের কাঁধের স্ট্র্যাপ এঞ্জিনিয়ারের। সে ব্রিজের দিকে আঙুল দেখাল… ‘ওইখানে’

‘ধন্যবাদ’ বলে লেফটেন্যান্ট গাড়ির মধ্যে বসে থাকা লোকটিকে বললেন ‘সব তৈরি রাখো।’ … বলেই দৌড় লাগালেন ব্রিজের দিকে। ফাইনহালস তাকে অনুসরণ করল।

খাকি বাদামি ইউনিফর্ম পরা, কাঁধে মেজরের স্ট্র্যাপ লাগানো লোকটি ঘুরে ঘুরে ব্রিজটা দেখতে লাগল। ডয়সেন তাকে সব দেখাতে লাগল। লোকটা সন্তোষজনক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছিল। মাথা নেড়ে ডয়সেনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজ থেকে টেমানদের বাড়ি অবধি এল লোকটা। ডয়সেন ভেতরে ঢুকে তার মালপত্র আর রেঞ্চ নিয়ে বেরিয়ে এসে বাদামি গাড়িটায় উঠে পড়ল; গাড়িটা সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল টেসার্জির দিকে।

দু’জন মেশিনগানধারী সৈনিক, যারা গ্রেস এবং ফাইনহালস মাঝরাতে চলে আসবার পরে ব্রিজে পাহারা দিচ্ছিল, তাদের সঙ্গে নিয়ে মুক ফিরে এল। এছাড়াও তার সঙ্গে এল এঞ্জিনিয়ার লেফটেন্যান্ট এবং এক আর্টিলারি সার্জেন্ট। সার্জেন্টের অবস্থা বেশ বিধ্বস্ত। সঙ্গে কোনো অস্ত্র নেই, মালপত্র নেই, ধুলোয় ঢাকা শরীর, ঘামে ভেজা মুখ, দেখে মনে হচ্ছে বেশ ক্লান্ত। সার্জেন্ট জঙ্গলের দিকে, জঙ্গল ছাড়িয়ে পাহাড়ের দিকে আঙুল তুলে উত্তেজিতভাবে কী যেন দেখাচ্ছে। ফাইনহালস নিজেও ওই পথে গাড়ি নেমে আসবার শব্দ শুনতে পেল। ছোটখাট চেহারার এঞ্জিনিয়ার লেফটেন্যান্ট দৌড়ে এলো ধূসর গাড়িটার কাছে এবং চিৎকার করে উঠল, ‘তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি!’ একজন সৈনিক ধূসর টিনের বাক্স, বাদামি কার্ডবোর্ডের বাক্স আর একবান্ডিল তার নিয়ে দৌড়ে এল।

এঞ্জিনিয়ার লেফটেন্যান্ট নিজের ঘড়ি দেখলেন, ‘সাতটা বাজে, আমাদের হাতে ঠিক দশ মিনিট সময় আছে।’ মুকের দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি… ‘ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে উড়ে যাবে। এভাবেই আক্রমণ আটকানো সম্ভব।’

ফাইনহালস ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে যায়। নিজের মালপত্র গুছোতে থাকে, রাইফেলটা নেয়। বাড়ির দরজার বাইরে সব জিনিস রাখে। তারপর আবার বাড়িটার ভিতরে যায়। বাড়ির ভিতরে দু’জন মহিলা, তারা কেউই বাইরে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়নি এবং উত্তেজিতভাবে ইচ্ছেমত জিনিসপত্র টানাটানি করে বাড়ির বাইরে রাখছে এবং একজন আরেকজনের উপরে চিৎকার করছে। ফাইনহালস ম্যাডোনার মূর্তির দিকে তাকায়, মূর্তির সামনে রাখা ফুলগুলো অর্ধেক শুকিয়ে গেছে। ফাইনহালস শুকনো ফুলগুলো বেছে নিয়ে ফেলে দেয়। অপেক্ষাকৃত তাজা ফুলগুলো একটা তোড়ায় বেঁধে সাজিয়ে রাখে মূর্তির সামনে, ঘড়ির দিকে তাকায়। আট মিনিট হয়ে গেছে। নদীর অন্য পারে, পাহাড়ের দিক থেকে অনেক গাড়ি আসবার শব্দ ক্রমেই স্পষ্টতর হচ্ছে। সম্ভবত গ্রাম পেরিয়ে গাড়িগুলি জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। যাবার জন্য প্রস্তুত। লেফটেন্যান্ট মুকের হাতে একটা কাগজের প্যাড, সে বিধ্বস্ত আর্টিলারি সার্জেন্টের সব ব্যক্তিগত তথ্য লিখছে। সার্জেন্ট বেঞ্চের উপরে বসে আছে।

‘শ্নীভিন্ড’ বলে সার্জেন্ট, ‘আমি আর্থার শ্নীভিন্ড… আমরা ৯১২ নম্বর থেকে এসেছি।’ মুক লিখে মাথা নেড়ে নিজের চামড়ার ব্যাগে কাগজের প্যাডটা ঠেলে ঢুকিয়ে দেয়। সেই মুহূর্তে ওই ছোটখাট এঞ্জিনিয়ার লেফটেন্যান্ট দৌড়ে আসে, সঙ্গে আগের সেই সৈনিক যে টিন, প্যাকিং বাক্স এসব নিয়ে গিয়েছিল; এঞ্জিনিয়ার লেফটেন্যান্ট জোরে চিৎকার করে… ‘ফুল কভার, ফুল কভার!’

সবাই কোণাকুণি দাঁড়িয়েছিল ব্রিজে উঠবার ঢালু পথের সামনে, মুহূর্তের মধ্যে ছিটকে সবাই শুয়ে পড়ল রাস্তার উপরেই, যতখানি বাড়িটার কাছাকাছি যাওয়া যায়, সেই আড়ালটুকু সামনে রেখে। এঞ্জিনিয়ার লেফটেন্যান্ট ঘড়ির দিকে তাকাল… তারপর ব্রিজটা উড়ে গেল। সেরকম কোনো বিশাল আওয়াজ হল না। প্রথমে মড়মড় করে কী যেন ভাঙল, বাতাসে বেশি ধুলো পর্যন্ত উড়ল না। তারপর হ্যান্ড গ্রেনেড ফাটার মত শব্দ হল কয়েকটা, ওরা বুঝতে পারল যে ভারি রাস্তাটা ভেঙে পড়ছে। ওরা কিছু মুহূর্ত অপেক্ষা করল, যতক্ষণ না ছোটখাট চেহারার লেফটেন্যান্ট বলে উঠলেন, ‘হয়ে গেছে।’

ওরা উঠে দাঁড়িয়ে ব্রিজের দিকে তাকাল। কংক্রিটের পিলারগুলো এখনও আছে। ব্রিজের উপরের রাস্তা, তার পাশের ফুটপাথ সব পরিষ্কারভাবে উড়ে গেছে। শুধু বাঁ দিকের রেলিঙের কিছু অংশ এখনও পিলারগুলোর সঙ্গে লেগে ঝুলে আছে।

ওপার থেকে এগিয়ে আসা গাড়িগুলোর শব্দ ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল; হঠাৎ শব্দ থেমে গেল। সম্ভবত গাড়িগুলো জঙ্গলের মধ্যে থেমে গিয়েছে।

ছোটখাট সেই এঞ্জিনিয়ার লেফটেন্যান্ট ফিরে যাবার জন্য গাড়িতে উঠবার আগে ঘুরে দাঁড়িয়ে মুককে বললেন, ‘আপনি আর এখানে কেন অপেক্ষা করছেন? আপনার কিন্তু এখানে থাকবার কোন অর্ডার নেই আর…’ বলে একটা স্যালুট ঠুকে সেই নোংরা ধূসর গাড়িটায় চেপে তিনি চলে গেলেন।

‘চলো’… চিৎকার করে ওঠে লেফটেন্যান্ট মুক। তারা পথে দাঁড়িয়ে আছে। মুকও পথে দাঁড়িয়ে দুটো বাড়ির দিকে তাকায়। কিন্তু বাড়ি দুটোতে একটা জিনিসও নড়েছে বলে মনে হচ্ছে না। মহিলার কণ্ঠে কান্নার আওয়াজ আসছে, মনে হচ্ছে কণ্ঠটা এক বয়স্ক মহিলার।

‘মার্চ’… চিৎকার করে মুক ‘জোরে পা না ঠুকে মার্চ করো’। সবার আগে সে সামনে এগিয়ে চলে; গম্ভীর এবং বিষণ্ণ লেফটেন্যান্ট মুক দূরে কোথাও চেয়ে আছে। সামনে অনেক দূরে, নাকি পেছনে কোথাও?



(চলবে)



*. শ্নাপ- ব্র্যান্ডি জাতীয় জার্মান মদ

0 comments:

0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















(১০)

নবাবহাট সংলগ্ন একটি ক্ষীণকায়া জলধারা দক্ষিণমুখে প্রবাহিত হতে হতে মূল নগরীতে এসে দামোদরের কোলে এসে মিশেছে।

যদিও এই জলপথটির কোন অংশে মূল নদীটির নাব‍্যতা নেই বললেই চলে তাও কুমোর পাড়ার দৈনন্দিন সামগ্রী ছোট ছোট কিস্তি নৌকো করে বড় গঞ্জের হাটগুলিতে বিক্রির জন‍্য অধিকাংশ সময় এই পথে প্রেরিত হয়ে থাকে।

নদীঘাটটির একাংশে কৈবর্ত‍্যদের একটি গ্রাম ও তারমধ‍্যে দু'তিনটি অগ্রদানী ব্রাহ্মণের চালাঘরও দেখতে পাওয়া যায়।

জলাশয়টির পূর্ব ও দক্ষিণদিকে বঙ্গভূমির প্রধান শস‍্য " ধান‍্যে"র অবারিত ভান্ডার। ধান পাকার সময়ে মৃদু হাওয়ায় 'ঝুনঝুন' শব্দে চতুর্দিক গুঞ্জরিত হলে মনে হয় যে স্বয়ং মা ধান‍্যলক্ষ্মী যেন দর্শনসুখের সাথে তাঁর অলক্তরঞ্জিত পদস্পর্শে শ্রুতিময় করেও তুলেছেন শস‍্যসম্পদের এই অনাবিল প্রাচূর্য‍্যটিকেও।

গোলকপতি আজ হাঁটতে বেরিয়ে উদাস নয়নে অনেকক্ষণ ধরে আমন ধানের প্রাচূর্য‍্যে মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়েছিল। ওর চটকা ভাঙ্গল একটা বিশেষ গোলমালে। সামনের মালো পাড়া এই চিৎকারের উৎস। সে বিষয়টি অনুধাবন করতে সেদিকের উদ্দেশ‍্যে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল।

......

বাগবাজারে গাঁজা-গুলি-চন্ডুর আড্ডায় এখন একটা কথাই ঘুরে ফিরে সব হট্টোগোলের মাঝে ফিরে ফিরে আসছে। সিপাই বিদ্রোহের পরে ইংরেজরা নাকি আবার এদেশের লোকাচারগুলিকেও এবার নাকি রদ করতে উঠে পড়ে লেগেছে! শোনা যাচ্ছে বড়লাট বেন্টিঙ্ক সাহেব নাকি হিন্দুদের সতীদাহের বিরুদ্ধে খুব চটেছেন আর তাঁর এই কুবুদ্ধিতে নানা রকম কেতাব খুলে খালি উস্কে দিচ্ছেন দেওয়ান রামকান্ত রায়ের ছোটছেলে 'রামমোহন'!

কিছুদিন আগে তাদের 'বেম্মজ্ঞানী'দের আড্ডাটা নিয়ে শহর কলকেতার মানুষজন তির্যক দৃষ্টিতে মেনে নিলেও তার এই লোকাচার নিয়ে বাড়াবাড়িটাকে কিন্তু কেউ ভাল চোখে দেখছে না।

পক্ষীদের দলের নেতা 'রূপচাঁদ ' কল্কে মুখে একরাশ গাঁজার ধোঁয়ায় চারিদিক ধুম্রাশ্রিত করে একবার বললেন, " আহ্! ভীষণ তো দেকচি ক‍্যাঁ..ক‍্যোঁ..কিচি...মি...চি! ওরে সব্বাই তো হাড়ে মাংসে পুড়চেই... তা কটা মেয়েছেলে যদিবা নাই পুড়ে ম'ল তো তাতে কার কি ক্ষেতি হে ? "

পক্ষীদের দলপতির মুখে এমন উল্টো কথা আগে কেউ তেমন শোনেনি। চার জন বশংবদ গাং শালিক বেশী ছোকরা চোখ বড় বড় করে তামাশা দেখতে লাগতেই একজন নধরকান্তি যুবা যার নাম 'রাজহাঁস' সে ধপ্ করে এসে একেবারে চাতালে বসে পড়ে মনে মাথা চাপড়ে বলল,

"...পুলিশের গুঁপো সান্ত্রীরা রাস্তায় লোকজনদের আর হেঁটে যেতে দিচ্চে না গো! ধরে ধরে সড়কীর গুঁতো মারতেচে আর ফেরৎ পাঠ‍্যে দিচ্চে। আমি কোনওমতে সটকে এসিচি। "

এসবের কারণটিও বোঝা গেল বড় চিন্তার।

আজ কলুটোলা দিয়ে যাবার সময় স্বয়ং লাটসাহেবের ফিটন গাড়ি লক্ষ‍্য করে কেউ বা কারা বেদম পাটকেল ছুঁড়ে মেরেছে আর তাতে গাড়ীর গারোয়ানের কপালে সেই ঢিল এসে লেগেছে ও তার কপালটিও সেই আঘাতে ভালমত ফেটে গেছে।

যদিও সাহেব তখন নিজে ওই গাড়িতে ছিলেন না। লাটভবন থেকে সায়েবের ফিটনে চেপে মির্জাপুর যাচ্ছিলেন স্বয়ং রামমোহন। বন্ধুকৃত‍্য করতে গিয়ে এবারে নিজেই বেশ বিপাকে পড়ে গেছেন স্বয়ং বড়লাট।

তাই শহর কলকেতার আনাচেকানাচে ওই ঢিল ছোঁড়নেওলাদের খোঁজে ব‍্যাপক ধরপাকড় চলছে বলে পুলিশ সাধারণ লোকজনেদের গতিবিধিও বেশ নিয়ন্ত্রণ করে ফেলছে।

সান্ধ‍্য আড্ডার মাঝে এসব অনাচার বিষয়ক বাগবিতন্ডা থামানোর জন‍্যে কয়েকজন "হাফ পক্ষী" নামধারী ছোকরার দল চোখ বুজে ওদের জাতীয় সঙ্গীতটি বিকট গলায় গেয়ে উঠল,

" খগ-সম্পাতি, কশ্যপ নাতি / খগ লীলা, জাতিমাল, কুলজি, নবপুথি /সারস বাবুই জাতি ব্যবসায়ী মহাজন/ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পক্ষী শূদ্র, শুক শারি হীরামন /কুলীন কায়স্থ পরহাম্মা, নীলকণ্ঠ আদি খঞ্জন/অষ্ট ঘর সেন সিংহ কর, গৃহবাজ,

বাজবাউড়ি বাঁশপাতি | (দে দত্ত দাস,

হয়পাতিহাঁস, ভীমরাজ কপোত কপোতী)

গলা ফোলা, মুক্ষি গোলা, জবর জং,

পরপঙ সক্কর খুরে..."

পরক্ষণে সমবেত কন্ঠে স্বয়ং রূপচাঁদ তার বাকী খেউড়ের দলের সাথে সমস্বরে গেয়ে উঠল,

" ....ওরে পক্ষীর ওছা কাদাখোঁচা, কালোপেঁচা বাহাডুরে,পাখি আরগিন বঙ্গের কুলীন গুহ পদবী ধরে/ উত্তররাঢ়ী কায়স্থ, নুরি মস্ত বুলি বার করে/বারেন্দ্র ফরিয়াদী, বাদী পেলে ঘাল করে,

কোকিল বৈদ্য বুদ্ধি হদ্দ, ঠকায় কালো কাকেরে,

নবশাক চক্রবাক নবরঙ্গের নয় জাতি...."

......

গোলকপতি এক জায়গায় বেশ ভীড় দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল। একটা জনাপঁচিশেক নারী-পুরুষের দল অন‍্য একজন মৃতপ্রায় প্রৌঢ়কে ধরাধরি করে এনে এখানকার জলাশয়টির দক্ষিণমুখে একটি অস্থায়ী চালাঘরে এনে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ব‍্যাপারস‍্যাপার দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে লোকটির অন্তিম সময় প্রায় উপস্থিত।

অবশ‍্য তার সঙ্গের লোকজনের চেহারা প্রমাণ করে দিচ্ছে যে সে এই গ্রামের আদি বাসিন্দা বা কৈবর্ত‍ কূলের কেউ নয়। তার সঙ্গের পুরুষদের অধিকাংশই স্বাস্থ‍্যবান ও যজ্ঞোপবীতধারী। কানাঘুষো যে খবরটি হাওয়ায় উড়ছে তা হল প্রৌঢ়টি হলেন বারেন্দ্র বংশীয় ব্রাহ্মণ, তবে এঁর পূর্বপুরুষের কেউ একজন অন্ত‍্যজ শ্রেণীর এক মহিলায় উপগত হওয়ায় ইনি আপাতত ভঙ্গকূলীন গোত্রের। তবে হাজার হোক বামুন বলে কথা! তাই অন্তিম সময়ে তাঁর দ্বিজত্ব রক্ষা করতে ও নানাবিধ পারলৌকিক সুবিচারের আশায় তাঁকে অন্তর্জলি যাত্রায় আনা হয়েছে।

বৃদ্ধটির পাশে এক বছর একুশের সধবা মেয়ে নতমস্তকে সমানে কেঁদেই যাচ্ছে। সম্ভবতঃ সে ওই বৃদ্ধের অনেকগুলি স্ত্রীদের মধ‍্যে নবতর। স্বামীর মৃত‍্যু ঘটলে তাকে নিশ্চয়ই অন‍্য কয়েকজন সপত্নীর সাথে নিয়ে গিয়ে সতীদাহ করা হবে।

মেয়েটির করুণ পরিণতির কথাটি মাথায় আসতেই গোলকপতির মধ‍্যে এক দুর্বিনীত ও বিদ্রোহী যুবক এসে হঠাৎ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।

লোকাচারের নির্মম আঘাত সে নিজেও এ জীবনে যা পেয়েছে তার ফলেই তো সে শেষ অবধি দেশহারা হয়েছে, তার যন্ত্রণা কোনদিন কি সে আদৌ কখনও ভুলতে পারবে? যদিও এখনও পর্যন্ত তার জীবনে চলছে শ্বদন্ত প্রকাশী নির্মমতার সাথে স্নায়ু ও শরীরের এক সমবেত ও তুমুল দ্বন্দযুদ্ধ।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in


 






সাত

তিনি বলতেন, কোজাগরি লক্ষীপুজোয় পুজো করার পরে যে গৃহস্থ রাত্রি জাগরণ করে রাত কাটাবে তার ঘরে লক্ষী স্বয়ং বিরাজ করেন। কোনো অভাব, অনটন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। স্বার্থ নিয়েই মানুষ পুজো করে। কারণ সে সংসারী। ছেলে, মেয়ে, বাবা,মা, ঠাকুমা, দাদু সকলকে নিয়ে এই সংসার। তাদের মঙ্গল কামনা করেই মানুষের এই পুজো পার্বণ। বাজারে দরদাম করে ঠাকুর কেনার পরে পুজোর ফলমূল, দশকর্মার জিনিসপত্র কিনে বাড়িতে আলপনা এঁকে ঠাকুরের প্রতিষ্ঠা হয়। তারপর পুরোহিতের পৌরোহিত্যে গৃহস্থের মঙ্গলসাধন। লৌকিক আচার, আচরণে বিশ্বাস জড়িয়ে থাকে। আর বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। পুজোর প্রতিটি পর্যায়ে শিল্প ভাবনা বিরাজ করে। তারফলে পুজো আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। দুর্গাপুজোয় ঢাক বাজে। প্যান্ডেলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে কোনো কিছুর আদলে মন্দির বানানো হয়। যেমন, তাজমহল, খাজুরাহো, কোনারক প্রভৃতি। নানারকম বাদ্যযন্ত্র পুজেকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। মা আমাদের নিয়ে,কাটোয়ার কার্তিক লড়াই, চন্দননগরে জগদ্ধাত্রি পুজো, কাগ্রামের জগদ্ধাত্রি পুজো,শিবলুনের মেলা,উদ্ধারণেরপুরের মেলা দেখাতে নিয়ে যেতেন। পুজো এলেই মায়ের লক্ষ্মীর ঝাঁপি উন্মুক্ত হয়ে যেতো। কোজাগরীর রাতে মা কম করে তিনশো লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। মাজা নীচু করে আসনে বসা মানুষদের প্রসাদ বিতরণ করতাম আমরা ভাই বোনেরা। পরের দিনও খিচুড়ির ব্যবস্থা থাকতো। ডোমপাড়ার সকলে এসে নিয়ে যেতো আনন্দে। সর্দার বুড়ি বেসকা দি, মঙ্গলীদি সবাই আসতো। ছোটো পিসি, মানা, বড়পিসী, সন্ধ্যা,রুনু, শংকরী সকলে আসতো। মায়ের ঘর পূর্ণ হয়ে উঠতো অতিথি সমাগমে। গম্,গম্ করতো বাড়ি। মানুষই যে লক্ষ্মী তা আবার প্রমাণ হয়ে যেতো চিরকালের সত্য সুরে।পুজোর বেশ কিছুদিন পরে মেয়েরা সকলে এক হয়ে মাংস, ভাতের ফিষ্টি করতো। মনেআছে আমার, খেতে এসে বিশাখাদি বলেছিলো, আমি বিধবা মাংস খবো কি করে? আমার মাসতুতো দিদি বলেছিলো, বিধবা আবার কি কথা? তোর স্বামী মরে গেছে। দুঃখের কথা। তার সঙ্গে মাংসের কি সম্পর্ক। আচ্ছা কেউ মনে কর মাংস খেলো না। আর মনে মনে স্বামীকে দোষ দিলো। সমাজপতিরা, সমাজের সেনাপতিরা মনের নাগাল কি করে পাবে? ওদের হাত ওই মাংস অবধি। অতএব, নো চিন্তা, ডু ফুর্তি।বিশাখাদি আনন্দে মাংস খেয়েছিলো। সমস্ত কিছুতেই চিরকাল কিছু মহিলার সংস্কারমুক্ত মনের জন্য পৃথিবী এত সুন্দর। উন্মুক্ত সমাজ আমাদের সর্দার পাড়ার। সেখানে সমাজের কোনো সেনাপতি বিধি আরোপ করে না। যে যারইচ্ছেমতো খেটে খায়। কেউ মুনিষ খাটে, কেউ মাছ ধরে, কেউ কেরালা সোনার দেকানে কাজ করে। বুড়ো বয়সে তারা ছেলে মেয়েদের রোজগারে খায়। ওদের কাউকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয় না। কার কৃপায় ওরা বুড়ো বুড়ি হয় না? শক্ত সমর্থ থাকতেই পরকালের ডাকে ওপাড়ে চলে যায়। কাজই হলো আসল লক্ষ্মী। কদতলার মাঠে এসে ঢিল মেরে পেরে নিতাম কাঁচা কদবেল। কামড়ে কচ কচ শব্দে সাবাড় করতাম কদ। বুড়ো বলতো, কদ খেয়ছিস। আর খাবি। কই তখন তো গলা জ্বলতো না। এখন শুধু ওষুধ। ভক্ত,ভব,ভম্বল,বাবু বুলা, রিলীফ সবাই তখন আমরা আমড়া তলায় গিয়ে পাকা আমড়া খেতাম। জাম, তাল,বেল, কুল,শসা, কলা, নারকেল কিছুই বাদ রাখতাম না। নারকেল গাছে উঠতে পারতো গজানন। শুধু দুহাতের একটা দড়ি। তাকে পায়ের সঙ্গে ফাঁদের মতো পরে নিতো গজানন। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই নারকেল গাছের পাতা সরিয়ে ধপাধপ নিচে ফেলতো। আমরা কুড়িয়ে বস্তায় ভরে সোজা মাঠে। বাবা দেখলেই বকবেন। তারপর দাঁত দিয়ে ছাড়িয়ে আছাড় মেরে ভেঙ্গে মাঠেই খেয়ে নিতাম নারকেল। একদম বাস্তব। মনগড়া গল্প নয়। তারপর গাজনের রাতে স্বাধীন আমরা। সারা রাত বোলান গান শুনতাম। সারা রাত নাচতাম বাজনার তালে তালে।শীতকালে খেজুর গাছের রস। গাছের কামান হতো হেঁসো দিয়ে। মাথার মেথি বার করে কাঠি পুঁতে দিতো গুড় ব্যাবসায়ী। আমাদের ভয় দেখাতো, ধুতরা ফুলের বীজ দিয়ে রাকবো। রস খেলেই মরবে সে। চুরি করা কাকে বলে জানতাম না। একরাতে বাহাদুর বিশুর পাল্লায় পরে রাতে রস খেতে গেছিলাম। বিশু বললো, তোরা বসে থাক। কেউএলে বলবি। আমি গাছে উঠে রস পেরে আনি। তারপর গাছে উঠে হাত ডুবিয়ে ধুতরো ফুলের বীজ আছে কিনা দেখতো। পেরে আনতো নিচে। তারপর মাটির হাঁড়ি থেকে রস ঢেলে নিতাম আমাদের ঘটিতে। গাছেউঠে আবার হাঁড়ি টাঙিয়ে দিয়ে আসতো বিশু। সকালে হাড়ি রসে ভরে যেতো। ভোরবেলা ব্যাবসায়ির কাছে গিয়ে বলতাম, রস দাও, বাড়ির সবাইকে দোবো। বুক ঢিপঢিপ চাঁদের গর্ত। দেবে কি দেবে না, জানিনা। অবশেষে প্রাপ্তিযোগ। যেদিন রস পেতাম না তখন মাথায় কুবুদ্ধির পোকা নড়তো। তাতে ক্ষতি কারো হতো না। বিশু ভালো মিষ্টি রস হলে বলতো, এটা জিরেন কাঠের রস। মানে চারদিন হাড়ি না বাঁধলে রস মিষ্টি হতো। জানি না। আমরা গাছে নিচে গিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। রস পরতো জিভে টুপ টাপ। কতদিন ঘনটার পর ঘনটা কেটে গেছে রসাস্বাদনে। মোবাইল ছিলো ন।,ফেসবুক ছিলো না। কোনো পাকামি ছিলো না।সহজ সরল হাওয়া ছিলো। ভালোবাসা ছিলো। আনন্দ ছিলো জীবনে। ব্লু হোয়েলের বাপ পর্যন্ত আমাদের সমীহ করে চলতো। কোনোদিন বাল্যকালে আত্মহত্যার খবর শুনিনি। সময় কোথায় তখন ছেলেপিলের। যম পর্যন্ত চিন্তায় পরে যেতো বালকদের আচরণে, কর্ম দক্ষতায়। আমাদের একটা বন্ধু দল ছিলো । পুজোর সময় রাত জেগে ঘুরতুম কোলকাতার অলিগলি । হাওড়া ব্রিজ থেকে শিয়ালদহ । পায়ে হেঁটে । গোল হয়ে প্রাচী পেরিয়ে হাঁটার নেশায় চলে আসতাম আবার কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে সোজা কলেজ স্কয়ার । জীবনের তিরিশটা বছর তিল তিল করে খরচ করেছি আনন্দের খোঁজে। অসীম বলে সীমাহীন আনন্দের ছেলেটা গান গাইতো সুন্দর । বিচ্ছু বলে বন্ধুটা ভালোবাসতো অপলক মায়া জড়ানো চোখের সুন্দরী কে । তাকে দেখলেই বিচ্ছু ওথেলো হয়ে যেতো ।অমিত রান্না করতো খুব ভালো । পুরী আর দীঘাতে ওর হাতের রান্না খেয়ে আনন্দিত আমরা ওকে একটা জামা উপহার দিয়েছিলাম । ও শেফ হতে চেয়েছিলো । অনিন্দিতা বলে বান্ধবী টা আমাদের মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলো । কিন্তু সব স্বপ্ন গুলো বিস্ফারিত চোখের কাছে থমকে গিয়েছিলো ।অই বন্ধুরা একত্রে সমাজ সেবার প্রচেষ্টায় আছে । রাস্তার অভুক্ত মানুষের মুখে একটু নুনভাত জোগানোর জন্য ওরা ভিক্ষা করে, জীবনমুখী গান শুনিয়ে । অসীম গান করে,বিচ্ছু একতারা বাজায় । অমিত আর অনিন্দিতা সুরে সুর মিলিয়ে স্বপ্ন দেখে । ওরা এখনও স্বপ্ন দেখে । হয়তো চিরকাল দেখে যাবে থমকা লাগা স্ট্যাচুর পলক..ছোটোবেলার রায়পুকুরের রাধা চূড়ার ডালটা আজও আমায় আহ্বান করে হাত বাড়িয়ে । এই ডাল ধরেই এলোপাথারি হাত পা ছুড়তে ছুড়তে সাঁতার শিখেছি আদরের পরশে । ডুবন্ত জলে যখন জল খেয়ে ফেলতাম আনাড়ি চুমুকে, দম শেষ হয়ে আসতো তখন এই ডাল তার শক্তি দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরতো অক্লেশে । হয়তো পূর্ব জন্মে আমার দিদি হয়ে যত্ন আদর করতো এই ডালটা । কোনোদিন তাকে গাছ মনে করিনি আমি ।এখনও জল ছুঁয়ে আদরের ডাক শুনতে পাই পুকুরের ধারে গেলে । রাধা নামের মায়াচাদর জড়ানো তার সবুজ অঙ্গে ।ভালো থেকো বাল্য অনুভব । চিরন্তন প্রকৃতির শিক্ষা অঙ্গনে নাম লিখে যাক নব নবীন শিক্ষার্থী প্রবাহ ।আমার স্বপ্নের সুন্দর গ্রামের রাস্তা বাস থেকে নেমেই লাল মোড়াম দিয়ে শুরু ।দুদিকে বড় বড় ইউক্যালিপ্টাস রাস্তায় পরম আদরে ছায়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে । কত রকমের পাখি স্বাগত জানাচ্ছে পথিককে । রাস্তা পারাপারে ব্যস্ত বেজি , শেয়াল আরও অনেক রকমের জীবজন্তু।.চেনা আত্মীয় র মতো অতিথির কাছাকাছি তাদের আনাগোনা । হাঁটতে হাঁটতে এসে যাবে কদতলার মাঠ। তারপর গোকুল পুকুরের জমি, চাঁপপুকুর, সর্দার পাড়া,বেনেপুকুর । ক্রমশ চলে আসবে নতুন পুকুর, ডেঙাপাড়া ,পুজোবাড়ি, দরজা ঘাট, কালী তলা । এখানেই আমার চোদ্দপুরুষের ভিটে । তারপর ষষ্টিতলা ,মঙ্গল চন্ডীর উঠোন , দুর্গা তলার নাটমন্দির । এদিকে গোপালের মন্দির, মহেন্দ্র বিদ্যাপীঠ, তামালের দোকান, সুব্রতর দোকান পেরিয়ে ষষ্ঠী গোরে, রাধা মাধবতলা । গোস্বামী বাড়ি পেরিয়ে মন্ডপতলা । এই মন্ডপতলায় ছোটোবেলায় গাজনের সময় রাক্ষস দেখে ভয় পেয়েছিলাম । সেইসব হারিয়ে যাওয়া রাক্ষস আর ফিরে আসবে না ।কেঁয়াপুকুর,কেষ্টপুকুরের পাড় । তারপর বাজারে পাড়া ,শিব তলা,পেরিয়ে নাপিত পাড়া । এখন নাপিত পাড়াগুলো সেলুনে চলে গেছে । সাতন জেঠু দুপায়ের ফাঁকে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরতেন মাথা ,তারপর চুল বাটি ছাঁটে ফাঁকা । কত আদর আর আব্দারে ভরা থাকতো চুল কাটার বেলা ।এখন সব কিছুই যান্ত্রিক । মাঝে মাঝে কিছু কমবয়সী ছেলেমেয়েকে রোবোট মনে হয় । মুখে হাসি নেই । বেশ জেঠু জেঠু ভাব ।সর্বশেষে বড়পুকুর পেরিয়ে পাকা রাস্তা ধরে ভুলকুড়ি । আর মন্ডপতলার পর রাস্তা চলে গেছে খাঁ পাড়া , কাঁদরের ধার ধরে রায়পাড়া । সেখানেও আছে চন্ডীমন্ডপতলা , কলা বা গান, দুর্গা তলার নাটমন্দির সব কিছুই । পুজোবাড়িতে গোলা পায়রা দেখতে গেলে হাততালি দিই ।শয়ে শয়ে দেশি পায়রার দল উড়ে এসে উৎসব লাগিয়ে দেয়। পুরোনো দিনের বাড়িগুলি এই গ্রামের প্রাণ ।এই গ্রামে ই আমার সবকিছু , আমার ভালোবাসা, আমার গান।ছোটোবেলার সরস্বতী পুজো বেশ ঘটা করেই ঘটতো । পুজোর দুদিন আগে থেকেই প্রতিমার বায়নাস্বরূপ কিছু টাকা দিয়ে আসা হত শিল্পী কে ।তারপর প্যান্ডেলের জোগাড় । বন্ধুদের সকলের বাড়ি থেকে মা ও দিদিদের কাপড় জোগাড় করে বানানো হত স্বপ্নের সুন্দর প্যান্ডেল । তার একপাশে

বানানো হত আমাদের বসার ঘর । পুজোর আগের রাত আমরা জেগেই কাটাতাম কয়েকজন বন্ধু মিলে। কোনো কাজ বাকি নেই তবু সবাই খুব ব্যস্ত । একটা ভীষণ সিরিয়াস মনোভাব । তারপর সেই ছোট্ট কাপড়ের পাখির নিড়ে কে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম তা কেউ জানতে পারতাম না । মশার কামড়ও সেই নিশ্চিন্ত নিদ্রা ভাঙাতে পাড়তো না ।তবু সকালে উঠেই মচকানো বাঁশের মত ব্যস্ততার আনন্দ । মা বাবার সাবধান বাণী ,ডেঙ্গু জ্বরের ভয় কোনো কিছুই আমাদের আনন্দের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি । হড়কা বানে যেমন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে , আমাদের আনন্দ ঠিক আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত মহানন্দের জগতে । এরপরে সকাল সকাল স্নান সেরে ফলমূল কাটতে বসে পড়তাম বাড়ি থেকে নিরামিষ বঁটি এনে । পুরোহিত এসে পড়তেন ইতিমধ্যে । মন্ত্র তন্ত্র কিছুই বুঝতাম না । শুধুমাত্র বুঝতাম মায়ের কাছে চাইলে মা না করতে পারেন না । পুষ্পাঞ্জলি দিতাম একসঙ্গে সবাই । জোরে জোরে পুরোহিত মন্ত্র বলতেন । মন্ত্র বলা ফাঁকি দিয়ে ফুল দিতাম মায়ের চরণে ভক্তিভরে । তারপরে প্রসাদ বিতরণের চরম পুলকে আমরা বন্ধুরা সকলেই পুলকিত হতাম । প্রসাদ খেতাম সকলকে বিতরণ করার পরে ।আমাদের সবার প্রসাদে ভক্তি বেশি হয়ে যেত ,ফলে দুপুরে বাড়িতে ভাত খেতাম কম । সন্ধ্যা বেলায় প্রদীপ ,ধূপ জ্বেলে প্যান্ডেলের ঘরে সময় কাটাতাম । পরের দিন দধিকর্মা । খই আর দই । পুজো হওয়ার অপেক্ষায় জিভে জল । তারপর প্রসাদ বিতরণ করে নিজেদের পেটপুজো সাঙ্গ হত সাড়ম্বরে ।এরপরের দৃশ্য প্রতিমা বিসর্জন । কাছেই একটা পুকুর । রাত হলে সিদ্ধিলাভে(দামীটা না) আনন্দিত হয়ে নাচ তে নাচতে অবশেষে শেষের বাজনা বেজে উঠতো । মা তুই থাকবি কতক্ষণ, তুই যাবি বিসর্জন ।

তার সাথে আমাদের মনটাও বিসর্জনের বাজনা শুনত দুদিন ধরে।সুমন্ত ভট্টাচার্য শুধু একজন যোগ্য বিজ্ঞানী নন। তিনি একাধারে চিকিৎসক, সন্ধানী গোয়েন্দা আবার কিশোর মনো বিজ্ঞান পত্রিকার সহ সম্পাদক । তিনি এক বনেদী পরিবারের সন্তান । পূর্ব বর্ধমান জেলায় পূর্ব পুরুষ রা বাস করতেন । অই বংশের একাংশ আবার জলপাইগুড়ি তে বাস করতেন । কিন্তু কালের প্রবাহে কোনো কিছুই স্থির নয় । এখন কে কোথায় ছিটকে পৃথিবীর কোন জায়গায় আছেন তার সন্ধান করা সহজ কাজ নয় । জয়ন্ত দা বসে বসে এইসব ভাবছেন আর মনে মনে প্রার্থনা করছেন, যে যেখানেই থাকুন, তারা যেনো সবাই সুখে শান্তিতে থাকেন ।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in






অধ্যায় ৬

শহর ছাড়িয়ে গাঁয়ে যাবার রাস্তা দিয়ে একটা রিকশা যাচ্ছে।রিকশাওলা এক রোগাপাতলা ঝাঁকড়াচুলো নওজোয়ান যার পরণে হাফপ্যান্ট, গায়ে রঙীন গেঞ্জি।ওর ঘামে জবজব চেহারা দেখে ব্যথার ছবি নয়, বরঞ্চ কার্টুনের কথাই মনে ভেসে ওঠে।

রিকশায় সমাসীন বদ্রী পালোয়ান, মুঠো পাকানো দুই হাত পেশিবহুল জঙ্ঘার উপর ন্যস্ত।পায়ের কাছে একটা সিন্দুক রাখা আর দুই পা’ এমনভাবে সিন্দুকের মাথায় তুলে দেয়া হয়েছে যে পা’ ভেঙে রিকশা’র তলায় চাপা পড়ুক, সিন্দুকের নীচে চাপা? কখনই নয়।

এখন সন্ধ্যা নামছে তার অর্থহীন সৌন্দর্য নিয়ে।পালোয়ানের গাঁ আসতে এখনও তিন মাইল। ও মুখ বাঘের মত মুখব্যাদান করে বড়সড় হাই তুলল। তারপর নিরাসক্ত ভাবে বলল—এ’বছর ফসল ভাল হয়নি।

কিন্তু রিকশাওলা কৃষিবিজ্ঞান বা অর্থনীতি নিয়ে সেমিনারের মুডে ছিল না।ও চুপচাপ রিকশা চালানোয় মেতে রইল। এবার পালোয়ান সোজাসুজি জিজ্ঞেস করল- কোন জেলার বট হে? তোমাদের দিকে ফসলের কী খবর?

রিকশাওলা পেছন ফিরল না। চোখের ওপর এসে পড়া চুলের গোছা এক ঝটকা মেরে সরিয়ে বলল—ফসল? আমি গেঁয়ো নই ঠাকুর সাহেব। পাক্কা শহুরে।

এটা বলে ও পাছা দুলিয়ে দুলিয়ে জোরে জোরে প্যাডল মারতে লাগল। আগে চলতে থাকা দু’একটা রিকশার কাছে এসে জোরে ঘন্টি বাজাতে লাগল। পালোয়ান আবার অলস হাই তুলে উদাস নয়নে চারপাশের ফসলের হাল দেখছিল।সোয়ারির দিক থেকে কোন সায় না পেয়ে রিকশাওলা হতপ্রভ। শেষে ধোঁস জমানোর চেষ্টায় সামনের রিকশাকে বলল—আবে ও বাঙরু! যা, সর বাঁদিকে।

রিকশাটা বাঁদিকে সরে জায়গা ছেড়ে দিল। ওকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাবার সময় আমাদের রিকশাওলা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল- কোথাকার? গোন্ডা নাকি বহরাইচ জেলা?

রিকশাওলাটি একগাদা পোঁটলাপুঁটলি সমেত সওয়ারি এবং তার পোঁটলারই মত বৌকে বসিয়ে ধীরে ধীরে প্যাডল মারছিল। এই আত্মীয় সম্বোধনে খুশি হয়ে বলল—গোন্ডা জেলার ভাইয়া, তুমি?

শহুরে রিকশাওলা সিনেমার স্টাইলে সিটি বাজিয়ে চোখ নাচিয়ে বলল- তাই তো বলি!



পালোয়ানের কোন হেলদোল নেই। বিরক্ত মুখে বলল—তুমি স্পীড বাড়াও মাস্টার!

রিকশাওলা স্পীড বাড়াতে খাড়া প্যাডল মারতে লাগল এবং তার সঙ্গে বকরবকর।

ঃ এই গোন্ডা-বহরাইচ আর তার আশপাশের রিকশাগুলো এসে এখানকার চালচলন বিগড়ে দিচ্ছে। ডান-বাঁ কাড়-কাঁকুড় জ্ঞান নেই। এদের চেয়ে খড়ের গাদা টানা গরুর গাড়ির বলদও বেশি বুদ্ধি ধরে। আংগ্রেজি বাজারে গিয়ে ‘বিরহা’ গাইতে থাকে। মুচি-মেথরকেও রিকশায় বসিয়ে নেয়, ওদের হুজুর-সরকার বলে ডাকে। কেউ যদি বলে চল মাল এভিনিউ বা ক্রম্পটন স্কোয়ার তো দাঁত কেলিয়ে দেয়। এদের বাপও যদি কখনও এসব জায়গার নাম শুনেছে তো—

পালোয়ান এবার মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল- ঠিক বলেছ মাস্টার!ওদিকের লোকগুলো হতদরিদ্র। ছাতু খায় আর ছোলা চিবিয়ে রিকশা চালায়। চার বছরের মাথায় অসুখে ধরে, তখন আর মাথার ঠিক থাকে না।

রিকশাওলা বড় তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল—এদের ভাব হচ্ছে যে চামড়ি চলি জায়, পর দামড়ি ন জায়। চামড়া ফেটে যাক, কিন্তু একটা ফুটো পয়সাও যেন খরচ না হয়। ব্যাটারা পিঁপড়ের পোঁদ টিপে খায়। গত বছর লু’ চলছিল। এক ব্যাটা রিকশাওলা রাস্তার ওপরেই পটল তুলল। গায়ে গেঞ্জি নেই, কিন্তু ট্যাঁক থেকে বেরোল বাইশ টাকা!

পালোয়ান মাথা নেড়ে বলল—লু’ বড্ড খারাপ; যখন চলে তখন ঘর থেকে বেরোতে নেই।খেয়েদেয়ে দরজা বন্ধ করে পড়ে থাকতে হয়।

কথা তো বেশ কাজের। রিকশাওলা বেশ ডাঁট দেখিয়ে বলল- আমি তো তাই করি। গরমের দিনে খালি সন্ধ্যে নাগাদ সনীমা’র শো’য়ের সময় রিকশা বের করি।কিন্তু ওই শালার গাঁইয়াগুলো! এদের কথা না বলাই ভালো ঠাকুর সা’ব। শালারা জান নিয়ে জুয়ো খেলে! চার আনার জন্যে মুখে ফেনা তুলে গরমের দুপুরে কয়েক মাইল চালিয়ে আসে। এক্কাগাড়ির ঘোড়াও অমন সময় গাছের ছায়া থেকে সরে না; কিন্তু ওই শালারা—

ঘেন্নার চোটে রিকশাওলার মুখে থুতু ভরে যায়, গলা বুজে আসে। পিচ করে থুতু ফেলে ও কথাটা শেষ করে।‘ শালারা একটু গরম হাওয়া লাগতেই রাস্তায় শুয়ে পড়ে’।

এসব কথায় পালোয়ানের আগ্রহ অনেকক্ষণ জুড়িয়ে গেছে। ও চুপ করে রইল। রিকশাওলা গাড়ির স্পীড কমিয়ে বলল—একটা সিগ্রেট খেয়ে নিই?

পালোয়ান নেমে রিকশার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।রিকশাওলা সিগরেট ধরিয়ে খানিকক্ষণ চুপচাপ টানতে থাকল, তারপর গোল গোল রিং ছাড়তে ছাড়তে শুরু করল—ওদিকের গেঁয়োগুলো দিনরাত বিড়ি ফুঁকে দাঁত খারাপ করে।

এবার সেই পেছনের রিকশাটা ওদের ধরে ফেলল। ছেঁড়া ধুতি, খালি গা’। অনেক কষ্টে টেনে টেনে চালাচ্ছে। শহুরেকে ধোঁয়া ছাড়তে দেখে পরম আত্মীয়তার সঙ্গে বলল, ভাইয়া! তুমিও কি গোণ্ডার লোক?

সিগ্রেটে টান দিয়ে ওর জবাব—আবে হট! কী ফালতু বকছিস?

ও বেচারা খিরর খিরর আওয়াজে রিকশা চালিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল।

আজকালকার সেন্টিমেন্টাল লেখকেরা কী জানি কোন স্কুলে পড়েছেন?ওঁরা বলেন, দূঃখ নাকি মানুষকে পরিষ্কৃত করে, শুদ্ধ করে।যত্ত বাজে কথা! সত্যি হল দুঃখ প্রথমে মানুষকে টেনে লম্বা করে। তারপর কষে নিংড়ে নেয়। নিংড়ে নিংড়ে চেহারায় একটা হতভম্ব ভাব আনে। তারপর সেই চেহারায় কিছু সাদা কালো কাটাকুটি এঁকে দেয়। দুঃখ গোন্ডাওয়ালা রিকশার সঙ্গে তাই করেছে।কিন্তু শহুরে রিকশার এতে কিছু যায় আসে নি। ও সিগ্রেট ছুঁড়ে ফেলে নির্বিকার ভাবে রিকশায় উঠে স্পীড বাড়ায়। ফের শুরু হয় ওর দ্বিতীয় লেকচার।

“আমার কথা হল, ঠাকুর সা’ব, -চোখা কাম, চোখা দাম। আট আনা বলে সাত আনায় রফা করি না।একবার যা বলেছি তা বলেছি। সেবার এক সাহেব আমার পেছনে বসে ঘরের হালচাল শুধোতে লাগলেন।বললেন, সরকার তোমাদের এই অবস্থার জন্যে দায়ি। রিকশা-টিকশা বন্ধ হওয়া উচিত। মানুষের ঘাড়ে মানুষ চড়ে! বড় লজ্জার কথা।বললাম, তো না চড়লেই হয়। উনি বললেন, নাচড়লে বা রিকশা একেবারে বয়কট করলে রিকশাওলারা যে না খেয়ে মরবে।ওর রিকশাওলাদের হাল নিয়ে কান্নাকাটির আর শেষ হয়না। কত কী বলল! সরকারকে কষে গাল দিল। বলল, শোন! তোমরা ইউনিয়ন বানাও। তারপর সরকারের কাছে মোটরেচলা রিকশার দাবি কর।আরও কত কী যে বলল।কিন্তু ঠাকুর সায়েব, আমিও ভেবে নিলাম। ব্যাটা চালিয়ে যা! রিকশাওলার দুঃখে কেঁদে ভাসিয়ে দে। কিন্তু নামার সময় আট আনার থেকে এক পাই কম নেব না”।

পালোয়ানের চোখ বুঁজে গেছল। এবার হাই তুলে বলল, ‘ কোন সিনেমার গানটান আসে? নাকি খালি বগর বগর’?

-দুটোই তো কাজ ঠাকুর সায়েব, রোজ সিনেমা দেখা আর সিগ্রেট ফোঁকা। গান শুনিয়ে দিতাম, কিন্তু আজ গলাটা খারাপ।

পালোয়ান হেসে উঠল,” তবে আর কি! শহরের নাম ডুবিয়ে ছাড়লে”।

রিকশাওলা এই অপমান শান্তভাবে হজম করে ফেলে ধীরে ধীরে ‘লারে লাপ্পা, লারে লাপ্পা, লাই রাখদা’র সুর ভাঁজতে লাগল। পালোয়ান পাত্তা দিল না। সোয়ারির উৎসাহ নেই দেখে ফের ওর গল্প শুরু হল। “আমার ভাইও রিকশা চালায়, কিন্তু কেবল বিশেষ বিশেষ মহল্লার সোয়ারি নেয়। একবার এক সুলতানপুরী রিকশাওলাকে ও সোয়ারি ধরারা দু’চারটে দাঁও প্যাঁচ শিখিয়েছিল।বেচারা কাঁদতে লাগল।বলল, আমার প্রাণ যাক, কিন্তু ধরম ভ্রষ্ট হব না।এ’সব কাজের জন্যে সোয়ারি নেব না। আমি বললাম, ছাড়ান দাও ভাইয়া। কেন গাধা পিটে ঘোড়া করতে চাও”?

শিবপালগঞ্জ এল বলে। পালোয়ান রিকশাওয়ালাকে পরামর্শ দেয়ার ঢঙে বলল,’তুমি মানুষটা মন্দ নও।সবার সঙ্গে গলাগলি করার দরকার নেই। কিন্তু তোমার স্বাস্থ্য বড্ড ঢিলেঢালা। কয়েকমাস ডনবৈঠক কর। তারপর দেখবে’।

“ কী আর দেখব? আমিও পালোয়ান হয়ে যাব।কিন্তু আজকাল পালোয়ানিতে কোন দম নেই। যুদ্ধে যখন আকাশ থেকে বোমা পড়ে, তখন মাটিতে বড় বড় পালোয়ান চিৎ হয়ে যায়।হাতে একটা পিস্তল থাকলে পালোয়ান হলেই কি আর না হলেই কি”!

পালোয়ান গম্ভীর।

একটু থেমে রিকশাওলা ফের বলল,’পালোয়ানি তো আজকাল গেঁয়ো ব্যাপার, ঠাকুর সাহাব। আমাদের শহরে এখন ছোরাছুরির চল হয়েছে’।

হঠাৎ বদ্রী পালোয়ানের অপমানের বোধ হল। ও হাত বাড়িয়ে রিকশাওলার গেঞ্জির কোনা ধরে একটান মেরে ধমকে উঠল,” আবে, তখন থেকে কী ঠাকুর সা’ব ঠাকুর সা’ব কচ্ছিস, জানিস না আমি বামুন”?

রিকশাওলা এই খবরে ভীষণ চমকে উঠল। তারপর চেহারায় সর্বোদয় আন্দোলনের ভাব এনে বলল,” ঠিক আছে, পন্ডিতজী, ঠিক আছে”।

তারপর ও রাস্তার ধারের প্রকৃতির শোভা দেখায় মগ্ন হয়ে গেল।

রামাধীনের পুরো নাম বাবু রামাধীন ভীখমখেড়ভী । মানে ভীখমখেড়া নিবাসী। (যেমন হিন্দি সিনেমার অনেক গীতের রচয়িতা শাহির লুধিয়ানভী হলেন লুধিয়ানা নিবাসী শাহির)। ভীখমখেড়া ছিল শিবপালগঞ্জের সঙ্গে জোড়া লাগা একটা গাঁ যা প্রাচীন ‘গ্রীস-মিশর-রোম’ এর মতন আজকাল দুনিয়া থেকে গায়েব হয়ে গেছে। মানে ঠিক হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি, কিন্তু শিবপালগঞ্জের লোকজন বোকার মত ভাবে- ওটা গায়েব হয়ে গেছে ।ভীখমখেড়া গ্রাম আজও আছে; বেঁচে আছে গোটাকয় ঝুপড়ি, মালবিভাগের কাগজপত্তর আর রামাধীনের পুরনো কবিতায়। ছোটবেলায় বাবু রামাধীন ভীখমখেড়া গাঁ থেকে বেরিয়ে রেললাইন ধরে চলতে চলতে শহরে পৌঁছে গেছলেন। তারপর সেখান থেকে কোন একটা ট্রেনে চড়ার প্ল্যানিং করে শেষে এক বিনা প্ল্যানিংযাত্রায় কোলকাতা পৌঁছে গেলেন। সেখানে উনি প্রথমে কোন এক ব্যবসায়ীর আড়তের চিঠিপত্তর যথাস্থানে পৌঁছে দেয়ার কাজে জুটে গেছলেন। তারপর লেগে গেলেন ওনার মালপত্তর সাপ্লাই করার কাজে। এরপর উনি শেঠজির পার্টনার হয়ে গেলেন এবং শেষে ওঁর কারবারের একচ্ছত্র মালিক।

কারবারটা ছিল আফিম সাপ্লাইয়ের। কোলকাতায় কাঁচা আফিম আসতো পশ্চিম দেশ থেকে, সেটা নানান কায়দায় সেখানকার বড় বড় ব্যবসায়ীদের গদীতে পোঁছে দেয়ার আড়তিয়া হলেন বাবু রামাধীন।তারপর এগুলো দেশের বাইরে পাচার করার কাজটাও উনি নিজের হাতে নিতে পারতেন। কিন্তু ওঁর কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। চুপচাপ নিজের আড়ত সামলাতেন আর বাকি সময় পশ্চিমা দেশোয়ালি ভাইদের সঙ্গে মশগুল থাকতেন।সেই সব আড্ডায় ভাই-বেরাদরদের মধ্যে ওনার ভারি নামডাক। লোকে ওঁর শিক্ষার অভাবের তারিফ করত আর অন্যদের উদাহরণ দিত যে আকবার বাদশা’ও তো অশিক্ষিত ছিলেন। কিন্তু কেমন মজবুত ও দক্ষ প্রশাসক!

আফিমের কারবারে আমদানি বেশ ভালই ছিল, আর এটায় অন্যদের সঙ্গে বেশি কম্পিটিশনও ছিল না। তবে এই ব্যবসায় একটা ছোট্ট খারাপ ব্যাপার ছিল; তা’হল এই কারবারটা বে-আইনি। এ’নিয়ে কথা উঠলে রামাধীন ইয়ারদোস্তদের বোঝাতেন—আমি কী করব? আইন তো আমাকে জিজ্ঞেস করে পাশ হয়নি।

একদিন যখন ধরা পড়ে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে পেশ হলেন, তখনও তাঁর সেই একই কথা, একই ভাব। উনি ইংরেজি আইনের নিন্দেমন্দ করে মহাত্মা গান্ধীর উদাহরণ দিয়ে বোঝালেন যে বিদেশি আইন খামখেয়ালি ঢংয়ে বানানো হয়েছে। যত ছোট ছোট খামতি – সবই অপরাধ! বললেন, ‘জনাব, আফিম হয় একটা ছোট্ট চারাগাছ থেকে। চারাগাছ একটু মাথা তুললে তাতে খুব সুন্দর সাদা ফুল ফোটে—ইংরেজিতে বলে পপি। ওর একটু অন্যরকম চারা থেকে লাল ফুল বেরোয়।সাহেবরা ওগুলোকে বাঙলোর বাগানে লাগিয়ে থাকেন। এর একটা তিননম্বর জাতভাই আছে, যার নাম ‘ডবুল পপি’।হুজুর, এসব হল ফুল-পাতার কাহিনী, এর মধ্যে অপরাধটা কোথায়?ওই সাদারঙের পপির গাছ থেকে পরে কালো কালো একরকম জিনিস বেরোয়। সেটা ওষুধ বানাতে কাজে লাগে। এর ব্যবসা অপরাধ? হতেই পারে না। যে আইনে একে অপরাধ বলা হয়েছে সেটা কালা কানুন; আপনার আমার সর্বনাশের জন্যে তৈরি’।

এই লেকচারের ফলে বাবু রামাধীনের দু’বছরের জেল হল। সেটা ইংরেজ জমানা, তখন এতে শাস্তি তো হতই। কিন্তু আসল সাজা হল এজলাসে ওই লেকচারটার জন্যে।বাবু রামাধীন জানতেন যে আদালতে এমন লেকচার দিয়ে অনেক বিপ্লবী এবং অহিংসাপন্থীরা এর আগে শহীদ হয়েছেন। ভাবলেন, উনিও লেকচারের সুবাদে চটপট শহীদ হবেন। কিন্তু জেল খেটে বেরিয়ে আসার পর বুঝতে পারলেন ভুল হয়ে গেছে।সহজে শহীদ হওয়ার জন্যে আফিম নয়, লবণ আইন ভাঙা উচিত ছিল। কিছুদিন কোলকাতায় ঘোরাঘুরি করে দেখলেন যে উনি বাজার থেকে আউট হয়ে গেছেন। শেষে মনের দুঃখে একটি ‘শের’(দ্বিপদী পদ্য) আউড়ে সোজা নিজের গাঁয়ে ফিরে এলেন, এবার রেলের টিকিট কেটে। তখন থেকে উনি শিবপালগঞ্জে শেকড় গেড়ে বসেছেন।

লোকজনকে সত্যি কথাই বলেছিলেন—ওনার আড়ত বন্ধ হয়ে গেছে। এটুকু বলাই যথেষ্ট। এরপর উনি ছোটখাটো কাঁচাপাকা বাড়ি বানালেন, কিছু খেত কিনে চাষের কাজ শুরু করলেন, গাঁয়ের ছেলেছোকরাদের কড়ির বদলে তাসের জুয়ো খেলায় হাতেখড়ি দিলেন, তারপর দরজার কাছে খাটিয়ায় আধশোয়া হয়ে কোলকাতার কিসসা শুনিয়ে বিশেষ খ্যাতি কুড়োলেন। তখনই গ্রাম-পঞ্চায়েত শুরু হল। উনি কলকাত্তাই কেরামতি দেখিয়ে এক খুড়তুতো ভাইকে তার সভাপতি বানিয়ে দিলেন। গোড়াতে লোকে বোঝেনি যে সভাপতি ব্যাপারটা কী? তাই ওর ভাইকে কোন ইলেকশনে দাঁড়াতে হয়নি। কিছুদিন বাদে লোকজন জেনে গেল যে পঞ্চায়েতে সভাপতি দু’জন। জমির পাট্টা দেবার সভাপতি হল বাবু রামাধীন, আর তবিল তছরূপের দায়ে জেলে যাবার সভাপতি ওনার খুড়তুতো ভাই।

একসময় বাবু রামাধীনের খুব বোলবোলাও ছিল। ওঁর ঘরের সামনে একটা খাপরা ছাওয়া বাংলোবাড়ি পড়ে ছিল, যার একপাশে গাঁয়ের নবযুবকেরা জুয়ো খেলত, অন্যদিকে চলত তাজা ভাঙের পাতা বেটে ভাঙ ঘোঁটার কাজ। একেবারে কবিত্বময় পরিবেশ। উনি ওই গাঁইয়ে প্রথম ক্যায়না, নেস্টারশিয়াম, লার্ক্সপার ইত্যাদি বিলেতি ফুল লাগিয়েছিলেন। ওর মধ্যে কিছু লাল রঙের ফুল ছিল। তাদের দেখে কখনও কখনও উনি অস্ফুটস্বরে বলতেন- এ হল পপি; আর ওটা সসালা ডবুল পপি।

ভীখমখেড়ভী(ভীমখেড়ীওলা) নামের থেকেই স্পষ্ট যে উনি কবিও বটেন। এখন না হলেও কোলকাতা বাসের ‘অচ্ছে দিন’গুলোয় কখনও কখনও উনি ‘শায়র’ হয়ে যেতেন।

উর্দূ কবিদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল ওঁদের জন্মভূমির প্রতি ভালবাসা।এই জন্যেই বোম্বাই বা কোলকাতা গেলেও ওঁরা নামে পেছনে নিজের গাঁ বা মহল্লার নামের লেজুড় লাগিয়ে ঘুরে বেড়ান, কোন অস্বস্তি হয়না।নিজেদের গোণ্ডভী, সলোনভী এবং অমরোহভী বলে ওঁরা বোম্বাই কোলকাতার কুয়োর ব্যাঙদের ইশারায় বুঝিয়ে দেন যে গোটা দুনিয়া খালি বোম্বাই নয়, যেখানে বোম্বাই আছে, সেখানেই গোন্ডাও রয়েছে।

এক হিসেবে এটা ভাল, কারণ জন্মভূমি-প্রেম থেকেই দেশপ্রেম জন্মায়।যার বোম্বাইয়ের পথেঘাটে নিজেকে ‘স্যান্ডালভী’ বলতে সংকোচ হয়না, শুধু সেই পারে পাঞ্জাবী -পাজামা পরে মুখে চারটে পান আর চার লিটার পিক ঠুঁসে নিউ ইয়র্কের ফুটপাথে নিজের দেশের সভ্যতার পতাকা উঁচুতে তুলে ধরতে। যে কোলকাতায় এসে নিজেকে ‘বারাবাঁকিভী’ (বারাবাঁকিওয়ালে)বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পায়, সে বিলেতে গিয়ে নিজেকে ‘হিন্দুস্থানী’ বলতে নিঘঘাৎ তোতলাবে।

এই নীতি মেনে বাবু রামাধীন কোলকাতায় নিজের ইয়ারদোস্তের কাছে ‘রামাধীন ভীমখেড়ভী’ বলেই পরিচিত ছিলেন।

এসব ছিল দানিশ টান্ডভীর সঙ্গে ওঠাবসার ফল। টান্ডভীর দেখাদেখি উর্দূ কবিতায় রুচি হল। আর কবিতায় রুচির প্রথম ধাপ হল কবিতা লেখা। তাই অন্যের দেখাদেখি উনি একদিন একটি শের লিখে ফেললেন। টান্ডভী সায়েব ওটা শুনে নিয়মমাফিক বললেন—বেশ বলেছ ভায়া!

কিন্তু রামাধীন খাপ্পা,’ আমি শের বলিনি তো, লিখেছি।’

--বাজে কথা, শের কেউ লেখে না, পড়ে বা বলে।

--আমি তো লিখেছি।

----না, তুমি শের শুনিয়েছ, বা বলেছ। এটাই দস্তুর।

এরপ্পর উনি রামাধীনকে শের পড়ার কিছু জরুরী নিয়মকানুন শেখালেন।

এক, শায়রী (পদ্য) হবে মুহাবরার (প্রবাদের)হিসেবে, মুহাবরা শায়েরীর হিসেবে চলবে না। দুই, শায়রের উপনাম কী হবে? টন্ডবীর মতে ইমান শিবপালগঞ্জী কেমন হবে?না,না, ইমান-টিমান(নীতি ধর্ম)চলবেনা। কারণ, শব্দটির মানে রামাধীনের জানা নেই।‘শিবপালগঞ্জী’ কী করে হবে, ওনার গাঁয়ের নাম তো ভীখমখেড়া? আর উপনামের ব্যাপারটাই ওনার মনঃপুত নয়, কারণ আফিমের চোরাকারবারে এমনিতেই ওঁর অনেকগুলো উপনাম চলছে, আর সংখ্যা বাড়িয়ে কী হবে? শেষে উনি শের-শায়েরীর কাব্যময় দুনিয়ায় বাবু রামাধীন ভীখমখেড়ী হয়েই রয়ে গেকেন।

“সাঁঝের বেলায় চোখ মেরে যায় কেলটে মেয়ের দল”,-- এমনি এক মুখড়ার কবিতা উনি আফিম কৌটোর উপর লিখে ফেললেন।(আসলে এটি সন্ধের সময় আফিমের কালো কালো দানার হাতছানির কাব্যিক মেটাফর!) তবে ওঁর কাব্যচর্চা দানিস টান্ডবীর আশেপাশেই থমকে রইল। ভেবেছিলেন জেলে গিয়ে অনেক মহান সাহিত্যিকের মত উনিও কোন অমর রচনা করে জেলে থেকে বেরিয়ে আসার পর এক লম্বা চওড়া ভুমিকা ফেঁদে জনতার দরবারে পেশ করবেন, কিন্তু দু’বছরের কারাবাসের দিনগুলো খাবার নিয়ে নালিশ, কয়েদিদের সঙ্গে ঠাট্টা তামাশা, এবং ওয়ার্ডারের গালি শুনে ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে কেটে গেল।

শিবপালগঞ্জে ফেরার পর ‘গঞ্জহা’ লোকেদের সামনে নিজের দম দেখানোর উদ্দেশে উনি আবার নামের সঙ্গে ‘ভীখমখেড়ী’ উপাধিটি জুড়ে নিলেন। কিছুদিন পরে উনি যখন এই গাঁয়ের বা সমগ্র ভারতের সংস্কৃতির প্রভাবে দলবাজির শিকার হলেন, তখন দু’একবার দু’চার লাইন পদ্য লিখে লোকজনকে বুঝিয়ে দিলেন যে ‘ভীখমখেড়ী’ শব্দটি শুধু ভুগোলের নয়, কাব্যজগতেরও আত্মীয় বটে।

কিছুদিন আগে বদ্রী পালোয়ান শিবপালগঞ্জের দশমাইল দূরে একটা গম পেষার কল লাগাল। যখন ওই আটা-চাক্কি ভালই চলতে লাগল, তখন বৈদ্যজীর বিরোধীরা বলতে লাগল যে এর সম্বন্ধ মনে হয় কলেজের বাজেটের সঙ্গে রয়েছে। রামাধীন ওই জনগণের ভাবনাটিকে এই দ্বিপদীর ছন্দে বাঁধলেন।

দেখ ভীখমখেড়ী দেখ, ভগবানের ছল,

খুলতে গেল কলেজ, খুলল আটা পেষার কল।।



গাঁয়ের বাইরে কেউ বদ্রী পালোয়ানের রিকশা থামাতে বলছে। সন্ধ্যের আলোআঁধারিতে চেহারা চেনা যাচ্ছে না। পালোয়ান বলল, ‘কৌন হ্যায় বে?’

--আবে -তাবে কোর না পালোয়ান, আমি রামাধীন।

বলতে বলতে একজন এসে রিকশার হ্যান্ডল ধরে দাঁড়াল। রিকশাওলা রাস্তার ঠিক মাঝখানে গাড়ি দাঁড় করিয়েছে। লোকটির পরনে ধুতি পাঞ্জাবি, কিন্তু আধো অন্ধকারে ওর মুন্ডিত মস্তক চেনা যাচ্ছে। ও বলল, ‘শুনেছ, আমার ঘরে নাকি ডাকাতি হবে?’

পালোয়ান পিঠে এক আঙুলের খোঁচা মেরে এগিয়ে যাওয়ার ইশারা করল।তারপর বলল,’ এখন থেকেই কেন চিঁ-চিঁ শুরু করেছ? যখন হবে তখন আমায় ডেকে নিও’।

রিকশাওয়ালা প্যাডলে চাপ দিল, কিন্তু রামাধীন এমন কষে হ্যান্ডল ধরে রেখেছে যে রিকশা নট নড়ন চড়ন, নট কিস্যু।

পালোয়ান ভনভনিয়ে বলল, ‘আমি ভাবছিলাম -এটা আবার কে? মাঝরাস্তায় রিকশা আটকিয়ে রাঁড়ের মত নাকে কান্না জুড়েছে”!

রামাধীন বলল, ‘ছিঁচকাদুনে নই, নালিশ করতে এসেছি’। বৈদ্যজীর পরিবারে তুমিই একমাত্র মানুষের মত, বাকি সব ফালতু। তাই তোমায় বলছি। একটা চিঠি এসেছে।তাতে ডাকাতেরা আমার থেকে পাঁচহাজার টাকা দাবি করেছে। বলেছে অমাবস্যার রাতে দক্ষিণদিকের টিলার উপরে রেখে আসতে হবে।‘

বদ্রী পালোয়ান নিজের উরূতে চাপড় মেরে বলল,’ মন চায় তো দিয়ে এস, না চাইলে একটা ফুটো কড়িও দেবার দরকার নেই। এর বেশি আর কী বলব? চলো রিকশাওয়ালে।

ঘর প্রায় এসে গেছে। এতক্ষণে নিশ্চয় বাইরের রোয়াকে ভাঙ ঘুঁটে তৈরি হয়ে গেছে।এক গেলাস মেরে দিয়ে, চানটান সেরে , কোমরে ল্যাঙট কষে গায়ে পাঞ্জাবি চড়িয়ে আড্ডায় জমিয়ে বসা যাবে। তারপর লোকেরা জানতে চাইবে, “পালোয়ান, কী করে এলে?”

কিন্তু ও চোখ বুঁজে ভাঙের মৌতাত নেবে। উত্তর দেবে না। লোকজনকেই প্রশ্ন ও উত্তর দুটোই চালাতে দেবে। তখন দেহের শক্তি আর ভাঙের নেশায় সব কথাবার্তা মশার ভনভনানি মনে হবে।

স্বপ্নের সাগরে গোঁত্তা খাওয়ার মাঝে মাঝরাস্তায় রিকশা থামানো? বদ্রীর খুব রাগ হল। ও আরেকবার রিকশাওলাকে ধমকে উঠল, “তোমাকে বলেছি না চলো”?

কিন্তু চলো বললেই হয়না, রামাধীনের হাত এখনও রিকশার হ্যান্ডল শক্ত করে ধরে রেখেছে। ও বলল,’ দেখ, টাকা-পয়সার কথা নয়। আমার থেকে কে টাকা আদায় করবে?আমি চাইছি যে তুমি তোমার ভাই রূপ্পনকে ভাল করে কড়কে দাও।বড্ড মাথায় চড়েছে। মাটিতে পা রাখুক, আকাশে উড়তে—‘।

বদ্রী পালোয়ান এবার নিজের উরূতে চাপ দিয়ে রিকশা থেকে লাফিয়ে নামল। তারপর রামাধীনকে টেনে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বলল, “কেন খামোখা মুখ খারাপ করছ? রূপ্পন করেছেটা কী”?

--আমার বাড়িতে ডাকাতির হুমকি ভরা চিঠিটা রূপ্পনই পাঠিয়েছে, প্রমাণ পেয়েছি।

পালোয়ান গজগজ করতে লাগল,--দু’চার দিন বাইরে গেলেও মুশকিল। এদিকে আমি গেছি কি ওদিকে এই তামাশা শুরু’।

তারপর একটু ভাবল, শেষে রামাধীনকে অভয়দান করে বলল,’যখন হাতেনাতে প্রমাণ পেয়েছ, তখন ঘাবড়াচ্ছ কেন?তোমার বাড়িতে ডাকাতি হবেনা। যাও, আরামে ঘুমোও গিয়ে। রূপ্পন ডাকাতি করার বান্দা নয়। চ্যাঙড়া বয়েস, একটু মজা করেছে, আর কি’।

রামাধীন কড়া সুরে বলল, ‘ওটা আমিও বুঝি, রূপ্পন চ্যাঙড়ামি করেছে। কিন্তু এটা কী ধরণের চ্যাঙড়ামি’?

পালোয়ান সায় দিল, ‘ঠিকই বলেছ, বড্ড বেশি ছ্যাবলামো’।

একটা ট্রাক ভীমবেগে তেড়ে আসছে। তার হেডলাইটের আলোয় সবার চোখ ধাঁধিয়ে যেতে বদ্রী রিকশাওলাকে বলল, ‘ রিকশা সরাও, এটা তোমার বাপের রাস্তা নাকি’?

রামাধীন বদ্রীর গলার স্বর চেনে। বলল,’ এটা রাগের কথা নয় পালোয়ান। ভেবে দেখ, এটা কোন কথা হল? ডাকাতির হুমকি দিয়ে চিঠি’!

পালোয়ান রিকশায় উঠে পড়ল।‘ডাকাতি হবে না বললাম তো, ফের তক্কাতক্কি কিসের? চালাও রিকশাওলা’!

রিকশা চলতে শুরু করলে ও বলল,’ রূপ্পনকে বলে দেব। বোঝাব, এসব ইয়ার্কি ভাল নয়’।

রামাধীন চেঁচিয়ে উঠল, ‘ও আমার ঘরে ডাকাতির হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠাল আর তুমি ওকে শুধু বোঝাতে যাবে?বোঝানো না, ওকে ভাল করে জুতোপেটা করা উচিৎ’।

রিকশা গড়গড়িয়ে চলতে লাগল। পালোয়ান মাথা না ঘুরিয়ে জবাব দিল,’ এক কাজ কর। খুব খারাপ লাগলে তুমিও আমার বাড়ির ঠিকানায় পালটা ডাকাতির চিঠি পাঠিয়ে দাও’। (চলবে)

0 comments:

0

গল্প - মনোজ কর

Posted in



 





অষ্টম পর্ব 

ক্লাইভের চন্দননগর দখল  

কলকাতা থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার উত্তরে হুগলি নদীর পশ্চিমপাড়ে ঘাঁটি গেড়ে যখন ব্রিটিশবাহিনী চন্দননগর আক্রমণের জন্য প্রস্তুত তখন গত্যন্তর না দেখে ফরাসিরা সিরাজকে একের পর এক চিঠি পাঠাতে শুরু করল। সিরাজ তখন মুর্শিদাবাদ থেকে প্রায় ষাট কিলোমিটার দূরে। ফরাসিদের বক্তব্য পরিস্কার। সিরাজ যেমন নিজের নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে সজাগ তেমনি ফরাসিদের নিরাপত্তার জন্য তার পদক্ষেপ নেওয়াও ততটাই জরুরি। খবর কানে আসা মাত্রই সিরাজ ব্রিটিশদের জানিয়ে দিল বলা ভাল একরকম আদেশ দিল যে এই অভিযান যেন এই মুহূর্তে বন্ধ করা হয়। 

এদিকে ওয়াট ততক্ষণে সিরাজের অনুরোধ রক্ষার ভান করে কুড়িজন সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। সিরাজ একদিকে যেমন ফরাসিদের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে উদগ্রীব অন্যদিকে ব্রিটিশদেরও দেখাতে চায় যে সে তাদের সঙ্গে আছে। ওয়াটসের সঙ্গে চলেছে ব্রিটিশ অনুগত ব্যবসায়ী এবং সিরাজের খুব কাছের লোক উমাচাঁদ। সিরাজের সঙ্গে ব্রিটিশদের যে কোনও রকম আলোচনায় উমাচাঁদের উপস্থিতি প্রায় আবশ্যিকতার পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। ওয়াটস এখন রাজকীয় কায়দায়তেই চলাফেরা করতে শুরু করছে। ৪০০ টাকা দিয়ে রুপোর কাজ করা হাতলের পালকি তৈরি করা হয়েছে তার জন্য। উমাচাঁদ ওয়াটসের কাছে আগেই পৌঁছেছিল সিরাজের দ্বিচারিতার খবর নিয়ে। অবশ্য ব্রিটিশদের কাছে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু ছিল না কারণ সাম্প্রতিককালে তারা নিজেরাও প্রয়োজনে দ্বিচারিতার আশ্রয় নিয়েছে বেশ কয়েকবার। উমাচাঁদ খবর নিয়ে এল যে একজন ফরাসি দূত গোপনে হুগলির গভর্নর নন্দকুমারের কাছে প্রায় একলক্ষ টাকার উপহারসামগ্রী নিয়ে দেখা করেছে। উমাচাঁদ এ খবরও দিল যে সিরাজ ইতিমধ্যেই নন্দকুমারকে নির্দেশ দিয়েছে যদি ব্রিটিশরা চন্দননগর আক্রমণ করে সে ক্ষেত্রে ফরাসিদের  সহযোগিতা করা জন্য। এই নন্দকুমার পরবর্তীকালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে মহারাজা উপাধিতে ভূষিত হয় এবং ওয়ারেন হেস্টিংসকে সরিয়ে ব্রিটিশ সরকার তাকে বর্ধমান, হুগলি এবং নদীয়ার দেওয়ান পদে অভিষিক্ত করে। 

ব্রিটিশরা আক্রমণের পরিকল্পনা স্থগিত রেখে উমাচাঁদকে পাঠাল নন্দকুমারের কাছে। উমাচাঁদ নন্দকুমারকে জানাল যে কোনও ভাবেই ব্রিটিশদের রোখা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। নন্দকুমার যদি ফরাসিদের সহযোগিতা করে তাহলে ব্রিটিশদের হাতে তার প্রাণসংশয়ের সম্ভাবনা প্রবল। অন্যদিকে নিরপেক্ষ থেকে ব্রিটিশদের সহযোগিতা করলে চন্দননগর জয়ের সঙ্গে সঙ্গে তার হাতে নগদ ১২০০০ টাকা তুলে দেবে ব্রিটিশরা।  ফৌজদার হিসাবে তার মাসিক বেতন যথেষ্ট বেশি হলেও উপরি পাওনার লোভ ছাড়তে পারল না নন্দকুমার। এখনকার মত তখনকার দিনেও উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিকদের ঘুষ নেওয়ার বেশ ভালোই রেওয়াজ ছিল।   

উমাচাঁদ ব্রিটিশদের হয়ে সিরাজের কাছে উমেদারি করার জন্য নাটকের অবতারণা করল। সিরাজের কাছে যখন খবর পৌঁছল যে ব্রিটিশরা চন্দননগর আক্রমণের পরিকল্পনা করছে সে তখন উমাচাঁদকে তার শিবিরে ডেকে পাঠাল। সিরাজ তখনও মুর্শিদাবাদ পৌঁছয় নি। সিরাজ জানতে চাইল ব্রিটিশরা কি গঙ্গাবক্ষে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল তা ভাঙতে চাইছে কি না। উমাচাঁদ শশব্যস্ত হয়ে সিরাজকে আশ্বাস দিতে শুরু করল এই বলে যে এই সব গুজব সর্বৈব মিথ্যা। ব্রিটিশরা জাতিগতভাবে বিশ্বাসী এবং পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসই তাদের উন্নতির কারণ। ব্রিটিশ সমাজে যে কথার খেলাপ করে বা মিথ্যার আশ্রয় নেয় সে সমাজ থেকে বিতাড়িত হয়ে একাকী জীবন যাপন করে।আত্মীয়-পরিজন এবং বন্ধু-বান্ধবেরা তাকে পরিত্যাগ করে। এক স্থানীয় ব্রাহ্মণকে ডেকে তার চরণস্পর্শ করে উমাচাঁদ বলল যে কোনও অবস্থাতেই ব্রিটিশরা চুক্তিভঙ্গ করবে না।উমাচাঁদের নাটক বিশ্বাস করল সিরাজ। সিরাজ জানাল যে ফরাসীদের সাহায্য করার জন্য অর্ধেক সৈন্যবাহিনী নিয়ে চন্দননগর অভিযানের যে আদেশ সে মিরজাফরকে দিয়েছে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে এবং এও জানাল যে ক্লাইভ যেন মনে না করে যে ব্রিটিশ সৈন্যদের তার কাছে পাঠানো হয়েছে তাদের ফরাসীদের সাহায্য করার জন্য ব্যবহার করা হবে। পরের দিন ক্লাইভের চিঠি এসে পৌঁছল সিরাজের কাছে যাতে লেখা আছে সিরাজের সম্মতি ব্যতীত কোনও ভাবেই চন্দননগর আক্রমণ করা হবে না। নিশ্চিন্ত হয়ে সিরাজ মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।   

  এদিকে ওয়াটস এবং উমাচাঁদ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলো। দু’জনে মিলে ব্রিটিশ আদালতে আবেদন জানাল যেন চন্দননগর আক্রমণের পক্ষে সম্মতি দেওয়া হয়। ওদিকে ক্লাইভ সিরাজের অনুমতি ছাড়া চন্দননগর আক্রমণ না করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আদালত কার্যতঃ কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না। ফরাসি প্রতিনিধি ল’ সহজে ছেড়ে দেবার লোক নয়। মানিকচাঁদ এবং খোয়াজা ওয়াজিদ ফরাসিদের পক্ষে তদ্বির শুরু করল। ওয়াজিদ ফরাসিদের সঙ্গে ভালোই ব্যবসা করে। ব্রিটিশরা চন্দননগর দখল করলে সে পথে বসবে। মানিকচাঁদ সিরাজের কলকাতা আক্রমণের সময় যে পরিমাণ টাকা হাতিয়েছে তা ব্রিটিশদের নজরের বাইরে রাখার জন্য ফরাসিদের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। জগৎশেঠের  কাছে ফরাসিদের ধারের পরিমাণ ১৫ লক্ষ টাকা। সুতরাং ফরাসিদের সমর্থন করা ছাড়া জগৎশেঠের আর কোনও উপায় নেই। এই ত্রিশঙ্কু অবস্থার জন্য সকলে সিরাজের দু’দিক  থেকেই অর্থ আহরণের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে ভারসাম্য রাখার প্রচেষ্টাকেই দায়ি করল।  এই প্রচেষ্টার পিছনে যে গভীর অভিসন্ধি আছে সে কথা বুঝতে কারও বাকি রইল না। এই অবস্থা চলতে থাকলো প্রায় ফেব্রুয়ারির শেষ অবধি।

এদিকে দিল্লিতে তখন পালাবদল শুরু হয়েছে। পাঞ্জাব সুবেদার মির মান্নুর স্ত্রী মুঘলানি বেগমের আমন্ত্রণে নাদির শাহের উত্তরাধিকারি আফগান রাজা আহমেদ শাহ দুরানি আর তার ছেলে তিমুর শাহ দুরানি তখন লাহোর, দিল্লি, মথুরা, বৃন্দাবন দখল করে মহম্মদ শাহ এবং আলমগীরের কন্যাদের নিজেদের হারেমে নিয়ে গিয়ে তুলেছে। নিজেরই রক্ষীদের হাতে খুন হয়ে ১৭৪৭ সালের জুন মাসে নাদির শাহের রাজত্বকাল হঠাৎই শেষ হয়ে যায়। দুরানির কাছে খবর আসে নিজের স্ত্রীর হাতে নিহত হয়েছে নাদির শাহ। নাদির শাহের একান্ত অনুগত এবং বিশ্বাসী আবদালি বাহিনীর সেনাপ্রধান দুরানি জীবন বাজি রেখে সৈন্যবাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছোয়। দুরানি জানত যে বিশ্বাসঘাতক রক্ষীরা তার ওপর আক্রমণ করতে পারে তবুও জীবনের মায়া তুচ্ছ করে ঘটনাস্থলে পৌঁছে নাদির শাহের মুন্ড এবং মুন্ডহীন দেহ দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে দুরানি। তারপর নাদির শাহের অনামিকা থেকে শিলমোহর এবং বামবাহু থেকে কোহিনূর খুলে নিয়ে ৪০০০ সৈন্য সহযোগে কান্দাহারে ফিরে এসে নিজেকে রাজা হিসাবে ঘোষণা করে। মুঘল সৈন্যবাহিনী ছেড়ে রোহিল্লা পাঠান সেনাপতি নাজিবুদৌল্লা তখন যোগ দিয়েছে আহমেদ শাহ দুরানির সঙ্গে। সিরাজের কানে এল আহমেদ শাহ দুরানি আর নাজিবুদৌল্লা পূর্ব ভারত আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভীত সন্ত্রস্ত সিরাজ ক্লাইভের কাছে সাহায্যের অনুরোধ জানিয়ে বলল যে সে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর খরচ বাবদ মাসে একলক্ষ টাকা দিতে প্রস্তুত আছে। 

ইতিমধ্যে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ কাম্বারল্যান্ড মাদ্রাজ থেকে বালাসোর এসে পৌঁছেছে। বোম্বে থেকে অতিরিক্ত সৈন্য নিয়ে জাহাজও এসে পৌঁছে গেছে। ক্লাইভের আত্মবিশ্বাস এখন তুঙ্গে। ক্লাইভ সিদ্ধান্ত নিল যে এখনই চন্দননগর আক্রমণের প্রকৃত সময়। ফরাসিদের সঙ্গে গঙ্গাবক্ষে নিরপেক্ষতা রক্ষা করার চুক্তি অর্থহীন। যে সমস্ত ফরাসি আধিকারিকেরা চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য অপেক্ষা করছিল ক্লাইভ তাদের ফেরত পাঠিয়ে সিরাজকে জানাল যে যে মুহূর্তে পাঠানদের এগিয়ে আসার খবর পাওয়া যাবে ব্রিটিশ সৈন্য সিরাজের কাছে পৌঁছে যাবে। ক্লাইভ এও জানাল যে ইতিমধ্যে সে সৈন্যবাহিনী নিয়ে চন্দননগরের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে। ক্লাইভের কাছ থেকে সম্ভাব্য পাঠান আক্রমণের মোকাবিলার প্রতিশ্রুতি পেয়ে সিরাজের তখন চুপ করে থাকা ছাড়া আর কিই বা উপায় ছিল? ব্রিটিশ অনুগত নন্দকুমার সিরাজকে আশ্বাস দিল যে ব্রিটিশদের কোনও অসদুদ্দেশ্য নেই। এদিকে চন্দননগর আক্রমণের ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত ওয়াটসন সিরাজকে বার্তা পাঠাল যে ফরাসিরা সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য গঙ্গাবক্ষে নিরপেক্ষতা বজায় রক্ষার জন্য সিরাজের নাম ব্যবহার করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা সিরাজের মতামত শুনতে চায়। ওয়াটসনের দীর্ঘসূত্রতায় বিরক্ত ক্লাইভ ৪ঠা মার্চ, ১৭৫৭ কাউন্সিলের কাছে অনুরোধ জানাল যে তারা যেন অনতিবিলম্বে অ্যাডমিরাল ওয়াটসনকে জলপথে চন্দননগর আক্রমণের নির্দেশ দেয়। ক্লাইভ এও জানালো যে সে নিজে স্থলবাহিনী নিয়ে প্রস্তুত এবং ওয়াটসনের এই বিলম্ব যদি কোনও দুর্ভাগ্যের কারণ হয় তবে তার জন্য সে দায়ি থাকবে না। তার আবেদন এই যে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন যা গঙ্গাবক্ষে নিরপেক্ষতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে কি না। যদি হয় তাহলে সে নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সৈন্যদের রেখে বাকি বাহিনী নিয়ে মাদ্রাজ ফিরে যাবে। সেক্ষেত্রে কাউন্সিল যেন সৈন্য পরিবহণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়।। ঠিক সেই সময়  সিরাজের চিঠি এসে পৌঁছোল। সরাসরি নিজের মতামত না জানালেও সিরাজ লিখল যে শত্রু যদি তোমার কাছে আন্তরিকতার সঙ্গে ক্ষমাভিক্ষা করে তবে তাকে ক্ষমা করাই উচিৎ। কিন্তু শত্রু যদি ছলচাতুরির আশ্রয় নেয় বা তার আচরণে ও কথায় আন্তরিকতা এবং আসল উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সংশয়ের উদ্রেক হয় তবে সময় এবং পরিস্থিতির বিচারে সঠিক পন্থা অবলম্বন করাই বুদ্ধিমানের কাজ। 

সিরাজের এই উত্তরকে চন্দননগর আক্রমণের ছাড়পত্র হিসাবে ধরে নিয়ে যুদ্ধজাহাজ চন্দননগরের পথে এগিয়ে যাওয়ার আদেশ দিল। স্থলপথে ক্লাইভের বাহিনী আর জলপথে ওয়াটসনের যুদ্ধজাহাজ কেন্ট, টাইগার এবং সালিসবেরির মিলিত আক্রমণে কেঁপে উঠলো চন্দননগর। সেদিনটা ছিল ১৪ই মার্চ, ১৯৫৭। কিন্তু কলকাতা পুনর্দখলের মত চন্দননগর বিজয় অত সহজ ছিল না। ফরাসিরা প্রতিরোধ গড়ে তুলল।বেশ কিছুদিন যুদ্ধ চলার পর বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হল ফরাসিরা। জনৈক বিশ্বাসঘাতক সেনা অফিসারের সহযোগিতায় ক্লাইভের বাহিনী দখল করে নিল চন্দননগর ফোর্ট। ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ প্রাথমিকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হলেও কয়েকদিনের মধ্যেই সমস্ত ফরাসি জাহাজকে হুগলিবক্ষে ডুবিয়ে বীরদর্পে চন্দননগর এসে পৌঁছে গেল। ব্রিটিশ স্থলবাহিনীর ৪০ জন সৈন্য নিহত এবং ৭০ জন আহত হল। যুদ্ধজাহাজ কেন্ট এবং টাইগার মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা ৩২ এবং আহতের সংখ্যা ৯৯। মৃতদের মধ্যে ছিল টাইগারের ভারপ্রাপ্ত ফার্স্ট লেফটেনান্ট স্যামুয়েল পেরু এবং আহতদের মধ্যে ছিল অ্যাডমিরাল পোকক। ফোর্ট দখল করার পর ওয়াটসন, পোকক, ক্লাইভ এবং ক্লিপট্রিক সিলেক্ট কমিটির কাছে চন্দননগর ফোর্ট সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার অনুমতি চেয়ে পাঠায়। তাদের যুক্তি ছিল যে কোনও সময়ে সুযোগসন্ধানী এবং সুবিধাবাদী  সিরাজ তার অবস্থান পরিবর্তন করে ব্রিটিশদের বিরোধিতা করে ফরাসিদের  দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। ফোর্ট ধ্বংস করে চন্দননগরকে ফরাসিমুক্ত করতে পারলে সেই সম্ভাবনা সমূলে বিনষ্ট হবে। শুধু তাই নয় চন্দননগরের মত বর্ধিষ্ণু উপনিবেশ ধ্বংস হলে ফরাসিদের কারখানা ও ব্যবসার ওপরে চরম আঘাত নেমে আসবে। ফলস্বরূপ হুগলিবক্ষে এবং বাংলায় ব্রিটিশরা একচ্ছত্র ব্যবসা চালাতে পারবে। ১৬ই এপ্রিল ১৭৫৭ ব্রিটিশদের হাতে ধ্বংস হয়ে গেল চন্দননগর ফোর্ট। আরও একবার প্রমাণিত হল রাজনীতি এবং যুদ্ধের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য সম্পদবৃদ্ধি ব্যতীত আর কিছু নয়। শিষ্টাচারস্বরূপ 

যুদ্ধশেষে ইউরোপের দুই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দী এবং ভারতের দুই ব্যবাসয়িক প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে স্থির হল ফরাসি কাউন্সিল এবং ফ্যাক্টরির প্রধানেরা কলকাতায় কড়া নজরদারিতে রাজকীয় মর্যাদায় গৃহবন্দি থাকবে এবং বন্দি থাকাকালীন তাদের প্রভূত পরিমাণে আর্থিক ভাতা দেওয়া হবে।

ব্রিটিশদের পরবর্তী পরিকল্পনা কি ইতিমধ্যে স্থির হয়ে গেছে? তলে তলে কি শুরু হয়ে গেছে পলাশিযুদ্ধের প্রস্তুতি? 


0 comments: