প্রবন্ধ - সেবিকা ধর
Posted in প্রবন্ধবন্ধু শব্দটি অনেক ব্যাপক।বন্ধু আকাশ হয়ে থাকে আমাদের মাথার ওপর।ছায়া হয়ে তা যেন আমাদের ছায়া দিতে থাকে অনবরত। সেই বন্ধুতার আকাশকে প্রসারিত করার জন্য অনেক অনেক প্রয়াস আমাদের জীবন বহমান।আমরা একজন ভালো বন্ধুকে সবসময় পেতে চাই। কিন্তু সঠিক বন্ধুত্বের সংজ্ঞা নিরূপণ করা কঠিন।কেননা বন্ধু হচ্ছে সেই, যে আমার দুঃখে, বিষাদে, কষ্টে, আনন্দে, আহ্লাদে, মৃত্যু এবং জীবনের ছন্দে পাশে থাকবে।সঙ্গে থাকবে ,পিঠে হাত বুলিয়ে দেবে,বুকে হাত বুলিয়ে দেবে, স্পর্শ করবে, নয়তো প্রলেপ দেয় আমাদের কথায়, আমাদের শোকে, বন্ধু সেই। বন্ধুর বিপ্রতীপে আছে শত্রু।তার ব্যাপারে আমরা উপসংহারে কথা বলব।শত্রুদের নিয়েও আমাদের জীবন-যাপনে অনেক তরঙ্গ ওঠে।শত্রুকে চিহ্নিত করা কর্তব্য এবং তাকে সতর্ক করাও কর্তব্য।আবার বন্ধু শত্রু হয়ে যায়।এমনও আছে যে ছিল পরম বন্ধু সেও পরম শত্রু হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় মুখ দেখাদেখি। এবং তারফলে মনের ভেতর তৈরি হয় এক অভূতপূর্ব নীল বেদনার তরঙ্গ।আমরা আমাদের এই কথাবার্তায় এই সাহিত্য যাত্রাপথে খানিকটা বন্ধুত্ব,খানিকটা শত্রুতা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছি।
জীবনের চলার পথে আমরা অনেক মানুষের সাথে পরিচিত হই কেউ আমাদের অনেক বহু কাছের বন্ধু হয়ে যায় আবার কেউ শত্রু। বাস্তব জীবনে চলতে হলে আপনি কখনোই একা চলতে পারবেন না। জীবনে চলার পথে আপনার বন্ধুর প্রয়োজন হবে। আর পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মানুষের অনেক বন্ধুই থাকে। কিন্তু সব বন্ধুই প্রকৃত হয় না। একজন বন্ধুকে চিনতে হলে আপনার অবশ্যই বিপদে পড়তে হবে। আপনি যদি বিপদে পড়েন তাহলেই বোঝা যাবে কে আপনার প্রকৃত বন্ধু আর কে প্রকৃত বন্ধু না। আপনি যখন বিপদে পড়বেন তখন প্রকৃত বন্ধু কখনই আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে না। আর যে আপনার প্রকৃত বন্ধু নয় সে আপনার বিপদে দেখলেই ছেড়ে চলে যাবে।
মানুষের জীবনে বন্ধু অনেককেই থাকে কিন্তু সবাই 'প্রকৃত' হয় না। বিপদে পড়লে অনেক বন্ধু চেনা যায়। প্রকৃত বন্ধু হল এমন একজন যে আপনার হাত কখনই ছাড়বে না সেটা সুখ আর দুঃখ হোক না কেন। আর যারা আপনার বিপদ দেখে ছেড়ে চলে যাবে তারা বন্ধু ছিল না। আমাদের সমাজে প্রত্যেকটা মানুষেরই অনেক বন্ধু থাকে। কিন্তু এর মধ্যে থেকে কে ভালো, কে মন্দ, এটা কেউ বলতে পারবে না। একমাত্র বোঝার উপায় হচ্ছে যদি আপনি বিপদে পড়েন। কেননা বিপদে পড়লে প্রকৃত বন্ধু সঙ্গে থাকে কিন্তু যারা প্রকৃত না তারা কখনই আপনার পাশে থাকবে না। বিপদে পড়লে আপনারা বন্ধু পরিচয় পেয়ে যাবেন।
বন্ধুত্ব জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা। একটা সময়ের পর জীবনকে যেন আমরা বুঝতেই শিখি বন্ধুর হাত ধরে। কিন্তু বন্ধুর সব সংকটে, সব বিপদেই কি আমরা নির্দ্বিধায় পাশে দাঁড়াতে পারি? এমনও তো দেখা যায়, বন্ধুর বিপদে গা বাঁচানর জন্যই আমরা পীঠ দিই। নিজের দোষের কারণে বন্ধু যখন কোনো ঝামেলায় জড়ায়, তখন কি মনে হয় না খামাখা এই ঝামেলায় নিজে না জড়ানই ভালো।
খুবই নির্ভর আর স্বাধীন এ সম্পর্কে সেভাবে ‘কমিটমেন্ট’ শব্দটি উচ্চকিত না থাকলেও, ‘বন্ধু’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু তাদের কথাই মনে হয়, যারা ভালো ও খারাপ সময়ে শর্তহীনভাবে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। তবে এ কথাও ঠিক, বন্ধুকে সাহায্য করার ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় আমরা বুঝে উঠতে পারি না, ঠিক কীভাবে তাকে সাহায্য করব। চাকরিচ্যুতি, সম্পর্কে সমস্যা বা বিচ্ছেদ, অসুস্থতা, পারিবারিক সমস্যা থেকে শুরু করে আইনগত জটিলতা, মামলা, অর্থসংক্রান্ত সমস্যায় ফেঁসে যাওয়া ইত্যাদি নানা জটিলতায় কিন্তু যে কেউ পড়তে পারে।
যেকোনো ধরনের সমস্যা বা বিপদে পড়াই এক ধরনের মানসিক চাপ। এই চাপ কিছুটা হলেও কমান যায় কারও কাছে মনের কথা নির্দ্বিধায় খুলে বললে। কাজেই বন্ধুকে সাহায্য করার প্রথম পদক্ষেপই হবে তার সমস্যার কথা বলতে দেওয়া এবং সম্পূর্ণ মনযোগ দিয়ে তার কথা শোনা। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কোনো ব্যক্তি কিছু শোনার মতো অবস্থায় থাকে না বলে এই সময় কোনো ধরনের মন্তব্য বা বিষয়টার বিশ্লেষণ না করাই ভালো।
বিপদের সময়ে তার দৈনন্দিন কাজে আপনার সামর্থ অনুযায়ী যতটা পারেন সাহায্য করুন। গুজবে কান না দিয়ে বা অন্যের কাছ থেকে না শুনে, সরাসরি বন্ধুকে বিষয়টা নিয়ে জিজ্ঞাসা করুন। তার অবস্থান থেকে তাকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ দিন।
সবকিছু শোনার পর আগে নিজের কাছে পরিষ্কার হোন নৈতিক দিক থেকে বন্ধুর কাজটি সমর্থন না করলেও আপনি তাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত আছেন কিনা। তার কাজের ফলাফলে ভবিষ্যতে যে ঝামেলা বা বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে, সেটার আঁচ আপনি বন্ধুর জন্য নিতে প্রস্তুত কিনা। সম্পূর্ণভাবে বিবেচনা করে সাহায্যের সিদ্ধান্ত নিলে আপনার বন্ধুত্বের হাতটি বাড়িয়ে দিন। আপনি এই বিপদে তার পাশে আছেন, এটা জানানর সঙ্গে সঙ্গে তার এই কাজটির (?) ব্যাপারে আপনার নৈতিক অবস্থান কী তা-ও পরিষ্কারভাবে জানান। কোনোভাবেই বিষয়টা আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে, এই বিষয়ে আপনার মতামত এবং অপারগতা স্পষ্ট করে তাঁকে বলুন।
মুখে বলুন, আচরণে প্রকাশ করুন। তার সঙ্গে বেশি করে দেখা করুন, ফোনে তার খোঁজ নিন। বিপদের সময় বা যেকোনো খারাপ সময়ে আমাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায়, নিজেকে ছোট লাগে বা মনে হয় এ অবস্থা থেকে যেন মুক্তি নেই। এই খারাপ সময়টা যে একসময় আর থাকবে না, সে ব্যাপারে তাকে মুখে বলুন ও আশ্বস্ত করুন। আপনার এই আশ্বাস আর পাশে থাকা এ ধরনের ঘোরপ্যাচ থেকে অবস্থা মোকাবিলা করতে বড় ধরনের শক্তি ও সাহস জোগাবে।
যেকোনো বিপদে আমাদের মন নানা ধরনের যৌক্তিক-অযৌক্তিক আবেগ, যেমন রাগ, কষ্ট, ঘৃণা, অভিমান, ক্ষোভ ইত্যাদিতে আপ্লুত থাকে। এসব আবেগের ঠিক-বেঠিক বিচার না করে তার মন থেকে এসব প্রকাশ করতে সাহায্য করুন। তাকে কাঁদতে দিন, রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, অভিমান তার মতো করে প্রকাশ করতে দিন।
কোনো ঘটনা শুনলে প্রথমেই আমরা ঠিক-বেঠিক বা নৈতিক-অনৈতিকতার বিচারে লেগে যাই। নানা রকম উপদেশমূলক কথা বলি, যা আসলে এক ধরনের বিরক্তি ঘটায়।
কাজেই এই সময় অহেতুক উপদেশ দেওয়া বা অতিরিক্ত বিচার-বিশ্লেষণ করা থেকে আপাতত নিজেকে বিরত রাখুন। বরং তার অবস্থানে গিয়ে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে জানতে চান আপনি কীভাবে তাকে সাহায্য করতে পারেন।
মনে রাখবেন, বন্ধুর পাশে দাঁড়ান মানে এই নয় যে, নীতিগতভাবে না মানলেও তার যেকোনো বিষয়ের সঙ্গে আপনাকে থাকতেই হবে। সাহায্য মানে এই নয় যে কারও বিরুদ্ধে বন্ধুর সঙ্গে প্রতিহিংসায় আপনি যোগ দেবেন। আপনি বন্ধুর জন্য ততটুকুই করবেন, যতটুকু আপনার মন সায় দেবে।
জীবনের নানা জটিলতার জট খুলতে, তার ভার লাঘব করতে সব সম্পর্ককে পেছনে ফেলে আমরা প্রথমেই ছুটে যাই বন্ধুর কাছেই। বলা হয়, বন্ধুত্ব আমাদের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, যার প্রয়োজন আর গুরুত্ব চোখের সামনে ভেসে ওঠে মূলত যেকোনো সংকটে। খুব বেশি আপনার নীতির বিরুদ্ধে না হলে বন্ধুর সেই সংকটে আপনার হাত বাড়িয়ে দিন। আপনারও হয়ত কোনো একসময় কোনো এক বন্ধুর হাতের প্রয়োজন হতে পারে।
এই প্রসঙ্গে এইটি লোককথার অবতারণা করছি।
কোনো এক কালে মণিপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে এক গৃহস্থ ছিল।ঐ গৃহস্থের বসতভিটের খালের পাশে এক বাঁশঝাড় ছিল। সেই বাঁশঝাড়টির গোড়ার মাটি খালের স্রোতে ধুয়ে নিয়ে যায়।তাই গেরস্থ বাঁশঝাড়টিকে রক্ষার জন্য খাল থেকে মাটি তুলে ভরাট করে দেয়।তার মনে প্রত্যাশা বাঁশঝাড়টির গোড়া শক্ত হলে বংশ বিস্তার করবে অর্থাৎ কড়ুল ছাড়বে।
বর্ষার সময়কাল।অবিরাম বর্ষণে বাঁশঝাড়ের গোড়ায় দেয়াল মাটির দেওয়ালগুলো গলতে শুরু কিরে।বাঁচার আশায় মাটির দলা - এভাবেই গলে গলে হারিয়ে যাওয়া আমাদের ভাগ্যলিপি।মাথা উঁচু করে দাঁড়ানর উপায় নেই।
মাটির দলার কথিত বেদনার মতো বাঁশঝাড়ের বুড়ো পাতাগুলো হাওয়ায় উড়ে যেতে থাকল।বাতাসের তীব্র গতিতে উড়ে দিকবিদিকে ছড়িয়ে যায়।কোথাও পুকুরের জলে,আবার কোথাও খালের জলে ছিটকে পড়ে পচে গলে হারিয়ে যায়। আর কখনও ব্যতিক্রমী কিছু পাতা বাঁশঝাড়ের গোড়ায় ঝরে পড়ে যায় তাদের ভাবনা আবার ভিন্ন।ঐগুলো ভাবে, হায়,আমাদের স্বজনদের মতো বাতাসের আক্রমণে খালে- বিলে পড়ে যেতাম তবে তাদের মতো হারিয়ে যেতাম।আর বাঁশপাতা বলে কোনো অস্তিত্বই থাকত না। সত্যিই এভাবে পচেগলে যাওয়াই আমাদের বিধিলিপি।দুর্বল বলেই কি বেঁচে থাকার কোনো অধিকারই নেই?
এই কথাগুলো নীরবে আউড়ে বুকভাঙ্গা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে যায়। এ ধরনের এলোমেলো চিন্তাভাবনার মুহুর্তে কোথা থেকে প্রবল ঘূর্ণি ঝড়ো বাতাস শোঁ শোঁ করে ধেয়ে ছুটে এল।বাঁশগাছের গোড়ার পাতাগুলো দিশেহারা হয়ে এদিক-ওদিক উড়ে যেতে লাগল।তখন এক বাঁশপাতা মাটির শক্ত দলার পাশে এসে উড়ে পড়ল।
তার করুণ অবস্থা দেখে মাটির দলার মন করুণায় ভরে গেল।তারপর মাটির সেই পিণ্ড বলল- ওহে বন্ধু! ভয় কর না কিসের চিন্তা মনে তোমার? আমি শক্তপোক্ত হয়ে তোমার পাশে আছি এই ঘূর্ণিহাওয়া আমার গায়ে লাগে না। তুমি নির্ভয়ে আমার দেহতলে আশ্রয় নাও।বাতাস তোমাকে কাবু করতে পারবে না।
বাঁশপাতাটি এলোমেলো কিছুক্ষণ তাকিয়ে নীরবে মাটির দলার নীচে আশ্রয় নিল।বাতাসের গতি তার ধারেকাছেও যায় নি এবারের মতো সে বেঁচে গেল।ঘূর্ণি হাওয়া থেমে পর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মাটির দলাকে বলে,বন্ধু তোমার স্নেহচ্ছায়ায় আমি রক্ষা পেলাম।নতুবা কোথায় হারিয়ে যেতাম বলা মুস্কিল।তোমার এই উপকার জন্ম-জন্মান্তরে ভুলতে পারব না।
এভাবে কিছুক্ষন অন্তরঙ্গ আলাপের মাঝে তারা দু'জন মজে গেল।তখন আবার হঠাৎ আকাশ গর্জন উঠল।চারদিকে দৈত্যের মতো কালো মেঘে ছেয়ে গেল।এদিক-ওদিক বাদলা মেঘের আনাগোনা। মুহুর্তেই অঝোরে বৃষ্টি নামল।বাঁশপাতা বন্ধু মাটির দলার উপকারের কথা মনে রেখে কৃতজ্ঞ চিত্তে কথা বলা নেই,নিজেই তার ওপরে ছাতার মতো মেলে রইল।বৃষ্টির জল তার গায়ে ছিটেফোঁটা লাগেনি।বৃষ্টি থামার পর মাটির দলা বন্ধুকে জড়িয়ে বলে, বন্ধু এই তো প্রকৃত বন্ধু এভাবেই চিরকাল আমরা একে-অপরকে সাহায্যের হাত প্রসারিত করে বাঁচতে হবে।
বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ানর অঙ্গীকারে দুই বন্ধু আবদ্ধ হল দুই বন্ধু আবার হাসিতে মশগুল হয়ে দিন কাটাতে লাগল।
এমনিভাবে চলার মাঝে আচমকা একদিন ঝোড়ো হাওয়া বৃষ্টি আছড়ে পড়ল।চারদিকে ঝড়-বৃষ্টিতে জল থৈ থৈ করতে লাগল।দুই বন্ধু দিশেহারা হয়ে উঠল।খাল-বিল-নদী-নালা জলের তীব্র স্রোতে ভাসতে লাগল।তখন বাঁশপাতা আর নিজেকে রক্ষে করতে পারল না, জলের স্রোতে ভেসে যেতে যেতে বাঁচার আশা ভঙ্গ হয়ে করুণ সুরে বন্ধু মাটির দলাকে বলে ওঠে, বন্ধু! আমার আর রক্ষে নেই।আর কোনোদিন তোমার সঙ্গে দেখা হবে না।
বন্ধুর করুণ অবস্থা দেখে মাটির দলা অশ্রুভরা কন্ঠে চিৎকার করে ওঠে, বন্ধু! আমিও তোমার পথের পথিক।
ঠিক কিছুক্ষণ পরে অঝোর বৃষ্টির জল তার গায়ে তীব্র আঘাত করতে শুরু করল।ধীরে ধীরে মাটির দলা গলে গলে জলের স্রোতে মিশে গেল।এভাবেই দুই বন্ধু- বাঁশপাতা ও মাটির দলা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।
মানুষ মানুষেরই শত্রু হয়। এই মানুষের ভেতরে যে শত্রুতা জন্ম হয়, তা চিহ্নিত করাটা খুুবই কঠিন। পৃথিবীতে ‘কে- শত্রু’ আর ‘কে- মিত্র’ তাকে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে উপলব্ধি করা যায় না। কেবলই প্রয়োজনের সময় কিংবা বিপদের মুহূর্তেই সত্যিকারের শত্রু-মিত্র চেনা যায়।
গৌতমবুদ্ধ একটা কথা বলেছেন,- জগতে শত্রুতার দ্বারা কখনও শত্রুতার উপশম হয় না, মিত্রতার দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়।
খুব গোপন শত্রু প্রকৃত বন্ধু বা কাছের ও দূরবর্তী মানুষের নিকটেই যেন একটা মুখোশে চিত্র। বিদ্রূপ যাকেই করা হোক না কেন তা অবশ্যই নেতিবাচক। এসমাজের ব্যক্তিত্ববান কোনও মানুষকে যদি ঠাট্টা-মশকরা করে অপমান করা হয়, তা হলে সমাজে তিনি যা দিতে পারতেন তা থেকে এ সমাজ বঞ্চিত হবে। সুতরাং এতে সমাজের যে ক্ষতি হয় তাকে সচেতন নাগরিকদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন। শত্রুরাই নিজ ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যেই যেন কৌশলে মিত্রকে ঘায়েল করে শত্রুতার পথ বেছে নেয়। তাদের কাছে এই কঠিন কাজ সহজভাবেই করতে যেন বাধে না। মনে মনে বা প্রকাশ্যে ঘৃণা করে বা ক্ষতি সাধন করে, এ ব্যক্তিরাও মানুষ মানুষের শত্রু হয়।
এবার আমাদের আলোচনার প্রতিপাদ্য বিষয় হলো শত্রু। শত্রু শব্দটা’কে বাংলা প্রতিশব্দের মাধ্যমে নানা ভাবেই যেন মানুষ চিনে থাকে। যেমন বৈরী, অরি, দ্বিষৎ, প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রতিপক্ষ, বিপক্ষ। শত্রুতা করা, শত্রু ভাবাপন্ন ব্যক্তিরা কখনও সমাজের বৃহৎ কর্মকান্ডে থাকতে পারে না। অবশ্য তাদের কখনও না কখনও পতন ঘটেছে। তাই সাক্ষী ইতিহাসের পাতায় আছে। অনেক শাসকের পতন ঘটেছে তাদের নিকট বন্ধু রূপেই লুকিয়ে থাকা শত্রুতার কারণে।
ধন-সম্পদ, প্রাসাদ বা রাষ্ট্র ষড়যন্ত্রের কথা তো হরহামেশাই মানুষের মুখে শোনা যায়। এ ধরনের শত্রুরা নিজ ইচ্ছা বা ক্ষমতাসীনদের দ্বারাই নিয়োজিত এজেন্ট এবং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আঁতাতে নিজসহ ক্ষমতাধর ব্যক্তির ফায়দা হাসিল করার জন্যই গোপনে ও প্রকাশ্যে সংবাদ আদান-প্রদানের কাজে নিয়োজিত থাকে। তাই, মানুষের কল্যাণে এরা কমই আসে, চতুরতা বা কৌশল খাটিয়েই যেন শত্রুতা করে। সুতরাং প্রয়োজনের সময়ে কেবল সত্যিকার মানুষের কেমন পরিচয় লুকিয়ে থাকে তার গভীর মনে সেটা উপলব্ধি করলেই জানা যায়।
সুতরাং এরা সমাজ এবং দলের নীতিনির্ধারকদের অতি আপন জন হয়ে খুব সহজে গুপ্তচর বৃত্তির কাজেই লিপ্ত থাকে। বিপুল জনপ্রিয়তা থাকার পরও অনেক সময় এ সব শত্রুর কারণেই সমাজ বা দল নিজস্ব সিদ্ধান্তকে ফলপ্রসূ করতে পারে না। এই মানুষরা সর্বক্ষণ অপরের খুঁত ধরতে থাকে। তাদের কাছে অন্যদের চিন্তা-ভাবনা, রুচি-পছন্দ, কাজ, পোশাক-আশাক, আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবদের মতো অনেকে অপছন্দ করে। এক কথায় সব কিছুই তাদের চোখেও খারাপ লাগে। পরশ্রীকাতর, প্রতিহিংসাপরায়ণ লোকেরা গোপন শত্রুতা পোষণ করে থাকে। ওদের থেকে অনেক দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়। তাদের কর্ম ও আচার-আচরণে দৃষ্টি দিলে অনেকাংশে পরিষ্কার হয়। তবে 'গভীর জলের মাছ' ধরতে হলে গভীরে নামতে হবে। তাদের কথা বার্তা ,আচরণ এবং গতিবিধির মধ্যে সর্বপ্রথমেই চলে আসে টাকা বিষয়ক ব্যাপার। কৌশলে টাকা নিতে পারলেই লেনদেন চুকিয়ে দেওয়াটাই তাদের কু-চরিত্রে বিরাজ করে।
বাঙালি আবেগপ্রবণ, আর এমন আবেগপ্রবণতাই যেন তাদের আত্মত্যাগের জন্যেই উদ্বুদ্ধ করে। ভালোবাসাতে যেমন আপ্লুত হতে পারে এ-জাতি, তেমনই- নিষ্ঠুরতা বা শত্রুতার চরম রূপও দেখাতে পারে। অদ্ভুত এক দ্বান্দ্বিক চরিত্র ও মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব আছে মানুষের মধ্যে। চরিত্রের এ বৈপরীতধর্মীতা দৃশ্যমান হয় কিছু স্বার্থ হাসিলের জন্যেই তা অকপটে বলা যায়।
সুতরাং, খুব ভালো মানুষ হতে হলে মানুষকে ভালোবাসতে হবে। আর প্রতিটা মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সুন্দর ভাষা বা শিষ্টাচারপূর্ণ ব্যবহারের প্রভাব অনস্বীকার্য। যদি ধর্মের যুক্তি দেখাতে চেষ্টা করি- তাহলে বলা যেতেই পারে, শত্রুর সঙ্গে সুন্দর ভাষায় কথা বলা। পাশাপাশি , ‘মানুষের উচিত শত্রুর নোংরা কথার জবাব খুবই সুন্দর কথায় দিয়ে দেওয়া।’ তুমি অসৎ কাজকে সেই 'নেকি'- পূণ্য দ্বারাই নিবৃত্ত করো যা সবচেয়ে ভালো। তা হলেই দেখা যাবে যে,- আপনার সাথে শত্রুতা যাঁর ছিল তিনি অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়েও গেছে।’’ শত্রুতা নয়- আপোস করতেই হয়, সেটাই তো জ্ঞানীদের সঠিক কাজ। সফলতার অর্জনের পাথেয়- বলা যেতেই পারে। ‘ভালোবাসা’ দিয়েই হবে জয়, আর শত্রুতা দিয়েই হবে পরাক্ষয়।
পৃথিবীতে মানুষ একা বাস করতে পারে না। মিলেমিশেই বসবাসের পাশাপাশি তারা যার যার ধর্ম পালন করে। এই বসবাসের সূত্রে আত্মীয়তার সম্পর্কের বাইরেও অনেক মানুষের সঙ্গে মানুষের নানারকম সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে মধুর ও পবিত্র সম্পর্ক বলা যায় ‘বন্ধুত্ব’। কারণ মানুষ তার বন্ধুর কাছে সুখ-দুঃখের বিভিন্ন কথা অকপটে ব্যক্ত করে। মানুষ তার বন্ধুর বিপদে- আপদেই সবার আগে এগিয়ে আসে এবং বিপদে-আপদে আশার বাণী শোনায়, তারাই তো- সুখ-দু:খের মুহূর্তগুলো ভাগা ভাগি করে উপভোগ করে।
জ্ঞান ও সভ্যতার ‘বাহ্যিক উন্নতি’ যদি আপাতদৃষ্টিতে সমৃদ্ধির উচ্চশিখরে আরোহন করে, তার পরও সে সমাজকে মানবীয় পূর্ণতায় সমৃদ্ধ সমাজ বলা যাবে না। যে সমাজের লোকজন একে- অপরের কাছে অনিরাপদ বোধ করে কিংবা একে-অপরের প্রতি হিংসা বিদ্বেষ পোষণ ও পরস্পরের মঙ্গল কামনা করে না বরং ভেতরে ভেতরে শত্রুতা এবং ক্ষতি কামনা করে, ষড়যন্ত্র করে, অপরের ধন-সম্পদের প্রতি ‘লোভ-লালসা’ লালন করে, সেই সমাজে কোনো রকম শান্তি বা স্বস্তির অস্তিত্ব নেই।
বিপদের বন্ধুই প্রকৃত ‘বন্ধু’। আর যে ‘বন্ধু’ বন্ধুর বিপদের সময় নিজেকে গুটিয়ে রাখে সে বন্ধুরূপী শত্রু। তাই বন্ধু নির্বাচনে সদা সতর্ক থাকতেই হবে। প্রচলিত সর্বজনীন মূল্যবোধ, আইন এবং অধিকার-বিরুদ্ধ কর্মকাণ্ড যখন সংঘটিত হয় তখনই মানুষের প্রতি মানুষের শত্রুতা এবং অবিচার সৃষ্টি হয়। শুধুমাত্র ন্যায়নীতির পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমেই সর্বস্তরের শত্রুতাকে দমন করে 'শান্তি প্রতিষ্ঠা' করা সম্ভব। অভিজ্ঞতার আলোকেই বলতে হয়, যেখানে ন্যায়নীতি আছে সেখানেই শান্তি আছে। আবার যেখানে ন্যায়বিচার নেই কিংবা আদর্শবোধ বা সহনশীলতা নেই, সেখানে কখনও শান্তি বিরাজ করতে পারে না। নিজ ঘর থেকে শুরু করে গোষ্ঠী এবং জাতি সকল ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য।
সর্বশেষে বলতে চাই যে, ‘আমার হাতে কোনো পাথর নেই, আমার সঙ্গে কারও শত্রুতা নেই। আমি কারও সঙ্গে যে দুর্ব্যবহার করি না, কেননা আমি গোলাপ বাগানের মতই সুমিষ্ট’। । আবার ‘‘শত্রুরা শত্রুতা করতে কৌশলে ব্যর্থ হলে তারপর বন্ধুত্বের সুরত ধরে”। সুতরাং মানুষের এই চরিত্রের পরিবর্তন করানটা খুবই কঠিন। তবুও- বুদ্ধির জোরেই শত্রুকে জয় করা প্রয়োজন। নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গেও একমত পোষণ করে বলা যায়,- “আপনি যদি সত্যিকার অর্থেই শান্তি চান,.. আপনাকে আপনার শত্রুদের সঙ্গেই কাজ করতে হবে, তাহলেই তিনি আপনার সহকর্মী হতে পারবেন। তবুও একটি কথা বলতেই চাই যে, হত্যা, সন্ত্রাস, নাশকতা বা গুজবের মতো শত্রুতা না করে সত্য, সুন্দর এবং মঙ্গল পথে সততা দিয়েই নিজেকে উপস্থাপন করা প্রয়োজন। সুতরাং শত্রুতার ওপরেই দাঁড়ান মানুষদের মনোবল কিংবা নিযেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাওয়া নিচু মনের পরিচয়।
আমরা বন্ধুর কথা শুনলাম,আমরা শত্রুর কথা শুনলাম।এর ভাইরেও বন্ধুত্ব থাকে,দুশমনি থাকে। আর বন্ধুতা বা বন্ধুত্ব আছে বলেই আমরা শত্রুতা বুঝতে পারি।কারণ কালো না থাকলে সাদা বা আলো বোঝা যায় না।রাত্রি না থাকলে অনুভব করা যায় না দিন।আমরা বন্ধুত্বের ময়ূরপঙখী নাও বাইতে বাইতে পৌঁছে গেলাম কোনো স্বপ্নের দেশে।
0 comments: