0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in






অধ্যায় ৬

শহর ছাড়িয়ে গাঁয়ে যাবার রাস্তা দিয়ে একটা রিকশা যাচ্ছে।রিকশাওলা এক রোগাপাতলা ঝাঁকড়াচুলো নওজোয়ান যার পরণে হাফপ্যান্ট, গায়ে রঙীন গেঞ্জি।ওর ঘামে জবজব চেহারা দেখে ব্যথার ছবি নয়, বরঞ্চ কার্টুনের কথাই মনে ভেসে ওঠে।

রিকশায় সমাসীন বদ্রী পালোয়ান, মুঠো পাকানো দুই হাত পেশিবহুল জঙ্ঘার উপর ন্যস্ত।পায়ের কাছে একটা সিন্দুক রাখা আর দুই পা’ এমনভাবে সিন্দুকের মাথায় তুলে দেয়া হয়েছে যে পা’ ভেঙে রিকশা’র তলায় চাপা পড়ুক, সিন্দুকের নীচে চাপা? কখনই নয়।

এখন সন্ধ্যা নামছে তার অর্থহীন সৌন্দর্য নিয়ে।পালোয়ানের গাঁ আসতে এখনও তিন মাইল। ও মুখ বাঘের মত মুখব্যাদান করে বড়সড় হাই তুলল। তারপর নিরাসক্ত ভাবে বলল—এ’বছর ফসল ভাল হয়নি।

কিন্তু রিকশাওলা কৃষিবিজ্ঞান বা অর্থনীতি নিয়ে সেমিনারের মুডে ছিল না।ও চুপচাপ রিকশা চালানোয় মেতে রইল। এবার পালোয়ান সোজাসুজি জিজ্ঞেস করল- কোন জেলার বট হে? তোমাদের দিকে ফসলের কী খবর?

রিকশাওলা পেছন ফিরল না। চোখের ওপর এসে পড়া চুলের গোছা এক ঝটকা মেরে সরিয়ে বলল—ফসল? আমি গেঁয়ো নই ঠাকুর সাহেব। পাক্কা শহুরে।

এটা বলে ও পাছা দুলিয়ে দুলিয়ে জোরে জোরে প্যাডল মারতে লাগল। আগে চলতে থাকা দু’একটা রিকশার কাছে এসে জোরে ঘন্টি বাজাতে লাগল। পালোয়ান আবার অলস হাই তুলে উদাস নয়নে চারপাশের ফসলের হাল দেখছিল।সোয়ারির দিক থেকে কোন সায় না পেয়ে রিকশাওলা হতপ্রভ। শেষে ধোঁস জমানোর চেষ্টায় সামনের রিকশাকে বলল—আবে ও বাঙরু! যা, সর বাঁদিকে।

রিকশাটা বাঁদিকে সরে জায়গা ছেড়ে দিল। ওকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাবার সময় আমাদের রিকশাওলা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল- কোথাকার? গোন্ডা নাকি বহরাইচ জেলা?

রিকশাওলাটি একগাদা পোঁটলাপুঁটলি সমেত সওয়ারি এবং তার পোঁটলারই মত বৌকে বসিয়ে ধীরে ধীরে প্যাডল মারছিল। এই আত্মীয় সম্বোধনে খুশি হয়ে বলল—গোন্ডা জেলার ভাইয়া, তুমি?

শহুরে রিকশাওলা সিনেমার স্টাইলে সিটি বাজিয়ে চোখ নাচিয়ে বলল- তাই তো বলি!



পালোয়ানের কোন হেলদোল নেই। বিরক্ত মুখে বলল—তুমি স্পীড বাড়াও মাস্টার!

রিকশাওলা স্পীড বাড়াতে খাড়া প্যাডল মারতে লাগল এবং তার সঙ্গে বকরবকর।

ঃ এই গোন্ডা-বহরাইচ আর তার আশপাশের রিকশাগুলো এসে এখানকার চালচলন বিগড়ে দিচ্ছে। ডান-বাঁ কাড়-কাঁকুড় জ্ঞান নেই। এদের চেয়ে খড়ের গাদা টানা গরুর গাড়ির বলদও বেশি বুদ্ধি ধরে। আংগ্রেজি বাজারে গিয়ে ‘বিরহা’ গাইতে থাকে। মুচি-মেথরকেও রিকশায় বসিয়ে নেয়, ওদের হুজুর-সরকার বলে ডাকে। কেউ যদি বলে চল মাল এভিনিউ বা ক্রম্পটন স্কোয়ার তো দাঁত কেলিয়ে দেয়। এদের বাপও যদি কখনও এসব জায়গার নাম শুনেছে তো—

পালোয়ান এবার মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল- ঠিক বলেছ মাস্টার!ওদিকের লোকগুলো হতদরিদ্র। ছাতু খায় আর ছোলা চিবিয়ে রিকশা চালায়। চার বছরের মাথায় অসুখে ধরে, তখন আর মাথার ঠিক থাকে না।

রিকশাওলা বড় তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল—এদের ভাব হচ্ছে যে চামড়ি চলি জায়, পর দামড়ি ন জায়। চামড়া ফেটে যাক, কিন্তু একটা ফুটো পয়সাও যেন খরচ না হয়। ব্যাটারা পিঁপড়ের পোঁদ টিপে খায়। গত বছর লু’ চলছিল। এক ব্যাটা রিকশাওলা রাস্তার ওপরেই পটল তুলল। গায়ে গেঞ্জি নেই, কিন্তু ট্যাঁক থেকে বেরোল বাইশ টাকা!

পালোয়ান মাথা নেড়ে বলল—লু’ বড্ড খারাপ; যখন চলে তখন ঘর থেকে বেরোতে নেই।খেয়েদেয়ে দরজা বন্ধ করে পড়ে থাকতে হয়।

কথা তো বেশ কাজের। রিকশাওলা বেশ ডাঁট দেখিয়ে বলল- আমি তো তাই করি। গরমের দিনে খালি সন্ধ্যে নাগাদ সনীমা’র শো’য়ের সময় রিকশা বের করি।কিন্তু ওই শালার গাঁইয়াগুলো! এদের কথা না বলাই ভালো ঠাকুর সা’ব। শালারা জান নিয়ে জুয়ো খেলে! চার আনার জন্যে মুখে ফেনা তুলে গরমের দুপুরে কয়েক মাইল চালিয়ে আসে। এক্কাগাড়ির ঘোড়াও অমন সময় গাছের ছায়া থেকে সরে না; কিন্তু ওই শালারা—

ঘেন্নার চোটে রিকশাওলার মুখে থুতু ভরে যায়, গলা বুজে আসে। পিচ করে থুতু ফেলে ও কথাটা শেষ করে।‘ শালারা একটু গরম হাওয়া লাগতেই রাস্তায় শুয়ে পড়ে’।

এসব কথায় পালোয়ানের আগ্রহ অনেকক্ষণ জুড়িয়ে গেছে। ও চুপ করে রইল। রিকশাওলা গাড়ির স্পীড কমিয়ে বলল—একটা সিগ্রেট খেয়ে নিই?

পালোয়ান নেমে রিকশার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।রিকশাওলা সিগরেট ধরিয়ে খানিকক্ষণ চুপচাপ টানতে থাকল, তারপর গোল গোল রিং ছাড়তে ছাড়তে শুরু করল—ওদিকের গেঁয়োগুলো দিনরাত বিড়ি ফুঁকে দাঁত খারাপ করে।

এবার সেই পেছনের রিকশাটা ওদের ধরে ফেলল। ছেঁড়া ধুতি, খালি গা’। অনেক কষ্টে টেনে টেনে চালাচ্ছে। শহুরেকে ধোঁয়া ছাড়তে দেখে পরম আত্মীয়তার সঙ্গে বলল, ভাইয়া! তুমিও কি গোণ্ডার লোক?

সিগ্রেটে টান দিয়ে ওর জবাব—আবে হট! কী ফালতু বকছিস?

ও বেচারা খিরর খিরর আওয়াজে রিকশা চালিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল।

আজকালকার সেন্টিমেন্টাল লেখকেরা কী জানি কোন স্কুলে পড়েছেন?ওঁরা বলেন, দূঃখ নাকি মানুষকে পরিষ্কৃত করে, শুদ্ধ করে।যত্ত বাজে কথা! সত্যি হল দুঃখ প্রথমে মানুষকে টেনে লম্বা করে। তারপর কষে নিংড়ে নেয়। নিংড়ে নিংড়ে চেহারায় একটা হতভম্ব ভাব আনে। তারপর সেই চেহারায় কিছু সাদা কালো কাটাকুটি এঁকে দেয়। দুঃখ গোন্ডাওয়ালা রিকশার সঙ্গে তাই করেছে।কিন্তু শহুরে রিকশার এতে কিছু যায় আসে নি। ও সিগ্রেট ছুঁড়ে ফেলে নির্বিকার ভাবে রিকশায় উঠে স্পীড বাড়ায়। ফের শুরু হয় ওর দ্বিতীয় লেকচার।

“আমার কথা হল, ঠাকুর সা’ব, -চোখা কাম, চোখা দাম। আট আনা বলে সাত আনায় রফা করি না।একবার যা বলেছি তা বলেছি। সেবার এক সাহেব আমার পেছনে বসে ঘরের হালচাল শুধোতে লাগলেন।বললেন, সরকার তোমাদের এই অবস্থার জন্যে দায়ি। রিকশা-টিকশা বন্ধ হওয়া উচিত। মানুষের ঘাড়ে মানুষ চড়ে! বড় লজ্জার কথা।বললাম, তো না চড়লেই হয়। উনি বললেন, নাচড়লে বা রিকশা একেবারে বয়কট করলে রিকশাওলারা যে না খেয়ে মরবে।ওর রিকশাওলাদের হাল নিয়ে কান্নাকাটির আর শেষ হয়না। কত কী বলল! সরকারকে কষে গাল দিল। বলল, শোন! তোমরা ইউনিয়ন বানাও। তারপর সরকারের কাছে মোটরেচলা রিকশার দাবি কর।আরও কত কী যে বলল।কিন্তু ঠাকুর সায়েব, আমিও ভেবে নিলাম। ব্যাটা চালিয়ে যা! রিকশাওলার দুঃখে কেঁদে ভাসিয়ে দে। কিন্তু নামার সময় আট আনার থেকে এক পাই কম নেব না”।

পালোয়ানের চোখ বুঁজে গেছল। এবার হাই তুলে বলল, ‘ কোন সিনেমার গানটান আসে? নাকি খালি বগর বগর’?

-দুটোই তো কাজ ঠাকুর সায়েব, রোজ সিনেমা দেখা আর সিগ্রেট ফোঁকা। গান শুনিয়ে দিতাম, কিন্তু আজ গলাটা খারাপ।

পালোয়ান হেসে উঠল,” তবে আর কি! শহরের নাম ডুবিয়ে ছাড়লে”।

রিকশাওলা এই অপমান শান্তভাবে হজম করে ফেলে ধীরে ধীরে ‘লারে লাপ্পা, লারে লাপ্পা, লাই রাখদা’র সুর ভাঁজতে লাগল। পালোয়ান পাত্তা দিল না। সোয়ারির উৎসাহ নেই দেখে ফের ওর গল্প শুরু হল। “আমার ভাইও রিকশা চালায়, কিন্তু কেবল বিশেষ বিশেষ মহল্লার সোয়ারি নেয়। একবার এক সুলতানপুরী রিকশাওলাকে ও সোয়ারি ধরারা দু’চারটে দাঁও প্যাঁচ শিখিয়েছিল।বেচারা কাঁদতে লাগল।বলল, আমার প্রাণ যাক, কিন্তু ধরম ভ্রষ্ট হব না।এ’সব কাজের জন্যে সোয়ারি নেব না। আমি বললাম, ছাড়ান দাও ভাইয়া। কেন গাধা পিটে ঘোড়া করতে চাও”?

শিবপালগঞ্জ এল বলে। পালোয়ান রিকশাওয়ালাকে পরামর্শ দেয়ার ঢঙে বলল,’তুমি মানুষটা মন্দ নও।সবার সঙ্গে গলাগলি করার দরকার নেই। কিন্তু তোমার স্বাস্থ্য বড্ড ঢিলেঢালা। কয়েকমাস ডনবৈঠক কর। তারপর দেখবে’।

“ কী আর দেখব? আমিও পালোয়ান হয়ে যাব।কিন্তু আজকাল পালোয়ানিতে কোন দম নেই। যুদ্ধে যখন আকাশ থেকে বোমা পড়ে, তখন মাটিতে বড় বড় পালোয়ান চিৎ হয়ে যায়।হাতে একটা পিস্তল থাকলে পালোয়ান হলেই কি আর না হলেই কি”!

পালোয়ান গম্ভীর।

একটু থেমে রিকশাওলা ফের বলল,’পালোয়ানি তো আজকাল গেঁয়ো ব্যাপার, ঠাকুর সাহাব। আমাদের শহরে এখন ছোরাছুরির চল হয়েছে’।

হঠাৎ বদ্রী পালোয়ানের অপমানের বোধ হল। ও হাত বাড়িয়ে রিকশাওলার গেঞ্জির কোনা ধরে একটান মেরে ধমকে উঠল,” আবে, তখন থেকে কী ঠাকুর সা’ব ঠাকুর সা’ব কচ্ছিস, জানিস না আমি বামুন”?

রিকশাওলা এই খবরে ভীষণ চমকে উঠল। তারপর চেহারায় সর্বোদয় আন্দোলনের ভাব এনে বলল,” ঠিক আছে, পন্ডিতজী, ঠিক আছে”।

তারপর ও রাস্তার ধারের প্রকৃতির শোভা দেখায় মগ্ন হয়ে গেল।

রামাধীনের পুরো নাম বাবু রামাধীন ভীখমখেড়ভী । মানে ভীখমখেড়া নিবাসী। (যেমন হিন্দি সিনেমার অনেক গীতের রচয়িতা শাহির লুধিয়ানভী হলেন লুধিয়ানা নিবাসী শাহির)। ভীখমখেড়া ছিল শিবপালগঞ্জের সঙ্গে জোড়া লাগা একটা গাঁ যা প্রাচীন ‘গ্রীস-মিশর-রোম’ এর মতন আজকাল দুনিয়া থেকে গায়েব হয়ে গেছে। মানে ঠিক হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি, কিন্তু শিবপালগঞ্জের লোকজন বোকার মত ভাবে- ওটা গায়েব হয়ে গেছে ।ভীখমখেড়া গ্রাম আজও আছে; বেঁচে আছে গোটাকয় ঝুপড়ি, মালবিভাগের কাগজপত্তর আর রামাধীনের পুরনো কবিতায়। ছোটবেলায় বাবু রামাধীন ভীখমখেড়া গাঁ থেকে বেরিয়ে রেললাইন ধরে চলতে চলতে শহরে পৌঁছে গেছলেন। তারপর সেখান থেকে কোন একটা ট্রেনে চড়ার প্ল্যানিং করে শেষে এক বিনা প্ল্যানিংযাত্রায় কোলকাতা পৌঁছে গেলেন। সেখানে উনি প্রথমে কোন এক ব্যবসায়ীর আড়তের চিঠিপত্তর যথাস্থানে পৌঁছে দেয়ার কাজে জুটে গেছলেন। তারপর লেগে গেলেন ওনার মালপত্তর সাপ্লাই করার কাজে। এরপর উনি শেঠজির পার্টনার হয়ে গেলেন এবং শেষে ওঁর কারবারের একচ্ছত্র মালিক।

কারবারটা ছিল আফিম সাপ্লাইয়ের। কোলকাতায় কাঁচা আফিম আসতো পশ্চিম দেশ থেকে, সেটা নানান কায়দায় সেখানকার বড় বড় ব্যবসায়ীদের গদীতে পোঁছে দেয়ার আড়তিয়া হলেন বাবু রামাধীন।তারপর এগুলো দেশের বাইরে পাচার করার কাজটাও উনি নিজের হাতে নিতে পারতেন। কিন্তু ওঁর কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। চুপচাপ নিজের আড়ত সামলাতেন আর বাকি সময় পশ্চিমা দেশোয়ালি ভাইদের সঙ্গে মশগুল থাকতেন।সেই সব আড্ডায় ভাই-বেরাদরদের মধ্যে ওনার ভারি নামডাক। লোকে ওঁর শিক্ষার অভাবের তারিফ করত আর অন্যদের উদাহরণ দিত যে আকবার বাদশা’ও তো অশিক্ষিত ছিলেন। কিন্তু কেমন মজবুত ও দক্ষ প্রশাসক!

আফিমের কারবারে আমদানি বেশ ভালই ছিল, আর এটায় অন্যদের সঙ্গে বেশি কম্পিটিশনও ছিল না। তবে এই ব্যবসায় একটা ছোট্ট খারাপ ব্যাপার ছিল; তা’হল এই কারবারটা বে-আইনি। এ’নিয়ে কথা উঠলে রামাধীন ইয়ারদোস্তদের বোঝাতেন—আমি কী করব? আইন তো আমাকে জিজ্ঞেস করে পাশ হয়নি।

একদিন যখন ধরা পড়ে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে পেশ হলেন, তখনও তাঁর সেই একই কথা, একই ভাব। উনি ইংরেজি আইনের নিন্দেমন্দ করে মহাত্মা গান্ধীর উদাহরণ দিয়ে বোঝালেন যে বিদেশি আইন খামখেয়ালি ঢংয়ে বানানো হয়েছে। যত ছোট ছোট খামতি – সবই অপরাধ! বললেন, ‘জনাব, আফিম হয় একটা ছোট্ট চারাগাছ থেকে। চারাগাছ একটু মাথা তুললে তাতে খুব সুন্দর সাদা ফুল ফোটে—ইংরেজিতে বলে পপি। ওর একটু অন্যরকম চারা থেকে লাল ফুল বেরোয়।সাহেবরা ওগুলোকে বাঙলোর বাগানে লাগিয়ে থাকেন। এর একটা তিননম্বর জাতভাই আছে, যার নাম ‘ডবুল পপি’।হুজুর, এসব হল ফুল-পাতার কাহিনী, এর মধ্যে অপরাধটা কোথায়?ওই সাদারঙের পপির গাছ থেকে পরে কালো কালো একরকম জিনিস বেরোয়। সেটা ওষুধ বানাতে কাজে লাগে। এর ব্যবসা অপরাধ? হতেই পারে না। যে আইনে একে অপরাধ বলা হয়েছে সেটা কালা কানুন; আপনার আমার সর্বনাশের জন্যে তৈরি’।

এই লেকচারের ফলে বাবু রামাধীনের দু’বছরের জেল হল। সেটা ইংরেজ জমানা, তখন এতে শাস্তি তো হতই। কিন্তু আসল সাজা হল এজলাসে ওই লেকচারটার জন্যে।বাবু রামাধীন জানতেন যে আদালতে এমন লেকচার দিয়ে অনেক বিপ্লবী এবং অহিংসাপন্থীরা এর আগে শহীদ হয়েছেন। ভাবলেন, উনিও লেকচারের সুবাদে চটপট শহীদ হবেন। কিন্তু জেল খেটে বেরিয়ে আসার পর বুঝতে পারলেন ভুল হয়ে গেছে।সহজে শহীদ হওয়ার জন্যে আফিম নয়, লবণ আইন ভাঙা উচিত ছিল। কিছুদিন কোলকাতায় ঘোরাঘুরি করে দেখলেন যে উনি বাজার থেকে আউট হয়ে গেছেন। শেষে মনের দুঃখে একটি ‘শের’(দ্বিপদী পদ্য) আউড়ে সোজা নিজের গাঁয়ে ফিরে এলেন, এবার রেলের টিকিট কেটে। তখন থেকে উনি শিবপালগঞ্জে শেকড় গেড়ে বসেছেন।

লোকজনকে সত্যি কথাই বলেছিলেন—ওনার আড়ত বন্ধ হয়ে গেছে। এটুকু বলাই যথেষ্ট। এরপর উনি ছোটখাটো কাঁচাপাকা বাড়ি বানালেন, কিছু খেত কিনে চাষের কাজ শুরু করলেন, গাঁয়ের ছেলেছোকরাদের কড়ির বদলে তাসের জুয়ো খেলায় হাতেখড়ি দিলেন, তারপর দরজার কাছে খাটিয়ায় আধশোয়া হয়ে কোলকাতার কিসসা শুনিয়ে বিশেষ খ্যাতি কুড়োলেন। তখনই গ্রাম-পঞ্চায়েত শুরু হল। উনি কলকাত্তাই কেরামতি দেখিয়ে এক খুড়তুতো ভাইকে তার সভাপতি বানিয়ে দিলেন। গোড়াতে লোকে বোঝেনি যে সভাপতি ব্যাপারটা কী? তাই ওর ভাইকে কোন ইলেকশনে দাঁড়াতে হয়নি। কিছুদিন বাদে লোকজন জেনে গেল যে পঞ্চায়েতে সভাপতি দু’জন। জমির পাট্টা দেবার সভাপতি হল বাবু রামাধীন, আর তবিল তছরূপের দায়ে জেলে যাবার সভাপতি ওনার খুড়তুতো ভাই।

একসময় বাবু রামাধীনের খুব বোলবোলাও ছিল। ওঁর ঘরের সামনে একটা খাপরা ছাওয়া বাংলোবাড়ি পড়ে ছিল, যার একপাশে গাঁয়ের নবযুবকেরা জুয়ো খেলত, অন্যদিকে চলত তাজা ভাঙের পাতা বেটে ভাঙ ঘোঁটার কাজ। একেবারে কবিত্বময় পরিবেশ। উনি ওই গাঁইয়ে প্রথম ক্যায়না, নেস্টারশিয়াম, লার্ক্সপার ইত্যাদি বিলেতি ফুল লাগিয়েছিলেন। ওর মধ্যে কিছু লাল রঙের ফুল ছিল। তাদের দেখে কখনও কখনও উনি অস্ফুটস্বরে বলতেন- এ হল পপি; আর ওটা সসালা ডবুল পপি।

ভীখমখেড়ভী(ভীমখেড়ীওলা) নামের থেকেই স্পষ্ট যে উনি কবিও বটেন। এখন না হলেও কোলকাতা বাসের ‘অচ্ছে দিন’গুলোয় কখনও কখনও উনি ‘শায়র’ হয়ে যেতেন।

উর্দূ কবিদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল ওঁদের জন্মভূমির প্রতি ভালবাসা।এই জন্যেই বোম্বাই বা কোলকাতা গেলেও ওঁরা নামে পেছনে নিজের গাঁ বা মহল্লার নামের লেজুড় লাগিয়ে ঘুরে বেড়ান, কোন অস্বস্তি হয়না।নিজেদের গোণ্ডভী, সলোনভী এবং অমরোহভী বলে ওঁরা বোম্বাই কোলকাতার কুয়োর ব্যাঙদের ইশারায় বুঝিয়ে দেন যে গোটা দুনিয়া খালি বোম্বাই নয়, যেখানে বোম্বাই আছে, সেখানেই গোন্ডাও রয়েছে।

এক হিসেবে এটা ভাল, কারণ জন্মভূমি-প্রেম থেকেই দেশপ্রেম জন্মায়।যার বোম্বাইয়ের পথেঘাটে নিজেকে ‘স্যান্ডালভী’ বলতে সংকোচ হয়না, শুধু সেই পারে পাঞ্জাবী -পাজামা পরে মুখে চারটে পান আর চার লিটার পিক ঠুঁসে নিউ ইয়র্কের ফুটপাথে নিজের দেশের সভ্যতার পতাকা উঁচুতে তুলে ধরতে। যে কোলকাতায় এসে নিজেকে ‘বারাবাঁকিভী’ (বারাবাঁকিওয়ালে)বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পায়, সে বিলেতে গিয়ে নিজেকে ‘হিন্দুস্থানী’ বলতে নিঘঘাৎ তোতলাবে।

এই নীতি মেনে বাবু রামাধীন কোলকাতায় নিজের ইয়ারদোস্তের কাছে ‘রামাধীন ভীমখেড়ভী’ বলেই পরিচিত ছিলেন।

এসব ছিল দানিশ টান্ডভীর সঙ্গে ওঠাবসার ফল। টান্ডভীর দেখাদেখি উর্দূ কবিতায় রুচি হল। আর কবিতায় রুচির প্রথম ধাপ হল কবিতা লেখা। তাই অন্যের দেখাদেখি উনি একদিন একটি শের লিখে ফেললেন। টান্ডভী সায়েব ওটা শুনে নিয়মমাফিক বললেন—বেশ বলেছ ভায়া!

কিন্তু রামাধীন খাপ্পা,’ আমি শের বলিনি তো, লিখেছি।’

--বাজে কথা, শের কেউ লেখে না, পড়ে বা বলে।

--আমি তো লিখেছি।

----না, তুমি শের শুনিয়েছ, বা বলেছ। এটাই দস্তুর।

এরপ্পর উনি রামাধীনকে শের পড়ার কিছু জরুরী নিয়মকানুন শেখালেন।

এক, শায়রী (পদ্য) হবে মুহাবরার (প্রবাদের)হিসেবে, মুহাবরা শায়েরীর হিসেবে চলবে না। দুই, শায়রের উপনাম কী হবে? টন্ডবীর মতে ইমান শিবপালগঞ্জী কেমন হবে?না,না, ইমান-টিমান(নীতি ধর্ম)চলবেনা। কারণ, শব্দটির মানে রামাধীনের জানা নেই।‘শিবপালগঞ্জী’ কী করে হবে, ওনার গাঁয়ের নাম তো ভীখমখেড়া? আর উপনামের ব্যাপারটাই ওনার মনঃপুত নয়, কারণ আফিমের চোরাকারবারে এমনিতেই ওঁর অনেকগুলো উপনাম চলছে, আর সংখ্যা বাড়িয়ে কী হবে? শেষে উনি শের-শায়েরীর কাব্যময় দুনিয়ায় বাবু রামাধীন ভীখমখেড়ী হয়েই রয়ে গেকেন।

“সাঁঝের বেলায় চোখ মেরে যায় কেলটে মেয়ের দল”,-- এমনি এক মুখড়ার কবিতা উনি আফিম কৌটোর উপর লিখে ফেললেন।(আসলে এটি সন্ধের সময় আফিমের কালো কালো দানার হাতছানির কাব্যিক মেটাফর!) তবে ওঁর কাব্যচর্চা দানিস টান্ডবীর আশেপাশেই থমকে রইল। ভেবেছিলেন জেলে গিয়ে অনেক মহান সাহিত্যিকের মত উনিও কোন অমর রচনা করে জেলে থেকে বেরিয়ে আসার পর এক লম্বা চওড়া ভুমিকা ফেঁদে জনতার দরবারে পেশ করবেন, কিন্তু দু’বছরের কারাবাসের দিনগুলো খাবার নিয়ে নালিশ, কয়েদিদের সঙ্গে ঠাট্টা তামাশা, এবং ওয়ার্ডারের গালি শুনে ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে কেটে গেল।

শিবপালগঞ্জে ফেরার পর ‘গঞ্জহা’ লোকেদের সামনে নিজের দম দেখানোর উদ্দেশে উনি আবার নামের সঙ্গে ‘ভীখমখেড়ী’ উপাধিটি জুড়ে নিলেন। কিছুদিন পরে উনি যখন এই গাঁয়ের বা সমগ্র ভারতের সংস্কৃতির প্রভাবে দলবাজির শিকার হলেন, তখন দু’একবার দু’চার লাইন পদ্য লিখে লোকজনকে বুঝিয়ে দিলেন যে ‘ভীখমখেড়ী’ শব্দটি শুধু ভুগোলের নয়, কাব্যজগতেরও আত্মীয় বটে।

কিছুদিন আগে বদ্রী পালোয়ান শিবপালগঞ্জের দশমাইল দূরে একটা গম পেষার কল লাগাল। যখন ওই আটা-চাক্কি ভালই চলতে লাগল, তখন বৈদ্যজীর বিরোধীরা বলতে লাগল যে এর সম্বন্ধ মনে হয় কলেজের বাজেটের সঙ্গে রয়েছে। রামাধীন ওই জনগণের ভাবনাটিকে এই দ্বিপদীর ছন্দে বাঁধলেন।

দেখ ভীখমখেড়ী দেখ, ভগবানের ছল,

খুলতে গেল কলেজ, খুলল আটা পেষার কল।।



গাঁয়ের বাইরে কেউ বদ্রী পালোয়ানের রিকশা থামাতে বলছে। সন্ধ্যের আলোআঁধারিতে চেহারা চেনা যাচ্ছে না। পালোয়ান বলল, ‘কৌন হ্যায় বে?’

--আবে -তাবে কোর না পালোয়ান, আমি রামাধীন।

বলতে বলতে একজন এসে রিকশার হ্যান্ডল ধরে দাঁড়াল। রিকশাওলা রাস্তার ঠিক মাঝখানে গাড়ি দাঁড় করিয়েছে। লোকটির পরনে ধুতি পাঞ্জাবি, কিন্তু আধো অন্ধকারে ওর মুন্ডিত মস্তক চেনা যাচ্ছে। ও বলল, ‘শুনেছ, আমার ঘরে নাকি ডাকাতি হবে?’

পালোয়ান পিঠে এক আঙুলের খোঁচা মেরে এগিয়ে যাওয়ার ইশারা করল।তারপর বলল,’ এখন থেকেই কেন চিঁ-চিঁ শুরু করেছ? যখন হবে তখন আমায় ডেকে নিও’।

রিকশাওয়ালা প্যাডলে চাপ দিল, কিন্তু রামাধীন এমন কষে হ্যান্ডল ধরে রেখেছে যে রিকশা নট নড়ন চড়ন, নট কিস্যু।

পালোয়ান ভনভনিয়ে বলল, ‘আমি ভাবছিলাম -এটা আবার কে? মাঝরাস্তায় রিকশা আটকিয়ে রাঁড়ের মত নাকে কান্না জুড়েছে”!

রামাধীন বলল, ‘ছিঁচকাদুনে নই, নালিশ করতে এসেছি’। বৈদ্যজীর পরিবারে তুমিই একমাত্র মানুষের মত, বাকি সব ফালতু। তাই তোমায় বলছি। একটা চিঠি এসেছে।তাতে ডাকাতেরা আমার থেকে পাঁচহাজার টাকা দাবি করেছে। বলেছে অমাবস্যার রাতে দক্ষিণদিকের টিলার উপরে রেখে আসতে হবে।‘

বদ্রী পালোয়ান নিজের উরূতে চাপড় মেরে বলল,’ মন চায় তো দিয়ে এস, না চাইলে একটা ফুটো কড়িও দেবার দরকার নেই। এর বেশি আর কী বলব? চলো রিকশাওয়ালে।

ঘর প্রায় এসে গেছে। এতক্ষণে নিশ্চয় বাইরের রোয়াকে ভাঙ ঘুঁটে তৈরি হয়ে গেছে।এক গেলাস মেরে দিয়ে, চানটান সেরে , কোমরে ল্যাঙট কষে গায়ে পাঞ্জাবি চড়িয়ে আড্ডায় জমিয়ে বসা যাবে। তারপর লোকেরা জানতে চাইবে, “পালোয়ান, কী করে এলে?”

কিন্তু ও চোখ বুঁজে ভাঙের মৌতাত নেবে। উত্তর দেবে না। লোকজনকেই প্রশ্ন ও উত্তর দুটোই চালাতে দেবে। তখন দেহের শক্তি আর ভাঙের নেশায় সব কথাবার্তা মশার ভনভনানি মনে হবে।

স্বপ্নের সাগরে গোঁত্তা খাওয়ার মাঝে মাঝরাস্তায় রিকশা থামানো? বদ্রীর খুব রাগ হল। ও আরেকবার রিকশাওলাকে ধমকে উঠল, “তোমাকে বলেছি না চলো”?

কিন্তু চলো বললেই হয়না, রামাধীনের হাত এখনও রিকশার হ্যান্ডল শক্ত করে ধরে রেখেছে। ও বলল,’ দেখ, টাকা-পয়সার কথা নয়। আমার থেকে কে টাকা আদায় করবে?আমি চাইছি যে তুমি তোমার ভাই রূপ্পনকে ভাল করে কড়কে দাও।বড্ড মাথায় চড়েছে। মাটিতে পা রাখুক, আকাশে উড়তে—‘।

বদ্রী পালোয়ান এবার নিজের উরূতে চাপ দিয়ে রিকশা থেকে লাফিয়ে নামল। তারপর রামাধীনকে টেনে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বলল, “কেন খামোখা মুখ খারাপ করছ? রূপ্পন করেছেটা কী”?

--আমার বাড়িতে ডাকাতির হুমকি ভরা চিঠিটা রূপ্পনই পাঠিয়েছে, প্রমাণ পেয়েছি।

পালোয়ান গজগজ করতে লাগল,--দু’চার দিন বাইরে গেলেও মুশকিল। এদিকে আমি গেছি কি ওদিকে এই তামাশা শুরু’।

তারপর একটু ভাবল, শেষে রামাধীনকে অভয়দান করে বলল,’যখন হাতেনাতে প্রমাণ পেয়েছ, তখন ঘাবড়াচ্ছ কেন?তোমার বাড়িতে ডাকাতি হবেনা। যাও, আরামে ঘুমোও গিয়ে। রূপ্পন ডাকাতি করার বান্দা নয়। চ্যাঙড়া বয়েস, একটু মজা করেছে, আর কি’।

রামাধীন কড়া সুরে বলল, ‘ওটা আমিও বুঝি, রূপ্পন চ্যাঙড়ামি করেছে। কিন্তু এটা কী ধরণের চ্যাঙড়ামি’?

পালোয়ান সায় দিল, ‘ঠিকই বলেছ, বড্ড বেশি ছ্যাবলামো’।

একটা ট্রাক ভীমবেগে তেড়ে আসছে। তার হেডলাইটের আলোয় সবার চোখ ধাঁধিয়ে যেতে বদ্রী রিকশাওলাকে বলল, ‘ রিকশা সরাও, এটা তোমার বাপের রাস্তা নাকি’?

রামাধীন বদ্রীর গলার স্বর চেনে। বলল,’ এটা রাগের কথা নয় পালোয়ান। ভেবে দেখ, এটা কোন কথা হল? ডাকাতির হুমকি দিয়ে চিঠি’!

পালোয়ান রিকশায় উঠে পড়ল।‘ডাকাতি হবে না বললাম তো, ফের তক্কাতক্কি কিসের? চালাও রিকশাওলা’!

রিকশা চলতে শুরু করলে ও বলল,’ রূপ্পনকে বলে দেব। বোঝাব, এসব ইয়ার্কি ভাল নয়’।

রামাধীন চেঁচিয়ে উঠল, ‘ও আমার ঘরে ডাকাতির হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠাল আর তুমি ওকে শুধু বোঝাতে যাবে?বোঝানো না, ওকে ভাল করে জুতোপেটা করা উচিৎ’।

রিকশা গড়গড়িয়ে চলতে লাগল। পালোয়ান মাথা না ঘুরিয়ে জবাব দিল,’ এক কাজ কর। খুব খারাপ লাগলে তুমিও আমার বাড়ির ঠিকানায় পালটা ডাকাতির চিঠি পাঠিয়ে দাও’। (চলবে)

0 comments: