0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in












(৬)


স্নানের পর নতুন কাপড় পড়িয়ে মেয়েগুলোকে শৃঙ্গারবেশের জন‍্য আর একজন মধ‍্যবয়সিনীর কাছে নিয়ে যাওয়া হল। এই মহিলাটি পৃথুলা হলেও মুখশ্রীটি সুন্দর। তার সীমন্তরেখায় মেটে সিঁদূরের প্রলেপ আছে বলে ওকে সধবা বলে বোঝা যাচ্ছে। একটা কাঠের কাজ করা সিন্দুকের ভিতর থেকে কিছু জরীর চেলী আর একজোড়া ঘুঙুড় বার করে সবার হাতে দেবার আগে মহিলাটি ওদের সবার কপালে একটি করে লাল চন্দনের টিপ পড়িয়ে দিল। ঠিক সেইসময় কাঠের খড়মের খটখট শব্দ করে একজন প্রৌঢ় পুরোহিত ঘরের ম‍ধ‍্যে ঢুকলেন। তাঁকে দেখেই ওই মহিলা তার সঙ্গে বাকীরাও নড়েচড়ে উঠল। ইনি হলেন আচার্য স্বয়ম্ভুদেব, এই মন্দিরের প্রধান। বোঝা গেল সকলেই এঁর অনুগত। প্রৌঢ়টি ঘরে এসেই এতক্ষণের রহস‍্যটিকে সবার সামনে পরিষ্কার করে দিলেন। আসলে ওদের এখানে নিয়ে আসার কারণ হল সুপ্রাচীন ব্রহ্মেশ্বর শিবের মন্দিরে নতুন একদল দেবদাসী নিযুক্ত করা। এই মেয়েদের অনেককেই তাদের পরিবার থেকে মন্দিরে দান করা হয়েছে বলে তাদের সবাই ' দত্তা' বলে সম্বোধন করছিল। ওর মত আর যাদের জোর করে তুলে আনা হয়েছে তাদেরকে সবাই 'হৃতা' বলে পরিচয় দিচ্ছিল। এখন থেকে আগামী ফাল্গুনমাস অবধি ওদের সবাইকে নৃত‍্যগীতাদি চৌষট্টিকলা রপ্ত করানো হবে। তারপর মহাশিবরাত্রির দিনে ওদের সঙ্গে মহালিঙ্গম্ ব্রহ্মেশ্বরের বিবাহের পর ওদেরকে আজীবন মন্দিরে উৎসর্গ করা হবে। আর আজ এই কার্তিকপূর্ণিমার মহাক্ষণ থেকেই ওদের 'মহারী' হবার প্রক্রিয়া শুরু।

এরপর মন্দিরের চাতালের ঈশানকোণে রাখা গজপতি অনঙ্গভীমদেবের মেঘেশ্বর শিলালেখের সামনে সবাইকে জড়ো করে আচার্য স্বয়ম্ভুদেব স্বস্তিবচন পাঠ করলেন।এই প্রাচীন শিব মন্দিরটিও অনঙ্গভীমদেবের আমলের।শিলালেখটিতে পালি ভাষায় মন্দিরের রুদ্রগণিকাদের নিয়োগের সব নিয়ম খোদাই করে লেখা আছে। প্রায় সাতশো বছর ধরে এই প্রথাটি প্রচলিত। আচার্য স্বয়ম্ভুদেব বললেন তুর্কী সুলতানদের সেনারা প্রায়ঃসই এসে এখানকার হিন্দুদেবস্থানগুলিকে অবাধে লুঠ করে ধনসম্পদ অপহরণের সঙ্গে সঙ্গে অসংখ‍্য দেবদাসীদেরকেও বলাৎকার করছে। দুঃখের বিষয় এই যে দেশজুড়ে তাদের এই আক্রমণ সামাল দেবার মত শক্তিশালী একজনও হিন্দুরাজা নেই বললেই চলে। তাই এই গোপনীয়তা। ও ভাবল ওঁকে একবার প্রশ্ন করে যে ওকে হঠাৎ এ ভাবে উঠিয়ে আনার কি কারণ! কিন্তু পুরো পরিবেশটা এতটাই থমথমে হয়ে আছে, যে কথাটা ইচ্ছে থাকলেও ওঠানো গেল না। আচার্য স্বয়ম্ভুদেব এরপর একটি হলুদ সুতো সকলের হাতে এক এক করে নিজেই বেঁধে দিলেন। সুতোগুলির সাথে আবার একটা তামার চাকতি বাঁধা। তারপর সকলের দিকে অপাঙ্গে একবার দেখে নিয়ে সেই ম‍ধ‍্যবয়সিনীটিকে যাকে সবাই এতক্ষণ ' বড়া মঞ্চাম্মা' বলে সম্বোধন করছিল তার কানে কানে কি সব ফিসফিস করে নির্দেশ দিয়ে ঝড়ের মতন চলে গেলেন।

******

শিলিগুড়ির মহানন্দা পাড়ার একটি সংকীর্ণ গলির ভিতরে একটা দু কামরার বাড়ি। আজ সকালে সমুদ্রকে নিয়ে সেখানে নিয়ে এসেছে কমরেড প্রভাকর। কি কারণে আসা সে ব‍্যাপারে একটা রহস‍্যের আড়াল সে সমুদ্রের সামনে ইচ্ছে করেই রেখেছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে কমরেড পবিত্র বলে একজনের সাথে দেখা হল ওদের। পবিত্র হেসে বলল - ' যাও!যাও! ভেতরে যাও! কফি খাওয়া শেষ হয়েছে এইমাত্র। আজ বেশ ভালোই আছেন !'

সমুদ‍্র কথাটার মাথামুন্ডু কিচ্ছু বুঝতে পারলনা। ঘরের মধ‍্যে ঢুকে দেখল একটা ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে লুঙ্গী আর হাতাওলা গেঞ্জি আর তার ওপর নস‍্যিরঙা একটা আলোয়ান গায়ে একজন শীর্ণদেহী মানুষ বসে আছে। মাথার চুলগুলো উস্কোখুস্কো, শরীর জুড়ে একটা অবসাদ আর ভাঙনের ছাপ। কিন্তু চোখদুটি ঈষ‍ৎ লালচে হলেও কিন্তু তা মারাত্মক রকমের বুদ্ধিদীপ্ত ও উজ্জ্বল। প্রভাকর লোকটির কাছে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। প্রভাকরকে দেখে লোকটিও খুশী হওয়ার অভিব‍্যক্তি প্রকাশ করল যেন। এবার সমুদ্রকে চমকে দিয়ে প্রভাকর বলল

'এ ছেলেটি কলকাতা থেকে কদিন হল এসেছে। এর নাম সমুদ্র। আর সমুদ্র ইনিই হলেন আমাদের বিপ্লবী নেতা সি. এম!'

*****

সি.এম' মানে চা-রু-ম-জু-ম-দা-র! ইনিই! সমুদ্রের মুখে আর কথা যোগায় না। হতভম্ব হয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থেকে সে পা দিয়ে মেঝে খুঁটতে থাকে। চারুবাবু সদ‍্য জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এখন পূর্ণ বিশ্রামের মধ‍্যে আছেন। কার্ডিয়াক অ‍্যাজমার প্রকোপে শরীরটা থেকেই থেকেই কাজের ব‍্যাঘাত ঘটাচ্ছে। কালু ডাক্তারের পেথিড্রিন ইঞ্জেকশন ছাড়া একটা দিনও কাটছে না। তাই এইসময় নিজে বইটই পড়া আর ছেলেদের সাথে হাল্কা ডিবেট করে মাথাটা পরিষ্কার রাখছেন। সব জেলার কমরেডদের এক এক করে ডেকে একটু আধটু কথাবার্তা বলে সবার মোটিভেশন লেভেলটা বজায় রাখতে চাইছেন। চারুবাবু সমুদ্রের দিকে হাল্কা হেসে বললেন - ' নর্থবেঙ্গলে এই প্রথম নিশ্চয়ই? কেমন বোধ করছেন? ' সমুদ্রকে

'আপনি' বলে সম্বোধন করায় সে আরও হতচকিত হয়ে যায়। অস্ফূট স্বরে সমুদ্র বলে -

" ভা-ভালোই! প্রভাকরদা আর সুশীল দা'দের সাথে ঘুরছি আর সবকটা স্টাডিসার্কেল গুলোতেই এখন নিয়মিত যাচ্ছি....!"

গ্রেপ্তার হয়ে চারুবাবু জলপাইগুড়ির সেন্ট্রাল জেলে থাকতেই চীন আর রাশিয়ার কমিউনিজম্ সংক্রান্ত মতপার্থক‍্যের বিষয়গুলি নিয়ে খুঁটিয়ে ভাবনাচিন্তা করেছেন। নিকিতা ক্রুশ্চেভ বরং তাঁর মতে চীনের পন্থাটিই সঠিক। বাংলায় এসব কারণে বামপন্থী পার্টীও ভেঙে এখন দু তিন টুকরো হওয়ার পথে। শোধনবাদী আর সংসদীয় গণতন্ত্র আসলে সুবিধাবাদীদের ঢাল হয়ে উঠছে। অথচ সমান্তরাল ভাবে বিপ্লবী গণঅভ‍্যূত্থান ছাড়া কখনোই শ্রেণীসাম‍্য অর্জন করা যাবে না। এইসব জিনিস নিয়ে খোলাখুলি আলোচনার জন‍্য 'দেশব্রতী' বলে একটি পত্রিকার রূপায়ণের ভাবনাও তাঁর মাথায় ঘুরছে। এমনকি এখন দলের নামটিও বদল হয়ে এখন সি পি আই (এম) রাখতে ইচ্ছুক তিনি।

চারুবাবু উপস্থিত সমবেত কমরেডদের উদ্দেশ‍্যে বক্তব‍্য রেখে বললেন - "আমাদের কিন্তু কৃষিবিপ্লবকেই মডেল করে এখন এগোতে হবে। যত শ্রমিক, মজুর আর মধ‍্যবিত্ত শ্রেণীকে আমাদের চিন্তাধারায় প্রভাবিত করতে পারব ততোই তারা ঘটনার বিশ্লেষণ করতে শিখে সার্থক বিপ্লবকর্মী হয়ে উঠবে!" সমুদ‍্র জানে সেই তেভাগা আন্দোলনের সময় থেকেই সরকারী উৎপীড়ন বিপ্লবের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বহারাদের একজোট করে রাজনৈতিক ক্ষমতাদখল না করতে পারলে আর কিসের বিপ্লব। চারুবাবু তো এটাই বোঝাতে চাইছেন। একটা সশস্ত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রকেই দ্রুত প্রস্তুত করতে হবে। নকশালবাড়ি আর তেলেঙ্গানায় যার বজ্রনির্ঘোষ ইতিমধ‍্যেই ধ্বনিত হচ্ছে।

*****

ক'দিন ধরেই রাতের বেলা ঘুম ভেঙে যাচ্ছে সাগরিকার। তখন কি সব অদ্ভূত সিনেমার দ‍ৃশ‍্যের মত কয়েকটা ঘটনা ওর চোখের সামনে ঘটতে থাকে। একটা প্রাচীন মন্দিরে ঠিক ওর মত দেখতে একটা মেয়েকে প্রায়ই দেখে। সঙ্গে আরও জনা দশেক মেয়েও আছে। একটা বিশাল হলঘরের ভেতর একজন সম্ভবত বৃহন্নলা যাকে সবাই 'গুড়িয়াম্মা' বলে ডাকতে শুনেছে ওদেরকে নাচের তালিম দিচ্ছে। তাছাড়া একজন অতিবৃদ্ধ মারাঠী পণ্ডিত তার নাম 'সচদেব জী' একঘন্টা করে ওদের কখনো কালিদাসের কুমারসম্ভব আবার কখনো বাৎসায়নের কামসূত্র শুনিয়ে ব‍্যখ‍্যা করেন। সেইসব শ্লোকগুলোর অধিকাংশই বেশ আদিরসাত্মক। খানিক্ষণ শুনতে শুনতে যেন সারা শরীর গরম হয়ে ওঠে।

এই অবান্তর দৃশ‍‍্যগুলোর সাথে সাগরিকার যে কিসের যোগ তা অবশ‍্য ওর জানা নেই। তবে স্বপ্নে দেখা ওর মত দেখতে মেয়েটির হরিণ চোখে একটা বিষণ্ণতা আছে। সেই বিপন্ন অসহায়তাটা সাগরিকাকেও ক্রমশ আচ্ছন্ন করে তুলছে আজকাল। একটা অব‍্যক্ত যোগাযোগ আছে যেন ওর সাথে ওই মেয়েটির। সাগরিকা ঠিক করেছে এবার থেকে মেয়েটির নাম ও দেবে 'মদনমঞ্জরী'!

0 comments: