0

সম্পাদকীয়

Posted in



একটা বিষয় আজকাল বেশ ভাবিয়ে তুলছে। একথা আমরা সবাই জানি, সমাজের সমসাময়িক বিষয় নিয়েই নির্মিত হয় সাহিত্য। আবার ভাষা হলো সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্যতম ধারক এবং বাহক। অর্থাৎ, বিষয়গুলি পরস্পর নির্ভরশীল। সংশয়টা ঠিক এইখানেই। সাহিত্য যদি সমসাময়িক সমাজের চিত্র হয় এবং তা প্রকাশের মাধ্যম যদি হয় ভাষা, তবে এই পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভাষা প্রয়োগের স্বাধীনতা কতটা আছে এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত সমাজচিত্র কতটা সাহিত্যে প্রতিফলিত হতে পারছে, তা সংশয়াতীত নয়। আজকের পরিস্থিতিটির কথাই ভাবুন। ভ্যাক্সিন আবিষ্কৃত, মে মাস থেকে ১৮ বছরের বেশি বয়স্ক সকলকেই ভ্যাক্সিন নিতে হবে, এই মর্মে সরকার নির্দেশ জারি করেছেন। নিঃসন্দেহে সাধু উদ্যোগ। অর্থাৎ, ধরে নিতে পারি, ভ্যাক্সিন এখন বাজারজাত এবং সহজলভ্য। অতিমারিকে কাবু করা গেছে – এমনটা ভাবাই যেত; যদি না এই অতিমারিরই নতুন একটি প্রবাহ আবার আছড়ে পড়ত প্রবল বিক্রমে। আগেরটাকেও চিনতাম না, আন্দাজে ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ি চলছিলো, আলটপকা সে ঢিল লেগেও যাচ্ছিল প্রায়ই, এখন এই দ্বিতীয় প্রবাহ আরও অচেনা। সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা। জীবন তো থেমে থাকতে পারে না! অথচ দেখুন, নির্বাচন প্রক্রিয়া চলছে প্রস্তাবিত কর্মসূচী এতটুকু সঙ্কুচিত না করেই। এদিকে কিন্তু ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ডকে উঠেছে। তারা চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছে ‘ওপেন বুক’ পরীক্ষা দেওয়া ব্যাচ হিসেবে, পরবর্তীকালে এদের চাকরি দেওয়ার দায় আর কারোর থাকছে না, স্বভাবতই! এই পরিস্থিতির কথা সাহিত্যের ‘প্রহসন’ধারায় লিপিবদ্ধ হচ্ছে কি? জাতীয় মূল্যবোধ, নৈতিকতা-অনৈতিকতা, শিক্ষা-কুশিক্ষা, সংস্কৃতি-অসংস্কৃতি, শালীনতা-অশালীনতা, ন্যায়-অন্যায়, সহযোগিতা-অসহযোগিতা, সেবা, আনুগত্য, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, ভালোবাসা সব ঘেঁটে ঘ! তবুও হতাশ হবো না, ঠিক করেছি। আসুন, সমবেত হয়ে লড়াই করি, সচেতন হই। জিততে আমাদের হবেই!

সুস্থ থাকুন, সৃজনে থাকুন

শুভেচ্ছা নিরন্তর

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in












(একটি বামমার্গী ভাষ্য)


"Far from being a feudal poet, the Shakespeare that 'Troilus & Cressida', 'The Tempest,' or, even 'Coriolanus' shows us is much more a Bolshevik (using this little word popularly) than a figure of conservative romance". Wyndham Lewis, "The Lion and the Fox" [London, 1927]. p.3.


গৌরচন্দ্রিকা

[আকাদেমিক দুনিয়ার বাইরে বাংলায় শেক্সপিয়র চর্চার,(মঞ্চে এবং লেখালিখিতে) অন্যতম পথিকৃৎ এবং বিশিষ্ট নট, নাট্যকার ও পরিচালক উৎপল দত্তের ৯১ তম জন্মদিন গেল ২৯মার্চ তারিখে। আবার উইলিয়ম শেক্সপীয়রের জীবননাট্যে ২৩শে এপ্রিল তারিখটি ধরা হয় একই সঙ্গে তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিন হিসেবে। এই সামান্য প্রবন্ধটি ওঁদের দুজনের প্রতি আমার বিনীত শ্রদ্ধাঞ্জলি মাত্র]


বর্তমান প্রবন্ধটি মহাকবি শেক্সপীয়রের রচনার কোন একাডেমিক চর্চা বা মূল্যায়নের প্রচেষ্টা নয়, সে যোগ্যতাও আমার নেই। এ শুধু বিশ্বজোড়া ভুমন্ডলীকরণ এবং নব-উদারবাদী অর্থনীতির বোলবোলাওয়ের দিনে আমার মত এক প্রাক্তন বামরাজনৈতিক কর্মীর নিজস্ব শেক্সপীয়র পাঠ; একান্তই আমার ভালোলাগাটুকু বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার প্রয়াস। তাই এই ছোট পরিসরে আমি সংক্ষেপে ওঁর কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইশারা করব।

প্রথমতঃ আমরা মধ্য যৌবনে শেকসপিয়রকে অন্যভাবে পড়ার আগ্রহ পেয়েছিলাম উৎপল দত্তের “শেক্সপিয়রের সমাজচেতনা” বলে বইটি হাতে পেয়ে। কোলকাতার অধ্যাপককুল সেই বইটি নিয়ে কিঞ্চিৎ নাক সিঁটকে ছিলেন। পরে আমার বন্ধু সাংবাদিক প্রণয় শর্মা আমাকে দেখিয়েছিলেন যে ওই বইটিতে ‘যীশু” এবং “ধর্ম” অধ্যায় দুটিতে জার্মান কমিউনিস্ট কার্ল কাউটস্কির ১৯০৮ সালে প্রকাশিত ‘ফাউন্ডেশন অফ ক্রিশ্চিয়ানিটি”র প্রভাব বেশ প্রকট।

তাতে অবশ্য বইটির উপস্থাপনায় কোন তফাৎ হয়নি। আমার এই অকিঞ্চিৎকর লেখায় মৌলিক চিন্তার বদলে উৎপল দত্ত সমেত সমসাময়িক বামমার্গী সাহিত্য সমীক্ষক গারেথ জেঙ্কিস -- ‘শেক্সপিয়র বিলংস টু আস’(২০১৬)-- এবং টেরি ইগলটন এর মত দিকপাল মার্ক্সিস্ট সাহিত্য সমালোচকদের প্রভাব। তাই এই প্রবন্ধে যদি কিছু ভাল আর্গুমেন্ট থাকে তার কৃতিত্ব ওঁদের। আর দুর্বল বা টেনে মানে করার ক্ষেত্রে বুঝতে হবে আমি কতটা ছড়িয়েছি।


মার্ক্স, এংগেলস, জেনি মার্ক্স ও শেকসপিয়র

দুই বন্ধু, মার্ক্স ও এংগেলস মুগ্ধ ছিলেন শেক্সপিয়রের কলমে সাদামাটা একমাত্রিক স্টেনসিল চরিত্রের বদলে বহুস্তরীয় দ্বন্দ্বে দ্বিধাদীর্ণ মানুষের চিত্রণে। এদিক ওদিক চিঠিপত্রে ওঁরা একাধিকবার উল্লেখ করেছেন ‘টিমন অফ এথেন্স’ নাটকে প্রায় সর্বস্বান্ত টিমনের সোনা নিয়ে বৈপরীত্যের বিখ্যাত স্বগতোক্তি।১৮৭৭ সালে জেনি মার্ক্স ইংল্যান্ডের লাইসিয়াম থিয়েটারে হেনরি আর্ভিংএর রিচার্ড দি থার্ড অভিনয়ে বাঁধাধরা ভিলেন এর স্টেনসিল থেকে আলাদা বুদ্ধিদীপ্ত চিত্রণে মুগ্ধ হয়ে রিভিউ লিখেছিলেন। মার্ক্সের জীবনীকার ফ্রাঞ্জ মেহরিং জানিয়েছেন মার্ক্সের গোটা পরিবার ভুগত ‘শেক্সপিয়রফোবিয়া’তে।

এছাড়া গত শতাব্দীর গোড়া থেকে সেসময়ের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার ও পরিচালক বের্টল্ট ব্রেখট ও ছিলেন শেক্সপিয়রভক্ত। শুধু ‘করিওলেনাস’ নয় অন্য কয়েকটি নাটককেও নতুন করে গড়ে তোলার বারবার পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন।

সে যাই হোক, গোদা বাংলায় আমার বক্তব্যের মোদ্দা কথাটা হল শেক্সপীয়র ছিলেন ওঁর যুগের ,মানে এলিজাবেথান যুগের, জনতার কবি।

যদিও মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গীর সাহিত্য সমালোচকেরা এ’ব্যাপারে দুই বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে। গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে একদল যান্ত্রিক ভাবে মার্ক্সের অর্থনীতিকে ভিৎ এবং শিল্পসাহিত্যকে ওপরের তলা, তথা এগুলো আর্থিক সম্পর্কের নিগড়ে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা গোছের যান্ত্রিক বিশ্লেষণে মগ্ন হয়ে ভাবতেন-- যেহেতু শেক্সপিয়রকে প্রগতিশীল হতে হবে , অতএব ওনাকে উঠতি বুর্জোয়ার প্রতিনিধি ধরতে হবে। কারণ ইতিহাসের বিচারে এলিজাবেথান ইংল্যান্ডে সামন্ততন্ত্র প্রতিক্রিয়াশীল এবং উঠতি বণিকপুজি হল প্রগতিশীল। অতঃ শেক্সপিয়র হলেন রেনেসাঁর এবং উঠতি বুর্জোয়ার প্রতিনিধি। ওঁরা উদাহরণ দেবেন মার্চেন্ট অফ ভেনিসের, কমেডি অফ এরর্সের এবং এই জাতীয় কিছুর। এযেন শার্টের গায়ে বোতাম লাগানোর বদলে হাতে একটা গোটা বোতাম পেয়ে তাতে শার্ট সেলাই করে দেয়া।


জীবননাট্যের কিছু প্রস্থানবিন্দুঃ

উইলিয়ম এসেছিলেন হ্যাভন নদীর তীরের স্ট্র্যাটফোর্ড নামের একটি অনামী গ্রামের সাধারণ পরিবার থেকে ।

পিতা জন শেকসপীয়র ছিলেন একজন সফল কারিগর। কিঞ্চিৎ সম্পত্তি অর্জিত করে চাইছিলেন সমাজের উঁচুতলায় উঠতে; আবেদন করেছিলেন ‘কোট অফ আর্মস’ পেতে। এই সাপসিঁড়ি খেলায় ব্যর্থ হন। কিন্তু ছেলে উইলিয়ম তাঁর সেই বাসনা পূর্ণ করেছিলেন। নিজে গ্লোবের নিয়মিত ভাল অভিনেতাদের একজন। তারপর সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ক্রমশঃগ্লোব থিয়েটারের মালিকানার অংশীদারি ছাড়াও নদীর পাড়ে বেশ কিছু জমিজমার মালিক হওয়া। দুনিয়াদারির ঘাঁতঘোঁত ভালই বুঝতেন। তাই রাণী এলিজাবেথের কড়া শাসন ও নাটক নিয়ে সেন্সার এবং জেল তথা মুন্ডচ্ছেদের সময়েও ধরি-মাছ, না-ছুঁই-পানি ভালই চালিয়ে গেছলেন।

ভাষাতেও অসামান্য দখল এবং বৈপরীত্য। কবিতায় সনেট ও ব্ল্যাংক ভার্সে পটুত্বের সঙ্গে নিজস্ব ছাপ। নাটকীয় গদ্য লেখার ও কাব্যময় সলিলোকিতে একমেবাদ্বিতীয়ম। চরিত্রের সৃজন ও তাদের মুখে সঠিক ভাষাশৈলীর প্রয়োগ—সে জেন্টলম্যানের হোক কি শুঁড়িখানার মাতালের বা ভবঘুরের। একদিকে ‘ টু বি অর নট টু বি’ বা ‘ হোয়াট ইজ ম্যান’ এর দার্শনিকতা, অন্যদিকে কমেডি অফ এরর্স ও মিডসামার নাইট’স ড্রিমএর বটম তাঁতি ও তার সাথিদের ভাঁড়ামি; শেক্সপিয়রে এই দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্যের সহাবস্থান।আজ সাড়ে চারশ’ বছর পরে তাঁর লেখা কেন আপন লাগছে?

মননের দিক থেকে তিনি ছিলেন সে’ সময়ের জনতার প্রতিনিধি। আত্মসাৎ করেছিলেন তাদের মুল্যবোধ ও রুচি। এখানেই তিনি তাঁর সমসাময়িক অন্য নাট্যকারদের – যেমন, বেন জনসন, এডওয়ার্ড মার্লো—থেকে স্বতন্ত্র। ওঁরা ছিলেন অভিজাত পরিশীলিত রুচির। তাই জনসন অনায়াসে শেক্সপীয়েরের লাতিন এবং গ্রীক সাহিত্যের সঙ্গে অপরিচয়ের কথা বলে খোঁচা দিতে একটুও ইতস্ততঃ করেন না, যদিও উইলিয়ম তাঁর গ্রামার স্কুলে গ্রীক-লাতিন সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন বলে জানা গেছে।

আসলে তাঁদের চোখে মহাকবি একটু গ্রাম্য রুচির। অনেকবার তাঁর চরিত্রদের ঠাট্টাতামাশা ভদ্রলোকের কানের পক্ষে মাত্রাছাড়া লাগে।

শুধু ফলস্টাফের ভাঁড়ামো নয় , রোমিও জুলিয়েটের একটি দৃশ্য দেখুন।

চজুলিয়েটের বয়স নিয়ে ওর মা এবং ধাইমার আলাপে। বৃদ্ধা মহিলাটি নিজের প্রয়াত স্বামীর রগুড়ে স্বভাবের কথা তুলে বলে-- ছোট্ট জুলি যখন পড়ে গিয়ে কপাল ফুলিয়ে কাঁদছিল তখন আমার কত্তাটি ওকে ভোলাতে গিয়ে বলে –এখন ছোট্টটি, তাই উপুড় হয়ে পড়েছ, যখন ডাগর হয়ে উঠবে তখন চিৎ হয়ে পড়বে।

“Won’t you Jule?
‘Aye’, quoth she.”

প্রশ্ন ওঠে, ডক্টর জনসন কি সেই ১৭৬৫ সালেই বলেননি যে শেক্সপীয়রের রচনা অগভীর, শুধু আনন্দলাভের জন্যেই পাঠ করা যায় , তার বেশি নয় ? এ বিষয়ে ডক্টর জনসন ও যাঁরা কেবল আনন্দলাভের জন্যে শেক্সপীয়র পাঠের কথা বলেন, এবং ব্র্যাডলির মত সমস্ত বিদগ্ধ অধ্যাপককুল, অর্থাৎ যাঁরা শেক্সপীয়রকে তাঁর সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেবল মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দিতে চান, তাঁদের নমস্কার করে আমি সবিনয়ে অন্য মত পোষণ করতে চাই ।

শেক্সপীয়র পড়ব শুধু আনন্দ বা মজা পেতে? মানে প্রেম? তলোয়ারবাজি? প্রেতাত্মা? রোমান্স এবং ভাঁড়ের ভাঁড়ামো ? মহাকবি নিজে এ ব্যাপারে কী বলেছেন শোনা যাকঃ

"Though it makes the unskillful laugh, cannot but make the judicious grieve". Hamlet (III, 2).

আরেকটি প্রশ্নঃ কীভাবে বুঝব কোনটি নাট্যকারের নিজের মত , আর কোনটি একান্তভাবে নাটকের চরিত্রটির? নিশ্চয়ই ওথেলো নাটকের শয়তান ইয়াগোর উক্তি শেক্সপীয়রের বলে ধরে নেব না ? তাহলে? কঃ পন্থা?

অধ্যাপক আর্থার সিটওয়েল তাঁর "Character and Society in Shakespeare" [Oxford, 1951] বইয়ে একটি পথ বাতলেছেন। উনি বলছেন যদি মুখ্য চরিত্রের মুখে একটি আইডিয়া বারবার, এমনকি নানান বিপরীত পরিস্থিতি ও পরিবর্তিত সময়েও, শোনা যায় তাহলে সেটা রচয়িতার নিজের চিন্তা বলে মানতে বাধা কোথায়? তেমনই যেটা উনি বারবার ভিলেনের মুখে বসিয়েছেন সেটা নিশ্চয়ই ওনার অপছন্দের স্বর?

কিন্তু যদি ওই জনরুচির তাগিদে তলোয়ারবাজি, প্রেতাত্মা,এবং স্থুল রসিকতাতেই শেক্সপীয়র আটকে থাকতেন তাহলে তাঁর রচনা কালোত্তীর্ণ হত না, কিছুতেই না । উনি খুব বেশি হলে সেকালের জনপ্রিয় আমুদে নাট্যকার হতেন যার রচনা দু’তিন দশকের পরে মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই ভুলে যায় । কিন্তু উনি একইসঙ্গে যুগের হয়েও ছাড়িয়ে গেছেন নিজের সময় ও সমাজকে। জনরুচিকে উপেক্ষা না করলেও তার গোলামি করেননি। প্রশ্ন করেছেন প্রচলিত মূল্যবোধকে, বারংবার।

আসুন, আমরা তাঁর লেখা থেকে তেমনই কিছু ধারণাকে—ধরুন, বাজার, মুনাফা, সমুদ্রযাত্রা, নারী এবং অল্পসংখ্যক সম্প্রদায় ইত্যাদিকে মহাকবির যুগ, কালখন্ড এবং সমাজের প্রেক্ষিতে নেড়েচেড়ে দেখি।


এলিজাবেথীয় যুগ

আমাদের মানসে রাণী এলিজাবেথের রাজত্বকাল ও ইংল্যান্ডের রেনেসাঁ বা নবজাগরণ একাকার হয়ে আছে। এবং শেক্সপীয়র হলেন সেই নবজাগরণের কবি ও নাট্যকার, যেমন দান্তে অলিঘিয়েরি হলেন ইতালীয় নবজাগরণের মুখপাত্র। কিন্তু একটু খুঁটিয়ে দেখলে এই বহুপ্রচারিত সযত্নে লালিত ধারণাটি ধাক্কা খেতে বাধ্য।

আমরা জানি যে রেনেসাঁ হল মধ্যযুগের অন্ত, নতুন করে গ্রীক-লাতিন ক্লাসিক্স পড়ার ঝোঁক, এবং ফলে চিন্তা ও বিচারের ক্ষেত্রে ঈশ্বরবাদের জায়গায় মানুষের জয়গান। কিন্তু এই ধারার মুখপাত্র তো আসলে বেন জনসন, মার্লোর মত শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী এলিট নাট্যকারেরা, আর শেক্সপীয়র তো ওই দুনিয়ার লোক ন’ন। জনসনের উক্তি- উনি লাতিন ও গ্রীক বিশেষ জানতেন না !

আর ভাবনার জগতে এই বিপ্লব তখনকার আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোয় কতটুকু ছাপ ফেলেছিলো?

ভুললে চলবে না যে এলিজাবেথীয় যুগ একই সঙ্গে ‘কর্ন ল’ বা শস্য আইন জারি হওয়ার যুগ বটে! ওই কানুনের ফলে প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র চাষির দল নিজেদের জমি থেকে উৎখাত হয়ে শহুরে মজুর এবং ভবঘুরে হয়ে গেল। কারণ তাদের ছোট ছোট ক্ষেতগুলো জুড়ে তৈরি হয়েছে বিশাল বিশাল ভেড়াপালন খামার। কাপড়ের মিলমালিকদের উলের চাহিদা পূরণ করতে হবে যে ! এভাবেই ক্ষয়িষ্ণু জরদ্গব সামন্ততন্ত্রের কবরের উপর গজিয়ে উঠেছিল ‘মার্কেন্টাইল ক্যাপিটালিজম’ বা নব্য বণিকতন্ত্রের সৌধ।

[ কোথাও আজকের ভারতবর্ষের কৃষিবিতর্কের ছায়া টের পাচ্ছি কি?]

শেক্সপীয়রের নাটক হল সেই বিশাল পরিবর্তনের ছবি, তার জীবন্ত দলিল---ঠিক যেভাবে তিন শতাব্দী পেরিয়ে লেনিনের চোখে তলস্তয়ের সৃজন সমাজবিপ্লবের ডাক না দিলেও সমাজের বিশ্বস্ত আয়না বলে ধরা দিত, অথবা মার্ক্স বালজাকের উপন্যাসে পুঁজিবাদী নরকের আগুন দেখে শিউরে উঠতেন।

অথচ মার্ক্সবাদের যান্ত্রিক ব্যাখ্যায় শেক্সপীয়রকে জোর করে বিপ্লবী বানাতে গিয়ে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে নবাগত পুঁজিবাদ বা বণিকবাদের মুখপাত্র ধরে নেওয়া হয়েছে। সাক্ষ্য হিসেবে দেখানো হয় ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’। তাতে কি সাগর পেরিয়ে নতুন দেশে গিয়ে ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’ মন্ত্রের আরাধনা করতে বলা হয়নি?

ধর্মাবতার, উই বেগ টু ডিফার। আবারও বলছি , শেক্সপীয়র নন’ –উদীয়মান পুঁজিবাদের চারণকবিরা হলেন মার্লো, জনসন, গ্রীন, মেসিঙ্গার, ও বোমন্ট এবং ফ্লেচার।


বণিকবাদঃ শেক্সপীয়র বনাম অন্যেরা

আমরা জানি যে বণিকবাদের পহচান বা হলমার্ক হচ্ছে-- সামুদ্রিক বাণিজ্য, নতুন নতুন দেশের এবং বাজারের খোঁজ, এবং দিন- দোগুণী, রাত- চৌগুণী মুনাফা। রাণী এলিজাবেথের ইংল্যান্ড তখন সাম্রাজ্যের সীমানা বাড়িয়ে এমন করতে ব্যস্ত ‘যেখানে সূর্য অস্ত যায় না ‘। তাই জাতীয় সংগীত হলঃ

" Britania! Rules Britannia.
Britannia rules the waves."

এবার দেখুন, গ্রীনের ‘অর্ল্যান্ডো’ নাটক ঘটিত হচ্ছে আফ্রিকায়, মার্লো’র ‘ট্যাম্বারলেইন’ এশিয়ায়, ম্যালিগ্নারের ‘রেনেগাদো’ টিউনিসে, বোমন্ট-ফ্লেচারের ‘ আইল্যান্ড প্রিন্সেস’ ঘটছে পর্তুগালের মশলা দ্বীপে। কিন্তু আমাদের শেক্সপীয়র তাঁর বিপুল রচনায় সহজে ইউরোপের বাইরে পা ফেলেন না । এমনকি ঊনি শুধু ইংল্যান্ডেই স্বচ্ছন্দ, ইতালিতেও নয়। নইলে কোন ভূগোলের হিসেবে মিলান থেকে জাহাজ ছাড়ে(টেম্পেস্ট)? বা বোহেমিয়ায় নোঙর ফেলে? এটাও সবাই জানে যে হ্যামলেট নাটকে প্রিন্স অফ ডেনমার্কের গল্প বললেও সেটা আসলে রূপকের আড়ালে তাঁর সমসাময়িক ইংল্যান্ডেরই কথা । যে কারণে পুশকিনের “ক্যাপটেইন’স ডটার” উপন্যাস আসলে সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী পুগাচেভের বন্দনায় লেখা উলটপুরাণ। ধড়ের থেকে মুন্ডু খসে পড়ার ভয় সব যুগেই থাকে; সেসব যুগে আরও বেশি।

ঊনি একবারই ইউরোপের বাইরে পা রেখেছিলেন, ওথেলো নাটকে সাইপ্রাসে। বোঝা যায় উথালপাথাল সমুদ্রের ঢেউয়ে জাহাজে চড়ে বিদেশযাত্রা ওঁর খুব একটা পছন্দ নয় । কলম্বাস বা ম্যাগেল্লানের আবিষ্কার, ১৫০০ সালে ব্রেজিলের খোঁজ –এসবের কোন কিছুই ওঁর লেখায় নেই । চ্যাপম্যান তাঁর ‘ইস্টওয়ার্ড হো’ নাটকে এবং জনসন তাঁর ‘ এভরিম্যান ইন হিজ হিউমার’ নাটকে সগৌরবে উল্লেখ করছেন স্যার ফ্রান্সিস ড্রেকের ‘গোল্ডেন হাইন্ড’ জাহাজে চড়ে বিজয়পতাকা ওড়ানো যা তখন ছিল পুঁজিবাদের অজেয় শক্তির প্রতীক। কিন্তু এর কোনকিছুই শেক্সপীয়রকে প্রেরণা দেয়নি।

আমাদের মতে, এই যে সোনার খোঁজে মুনাফার লালসায় দিকে দিকে নৌ- অভিযান তা’ শেক্সপীয়রের না-পসন্দ ।

পেরিক্লিস নাটকের দৃশ্য দুইয়ে শুনতে পাইঃ সমুদ্রযাত্রায় শান্তি নেই । আকাশ থেকে বজ্র নামে, সাগরের অতলে তলিয়ে যায় বাণিজ্যপোত, এভাবেই আমাদের রাজপুত্র সর্বস্বান্ত হলেন।

উইন্টার্স টেল নাটকে ক্যামিল্লো রাজকুমার ফ্লোরিজেলকে বলে সাগরে না যেতে। টেম্পেস্টে শান্ত গঞ্জালো আফসোস করে বলে মরতে হলে ডাঙায় মরব, জলে ডুবে কেন ?

এবার মার্চেন্ট অফ ভেনিস নাটকে মুনাফার ছবিটি কেমন দেখা যাক। সেইসময়ে সমাজে ব্যবসায়ী ও বণিককুলের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ছিল সন্দেহ নেই । এই নাটকের ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে পারস্পরিক সন্দেহ, গলাকাটা প্রতিযোগিতা, নগ্ন লোভ এবং মানবমূল্যের অবনমনের ছবি। শেয়ারবাজারের অনিশ্চয়তা এবং মুনাফার ঝুঁকি কেড়ে নিচ্ছে রাতের ঘুম। আন্তনিওর বন্ধু সালেরিও এবং সোলিনিওর কথাবার্তা শুনুনঃ

"Your mind is tossing in the ocean" এবং " Believe me Sir, had I such venture forth, the better part of my affection would be with my hopes abroad.

পুঁজিবাদী সমাজে প্রেম? ব্যাসানিও এবং পোর্শিয়ার প্রেম? হাসালেন মশাই। বন্ধু আন্তোনিওকে ব্যাসানিও চুপি চুপি জানায় যে বেহিসাবী খরচায় ও দেউলে হয়ে গেছে। সম্পত্তি গেছে ভোগে, আকন্ঠ ধারে ডুবে সম্মান যায় যায় । উপায়? অগাধ ধনসম্পত্তির মালকিন বেলমন্টের পোর্শিয়াকে বিয়ে করা । [Merchant of Venice, I, 1,122 and 161]

শুধু এইই নয়, নারীকে পণ্যদ্রব্য (কমোডিটি) হিসেবে দেখা পুঁজিবাদী ধ্যানধারণায় স্বাভাবিক। তাই ব্যাসানিও’র চোখে পোর্শিয়া হলেন একটি লোভনীয় বস্তু, উনি অনায়াসে স্বয়ংবরা পোর্শিয়ার পাণিগ্রহণে তিন প্রার্থীর মধ্যে প্রতিযোগিতাকে বর্ণনা করেন বণিকদের মধ্যে লুটের মাল ভাগাভাগি হিসেবে। প্রেমই বটে! এক্কেবারে টুরু লাভ।

এবার দেখুন, পুঁজিবাদের গতিপ্রকৃতির সবচেয়ে গহন ভাষ্যকার মার্ক্সের চোখে শেক্সপীয়রের সময়ে বণিকতন্ত্রের জন্মলগ্নের ছবিটি কেমন ছিল। কেমনভাবে বর্বরের মত শিল্পী কারিগর ও লঘু উৎপাদকদের লুঠ করে পুঁজিবাদের ভিত্তি তৈরি হচ্ছিল।

"--- under the stimulus of passions, the most infamous, the most sordid, the pettiest, the most meanly odious". Karl Marx: Capital (New York, 1906), Part VIII, P. 835-836 [Footnote]

টিমন অফ এথেন্সেও প্রায় একই ভাষায় অভিশাপ বর্ষিত হয় লোভ, সম্পত্তি, সোনা ও মুনাফাখোরির উপর। আপেমান্তুস এক বণিককে বলে যে ব্যবসা হল তোমাদের ভগবান। এই ভগবানই তোমাদের জাহান্নমে পাঠাক।টিমন চোরেদের সোনা বিলিয়ে দিয়ে বলেন—যাও, এবার সবার গলা কাটো আর গোল্লায় যাও।

টিমনের চোখে সোনা হল অমিতশক্তিধর। বানিয়া সমাজে সোনা সব জিনিসকে তার বিপরীত বস্তুতে বদলে দিতে পারে । যেমন, সোনা (পড়ুন টাকা) থাকলে সবচেয়ে কুৎসিত পুরুষ হয়ে যায় সবচেয়ে রূপবান। কারণ সে অর্থের জোরে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটিকে কুক্ষিগত করতে পারে। ঠিক যে ভাবে সবচেয়ে রোগাপ্যাংলা লোকও টাকার জোরে বাউন্সার রেখে হয়ে ওঠে শক্তিমান।

Timon of Athens, I, 1, 237; IV, 3,443; III, 6, 97; and IV, 1, 8.

কী করে ভুলব আলবানির সেই ভবিষ্যবাণী যাতে উনি নবযুগের বৈশিষ্ট্য হিসেবে বলছেন – যখন মানুষ মানুষকে ছিঁড়ে খাবে? King Lear, IV, 2, 46.


শেক্সপীয়রের চোখে নারীঃ

আচ্ছা, আজকাল যে নারী-স্বাধীনতা বা লিঙ্গসাম্য নিয়ে এত কথাবার্তা, কল্পনা করুন তো সাড়ে চারশ’ বছর আগে কী ভাবতেন মহাকবি? ধরুন লাভ-জিহাদ নিয়ে ?

আমার ভাবতে ভাল লাগে যে আমার (এবং আরও অগণিত মানুষের) প্রিয় কবি ও নাট্যকার এ’ব্যাপারে যুগের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন । তাঁর সমসাময়িক সমাজের চোখে প্রশ্নটি অবান্তর । এ নিয়ে প্রচুর সাক্ষ্য বর্তমান। পাদ্রীদের মুখ থেকে নারী -নরকের-দ্বার বা শয়তানের দূতী গোছের ফতোয়া আকছার শোনা যেত। বাইবেলে দেখুন-আপেল খেলেন আদম ঈভ দুজনে, দোষী সাব্যস্ত হলেন একা ঈভ। আদম যেন এক অপাপবিদ্ধ কিশোর যাকে ফুসলে পাপের পঙ্কিল পথে টেনে নামিয়েছে ঈভ।

কিন্তু কবি নিজে কী ভাবতেন?

ওঁর অনেক নাটকে পিতা-পুত্রী মুখোমুখি, এবং মেয়েটি প্রশ্ন তুলছে--‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার’?

নাটকের নাম ‘মিড সামার নাইটস’ ড্রীম’। মেয়ে হার্মিয়ার পছন্দের ছেলে লাইসান্ডারকে নাকচ করেছেন বাবা। তাঁর চোখে কন্যা হল তাঁর সম্পত্তি, জমিজমা, গয়নাগাটি বা টাকাপয়সার মত । এসব তিনি যথাসময়ে সুযোগ্য জামাইবাবাজির হাতে তুলে দেবেন, যেন খপ- পঞ্চায়েত বসেছে। তাঁর ফরমান শুনুনঃ

"And she is mine; and all my right of her
I do estate into Demetrius".

আর মেয়েটি ভাবছে: "O hell! To choose love by another's eyes."

নাটকের শেষে হার্মিয়া বিজয়ী হয় এবং মনের মানুষকে বিয়ে করে ।

ওথেলো নাটকে নায়িকা ডেসদেমোনার বাবা ব্রাবান্তসিও ওথেলোর নামে অপহরণের কেস করেন । কিন্তু আদালতে দাঁড়িয়ে ডেসদেমোনা বলেনঃ

"I am hitherto your daughter; but here's my husband,
And so much duty as my mother show'd
To you, preferring you before her father,
So much I challenge that I may profess
Due to the Moor, my Lord."
(Othello, I, 3, 185)

‘কমেডি অব এরর্স’ নাটকে আদ্রিয়ানা লিঙ্গসাম্যের দাবি তোলে: "Why should their liberty than ours be more?" (II, I)।

জুলিয়েট বাবার পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করতে দোনোমোনো করে বাবার কাছে বকুনি খায়। ‘মারচেন্ট অফ ভেনিস’ নাটকে জেসিকা কাপড়চোপড় গয়নাগাটি নিয়ে মায়কা থেকে পালিয়ে দয়িতের সাথে মিলিত হয় । নাট্যকারের পক্ষপাতিত্ব জেসিকার প্রতি প্রকট, সূদখোর বাবা শাইলকের জন্যে ঝরে পরে অবজ্ঞা ও সামান্য করুণা। ‘হ্যামলেট’ নাটকের অফিলিয়াকে বাবা পোলোনিয়াস আচ্ছা করে কড়কে দেন , কারণ ও বাবার পছন্দকে অগ্রাহ্য করে পাগলাটে রাজকুমার হ্যামলেটের প্রেমে পাগল। টেম্পেস্টের প্রসপেরো মেয়ে মিরান্দার জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকারকে তাচ্ছিল্য করে পদে পদে বাধার সৃষ্টি করেন। কিন্তু শেষপর্বে মেয়ের পছন্দকে স্বীকৃতি দিয়ে পাঠকের চোখে মহান হয়ে ওঠেন।

‘মেরি ওয়াইভস অফ উইন্ডসর’নাটকে বিবাহিত মহিলারা দল পাকিয়ে রাজদরবারের বিদূষক ফলস্টাফকে মেয়েবাজির জন্যে ভাল করে উত্তমমধ্যম দেন। রাজার বয়স্য বলে লুজ -ক্যারেকটারটি রেহাই পায় না

[।আমার মনে হয় দীনবন্ধু মিত্রের ‘কমলে কামিনী’ নাটকে হলধর বলে চরিত্রটি, পদে মন্ত্রী স্বভাবে স্থুল রসিকতায় ডগোমগো মেয়েবাজ এবং পরিণতিতে মেয়েদের হাতে উত্তম মধ্যম পাওয়া, ফলস্টাফের আদলে তৈরি।]


শেকসপীয়র এবং থিয়েটার

থিয়েটার সমস্ত যুগেই ক্ষমতার সমালোচনা করেছে এবং প্রতিবাদের মঞ্চ হয়ে উঠেছে। শাসকেরাও তাই যুগে যুগে থিয়েটারকে সন্দেহের চোখে দেখে এসেছেন। বর্তমান সময়ও তার ব্যতিক্রম নয় ।

ইংল্যান্ডে ক্রমওয়েল বিপ্লবের পর পিউরিটানরা ক্ষমতায় এসে এক অর্ডিন্যান্স জারি করে সবরকম থিয়েটারকে নিষিদ্ধ করলেন। ফিলিপ স্টাবসের চোখে থিয়েটারই হল বেশ্যাবৃত্তি ও বিকৃতির মূল। টমাস হোয়াইট লন্ডনে প্লেগের জন্যে দায়ী করলেন থিয়েটারকে। গসন এবং নর্থব্রুক থিয়েটারকে আখ্যা দিলেন শয়তানের আখড়া যেখান থেকে মেয়েরা শেখে বেশ্যাবৃত্তি,( ১৫৭৮ থেকে ১৫৮৩ নাগাদ প্রকাশিত বিবিধ প্রবন্ধ ও বক্তৃতামালা)।

রাণী এলিজাবেথ- প্রথম স্বয়ং থিয়েটারের অনুরাগী ছিলেন । সাধারণ মানুষ থিয়েটারের নামে পাগল। তাতে কি ? ক্ষমতাশালী লর্ড মেয়র হরদম বখেড়া খাড়া করতেন। টমাস ন্যাশের ‘আইল অফ ডগস’ নাটক নিষিদ্ধ হল। ওতে নাকি রাজদ্রোহমূলক ডায়লগের বাড়াবাড়ি! অভিনেতাদের জেলে পোরা হল।

বেন জনসনের মত নাট্যকারকেও হাজতবাস করতে হয় । ‘ইস্টওয়ার্ড হো!’ নাটক নিষিদ্ধ হয় এবং নাট্যকার চ্যাপমান কারারুদ্ধ হন। শেক্সপীয়রকেও বাধ্য করা হয়েছিল ‘রিচার্ড দ্বিতীয়’ নাটকে রাজার সিংহাসনচ্যুত হওয়ার দৃশ্যটি বাদ দিতে ।গোড়ায় ফলস্টাফ চরিত্রটির নাম ছিল ‘ওল্ডক্যাসল’, কিন্তু সেন্সরের চাপে শেকসপীয়র বাধ্য হলেন বদলে দিতে, --একেবারে ‘পদ্মাবতী’ থেকে ‘পদ্মাবৎ’ কেস।এরকম উদাহরণ আরও আছে।


শেকসপীয়রের প্রাসংগিকতা

আজকে সাড়ে চারশ’ বছর আগের শেকসপীয়র কতটা প্রাসংগিক? বা আদৌ প্রাসংগিক কি?উনি কি ইতিমধ্যেই সযত্নে জাদুঘরে রক্ষিত একটি পুরাতাত্ত্বিক বস্তু হয়ে যান নি? মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো মোটা মোটা রচনাবলীর মধ্যে মুখ লুকোননি?

আমার কাছে শেকসপীয়রের চরিত্রগুলো আজ আমার মত সাধারণ ছাপোষা মানুষের অনেক বেশি কাছের, ইদানীং যেন ওদের আরও ভাল করে চিনতে পারছি ।তাই ওরা আজকের ভারতে বৃটেনের চেয়েও বেশি প্রাসংগিক বলে আমার একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত।

যখনই আমি বিশ্ববাণিজ্য ও গ্লোবালাইজেশনের বন্দনা শুনি বা নব-উদারনীতিবাদের ভাট ও চারণদের গাথায় এই আশ্বাসবাণী ধ্বনিত হয় যে কীভাবে মুক্ত ব্যাপার এবং ব্যক্তিগত বিদেশি পুঁজি (এফ ডি আই) এলে আমাদের সব জ্বালা-যন্ত্রণা জুড়োবে, তখনই আমার মগ্নচৈতন্যে মুনাফা ও বল্গাহীন লোভের ভয়াবহ পরিণামের বিষয়ে মার্চেন্ট অফ ভেনিসের সাবধানবাণী গুরু গুরু রবে বেজে ওঠে।

যখন দৈনিক পত্রিকায় ‘অনার কিলিং’, খপ-পঞ্চায়েতের ফয়সালা, ‘লাভ-জিহাদের’ নির্মমতা বা সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ যুগলের আত্মহত্যার খবর পড়ি তখন আমার সামনে অভিনীত হয় ‘রোমিও জুলিয়েট’, ‘মিডসামার নাইটস’ ড্রিম’ এবং ‘অবশ্যই ‘ওথেলো’।

এভাবেই অল্পসংখ্যক সমুদায়ের মানুষজনের উপর ধর্ম, পোশাক, খাদ্যাখাদ্য নিয়ে অপমান ও হিংস্র আক্রমণের খবরে দেখি ‘ওথেলো ‘ ও ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিসে’র পুনরাভিনয়।আমার কানে বাজে শাইলকের মার্মিক আবেদন ও অভিযোগ--" Hath not the Jews eyes and ears?"

মার্চেন্ট অফ ভেনিসের আপাত খলনায়ক শাইলকের ওই দীর্ঘ মনোলগের মতন অল্পসংখ্যকের পক্ষে এমন শক্তিশালী বয়ান সাহিত্যে অন্ততঃ আমার চোখে পড়েনি।

আর রাজনীতিবিদদের নিয়ে ঘোড়া কেনাবেচা, শিবিরবদল, গুপ্তহত্যা, ক্ষমতা দখল, প্রজা খেপিয়ে বিদ্রোহ? একেবারেই হাতড়াতে হবেনা,-- লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ম্যাকবেথ, হ্যামলেট, জুলিয়াস সীজার, করিওলেনাস ও টিমন অফ এথেন্স। রাজাদের নিয়ে একগুচ্ছ ডার্ক নাটক, যেমন রিচার্ড দ্য থার্ড এবং কিছু ডার্ক কমেডি।

এতসব লেখার পর একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি—তাহলে কি সাড়ে চারশ’ বছর পরেও মানুষ একটুও এগোয়নি?


[পাদটীকাঃ আমি জানি যে এই বামমার্গী শেকসপীয়ার -পাঠ অধ্যাপককুলে সমাদৃত নয়। কিন্তু এই ব্যাখ্যাটিও তো অনেক সম্ভবপর ব্যখ্যার একটি হতে পারে। সেই প্রত্যয়ে লেখাটি পেশ করলাম।]

0 comments:

0

প্রবন্ধ - Abhijit Roy

Posted in

 

Over more than a decade now, we have witnessed many instances of Indian news television overstepping into the privileges of the executive institutions and the judiciary. While news television’s quasi-executive functions can be investigation of crimes, sting operations, campaign for “development”, building and presenting public opinion, exhibition of patriotism, etc., the quasi-judicial ones involve ‘trial by media’ along with generation of public opinion through social media and audience poll.[i] The quasi-legislative functions relate more to the structure of news studio debate which, I have pointed out elsewhere, is informed by certain ‘modern’ structure of public deliberation as in the parliament. The communicative form of the courtroom or of an ‘official’ meeting may overlap into this structure. [ii]

Objections to media’s efforts to appropriate the functions of the government, the court and the legislative body take many forms: Government directives, amendments in law and court orders amounting to case laws. Trial by media, from sting operations and high-pitch judgmental talk to audience poll, seems to be the most crucial point of worry. The problem of the state with such appropriation seems to be media’s claim to represent the public more than any state institution. Politics indeed is a contested terrain defined by ‘who represents the public the most’. In this short thinkpiece I wish to understand the implications of such mediatic appropriation with particular reference to its influence on judiciary. The question is whether ‘public sentiment’ and ‘public interest’, impressions of which are constructed by private news television very intensely particularly from the beginning of this century, have become major determinant of judicial procedure including judgments. To what extent such influence of the mediated public is instrumental behind judiciary’s intervention into the executive and legislative functions, thus leading to destabilisation of ‘separation of powers’?

One of the much-debated cases of alleged influence of ‘trial by media’ on the judiciary is the case of Afzal Guru. So much was the pressure of public opinion evident in media’s coverage that the judgment by the Supreme Court (August 4, 2005) which found Mohammad Afzal Guru guilty and sentenced to death, referred to the way "the collective conscience of the society" was outraged due to the attack on parliament. NDTV aired Afzal’s video confession on October 20, 2006 without mentioning that this was by then a five year old footage discredited by the Supreme Court. Almost all of the SMS messages that poured into the programme, presented simultaneously, spat hatred against Pakistan and called for hanging of Afzal Guru. The death sentence was upheld by the Supreme Court on 12 January, 2007. That Afzal Guru’s death sentence and finally capital punishment in February 2013 were greatly influenced by public opinion has been argued by many. Supreme Court lawyer and civil rights activist Indira Jaising writes:

Judges may say they are brave hearts and not influenced by press reports, but these reports are intended to build up public opinion in a negative manner which by itself can influence the outcome of a case. An example of this is the SMS polls run by television channels on controversial issues. This is what happened in Afzal Guru’s case. All television channels ran polls on whether Afzal Guru should be given the death penalty, a first in Indian legal history, when an SMS poll could decide the penalty by influencing public opinion. That public opinion, in any case something not measurable by any means, did influence the outcome of the case is evident from the fact that the judges who decided the case said that the “collective conscience of society” was outraged by the attack on parliament![iii]   

In the ‘Law Commission of India 200th Report on Trial by Media’ (August, 2006), there is a section titled ‘Do publications in the media subconsciously affect the Judges?’. Comparing the assumptions of Indian jurisprudence with other national contexts, the report summarizes that the right to free speech in India is not “absolute” but is conditional and restricted by Article 19(2).[iv] Judges including the Chief Justice of India S.H. Kapadia repeatedly urged that the judiciary should be independent not just from politics but also from public sentiment, that judges should deliver justice as per law and not according to the opinion of the majority.[v] The Supreme Court of India formed a special constitutional bench called the ‘Media Bench’ to explore the possibility of framing guidelines for the media, but ended up declining to do so, possibly because it thought the guidelines would be tantamount to ‘judicial overreach’ or what legislators and politicians call “judicial activism”. The Bench however laid down the principle of “postponement” allowing courts to place a temporary restraint on the publication and broadcast of specific matters if the said publication affected a trial.[vi]

The worry about media activism can be the apprehension about a ubiquitous public that is provoked by the media to raise various demands. While generally such demands are for justice of some kind, the demands themselves can be unjust ‘in the eye of the law’. The judiciary is not only perturbed by the public’s demand (for capital punishment for instance), but also by the ‘campaigns’ the media resort to (A large part of Anna Hazare’s anti-corruption movement in 2011 was given positive coverage by the channel ‘Times Now’ with the tagline “A Times Now Campaign”) and the commitments governments or people in high offices make (Mamata Banerjee, the Chief Minister of West Bengal, said on camera that the accused persons in the Kamduni case would be hanged).

The scenario gets further interesting when a section of the judiciary acknowledges the need to address public opinion. A two-judge Supreme Court bench said on July 12, 2011, that the courts do not exceed their jurisdiction by hearing public interest litigations filed by NGOs and social activists on behalf of the poor and the illiterate. Rather, by doing so, the courts fulfil a mandate laid down in the Constitution’s chapter on Directive Principles of State Policy. “If the system can devote hours, days and months to hear the elitist class of eminent advocates engaged by those accused of evading payment of taxes... (or) heinous crimes... (then) some time can always be devoted for hearing the grievance of the vast majority of silent sufferers,” Justices G.S. Singhvi and A.K. Ganguly observed.[vii] The activist tenor is difficult to shun here as unwarranted; it in fact should be appreciated, since the drive is to tilt the balance of justice towards the “vast majority of silent sufferers”. But the apprehension about judicial overreach has increased so much in the era of a boom in privately owned satellite news channels that the Government thought of the ‘Judicial Standards and Accountability Bill’.

The Vodafone taxation case and the 2G spectrum allocation case were significant because they brought into the fore the tussle between the formal institutions of democracy over representing public interest. In the first case, the government tried to tax Vodafone for a deal involving an Indian company but made in a foreign land in 2007 and after its defeat at the court, tried to invert the court’s verdict by bringing in a law that would have retrospective effect. Notably, all the parties involved had to pitch their arguments flaunting how much they cared for the general public: While the government, as it does in case of tax-claim cases, urged to look into the ‘public interest’ involved, the court cautioned of the possibility of reduction in foreign investment in India if Vodafone was to be taxed on this occasion, affecting public welfare schemes in turn.

Most interesting however was the Supreme Court verdict in the 2G spectrum allocation case which ordered cancellation of 122 licenses granted earlier to private telecom operators in 2008 and institution of ‘auction’ instead of ‘first come-first served’ system. The two-judge bench cited “public interest” and larger public good to justify its intervention while conceding that the “Court should not ordinarily interfere with the policy decisions of the Government in financial matters”. The court said that “when it is clearly demonstrated before the Court that the policy framed by the State or its agency/instrumentality and/or its implementation is contrary to public interest or is violative of the constitutional principles, it is the duty of the Court to exercise its jurisdiction in larger public interest”.[viii] Somnath Chatterjee, former Lok Sabha Speaker and a lawyer, objected strongly: “Trying to appropriate executive powers can be very tempting. Well, the Supreme Court is supreme. But it cannot interfere with executive policies and decisions, even by justifying that larger public interest is involved.” (italics mine).[ix] What followed was a debate in the pages of The Telegraph in the month of February 2012 on how far the judiciary could go to serve public interest. Chatterjee, and Justice Asok Kumar Ganguly who was on the panel of judges passing the 2G order, wrote a number of articles defending their positions and the paper also published an editorial critiquing Justice Ganguly’s coming to public to defend his judgment.[x]

It is my argument that the media and particularly the private satellite news television, with its tremendous capability to make publics and their interests ubiquitously visible, are playing a significant role in redefining ‘separation of powers’, key to modern democracy. In post-Liberalisation India, the increasing claim of the media, private news channels particularly, to represent ‘public interest’ more than any state institution insecure the three pillars of democracy and push them towards constantly gauging the ‘mood of the public’ (a mediatic construction with many problems). While the three arms of democracy (executive, legislative, judicial) should classically clearly define jurisdictions, there have always been instances of such separation getting blurred and disputed. But it seems such disputes have intensified in the era of immense popularity of the privatized media, particularly satellite television news and the internet. What may have largely contributed to this are the new incarnation and certain image of the public that are primarily driven by the media but are also amply capable of representing themselves as relatively autonomous. The relevance of the ‘public’ has generally increased where any kind of movement, physical assembly or virtual mobilisation stands a greater chance of making its presence felt, not necessarily its demands met. Such mediated publicness cannot be romanticised as the realisation of the ideal of deliberative democracy as it is characterised by much silence about the misdeeds of the corporate sector including the private media and by the limiting concerns of the middle class. This is precisely the reason why we should constantly scrutinise the mediated image of the ‘public’ that the four (including Media) pillars of democracy claim to represent more than each other.

 



[i] Abhijit Roy, ‘Staging democracy: Indian news television and its publics’ in Indian Nationhood and Nationalism: Perspectives, Representations and Reflections eds. Parthapratim Sen and Arunima Raychowdhury. Rohini Nandan, Calcutta, January, 2014.

[ii] Abhijit Roy, ‘Performing Democracy: On the Communicative Structure of News Television’ in Culture and Politics in South Asia: Performative Communication edited by Dev Nath Pathak and Sasanka Perera, Routledge, New Delhi, July 2017

[iii] Indira Jaising, “Driven by sensationalism”, The Hindu, August 3, 2008 http://www.hindu.com/mag/2008/08/03/stories/2008080350020100.htm 

[iv] Govt. of India, “Law Commission of India 200th Report on Trial by Media: Free Speech and Fair Trial under Criminal Procedure Code, 1973”, August, 2006, 46-60. http://lawcommissionofindia.nic.in/reports/rep200.pdf 

[v] “Judiciary must be free of politics, public opinion: CJI”, Hindustan Times, January 14, 2012, Mumbai edition. http://www.hindustantimes.com/India-news/Mumbai/Judiciary-must-be-free-of-politics-public-opinion-CJI/Article1-797319.aspx 

[vi] “Media can be gagged to ensure fair trial, says SC”, The Hindu, September 11, 2012. http://www.thehindu.com/news/national/media-can-be-gagged-to-ensure-fair-trial-says-sc/article3884621.ece  

[vii] “SC rebuts activism charge”, The Telegraph, July 15, 2011. http://www.telegraphindia.com/1110715/jsp/nation/story_14242345.jsp 

[viii] See the relevant parts of the verdict in “‘Wholly arbitrary, capricious and contrary to public interest’”, The Hindu, February 3, 2012 http://www.thehindu.com/todays-paper/tp-opinion/wholly-arbitrary-capricious-and-contrary-to-public-interest/article2855371.ece 

[ix] “Somnath on 2G: Can’t interfere with policy decisions”, The Telegraph, Kolkata, February 4, 2012. 

[x] See the following articles in The Telegraph: “Somnath on 2G: Can’t interfere with policy decisions”, February 4, 2012; “Not to grab executive powers: 2G judge”, February 6, 2012; “Uneasy conscience …and all the best”, February 7, 2012; “Quiet in Court” (Editorial), February 9, 2012.

0 comments:

1

প্রবন্ধ - পৃথা কুণ্ডু

Posted in


নদী ভালবাসেন? বেড়াতে গিয়ে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে লাফিয়ে পেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করে তিরতির করে বয়ে চলা জলের ধারা? ‘আমাদের ছোট নদী’ আর ‘অঞ্জনা নদীতীরে’ দুলে দুলে মুখস্থ করার সেই সহজপাঠের দিনগুলো মনে পড়ে? সুর করে পড়লে মনে রাখতে সুবিধে হত কিনা, বলুন? এখনও, সারাদিন অফিস করে ফেরার পথে লোকাল ট্রেনের বদলে বেশিরভাগ দিন লঞ্চঘাটের দিকে পা বাড়ান, নদীর বাতাসটুকু মেখে নেবার লোভে? কেন বলুন তো? আসলে ওই নদীটা বইছে প্রাণের মধ্যেই, আপনার-আমার শিরায় শিরায়, জীবনের বাঁকে বাঁকে কত না পলি জমিয়ে, কখনও পুরনো খাত ভেঙ্গেচুরে গড়ে নিচ্ছে নতুন গতিপথ। কখনও মিলিয়ে নিচ্ছে নিজের বুকের মাঝে উপনদীর স্রোত, শাখায় প্রশাখায় ছড়িয়ে দিচ্ছে নিজেকে, কখনও আবার ভেদ গড়ে দিচ্ছে এপার ওপারের মধ্যে। নদীর গান মনের মধ্যে গুনগুনিয়ে উঠলে ভেতর আর বাইরেটাকে মিলিয়ে নিতে সাধ জাগে অজান্তেই। শুধু নদীর গান নয়, নৌকা আর মাঝির গানও-- তাদের বাদ দিলে পারানির কড়ি দেওয়াও হয়ে ওঠে না, সোনার ধান বয়ে নিয়ে চলে যাবার শূন্যতাও ধরা পড়ে না এক-জীবন-ভরা নদীর জোয়ার ভাঁটার খেলায়। যিনি নদী নিয়ে এত এত লিখলেন, সেই ‘সোনার তরী’ থেকে বলাকার ‘চঞ্চলা’ হয়ে ‘শেষ খেয়া’-- তাঁর গানের ধারাও কি নদীর মত নয়?

স্কুলে সেই ভূগোলের বইতে পড়েছি, আদর্শ নদীর মধ্যে নাকি উচ্চগতি, মধ্যগতি, নিম্নগতি পরিষ্কার বোঝা যায়। উচ্চগতির মধ্যে একটা পাগলামো থাকে, লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পাহাড় থেকে নামতে চাওয়ার মাতন থাকে। ‘ওগো নদী আপন বেগে পাগল পারা’য় সেই দুর্বার পাহাড়িয়া নদীর গতিবেগের আভাস। কিন্তু ছোটবেলায় শুনতাম, বেশিরভাগ শিল্পী গানটা গাইতেন চাপা গলায়, মাঝারি লয়ে- ভাল লাগত না তেমন। পরে যখন চমকে উঠলাম এ গানের অন্য রকম এক পরিবেশন শুনে- উঁচু স্কেলে, দ্রুত লয়ে, প্রায় এক দমে- তখন নদীর কথা রইল কেবল শুরুর দিকটায়, বাকি গানটা হয়ে গেল ‘স্তব্ধ চাঁপার তরু’র। নদীর উচ্চগতি খুঁজতে খুঁজতে একসময় পেয়েছি ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’। সে মাতনকে সুরে বাঁধতে চাননি কবি, শুধু কবিতা হয়েই রয়ে গেছে। বাঁধলে হয়ত নদীর উচ্চগতির সুর কেমন হতে পারে, তার একটা আদল পাওয়া যেত। কবিতাটা বহুবার শোনা; যেখানে বড় হয়ে ওঠা- সে এলাকার এক গণ্যমান্য মানুষ প্রায়ই আবৃত্তি করতেন কাছেপিঠের কোন না কোন অনুষ্ঠানে, শুনে শুনে কানে লেগে থাকত। মানে বুঝি আর না-ই বুঝি, বড় আপসোস ছিল, এমন একটা কবিতায় সুর দেওয়া হয়নি কেন? সে দুঃখও অবশ্য খানিকটা ঘুচেছিল অনেক পরে, যখন প্রথমবার ‘তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী’ শুনেছিলাম ‘পাষাণ টুটে ব্যাকুল বেগে ধেয়ে’ চলা ‘সুরের সুরধুনী’কে নামিয়ে আনতে পারার মত এক ভগীরথের কণ্ঠে। ওই এক লাইনেই বুঝিয়ে দেওয়া, ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ গান হলে কী হতে পারত!

মধ্যগতির নদীতে কত রকমের বৈচিত্র্য; টপ্পা, খেয়াল, হরেক রকমের রাগ-ভাঙা গান আর নানান লোকসুর তাতে মেশে উপনদীর মত, আর সে বৈচিত্র্যের এক-এক রূপ হয়ে শাখানদীর মত ছড়িয়ে পড়েন, ভাবনায়-ভালোলাগায় মনের অববাহিকার বিস্তীর্ণ মাটি ভিজিয়ে দেন দেবব্রত-হেমন্ত, কণিকা-সুচিত্রা-ঋতু গুহরা। একত্রিশ বছর বয়সে লেখা ‘শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা’র মত একটা গানের আসল ভাবের বয়স বুঝিয়ে দেন দেবব্রত, তাঁর নাটকীয় গায়কিতে। ‘চিরকুমার সভা’র হাসির আবহে বাঁধা ‘তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়’-এর মত একটি গান কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায় কেমন করে যে বেদনার গান হয়ে বেজে ওঠে, সে হিসেব ভেসে যায় স্রোতের লীলায়। অনেক পরে ‘পারমিতার একদিন’ ছবিতে নতুন করে ভাল লাগা এই গানের অভিব্যক্তিতেও কিন্তু সেই করুণ রসের ধারাটিই রয়ে যায়, কৌতুকের উৎসকে দেয় ভুলিয়ে। রক্তকরবীর বিশু পাগলের গান ‘ও চাঁদ, চোখের জলের লাগল জোয়ার’ নদীকে মিশিয়ে দেয় ‘দুখের পারাবারে’; বুঝি দেবব্রত বিশ্বাস ছাড়া আর কারও গলায় এমনি করে মানাত না, ‘কানায় কানায় কানাকানি এপারে ওপারে’ হলে শুনতে কেমন লাগে, তাও থাকত অধরা। অবশ্য সুচিত্রা মিত্র বা ঋতু গুহর গলাতেও এ গান শোনা আর এক রকম অভিজ্ঞতা বৈকি।

তবে নদীর গানে সবচেয়ে বেশি মন ছুঁয়ে যায় বাউল আর সারি, ভাটিয়ালি-ঘেঁষা সুর-- গান যিনি লিখেছেন, একথা তাঁর চেয়ে বেশি তো আর কেউ জানত না! শিলাইদহে বোটে বসে কোন এক অখ্যাত মাঝির গান শুনতে শুনতে যে মানুষটির মনে হত, জীবনটা ওইখান থেকে আবার শুরু করতে পারলে বেশ হয়, তাঁর লেখা নদীর গানের সংখ্যা আর সুর মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, লোকসুরের প্রতি তাঁর প্রাণের টান কতখানি। নদীর জলের ছলছল শব্দ, জোয়ার ভাঁটার টান, অতল গহন উদাসী ভাবের পাশাপাশি মরা গাঙে বান আসার তেজ-- সবকিছুই স্বর খুঁজে পায় বাউল বা সারি অঙ্গের অবাধ, উদার, খোলামেলা আঙ্গিনায়। ‘তোমার খোলা হাওয়া’ অনেকেই গেয়েছেন, আমাদের অনেকের খুব চেনা, প্রিয় গান, তবে এ গান যখন প্রাণ পায় সুচিত্রা মিত্রের গলায়, মনে হয় এর জন্যই বলা যায় ‘টুকরো করে কাছি, আমি ডুবতে রাজি আছি’। একই কথা বলা যায় ‘আমার শেষ পারানির কড়ি’ সম্বন্ধে- কিন্তু সে গানের ভঙ্গি, ভাব আলাদা।

‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে’ প্রথম শোনা ‘মহাবিপ্লবী অরবিন্দ’ ছবিতে, অনেক ছোটবেলায়- তখন মনীষীদের জীবন নিয়ে শিক্ষামূলক ছবি মাঝে মধ্যে টিভিতে দেখালে, একটু বসে দেখার অনুমতি মিলত। শিক্ষা কতটুকু কী পেয়েছিলাম সেই বয়সে, এতদিন পরে আর মনে নেই। কিন্তু ভুলতে পারিনি গানগুলো, বিশেষ করে ‘জয় মা বলে ভাসা তরী---ই’, ‘খুলে ফেল সব দড়াদড়ি---ই’, ‘যা হয় হবে বাঁচি মরি---ই’ বলে টান দিয়ে একটা করে ঝাঁকুনি, আর সেই সুরেলা ধাক্কায় মূল গায়কের সঙ্গে কোরাসের গলাগুলো কেমন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া-- সব মিলিয়ে একটা আশ্চর্য উদ্দীপনা জাগার অনুভূতি। সেই গায়কের নাম জেনেছি বছর কয়েক পরে, আর অবাক হয়ে ভেবেছি, ওই গলাতেই ‘আমি ফিরব না রে’ এত অন্যরকম শোনায়! সেই একই নৌকো বাওয়া, বাঁধন-ছেঁড়ার উচ্ছ্বাস, জোয়ারের আমেজ আছে, কিন্তু ধাক্কা নেই, লগি ঠেলতে জোর দিতে হয় না, শুধু হাওয়ার মুখে গানের তরী ভাসিয়ে দিলেই হয়। আবার অন্য আমেজে গাওয়া ‘কে বলে যাও যাও’-- জোয়ার-ভাঁটা সেখানে একই গতির দুই অভিমুখ-- ‘ভাসাও আমায় ভাঁটার টানে’ বলতে বলতে তারসপ্তকের পা অবধি চলে যাওয়া যায় অবলীলায়, আবার ‘জোয়ার জলে তীরের তলে ফিরে তরী’ বাইতে বাইতে আরাম করে মাঝের সপ্তকে নেমে খেলে বেড়ানো যায়- কোনটা জোয়ার, কোনটা যে ভাঁটা- ভেবে মরুক লোকে! ‘আর নাইরে বেলা নামল ছায়া ধরণীতে’ গাইলে আবার আর এক রকম মেজাজ- ‘জলধারার কলস্বরে সন্ধ্যাগগন আকুল করে’-র টানে মিশে যায় ইমনের সাথে বাউল, ‘ঘাটে সেই অজানা বাজায় বীণা তরণীতে’ গাইবার সময় গভীর জলতরঙ্গের আমেজে ‘পা’ থেকে কড়ি আর শুদ্ধ মা, ‘গা’ ‘ধা’ ছুঁয়ে ছুঁয়ে তুলে আনা এক রহস্যের অভিব্যক্তি মনে পড়িয়ে দেয় ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’র ভাবসাদৃশ্য- কবিতায়, গানে, গায়নে কী গভীর ষড়যন্ত্র!

এ ষড়যন্ত্র পিছু ছাড়ে না, সন্ধ্যা হয়ে গেছে বলে উঠে আসার উপায় পর্যন্ত নেই! সেই সন্ধ্যার প্রায়-অন্ধকার একাকিত্বকে আরও জমাট, ভরাট বেদনার কুয়াশায় ভরে দিয়ে আবার পেছন থেকে ডাক আসে, ‘অশ্রুনদীর সুদূর পারে ঘাট দেখা যায় তোমার দ্বারে...’। অসীম এই দূরত্ব পার হতে চাওয়ার আর্তি নিজের অতলে নিজেই ডুব দেয়, এক স্বর থেকে আর এক স্বরে যেতে গিয়েও ধরে রাখে ব্যবধানের সুরসাম্য। ঘরে আধা- বাইরে আধা- এমন ‘যে জন আছে মাঝখানে’র নিবিড় রিক্ততার বেদনা যে কেমন করে পূরবীর আবেশে সন্ধ্যার আকাশ বাতাস নদীজল স্তব্ধ করে দিতে পারে এমন ইন্দ্রজালে-- এ গান না সৃষ্টি হলে, গাওয়া না হলে চির রহস্যময়ী নদীও বোধহয় বুঝতে পারত না নিজের ‘অতল জলের আহবান’।

এই সন্ধ্যার আবহেই মনে পড়ে আর এক অবিস্মরণীয় নদীর গান, খেয়ার গান- কিন্তু ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ হিসেবে তার ছাড়পত্র মেলে না- স্বয়ং কবি তাঁর ‘শেষ খেয়া’ কবিতায় পঙ্কজকুমার মল্লিকের দেওয়া সুর অনুমোদন করা সত্ত্বেও- না! তা হলই বা, ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গানের আবেদন তাতে আটকায় না। ‘মুক্তি’ ছবিতে পঙ্কজকুমারের কণ্ঠে এ গানের প্রয়োগ সেই তিরিশের দশক থেকেই ইতিহাস-- কবিতা থেকে গান হয়ে ওঠার ইতিহাস। ছোটবেলায় পড়েছি না, ইতিহাস বহতা নদীর মত! এক ইতিহাস থেকেই নতুন ইতিহাস সৃষ্টির প্রেরণা আসে-- পরিবর্তনে, পরিবর্ধনে, সম্মিলনে। তাই হল আবার, যখন ‘অনিন্দিতা’ ছবিতে এ গান নতুন করে গাইলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তাঁর শ্রদ্ধেয় পঙ্কজদার অনুমতি নিয়েই, কিন্তু ‘সঞ্চারী’ অংশে জুড়ে নিলেন ‘সাঁঝের বেলা ভাঁটার স্রোতে’ স্তবকটি, নিজের সুরে। স্বরবিতানে জায়গা না মিলুক, রবীন্দ্রনাথের খেয়ার গান, নদীর গানের কথা বলতে গেলে ‘দিনের শেষে’কে বাদ দেওয়া- ‘অসম্ভব, সে অসম্ভব’।

‘সাঁঝের বেলা ভাঁটার স্রোতে’ ভেসে নদী-মোহনার পানে শেষ খেয়ার এই অনির্দেশ্য যাত্রা একটু একটু করে বাঁক নিয়ে নেয় নিম্নগতিতে। স্রোত তখন মৃদু, লয় তাই ধীর, কিন্তু ব্যাপ্তি কী বিশাল! সেই স্রোতে আলতো করে খেলার ছলে গানের বাণীকে নৌকোর মত ভাসিয়ে দেওয়া যায়; সেখানে ঝড় নেই, উত্তাল ঢেউ নেই, আছে শুধু জীবনের দীর্ঘ চলার ভার-- তবে সেই ভার নিয়েও চিন্তা নেই, ডুবে গেলেও যা, ভেসে উঠলেও তাই-- সবই খেলা। ‘না হয় ডুবে গেলই, না হয় গেলই বা/ না হয় তুলে লও গো, না হয় ফেলই বা/... এই খেলাতেই আপন মনে ধন্য মানি।’ এ কথা সে নদীই বলতে পারে, যার অনন্তে মেশার সময় এসে গেছে। আশ্চর্য হবার কিছু নেই, যদি বলি-- এমন একখানা গান কিন্তু শোনার অভ্যাস বা জনপ্রিয়তার বিচারে ‘ওগো নদী আপন বেগে’, ‘তোমার খোলা হাওয়া’, ‘এবার তোর মরা গাঙে’, ‘অশ্রুনদীর সুদূর পারে’ এমনকি উচ্চাঙ্গ-ঘেঁষা ‘ও চাঁদ, চোখের জলের লাগল জোয়ার’-এর তুলনায়ও একটু যেন পিছিয়ে থাকে। আসলে এই বোধহয় নদীর নিয়ম, সে যখন সাগরে মেশে, পরম মোহনার সাথে সঙ্গমের জন্য নিজেকে ছড়িয়ে দেয় অপার করে, অশেষ করে- তখন তার আর নৌকা বওয়ার, হাজার হাজার যাত্রীকে খুশি করার দায় নেই। তখন তার শুধু অবরোহ-যাত্রায় সাগর-স্বরূপে ফেরাটুকু থাকে বাকি- আবর্তনে শেষ দুটো শব্দ তাই গড়িয়ে যায় মন্দ্র-ধীর স্রোতে, প্রায় নিস্তরঙ্গ, কেবল একটু বাতাসের ছোঁয়া-লাগা কম্পনে- গা মা পপা মা গা রা(কোমল) সা-তে – ‘গা-নে-র বা-ণী-’।

ভাগ্যিস, এ গানটাও গেয়ে রাখা হয়েছিল- অন্তত এমন কারও জন্য, যে নেহাত নালা হয়েও মজে যায়নি, সাহস করে মহানদীর স্রোতে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে, মিলিয়ে দিয়ে শেষপর্যন্ত যে কিনা সমুদ্রের স্বাদ চেয়েছে।

1 comments:

0

প্রবন্ধ - সুমিত বড়ুয়া

Posted in

 

এক

“আমি কবিতা লিখি/ অথচ আমার কবি হবার/ আকাঙ্ক্ষা ছিল না,/ কবিতা আমার একলা থাকার উপায়।” ‘আমি এখন যাবার জন্য তৈরি’ (আমার সময়) কবিতায় আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ (৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৪ – ১৯ মার্চ ২০০১) এই উচ্চারণ করেছিলেন।তিনি তাঁর কবিতাসমগ্র-এর (১৯৯৯) ‘ভূমিকা’য় লিখেছেন – “কেন লিখি? আমি নিজেও জানি না। কবে শুরু, কেমন করে শুরু? সে তো বিস্মৃতির পটভূমিকায় স্মৃতির জলের রেখা।...তবে একটি সত্য আমাকে আজও তাড়া করে চলেছে। আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের কতিপয় পঙ্‌ক্তি। “জীবন ছাড়িয়ে কোনো মানবীয় অভিজ্ঞতা থাকা কি সম্ভব? কবির অভিজ্ঞতা যা আকাশ পাতাল সমস্তই উপলব্ধি করে নিতে চায়, তাওতো মানবীয়।” ঐ যে মানবীয় উপলব্ধি সেটি যখন ধ্বনির ওপারে ধ্বনি তখনি গাঁথা হয় কবিতার মঙ্গল সূত্র। তাকে কণ্ঠে ধারণ করবো আমার তেমন সাধ্য নেই। তবে নিস্ফল প্রয়াসের যে আনন্দিত বেদনা তাকে কখনো অস্বীকার করি নি।... আমার কবিতা আমার ভালবাসার স্বজনদের জন্য।”

বাংলাদেশের সাহিত্যেস্বকীয় কাব্যভাষা সৃষ্টিতেপারঙ্গম কবি ওবায়দুল্লাহবরিশাল জেলার বাবুবগঞ্জ উপজেলার বাহেরচর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পুরো নাম আবু জাফর মহম্মদ ওবায়দুল্লাহ খান। পিতা আব্দুল জব্বার খান পাকিস্তানের আইন পরিষদের প্রাক্তন স্পিকার। কবি ওবায়দুল্লাহ ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর শেষ করে সেই বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে অধ্যাপনার পেশা ছেড়ে তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘লেটার পোয়েমস অফ ইয়েটস: দ্য ইনফ্লুয়েন্স অফ উপনিষদস্‌’ বিষয়ে গবেষণা করেন। এখান থেকে তিনি পরবর্তীকালে উন্নয়ন অর্থনীতি নিয়ে ডিপ্লোমা অর্জন করেন। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে সচিব রূপে অবসর নিয়ে মন্ত্রীসভায় যোগ দেন। কৃষি ও জল সম্পদ মন্ত্রী রূপে দুই বছর দায়িত্ব পালন করে তিনি ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত রূপে যোগ দেন। পরবর্তী কালে ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে ব্যাঙ্ককের এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের (এফ.এ.ও) অতিরিক্ত মহাপরিচালক রূপে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থায় দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে অবসর গ্রহণের সময় তিনি প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক ছিলেন। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে দেশে প্রত্যাবর্তনের পরেতিনি বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের চেয়ারম্যান হিসাবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি উইনরক ফাউন্ডেশনের সাম্মানিক সদস্য, হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স ও জন এফ কেনেডি স্কুল অফ গভর্নমেন্টের ফেলো ছিলেন।রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিয়মিতভাবে সাহিত্যচর্চা করে গেছেন।

কিংবদন্তীর কবি ওবায়দুল্লাহ পঞ্চাশের দশকে বেড়ে ওঠা কবিদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন। তিনি তাঁর সৃষ্টির জন্যে অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা পেয়েছেন। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি একুশে পদক সম্মানে ভূষিত হন। তিনি ‘পদাবলি’ নামে কবিদের একটি অভিনব সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। কবি ওবায়দুল্লাহের কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা প্রচুর না হলেও তা গুণমানে স্বতন্ত্র্যতার দাবিদার। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি হল – সাত নরী হার (১৯৫৫), কখনো রঙ কখনো সুর (১৯৭০), কমলের চোখ (১৯৭৪), আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি (১৯৮১), সহিষ্ণু প্রতীক্ষা (১৯৮২), বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্যে প্রার্থনা (১৯৮৩), আমার সময় (১৯৮৭),নির্বাচিত কবিতা (১৯৯১),আমার সকল কথা (১৯৯৩), খাঁচার ভিতর অচিন পাখি (১৯৯৯), মসৃণ কৃষ্ণ গোলাপ (২০০২)। কাব্যগ্রন্থ রচনা ছাড়াও তিনি বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণাধর্মী গ্রন্থ রচনা করেছেন যেগুলির মধ্যে চীনের কমিউন সম্পর্কে ইয়েলো স্যান্ড হিলস: চায়না থ্রু চাইনিজ আইজ, বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়ন সম্পর্কে (টম হেক্সনারের সঙ্গে যৌথভাবে) রুরাল ডেভেলপমেন্ট: প্রব্লেমস অ্যান্ড প্রস্পেক্টস ওক্রিয়েটিভ ডেভেলপমেন্ট, ফুড অ্যান্ড ফেইথ উল্লেখযোগ্য।


দুই

বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলনে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহের বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। বাহান্নের ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে, মিছিলে, সভা সমিতিতে তাঁর সরব উপস্থিতি ছিল। তাঁর কবিতার জগতে প্রবেশ সম্পর্কে তিনি (‘ভূমিকা’, কবিতাসমগ্র, ১৯৯৯) লিখেছেন – “...যিনি আমাকে হাতে ধরে কবিতায় টেনে এনেছেন তিনি প্রয়াত হাসান হাফিজুর রহমান, একুশের প্রথম সংকলন যাঁর সাহসের অবদান। ...আমার তাঁকে দীক্ষাগুরু বলতে কোনো দ্বিধা নেই। অবশ্য সেই পঞ্চাশের দশকটিই ছিল বিদ্রোহের কাল। সতের বছরের স্পর্ধার কাল।” ভাষা আন্দোলনের মিছিল, পুলিশের গুলিবর্ষণ, শহিদ হওয়া ছাত্রদের লাশ তাঁর মধ্যে গভীর ক্ষোভ ও বেদনার সৃষ্টি করেছিল যার প্রকাশ ঘটেছে কবিতায়। বাংলাদেশের সমস্ত প্রান্তকে উত্তাল করে দেওয়া একুশের ভিন্নতর এক ব্যঞ্জনা তাঁর কবিতায় প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় একুশের প্রথম সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারী প্রকাশিত হয়। এতে শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আতাউর রহমান, আনিস চৌধুরী, আবদুল গনি হাজারী, জামালুদ্দিন, ফজলে লোহানী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও সৈয়দ শামসুল হক – এই এগারো জনের এগারটি কবিতা রয়েছে। এদের কাছে দিনটি ভিন্ন তাৎপর্যে, নতুন সম্ভাবনায়, বিদ্রোহী অনুপ্রেরণা ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ইঙ্গিতে ধরা পড়েছিল।

আধুনিক বাংলা কবিতার ধারায় দেখি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তীকালে দুর্ভিক্ষের সর্বকুলপ্লাবী আগ্রাস মানুষের শিকড়ে টান মেরেছে, দ্বিজাতিতত্ত্বের জিগির তুলে রাজনৈতিকভাবে দেশ দ্বিখণ্ডিত হয়েছে, ন্যায়-অন্যায় মূল্যবোধ, সম্পর্ক ও চেতনায়, জাতিগত ভাব-ভাবনায়, শ্রেণি চরিত্রের লক্ষণে এক বড় রকমের পটপরিবর্তন দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যেই শিল্প সাহিত্যে আধুনিকতার অস্থির চরিত্র প্রকাশের বেদনায় ফুটে উঠে রূপ-রস-গন্ধময়তা লাভ করেছিল। প্রসঙ্গত পঞ্চাশের দশকের কবিতা সম্পর্কে ‘আধুনিক বাংলা কবিতা; শব্দের অনুষঙ্গে’ (পূর্ব পাকিস্তানের কবিতা) প্রবন্ধে সৈয়দ আলী আহসানের মন্তব্যটি উদ্ধারযোগ্য – “একথা বোধ হয় আমি নিশ্চিন্তে বলতে পারি এবং সকলেই বোধ হয় স্বীকার করবেন যে, ত্রিশের কবিদের পরে আমরা যারা কবিতা লেখায় অগ্রসর হয়েছিলাম, যেমন আবুল হোসেন, আমি, আহসান হাবীব, সিকান্‌দার আবু জাফর, সানাউল হক, ফররুখ আহম্মদ – এরা প্রত্যেকেই আপন আপন স্বকীয়তা নিয়ে আপন আপন ক্ষেত্রে কাব্য রচনায় ব্রতী... । বর্তমান সময়কে এরা অস্বীকার করেননি এবং বর্তমান সময়ের চিন্তা থেকে এরা সম্পূর্ণ আড়ালেও নন। এদের মধ্যে কেউ কেউ আধুনিকতার বাচনভংগী সম্পর্কে অবহিত, আর আধুনিক কবিতার রূপকল্প সম্পর্কে সজ্ঞান। ...এর পরে যাঁরা কাব্য রচনায় অগ্রসর হয়েছেন তাঁদের মধ্যে আছেন শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, ...এবং আরো অনেকে।” এই উদ্ধৃতিতে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহের নাম নিশ্চিতভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। পঞ্চাশের জাগর ধ্বনিময় স্বতন্ত্র পশ্চাৎপট তাঁর কাব্যভুবন সৃষ্টিতে সহায়তা করেছিল।

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহের কবিতা ‘মাগো, ওরা বলে’ ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের একুশে ফেব্রুয়ারির পটভূমিকায় লেখা। কবিতাটিকে নানামাত্রিক ব্যঞ্জনা রয়েছে। মা একটা ভরন্ত আশা নিয়ে খোকার জন্যে প্রতীক্ষায় রয়েছেন। খোকার প্রতীক্ষার জন্যেই যেন কুমড়ো ফুলে ফুলে লতাটা নুয়ে পড়েছে, সজনে গাছ ডাঁটায় ভরা, ডালের বড়ি শুকিয়ে খোকার প্রতীক্ষায় মা চিঠি লিখেছিলেন –“খোকা, তুই কবে আসবি?/ কবে ছুটি?” মাতৃভাষার অধিকার যারা কেড়ে নিতে চায়, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তাড়িয়ে খোকা তবেই বাড়ি আসবে বলে মাকে চিঠি লিখেছে –“মাগো, ওরা বলে/ সবার কথা কেড়ে নেবে।/ তোমার কোলে শুয়ে/ গল্প শুনতে দেবে না।/ বলো, মা,/ তাই কি হয়?/ তাইতো আমার দেরি হচ্ছে।/ তোমার জন্যে/ কথার ঝুড়ি নিয়ে/ তবেই না বাড়ী ফিরবো।” কটা দিনের পর প্রতীক্ষার অবসান হবে, তাই ‘লক্ষ্মী মা’ যেন রাগ না করে। ‘পাগল ছেলে’র চিঠি পড়ে আর মা হাসেন। ছেলের উপর কী আর রাগ করা যায়! নারকোলের চিড়ে কুটে, উড়কি ধানের মুড়কি ভেজে ইত্যাদি আরো এটা সেটা করে ‘ক্লান্ত’ খোকার জন্যে মায়ের অপেক্ষা থাকে। চিত্রটা শুধু পাল্টে যায় – কুমড়ো ফুল শুক্‌নো, ডাঁটা ঝরা, পুঁই লতাটা নেতানো।মায়ের উজাগর প্রতীক্ষার তবুও শেষ হয় না – “খোকা এলি?”অবশেষে খোকা লাশ হয়ে বাড়ি ফেরে। শকুনিদের দ্বারা খোকার শব ব্যবচ্ছেদ ঝাপসা চোখে মাকে দেখতে হয়। কিন্তু সেই দুঃখইপরিণয় হয়েছে ন্যায়সঙ্গত ক্রোধে। তাই “এখন/ মা’র চোখে চৈত্রের রোদ/ পুড়িয়ে দেয় শকুনীদের।” আবার ঘরের দাওয়ায় মা ধান ভানতে আর বিন্নি ধানের খই ভাজতে বসেন। বিস্মৃতি নাকি প্রতীক্ষা? এক খোকাই বহুগুণিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রান্তে? তাই কি তাঁর প্রতীক্ষা? হঠাৎ হয়তো খোকা বিজয়ীর বেশে দেখা দেবে।খোকার জন্যে মায়ের প্রতীক্ষা তাই ফুরোয় না – “এখন/ মা’র চোখে শিশির-ভোর/ স্নেহের রোদে ভিটে ভ’রেছে।” এই কবিতা সম্পর্কে স্মৃতিচারণায় সৈয়দ শামসুল হক তাঁর তিন পয়সার জোছনা গ্রন্থে লিখেছেন – “সেদিন খাওয়াদাওয়া শেষে জুত করে সিগারেট ধরিয়ে ওবায়দুল্লাহ পকেট থেকে তাঁর সদ্য লেখা কবিতাটা বের কর পড়ে শোনালেন। সেই কবিতা, “কুমড়ো ফুলে ফুলে নুয়ে পড়েছে লতাটা” – শুনে আমিখুব অবাক হলাম, ওবায়দুল্লাহ এত দিন পর্যন্ত তাঁর সব কবিতাই ছড়ার আঙ্গিকে লিখেছেন, এতেই তাঁর প্রসিদ্ধি, কিন্তু এ কবিতা যে নিপাত গদ্যে লেখা। এই কি তাঁর সেই অভ্যেস থেকে সরণ, যার পরিণামে আমরা বহু বছর পরে দেখে উঠব তারই কলমে এমন অবিস্মরণীয় কবিতা, “আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি”, কিংবা “বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্যে প্রার্থনা!”


তিন

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসে তৃতীয় প্রজন্মের কবি। প্রথম প্রজন্মের মধ্যে রয়েছেন শাহাদাৎ হোসেন, গোলাম মোস্তাফা, জসীমউদ্দীন, আবদুল কাদির, সুফিয়া কামাল প্রমুখ। দ্বিতীয় প্রজন্মে রয়েছেন আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, আব্দুল গণি হাজারী, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন, তালিম হোসেন, সিকান্‌দার আবু জাফর প্রমুখ।

কবি ওবায়দুল্লাহের কবিতা ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সূচিত হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সামগ্রিক জনজীবনের আশা-নিরাশা এবং স্বপ্ন বাস্তবতাকে সঙ্গে নিয়েই তাঁর এই কবিতা ভাবনার বিকাশ ঘটে। কবির কাব্যধারায় মূলত দুটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়। পঞ্চাশের দশক থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত অর্থাৎ সাত নরী হার থেকে কমলের চোখ পর্যন্ত একটি গীতিমুখ্য সুললিত ধারা রয়েছে। কবি কবিতাসমগ্র-এর ‘ভূমিকায় জানিয়েছেন – “মাঝখানে বেশ কয়েক বছর কিছুটা প্রাত্যহিক প্রয়োজনের জড়তায়, কিছুটা অভিমানে কবিতার কাছ থেকে দূরে চলে গেছি। লিখেছি, ছিঁড়ে ফেলেছি। আবার যখন সত্তরের মাঝামাঝি শুরু করলাম। তখন সব সময় পাশে ছিলেন আমার প্রিয়তম বন্ধু কবি সাইয়িদ আতিকুল্লাহ। ...আরো মনে করছি বন্ধু সৈয়দ সামসুল হক এবং গাজি শাহাবুদ্দিনকে। আর এই উৎসাহ জোয়ারে আমার প্রধান কাণ্ডারি ছিলেন প্রয়াত কবি বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।” তিনি আরো বলেছেন – “তবে আমার কবিতা যে নতুন মোড় নিয়েছিল কিংবদন্তির কবিতা থেকে, তাঁর পেছনে ছিলেন আমার অনুজ বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ, রবিউল হুসাইন এবং আরো অনেকে।”

পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের প্রকল্পে একদিকে যেমন উদারনৈতিক গুণগুলি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে আত্মস্থ হয়েছে, অন্যদিকে নানা বিকৃতি তার চিন্তাকে আচ্ছন্ন করেছে। এই বিকৃতিগুলি আর্থিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিস্তৃত হয়ে সুস্থ স্বাভাবিক সমাজ গঠনের পক্ষে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল। এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনেক কবি সোচ্চার হয়েছেন। এই দিককে তীব্র ব্যঙ্গে আক্রমণ করতেও আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ পিছপা হননি।সাত নরী হার কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি মোটের উপরে ছোট কবিতা। নামকবিতা ‘সাত নরী হার’ দেশি রূপকথার ঢঙে চেনা ছন্দে শুরু হয়েছে। ১ সংখ্যক কবিতায় কুঁচবরণ কন্যাদের কাহিনি বর্ণিত। তাদের ‘মেঘ বরণ চুল’-এ ফুলের শোভা, তাদের কণ্ঠে সাতনরী হার শোভমান হবে। রাজপুত্র তো তারই প্রতীক্ষায় রয়েছে। রূপকথাগুলি বাঙালির সেই স্বপ্নলব্ধ সময়ের নির্মাণ। কিন্তু সমকালীন শ্রীহীন সমাজে, নিরন্ন ও বিবর্ণ মানুষের ঢলে রূপকথার জগত উবে যায়। তাই একটা বড় ধরনের রূপান্তর লক্ষিত হয় কবিতামালায় – “কুঁচবরণ কন্যা তোমার/ মেঘ বরণ চুল,/ চুলগুলো সব ঝ’রেই গেলো/ গুঁজবো কোথা ফুল।রাজপুত্র রাজকন্যাকেসাতনরী হারদেবে ভেবেছিল, কিন্তু“গলায় দড়ি তার চেয়ে কি/ মন্দ অলঙ্কার?” দারিদ্র্যলাঞ্ছিত দেশে রাজকন্যার দড়িও জোটেনা। তাই ছেঁড়া গামছা দিয়ে আত্মহননের আয়োজন। মরেও মেয়ে দায় ঠেকালো, লাশ কীভাবে ঢাকা দেবে তাই চিন্তার বিষয় হল। পৃথিবীতে ‘ফুলশয্যার রাত’ পাওয়া যায় নি, তাই রাজপুত্রের স্বপ্ন কবরেতেই রাজকন্যার চুলে হাত জড়িয়ে নেবে, পাতালপুরে তার বাসরশয্যা রচনা করবে। ছয় বেহারার পাল্কি চড়ে রাজকন্যা সেখানে আসবে। চাঁদের অনুপস্থিতিতে জোনাকি দীপ জ্বালবে, আর ‘বকুল-ঝরা মাটির ফুলে’ রাজকন্যাকে ঢেকে দেওয়া হবে। প্রেমের স্মৃতি উদ্‌বেজক গন্ধে বকুল ফুল আমোদিত হবে। বিদেহী রাজকন্যা চাঁপাগাছ হয়ে উঠবে। রাজকন্যার সাদৃশ্যেই কি চাঁপার বোনের রঙ লাগা? তাই কি চাঁপা আর রাজকন্যাকে চিনতে ভুল করে ফেলা? তাই এই মধুর ভুল – “চাঁপার ডালে নিরাভরণ/ ফুলের কাফনে/ লুকিয়ে যদি রইলে তুমি/ চিনবো কেমনে।”

বাংলাদেশের কবিতায় শুধু দেশজ আঞ্চলিক শব্দের প্রচুর ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে লৌকিক রূপকল্প ব্যবহারের ঝোঁক রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এই ধরনের কবিতা লেখার প্রচলন করেছিলেন। ছড়ার অসংলগ্ন চিত্রময়তার প্রতি অমোঘ আকর্ষণের আকুতি ও মৃত্তিকা-সংলগ্ন গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে নিবিড় যোগ তাঁর কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে। সেই উত্তরাধিকার বর্তেছে অন্নদাশঙ্কর রায়, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখ এপার বাংলার কবিদের কবিতায়। কিন্তু বাংলাদেশের কবিদের কবিতায় এই উত্তরাধিকার ব্যাপকভাবে কার্যকরী হয়েছে। খলিলুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আশরাফ সিদ্দিকির মতো আবু জাফর ওবায়দুল্লাহের কবিতায় এই উত্তরাধিকারের সার্থক প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। তাঁর ‘কন্যে তোমার’ কবিতায় রোমান্টিকতার অঙ্গীকার ধরা পড়েছে – “কন্যে তোমার গায়ে হলুদ/ তত্ত্ব এনেছি/ পোড়া চোখের কালি দিয়ে/ কাজল এঁকেছি!” কী অসামান্য চিত্রকল্প তৈরি করেন কবি – “আলতো পায়ে আলতা দেবো/ হৃদয় ছিঁড়েছি/ খোঁপায় দেবো বুকের কাঁটা...।” ‘কণ্ঠে দেবো কী?’ এই অনুসন্ধানরূপকথার গল্পের ‘তারপর’-এর আকর্ষণকে কবিতায় তীব্রভাবে কবি ধরে রাখেন – “কণ্ঠে দেবো গজমোতি/ পাঁজর ভেঙ্গেছি...।” কন্যাররূপের বাহার প্রসঙ্গে কবি লেখেন – “সোনার থালা চাঁদ দেখেছি/ আরো সোনা কি?/ গায়ে রূপের ঢল নেমেছি/ সোনার লাবণি।” দারিদ্র্যলাঞ্ছিতরূপের পরিচর্যার জন্যে অভিনব পন্থায় কবি অসামান্য – “সোনায় সোনা মাখিয়ে দেবো/ হলুদ বেটেছি”। কন্যার বিবাহে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পিতৃগৃহের সঙ্গে আশু বিচ্ছেদের অনুষঙ্গ। অব্যক্ত ব্যথার সূত্রে তাই লবণ আর সাগর পানির চেয়েও ‘আরো লোনা চোখের পানি’র কথা এসেছে।আনন্দের উৎসবে চোখে জলের বৈপরীত্যে কবিতাটি ভাষা পেয়েছে।

কী অপূর্ব দৃশ্যরূপময়তার জন্ম দেন কবি ‘রূপকথা’ কবিতায় – “কৃষ্ণচূড়ার ডালে-ডালে/ আগুন লেগেছে/ পলাশ বনে লাল পরীরা/ নাইতে নেমেছে।” আবার পরিচিত ছড়ার ছন্দে এবং ঢঙে কবি সাজিয়ে তোলেন। কে দেখেছে? কন্যে দেখেছে – “নীল দিঘিতে স্বর্ণকলস/ ভেসে উঠেছে।” স্বর্ণকলস কি সূর্যের প্রতিবিম্ব নাকি সকল প্রত্যাশা! কারো বলা কথায় এলো খোঁপা বাঁধতে কন্যার কান্না বা কারো শোনা কথায় সোনার কাঁকন খুঁজতে গিয়ে কন্যার জলে ডুব দেয়।

‘ময়নার জন্য’ ১ কবিতায় ছড়ার ছন্দ বা দলবৃত্ত ছন্দ নিয়ে অসামান্য ছড়া বানিয়েছেন। তার একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় –“টুকটুকে ময়নার তুলতুলে গাল/ ফুটফুটে জোছনায় হলো আবডাল।/ ঘরদোর তছনছ সব হয়রান/ খোঁজ খোঁজ খোঁজ রব নেই সন্ধান।/ কইকইহইচই বের করা ভার/ জোছনায় ময়নায় সব একাকার।” ‘মেঘ-বৃষ্টি-ঝড়’ ছড়ায় ইতিহাসের টুকরো স্মৃতির বিনির্মাণ ঘটিয়েছেন – “বর্গীরা তো আর আসে না/ খুকুর ঘুমের উপায় কী?/ বন্যা এসে ধান ফুরালো/ তবু তো ঘর জুড়ায় নি।”‘সবিনয় নিবেদন’ কবিতায় তীক্ষ্ণ শ্লেষ লক্ষ করার মতো।খোদার মর্জির প্রতিও তাঁর তীব্র শ্লেষ যে বড়োলোক ছোটলোকের বৈষম্য তাঁরই করা, তাই‘হুজুর পরেজগার/ তাইতো তরক্কি’। কাজেই শোষণের কবলে ‘জমিদারী কায়দা’য়‘ভিটেজমি নজরানা’ গেল। এমনকিবউটা‘জুমাবারে পয়দা’ হওয়া সত্ত্বেও‘নেক-নজরে পছন্দ’ পড়ে যায়, ছাড় মেলে না।তার পরিণতি ঘটলো ভয়ঙ্কর – “পোড়ামুখী হতভাগী/ লটকালো ফাঁসেতে/ খেদমতগার লাশ/ ঠাঁই দিন পায়েতে।” আর এই সমগ্র বয়ান উঠে এসেছে হজুরেরঅধীনের ‘বশংবদ’ রহমান মণ্ডলের‘সবিনয় নিবেদন’-এর মধ্যে দিয়ে।


চার

সাতনরী হার কাব্যগ্রন্থের প্রকাশের পর দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে প্রকাশিত হয় প্রায় একই মেজাজের কাব্যগ্রন্থ কখনো রঙ কখনো সুর এবং কমলের চোখ। এটাই বাঙালির সবচেয়ে সংকট ও আত্মপ্রতিষ্ঠার সময়। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ছয় দফা, ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের গণ-অভ্যুত্থান আর পশ্চিম পাকিস্তানি শোষণ-শাসন-নির্যাতনকে বাঙালি কবিরা কবিতায় ধরতেও চেয়েছেন। কিন্তু তিনি এই কালপর্বে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা। সরকারী চাকুরে হওয়ায় যে তিনি তাঁর কবিতায় ভাবপ্রকাশের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন তা ব্যক্ত হয়েছে।আমার সময় কাব্যগ্রন্থের ‘আমি এখন যাবার জন্যে তৈরি’ কবিতায় কবি লিখেছেন – “ফুল যেমন ঢালুর মধ্যে গড়িয়ে পড়ে/ হাওয়া যেমন পাতার মধ্যে কাঁপন তোলে/ আমি তেমন অনায়াসে/ লিখতে পারি না,/ ভাবনা/ আমার চোখকে ঝাপসা ক’রে দেয়।” একটু গভীরতর ভাবে দেখলে তিনি চাকরিগত কারণে জাতির উদ্দেশে যে গুরুত্বময় কবিতাগুলি লিখতে পারলেন না, সেগুলির অঙ্কুর যে চেতনার মধ্যে ঘা দিয়ে চলেছে তার অভিজ্ঞান ধরা পড়বে আশির দশকে। আসলে যে কবিতাগুলি ষাটের দশকে লেখা উচিত ছিল বা যে কবিতাগুলি ষাটের দশকের উদ্দীপনাকে ধারণ করে রয়েছে তার প্রকাশ ঘটল আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি ও বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্যে প্রার্থনা কাব্যগ্রন্থে।ষাটের দশক থেকে মনের মধ্যে অবরুদ্ধ থাকা কবিতাগুলি কী পুঞ্জিভূত দীর্ঘ আবেগে ধীরে ধীরে মন্ত্রের মতো হয়ে উঠেছে। স্বজাতির ইতিহাসকে ধারণ করে কবির এই মন্ত্রোচ্চারণের ভঙ্গি।

কমলের চোখ কাব্যগ্রন্থে রঙের আশ্চর্য প্রয়োগ ঘটান কবি ওবায়দুল্লাহ তাঁর ‘অথবা শীতল দিঘি’ কবিতার মধ্যে – “দড়িতে ছড়ানো মেঘ/ বিধবার শাড়ী/ যুঁইফুল/ সাদাবক শ্বেতচন্দন/ সুঘ্রাণ/ মৃতের কাফন।” আবার “তিতাস সুন্দর নদী বিশেষ যখন/ কার্তিকে চাঁদ তার মুখ দেখে জলে।”কী অসামান্য পর্যবেক্ষণ ও চিত্র রচনার শক্তি থাকলে তবেই এই সাদৃশ্য পাওয়া সম্ভব – “পদ্মার সরু চর/ কুমারীর সিঁথি/ জলের চুলের ভিড়ে/ রোদের ইলিশ;/ হঠাৎ উদ্ধত/ তাজা হৃদপিণ্ড/ ছিঁড়ে যুবকেরা/ পরায় সিঁদুর।” জীবনানন্দীয় চিত্ররূপময়তার প্রতি একটা ঝোঁক প্রথম দিকের কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে লক্ষ করা যায়। ‘অঘ্রাণ হলুদ পাখি’ “কুয়াশা ব্যথার মত/ ধানের শীষে গর্ভবতী/ পুলকে সম্ভাবনাময়/ উথান নিকায় চার এয়োতী।” ‘শালুক শাপলা ফুল’ কবিতার “কিছু যদি ভাত পাওয়া যেত।” বা ‘ক্রোধ এবার’ কবিতার “ক্রোধ এবার তোমার ভাষা হবে।” –এইসব পঙক্তি আমাদের চেতনায় সরাসরি আঘাত হানতে অব্যর্থ। আবার ন্যায়সঙ্গত ক্রোধের সূত্রে আত্মানুসন্ধানের ক্ষেত্রেও তিনি উৎসমুখী। বাঙালি জাতির আত্মানুসন্ধানের ক্ষেত্রে ‘ক্রোধ এবার’-৪ (কমলের চোখ) কবিতায় বাহান্নের আন্দোলনের প্রেক্ষাপট যুক্ত – “ভাগ্‌চাষী আর/ ক্ষেত মজুর/ কৃষ্ণচূড়া/ পলাশ ফুল।/ দমকা হাওয়া/ ফুল ছড়ায়/ কল্‌জে থেকে/ খুন ঝরায়;/ এবার তবে/ সংহতি/ আসুক তুফান/ দুর্গতি/ বটের শিকড়/ আমরা যে/ ওপাড়াবে তার/ সাধ্য কি?”‘কতিপয় যুবা’ কবিতায় ঈশ্বরের প্রতি ঠেসটি চমৎকার – “ঈশ্বর মহান কারণ ঘাতক তিনি।” কিন্তু কবি ঈশ্বরের মতো মহৎ না হতে পাড়া ‘কতিপয় যুবা’র জন্যেই সওয়াল করেছেন – “তারা স্বেচ্ছায় ভালবেসে বাঁচে/ শেফালীর ফুলে। অথবা যুদ্ধে/ মরে যায় আহা।/ কতিপয় যুবা ঈশ্বর হবে না।” আর এখানেই যুবারা অনন্য। ‘কমলের চোখ’ মুক্তিযোদ্ধা কোমল সিদ্ধিকির উদ্দেশে লেখা। কবিতাটি সূচিত হয়েছে নাটকীয় ভঙ্গিতে – “কমলকে চেনো তুমি;/ সুন্দর সুঠাম দেহ/ প্রদীপ্ত চোখ/ দুপুর রোদের মত/ তীব্র প্রখর।/ একটা বুলেট/ কমলের ডান্‌ চোখ/ ছিঁড়ে নিয়ে গেছে।” মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক এই কবিতায়ও ভাষা আন্দোলনের চিত্রকল্পের উপস্থিতি লক্ষণীয় – “আমার তোমারও/ বন্ধু কি প্রিয়জন/ ধমনী যাদের ছিল/ কৃষ্ণচূড়ার মত/ তাজা সোচ্চার/ রক্তের কোলাহলে,/ স্তব্ধ এখন।”

আশির দশক থেকে অর্থাৎ আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি কাব্যগ্রন্থ থেকে কবি ওবায়দুল্লহের কাব্যগ্রন্থগুলিতে মহাকাব্যিক ধারা লক্ষ করা যায়। এই পর্যায়ে তাঁর কবিতার বিষয় হিসাবে উঠে আসে মা-মাটি ও সংগ্রামী জনতার ছবি, তা কেবল দেশ কালের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ না থেকে আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তি লাভ করে। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলির প্রকাশের কথা সরিয়ে রেখে বলতে হয়, সত্তরের দশকের মধ্য সময় থেকেই তাঁর কবিতার সৌধচূড়ার প্রস্তুতি দেখা যায়। ওবায়দুল্লাহ অতিপ্রজ ও দ্রুত সৃষ্টিক্ষম কবি নন, তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে সময় লেগেছে তুলনামূলকভাবে অনেকটা বেশি। আবার অন্যদিকে তিনি অনেক বেশি লক্ষ্যভেদী নীতিতে বিশ্বাসী। এই পর্বে তিনি বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রতিষ্ঠার স্বার্থে গণসংগ্রামের উপর আস্থা রেখেছেন। এই সম্ভাবনার সূত্রেই কবি প্রত্যাবর্তন করেছেন বাঙালির সংগ্রামী অতীতে, যে অতীতে ‘সহিষ্ণু প্রতীক্ষা’ ছিল। সহিষ্ণু প্রতীক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন – ‘জোয়ান পুরুষ কাঁদে কেন?’ ‘জোয়ান পুরুষ কাঁদে কেন?’ (সহিষ্ণু প্রতীক্ষা) কবিতায় ন্যায়সঙ্গত ক্রোধের প্রশ্নটা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে – “জোয়ান পুরুষেরা কাঁদে কেন?/ কান্না পুড়িয়ে ফেলে হিংস্র থাবায়/ ছিঁড়তে পারে না কেন রাজার হৃদয়?/ ভাঁটার মতন চোখে আগুন জ্বলে না কেন/ ঘৃণার আগুন।” কবি তাই ‘সাহসী পুরুষ’ প্রার্থনা করে ‘বৃষ্টি’ চেয়েছেন। কবি নিজে প্রাচীনপিতা হিসাবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পূর্বপ্রজন্মের নির্যাতন সহ্যের চিহ্নের সঙ্গে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও সংগ্রামের উল্লেখ করে শুভৈষী বার্তাকে তুলে ধরেছেন। তাই সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থানে তিনি আস্থা রেখেছেন। ঊষরতায় যখন চারদিক ধ্বস্ত, তখন কবি জননীর কোলে স্তন্যপানরত শিশু আর বৃষ্টির সোহাগে গর্ভবতী বসুন্ধরাকে কামনা করেছেন।

আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি কাব্যগ্রন্থের একাধিক কবিতার মধ্যে বিপ্লবী সংবেদনা ক্রিয়াশীল। আশির সময়ের মধ্যে জাতির একটা গঠনমূলক কাজ করবার তাগিদ কবিতাগুলির মধ্যে লক্ষ করা যায়।‘আত্মচরিত’ কবিতায় মুক্তিযুদ্ধোত্তর আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে – “যুদ্ধ এখন শেষ হ’য়েছে/ মা’য়ের সবার ছোট ছেলে/ ফুলের ক্ষত বুকে নিয়ে/ লাল গোলাপের সূর্য খোঁজে।”‘বাঁশী শুনি পাখিদের গান’ কবিতায় ভৌগোলিক দেশ ও মায়ের অনুভূতি মিশে গেছে। সুন্দর একটি চিত্রকল্পের জন্ম দিয়েছেন কবি – “শৈশব অস্পষ্ট।/ কৈশোর আব্‌ছায়া নদী/ মস্‌জিদ ছুঁই ছুঁই কীর্তনখোলা/ ছুটিতে দেশের বাড়ি/ হোগলার পাটি, / প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র/ তার তীরে ছোট শহর,/ সেইখানে মা সমাহিত।” ‘কারণ আমার ভালবাসা’ কবিতায় কবি রোমান্টিক ভাবনায় বিলসিত – “...কারণ আমার ভালবাসা,/ সেগুন গোলাপ কৃষ্ণচূড়া/ ভালবেসে খুন্‌ হয়েছে/ ইচ্ছা আমার বড় একা।” ‘কৃষ্ণচূড়া লোহার খাঁচা’ কবিতার মধ্যেও এই কৌতুক রেশ রয়েছে – “কাণ্ড শাখা/ ফুলের পাখা/ কৃষ্ণচূড়া/ লোহার খাঁচা/ আট্‌কাবে?”‘আমার মৃত্যু হ’লে’ কবিতাও চন্দ্রাহত কবির রোমান্টিক বিলাস – “চাঁদের দুধের সর চেটেপুটে’/ ‘প্রমত্ত আমি ফিরে আসি’।/ ‘আমার মৃত্যু হ’লে/ জ্যোছনা আমার দেহ/ যেন ঘিরে থাকে।’ ‘আমি ভালবাসা চেয়েছিলাম’ কবিতায় রোমান্টিক বিষাদের সুর বেজেছে। আবার আল্লাহের প্রতি তীব্র সমালোচনা ধরা পড়ে ‘হে আল্লাহ তুমি আকবর’ কবিতায় – “তুমি মৃত্যু দাব্‌দাহ/ শিশুর ঘাতক/ হে আল্লাহ/ তুমি আক্‌বর।”

রফিক আজাদের ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতাটির প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধারযোগ্য – “...যদি না মেটাতে পারো আমার সামান্য এই দাবী/ তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘ’টে যাবে/... দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অব্দি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে/ অবশেষে যথাক্রমে খাবো: গাছপালা, নদী-নালা/ গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাত, নর্দমার জলের প্রপাত/ চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব প্রধান নারী/ উডদীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ী/ আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ/ ভাত দে হারামজাদা,/ তা না হলে মানচিত্র খাবো।” রফিক আজাদের মতো আবু জাফর ওবায়দুল্লাহের কবিতায় মানুষের খাদ্যের দাবীর কথা সোচ্চার কণ্ঠ ফুটে উঠেছে। শৈশবের স্নিগ্ধ, সমৃদ্ধ, ‘অত্যন্ত ক্ষীণ’ দিন আর নেই, শাসককুলের অত্যাচারে মানুষ এখন প্রতিবাদী, কাজেই চিত্রের বদল ঘটেছে, দাবিরও – “ইদানিং গোত্রকূলহীন/ কতিপয় বন্য বরাহ/ “ভাত দে হারামজাদা” চীৎকার করে,/ কুলীন বংশোদ্ভুত/ শব্দেরা সন্ত্রাসে ক্লীব/ স্বগৃহ-প্রজননে অতি অক্ষম। সুতরাং বোনকে ব’লেছি/ কুমড়োর ফুল ভেজে দাও/ আমি ভাত খাবো,। যেমন খেতাম আমি মা যখন জীবিত ছিলেন।”

‘ফেরারী কবির খোঁজে’ কবিতায় সমকালীন অস্থির সময়ের ছবি উঠে এসেছে – “এখানে নবীন সবি/ শিশুরা ক্ষুধায় কাঁদে/ এখানে শোভন সবি/ কবিরা দ্বীপান্তরে।” সমকালীন দেশাত্মবোধের প্রেক্ষাপটে লেখা ‘...ঘাতক না হ’লে/ নিশ্চয়ই হত হ’তে হবে’ (‘কারণ ঘাতক না হ’লে’) বা “আমার ভাই যেদিন মুক্তি পেল,/ মানুষকে ভালবেসে ব’লে সে জেলে গিয়েছিল,/ কান্না আর খুশি আমার গলায় আট্‌কে গ্যালো।” (ডাক্‌তে চেয়েছি) বা “আমার দেহে ব্যথা পুষি/ ব্যথা।” (‘আমি একটা ব্যথা পুষি’) পংক্তিগুলি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। ‘অতি নিরাপদ দেয়ালে’ কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের একটি প্রতিক্রিয়া, অন্যদিকে ‘আমি মানবো না’ কবিতায় প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে কবির মনোভাব ধরা পড়েছে। ‘অতি নিরাপদ দেয়ালে’ দেখি এক বিপরীত চিত্র। যুদ্ধে যারা ‘গর্তের অধিবাসী’ যুদ্ধের শেষে তারাই সোচ্চার। কিন্তু ‘অতি নিরাপদ’ দেয়াল জুড়ে শান্তি আর ভালোবাসার ইস্তাহার থাকে। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের প্রতিক্রিয়ায় লিখিত এই কবিতায় যারা নিরাপদে ভালোবেসে থাকতে চায়, যারা ‘উষ্ণ পশম্‌ মৃত্যু’কে ভুলে থাকতে চায় তাঁদেরকে উপেক্ষা করে কবি বিপ্রতীপ অবস্থান নেওয়ার পক্ষপাতী – “যারা ঘৃণা করে তাদের সঙ্গী আমি/ পোড়াব শান্তি এবং মনস্থাপ।” ‘আমি মান্‌বো না’ কবিতায় ‘সব কিছু প্রতিকূল’ নিষ্প্রদীপ অবস্থায় যখন ‘আশা পরাজিত’, তখন হঠাৎ জানলা থেকে কাচ ঝন্‌ ঝন্‌ করে ভেঙে পড়ে, বজ্রের শব্দ ডিঙিয়ে তীক্ষ্ণ চীৎকার জ্বলে ওঠে যে ‘আমি মান্‌বো না’। ‘কাকের কর্কশ স্বরে’ বা ‘আমি অন্ধকারে সন্ত্রস্ত’ কবিতাদুটি অস্থির সময়ের চালচিত্র। ‘প্রভু যায় প্রভু আসে’ কবিতায় হাজার বছর ধরে ‘উলঙ্গ ক্ষুধার্ত পূতিগন্ধময়’ জনতার মাঝে দাঁড়িয়েও সত্যের প্রত্যয়ে কবি একরোখা ভূমিকা নিতে চান – “মাঝে মাঝে দাঁত দিয়ে/ প্রভুদের মুখোশ্‌টা ছিঁড়ি।”‘সুতরাং নতজানু হও’ কবিতায় তীক্ষ্ণ শ্লেষে ও বিদ্রূপ ঝড়ে পড়েছে। গ্রামে গঞ্জে গোলোযোগ, উদ্ধত মিটিং মিছিল। তাই বিজ্ঞপ্তি জারি করে জনতার প্রতি সরকার অনাস্থা এনেছে যে ‘নতজানু হও/ এবং শৃংখলিত,/ না হলে নির্বাচন’। জনতা যেখানে সরকার বেছে নেয়, সেখানে ক্ষমতার দম্ভে সরকারই নিজেদের পেটোয়া অনুগত মেরুদণ্ডহীন বেছে নেবে – ‘জনগণ বেছে নে’য়া হবে’।

সহিষ্ণু প্রতীক্ষা কাব্যগ্রন্থের ‘প্রায় ঠোঁট প্রায় মুখ’ কবিতায় রোমান্টিক কবি বলে ওঠেন – “প্রায় ঠোঁট প্রায় মুখ প্রায় গোলাপের মত।” কবি বৃষ্টি নামার আয়োজন করেন – “যখন ধানের ক্ষেতে শামুক ওঠে/ চাঁদের সভায় তারা ফোটে/ গাছগাছালিতে জোনাক-পোকা ভিড় করে/ তখন বৃষ্টি নামে।” ‘তিনি অলৌকিক’ কবিতায় ‘তিনি’ বলতে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের প্রতি তির্যকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ‘তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী’, ‘তাঁর নির্দেশে কীটদষ্ট সকল মানুষ/ ইতিমধ্যে মৃত’। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় এই কবিতা রচিত বলে মনে হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বর অত্যাচারের ফলে পূর্ব বাংলার মানুষদের দুর্বিষহ অবস্থা। অথচ সাধারণ নিরপরাধ মানুষ যাঁরা নিজেদের ন্যায্য অধিকারের কথা বলছেন, তাঁরাসুবিচার পান না। কবর থেকে মৃত মানুষদের উঠে আশার দৃশ্য ভাবনায় স্বভাবতই মুনীর চৌধুরীর ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকায় লেখা কবর (১৯৫৩) নাটকটির কথা আমাদের স্মরণে আসতে পারে। কবিতায় ‘একটি কারাগার এবং বধ্যভূমির একমাত্র এবং একচ্ছত্র অধিপতি’ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক-শোষকেরা নিদ্রা ও দুঃস্বপ্নকে অপছন্দ করেন। কিন্তু এবার তিনিও ‘বিশ্বস্ত অনিদ্রার সামান্য অমনোযোগের ফলে’ আক্রান্ত হলেন – “মৃত মানুষেরা কবরকে অনাবৃত করে উঠে আস্লো,/ তিনি ভয় পেলেন। ছিন্নমস্তক কণ্ঠস্বর/ ঝড়ের নেত্রের মত ক্রমেই কাছে আসলো,/ তিনি ভয় পেলেন। ছিন্নমস্তক কণ্ঠস্বর/ ঝড়ের নেত্রের মত ক্রমেই কাছে আসলো,/ তিনি ভয় পেলেন। অবদমিত ক্রন্দন/ সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাসের মত ভেসে আস্লো,/ তিনি ভয় পেলেন, তিনি নিঃশব্দ হ’লেন।” আর সেই শাসক-শোষকেরা ‘কীটদষ্ট এবং একটি বধ্যভূমির নিঃসঙ্গ অধিবাসী’মাত্র। এই শাসক-শোষক প্রভুকে উদ্দেশে কবি ‘একজন বৃদ্ধ সাপ’ কবিতায় বলেছেন যে তাঁরা ক্ষমতার বলে বলীয়ান হয়ে ন্যায়সঙ্গত প্রশ্নকারী বিদ্রোহীদের উলঙ্গ শিশুর মতো ‘নির্লজ্জ’, অদম্য পথিকের মতো ‘অশিষ্ট’, অবাধ্য কবিদের মতো ‘বেআইনী’ মনে করতে পারেন। তিনি উৎসবের বাদ্য স্তব্ধ করতে, একজন উলঙ্গ শিশুকে কাফন পরাতে, নৃত্যরত পথিকের অঙ্গহানি করতে বা অসংযত গায়কের জিহ্বা ছেদন করতে পারেন, “কিন্তু সমুদ্রের উচ্চারণ ঝড়ের কণ্ঠস্বর এবং/ পাখিদের নৃত্য আপনি কেমন করে বন্ধ করবেন?” অসীম আত্মবিশ্বাসে প্রভুর উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে কবি বলবার স্পর্ধা রাখেন – “প্রভু আপনি একজন গৃহপালিত পশু/ নৃত্যের কাছে পরাজিত একজন বৃদ্ধ সাপ।”

আমার সকল কথা কাব্যগ্রন্থের মধ্যে কবির সময়ের চিত্রণ মুখ্যত ফুটে উঠেছে। কবি অকপটে ‘আমার সকল কথা’ দীর্ঘকবিতায় তাঁর আবেগ প্রবাহকে কাব্যরূপ দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী অস্থির সেই সময়ে কবিরা যে দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। সেই অস্থির সময়কে তুলে ধরতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন – “আমার সময় ছিল খল্‌ প্রকৃতির/ শিকারীর শ্রেষ্ঠ সময়।”‘শেষ আর্তি’ কবিতায় প্রকাশের বেদনাই কবির মুখ্য হয়ে উঠেছে – “যে ব্যথা গোপনে থাকে/ কুঁড়ি থেকে গোলাপ ফোটে না/ আমি তারে কী ক’রে ফোটাবো?”

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কাব্যগ্রন্থে ওবায়দুল্লাহের কবিতার শেষের দিকের গুরুত্বপূর্ণ বদলের চিহ্ন ধারণকরে রয়েছে। কাব্যগ্রন্থের নাম দেখে মরমিয়া ধারার প্রতি কবি স্থিত হয়েছেন এমন মনে হওয়া অসম্ভব নয়, হয়তো তা হবে। তবুও এর মধ্যে সত্তরের শেষ ও আশির কাব্যধারার সূক্ষ্ম অথচ তীব্র প্রকাশ লক্ষ করা যায়। ‘নিঃশব্দ মর্মরে’ কবিতায় পরাধীনতা ও স্বাধীনতার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। একজন বন্দী মানুষের স্বপ্ন দেখা এবং স্বাধীনভাবে পথে নামার মধ্যেই একটি নবতর সূচনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ‘হৃদয়ে হৃদয়’ কবিতায় দুই হৃদয়ের সম্মিলনে সমে ফেরার ডাক দিয়েছেন – “হৃদয়ে হৃদয় শ্বেত গোলাপের গুচ্ছ/ পাহাড়ের চূড়া বৈরী-কলুষমুক্ত।” আবার সেই সম মাঝেমধ্যেই বিঘ্নিত হয়, তখন ‘এখন কার পালা?’ কবিতায় সেই আততি ফুটে ওঠে – “অবশেষে অস্ত্র প্রশ্ন করে,/ এখন কার পালা?/ তোমার না আমার।” কখনোবা চিত্রকল্প হানা দেয় মনে – “সবুজ অন্ধকার/ হিজলের নদী/ শিকড়ে হরিণ শিশু/ শতজলঝর্ণার ধ্বনি –” (‘নির্জন তৃষ্ণা’), কখনোবা “অশ্রুত পদাবলী/ একা একা হাঁটে/ অবিরাম জল্ধারা/ অনিবার তৃষ্ণার পথে।” (‘অশ্রুত পদাবলী’)। আবার কখনোবা কবি ঘরছাড়া পাখির মতো ‘একা একা রোদের সাথে’ কবি পুড়তে থাকেন (‘একা একা পুড়তে থাকি’)। কবি সাদৃশ্যের সন্ধানে গোধূলি এবং কাঠবিড়ালির বড় বেশি সাদৃশ্য খুঁজে পান, “যেমন সুখ ভাঙা দুঃখের মত/ ঘুঘু পাখির কুয়াশা/ অথবা শ্যাওলা রঙ কিশোরী।” (‘শ্যাওলা রং কিশোরী’) বা শিশিরের চোখের কোণে আটকে রাখা কান্নাকে ‘শেফালির গাল বেয়ে’ গড়িয়ে পড়তে দেখেন, তা আবার রোদ উঠলে ‘ম’রে যায়’ (‘ঝিনুক-ছেঁড়া শিশির’)। কবির বিস্ময়ের কাছে পাখি মানুষের চরিত্র পেয়ে যায় ‘একজন’ (‘একজন ময়লা রং শালিক’)। ‘চিত্র কাঁপে চিত্র হীনতায়’ বা ‘আঙ্গুল যদি চোখ হ’তো’ কবিতায় দৃশ্যমালার অনুবর্তনের পাশাপাশি ফিরে আসে বর্ণমালার প্রসঙ্গ, কিন্তু রূপতন্ময় কবি দেখতে চান ‘দিন এবং রাত্রির অক্লান্ত পথ হাঁটা’ আর ‘ভাবনাহীন দ্যাখ্যা’ (‘অনুচ্চার উচ্চারণ’)।

‘প্রথম সূর্য: প্রথম আলো’ কবিতায় কবি পরম পিতাকে প্রণতি করেও ‘লাঞ্ছিতা কিশোরীর মৃতদেহ’, ‘যুবতীর অপরিসীম লজ্জা’, ‘শ্রমজীবী নারীর দেহ ভস্ম’, ‘রক্তাপ্লুত শিশুর গোলাপ কুঁড়ি’কে কেন্দ্র করে একাধিক প্রশ্ন তাঁর উদ্দেশে ছুঁড়ে দিয়েছেন – ‘তথাপি অমঙ্গলের ক্রন্দন কেন?’, ‘মায়ের মত শিশিরের রোদ’-এর কাছে কবি প্রার্থনা করেছেন – মানুষকে সন্নিহিত করে ব্যাপ্ত করো, বৈষম্যের পঙ্কিলতা, দ্বিধাদ্বন্দ্ব কলহ-কালিমা দূর করে নবীন আশা জাগাও। সঙ্গে রয়েছে কবির দায়বদ্ধতা – “জননী জন্মভূমি/ তোমার চরণে অঙ্গীকার/ তোমার শ্যামল অঞ্চলে/ রোদ-বাঁধা জীবনের অঙ্গীকার:/ যে হলাহল তোমার হৃদয়ের অমৃতকে/ নীলবর্ণ করেছে/ আমরা তা অঞ্জলি ভ’রে পান ক’রবো/ তোমার অশ্রুধারা অন্তরে ধারণ করে/ আমরা পরিস্নাত এবং পরিশুদ্ধ হব/ এবং প্রথম আলোর আনন্দলোকে/ ধ্বনিত হবে/ তোমার করুণার মূর্ছনা/ আমাদের কণ্ঠে/ ঋজু ভালবাসার সুপ্রাচীন সঙ্গীত।”

‘এখানে মাঠ ছিল’, ‘ফিরে আসে না’, ‘শিকড় ছিঁড়ে গেলে’, ‘হাওয়া থমকে গেলে’, ‘নিঃসঙ্গ ভাব্‌না’ ইত্যাদি কবিতায় কবিমনের অস্থিরতা ধরা পড়েছে। ‘বিশ্বাসের ইচ্ছা’ কবিতায় এরকমই বিশ্বাসের সংকট দোলা খেয়েছে – “যদি একটুখানি বিশ্বাস থাকতো/ অথবা বিশ্বাসের ইচ্ছা/ তাহলে হাওয়া নরোম বেড়াল।” এরই পাশাপাশি চকিতে ছড়ার ছন্দকে ধরতে ইচ্ছে হয় কবির – “মেঘে মেঘে মেঘনা নদী/ আকাশ ভরেছ/ রুপোর কাঁকন ঝম্‌ঝমিয়ে/ বৃষ্টি নেমেছে।/ রোদের খেয়া নোঙর ছিঁড়ে/ ভেসে গিয়েছে/ জল্‌ডুবুরী পানকৌড়ি/ জলে ডুবেছে।/ তাই না দেখে হিজল-শুশুক/ সাঁতার কেটেছে/ উজান ভেঙে রামধনুকে/ টেনে এনেছে।” (‘ভিজে যায় শুধু ভিজে যায়’ ২)।

কবি ওবায়দুল্লাহ প্রয়াত অগ্রজ কবি হাসান হাফিজুর রহমানের উদ্দেশে লেখেন ‘দীর্ঘদেহ বালকের কবি’, আবার বন্ধু কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিনে তাঁর উদ্দেশে লেখেন আশ্চর্য কবিতা পাশে তাঁর ‘চিতাবাঘ, ভায়োলিন এবং একটি শাদা হরিণ ঘুমোয়’। গদ্য আর পদ্যের সম্মিলনে লেখা এই কবিতা কবির সমগ্র কাব্যগ্রন্থের দোসরহীন। কবিতাটির আংশিক উদ্ধৃতি উদ্ধারযোগ্য – “...তিনি শত্রু পরিবৃত্ত শহরের হৃদয়ে স্পন্দিত হ’য়ে কবিতা লেখেন রুদ্ধশ্বাস ঘরে মৃত্যুর ছায়ায়। কারণ নান্দনিক সঞ্চয়, মৃত্যুঞ্জয়, সাহসী, স্বাধীন।/ দুঃখ যখন ক্রোধ এবং ক্রোধ যখন আনন্দিত তখন শৃংখলিত মানুষ অনায়াসে শিকল ছেঁড়ে, তখন মুহূর্তের সুন্দর আদিগন্ত বিস্তৃত সর্বকালীন। তখন শীতার্ত অন্ধকার রৌদ্রের পূর্ণিমায় আলোকিত এবং বিশেষ্য-বিশেষণের কোলাহল অতিক্রম ক’রে কবিতার ক্রীড়াপদ, কখনো বিদ্যুৎ শিখার মত বহ্নিমান, কখনো একঝাঁক হরিয়ালের সবুজ হাওয়া, আবার কখনো আকাশের একুল-ওকুল দুকূল ভাসানো শ্রাবণের অশ্রুধারা।/ জলের রেখার আগুনের স্ফুলিঙ্গের আকার-নিরাকার এক এবং অভিন্ন।/ একজন কবি শুধু বারবার পুড়ে গিয়ে কেমন ধূসর/ ভস্ম ফুঁড়ে পুনরায় নিঃশঙ্ক ওঠেন বেঁচে সতেজ পালক/ নিয়ে বুকে, তারপর ‘শব্দ গান হও’ ব’লে স্বপ্নের গ্যারেজে বসে একা-একা/ লেখেন অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ কী তন্ময় রূপান্তরে।/ পাশে তাঁর চিতাবাঘ, ভায়োলিন এবং একটি শাদা হরিণ ঘুমোয়।”

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কাব্যগ্রন্থের ভাবনার রেশ রয়ে গেছে কবির শেষ কাব্যগ্রন্থ মসৃণ কৃষ্ণ গোলাপ-এ গ্রন্থে। কবি কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতা ‘গোধূলির জিজ্ঞাসা’য় কবি লিখেছেন – “মাননীয় অন্নদাতা/ আমাকে উঞ্ছবৃত্তি থেকে অব্যাহতি দিন”। কারণ, “আমার কিছু কিছু কর্মসূচি অসমাপ্ত/ যেমন কথা ছিল/ মিঠাপুকুরের এক তরুণ কৃষক/ যে ছোট্ট জমিতে ছ-রকমের সবজি ফলায়/ তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায়/ এবং বিরল বন্দরের কয়েকজন ক্ষুদ্র চাষি/ যারা অসময়ে টমেটো চাষ করে/ তাদের ওপরে একটি প্রতিবেদনের”। এই ঐকান্তিক ইচ্ছের তথা নিয়তির দীর্ঘ পরিক্রমণের ফলে ‘উঞ্ছবৃত্তি’র সঙ্গে যুক্ত তাঁর অন্যান্য সব পরিচয় মুছে গিয়ে কবি পরিচয়ই প্রধান হয়ে উঠেছে।


পাঁচ

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের দ্বিজাতিতত্ত্ব ও ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের পাকিস্তান প্রস্তাব বাঙালি মুসলমানকে সাম্প্রদায়িকতায় উৎসাহী করে তোলে এবং সাহিত্যক্ষেত্রে তার প্রবল প্রভাব পড়েছিল। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে বাঙালি মুসলমান লেখকেরা সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানবাদী সাহিত্যসৃষ্টিতে মেতে ওঠেন, যার মধ্যে শিল্পকলা ও জীবনের থেকে সাম্প্রদায়িকতার পরিমাণ অনেক বেশি ছিল। পাকিস্তানবাদী সাহিত্যসৃষ্টির প্রত্যক্ষ প্রেরণা ছিল পাকিস্তান প্রস্তাব। যাঁরা এতে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁদের অধিকাংশই সৃষ্টিশীল লেখক ছিলেন না। কেউ ছিলেন সাংবাদিক, কেউ রাজনীতিক বা রাজনীতিপ্রবণ, কেউ প্রাবন্ধিক। এঁরা অধিকাংশই ছিলেন প্রগতিবিমুখ। তাঁরা সবাই মুসলিম লীগের রাজনৈতিক দর্শন বিনাপ্রশ্নে গ্রহণ করে তাতে উগ্রভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। পাকিস্তানবাদী সাহিত্যসৃষ্টি ও পাকিস্তানবাদ প্রচারের জন্যে তাঁরা কলকাতায় ও ঢাকায় দুটি সংঘও গড়ে তুলেছিলেন। এই সংঘগুলি আলোচনা অনুষ্ঠান ও সাহিত্যসম্মেলন আয়োজন করে মুসলমান সমাজে বিশেষ এক ধরনের সংস্কৃতি ও সাহিত্যচেতনা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। তাঁদের তত্ত্ব বা দর্শন প্রচারে ব্যবহৃত হয় মাসিক মোহাম্মদী। পরে, পাকিস্তান পর্বে সরকারি মাহে-নও সাময়িকপত্রটি পাকিস্তানবাদী সাহিত্যতত্ত্ব প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পূর্ব-পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’। এই সোসাইটি শুধু সাহিত্যিক সংঘ ছিল না, মুসলিম লিগের রাজনীতি এই সোসাইটিকে পরিচালিত করত। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’। এটি গঠনে প্রধানত উদ্যোগ নিয়েছিলেন সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন ও সৈয়দ আলী আহসান। রেনেসাঁ সোসাইটি ও সাহিত্য সংসদের কোনো নীতিগত পার্থক্য ছিল না। রেনেসাঁ সোসাইটি জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণে উৎসাহী ছিল, আর সাহিত্য সংসদ উৎসাহী ছিল শুধু পাকিস্তানি সাহিত্য নিয়ন্ত্রণে। সাম্প্রদায়িক ও প্রগতিবিমুখ এই দুই সংগঠন ১৯৪৩ ও ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে যে সম্মেলনের আয়োজন করে, তাতে প্রদত্ত সভাপতিসহ অন্যান্যদের ভাষণে পাকিস্তানবাদী সাহিত্যের রূপ নিয়ে বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের প্রথম বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা মুসলিম হল মিলনায়তনে (১৯৪৩) এবং পরের বছর দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশন বসে। কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজ হলে পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটির প্রথম বার্ষিক অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনগুলিতে পাকিস্তানবাদী সাহিত্যের যে রূপ নির্দেশ করা হয়েছিল তা মুসলিম লেখকমহলে বেশ সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। এর ফলে সাম্প্রদায়িক সাহিত্যের একটি সচেতন ধারা বিকশিত হয় যা পাকিস্তান লাভের পর প্রবল হয়ে ওঠে। সাম্প্রদায়িক সাহিত্যতত্ত্ব বাঙালি মুসলিম সাহিত্যের বেশ ক্ষতি করেছিল। চল্লিশের দশকে সুস্থ একটি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা তাঁরা সৃষ্টি করতে পারেননি, কারণ পাকিস্তানি রাজনীতি ও পাকিস্তানবাদী সাহিত্যতত্ত্ব তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করেছিল। এই নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছিল। (হুমায়ুন আজাদ। ভাষা-আন্দোলন: সাহিত্যিক পটভূমিকা, ১৯৯০)।কিন্তু বাঙালির আত্মানুসন্ধানের যে তাগিদ সূচিত হয়েছিল, নতুন করে দেখবার যে দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছিল তাই ‘বাংলাদেশের সাহিত্য’ সৃষ্টির অনুপ্রেরণার ভূমিকা গ্রহণ করে। সাহিত্যের কবিতা সংরূপের ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গি সবচেয়ে কার্যকরী হয়েছিল। কবিতা কী এই প্রশ্নটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শামসুর রাহমানের ‘একটি কবিতার জন্য’, আল মাহমুদের ‘কবিতা এমন’, ফরহাদ মাজহারের ‘কবিতা: এর বিবিধ ব্যবহার ও স্বভাব’, আবুল হাসানের ‘উদিত দুঃখের দেশ’, আবিদ আজাদের ‘জীবনসত্য’ প্রভৃতি কবিতায় কবিতা সম্পর্কে নানারকম প্রশ্ন ও পর্যবেক্ষণ লক্ষ করা যায়। এইসব কবিতার সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হতে পারে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহের ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ কবিতাটি।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশবিভাগের পরে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যাচ্ছিল। অখণ্ড বাংলার বিভাজনের পরে পূর্ববঙ্গ থেকে বাঙালি হিন্দু ও মাড়োয়াড়ি পুঁজির বহির্গমন ঘটে। সেই শূন্যতা বাঙালি মুসলমানেরা পূরণ করেনি, করেছিল প্রধানত অবাঙালি মুসলমানেরা। সামরিক বাহিনি সহ সরকারি অন্য চাকরির উচ্চপদে শিক্ষায় অগ্রসর পশ্চিমী পাকিস্তানিরা প্রাধান্য পায়। তবে এও ঠিক যে সরকারি চাকরির মতো স্বাধীন বৃত্তিতে, জমি ও স্থাবর সম্পত্তিতে হিন্দুদের ফেলে যাওয়া শূন্যস্থান পূরণের জন্যে পূর্ববঙ্গের শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানেরা এগিয়ে আসে। পাটের দর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি চাষি বা নিম্নতর স্তর থেকেও কিছু সংখ্যক মানুষ উচ্চশিক্ষাকে কেন্দ্র করে অগ্রসর হতে থাকলে সমাজে গতিশীলতা সঞ্চারিত হয়। মোটের উপর ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ রাজধানী ঢাকা এবং রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা প্রভৃতি শহরকে কেন্দ্র করে এক শিক্ষিত নাগরিক বাঙালি মুসলমান স্তর গড়ে উঠতে শুরু করে। এই নবোদ্ভুত বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজ দেখে তার আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার পথে পশ্চিম পাকিস্তানি সমধর্মী অথচ ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের বাধা, যেমন একদিন বাঙালি মুসলমানেরা হিন্দুদের মনে করেছিল। একবার ভারত বিভাগ, পরে পাকিস্তান বিভাগ হয়ে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র রূপে বাংলাদেশের জন্ম হল। সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমী পাকিস্তানিদের বেরিয়ে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের অগ্রগতি ও ব্যাপ্তি ত্বরান্বিত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠেছে। এই নতুন মধ্যবিত্তের অধিকাংশের পিতা বা পিতামহ ছিলেন কৃষিজীবী অথবা খুদে ব্যবসায়ী। এখনো বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর, জাতীয় আয়ের পঞ্চান্ন শতাংশ কৃষি থকে আসে এবং পঁচাশি শতাংস মানুষ কৃষির সঙ্গে যুক্ত। এইসব কারণগুলির জন্যে বাংলাদেশের নবজাগ্রত মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজের সঙ্গে গ্রামের এবং কৃষির যোগ তেমনভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি, যতটা বিচ্ছিন্নতাঘটে গেছে পশ্চিমবঙ্গের নগরবাসী শিক্ষিত বর্ণহিন্দুমধ্যবিত্ত সমাজের সঙ্গে। যেহেতু কবিরা প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে মধ্যবিত্ত সমাজ থেকে উঠে আসেন, সেই কারণে কৃষিব্যবস্থার সঙ্গে মধ্যবিত্তের যোগ থাকা আর না থাকা নিয়ে দুই বাংলার স্বাধীনতা-উত্তর কবিতার ক্ষেত্রে পার্থক্য ঘটে গেছে। (‘কৃষকের উপমা’, চোখের দুটি তারা: দুই বাংলার কবিতা, ২০০০, অশ্রুকুমার শিকদার)। বাংলাদেশের কবি আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান, হাসান হাফিজুর রহমান, বেলাল চৌধুরী, আল মাহমুদ, রফিক আজাদ, আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, মোহাম্মদ রফিক, সৈয়দ শামসুল হক, মহাদেব সাহা, মাহবুব সাদিক, মুহম্মদ নুরুল হুদা, আবু হাসান শাহরিয়ার, আজিজুল হক, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহের কবিতায় তো বটেই; এমনকি নাগরিক কবি শামসুর রাহমানের কবিতায় খুব নগণ্য হলেও কৃষি, কৃষক, কৃষি সভ্যতা, শ্রমের উপমা ও অনুষঙ্গ ফিরে ফিরে এসেছে।কৃষিকাজের মতো কবিও তাঁর কবিতা প্রায় একই প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি করেন। কবিতা রচনা যে কৃষিকাজের তুল্য কবি মহাদেব সাহা এমন মনে করেন – “ফসলের ভিত্তিভূমি এই মাটি জেনেছি তো ঢের/ অজন্মা বন্যায় দেখি ব্যর্থ সব আমার আয়াস,/ রোদে ও বৃষ্টিতে আমি আজো করি মৃত্তিকার চাষ/ বীজ বুনি ফসলের।” এই কর্ষণ কবিতার জন্যে, ফসল কবিতা। কবি নির্মলেন্দু গুণ প্রায় সমধর্মা বক্তব্য প্রকাশ করে লেখেন – “মাটি যেথায় লেখার খাতা, কলম যেথায় ফলা,/ রক্ত যেথায় কবির কালি, সেই তো শ্রেষ্ঠ কলা।” সেই সূত্রেই কবি ওবায়দুল্লাহের ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ কবিতায় পূর্বপুরুষদের কথা বিচার্য – “পতিত জমির আবাদের কথা বলতেন/ তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।”

‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ কবিতাটির পূর্ণাঙ্গ রূপ দৈনিক সংবাদের রোববারের সাময়িকী-তে২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতাটির শেষে সম্পাদকীয় পাদটীকাটি খুবই গুরুত্বময় – “মাঝে বেশ কিছুকাল লেখালেখি থেকে দূরে থাকার পর গত কয়েক বছরের মধ্যে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ আবার প্রবলভাবে বাংলা কবিতার মৌলিক ধারায় ফিরে এসেছেন। সেই সঙ্গে তাঁর কবিতারও একটা ব্যাপক চরিত্র বদল ঘটেছে।/ সম্প্রতি এক বক্তব্য প্রসঙ্গে সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন, বাংলা ভাষায় রচিত সমকালের যে দশটি কবিতাকে তিনি বিশিষ্ট বলে মনে করেন আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ তাদের মধ্যে দ্বিধাহীনভাবে একটি। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ নতুন পর্যায়ে লেখা শুরু করার মুহূর্ত থেকেই এ কবিতাটির রচনায় হাত দেন। তারপর থেকে গত বছর তিনেকের মধ্যে খণ্ডে খণ্ডে কবিতাটির নির্মাণ কাজ চলতে থাকে। যখন যেটুকু লেখা হয়েছে সেটুকু বিভিন্ন কাগজে স্বয়ংসম্পূর্ণ কবিতা হিসেবে, এমনকি একটি কাব্যগ্রন্থেরও নামাঙ্কিত হওয়ার পর এতোদিনে পূর্ণাঙ্গরূপ পেল সর্বমোট দু’শ পঞ্চাশটি উজ্জ্বল পংক্তিতে।” কবিতাটি তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়েছেল অপূর্ণাঙ্গ রূপে, দুই শিরোনামে – আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি কাব্যগ্রন্থে একই শিরোনামে আর সহিষ্ণু প্রতীক্ষা কাব্যগ্রন্থে ‘আমরা কি তাঁর মতো কবিতার কথা বলতে পারবো’ শিরোনামে। আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি গ্রন্থে পঙক্তি সংখ্যা ছিল সাতান্ন এবং সহিষ্ণু প্রতীক্ষা গ্রন্থে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে একশো আট। সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ রূপায়ণে আড়াইশো পংক্তিসহ সাময়িক পত্রে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে কবিতাটি বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। এই কবিতা সম্পর্কে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় আনন্দবাজার পত্রিকা-য় লেখেন – “মন্ত্রের মতো অমোঘ উচ্চারণ। এমন কবিতা বাংলাভাষায় লেখা সম্ভব আমার জানা ছিল না।” কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় কবিতাটিকে অনুরণিত শ্লোকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কবি অন্নদাশঙ্কর রায় কবিকে চিঠিতে লিখেছেন – “আপনার কবিতা আমায় চমক লাগিয়েছে।”

‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ কবিতাটিতে কবি ওবায়দুল্লাহের কবিকৃতির একটি অনন্যসাধারণ বিস্তৃতি ও সামগ্রিক বিশ্বাসভূমির প্রেক্ষাপট উপস্থাপিত হয়েছে। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, একটি জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার দ্বন্দ্ব, বিশ্বাসবোধের ধ্রুপদী উচ্চারণ, জাতির সংহতি চিন্তায় কবিতাটি বাংলা কবিতার একটি মাইলফলক। কিংবদন্তি হল লোকপরম্পরায় শ্রুত ও কথিত এমন কোনো বিষয় যা জাতির ঐতিহ্যের পরিচয়বাহী। কবিতায় কবি ঐতিহ্যসচেতন শিকড়সন্ধানী মানুষের সর্বাঙ্গীণ মুক্তির ঘোষণা করেছেন। বাঙালি জাতির হাজার বছরের সংগ্রাম ও বিজয়ের ইতিহাস এই কবিতার প্রেক্ষাপট তৈরিতে উদ্দীপক রূপে কাজ করেছে। কবি মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এবং তাঁর পূর্বপুরুষের সাহসী ও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা বলেছেন। কবি মাটির কাছাকাছি মানুষের ইতিহাসের সঙ্গে বাংলার অনার্য-ক্রীতদাসের লড়াই করে টিঁকে থাকার ইতিহাস তুলে ধরে ‘কবি ও কবিতার কথা’ বলেছেন। বংশপরম্পরায় যারা অন্যের দ্বারা শাসিত তাদের ক্রীতদাস বলা হয়েছে। ক্রীতদাস ক্রীত মানুষ। আমাদের পূর্বপুরুষেরা ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে পদানত ছিলেন। তাঁরা নিজের জমিতে ফসল ফলালেও তা নিজেদের মতো করে ভোগ করতে পারতেন না। শত্রুশক্তির সঙ্গে শক্তিতে পেরে উঠতে না পেরে তাঁরা নির্জীব জীবন যাপন করতেন। প্রভুর শক্তিকে নিয়তি মনে করে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলে মুখ বুজে সব সহ্য করতেন। এইজন্যে পূর্বপুরুষদের ক্রীতদাস বলা হয়েছে। কবিতায় কবি প্রতারক ও অত্যাচারী ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার কথা বলেছেন। জনতা সঙ্ঘবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ালে বজ্রকণ্ঠে প্রতিবাদের ভাষা ধ্বনিত হয়। এই মাহাত্ম্যগুণে সেই প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে কবিতা। ‘পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত’ বোঝাতে মানুষের ওপর অত্যাচারের ইতিহাস এখানে তুলে ধরা হয়েছে। সেই অত্যাচারের আঘাত যে এখনও তাজা রয়েছে তা বোঝাতেই রক্তজবার প্রসঙ্গ ব্যবহৃত হয়েছে। লক্ষণীয় যে আঘাত রয়েছে পিঠে। অর্থাৎ শত্রুরা ভীরু কাপুরুষের মতো পিছন থেকে আক্রমণ করেছে অথবা বন্দি ক্রীতদাসদের অপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, মুক্তমানুষের সঙ্গে সম্মুখ লড়াইয়ে বীরোচিত সাহস দেখায়নি।

‘কবিতা রক্তাক্ত ক্ষত’ (আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি) কবিতায় কবি ওবায়দুল্লাহ বলেছেন – “কবিতা রক্তাক্ত ক্ষত,/ আত্মহননকারী রমণীর কব্‌জির মত/ নিহত কৃষ্ণচূড়া দুঃখের দেহ।” কবিতা কেবল কুসুমকোমল সৌন্দর্য নয়, ‘কবিতা কদর্য ক্ষুধা’। কিন্তু এই কবিতাই হয়ে উঠেতে পারে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের অস্ত্র। ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ কবিতায় কবিওবায়দুল্লাহ কবিতা সম্পর্কিত তাঁর ধারণা ও প্রস্তাব সবিশেষ উল্লেখযোগ্য – ক) “জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা/ কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।”খ) “যে কর্ষণ করে তাঁর প্রতিটি স্বেদবিন্দু কবিতা/ কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।”গ) “দিগন্ত বিদীর্ণ করা বজ্রের উদ্ভাসন কবিতা/ রক্তজবার মত প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।”ঘ) “নদী এবং সমুদ্রের মোহনার মত/ সম্মিলিত কণ্ঠস্বর কবিতা/ অবদমিত ক্রোধের আনন্দিত উৎসারণ কবিতা।”ঙ) “উৎক্ষিপ্ত নক্ষত্রের প্রস্ফুটিত ক্ষতচিহ্ন কবিতা/ স্পর্ধিত মধ্যাহ্নের আলোকিত উন্মোচন কবিতা।”চ) “শৃংখলিত বৃক্ষের ঊর্ধ্বমুখী অহংকার কবিতা/ আদিবাস অরণ্যের অনার্য সংহতি কবিতা।”ছ) “স্বপ্নের মত সত্যভাষণ ইতিহাস/ ইতিহাসের আনন্দিত অভিজ্ঞান কবিতা।”জ) “সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা/ সুপুরুষ ভালবাসার সুকণ্ঠ সংগীত কবিতা/ জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা/ রক্তজবার মত প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।” কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ ‘The Preface’-এ (Lyrical Ballads, 1802) কবিতা সম্পর্কেবলেছেন – “For all good poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings; and though this be true, Poems to which any value can be attached were never produced on any variety of subjects but by a man who, being possessed of more than usual organic sensibility, had also thought long and deeply. …Poetry is the first and last of all knowledge – it is as immortal as the heart of man.”এই বক্তব্য থেকে ওবায়দুল্লাহের কবিতা বিষয়ক বক্তব্য যে খুব অনাত্মীয় এমনটা বলা যাবে না।

আলোচ্য কবিতায় ‘কবি’র অভিনব সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে – “যে উদ্গত অংকুরের মত আনন্দিত/ সে কবি/ যে সত্যের মত স্বপ্নভাষী/ সে কবি/ যখন মানুষ মানুষকে ভালবাসবে/ তখন প্রত্যেকে কবি।” কবির আত্মবলিদানও মানুষকে সৌভ্রাত্রে সম্মিলিত ও অগ্নিগর্ভ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।হিংস্র ঘাতককেও নতজানু হয়ে কবিতার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে হয়। কবি ওবায়দুল্লাহ উত্তমপুরুষ ‘আমি’র জবানিতে কি বিষয়ে প্রস্তাবনা করতে চান সেই সম্পর্কে দীর্ঘ বক্তব্য পেশ করেছেন। ‘কিংবদন্তী’ ও ‘পূর্বপুরুষের’ কথা ধ্রুবপদের মতো কবিতায় ফিরে ফিরে এসেছে। কবির বক্তব্যগুলি উদ্ধৃত হল –ক) “আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি/ আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।”খ) “আমি উচ্চারিত সত্যের মত/ স্বপ্নের কথা বলছি।/ উনোনের আগুনে আলোকিত/ একটি উজ্জ্বল জানালার কথা বলছি।/ আমি আমার মায়ের কথা বলছি।”গ) “আমি বিচলিত স্নেহের কথা বলছি/ গর্ভবতী বোনের মৃত্যুর কথা বলছি/ আমি আমার ভালবাসার কথা বলছি।” ‘মা তুমি’ (কমলের চোখ) কবিতায় কবি ওবায়দুল্লাহ লিখেছিলেন – “ভালবাসা দিলে মা মরে যায়/ যুদ্ধ আসে, ভালবেসে/ মায়ের ছেলেরা চ’লে যায়।” ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি কবিতায় সেই পংক্তিগুলি হুবহু ফিরে এসেছে। শুধু যুক্ত হয়েছে শেষে একটি পংক্তি – “আমি আমার ভাইয়ের কথা বলছি।” ঘ) “আমি জলোচ্ছ্বাসের মত/ অভ্যুত্থানের কথা বলছি/ উৎক্ষিপ্ত নক্ষত্রের মত/ কমলের চোখের কথা বলছি/ প্রস্ফুটিত পুষ্পের মত/ সহস্র ক্ষতের কথা বলছি/ আমি নিরুদ্দিষ্ট সন্তানের জননীর কথা বলছি। আমি বহ্নিমান মৃত্যু/ এবং স্বাধীনতার কথা বলছি।”ঙ) “আমি শ্রমজীবী মানুষের/ উদ্বেল অভিযাত্রার কথা বলছি/ আদিবাস অরণ্যের/ অনার্য সংহতির কথা বলছি,/ শৃংখলিতবৃক্ষের/ ঊর্ধ্বমুখী অহংকারের কথা বলছি,/ আমি অতীত এবং সমকালের কথা বলছি।”চ) “আমি স্থির লক্ষ্য মানুষের/ সশস্ত্র অভ্যুত্থানের কথা বলছি/ শ্রেণীযুদ্ধের অলিন্দে/ ইতিহাসের বিচরণের কথা বলছি/ আমি ইতিহাস এবং স্বপ্নের কথা বলছি।”ছ) “আমি বিচলিত বর্তমান/ এবং অন্তিম সংগ্রামের কথা বলছি।” জ) “আমার সন্তানেরা/ আমি তোমাদের বলছি।/ যে দিন প্রতিটি উচ্চারিত শব্দ/ সূর্যের মত সত্য হবে/ সেই ভবিষ্যতের কথা বলছি,/ আমি ভবিষ্যতের কবিতার কথা বলছি।”ঝ) “আমি বিষসর্প প্রভুদের/ চির প্রয়াণের কথা বলছি/ দ্বন্দ্ব এবং বিরোধের/ পরিসমাপ্তির কথা বলছি/ সুতীব্র ঘৃণার/ চূড়ান্ত অবসানের কথা বলছি।/ আমি সুপুরুষ ভালবাসার/ সুকণ্ঠ সংগীতের কথা বলছি।”ঞ) “দীর্ঘদেহ পুত্রগণ/ আমি তোমাদের বলছি/ আমি আমার মায়ের কথা বলছি/ বোনের মৃত্যুর কথা বলছি/ ভাইয়ের যুদ্ধের কথা বলছি/ আমি আমার ভালবাসার কথা বলছি/ আমি কবি এবং কবিতার কথা বলছি।”

যে কবিতা ভালোবাসে-না বা কবিতা শোনার মানসিকতা যার নেই, তাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন কবি। কবির এই সাহস অদম্য। তিনি বলেছেন – ক) “যে কবিতা শুনতে জানে না/ সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।/ ...সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।/ ...সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।” খ) “...সে নদীতে ভাস্তে পারে না।/ ...সে মাছের সঙ্গে খেলা করতে পারে না।/ ...সে মা’য়ের কোলে শুয়ে গল্প শুনতে পারে না।” গ) “...সে সন্তানের জন্য মরতে পারে না/ ...সে ভালবেসে যুদ্ধে যেতে পারে না।/ ...সে সূর্যকে হৃদপিণ্ডে ধরে রাখতে পারে না।” ঘ) “...শস্যহীন প্রান্তর তাকে পরিহাস করবে।/ ...সে মাতৃস্তন্য থেকে বঞ্চিত হবে। ...সে আজন্ম ক্ষুধার্ত থেকে যাবে। ঙ) “...পরভৃতের গ্লানি তাঁকে ভূলুন্ঠিত করবে। ...অভ্যুত্থানের জলোচ্ছ্বাস তাঁকে নতজানু করবে। ...পলিমাটির সৌরভ তাকে পরিত্যাগ করবে।”চ) “সে তরঙ্গের সৌহার্দথেকে বঞ্চিত হবে।/ ...নিঃসঙ্গ বিষাদ তাকে অভিশপ্ত করবে। ...সে মূক এবং বধির থেকে যাবে।” ছ) “সে মধ্যাহ্নের প্রত্যয়ে প্রদীপ্ত হতে পারে না। ...সে সন্ত্রাসকে প্রতিহত করতে পারে না।” জ) “যূথভ্রষ্ট বিশৃংখলা তাকে বিপর্যস্ত করবে। ...সে আজন্ম হীনমন্য থেক যাবে।” কবিতাবিমুখদের উদ্দেশে কত সহজ-সাবলীল ভাষায় কবি কথাগুলো বলেছিলেন। কত গভীরের অনুভূতি দিয়ে তিনি এমনি ভাবপ্রকাশ করে গেছেন।

বাঙালি চিন্তাচেতনা ও সংস্কৃতির হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা অনেক শোষণ, বঞ্চনা আর নিগ্রহ সহ্য করে ইতিহাসে ‘বাঙালি’ জাতি হিসাবে আমাদের প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ তারই সাক্ষ্য বহন করে। বাঙালি জাতির অস্তিত্ব টিকে থাকার ইতিকথা, সর্বোপরি কবিতার শক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরিচয় কবিতাটির মধ্যে পাওয়া যায়। কবি তাঁর ‘পূর্বপুরুষ’ বলতে আমাদের সবার পূর্বপুরুষ তথা বাঙালি জাতির আদি পিতাদের বুঝিয়েছেন। ‘করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল’ বলতে কৃষিভিত্তিক সমাজের কথা বলা হয়েছে। সে সমাজ যন্ত্রনির্ভর নয়,

কবির পূর্বপুরুষের চোখে ছিল স্বপ্ন। তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়, অরণ্য ও শ্বাপদ, পতিত জমি আবাদ, কবি এবং কবিতার কথা বলতেন। প্রবঞ্চক ভূস্বামীর বিরুদ্ধে যুথবদ্ধ প্রতিরোধ, রাজশক্তির বিরুদ্ধে ঋজু ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে শ্বেত সন্ত্রাসকে সমূলে উৎপাটিত করে কবিদের এগিয়ে যাওয়া। নগরীতে ক্ষুধা, নিঃসঙ্গতা, নিষ্ফলতার সঙ্গে যুঝতে হয়। প্রপিতামহদের বীরগাথা স্মরণ করে নিজেদের উজ্জীবিত করে পর্বতের মতো অবিচল আর ধ্রুবতারার মতো লক্ষ্য স্থিরীকৃত করা হয়। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে ভূমিকর্ষণে, বীজবপনে অক্লান্ত কাজ জারি থাকে কারণ পরিশ্রমই উন্নতির গোড়ার কথা। কবিতাটিতে ‘আমি’ থেকে ‘আমরা’য় ভাবের উত্তরণ ঘটেছে। আর সব ভাবনা এসে মিশেছে স্বাধীনতার প্রসঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে –“আমরা কি তাঁর মত কবিতার কথা বলতে পারবো/ আমরা কি তাঁর মত স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো।” এই ইতিবাচক আত্মানুসন্ধানই কবিতাটির মূল জোরের জায়গা।

দেশবিভাগের পর পূর্ববাংলায় যে নাগরিক মধ্যবিত্ত সমাজ দ্রুত বিকশিত হয়েছিল সেই সমাজের মানুষ ভূমি ও কৃষিব্যবস্থার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু তাঁদের নগরবাসী, নানা পেশায় নিযুক্ত, উচ্চশিক্ষিত সন্তানেরা, পৌত্র-দৌহিত্রেরা পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে ভূমির সঙ্গে সেই যোগাযোগ নষ্ট করে ফেলেছেন। আগেকার নাগরিক কবিতার ধারা থাকলেও বাংলাদেশের তরুণ কবিরা এখন অনেক বেশি নাগরিক। তার মধ্যে রয়েছে নাগরিক জটিল বাগবন্ধ ও সংহতি, পাব গভীর ফর্ম সচেতনতা। আবার অনেক কবিতাই স্বীকারোক্তিমূলক, তার রচনা আত্মজৈবনিক উপাদানে গঠিত। তার মধ্যে কখনো বিষাদ আর আত্মরতি, আবার কখনো তাতে আত্মকেন্দ্রিকতা ছারিয়ে থাকে ইতিহাসজ্ঞান ও পরিবেশ চেতনা। বিপরীত প্রবণতার একটি অস্ফুট ইশারা কখনো কখনো পশ্চিমবঙ্গের কবিতায় পাওয়া যায়। (‘কৃষকের উপমা’, চোখের দুটি তারা: দুই বাংলার কবিতা, ২০০০, অশ্রুকুমার শিকদার)। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ নামকবিতায় কবি ও কবিতার সঙ্কটের ছবি ফুটে উঠেছে। “আমি লিখি বলে/ নদীতে ঢেউ ওঠে/ কুমড়ো গাছে ফুল ফোটে –/ কিছুদিন/ মাত্র কিছুদিন/ আমি হেরে গেলাম,/ রাজ

‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ কবিতার সূত্রেই আলোচনা করা যেতে পারে ‘বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা’ কবিতাটি।দুটি কবিতাই আধুনিক বাংলা সাহিত্যে অভূতপূর্ব সংযোজন, দুটি কবিতার মধ্যেই রয়েছে মহাকবিতার বিস্তার।কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘আগ্নেয়াস্ত্র’ (না প্রেমিক না বিপ্লবী, ১৯৭২) কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর মুক্তিবাহিনির বাংলাদেশের সরকারের কাছে অস্ত্র জমা দেবার উল্লেখ রয়েছে। কবি লিখেছেন – “আমি শুধু সামরিক আদেশ অমান্য ক’রেহয়ে গেছি/ কোমল বিদ্রোহী, প্রকাশ্যে ফিরছি ঘরে,/ অথচ আমার সঙ্গে হৃদয়ের মতো মারাত্মক/ একটি আগ্নেয়াস্ত্র, - আমি জমা দিইনি।” এক দশক পরে একই ভাবনা ফিরে এসেছে কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহের কবিতার পঙক্তিতে, তীব্র হতাশায়, ‘বৃষ্টি এবং সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা’য় – “যুবকের বুকে ভালবাসার মত আগ্নেয়াস্ত্র/...যে সাহসী সে যুদ্ধে গেছে/ যারা যুদ্ধে যায় তারা ফিরে আসে না।” কবির ‘বিচিত্র শব্দাবলী বিবর্ণ/ বৈশাখের শিলাপাতে আহত শস্যের মত বিচূর্ণ”। কবির সমকালীন পরিবেশ ও পরিস্থিতি প্রতিকূল আর কবি ‘নিঃসঙ্গ ধূ ধূ’। অথচ তিনি বৃক্ষহীন প্রান্তর, যুদ্ধ এবং আগ্নেয়াস্ত্র, বিশীর্ণ নদী কিংবা রুক্ষ মাটি, ভাঁটি অঞ্চলের বিপন্ন কৃষকের কথা বলতে চান না। কিন্তু, তাঁর কাছে কিছু বিষয় অন্তরায় সৃষ্টি করে রেখেছে – “কিন্তু আমি কেমন করে/ কৃষকের গাঙ্গে বান আনবো/ কৃষকের ঘরে শস্যের দানা তুলে দেবো/ যুবকের বুকে ভালবাসার ধন তুলে দেবো/ অথবা বর্ণাঢ্য অরণ্য সৃষ্টি করবো?” সমস্যা হল – “আমাদের শস্যের দানা বিনষ্ট/ বিস্তীর্ণ প্রান্তর বৃক্ষহীন/ ভালবাসার যুবক নিরুদ্দিষ্ট/ সাহসী পুরুষ নিহত।”

কীভাবে এই সমস্যার নিরসন হবে? কবি জানিয়েছেন – “তুমি আসলে/ সুবাতাস বইবে/...জননীর পুত্ররা দীর্ঘ আয়ু হবে/ ...সবৎসা গাভীগণ মধুময় হবে/ ...নিষ্পত্র বৃক্ষ মুকুলিত হবে/ ...শস্যের দানা পরিপূর্ণ হবে/ ...সাহসী পুরুষেরা ফিরে আসবে।”কবি প্রদোষ কাল থেকে রক্তিম প্রত্যুষ পর্যন্ত ‘সহিষ্ণু প্রতীক্ষায়’ সাহসী পুরুষ, বর্ণ এবং বৃষ্টি, শস্য এবং গাভী’ ভূমি এবং কৃষকের জন্যে প্রার্থনা করেছেন। “কবি ‘পিতামহের স্তোত্রের মত’, ‘পবিত্র কবিতার মত’, দিবারাত্র ‘শ্রাবণের ধারার মত’ মঙ্গল বা কল্যাণের জন্যে প্রার্থনা করছেন – “আমাদের ভূমি/ প্রভাতে সূর্যাস্তে যেন রঞ্জিত হয়/ ভাদ্রে কার্তিকে যেন বারিসিক্ত হয়/ কৃষকেরা কাজ করে কৃষকের গাভী/ সুস্থ সবল থাকে নিরাপদে থাকে।/ আমাদের বিশুষ্ক ভূমি/ তিমির মতন যেন জলে ভেসে ওঠে/ আমাদের তৃষ্ণার্ত ভূমি/ জননীর শিশু যেন স্তন্য পান করে/ আমাদের চিরবন্ধ্যা ভূমি/ বৃষ্টির আদরে যেন গর্ভবতী হয়।”

বয়সোচিত ক্লান্তি, উদ্যমহীনতা, আরাম কীভাবে কবির কাব্য-কবিতার ভাবনাকে ক্ষয়িষ্ণু করে তোলে – কবি ও কবিতার এই আত্মসঙ্কট ধরা পড়েছে খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কাব্যগ্রন্থের নামকবিতায়। কবি ও কবিতার এই সঙ্কট ও হতাশার চিহ্ন কবির ঐকান্তিক ইচ্ছা সত্ত্বেও লক্ষ করা যায় – “এমন দিন ছিল/ আমি তোমার মত ভাবতাম/ আমি লিখি বলে/ নদীতে ঢেউ ওঠে/ কুমড়ো গাছে ফুল ফোটে –/ কিছুদিন/ মাত্র কিছুদিন/ আমি হেরে গেলাম,/ রাজহাঁসের পালকের মত/ নরোম আরামের কাছে হেরে গেলাম।” কবির মধ্যে দুই আমির সংলাপে এই কবিতা রচিত, এও এক আত্মদর্শন। নিজের সঙ্গেই নিজের মুখোমুখি বসার আয়োজনে কবি মেতে ওঠেন – “তাকিয়ে দ্যাখো কেউ নেই।/ আমি সবাইকে ছুটি দিয়েছি।/ ওঠো, খোলা পায়ে/ শিশিরের কাছে যাও/ তারপর/ তোমার মায়ের মাথার কাছে শেফালি/ যেমন সারারাত ফুল ফোটায়/ তুমি আমাকে তেমন করে ডাকো,/ ডাকতে ডাকতে ঝরে পড়ো –/ আমি আসবো।”তারপরেই সূচিত হবে মরমিয়া খেলা – “আমরা দু’জনে নীরব আবছায়া,/ মনে হলো কে যেন গান গায় –/ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি/ কমনে আসে যায়।”

আবার, ‘পিতার ছবি’ (খাঁচার ভিতর অচিন পাখি) কবিতায় ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ কবিতার কথার সূত্রই ফিরে এসেছে একটু অন্যভাবে। মন্ত্রের মতো উচ্চারণ কবি পিতার জবানিতে উচ্চারিত হয়েছে – “ভালবাসার আকাশ ঋজু এবং বন্ধুর/ তোমরা তাঁকে অনুসরণ কর।/ ভালবাসা যখন কথা বলে/ তোমরা গভীর বিশ্বাসে শ্রবণ করবে,/ যদিয়ো ভালবাসার স্বপ্নের মত উচ্চারণ/ স্বপ্নকে বিদীর্ণ করে/ যেমন কালবোশেখী গোলাপের বাগানকে। ভালবাসা তোমাদের মুক্তির মুকুট পরাবে/ ভালবাসা তোমাকে ক্রুশবিদ্ধ করবে,/ ...যখন তোমরা ভালবাসার কাছে সমর্পিত/ তখন হৃদয়ের গোপন সংবাদ জানতে পারবে/ এবং জীবনের হৃদয়কে অন্তরে ধারণ করবে।” ‘প্রপিতামহের গান’ (খাঁচার ভিতর অচিন পাখি) কবিতায় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের চমৎকার চিত্র উদ্ভাসিত হয়েছে – “পাহাড় চূড়ায় প্রপিতামহের সমাধি/ শ্যামল রক্ত ফল্গুধারায় সিক্ত/ বননির্ঝরে মাতার স্নেহের অশ্রু/ চরণে অধীর কর্ণফুলীর নৃত্য।” কবিতাটির ভাবের উত্তরণ ঘটেছে গানে।


ছয়

ওবায়দুল্লাহের কবিতায় বৃক্ষশোভিত নদীমাতৃক বাংলাদেশের চিত্রকল্প বারংবারই ধরা দেয়। আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি কাব্যগ্রন্থে কবির ইচ্ছার মধ্যে নদী হওয়ার ইচ্ছেটা বিশেষ তাৎপর্যময়। সেইসঙ্গে বৃক্ষ হয়ে উঠবার তাড়নাও কবির মধ্যে কম নয়। বৃক্ষ ও রমণী ভিন্ন হয়েও কবিদৃষ্টিতে সমধর্মা। পা কাটা বৃক্ষ আর শূন্যসার রমণীর দশা একই। তবুও তার প্রত্যাশায় চলিষ্ণুতার স্বপ্ন উজাগর থাকে – “ধূ ধূ চর্‌/ কবে নদী হবে?” (‘রমণী বৃক্ষ নদী’ ১)।রমণীর উদ্দেশে বলা স্মৃতিজাগানিয়া কথায় কবিরতাকে জিগেস করেন যে তার নদীকে কি মনে পড়ে কিনা?‘মৃদু বৃষ্টির মন্দিরা’ ‘জলের আদরে’,‘সিক্ত অঙ্গে হিজল্‌ গাছের বাসনা’য় কী ভাবে ফুটেছিল? কবির “মনে পড়ে নদী নদীর ছায়াতে রাত্রি/ চরণ ভিজিয়ে হিজল এবং তুমি/ অন্ধকারের আকাশে হেলান্‌ দিয়ে/ যত তারা ছিল মাছ হ’য়ে খেলা করে।” এখন তা শুধুই স্মৃতি। নদীরা এখন শুকনো, ক্ষত বিক্ষত ধূ ধূ রোদের চরে শুধুই ঊষরতা, হিজল গাছ মৃত, চারদিকে মৃত্যুর রিক্ততা। (‘রমণী বৃক্ষ নদী’ ২)।কিন্তু এত শূন্যতা রিক্ততার মধ্যেও কবি আশাবাদী – “শূন্য রমণী নদী কূলে ব’সে আছে/ শ্যামল বৃক্ষ নদীর অপেক্ষাতে।” (‘রমণী বৃক্ষ নদী’ ৩)।

প্রকৃতির সঙ্গে কবির আত্মিকতার ছবি বারংবার ফিরে ফিরে এসেছে। প্রাণোচ্ছ্বোসে ভরা কবি চলিষ্ণুতায় বিশ্বাসী। তিনি ‘নীল জামাতে আকাশটাকে মাখিয়ে’ নিয়ে চলে যেতে চান, ধান কুড়ানো শালিখ পাখিকে চম্‌কে দিয়ে মেঘের কাছে, গাছের কাছে, নদীর আশ্রয়ে যেতে চান – “রোদ্‌ ভিজিয়ে বৃষ্টি হব/ নদীর কাছে চলে যাব।” (‘রোদ্‌ ভিজিয়ে নদীর কাছে’)। কবি আবার কবিতায় নদীর কর্মদক্ষতার প্রশস্তি করেছেন – “নদী তুমি/ যখন্‌ তখন/ চাঁদ্‌টা বুকে/ টান্‌তে পার,/ আদর ক’রে/ রাখ্‌তে পার/ আহ্‌লাদীকে/ ভাঙ্গতে পার/ ...চাঁদ্‌কে ডাক/ চাঁদকে রাখ/ চাঁদকে ভাঙ্গো,”। সেই সঙ্গে তার উদ্দেশে একটি আততিময় আবেদনও রয়েছে – “আমার ঘরে/ চোখ দিয়ো না/ ঘর ভেঙ্গো না/ ঘর ভেঙ্গো না।” (‘নদী তুমি’)।

‘নদীর সোহাগী নারী’ কবিতায় দেখি যে নদীর প্রবল আবেগ সবসময় অনুকূলে বয় না। তাই সে সংসার ভাসিয়েও দেয়। গাছ, পাখি, নদী-পচানো পাটের গোছা, সজনের ডাঁটা, ধান কুড়ানিয়া পাখির ছেঁড়া ছেঁড়া ছবি দিয়ে কবি সংসারের একটি রেখাচিত্র এঁকেছেন। কিন্তু ‘নদীর আবেগে’ এই ‘সংসার’ ভেঙে গেছে। তবুও ঘাসের দ্বীপে বৃক্ষের চারা বেড়ে ওঠে, ‘পাখিদের ভিড়ে/ নিকানো উঠানে ধান/ ডুরে শাড়ি ঘাসের ফড়িং’ সমন্বিত হয়ে ‘সংসার’ মেতে ওঠে। এমনকি ‘নদীর সোহাগী নারী’কেও নদী টেনে নিয়ে যাবে। ভাঙ্গা-গড়ার সংসারের ছবিতে চিরচলিষ্ণুতার প্রতীকে নদী এমনভাবেই প্রবহমান থাকে।

কবিসত্তার সঙ্গে বৃক্ষের নিবিড় যোগের কথা ওবায়দুল্লাহের কবিতায় বারংবার ফিরে ফিরে আসে। ‘গাছ হব ফুল হব তারা হব’ কবিতায় সংসারের দিনানুদৈনিকতাকে ছুঁয়ে কবি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস দেখিয়েছেন। কবিতায় কবির ‘অহং’ চেতনা মৃত্যুর প্রতিস্পর্ধী হতে পেরেছে। ‘দুর্বিনীত কালবোশেখী’ রূপ ‘মৃত্যুর কাছে’ তিনি বলেন – “তুমি একটা গোলাপ ছিঁড়তে পার,/ এক্‌টা তারা যদি খসে পড়ে/ আকাশ কখনো অন্ধ হবে না।” বা ‘দাম্ভিক’ মৃত্যু গাছের গুঁড়ি আছড়ে ভাঙতে পারলেও কবির আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠস্বর – ‘আমি মরব না’। মৃত্যুকে উপেক্ষা করেই বেঁচে থাকবার দৃঢ় প্রত্যয় – ‘গাছ হব ফুল হব তারা হব’। মৃত্যুকে কবির সমকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাখলে অন্যতর ব্যঞ্জনা বুঝে নিতে পাঠকের অসুবিধা হয় না।কমলের চোখ কাব্যগ্রন্থের ‘বৃক্ষ বৃক্ষ করো’ ১ সংখ্যক কবিতাটিসহিষ্ণু প্রতীক্ষা কাব্যগ্রন্থের ‘বৃক্ষ, বৃক্ষ করো’ কবিতারূপে সংকলিত হয়েছে।কবিতায় ‘প্রেমে নয় সন্ত্রাসে’র প্রেক্ষাপটে বৃক্ষ হওয়ার প্রার্থনা পুনরাবর্তিত হয়েছে – ‘মা বৃক্ষ হ’তে চাই’। ‘বৃক্ষ বৃক্ষ করো’ ২ সংখ্যক কবিতায়পাখি, গাছের সঙ্গে কবিসত্তার যোগের কথা উল্লিখিত হয়েছে। তাই কবি টিয়ে সবুজ পাখনার পাখির খোঁজ করেন। কৃষ্ণচূড়া গাছের পাতা ঝরে গেলে নিজের অন্ধত্ব কামনা করেন। ‘বৃক্ষ বৃক্ষ করো’ ৪ সংখ্যক কবিতাটিতে চল্লিশ ছুঁয়ে থাকা কবি আত্মবলোকন করেছেন। কবির অভিজ্ঞতার মধ্যে যুক্ত হয়ে যায় প্রতিরোধের, যুদ্ধের স্মৃতি, সেখানেও নদী তাঁর সত্তা বিনির্মাণে সহায়ক –“...জননী মৃত্যু শেফালী/ বকুল গন্ধ মাটি। বন্ধু অনুজ/ সহিষ্ণু নারী রক্ত অমিতাচারী/ মিছিল যুদ্ধ। কনিষ্ঠ আত্মজ/ তিতাসের নামে নাম রাখিয়াছি তার,/ তিতাসের জল এখনো স্নিগ্ধ করে।”

কিন্তু সবসময় যে কবি আত্মস্থ থাকেন বা থাকবার পরিস্থিতি থাকে এমনটিও নয়। তাই ‘ফেরারি কবির খোঁজে’ কবিতায় স্বাভাবিক জীবনের চোরাতলে থাকে অনেক প্রশ্ন – সূর্য ওঠে, সহসা বৃষ্টি পড়ে, ফসল ফলে, আবার ‘শিশুরা ক্ষুধায় মরে’। এখানে ‘অনেক নদী’, ‘মেঘেরা রঙিন শাড়ি’, ‘ফুলের পাখি’ ‘ফেরারি কবির খোঁজে’ ব্যস্ত থাকে। আপাত সচল জীবনযাত্রা, অথচ সকল কিছু ‘নবীন’, ‘শোভন’, তবুও ‘শিশুরা ক্ষুধায় কাঁদে’। কেন এমন হয়? কারণ, ‘কবিরা দ্বীপান্তরে’।


সাত

কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তাঁরকবিতাসমগ্র-এর ‘ভূমিকা’য় লিখেছেন – “আমার সবচেয়ে বড় ঋণ আমার মায়ের কাছে। তাঁর সংসার খরচ বাঁচিয়ে আমাকে দেয়া কবিতা লেখার কলমটি হারিয়ে গিয়েছে। তবে তিনিই ছিলেন আমার কৈশোরের কাঁচা লেখার মুগ্ধ শ্রোতা। তাঁরই ষড়যন্ত্রে একটি লেখা পাথিয়েছিলাম কলকাতায় স্বর্গত বুদ্ধদেব বসুর কাছে। তিনি পরিমার্জন করে ছাপিয়েছিলেন।” কবি ওবায়দুল্লাহের কাব্যে মায়ের উপস্থিতি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মায়ের ধারণা তাঁর কাব্যে বহুমাত্রিকতা লাভ করেছে। তা যেমন জন্মদাত্রী মা, তা আবার বাংলা ভাষা ও দেশমাতৃকা বাংলাদেশে ব্যাপ্ত হয়েছে।

‘মা তুমি’ (কমলের চোখ) কবিতায় ‘মা’ ‘সোঁদা গন্ধ মাটি’। মাটি ফলবতী কারণ মা-ই আমাদের জন্মদাত্রী। কবির মায়ের এই ধারণা ব্যাপ্ত হয় প্রকৃতিতে। মা কোলে ‘সহোদর ঘাস ঘাসফুল’ সাজানোয় কবি-সন্তান একটু অভিমানী। বিস্ময় মাকে ঘিরে থাকে। তাই তিনি আবার শালিক পাখির আদল পেয়ে যান – “মা কি শালিক পাখি? খয়রী শাড়িতে তাঁর/ হলুদের ছোপ্‌/ তারপর একদিন তিনি/ শুভ্র কাফন প’রে/ শেফালীর ফুল।” ভালোবাসা দিলে মায়ের মৃত্যু হয়, যুদ্ধ আসে তারফলে মায়ের ছেলেদের প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়।

কবিতায় তাই প্রশ্ন ফিরে আসে – “তোমরা আমার কাছে/ কেন কেন চাও?” ‘আত্মচরিত’ (আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি) কবিতায় শালিক পাখি মায়ের কথা মনে পড়ায়। আবার ‘মায়ের ছবি হারিয়ে গেছে/ গুল্মলতা দূর্বা ঘাসে।” “যুদ্ধ এখন শেষ হ’য়েছে/ মা’য়ের সবার ছোট ছেলে/ ফুলের ক্ষত বুকে নিয়ে লাল গোলাপের সূর্য খোঁজে।” কিন্তু ‘বটের ছায়া’স্বরূপ দাদা ‘প্রবাস’ গেলে কথক একা – “মাগো আমার/ কাঁটা কে আর তুলে দেবে।”

‘বাঁশী শুনি পাখিদের গান’ (আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি) কবিতায় আত্মচরিতের চিত্র রয়েছে। অনেক ভোরে ঘুমের ওপার থেকে কবি পাখিদের গান শুনতেন – “খোকা ওঠ্‌/ বেলা হ’য়ে গেল।” শৈশবের অস্পষ্টতার সঙ্গে কৈশোরের আবছায়া স্মৃতি জেগে থাকে ‘খোকা’র মনে। মসজিদ ছুঁইছুঁই কীর্তনখোলা নদী, ছুটিতে দেশের বাড়ি হোগলার পাটি, প্রাচীন ব্রহ্মপুত্রের তীরে ছোট্ট শহর, সেইখানে মা সমাহিত। কিন্তু, এখনো ভোরে বাঁশি আর পাখিদের গান শোনেন, মায়ের স্বর স্মৃতিতে জায়মান থাকে – “বাবা ওঠ্‌/ য়্যাই বাবা ওঠ্‌।”‘মা দুঃখ পাবে’ (আমি কিংবদন্তীরকথা বলছি) কবিতায় কবির মনে প্রকৃতি ও মায়ের একীভূত হওয়ার চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। মা প্রকৃতি বা দেশের প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গে একাত্মতা উপলব্ধি করেন। তাই কবির উপলব্ধি – “বন্দুক নামিয়ে ফেল/ হাঁসকে মেরো না।/ মেঘ নিঃসঙ্গ হবে/ শিশু নিঃশব্দ হবে/ দেশে আকাল হবে/ মা দুঃখ পাবে।”‘মা কখনো যায় না চলে’ (আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি) কবিতায় জীবনে মাতৃভাবনার ধারণার পুনরাবর্তনের কথা বলা হয়েছে। কবিতার প্রতিপাদ্য হল মা হারিয়ে যেতে পারে কিন্তু কখনো চলে যায় না। কবি যখন পিতৃত্ব পদে অভিষিক্ত হলেন, তখন তাঁর ‘মা’ মন’ ত্রিশ বছর পরে ক্ষেত্রে প্রত্যাবর্তিত হয়েছে। ছড়ার ছন্দের দোলানিতে প্রত্যাবর্তনের সুর বেজেছে – “আমি মায়ের কোলে ছিলাম/ আমার কোলে মা/ মা’র কপালে ফোঁটা দিলাম/ নজর দিয়ো না।/ মা কখনো যায় না চ’লে/ আমার সোনার মা।”

বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি কবির মনে কখনো ম্লান হয় না। ‘এখানে শব্দ ক্ষুব্ধ কৃষ্ণচূড়া’(আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি)কবিতায় একুশে ফেব্রুয়ারির কোন সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে এর প্রেক্ষাপট রচনা করেছে ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত বলিদান –“এখানে শব্দ ক্ষুব্ধ কৃষ্ণচূড়া/ বুলেটে বিদ্ধ উষ্ণ রক্তে বোনা/ জননী কান্না আমার তোমার ঘৃণা/ মিছিলে আগুন এবং সম্ভাবনা:/ নবজাতকের বাসের যোগ্য ভূমি/ মা ভালোবাসা ঢেকিতে কিশোরী পা/ উদ্ধত কবি/ শব্দ যাহারা তীক্ষ্ণ বর্শাফলা/ অন্ধকারের কল্‌জেটা ছেঁড়ে/ দুপুরের ফাল্‌গুনে।/ অথবা কবিতা শেফালী ফোটাবে ভোরে/ শিশুরা হাসবে আমার মা’য়ের চোখে।”

‘আমার ঠিক মনে পড়ে না’ (সহিষ্ণু প্রতীক্ষা) কবিতায় ঘর গেরস্থালির পরিবেশে লোকান্তরিত মা আর মেয়ের প্রসঙ্গ এসেছে। হোগলার বোনের মতো অন্ধকারে শুধু একটি তারার আলো, সবাই ঘুমিয়ে গেলে মা উনোন জ্বালিয়ে পিঠা ভাজতেন। মায়ের চোখ ‘বেতের ফলের মত বিষণ্ণ ছিল’, যদিও ঠিকমনে পড়ে না, শোনা কথা। মায়ের সূত্রে আসে আত্মজার কথা – “আমার মেয়ে বাবুই পাখির মত গান করে/ গাংচিলের মত নেচে বেড়ায়/ দু’হাত তুলে চুড়ি বাজিয়ে বলে,/ ‘ঝিকিমিকি ঝিকিমিকি ছোট্ট তারা/ কোথায় আছ আমি যে পাইনে সাড়া’। আত্মজার মধ্যে দিয়ে মায়ের দৃষ্টির নিশ্চয়তা এই কবিতাটির প্রাণ। এই প্রত্যয়ে মায়ের ভাবনা পুনরাবর্তিত হয় আত্মজার মধ্যে – “শুনেছি মা’য়ের চোখ/ বেতের ফলের মত বিষণ্ণ ছিল, অনেকে বলে অবিকল আমার মেয়ের মত,/ আমার ঠিক মনে পড়ে না।”

‘আমার সময়’ (আমার সকল কথা) কবিতায় মায়ের উপমা হিসাবে শালিকপাখির কথা ফিরে এসেছে – “বাড়ির মুখে ডোবা পুকুর/ চোখ তুললে জারুল ফুল/ আধ ময়লা শাড়ির মত গোধূলি,/ ডোবা পুকুর জারুল ফুল গোধূলি/ এদের সঙ্গে মা’র/ বড় বেশি সাদৃশ্য/ যেমন দুঃখিনী শালিক পাখি।” ‘মা তুমি’ (কমলের চোখ) কবিতার “মা কি শালিক পাখি?... শেফালির ফুল।” অবিকল লিপিবদ্ধ হয়েছে। একই কবিতার অংশকে বা ভাবকে পরবর্তীকালে অন্য প্রসঙ্গে বা বিবর্তিত ভাব বোঝাতে ব্যবহার করার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়।

লোকান্তরিত মায়ের কবরে ঘাস বুনো ফুল ছেয়ে থাকে। ‘যন্ত্রণা নিটোল গোলাপ’কবির ‘ফুসফুস’ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে শ্বাস নিতেও পারেন না – ‘নিঃশ্বাস বড় নির্মম’। মায়ের সঙ্গে সন্তানের নিবিড় একাত্মতার বোধ বাংলা কবিতার একটি বিশিষ্ট দিক। ‘বসুন্ধরা’ (সোনার তরী)কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সন্তানের নিরাপদ আশ্রয়স্থান মা বসুন্ধরার মাতৃগর্ভেই ফিরে যেতে চেয়েছেন – “আমারে ফিরায়ে লহো, অয়ি বসুন্ধরে,/ কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে/ বিপুল অঞ্চল-তলে।” শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘জরাসন্ধ’ (হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য, ১৩৬৭) কবিতায় এই নিরাপত্তার প্রশ্নটি অন্যভাবে উত্থাপিত হয়েছিল – “যে-মুখ অন্ধকারের মতো শীতল, চোখদুটি রিক্ত হ্রদের মতো কৃপণ করুণ, তাকে/ তোর মায়ের হাতে ছুঁয়ে ফিরিয়ে নিতে বলি। এ-মাঠ আর নয়, ধানের নাড়ায়/ বিঁধে কাতর হ’লো পা। সেবন্নে শাকের শরীর মাড়িয়ে মাড়িয়ে মাড়িয়ে আমাকে/ তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে।”ওবায়দুল্লাহের সতীর্থ কবি শহীদ কাদরী বাংলাদেশের অস্থির সময়ের প্রেক্ষাপটে আশ্রয়হীনতার সংকটকে তুলে ধরেছেন – “জন্মেই কুঁকড়ে গেছি মাতৃজরায়ন থেকে নেমে –/ সোনালি পিচ্ছিল পেট আমাকে উগ্‌রে দিলো যেন/ দীপহীন ল্যাম্প্‌পোস্টের নীচে, সন্ত্রস্ত শহরে/ নিমজ্জিত সবকিছু, রুদ্ধচক্ষু সেই ব্ল্যাক-আউটে আঁধারে।” এইসব কবিদের ভাবনার ঐতিহ্যের সূত্রে আমরা ওবায়দুল্লাহেরপঙক্তিটি উদ্ধার করতে পারি – “আমার সময়ে/ মায়ের পেট ছাড়া/ কোথায়ো কোন/ নিরাপত্তা ছিল না।” কবিতায় পরেই অস্থির সময় উল্লিখিত হয়েছে – “আমার সময়ে সন্ত্রাস/ চতুর কামোটের মত/ বিবেচনার বিষয় ছিল।” মা প্রতিবাদে প্রতিরোধেও সন্তানের আশ্রয়স্থল। তাই আশ্রয়ের তাগিদে বারবার মায়ের কাছে ফেরা – “জেলখানায় রক্তপাত/ এবং রাজপথে রক্ত/ দু’জনেই লাল/ কিন্তু উচ্চারণ আলাদা,/ একজনের সাক্ষী নাই/ একজনের সাক্ষী/ চন্দ্র সূর্য নক্ষত্র/ একজন নদীর মত/ নিজেই নিজের ঠিকানা খুঁজে/ মায়ের কাছে ফিরে যায়/ একজন বন্দী।”কিন্তু লোকান্তরিত মায়ের সঙ্গে যেসব সুখস্মৃতি ও অনুষঙ্গ জড়িত ছিল, এখন তা শুধুই স্মৃতিবিষ – “আমার মা/ চাঁদের আলো ভালবাস্‌তেন/ এখন চাঁদ দেখলে মনে হয়/ এক থালা রক্ত।”

কবির সময়ে মৃত্যু – পাখির মায়ের মৃত্যু, শেফালির মৃত্যু, বংশীবাদক রাখালের মৃত্যু বাতাবি ফুলের গন্ধের মতো ‘স্বাভাবিক’; জেলখানায় রক্তপাতের মতো ‘সাধারণ’ ছিল। কবিতায় একাধিক মৃত্যুর প্রসঙ্গ এসেছে – কৃষকের খোলানে ধান তুলতে গিয়ে মৃত্যু, ওজুর পানি তুলতে গিয়ে বৃদ্ধের মৃত্যু, কবিতা পড়তে পড়তে যুবকদের মৃত্যু, শিশির কুড়োতে কুড়োতে পাখির মৃত্যু, বৃষ্টির মতো কথা বলতে বলতে মেয়েদের মৃত্যু, হলুদ পাতা বুন্তে বুন্তে বৃক্ষের মৃত্যুর পরেই এসেছে মায়ের মৃত্যুর প্রসঙ্গ – “আমার মা/ ছেলের জন্য অপেক্ষা করতে করতে/ ম’রে যায়/ আমার পিতার ঠোঁটে/ পানি গড়িয়ে পড়ে/ আমার বোন/ হু হু ক’রে কেঁদে উঠে/ আমার ভাইকে/ চোখ বেঁধে ধ’রে নিয়ে যায়,/ আমি আমার মায়ের কবরের মত/ চুপ করে থাকি/ রাস্তাঘাটে প’ড়ে থাকা/ যেমন একজন উপুড় মানুষ/ রোদ এবং বৃষ্টির/ মুছে ফেলতে সময় লাগে।” কবিতার শেষ হয়েছে তীক্ষ্ণ প্রশ্নে – “আমার মার চুল/ লম্বা এবং কাল ছিল/ কবর কি চুলের মত কালো?”

‘এখন ভয় করে না’ (আমার সকল কথা) কবিতায় মা-বাবা-মেয়ের প্রসঙ্গ রয়েছে। যদিও কবন্ধ সময়, তবুও কবিতাটির মধ্যে আশ্চর্য ইতিবাচক আত্মবিশ্বাস রয়েছে।মোড় ঘুরলে পথকে বা সকালবেলায় তারা দেখা যায় না। পথের চলা অবিরাম, তারারাও সন্ধ্যায় ফিরে আসে। চোখের আড়াল মানেই মৃত্যু নয়। জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েই কবি দেখেছেন যে লোকান্তরিত মা’য়ের জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করেছেন, এখন মায়ের চেহারা তাঁর মনে পড়ে না। বাবা একদিন হাঁটতে হাঁটতে মোড় ঘুরলে কবির মনে হয়েছিল যে বাসটা কেমন খালি হয়ে গিয়েছে। আবার ঘরের সামনে গাছের জটলা করে পাখিরা ঘোরে ফেরে, কবির মেয়ে কল্‌কল্‌করে কথা বলে, কবি সারাদিন ধরে তারা খোঁজেন, কিন্তু সন্ধ্যায় ঘরে ফিরলে মেয়েকে জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। আবার তিনি যখন অফিস যান, তাঁর মেয়ের ছবি কাজের টেবিলে রাখা থাকে, যেন সে বাবাকে চোখে চোখে রাখে। এই ভাবকে কবি ভাষা দিয়েছেন – “আসলে সব ছবি যদি/ আকাশে টাঙ্গানো যেত/ অথবা গাছের সব চেয়ে উঁচু ডালে/ তা’হলে বাসা আর খালি থাকে না/ উনুনে তারা ফোটে।” কবিতার শেষে দৃঢ় প্রত্যয় ফুটে ওঠে – “আমার মোর ঘুরতে ভয় ক’রতো/ এখন ভয় করে না,/ চোখের আড়াল মানে/ মৃত্যু নয়।”

‘শিশিরের রোদ’ (খাঁচার ভিতর অচিন পাখি) কবিতাটি ঔপনিষদিক আবহে তৈরি হয়েছে – “এ দ্যুলোক মধুময় মধুময় পৃথিবীর ধূলি/ আরো মধু তাঁর চোখে/ যেখানে বেঁধেছে বাসা/ ডানা ভাঙা পাখি/ হেরে যাওয়া মানুষেরা/ যে তরীর নোঙর ছিঁড়েছে/ শেষ পারানীর মাঝি কণ্ঠ নীরব।” এখানে ‘তাঁর’ বলতে মাকে বোঝানো হয়েছে। মা সকলকে নানা ঋতুতে কাছে টেনে “আঁচলে রাখেন বেঁধে/ শিশিরের রোদ”। মহাজাগতিক ঘটনা ঘটে, প্রকৃতি তার মতো চলে, কিন্তু মায়ের স্নেহ ধ্রুব। তাই মায়ের অনিঃশ্বেষ আদরেই সন্তানের একমাত্র ভরসা। তাই সন্তানের ঐকান্তিক আবদার – “আমাকে একটু বেশি/ আদর করো না কেন,/ আমি যে ভীষণ একা/ তুমি ছাড়া, আমার জননী।”

‘সব মায়েরা পারে না’ (খাঁচার ভিতর অচিন পাখি) কবিতাটি একটি অলীক স্বপ্নের আলোকে রূঢ় বাস্তবের পর্যালোচনা। সংক্রান্তির রাতে কথক একটা স্বপ্ন দেখেন যে তাঁরা মাদুর পেতে অপেক্ষারত, তারারা উনুন জ্বালিয়ে পিঠে ভাজছে, চাঁদের থালায় বেড়ে দিলে খাওয়া হবে। স্বপ্ন অপূর্ণিত বাসনার প্রকাশ, যা বাস্তবে সম্ভবপর নয়, তা স্বপ্নে পূরণ করা হয়ে থাকে। জ্ঞানী মানুষ সেই স্বপ্ন বিশ্লেষণ করে কথককে যোগ্যতমের উদ্বর্তনের কথা বলেন। কথক তাও প্রশ্ন করেন যে মায়ের কোলে অসহায় শিশুকে মা দুধ দেয় না কেন? জ্ঞানী মানুষ কথককে রূঢ় বাস্তবের মুখোমুখি করে দেন, তীব্র শ্লেষে সভ্যতার শোষণের চিত্র ফুটে ওঠে – “না, সব মায়েরা পারে না –/ যে মা খেতে পায় না/ তার বুক শুকিয়ে যায়।।”

কবি ‘শেফালির ফুল’ (খাঁচার ভিতর অচিন পাখি) কবিতায় একটি কাহিনি কাব্যের খসড়া করেছেন। ‘অন্ধকারে আশ্রিত সেঁতসেঁতে বুকের মধ্যে/ মা’য়ের জন্য ভালবাসার রক্ত’ নিয়ে যুবক ছেলেরা পালিয়ে থাকে। ছেলের জন্যে প্রতীক্ষায় থেকে থেকে মা মারা যান। ছেলে বহুদিন পরে মা’য়ের কআছে এসে শিয়রে একটি শেফালির চারা বুনে দেয়, মনে মনে ভাবে ‘ফুল ফুটলে আবার আসবে’। কিন্তু অর্থকে ভালবেসে ‘আপাতসুন্দর অবক্ষয়’ বেছে নেয় সে। রাষ্ট্রের অত্যাচার আর বিদ্রোহের কালে ছেলেদের আবার পালাতে হয়, পরে অনেকে ফিরে আসে, অনেকে ফেরে না। কিন্তু মায়ের কাছে প্রত্যাবর্তনের এক সদর্থক ভাবনায় কবিতাটির উত্তরণ ঘটে – “শেফালি গাছে আজও ফুল ফোটেনি,/ হয়তো ফুটবে/ যখন মায়ের সবার ছোট ছেলের কান্না/ গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়বে।/ তখন আমি মায়ের কাছে যাবো,/ বিশ্বাসের একাগ্রতায় প্রার্থনা করবো/ ভালবাসার সুকুমার দাক্ষিণ্যের জন্য।”

‘একজন প্রবীণ বয়াতী’ (খাঁচার ভিতর অচিন পাখি) কবিতায় মায়ের বেশ বয়স হয়েছে, এখন বেশ অভিমানীও, তাই মাকে সামলাতে হয়। সন্তান মায়ের কাছে অঙ্গীকার করে যায় “তোমার জন্য কথার ঝুড়ি নিয়ে/ তবেই না বাড়ী ফিরবো/ লক্ষ্মী মা, রাগ ক’রো না,/ মাত্রতো আর কটা দিন”। কিন্তু এই প্রতীক্ষা খুব নিশ্চিন্তির থাকে না, কারণ ‘হাওয়ায় মৃত্যুর গন্ধ’, ‘জননীর পুত্র নিরুদ্দিষ্ট’। তবুও জীবনের প্রতি ভালোবাসাই জয়ী হয়, ‘গান গায় বিজয়ের গান’ – “যারা ভালবাসে/ তারা যুদ্ধে যায়/ সকলে ফিরে আসে না/ এবং যারা মায়ের কাছে ফিরে আসে/ তাদের ঝুলিতে বর্ণমালার নূপুর,/ ঢেকিতে কিশোরী পা/ ডুরে শাড়ি ঘাসের ফড়িং।/ তখন জোনাকির মত বৃষ্টি নামে/ ধানের ক্ষেতে শামুক ওঠে/ প্রবীণ বয়াতী একতারায় গান বাঁধে/ সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান/ কবিতা/ রক্ত জবার মত প্রতিরোধের উচ্চারণ/ কবিতা।”


আট

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহের কাব্যিক আঙ্গিক ও শব্দ ব্যবহারে স্বতন্ত্রতা রয়েছে। তাঁর কাব্য রচনার মূল প্রেরণা ভাষা আন্দোলন। পঞ্চাশের দশকে তিনি প্রধানত ছড়া লিখতেন। এই সময়ে তিনি বেশ কিছু বিদেশী কবিতা অনুবাদ করেন। বেশ কয়েক বছর তিনি ছড়া লেখার মধ্যে দিকে অতিবাহিত করার পরে কবিতার অঙ্গনে অনুপ্রবেশ করেন। কাব্যের আঙ্গিক গঠন এবং শব্দ যোজনার বৈশিষ্ট্য কৌশলে তাঁর কবিতাকে আলাদা করে চেনা যায়। তিনি লোকজ ঐতিহ্য ব্যবহার করে ছড়ার আঙ্গিকে কবিতা লিখেছিলেন। শব্দকে সুন্দর ও সাবলীলভাবে সাজিয়ে তিনি নিজস্ব রীতি তৈরি করতে সক্ষম হন। প্রকৃতির রূপ ও রঙের বিচিত্রিত ছবিগুলি তাঁর কবিতাকে মাধুর্য মণ্ডিত করেছে। ‘বিদেশী কবিতা থেকে’ (সাতনরী হার)সিরিয়ায় জন্মগ্রহণকারী আরবীয় দারশনিক-কবি আবুল আলা আল মারীর দশটি, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে অভিসিনা বা ইব্‌নে সিনা নামে পরিচিত কবির একটি, ব্রিটিশ কবি শেক্সপীয়ারের একটি, ফরাসি কবি ভিয়োঁর একটি, ব্রিটিশ কবি এ. য়ি. হাউসম্যানের দুটি কবিতা তরজমা করেছেন। ইব্‌নে সিনার কবিতাটি তীব্র শ্লেষাত্মক – “কর্ণ দৈর্ঘ্য নিরূপিত জ্ঞান/ গর্দভ প্রথা সাত্ত্বিক/ লম্বকর্ণ শানিয়া কণ্ঠ/ কহে জ্ঞান আধ্যাত্মিক।/ যেহেতু কর্ণ পরিমিত তব/ অতএব তুমি নাস্তিক/ ফতোয়া দিলেন পুচ্ছ নাড়িয়া/ গর্দভ কুল-কার্তিক।” কবিতাটির তরজমায় দেশী অনুষঙ্গে অন্য মাত্রা পেয়েছে। আবার ভিয়োঁর তরজমায় সৌন্দর্যগর্বী পারীর মেজাজও সুন্দরভাবে ফুটেছে – “ভেনিসের মেয়ে মধুর-ভাষিণী জানি/ রোমের রমণী রমণীয় নাকি আরো/ স্বর্গ সাক্ষী তবুয়ো বলবো আমি/ কেন মিছেমিছে ফ্লোরেন্স ঘুরে মরো,/ রক্ত অধর যদি তুমি খোঁজ করো/ পারীর বাইরে যেয়ো নাকো কক্ষনো।”সাতনরী হার কাব্যগ্রন্থে বাংলার লোকায়ত ‘কুঁচবরণ কন্যা তোমার/ মেঘবরণ চুল’-এর নারীর পাশাপাশি স্থান করে নেয় ভিনিস সুন্দরী, বাংলা আর প্যারিস মিশে যায় একই প্রবহমাণ সৌন্দর্যে, স্বদেশ থেকে কবিদৃষ্টি প্রসারিত হয় বিশ্বে। স্মরণযোগ্য যে মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই কবি এই সম্প্রসারণশীলতায় বিশ্বাসী ছিলেন।

‘তোমাকে গুপ্তচর খুঁজছে’ (সহিষ্ণু প্রতীক্ষা) দক্ষিণ আফ্রিকার কবিতায় চারদিকের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে হয় রাজসাক্ষী, নয় অপরাধী এই দুইয়ের মধ্যে থাকতে হবে। তবুও “কোথাও কোন নিরাপত্তা নেই/ হয় ধরা পড়বে অথবা মরে যাবে।” ‘আমার উত্তর-পুরুষকে’ ব্রেখটের কবিতা অবলম্বনে রচিত। কবিতায় আমি ‘দুঃসময়ের অধিবাসী’। আমি যে কাজই করুক না কেন তা তাকে ‘কোনক্রমে বাঁচার অধিকার দিতে পারে না’। ‘ওরা’ যদিও আমাকে বলে ‘খাও-দাও আনন্দ করো’। কিন্তু তা কীভাবে? কারণ প্রতিটি গ্রাস, পান, বেঁচে থাকা অন্যকে বঞ্চিত করে। আর ‘জ্ঞানী’ হওয়ার পুঁথিগত উপায় হল – দ্বন্দ্ব এবং বিরোধ থেকে নিজেকে আগলানো, হিংসা এবং বিদ্বেষ থেকে বিরতি, অহিংসা এবং প্রবৃত্তি এবং অভিলাষকে সযত্নে সুপ্ত রাখা। খুব বিশৃঙ্খলা, চারদিকে ক্ষুধার পরিবেশে ‘আমি’ মানুষের কাছে যান, তখন ‘বিদ্রোহের কাল’, ‘সকলেই বিদ্রোহী’। অস্থির কালে ‘আমি’ ভাবতেন তিনি আছেন বলেই ‘শাসকেরা সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়’ আর গন্তব্যে কীভাবে পৌঁছাবেন? কিন্তু এভাবেই দিনরাত কেটে যায়। ‘আমরা’র নিমজ্জনের পরে ‘তোমরা’ উঠে আসবে। ‘তোমরা’ ‘আমরা’র ব্যর্থতা আর দুর্বলতার সমালোচনা করবে, কিন্তু আমারার ‘বিষণ্ণ দুঃসময়’ পথ পেরিয়েই ‘তোমরা’র পরিত্রাণের পথ নির্মিত হয়েছে। যদি সুসময় আসে, তখন ‘আমরা’র দীর্ঘ সংগ্রামের কথা যেন ‘তোমরা’ স্মরণ করে, সেই ‘দাক্ষিণ্যে’র কথাই বলা হয়েছে।

এই প্রসঙ্গে আরো দুটি উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘পিঁপড়ে’ (সহিষ্ণু প্রতীক্ষা) ও ‘ভালবাসার পথ’ (সহিষ্ণু প্রতীক্ষা)। ফরাসি কবিতা অবলম্বনে ‘পিঁপড়ে’ কবিতাটি হেজেমনি বা আধিপত্যকে নিয়ে লেখা সুচারু তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ কবিতা। ঘাসের মধ্যে পিঁপড়ের ‘লাশ’। ‘আমি’ পিঁপড়ে মেরেছি, কারণ পৃথিবীতে মানুষের আধিপত্য। ঘাসের মধ্যে ‘হামা’ দিয়ে বেড়ানো পিঁপড়ে পোকা-মাকড়দের কোনো স্থান এখানে নেই। প্রকৃতি যদি ভুল করে থাকে, তা শোধরানোর ‘দায়িত্ব’ মানুষের। কেমন সেই দায়িত্ব? তা বোঝাতে কবি ক্ষমতা ও আধিপত্যের সূত্রটাকে ধরিয়ে দিয়েছেন – “অবশ্য পিঁপড়ে যদি দীর্ঘদেহ হতো/ হাজারগুণ চওড়া হতো/ এবং তার হাতে যদি বন্দুক থাকতো/ আমি তাকে সম্মান দেখাতাম।” খলিল জিব্‌রানের কবিতা পাঠ করে কবি ওবায়দুল্লাহ লিখলেন কবিতা – ‘ভালবাসার পথ’। এই কবিতার মধ্যে ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ কবিতার ভাবাবেগ লক্ষ করা যায়। কবিতাটি সূচিত হয়েছে কথোপকথনের বয়ানের মধ্যে দিয়ে নাটকীয়ভাবে –“আমরা তাঁকে ভালবাসার কথা জিজ্ঞাসা করলাম।/ তিনি বললেন ভালবাসার পথ ঋজু এবং বন্ধুর/ তোমরা তাঁকে অনুসরণ কর। ভালবাসার তূণে অনেক বাণ আছে,/ তোমরা তার কাছে নিজেদেরকে সমর্পিত কর।” সমগ্র কবিতাটি ‘তাঁর’ (ঈশ্বর?) সঙ্গে ‘আমরা’র বোঝাপড়ার। তাঁর নির্দেশটাই এখানে প্রধান। ভালবাসার গভীরতা বোঝাতে খ্রিস্টিয় অনুষঙ্গ ব্যবহৃত হয়েছে – “ভালবাসা তোমাদের মুকুট পরাবে এবং ক্রুশকাঠে বিদ্ধ করবে।” ভালবাসাকে কাছে পেলে কী কথা বলা উচিত নয় তা কবি জানিয়ে দিয়েছেন। যেমন ‘আমার হৃদয়ে ঈশ্বর’ না বলে বলতে হবে ‘ঈশ্বরের হৃদয়ে আমি’। নদী যেমন তার ঠিকানা সন্ধানী, তেমনি ‘ভালোবাসার পথ ভালোবাসা নিজেই ঠিক করে নেয়’। তাই ভালবাসা আপনাতে আপনি পূর্ণ – “ভালবাসা ভালবাসাতেই পূর্ণ।/ সে নিজেকে ছাড়া আর কিছু দ্যায় না।/ নিজের থেকে ছাড়া আর কিছু গ্রহণ করে না।/ পূর্ণতা ছাড়া ভালবাসার কোনো আসক্তি নেই।” কবিতার শেষে কবির নির্দেশ – “ভালবাসার পথ ঋজু এবং বন্ধুর/ তোমরা তাঁকে অনুসরণ কর।”

‘ভালোবাসার গান’ (খাঁচার ভিতর অচিন পাখি) ১ সংখ্যক কবিতাটি অক্টাভিয়ো পাজ্‌ অবলম্বনে লেখা ও ২ সংখ্যক কবিতাটি যোহান উলফগ্যাঙ ফন গ্যেটের কবিতার তরজমা। ১ সংখ্যক কবিতায় ভালোবাসার যুগলের ‘দেহ মুখোমুখি’ প্যাশান প্রকাশিত। কবি দুই দেহের মুখোমুখিতে ‘দুই ঢেউ উথাল-পাথাল’, ‘আকীর্ণ যুগল প্রস্তর’, ‘ভূগর্ভে উভয় শিকড়’, ‘বিদ্যুৎ সুতীক্ষ্ণ ছুরি’ এবং ‘দুরন্ত উল্কাপতন’-এরচিত্রাঙ্কন করেছেন। সবক্ষেত্রেই প্রেক্ষাপটে রয়েছে রাত্রির নিভৃতি, ভালোবাসবার, কাছে টানবার আয়োজন। তাই প্রতিবারেই রাত্রির ব্যঞ্জনা ফিরে ফিরে এসেছে ভালোবাসবার ব্যাপ্তি নিয়ে – ‘রাত্রি কি আদিগন্ত/ সাগরের অবাক প্রসার’, ‘রাত্রি কি মরুভূমি/ নীলিমায় ধূসর বিস্তার’, রাত্রি কি মুকুলিত/ বৃক্ষের অরণ্যবিহার’, ‘রাত্রি কি শরাহত/ স্ফুলিঙ্গ স্পর্শকাতর’, ‘রাত্রি কি মহাশূন্য/ নক্ষত্রবিহীন আকাশ’। গ্যেটের তরজমায় কবি ওবায়দুল্লাহ ভালোবাসার অনুভূতিকে দেশ কাল পাত্রের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে মুক্ত করেছেন – “তোমার চোখে কালো মেঘের ছায়া/ তোমার চোখে নয়নতারা জ্বলে/ তোমার চোখের একটু ইশারাতে/ রম্য প্রাসাদ নগর ভেঙে পড়ে/ আমার হৃদয় খড়কুটো আর মাটি/ জীর্ণ দেয়াল একপলকে ধ্বসে/ তোমার চোখে তড়িৎ খেলা করে/ নগর পোড়ে প্রাসাদ ভেঙে পড়ে।।”

কবি ওবায়দুল্লাহের নিরীক্ষামূলক একটি কবিতার দৃষ্টান্ত হল ‘উদ্ধৃত পংক্তিমালা’ (খাঁচার ভিতর অচিন পাখি)। এটি কবির মৌলিক রচনা নয়। কবি আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদ্‌রী, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরীর কবিতা থেকে পংক্তিমালা নিয়ে একটি কবিতা বিষয়ক কবিতা সৃষ্টি করেছেন। কবিতাটি সম্পূর্ণ উদ্ধারযোগ্য – “কবিতা উধাও নদীর মুগ্ধ বালক/ কখনো কোমর বাঁকানো/ বেদেনী তন্বীর মত সবুজ,/ মাঝে মাঝে নিমের ডালে হলুদ পাখি/ পাখির বাসা হরিণ শিশুর ঘুম,/ অথবা আগুন বিদ্যুৎ বৃষ্টি ঝড়/ সভ্যতার কাছ থেকে ধার করা/ সোনালি ছুরি –/ ছুরির ওপরে প্রজাপতির ইশারা/ একজোড়া ম্লান চোখ,/ সব মিলিয়ে ভিক্ষা এবং জননী।”


নয়

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহের কবিতার স্ফুরণ বাহান্নের ভাষা আন্দোলনে সূচিত হলেও জীবনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তার কবিতার সুস্পষ্ট বিকাশ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীনতাত্তর কালে তিনি আত্মমগ্নতায় স্থিত হন। বাংলা কবিতার প্রচলিত ধারায় তাঁর কাব্যের শরীর নির্মিত হলেও ভাবসম্পদে তিনি আন্তর্জাতিক মননের অধিকারী। মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি তাঁর অমলিন ভালবাসা, দেশের ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সমষ্টিগত প্রাণ প্রবাহকে তিনি তাঁর কাব্যশরীরে ধারণ করে মাতৃস্নেহচ্ছায়ায় বারবার কবির ফিরে আসবার অনুরক্তি তাঁকে বাংলাদেশের কাব্যধারায় কিংবদন্তীপ্রতিম কালপুরুষ করে তুলেছে।

0 comments: