0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in







৩৪



ফাইনহালস শুনতে পেয়েছিল গাড়ি স্টার্ট দেবার শব্দ। সব শ্রমিকেরা ফিরে যাচ্ছে। ব্রিজের সামনে ঢালু পথে দাঁড়িয়ে সে দেখতে লাগল। ওদের বেশি জিনিসপত্র বাকি নেই আর। রান্নার চুলা, কিছু চেয়ার, আলুর ঝুড়ি, কিছু প্লেট, শ্রমিকদের মালপত্র গাড়িতে তোলা হচ্ছে। শ্রমিকেরা কাজ সেরে চলে এসেছে। গাড়িতে উঠে পড়ছে সবাই। ওদের সবার হাতে শ্নাপের* বোতল। ওরা একটু একটু শ্নাপ খাচ্ছে সবাই। স্লোভাক মেয়েটা সবার শেষে গাড়িতে উঠল। মাথায় একটা লাল স্কার্ফ বেঁধেছে মেয়েটা। মেয়েটার সঙ্গে মালপত্র কিছুই নেই প্রায়, মাত্র একটা নীল কাপড়ের পুঁটলি। ওরা চলে যাচ্ছে দেখে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছিল ফাইনহালস, ভাবছিল একবার সামনে যাবে কি না বিদায় জানাতে; কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরে এলো সে ব্রিজের উপরে।

কাজ শেষ করে ডয়সেন ব্রিজের উপর থেকে নেমে এলো ধীরে ধীরে। হাতে রেঞ্চটা রয়েছে তার। ধীরপায়ে সে ঢুকে গেল টেমানদের বাড়িতে।

মাঝরাত অবধি ফাইনহালস আর গ্রেস ব্রিজের সামনের ঢালু রাস্তার পাশে যে নিচু দেওয়ালটা ছিল, সেই দেওয়ালের আড়ালে বসেছিল। রাতের অন্ধকারে কান খাড়া করে জেগেছিল তারা।

চারদিক নিস্তব্ধ। মাঝেমাঝে জঙ্গলের ভিতর থেকে সান্ত্রীরা বেরিয়ে আসছিল। এক দু’টো ক্লান্ত কথাবার্তা সেরে, জঙ্গলের দিকে চলে যাওয়া সরু পথের দিকে চেয়ে, নীরবতার মধ্যে বসে থাকছিল তারা। কিন্তু কেউই আসেনি সেই পথ ধরে। এমনকি পাহাড়ের উপরেও সব কিছু নিস্তব্ধ। মাঝরাতে আরও দু’জন সৈনিক তাদের জায়গায় যাবার পরে তাদের ছুটি হল। তারা ঘরে এসে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু ভোর হবার আগেই একটা কোলাহলে ঘুম ভেঙে গেল তাদের। বিছানা ছেড়ে গ্রেস পায়ে জুতোজোড়া গলাতে শুরু করল এবং ফাইনহালস খালি পায়ে গিয়ে জানালায় দাঁড়াল। নদীর ওই পারে প্রচুর লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। তারা লেফটেন্যান্টের সঙ্গে কথা বলছে। কিন্তু লেফটেন্যান্ট একেবারেই তাদের ব্রিজে উঠবার অনুমতি দিতে রাজি নন। লোকগুলো সম্ভবত দূরে যেখানে গির্জার চূড়া দেখা যায় জঙ্গলের পিছনে, সেই গ্রাম থেকে কিম্বা পাহাড়ের গ্রাম থেকে এসেছে এখানে। বিরাট মিছিল করে লোকগুলো এসেছে। কোথায় এই মিছিলের শেষ, সেটা দেখা যাচ্ছেনা এখান থেকে। জঙ্গলের ভিতরে এখনও আছে প্রচুর লোক। লোকগুলো ভীষণ চিৎকার করছে, ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর তাদের। ফাইনহালস দেখতে পেল যে মিসেস সুজান চপ্পল পায়ে, গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে ব্রিজের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। লেফটেন্যান্ট তার সঙ্গে কিছু কথা বললেন, তারপর মিসেস সুজানকে দেখা গেল অনেকটা সময় ধরে ওই গ্রামের লোকগুলোর সঙ্গে কথা বলতে। তারপর আবার মিসেস সুজান লেফটেন্যান্টকে কিছু একটা বললেন। ইতিমধ্যে ডয়সেনকেও দেখা গেল; ধীরে ধীরে হাতে সিগারেট নিয়ে হেঁটে গেলেন তিনি ব্রিজের দিকে। প্রথমে তিনি লেফটেন্যান্টের সঙ্গে কথা বললেন, তারপর মিসেস সুজানের সঙ্গে, তারপর গ্রামের লোকজনের সঙ্গে। অবশেষে উদ্বাস্তু মানুষজনের মিছিলটা নদীর ওইদিকের পাড় বরাবর পথ ধরে ঝারনির দিকে যেতে লাগল। অনেকগুলো গাড়ি, ঠেলা, সব মানুষজন, মালপত্র দিয়ে ঠাসা। বাচ্চাকাচ্চা, হাঁসমুরগির বাক্সখাঁচা সব নিয়ে লোকগুলো যাচ্ছে। বিরাট সারি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। ডয়সেন মিসেস সুজানকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছেন এবং ক্রমাগত মাথা নেড়ে যাচ্ছেন।

ফাইনহালস ধীরে সুস্থে পোশাক পরে তৈরি হল এবং বিছানায় শুয়ে রইল। সে ঘুমোবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু গ্রেস তখন দাড়ি কামাতে শুরু করল এবং হালকা শিস দিয়ে গান গাইতে লাগল। কয়েক মিনিট পরে তারা শুনতে পেল দুটো গাড়ির শব্দ। প্রথমে মনে হচ্ছিল যে গাড়িদুটো পাশাপাশি আসছে, তারপর শব্দে মনে হল একটা আরেকটাকে টেক্কা দিতে ব্যস্ত; তারপর কেবলমাত্র একটা গাড়ির শব্দ আরেকটা শব্দকে ঢেকে দিল। ফাইনহালস লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে গিয়ে দেখে যে বাদামি গাড়িটা এসেছে, যেটায় করে প্রায়ই ওদের তহবিলদার এসে বেতন দেয় শ্রমিকদের। গাড়িটা টেমানদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ডয়সেন আরেকজন লোকের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজের দিকে যাচ্ছে। লোকটার খাকি বাদামি ইউনিফর্ম, কাঁধে মেজরের পদমর্যাদার সাজসজ্জার স্ট্র্যাপ। এর মধ্যে দ্বিতীয় গাড়িটাও এসে পড়েছে; একটা ধূসর রঙের গাড়ি। গাড়িটার অবস্থা বেশ সঙ্গিন মনে হচ্ছে, ধুলো ভর্তি, কাদার ছিটে লাগা। গাড়িটা মিসেস সুজানের বাড়ির সামনে থামল।

গাড়ি থেকে প্রাণবন্ত এবং ছোটখাট চেহারার এক লেফটেন্যান্ট বেরিয়ে এসে বলে উঠল, ‘তৈরি হয়ে নিন আপনারা সবাই। যেতে হবে এখান থেকে। পরিস্থিতি সুবিধের নয়। আপনার বস কোথায়?’ ফাইনহালস লক্ষ্য করল যে ছোটখাট চেহারার লেফটেন্যান্টের কাঁধের স্ট্র্যাপ এঞ্জিনিয়ারের। সে ব্রিজের দিকে আঙুল দেখাল… ‘ওইখানে’

‘ধন্যবাদ’ বলে লেফটেন্যান্ট গাড়ির মধ্যে বসে থাকা লোকটিকে বললেন ‘সব তৈরি রাখো।’ … বলেই দৌড় লাগালেন ব্রিজের দিকে। ফাইনহালস তাকে অনুসরণ করল।

খাকি বাদামি ইউনিফর্ম পরা, কাঁধে মেজরের স্ট্র্যাপ লাগানো লোকটি ঘুরে ঘুরে ব্রিজটা দেখতে লাগল। ডয়সেন তাকে সব দেখাতে লাগল। লোকটা সন্তোষজনক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছিল। মাথা নেড়ে ডয়সেনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজ থেকে টেমানদের বাড়ি অবধি এল লোকটা। ডয়সেন ভেতরে ঢুকে তার মালপত্র আর রেঞ্চ নিয়ে বেরিয়ে এসে বাদামি গাড়িটায় উঠে পড়ল; গাড়িটা সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল টেসার্জির দিকে।

দু’জন মেশিনগানধারী সৈনিক, যারা গ্রেস এবং ফাইনহালস মাঝরাতে চলে আসবার পরে ব্রিজে পাহারা দিচ্ছিল, তাদের সঙ্গে নিয়ে মুক ফিরে এল। এছাড়াও তার সঙ্গে এল এঞ্জিনিয়ার লেফটেন্যান্ট এবং এক আর্টিলারি সার্জেন্ট। সার্জেন্টের অবস্থা বেশ বিধ্বস্ত। সঙ্গে কোনো অস্ত্র নেই, মালপত্র নেই, ধুলোয় ঢাকা শরীর, ঘামে ভেজা মুখ, দেখে মনে হচ্ছে বেশ ক্লান্ত। সার্জেন্ট জঙ্গলের দিকে, জঙ্গল ছাড়িয়ে পাহাড়ের দিকে আঙুল তুলে উত্তেজিতভাবে কী যেন দেখাচ্ছে। ফাইনহালস নিজেও ওই পথে গাড়ি নেমে আসবার শব্দ শুনতে পেল। ছোটখাট চেহারার এঞ্জিনিয়ার লেফটেন্যান্ট দৌড়ে এলো ধূসর গাড়িটার কাছে এবং চিৎকার করে উঠল, ‘তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি!’ একজন সৈনিক ধূসর টিনের বাক্স, বাদামি কার্ডবোর্ডের বাক্স আর একবান্ডিল তার নিয়ে দৌড়ে এল।

এঞ্জিনিয়ার লেফটেন্যান্ট নিজের ঘড়ি দেখলেন, ‘সাতটা বাজে, আমাদের হাতে ঠিক দশ মিনিট সময় আছে।’ মুকের দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি… ‘ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে উড়ে যাবে। এভাবেই আক্রমণ আটকানো সম্ভব।’

ফাইনহালস ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে যায়। নিজের মালপত্র গুছোতে থাকে, রাইফেলটা নেয়। বাড়ির দরজার বাইরে সব জিনিস রাখে। তারপর আবার বাড়িটার ভিতরে যায়। বাড়ির ভিতরে দু’জন মহিলা, তারা কেউই বাইরে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়নি এবং উত্তেজিতভাবে ইচ্ছেমত জিনিসপত্র টানাটানি করে বাড়ির বাইরে রাখছে এবং একজন আরেকজনের উপরে চিৎকার করছে। ফাইনহালস ম্যাডোনার মূর্তির দিকে তাকায়, মূর্তির সামনে রাখা ফুলগুলো অর্ধেক শুকিয়ে গেছে। ফাইনহালস শুকনো ফুলগুলো বেছে নিয়ে ফেলে দেয়। অপেক্ষাকৃত তাজা ফুলগুলো একটা তোড়ায় বেঁধে সাজিয়ে রাখে মূর্তির সামনে, ঘড়ির দিকে তাকায়। আট মিনিট হয়ে গেছে। নদীর অন্য পারে, পাহাড়ের দিক থেকে অনেক গাড়ি আসবার শব্দ ক্রমেই স্পষ্টতর হচ্ছে। সম্ভবত গ্রাম পেরিয়ে গাড়িগুলি জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। যাবার জন্য প্রস্তুত। লেফটেন্যান্ট মুকের হাতে একটা কাগজের প্যাড, সে বিধ্বস্ত আর্টিলারি সার্জেন্টের সব ব্যক্তিগত তথ্য লিখছে। সার্জেন্ট বেঞ্চের উপরে বসে আছে।

‘শ্নীভিন্ড’ বলে সার্জেন্ট, ‘আমি আর্থার শ্নীভিন্ড… আমরা ৯১২ নম্বর থেকে এসেছি।’ মুক লিখে মাথা নেড়ে নিজের চামড়ার ব্যাগে কাগজের প্যাডটা ঠেলে ঢুকিয়ে দেয়। সেই মুহূর্তে ওই ছোটখাট এঞ্জিনিয়ার লেফটেন্যান্ট দৌড়ে আসে, সঙ্গে আগের সেই সৈনিক যে টিন, প্যাকিং বাক্স এসব নিয়ে গিয়েছিল; এঞ্জিনিয়ার লেফটেন্যান্ট জোরে চিৎকার করে… ‘ফুল কভার, ফুল কভার!’

সবাই কোণাকুণি দাঁড়িয়েছিল ব্রিজে উঠবার ঢালু পথের সামনে, মুহূর্তের মধ্যে ছিটকে সবাই শুয়ে পড়ল রাস্তার উপরেই, যতখানি বাড়িটার কাছাকাছি যাওয়া যায়, সেই আড়ালটুকু সামনে রেখে। এঞ্জিনিয়ার লেফটেন্যান্ট ঘড়ির দিকে তাকাল… তারপর ব্রিজটা উড়ে গেল। সেরকম কোনো বিশাল আওয়াজ হল না। প্রথমে মড়মড় করে কী যেন ভাঙল, বাতাসে বেশি ধুলো পর্যন্ত উড়ল না। তারপর হ্যান্ড গ্রেনেড ফাটার মত শব্দ হল কয়েকটা, ওরা বুঝতে পারল যে ভারি রাস্তাটা ভেঙে পড়ছে। ওরা কিছু মুহূর্ত অপেক্ষা করল, যতক্ষণ না ছোটখাট চেহারার লেফটেন্যান্ট বলে উঠলেন, ‘হয়ে গেছে।’

ওরা উঠে দাঁড়িয়ে ব্রিজের দিকে তাকাল। কংক্রিটের পিলারগুলো এখনও আছে। ব্রিজের উপরের রাস্তা, তার পাশের ফুটপাথ সব পরিষ্কারভাবে উড়ে গেছে। শুধু বাঁ দিকের রেলিঙের কিছু অংশ এখনও পিলারগুলোর সঙ্গে লেগে ঝুলে আছে।

ওপার থেকে এগিয়ে আসা গাড়িগুলোর শব্দ ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল; হঠাৎ শব্দ থেমে গেল। সম্ভবত গাড়িগুলো জঙ্গলের মধ্যে থেমে গিয়েছে।

ছোটখাট সেই এঞ্জিনিয়ার লেফটেন্যান্ট ফিরে যাবার জন্য গাড়িতে উঠবার আগে ঘুরে দাঁড়িয়ে মুককে বললেন, ‘আপনি আর এখানে কেন অপেক্ষা করছেন? আপনার কিন্তু এখানে থাকবার কোন অর্ডার নেই আর…’ বলে একটা স্যালুট ঠুকে সেই নোংরা ধূসর গাড়িটায় চেপে তিনি চলে গেলেন।

‘চলো’… চিৎকার করে ওঠে লেফটেন্যান্ট মুক। তারা পথে দাঁড়িয়ে আছে। মুকও পথে দাঁড়িয়ে দুটো বাড়ির দিকে তাকায়। কিন্তু বাড়ি দুটোতে একটা জিনিসও নড়েছে বলে মনে হচ্ছে না। মহিলার কণ্ঠে কান্নার আওয়াজ আসছে, মনে হচ্ছে কণ্ঠটা এক বয়স্ক মহিলার।

‘মার্চ’… চিৎকার করে মুক ‘জোরে পা না ঠুকে মার্চ করো’। সবার আগে সে সামনে এগিয়ে চলে; গম্ভীর এবং বিষণ্ণ লেফটেন্যান্ট মুক দূরে কোথাও চেয়ে আছে। সামনে অনেক দূরে, নাকি পেছনে কোথাও?



(চলবে)



*. শ্নাপ- ব্র্যান্ডি জাতীয় জার্মান মদ

0 comments: