0

প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার

Posted in







কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন “পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।” কিন্তু, আমরা অনেকেই হয়তো জানি না যে, এক ধরণের গোল রুটি যা মূলত উত্তর ভারতে ‘চাপাটি’ নামে পরিচিত তা আতঙ্ক ধরিয়ে প্রায় ঝলসে দিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অনেক ব্রিটিশ অফিসারদের এ দেশকে শাসন করার আশা। আসলে, ইতিহাসের পাতায় স্থান পাওয়া অনেক অন্দোলনের কথাই কালের সমুদ্রে আজ হারিয়ে গেছে। আর সেই আন্দোলন যদি হয় রহস্যময়, তাহলে? তাহলে, তো কোনও কথাই নেই। রহস্যময় আন্দোলনই প্রায় অমীমাংসীত অবস্থায় স্থান পায় ইতিহাসের কালের গভীরে।

আমাদের ভারতবর্ষের দীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক ঘটনাই ইতিহাসে লিপিলব্ধ হলেও, সেগুলো সম্পর্কে আমরা তেমন কিছুই জানি না। যদিও আমরা ইতিহাস থেকে অনেক কিছুই শিখেছি, শিখে চলেছি এবং ভবিষ্যতেও শিখব। অনেক রহস্যময় আন্দোলনই আমাদের শিক্ষাদান করে চলে যখন তা সংগঠিত হয়েছিল তখনকার তার সামাজিক প্রভাব ও বিস্তারও আমাদের ভাবিয়ে তোলে। অনেক রহস্যময় আন্দোলনই কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও সেগুলো আমাদের শিহরণ জোগায়, বিস্মিত করে তোলে। এরকমই এক রহস্যময়, প্রায় অজানা আন্দোলনের নাম ‘চাপাটি আন্দোলন’, যে আন্দোলনের অস্ত্র কোনও বন্দুক, রাইফেল বা তলোয়ার কোনও কিছুই ছিল না, ছিল একটি গোল রুটি। যে রুটি হাতের তালুতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে থাপ্পড় মেরে বানানো হয়। তাই, এর আকার চ্যাপ্টা। এর চ্যাপ্টা আকারের জন্য আর থাপ্পড় দিয়ে বানানোর জন্য এর নাম ‘চাপাটি’। ‘চাপাটি’ শব্দটি এসেছে হিন্দি শব্দ ‘চপত’ থেকে যার অর্থ ‘চ্যাপ্টা’। আবার এর অপর অর্থ হল ‘চড়’। এই চাপাটি ভারতীয়দের বিশেষ করে উত্তর ভারতীয়দের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় খাদ্য। এমনকি, ১৬ শতকে আবুল ফজলেরর লেখা আইন-ই-আকবরী থেকে জানা যায় যে, সম্রাট আকবরের পছন্দের খাবারের তালিকাতে ছিল এই চাপাটি। আর, সেই চাপাটি নিয়েই একটা আন্দোলন ঘটে গিয়েছিল ১৮৫৭ সালে দেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা সেপাহী বিদ্রোহের ঠিক আগেই।

কোনও সংগঠিত ঐতিহাসিক আন্দোলন সম্পর্কে জানতে হলে ইতিহাসবিদদের অনেক উপাদানের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। কিন্তু, চাপাটি আন্দোলনের প্রামাণ্য হিসেবে রয়েছে একটি চিঠি আর কিছু লেখা। সেইসব কিছু নিয়েই রোমমন্থন করা যাক রহস্যময় চাপাটি আন্দোলনকে।

এই আন্দোলনের কথা প্রথমবার উল্লেখ করেছিলেন ১৮৫৭ সালের মার্চ মাসে 'ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি'র সামরিক সার্জন ডক্টর গিলবার্ট হেডো। তিনি ব্রিটেনে অবস্থিত তাঁর বোনকে একটি চিঠিতে লেখেন যে, “There is a most mysterious affair going on throughout the whole of India at present. No one seems to know the meaning of it. It is not known where it originated, by whom or for what purpose, whether it is supposed to be connected to any religious ceremony or whether it has to do with some secret society. The Indian papers are full of surmises as to what it means. It is called the chapati movement.” বাংলায় যার তর্জমা করলে দাঁড়ায়, “বর্তমানে গোটা ভারত জুড়ে এক রহস্যময় ঘটনা ঘটে চলছে। কেউ এর অর্থ জানে বলে মনে হয় না। এটি কোথা থেকে শুরু হয়েছে, কার দ্বারা বা কি উদ্দেশ্যে, এর সাথে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত হওয়ার কথা বা কোন গোপন সমাজের সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে কি না তা জানা যায়নি। ভারতীয় পত্রপত্রিকায় এর অর্থ কী তা নিয়ে অনুমানে পূর্ণ। একে চাপাটি আন্দোলন বলে।”

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এই চিঠিতে 'চাপাটি আন্দোলন'-এর কথা উল্লেখ ছিল আর যার ফলেএই চিঠিই ভারতবর্ষের ইতিহাসে 'চাপাটি আন্দোলনের' একমাত্র প্রমাণ হিসেবে গণ্য। আর এই চিঠি থেকে এটা স্পষ্ট যে চাপাটি আন্দোলন কোনও ছোটখাটো ঘটনা ছিল না বরং এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে অনেক ব্রিটিশ অফিসারের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল এই চাপাটি আন্দোলন।

আসলে ঘটনাটি এইরকম। ১৮৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কোনও এক সকাল। মাথুরার ম্যাজিস্ট্রেট মার্ক থ্রনহিল অফিসে এসে হঠাৎ দেখেন যে তাঁর টেবিলে রয়েছে এক টুকরো রুটি। বেশ বিস্মিত হয়েছিলেন তিনি। হঠাৎ রুটি এখানে কে আনল আর কেনই বা আনল? অনুসন্ধান করে থ্রনহিল সাহেব জানতে পারেন যে, রুটিটি এনেছেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা যিনি সেটা পেয়েছেন একজন গ্রামের চৌকিদারের কাছ থেকে। সেই চৌকিদার রুটি কোথা থেকে পেয়েছিল? জানা যায় যে, জঙ্গল থেকে কেউ একজন প্রহরীদের হাতে রুটি তুলে দিচ্ছিলেন আর তার সাথে এটাও বলে দিচ্ছিলেন যে আরও চারটে রুটি বানিয়ে যেন সকলকে বিতরণ করা হয়। আবার, সেই চারজনকেও যেন জানিয়ে দেওয়া হয় তারাও যেন প্রত্যেকে আরও চারটে করে রুটি বানিয়ে বিতরণ করে। অর্থাৎ, এর ফলে জ্যামিতিক অগ্রগতিতে বাড়বে রুটির সংখ্যা। অপর মতে একদিন মার্ক থ্রনহিল সাহেব বাড়ি থেকে থানায় এসে নিজের টেবিলে দেখেন যে, রুটি বা চাপাটি ভর্তি একটি বস্তা পড়ে আছে। তিনি অবাক হয়ে এই বিষয়ে একজন ভারতীয় সেনার কাছে জানতে চাইলেন। সেই সেনা জানান যে, রাতে হয়তো এই বস্তা কেউ রেখে দিয়েছে। মার্ক অবাক হয়ে বলেছিলেন যে, “এই বস্তা ভর্তি চাপাটি কে দেবে?” কয়েকদিন পর খবর এল যে মাথুরার আশেপাশের প্রতিটি গ্রাম ও চৌকিতে এই ধরণের চাপাটির বস্তা পাওয়া যাচ্ছে।

মার্ক থ্রনহিল সাহেব ক্ষান্ত হলেন না। তিনি আরও তদন্ত ও অনুসন্ধান করে জানতে পারেন যে, রুটির ক্রমাগত বিতরণ চলছে উত্তর ভারত এমনকি উত্তরে নেপালের সীমানা থেকে দক্ষিণে নর্মদা নদীর তীরবর্তী এলাকা পর্যন্ত। এই রুটির বিতরণ চলছে প্রায় কয়েকশো মাইল পর্যন্ত বলা যায় দুই থেকে তিনশো কিলোমিটার পর্যন্ত। তিনি এই রুটির বিতরণের তদন্তের নির্দেশ দেন। কিন্তু তদন্তকালে তিনি ভারতীয় সৈন্যদের থেকে কোনও সাহায্য বা সুবিধা পেলেন না। কেননা, সৈন্যরা ও পুলিশেরা নিজেরাই চাপাটি তৈরি এবং বিতরণে সাহায্য করছিলেন। শুধু সাহায্যই নয়, মনে করা হয় যে, ৯০ হাজার কি তারও বেশি ভারতীয় পুলিশ একত্রিত হয়ে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে চাপাটির বস্তা বিতরণ করতেন। তাই, এভাবেই মথুরার ম্যাজিস্ট্রেটের নাকের ডগা থেকেই চাপাটি বিতরণ হয়ে যাচ্ছিল প্রতিটি গ্রামে। ব্রিটিশ অফিসারেরা কড়া প্রমাণ ছাড়াই তদন্ত করে জানতে পারেন যে, এক রাতের মধ্যে এক গ্রাম থেকে তৈরি চাপাটি দীর্ঘ ৩০০ কিলোমিটারের পথ অতিক্রম করে অন্য এক গ্রামে পৌঁছায়! এই বিতরণের ব্যবস্থা তো ব্রিটিশ মেইল ব্যবস্থার থেকেও দ্রুত! নেটিভদের এই অজ্ঞাত কৌশলে মাথাব্যথা ধরে যায় ব্রিটিশ অফিসারদের। মজার ব্যাপার হল এই যে, যারা বিতরণ করত তারা অনেকেই জানত না ব্যাপারটা কী হচ্ছে। গ্রামে একজন অচেনা মানুষ আসতেন এবং চাপাটির একটি বস্তা রেখে দিয়ে চলে যেতেন। যাওয়ার আগে গ্রামবাসীদের বলে দিতেন যে তারা যেন আরও বেশি করে রুটি তৈরি করে অন্য গ্রামে যেন পৌঁছে দেয়। কেন পৌঁছে দিতে হবে তা কেউ বুঝত না। গ্রামবাসীরা তাদের নিজেদের জমির গম থেকে আটা পিষে চাপাটি তৈরি করত আর তা বিতরণ করত। ব্রিটিশ কর্মকর্তারাও কোনও সদুত্তর খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অনেক গুজব ও জল্পনা ছিল চাপাটি ঘিরে। অনেকের মতে এই যে, চাপাটির মাধ্যমে গোপন কোনও বার্তা পাঠানো হচ্ছে। হয়তো ইংরেজ সরকারের বা কোম্পানীর বিরুদ্ধে কোনও গোপন আন্দোলনের পরিকল্পনা চলছে। এরকম আরও কত কি! কিন্তু এসবের কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি, থ্রনহিল সাহেব তাঁর অফিসে চাপাটি খুব গভীরভাবে পরীক্ষা করেও অস্বাভাবিক কিছু পেলেন না। চাপাটিগুলো স্বাভাবিক আকারেরই ছিল। তাতে না ছিল কোনও বার্তা, না ছিল কোনও অস্বাভাবিক চিহ্ন।

ধীরে ধীরে শত শত চাপাটি বিতরণের খবর প্রচার হয়ে গেল ভারতের উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, কলকাতা, মধ্য ভারত, গুজরাট সহ নানান জায়গায়। কিন্তু, এই চাপাটি বিতরণের রহস্যময় আন্দোলনের যে কি উদ্দেশ্য তা কেউই বুঝতে পারছিল না। আবার এদিকে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আগামীদিনে তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা ভেবে ভীত হয়ে উঠল। আর তাই অনেকেরই প্রিয় খাদ্য, এই নিরীহ চাপাটি রুটির অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলা বিতরণের ফলে তাদের ঘুম উড়ে যায়। এদিকে, রুটি বিতরণ তো আইনত অবৈধ কিছু নয়। এই রুটির মধ্যে তো কোনও বার্তা নেই। তাই, রুটির বিতরণকে ব্রিটিশ অফিসাররা গুরুতরভাবে সন্দেহ করলেও একে আইনত প্রতিরোধ করতে পারছিলেন না। তাই, চাপাটি রুটি বহনকারীদের কাউকে গ্রেফতার বা কারুর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করতেও তাঁরা পারছিলেন না।
এই আন্দোলন সম্পর্কে যতই গুজব বা জল্পনা প্রচলিত থাকুক না কেন, অনেকেই মনে করেন যে, সেই সময় মধ্য ভারতে কলেরা রোগ দেখা দিয়েছিল। তাই, সেই রোগে আক্রান্ত পরিবারগুলোকে সাহায্য করতে চাপাটি রুটির বিতরণ করা শুরু হয়েছিল। যদিও এই যুক্তি বা কারণের কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। তাই, ব্রিটিশ অফিসারদের কাছে তো বটেই এমনকি ভারতীয় ইতিহাসবিদদের থেকে শুরু করে আমজনতার কাছেও 'চাপাটি আন্দোলন' ব্রিটিশদের কাছে চিরকালই এক ‘রহস্যময় আন্দোলন’ হিসেবে রয়ে গেছে।

0 comments: